Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,eid 2021 bangla golpo zakir talukder

ঈদ সংখ্যার গল্প: নাটকের মানুষ । জাকির তালুকদার

Reading Time: 5 minutes

টাটকা বিয়ে করা বউকে নাটক দেখাতে এনেছিল মনোয়ার। বোরখা পরা বউ। আমরা কেউ তাতে কিছু মনে করিনি। কারণ বোরখা ততদিনে ফ্যাশন হয়ে উঠছে। তো বউকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েই মনোয়ার ছুটল গ্রীনরুমের দিকে মেকাপ নিতে। ‘বেনজামিন মলোয়েজ ’ নাটকের একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করছে মনোয়ার। নিজেদের নাটকের দল, নিজে অভিনয় করছে, তবু টিকেট কিনেই বউকে নাটক দেখাচ্ছে মনোয়ার। আমরা সবাই সেটাই করি। তবু হাজার হলেও একেবারেই নতুন বউ। তার জন্য একটা সম্মানী সৌজন্য টিকেট দেওয়াই যেত। কিন্তু নাটকে নিবেদিত মনোয়ার সেটা করতে রাজি নয়। তবে সেই নাটকই যে নাটকঅন্তপ্রাণ মনোয়ারের অভিনীত শেষ নাটক হবে, তা আমাদের ধারণাতেও ছিল না।

পরদিন থেকে মনোয়ার আর ক্লাবে আসে না। আমরা ভাবলাম নতুন বউ নিয়ে মগ্ন আছে, থাকুক। কিন্তু ছয় মাসেও যখন তার ছায়া দেখা গেল না, আমাদের টনক তো নড়বেই। ধরে আনো ওকে। কিন্তু মনোয়ার আসে না। নুরুজ্জামান একদিন বলে মনোয়ার দাড়ি রেখেছে। দাড়ি রেখেছে রাখুক। তার সাথে ক্লাবে না আসার সম্পর্ক কী?
দুইদিন পরে লিটন খবর আনে যে মনোয়ার আর প্যান্ট-সার্ট পরে না। সবসময় পায়জামা-পাঞ্জাবি। মাথায় টুপিও থাকে অনেক সময়। আমরা এ-ওর মুখের দিকে তাকাই। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যায় আলতাফের মুখে। মানোয়ার তাকে বলেছে যে, বউ তাকে পূর্ণ হেদায়েত করেছে। নাটক করা একটা প্রচন্ড বেশরিয়তি কাজ। সে আর কখনোই ক্লাবে আসবে না। সে ইসলামি জীবনযাপন করবে। আল্লাহর কাছে বার বার শুকরিয়া জানিয়েছে মনোয়ার, কারণ তিনি তাকে এমন একজন স্ত্রীরত্ন উপহার দিয়েছেন।

আমরা ইতিমধ্যে মনোয়ারকে বাদ দিয়েই নতুন নাটকের রিহার্সেল শুরু করে দিয়েছিলাম। এবার তাকে চিরকালের জন্য হারানোর কষ্টটা মেনে নিলাম। তারপরে আর মনোয়ারের সঙ্গে আমাদের তেমন কথাবার্তা হয়নি। তবে দেখা হয়। দেখা তো হবেই। এতটুকুন শহর আমাদের। নিজেকে ঘরবন্দি না রাখলে মানুষের সাথে মানুষের দেখা হয়েই যায়। মনোয়ারকে দেখতাম সাইকেল চালিয়ে অফিসে যেতে, দেখতাম বাজার থেকে হ্যান্ডেলে মাছ-তরকারির ব্যাগ ঝুলিয়ে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে যেতে। সামনাসামনি পড়লে আগের মতোই সালাম দিত মনোয়ার। আমরাও ওয়ালেকুম বলে একটু হাসি বিনিময় করতাম। দিন তো দিন, বছরও এত তাড়াতাড়ি যায় যে আমরা টেরই পাই না। আর টের পেলে হকচকিয়ে যেতে হয়।

বেশ কয়েকটা বছর যে পার হয়ে গেছে তা বোঝা গেল যখন দেখলাম মনোয়ার তার পুত্রসন্তানকে সাইকেলের সামনের রডে বসিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছে আর বাড়ি ফিরিয়ে আনছে। তারপরেও আরো অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। আর আমরা এই বছর হলো না, সামনের বছর থেকে লেখার কাজ, গানের অনুষ্ঠান, নাটক-পালা ঠিক-ঠাক মতো করব বলে নিজেকে সান্তনা দিয়ে দিয়ে বছর কাটিয়ে দিচ্ছি। তবে মনোয়ারকে নিয়ে আর কোনোদিন ভাবা হয়নি। নিজেদের মধ্যে গল্প-গাছাও না। সেই রকম একদিন আমাকে সাকু ভাইদের বাড়ির দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আলতাফ জিগ্যেস করে ভাই খবর শুনিছেন?
কীসের খবর?
মনোয়ারের।
একটু ধন্দ লাগে। কোন্ মনোয়ার?
ঐ যে আমারে সাথে নাটক করত! বিয়ের পরে মোল্লা বউয়ের নিষেধের কারণে নাটক করা ছেড়ে দিল।
হ্যাঁ হ্যাঁ মনোয়ার। তা কী হইছে মনোয়ারের? এখন কি আবার নাটক করতে চায়?
আলতাফ বলে আরে তা না। মনোয়ারের একটা প্যাথেটিক ঘটনা ঘটে গেছে।
কী?
ওর ছেলেটা এইবার জেএসসি পরীক্ষা দিছে।
জেএসসি মানে ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষা?
হ্যাঁ।
তো?
ঐ ছেলের পরীক্ষা যেদিন শেষ হইছে, সেইদিনই মনোয়ারের মওলানা-বউ তার ব্যাটার প্রাইভেট মাস্টারের সাথে চলে গেছে।
আমি বিষম খাওয়ার মতো করে বলি, চলে গেছে মানে!
চলে গেছে মানে, স্বামী-সন্তান ফালায়া প্রাইভেট মাস্টারের সাথে পালায়া যায়া বিয়া করিছে।
এহ্ হে! তাহলে তো বেচারা মনোয়ারের দিনকাল এখন খুব খারাপ যাচ্ছে!
আলতাফ আমার সহানুভূতিতে কানই দেয় না। বলে, শালা বউয়ের ভাড়–য়া। বউয়ের কথাত নাটক ছাড়ল, মোল্লা হলো। এখন দ্যাখ শালা মিয়্যামানুষ কী জিনিস!
এইভাবে মনোয়ার আবার অনেক বছর পরে আমাদের আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়ে।

 

০২.

ক্লাবে রিহার্সেলের পরে চা-মুড়ি খাওয়ার সময় সুকুমারদা হঠাৎ বলে ওঠে, আমাদের কিন্তু মনোয়ারের সাথে একটু কথা বলা দরকার।
কেন?
একটা সময় সে তো আমাদের সঙ্গে ছিল। অনেকগুলো নাটকে কাজ করেছে। ক্লাবের জন্য অনেক খেটেছে। এখন তার দুঃসময়ে আমাদের অন্তত সান্তনা দিতে একবার হলেও যাওয়া উচিত।
নান্টু বলে, কিন্তু আমাদের যাওয়াটাকে মনোয়ার যদি ভালোভাবে না নেয়? যদি ভাবে তাকে টিটকারি করার জন্য যাচ্ছি আমরা?
তা ভাববে কেন?
ভাবতেও তো পারে। শুনেছি সে নাকি পারতপক্ষে কারো সাথে দেখা করে না। বাইরে যায় না। কোনোমতে অফিস করে, বাজার-সদাই করে, বাড়িতে ফিরে নিজেই রেঁধে-বেড়ে ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে খায়। ছেলেটাও নাকি অনেকদিন ধরে স্কুলে যায়নি। স্কুলের অনেক ছাত্র তো বটেই, মাস্টাররা পর্যন্ত লুকিয়ে হাসে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে।
এই কথা শুনেই ঝট করে উঠে দাঁড়ায় ঝুমা অসহ্য! একটা নির্দোষ-নিষ্পাপ বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে এমন করবে কেন মানুষ? আমাদের এখনই যাওয়া উচিত মনোয়ার ভাইয়ের বাড়িতে। অন্তত বাচ্চাটাকে স্বাভাবিক করতেই হবে। ইস কী কষ্টটাই না পাচ্ছে বাচ্চাটা!

দরজা খুলতেই যেন চাইছিল না মনোয়ার। ঝুমার তখন ওসব কেয়ার করার অবস্থা নেই। পাল্লা ফাঁক হবার সাথে সাথে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। সাথে আমরাও।
কীভাবে কথা শুরু করা যায় তা ভাবছি। কিন্তু ঝুমার সেই পরোয়া নেই। মনোয়ারের ছেলেকে কাছে ডেকে বুকে টেনে নিয়ে একনাগাড়ে কথা বলে চলল, তোমার নাম কী বাবা? কোন ক্লাসে পড়ছ? আজ দুপুরে কী খেয়েছ? বড় হয়ে কী হতে চাও? স্কুলের পরে কি বাড়িতেই বসে থাকো? পাবলিক লাইব্রেরিতে যাও? বরেন্দ্র মিউজিয়াম দেখেছ? পুঠিয়ার টেরাকোটার মন্দির? মোমিনপুরের পাখিগ্রামে গেছিলে? চলো কালকেই যাব আমরা। ছেলেটা প্রথমে একটু সিঁটিয়ে ছিল। সিঁটিয়ে ছিল মনোয়ারও। কিন্তু আমরা সবাই এড়িয়ে গেলাম ওদের অস্বস্তির আর লজ্জার বিষয়টা। এড়িয়ে যেতে পারলাম একেবারে অনায়াসেই। এতটাই অনায়াসে যে আমরা তো আমরা, খোদ মনোয়ারও বোধহয় ভুলেই গেল যে ক্লাবের আড্ডা ছাড়াই তার কেটেছে মাঝের এতগুলো বছর। মনে হতে লাগল যে আমরা আমাদের নিয়মিত আড্ডার মধ্যেই আছি। মাঝের এতগুলো বছরের ছেদ আমাদের মধ্যে এতটুকু ফাঁকও তৈরি করতে পারেনি।
আর ঝুমা তো মনোয়ারের পুত্র তনুকে এতটাই জাদু করে ফেলল যে, তার আর আমাদের সাথে যোগ দেবার সুযোগই হচ্ছিল না। তনুকে নিয়ে সে চলে গেছে বারান্দায় পার্টিশন দিয়ে বানানো তার পড়ার ঘরে।
চা ছাড়া তো আর আড্ডা জমে না। দেখা গেল মনোয়ার নিজে ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে রান্নাশিল্প। চা তো বানালোই কয়েকবার। সেইসাথে বিভিন্ন রকম তেলেভাজাও করে ফেলল। গল্পগাছায় রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। তখন মনোয়ার প্রস্তাব করল যে খিঁচুড়ি রান্না করে সে সবাইকে রাতের খাবার খাওয়াতে চায়। কিন্তু ঝুমার পক্ষে তো আর বেশি রাত করা সম্ভব নয়। বাড়িতে ঝামেলা হতে পারে। কাজেই আজকের মতো খিঁচুড়ি স্থগিত।

পরদিন সকালে নান্টু দেখল টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে ঝুমা যাচ্ছে মনোয়ারের বাড়ির দিকে। তাকে দেখে একটু বেদনামিশ্রিত হাসি হেসে ঝুমা বলেছে, বাচ্চাটাকে, মানে তনুকে, রোজ সকালে ভাত আর আলুসেদ্ধ খাইয়ে স্কুলে পাঠায় মনোয়ার ভাই। ছেলেটার ভালো না লাগলেও মুখ বুঁজে খেয়ে নেয়। কথায় কথায় ঝুমা জেনে নিয়েছে যে তনুর খুব পছন্দ পরোটার সাথে কুচি করে ভাজা আলু আর সুজির হালুয়া। সে তাই বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেটাকে খাওয়ানোর জন্য। অন্তত একটা দিন বাচ্চাটা মনের মতো নাস্তা খাক!

আমরা ক্রমেই খেয়াল করি যে তনুর ভার প্রায় পুরোপুরি নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে ঝুমা। কোনো রকমে ক্লাবে এসে বিকালের রিহার্সেলটা করে। তারপরই সোজা দৌড় দেয় মনোয়ারের বাড়ির দিকে। আমরা ঝুমার মাতৃত্বের প্রকাশ দেখে মুগ্ধ হই। মেয়েদের মধ্যে একজন মমতাময়ী মা থাকেই। সে যে বয়সের মেয়েই হোক না কেন! সে বিবাহিতাই হোক আর অবিবাহিতাই হোক। আমরা তাত্তিকভাবে কথাটা জানতাম। কেউ বিশ্বাস করতাম। কেউ হয়তো করতাম না। কিন্তু ঝুমা আমাদের চোখের সামনে নিজেকে উদাহরণ বানিয়ে দেখিয়ে দিতে শুরু করেছে। বিশ্বাস না করে উপায় নেই। মাতৃত্বের সাথে যোগ হয়েছে তার সংবেদনশীল শিল্পী মন।
দিনে দিনে আমরা তো বটেই, আমাদের এই ছোট্ট মফস্বল শহরের অনেক মানুষই দেখতে পায় তনুর দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে ঝুমা। তনুর সাথে সাথে অনেকখানি মনোয়ারেরও। ওদের তিনজনকে বিভিন্ন জায়গায় যেতেও দেখা যায় একসাথে। কখনো আমাদের কেউ দেখতে পায়, কখনো অন্য কেউ দেখে এসে আমাদের বলে। একটু ইঙ্গিতপূর্ণ কথাও বলতে চায়। আমরা সেগুলোকে ছোটমনের মানুষের কথা বলে উড়িয়ে দিই।
তবে মাসখানেক পরেই আমরা জানতে পারি যে মনোয়ার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে ঝুমাকে। আর ঝুমা প্রধানত তনুর মায়ার টানে, আর কিছুটা মনোয়ারের প্রতি জন্মানো দুর্বলতায় সম্মত হয়েছে বিয়ের প্রস্তাবে।

 

০৩.

বেশি আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বিয়ে হয়ে যায়।
আমরা ওদের শুভকামনা জানিয়ে বিয়ের দাওয়াত খেয়ে আসি।
কিন্তু বিয়ের পর থেকে ঝুমা আর রিহার্সেলে আসে না। আমরা ভাবলাম, নতুন বিয়ের পর ওদেরকে তো নিজেদের মতো কিছুদিন সময় কাটাতে দিতেই হবে। ঝুমাকে বাদ দিয়েই আমরা নতুন নাটকের মহড়া শুরু করি। টানা একমাস রিহার্সেল করে নাটকও মঞ্চস্থ করে ফেলি। ঝুমা এবং মনোয়ার দুজনকেই জানানো হয়েছিল নাটকের কথা। কিন্তু পর পর তিনদিন নাটকের শো করা হলেও মনোয়ার কিংবা ঝুমা আসেনি নাটক দেখতে। আমরা মোবাইলে কথা বললাম। ওরা আমতা আমতা করে কিছু কথা বলল। নাটক দেখতে আসতে না পারার বিভিন্ন অজুহাত দেখাল।
তবে আসল খবর নিয়ে এল সেই আলতাফই।
মনোয়ার নাকি ঝুমাকে বুঝিয়েছে যে নাটক করা মেয়েদের সমাজে ভালো চোখে দেখা হয় না। বিয়ের আগে যা হবার হয়েছে। বিয়ের পরে আর ঝুমার নাটক করা চলবে না। শুধু তাই-ই নয়, ঝুমাকে এখন থেকে আদর্শ মুসলিম রমণীর মতো হিজাবও পরতে হবে।
এবং ঝুমা মেনে নিয়েছে মনোয়ারের নির্দেশ।

 

 

 

 

One thought on “ঈদ সংখ্যার গল্প: নাটকের মানুষ । জাকির তালুকদার

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>