ঈদ সংখ্যার গল্প: মনকান্দার শোল । স্বকৃত নোমান
কার্তিকে টান ধরে খাল-বিলের জলে। ছুটে চলে নদীর ডাকে। জলের সঙ্গে ছুটে যায় মাছেরাও। কিছু মাছ থেকে যায় খাল-বিল-পুকুরের মায়ায়। এই মস্ত শোলটা বুঝি মনকান্দা ডেবার মায়ায় পড়ে গিয়েছিল। শব্দটা আসলে ডোবা। শিলপরানির মানুষ শোলকে যেমন হইল বলে, তেমনি ডোবাকে ডেবা। মনকান্দা আসলে ডোবা নয়, বিল। গ্রামের মানুষের ভাষা পাঁক-কাদায় পিছলে যায়। ডোবা পিছলে হয়ে গেছে ডেবা।
প্লাস্টিকের একটি বড় বালতিতে শোলটা নিয়ে সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। পলিথিনে বালতির মুখটা বাঁধা। মাঝখানে তিনটি ছিদ্র, শোলটা যাতে শ্বাস নিতে পারে। কতক্ষণ পরপরই লাফঝাঁপ দিচ্ছে, ছিদ্র দিয়ে জল ছলকে উঠছে, ছটা পড়ছে আমার প্যান্টে, জুতায়। পড়ুক। শোলটা জ্যান্ত ঢাকায় নিয়ে যেতে চাই। অনুপ কখনো জ্যান্ত শোল দেখেনি। খুব খুশি হবে সে। শোল-বোয়াল বিনুর খুব পছন্দ। আমিও শেষ কবে দেশি শোল খেয়েছি, ভুলে গেছি। ঢাকায় তো সব চাষের মাছ। দেশি মাছ বলে যা বিক্রি হয়, তা আসলে ঘেরের। কৃষি মার্কেট বা টাউন হলে দেশি মাছ ওঠে কদাচিৎ। কিন্তু দাম এতই চড়া, সাধ্যে কুলোয় না কেনা।
বাড়ি থেকে ফেনী শহরে পৌঁছাতে এক ঘণ্টা লাগল। মহিপাল চৌরাস্তায় এসে নাশতা করে নিল তাপস। আমিও খেয়ে নিলাম চা-সিগারেট। তারপর আবার যাত্রা। কাঁচপুর-শনির আখড়ায় জ্যাম না থাকলে আশা করি এগারোটা নাগাদ ঢাকায় পৌঁছাতে পারব। আজ শুক্রবার। জ্যাম থাকার কথা নয়।
শোলটা অনেকক্ষণ লাফাচ্ছিল না। মরে গেল না তো! শোলের প্রাণ বড় শক্ত, সহজে মরার কথা নয়। লাফাতে লাফাতে হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। গুণবতী বাজার পার হতেই লাইট অন করে বালতির পলিথিনটা সরিয়ে দেখি মরেনি, চুপচাপ ভেসে আছে। চোখে আলো পড়তেই লেজে নাড়ান দিল। পলিথিনটা বাঁধতে যাব, অমনি এমন জোরে লাফ মারল, উঠে বসল ডানের সিটে। গাড়ি সাইড করে থামাল তাপস। ঘাড় ধরে শোলটাকে আবার বালতিতে রাখল। ন্যাকড়া দিয়ে সিটটা মুছল। গাড়িতে মাছের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বলে স্প্রে করল। তার চোখেমুখে খানিক বিরক্তির ছাপ। বলেছিল বালতিটা গাড়ির পেছনের বক্সে রাখতে। আমি রাখিনি। বদ্ধ পরিবেশে যদি মারা যায়!
শোলটির পেটে ডোরা দাগ। যেন খুদে অজগর। মাথাটাও অনেকটা সাপের মতো। যেন ফণা তুলে লেজের ওপর দাঁড়িয়ে যেতে পারবে। শোল কি সাপের বংশধর? পূর্বজন্মে শোল হয়তো সাপ ছিল। ঘুরে বেড়াত বনে-জঙ্গলে। হাজার বছরের বিবর্তনে সাপ হয়ে গেছে শোল। জলপ্রাণ থেকে বিবর্তনের পথ ধরে মানুষ যেমন। পুরাকালে মানুষ যেমন সত্তর হাত লম্বা ছিল, শোলও বুঝি তেমন ছিল। খাটো হতে হতে এই আকার নিয়েছে এখন।
কোথায় ছিল শোলটার আদি নিবাস? হয়তো মুহুরি নদী কিংবা কহুয়া গাঙ। বর্ষার ঢলে বুঝি ভেসে এসেছিল মনকান্দার ডেবায়। ফিরে যাওয়ার পথ পায়নি। কিংবা পথ পেয়েও ডেবার মায়ায় যায়নি। কিংবা তার জন্ম মনকান্দার ডেবাতেই। সে জন্মেছে এ বছর কিংবা গত বছর। জন্মেই দেখেছে মনকান্দা ডেবার রূপ। আয়নার মতো জল আর শাপলা-শালুক-হেলেঞ্চা ঝোপের অপরূপ জগৎ। হয়তো তার একটা নাম ছিল। মানুষের মতো মাছেদেরও কি নাম হয়? হয়তো হয়। হয়তো তার নাম জলা, খলা, ভলা কিংবা মন্ডা, পন্ডা, ষন্ডা। শরীরের যে সাইজ, নাম যা-ই হোক, হয়তো সবাই তাকে ষন্ডা বলেই ডাকত। তার ভয়ে বুঝি তটস্থ থাকত মনকান্দা ডেবার মাছেরা। দুর্দমনীয় শক্তির জন্য সে বুঝি পেয়েছিল বীর-পালোয়ান খেতাব। হয়তো তার একজন প্রেমিকা ছিল। ঘোর বর্ষায় কিংবা মায়াবী পূর্ণিমায় প্রেমিকাকে নিয়ে সে অভিসারে যেত। চলে যেত মনকান্দার দক্ষিণে, যেখানে জ্যোৎস্না আর জল কোমর ধরে নাচন করে।
আশি কি নব্বই কিলোমিটার বেগে চলছে গাড়ি। একটানা শোঁ-শোঁ ছাড়া কানে আসছে না আর কোনো শব্দ। প্লেয়ারে মৃদুস্বরে বাজছে, ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে…।’ আমার নাকে ভাসছে রান্না শোলের ঘ্রাণ। তেলে-ঝোলে বিনু কাল মাছটা রাঁধবে। মাছের খন্ডগুলো ঝোলের ওপর সোনার টুকরার মতো ভেসে থাকবে। একটু ফোলা ফোলা। মাছের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াবে গোটা বাসায়; ঢুকে পড়বে পাশের বাসাতেও। আহা, কত দিন পর দেশি শোল খাব!
এসির বাতাসে একটু ঠান্ডা লাগছিল। দুই হাত বুকে মুড়ে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলাম। ধীরে তন্দ্রা নামল চোখে। তন্দ্রার ঘোরে দেখি আকাশে গাঢ় মেঘ। চরাচরে বৃষ্টি নামবে ঘোর। হঠাৎ মেঘের আড়ে দেখতে পাই মস্ত এক শোল। মেঘের সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে। যেন নিচ থেকে দেখা ছোট্ট প্লেন। একবার মেঘের আড়ে ঢুকে পড়ছে, আবার ভেসে উঠছে। আমি চিনতে পারি তাকে। ঠিক বালতির শোলটাই। আমি হায় হায় করে উঠি। তাকে ধরতে আমিও উড়াল দিই। উড়তে উড়তে পৌঁছে যাই তার কাছে। যেই না দু-হাতে চেপে ধরলাম, অমনি বেরিয়ে গেল হাত ফসকে। আর তখনই কেটে গেল তন্দ্রা। গলাটা শুকিয়ে গেছে। বোতল থেকে জল খেলাম। বালতিতে শোলটা ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিলাম। ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে ভেসে আছে। লাইটের আলো পেয়ে লেজে নাড়ান দিল। পলিথিনটা লাগিয়ে দিলাম ঝটপট। সুতলি দিয়ে বেঁধে নিলাম শক্ত করে। আবার যদি লাফ মেরে সিটে উঠে বসে!
মিয়াবাজারে এসে লাগল জ্যাম। আধা ঘণ্টা ধরে বসে আছি, ছাড়ার কোনো লক্ষণ নেই। সামনে কোথাও হয়তো দুর্ঘটনা ঘটেছে। বাস কিংবা ট্রাক উল্টে গেছে। হয়তো এ জ্যাম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত ঠেকেছে। কখন ছাড়বে ঠিক নেই। দশটা বেজে গেছে। মনে হচ্ছে না শিগগিরই ছাড়বে।
খিদা পেয়েছে, তাপস?
না স্যার।
চাইলে খেয়ে নিতে পারো।
না স্যার, একবারে বাসায় গিয়ে খাব।
যে জ্যাম লেগেছে, মনে তো হচ্ছে না একটার আগে পৌঁছাতে পারব। এদিকের জ্যাম বেশিক্ষণ থাকে না, ছেড়ে দেবে। আশা করি সাড়ে বারোটার মধ্যে ঢাকায় ঢুকতে পারব। জ্যাম ছাড়তে ছাড়তে পৌনে এগারোটা। একটার আগে ঢাকায় ঢোকা অসম্ভব। তা ছাড়া সামনে যে জ্যাম পড়বে না, তার তো ঠিক নেই। দেখা যাক। সিটপকেট থেকে বইটি নিলাম। লর্ড মেকলের নির্বাচিত রচনা। অর্ধেক পড়া শেষ। মেকলের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইংল্যান্ডপ্রীতি আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু পরিবেশিত তথ্য-উপাত্তে তাকে নিরপেক্ষ বলেই মনে হচ্ছে। ‘লর্ড ক্লাইভ’ প্রবন্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার চরিত্রের যে বর্ণনা দিয়েছেন, মনে হয়নি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। ‘মেকিয়াভেলি’ প্রবন্ধটা পড়া শুরু করেছিলাম, কিন্তু গাড়ির ঝাঁকুনিতে চোখ স্থির রাখতে পারছিলাম না। ইদানীং গাড়িতে পড়ে স্বস্তি পাই না। আগে খুব পড়তাম। কত বড় বড় বই যে গাড়িতে বসে পড়েছি! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অনেক কিছু বদলে যায়।
বারোটা নাগাদ গাড়ি পৌঁছে গেল দাউদকান্দি ব্রিজে। আমার দৃষ্টি বাইরে। নদীর বুকে নৌকা আর ট্রলারের লাইটগুলো জ্বলছে, নিভছে। মনে পড়ে গেল শৈশবস্মৃতি। আমাদের গ্রামের দক্ষিণে জিয়লার বিলে রাতভর জ্বলত এমন বাতি। রাতভর মাছ মারত মাছুয়ারা। ব্রিজের মাঝামাঝি আসতেই শোলটা বালতিতে মারল ঢুঁশ।
কী?
জলের গন্ধ পাচ্ছি।
তোমার ঘ্রাণশক্তি তো দেখছি প্রখর!
জলেই তো আমার বাস, জলের ঘ্রাণ বুঝব না?
এটা গোমতী নদী।
আহা নদী! আমার কোনো এক পূর্বপুরুষ নদীবাসী ছিল। এক বন্যায় পথ ভুলে ঢুকে পড়েছিল জিয়লার বিলে। গোটা বিল তখন জলে থইথই। সেই যে ঢুকল, আর ফিরল না নদীতে। এ-পুকুর ও-পুকুর, এ-খাল ও-খালে কাটে তার জীবন। শুনেছি আমার বাপ-মায়ের জন্মও জিয়লার বিলে। একবার জেলেদের তাড়া খেয়ে ঢুকে পড়ে মনকান্দার ডেবায়। শাপলা-শালুকের মায়ায় পড়ে আর যায়নি।
তোমার কি নদীতে যেতে ইচ্ছে করছে?
খুউব! সেখানে আমার জ্ঞাতিরা আছে। তারা আমাকে দেখেশুনে রাখবে। আর কখনো মানুষের হাতে আটকা পড়তে দেবে না। দাও না ছেড়ে।
হা হা। ছাড়ার জন্য তোমাকে কিনেছি? জানো দাম কত তোমার? পাঁচ শ, পাক্কা পাঁচ শ টাকা। অবশ্য স্বস্তাই বলতে হবে। ঢাকায় হলে দুই হাজারের কমে পেতাম না।
শোলটা আবার ঢুঁশ মারল। আমার উন্মনা ভাবটা কেটে গেল। হাই স্পিডে চলছে গাড়ি। একটু ভয় লাগছে। তাপস খুব দক্ষ ড্রাইভার। তার ওপর ভরসা করি। দু’ বছরে গাড়িতে কখনো একটা টোকাও লাগায়নি। তবু বললাম, একটু আস্তে তাপস। সে স্পিড কমিয়ে দিল। কোথাও না থেমেই পার হয়ে গেল মেঘনা ব্রিজ।
তাপস যে আশঙ্কা করেছিল তাই ঘটল। মোগরাপাড়া চৌরাস্তা পার হতেই আবার জ্যাম। কাঁচপুর ব্রিজে নাকি কাজ চলছে, এক পাশ বন্ধ; সেই জ্যাম ঠেকেছে এই পর্যন্ত। রাতে ট্রাক চলাচল শুরু হয় বলে কাঁচপুরে প্রায়ই জ্যাম লাগে। তার ওপর চলছে ব্রিজের কাজ। কখন যে ছাড়বে! শোলটা কয়েকবার লাফ দিল। শেষ লাফে অল্পের জন্য পলিথিনটা ছিঁড়েনি। সামনে তো শীতলক্ষ্যা নদী। আবার বুঝি সে জলের গন্ধ পাচ্ছে। জীবন বুঝি তাকে বড় টানছে। হয়তো মনকান্দার স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। কিংবা তার প্রেমিকার কথা। কিংবা বাবা মা বন্ধুবান্ধবের কথা। কাল রাতের ঠিক এই সময়টায় সে কতই না হাসিখুশি ছিল। মনকান্দায় তখনো হাঁটুজল। দুটি মেশিন চলছিল দুই মাথায়। শোলটা কি মেশিনের শব্দ পেয়েছিল? হয়তো পেয়েছিল। মাছেদের তো কান আছে। মেশিনের টানে জল যে কমে যাচ্ছিল ক্রমে, সে টের পেয়েছিল। কিন্তু ভাবেনি দুটি মেশিন যে রাতভর টানতে টানতে মনকান্দার সমস্ত জল নিঃশেষ করে দেবে। সকালে শুরু হলো মাছ ধরার উৎসব। শোলটা হয়তো বাঁচার জন্য ডেবার এ-মাথা ও-মাথায় ছোটাছুটি করছিল। ছুটতে ছুটতে বুঝি উঠে পড়েছিল থিকথিকে কাদায়।
আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জেগে উঠলাম হর্নের শব্দে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। পেছন থেকে একটা ট্রাক হর্ন বাজাচ্ছে অবিরাম। একটা বেজে গেছে। বিরক্তি লাগছে খুব। রাস্তার এ কী হাল! এই মন্থর যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে কোনো দেশ কি উন্নতি করতে পারে? কীভাবে যে চলছে দেশটা!
ধানমন্ডি পৌঁছতে পৌঁছতে দুইটা। গোটা পাড়া নীরব। কুকুরটা ডেকে উঠল। বিনু তখনো জেগে। সিনেমা দেখছিল টিভিতে। কলবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল। গাড়ির শব্দ পেয়ে বুঝি দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। অনুপ ঘুমাচ্ছে। মাছটা দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিনুর চেহারা। ফোনে তার সঙ্গে কথা হয়েছে, কিন্তু একবারও বলিনি শোলটির কথা। তাকে আসলে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। মাংসের চেয়ে আমার মতো সেও মাছ পছন্দ করে। এমন মজা করে রাঁধে, বিশেষ করে ইলিশ-বোয়াল, দু-তিন দিন জিব থেকে পড়ে না স্বাদ। বালতিটা বাথরুমে নিয়ে জলটা পাল্টে নিল সে। নতুন জল ভরে বালতির মুখে একটা ডালা রেখে শিলচাপা দিল। নতুন জল আর ভরা বালতি পেয়ে শোলটা বুঝি খুশি। সুস্থির হয়ে গেল। লাফঝাঁপ দিচ্ছে না আর।
শরীর এতই ক্লান্ত, দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে হানা দিল শোলটি। শোল থেকে রূপ নিয়েছে বিশাল গজারে। গায়ে ছোপ ছোপ ডোরা দাগ। কোনো এক নদীর জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। কোন নদী? মেঘনা, না গোমতী? নাকি শীতলক্ষ্যা? ঠিক চিনতে পারছি না। মাছটা নদীর জলে ভাসছে, এক ডুবে চলে যাচ্ছে পাতালে, আবার ভেসে উঠছে, ছিরিৎ করে লাফ মেরে উঠে পড়ছে জলের ওপরে, আবার তলিয়ে যাচ্ছে। তীরে দাঁড়িয়ে আমি তাকে ডাকছি, আয় আয় আয়…। সে শুনছে না আমার ডাক। ছুটে বেড়াচ্ছে মহা আনন্দে।
বালতিতে শোলটার অবিরাম লাফঝাঁপে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বাথরুমে গিয়ে ডালাটা সরিয়ে শোলটা দেখি। আমাকে দেখেই মাথাটা বাড়িয়ে দিল। মুখটা হাঁ করল। খিদা পেয়েছি বুঝি। র্যাকের বৈয়াম থেকে দুটি বিস্কুট নিয়ে বালতিতে ফেললাম। না, ফিরেও তাকাল না সে। ডালায় শিলচাপা দিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। আবার তলিয়ে গেলাম ঘুমে। স্বপ্নে এবার হাজির হলাম নিজেই। সিমেন্টের মস্ত এক গামলায় আমি আটকা। গামলার ওপর টিনের ভারী ছাদ। একটুখানি ফাঁকে কোনোরকমে শ্বাস নিচ্ছি। বাইরে মানুষের আনাগোনা, হাঁকডাক। আমি চিৎকার করে বলছি, আমাকে ছেড়ে দাও ভাই। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও। কেউ শুনতে পাচ্ছে না আমার আকুতি। কিংবা শুনতে পেয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে না।
শনিবার অফিস বন্ধ। ঘুম থেকে একটু দেরি করেই উঠলাম। সোয়া দশটায়। নাশতা করে নিচে নামলাম। রাস্তার মোড়ে ভ্যানে সবজি বিক্রি হয়। ধনেপাতা নিলাম দশ টাকার। ধনেপাতা ছাড়া শোল মজা হয় না। বাসায় ফিরতেই দেখি বিনু জল ফেলে বালতিটা খালি করছে, শোলটা পড়ে আছে বাথরুমের কোনায়। বিনু এক্ষুনি কাটবে তাকে। মাথাটা চেপে ধরে আমি শোলটা হাতে নিলাম। সারা রাত বালতি ভেঙে পালাতে চাওয়া শোলটা একটুও নড়ছে না। ক্লান্ত বুঝি। কিংবা লাফ মারার ফন্দি আঁটছে। মওকা বুঝে যেকোনো মুহূর্তে লাফ দেবে। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। যেন সে-ও আমার দিকে তাকিয়ে। বড় করুণ দৃষ্টি। যেন কিছু বলতে চাইছে আমাকে। যেন বলতে চাইছে, আমাকে মুক্তি দাও। জল আমাকে বড় টানছে, আমাকে মুক্তি দাও।
বারান্দায় ফুলের টবে পানি দিতে গেল বিনু। বালতিতে মাছটা রেখে হাত ধুয়ে বেডরুমে গিয়ে টিভি অন করলাম। সহসা মনে পড়ে গেল রাতে দেখা স্বপ্নের কথা। কোনো এক নদীর জলে শোলটা সাঁতরে বেড়াচ্ছে। ভাসছে, এক ডুবে চলে যাচ্ছে পাতালে, আবার ভেসে উঠছে, ছিরিৎ করে লাফ মেরে উঠে পড়ছে জলের ওপরে, আবার তলিয়ে যাচ্ছে। আমি আটকা পড়েছি গামলায়। কোনোরকমে শ্বাস নিচ্ছি। বেরোনোর জন্য চিৎকার করছি। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল শোলটির করুণ দুটি চোখ। যেন সে কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে বলছে, আমাকে মুক্তি দাও। আর কটা দিন বাঁচতে দাও।
আমি ডুবে গেলাম ঘোরে। ঘোরের মধ্যে চ্যানেল পাল্টাই। আশিটি চ্যানেল টিভিতে। পাল্টাতে থাকি। দুই থেকে আশি পর্যন্ত যাই। আশি থেকে আবার দুইয়ে। দুই থেকে আবার আশিতে। হঠাৎ বাথরুমে জলের শব্দে চমকে উঠলাম। কল ছেড়েছে বিনু। কেটে গেল ঘোর। আমি আবার রিমোর্ট চাপতে লাগলাম। চাপতে চাপতে হঠাৎ উঠে পড়ি। কিচেনে এসে দেখি বটি নিয়ে শোলটা কাটতে বসেছে বিনু। যেই না কাটতে যাবে, অমনি খপ করে ধরে ফেললাম তার হাত। বিনুর চোখেমুখে জিজ্ঞাসা। প্রশ্ন করার আগেই বললাম, মাছটা বালতিতে রেখে দাও। এখুনি বের হবো। মাছটা ছেড়ে আসব তুরাগ নদে।
কথাসাহিত্যিক, প্রতিশ্রুতিশীল ঔপন্যাসিক। জন্ম ১৯৮০ সালের ৮ নভেম্বর, ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়ায় । জ্ঞান অন্বেষণ ও শিল্পসৃষ্টিকে জীবনের প্রধান কাজ মনে করেন। স্বভাবে অন্তর্মুখী, আবেগপ্রবণ, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক । রাজনীটী উপন্যাসের জন্য এইচএসবিসি-কালি ও কলম কথাসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার উপন্যাস বেগানা, হীরকডানা ও কালকেউটের সুখ পাঠকনন্দিত। বর্তমানে তিনি সাপ্তাহিক সংবাদ ম্যাগাজিন এই সময়-এর সহযোগী সম্পাদক হিসেবে ঢাকায় কর্মরত। স্ত্রী নাসরিন আক্তার নাজমা ও মেয়ে নিশাত আনজুম সাকিকে নিয়ে তার ব্যক্তিগত জীবন।