আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিটনি:শব্দ কামানে তুমি একা বসে ভরছো বারুদ
নি:শব্দ কামানে তুমি একা কেন
মেগাস্থিনিসের হাসিও কি মেগাস্থিনিস?
শক্তিচালিত এই তামাশার মধ্যে বহু
—এঞ্জিনের শব্দ আর রোবটের কাশি শোনা যায়
নি:শব্দ কামানে তুমি এখনো কি ভরছো বারুদ?
আমার বাবার ছবি মুছে দিল রাতের জঙ্গল
আমার মায়ের মুখ এখনো বেড়াতে আসে
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ ঢেলেছে আগুন;
জ্যোতিরথে চোখ রেখে চেনা পথ শান্ত পায়ে হেঁটে
নিজেকে শুনিয়ে কোনো গূঢ়কথা, গোপন মর্মর
বীতশোক চলে গেছে। পশ্চিমের প্রত্যন্ত প্রদেশে।
আমার ‘সামান্য ক্ষতি’? বিপর্যয়! খসে পড়ে ফল!
বহুঘুম-রাত্রিব্যেপে অনৃত ঢেউয়েরা! তরী ডোবে!
পুরাতন বিষণ্নতা, গোপনে যে আঙুরলতায়
ফল রূপে পেকে ওঠে, সারারাত তস্করের ভয়ে,
শুষ্ক তৃণে ঢেকে তারে সযতনে দিয়েছে প্রহরা।
প্রত্যহের দুঃখ-দৈন্য-বেদনা ও ক্লেশে—হয়তো সে
বসন্ত-রুধির এনে চেয়েছিল কিছুটা মেশাতে;
যেন নীল প্রজাপতি এসে তার কাছে চায় মদ;
অধীর মক্ষিকা শুধু দ্রাক্ষা মেগে উড়ে উড়ে চলে।
সন্তর্পণে একা বসে পানপাত্রে দিল সে চুমুক;
লম্বা ঢোঁক গিলে নিয়ে স্তনলোভী শিশুর নিয়মে
আলগোছে মৃগনাভী ভরেছে উদকে স্বার্থপর!!
‘শিশির-চোঁয়ানো রাতে, মধ্যদিনে দহনের শেষে’
অন্যরা ঘুমিয়ে ছিলো? এ-সুযোগে হলো সে কর্পূর?
হেমন্তের মঞ্চ থেকে গরুড়ের ছড়ানো ডানায়
অতর্কিতে চড়ে বসে শরীর সারাতে গেছে দূরে।
কত দূরে? কাউকে বলে নি; শুধু উপশমহীন
অনন্ত গোধূলিপথ ছেয়ে আছে হলদে পাতায়!
এই তবে গূঢ়লেখ? বৃথা তব নর্তকী ও মদ?
বীতশোক, তুমি আছো! অনন্ত পশ্চিমে নাকি পুবে?
অসম্ভব ভুলে থাকা; লিথিজলও স্মৃতিসমুজ্জ্বল!
অফুরান দ্রাক্ষা থেকে অন্ধকার প্রশীর্ণ আঙুলে
নিজের ভিতরে, চুপে, শমদায়ী পেড়ে আনো ফল?
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ! জ্বলছে আগুন!
ফিরে এসো সেই পথে;—ঝরাপাতা-মুখর সরণি—
কিছুটা যবের মোহে, কিছু প্রেমে, শর্করার টানে।
উপশম হলো ব্যথা? পিঞ্জিরার ভেতরে পাখির?
দ্রুত তবে চলে এসো, পরিত্যক্ত আঙুরের বনে;
অনন্ত গোধূলিপথ ভরে দিয়ে পাতায়, মর্মরে।
নিজেকে সরিয়ে দূরে, আলগোছে,
গাছের গোপন কোনো ডালে রেখে আসি;
নানা রকমের হাওয়া, রোদবৃষ্টি হিম-কুয়াশায়
পেয়েছি কেমন ফল। বোঁটকা-ঘ্রাণ
মৃত্যু-অশ্রু-হাওয়ার নিস্বন থেকে
তৈরি হয় গান। বাজে পাতার মর্মর
নিজেকে ঘুমন্ত রেখে ছায়ারূপে বেরিয়েছি
নিচে গিরিখাত, নিচে পতনশীল হিমবাহের
ভেতর দিয়ে আধো-ভোরে নৌকা চলেছে একা।
বুঝিবা তারও গায়ে এসে লাগছে
আর এখানে, এই সূর্যহীন অচেনা প্রদেশে,
অপণা মাঁসের পানে ছুটে যাচ্ছে
তীর-ভল্ল, পাশুপত, সহস্র বৃশ্চিক। আর
চতুর্দিকে জমে উঠছে রক্ত-ফেনিল শুধু শিকার! শিকার!
রক্ত-মাংসপরিতৃপ্ত শকুন-চিতা-হায়েনাদের ঘুমের বুদ্বুদ নিয়ে
নবদশাপ্রাপ্ত এই পৃথিবীতে ফিরে আসি যদি,
এ-আমার লুপ্তদেহ ধূমায়িত পাতার শিহরে!
চেয়েছিলে তীব্র রতি। সিঁড়িঘরে হঠাৎ বিকেলে!
লাল লাল চোখে ঈর্ষা। জ্বলে ওঠে যেন দাবানল;
উটকো লোকের দল। কটমট্ কেন যে তাকায়!
তৃতীয় বিশ্বের হ্যাপা! আঁতিপাতি পেছনে কুকুর;
কেউ যদি দেখে ফ্যালে, পায় রতি-কুসুমের ঘ্রাণ?
নির্ঘাৎ ঝামেলা হবে। বিকেলের অপার্থিব আলো
সে-ও ঝানু গুপ্তচর। সঙ্গে নিয়ে বেয়াড়া বাতাস
আল্টপকা ঢুকে যাবে ঘরে। –তাই, আসঙ্গলিপ্সার
মৃত্যু হবে। নারীমাছগুলি ভয়ে ভুলবে সাঁতার
তার চে’ বরং চলো, ভাণ করি মোরা প্লেটোনিক
নিষ্কাম যক্ষের মতো লিবিডো পাহারা দিয়ে চলি;
দ্বীপান্তর? প্রেম-নাস্তি?– চারপাশে এতো যে শ্বাপদ!
এতো যে বন্দুক, চাকু, বল্লমের এতো আয়োজন!
অধর, স্তনের শোভা, লোল হাস্য, মদির ভ্রূকুটি
পুরুষের বগলের ঘ্রাণ, পেশি, চুমুর গোলাপ
রতি-মধুরতা ভুলে অপরের মর্জিমতো বাঁচো
অলক্ষ্যে ও অনাদরে স্তন-ডালিমের বোঁটা ঝরে যাবে;
ফ্যাকাশে ও নীল হবে। অরব মরুভূ শুধু ধু-ধু
মরীচিকাময় এক অতল গহ্বর মেলে র’বে
আমার উত্থান বৃথা! ব্যর্থরতিতোমারও করুণ
চোখের লেগুনে ক্রমে কাত হ’য়ে তরী ডুবে যাবে
এইভাবে দিন যাবে। মুখ ভরে জমে উঠবে ছাই;
ছেঁড়াখোড়া মন নিয়ে এইভাবে অবিরাম হেঁটে
তুমি-আমি একটু-একটু ঝুঁকে পড়বো হাঁ-মুখ কবরে
আমরা অতৃপ্ত আত্মা। আমাদের নীল দীর্ঘশ্বাস
কুকুরের বন্ধ চোখে সারারাত শিশির ঝরাবে
সে-রমণী, তাহাকে অল্পকাল চিনি। অশ্বেতর প্রাণীদিগের জন্য তাহার সে কী মায়া! ইহাদের জন্য প্রভাতে পুষ্পচয়নের পরিবর্তে শষ্প ও বিবিধ তৃণাহরণেই তাহার সকল মনোযোগ; হ্রেষার পরিবর্তে ইহাদের রহিয়াছে কেবল অলস প্রহরের গাঁড়ফাটানো রাসভনিনাদ।কাকস্য পরিবেদনার সহিত এই রাসভস্বর মিশাইয়া বারান্দায় বসিয়া বিবিধ ককটেল বানাই। তাহা পান করি। গলদেশ দিয়া নহে, কর্ণকুহরে ঢালিয়া।
রমণীকে দেখিয়া কাম জাগে। এ-বিষয়ে তাহার প্রভূত প্রশ্রয় আঁচ করি। তবে কাহারো তরফে কোনোরূপ বাক্য বিনিময় নাই।
ঈগলচঞ্চুর ন্যায় তাহার বক্র নাসাখানি তিলনিন্দিত। হাকালুকি হাওরের হাঁসিনীর গ্রীবার ন্যায় তাহার গ্রীবা। তদুপরি তাহার পাউটি লিপস। তাহাতে একখানি ডাঁশা জড়ুল।
আর তাহার বগলে ঘাম। বগল ক্ষৌরহীন দেখিয়া সঙ্গত পুলক জাগে।আমার বারান্দার গাঢ়লাল জবাটিকে দেখিবার অছিলায় তিনি ডাগর চক্ষু তুলিয়া তাকান। সেই চক্ষে অথির বিজুলি।
তিনি শ্যামাঙ্গিনী। তাহার কম্বুগ্রীবাটি আহ্লাদে ঈষৎ কাত। এক্ষণে জবাফুলটি আরো গরিমাময়, আরো লাল হইল। হইলে হউক! তাহাতে আমার কি!
তাহার হস্তধৃত তৃণাদি মাতৃহারা খচ্চরশিশুটি খাইবে, সদা-ভ্যাঁ-ভ্যাঁ-করা বকরিদল খাইবে; খাইতে খাইতে ইহারা গুটলিময় নাদা ত্যাগ করিয়া ক্রমশ উঠান ভরিয়া তুলিবে। তাহাতেও রমণীর স্নেহ ও প্রশ্রয়।
ইহাদিগের মধ্যে একটি প্রাণিই কেবল ব্যতিক্রম। খাবারে ইহার মনোযোগ নাই। আঁচ করিলাম প্রাণিটির ইচ্ছা মদীয় ইচ্ছার নিকটতর। এই কথা কাহাকেও কদাপি বলা যাইবে না। আপনাদিগকেও নহে। কেননা লোকে আমাকে ভালো লোক বলিয়া মান্য করে। কেহ কেহ ‘কত্তা কত্তা’ বলিয়া ষাষ্টাঙ্গ প্রণামে উদ্যত। মান্য লোকদিগের অঙ্গ হষরিত হওয়া বোধ করি অনুচিত। অন্তত অস্থানে। লোকে এমত ভাবে।
সংসারে লোকের ভাবাভাবিকে মূল্য দিয়া চলিতে হয়। আমাকে এবং— যিনি বুঝিয়াও না-বুঝিবার ভাণ করিয়া খোঁপা বাঁধিবার ছলে কুচযুগ আন্দোলিত করিয়া আড়চোখে আমাপানে চাহেন——তাহাকেও। ইহাই রীতি। এই অতি শিষ্ট অণ্ডহীন, যোনিহীন মনুষ্যজঙ্গলে এইমত বিধান। এমত বিধানে যদিও এক মুষ্ঠি ধান্য ফলিবে না।
পাঁঠাটির সেই বালাই নাই। ইহা স্বাধীন। কেননা ইহা ছাগাসুর, তদুপরি তরুণ। আর ইহার বিশেষ অঙ্গটির সে কী গরিমা। কী তেজ! জিভ বাহির করিয়া, মুখে তপ্ত ফেনা তুলিয়া, সে চর্মঘেরা লোমশ খাপ হইতে দেমোক্লিতাসের তরবারিসদৃশ অঙ্গটি বাহির করিল। আচমকা। আর তাহা পেন্ডুলামবৎ দুলিতে থাকিল। লাল। এবং জবারও অধিক। সূর্যেরও অধিক। ইহার রঙ কেবল আসামদেশের কামরুপে ফলিত নাগা মরিচের রঙের সহিত তুলনীয়।
আমরা উভয়েই, লজ্জাহেতু, অন্য দিকে মুখ ঘোরাই। চকিতে তাহার মুখের একপাশ দেখিলাম। মনে হইল তিনি ঈষৎ বিব্রত; তথাপি তাদৃশ আমোদিত। ফটকদরোজা দিয়া তিনি ঝটিতি ভেতরবাটীতে অন্তর্হিত। আর আমি ছাগাসুরের দিকে অসীম তিতিক্ষা লইয়া তাকাই।
পাঁঠাটির প্রতি আমার গোপন ঈর্ষা হইল। এমন সময় প্রতিবেশীর ট্রেসপাসার নচ্চার হুলোবিড়ালটি কোথা হইতে আসিয়া আমার দিকে ‘আইবল টু আইবল’ তাকাইয়া কহিল ‘ম্যাঁও’।
এখন সকাল খুব লাল। তবু হৃদয়ে গোধূলি। আমি সদ্য বানানো নৌকার খোলের ভেতর শুয়ে; নৌকার একা-
কারিগর। গাবের আঠার গন্ধে, তারপিনের গন্ধে ভরে আছে নাক । ছুতোরের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছিলাম এই
জেলেপাড়ায়। তারপর থেকেই তৈরি করে চলেছি নৌকা। উত্তল আর অবতল নৌকা। সমুদ্রের ছোবলে
জেলেপাড়ার মরদেরা সব একে একে ঢেউয়ের অতলে।
এখন নৌকার মতো কাত হয়ে আছে জেলেপাড়া। সদ্যবিধবাদের সারি সারি ঝুপড়িঘর বিষণ্নতায় ঠাসা।
এখানে ভোর আর বিকেলের একটাই নাম ——গোধূলি!
একা এক ঘেয়ো কুকুরের কান্নায় ভরে আছে আমার দুই কানযে ঝুপড়িতেই আমি ঢুকতে চেয়েছি, বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকাণ্ড এক মাকড়জালমাকড়েরা আমাকে না দিয়েছে একাকিত্ব ঘোচাতে, না দিয়েছেজেলেপাড়ার নম্র বিধবাদের বিষণ্নতার গাদ সরাতেপ্রতিবারই নিষেধের লাল তর্জনী।
এবার রাগী বেড়ালের মতো নিজের ভেতরের মাকড়জাল ছিঁড়ে ফেলতে চাইছি আমিফরসা হয়ে উঠছেআমার চোখ। বিধবাদের কামনাতুর দেহে জ্বলে উঠছে ফসফরাস;সমুদ্র ঝিলকে উঠছে মাছের পেটির মতো।ওই তো মরীচিকার ভেতরে পেখম তুলছে বিধবাদের ময়ূর।
আমার পা টলছে ধুতুরার নেশায়। একটি একক মুহূর্তকে আমি সকাল ও গোধূলি বানিয়ে ধরে আছি দু-হাতেরমুঠোতে। এ-খেলা আমি অসংখ্য একা-আমিকে দেখাই বারবার। একটা সরু দড়ির উপর দিয়ে একা-পিঁপড়েহয়ে হেঁটে চলেছি ধোঁয়ায় মোড়ানো কোনো আবছায়া বাড়ির দিকে।
আমার পাশাপাশি নতমুখ হেঁটে চলেছে২০ বছরের পেনিলোপিহীন নৈশাঘাতে বিবর্ণ এক একা-ইউলিসিস
ছিন্নবস্ত্র ভিখিরির বেশে। শূকরপালক আর ছাগপালকের অবজ্ঞার ভেতর দিয়ে—একবার সে আমার ছায়ার ভেতর ঢুকে পড়ছে। পরক্ষণে আমি তার ছায়ার ভেতরে।
লাল সকালের ভেতর দিয়ে আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি গোধূলি
সব বিষণ্ন লাল সকালই সব একা-মানুষের গোধূলি
ধুতুরার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে
সদ্যবিধবাদের স্পর্শ ও চুম্বন
ধূসরতার ভেতর রাংতার ঝিলিক।
হঠাৎই হেসে উঠছে, গান গেয়ে উঠছেএকা-একা মানুষেরা
তাদের তীব্র স্বমেহনের ভেতর ফেটে পড়ছে
মাকড়জাল সরিয়ে কামনাতুর বিধবারা আমাকে ডাকছে।
তারা ময়ূর ছেড়ে দিয়েছে বৃষ্টিতে ..
একা-মাছ লাফিয়ে উঠছে শূন্যে
একা-মাছ ঝিলকে উঠছে শূন্যে
একা-মাছ পার হচ্ছে মরীচিকা
একা-মাছ সওয়ার হচ্ছে ঢেউয়ের ওপর
ভুসুকু-জুয়েলু ঘরে একা বসে
ছুঁইনে গোলাপওদ্বিধায়, তরাসে
—চুমু ও অধর যোজনান্তর; –দূরে!
নিজ নাম লিখি এপিটাফে নিজে;
ভোলো না আমায়। রাখিও স্মরণে!
কথা বললে চুপিসারে ঘুমন্তের স্নায়ুর ভেতরে
সেই থেকে গলছে বরফ। সেই থেকে কতো
পার্বত্য ঝরনা এসে হিম-জলে ধুয়ে দিলো
অভিমানী পাথরের জ্বরতপ্ত মাথা
উঁচু থেকে নিচে পড়ে ভেঙেছে পাঁজর। তার
রক্তের প্রগাঢ় বুদ্বুদে এই কালো রাত্রি হয়ে উঠল লাল
দলছুট একা সেই বনমানুষের মাথার উপরে তুমি
মেলে ধরলে ছায়ার ক্যানোপি;
অগাধ ঘুমের জলে দিলে তাকে অপার্থিব স্নান
বললে তাকে: হে পাগল, পদতলে ক্ষত নিয়ে এভাবে ছোটো না
নররাক্ষসের বনে, সর্পঘেরা এ-ঘোর জঙ্গলে
নগ্ন হয়ে একা হয়ে এভাবে ছোটো না!
—ইশারায় এই কথা বলে তুমি মৃদু হেসে অন্তর্হিত হলে
বিষভল্ল মনোশৈলচূড়ে বহু হননের
উদ্যত কৃপাণ তুচ্ছ করে, সে জানে না,
অখিল শুশ্রূষা নিয়ে তুমি তার
শিয়রের পাশে এসে শান্ত বসেছিলে
তার ফাটা খসখসে ঠোঁটের নিকটে তুমি মায়া-পয়োধর
মেলে ধরেছিলে। দিয়েছিলে স্তনের আরতি
অমল ধবল গাঢ় ফোঁটায়-ফোঁটায় ;
রাতুলাঙ্গ-নিদালির স্পর্শ দিয়ে
সারারাত তুমি তাকে দিয়েছিলে স্বাদু,মৃদু মদ
রতিরূপবিশল্য মাদুলি বুলিয়ে
অপরূপ লীলা তুমি সম্ভব করেছো, ওগো, দেবী
বুকের হাপরে যার জমা আছে অতি অল্প শ্বাস;
সে আসলে অর্ধেক নিহত তার ললাটলিখনে
অভিশাপে শিলীভূত ছোটো তার পরাণকুঠুরি
অথবা সে বোঁটা থেকে খসেপড়া আধপচা ফল
পাখির চঞ্চুর ঘায়ে ঝোপের আড়ালে ভূপাতিত
পথে যেতে তুমি তাকে তুলার বলের মতো কুড়িয়ে নিয়েছ
তুমি তাকে কোল পেতে অক্লেশে দিয়েছ ঠাঁই জঘনপ্রসারে
তাতে তার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল তরল আগুনভরা বীজ
ছিটকাল লাবণ্য ও লাবণিক ক্ষার
ওম শান্তি!ওঙ্কার!ওম শান্তি!
ওওওওওম্ম্ম্ শান্তি ওওওওওম্ !
কুঁকড়ে ছিল পারমা ফ্রস্টে ভয়াবহ শীতে
বহুযোনি, তুমি তাকে দিয়েছ কার্পাস
তুমি তাকে করেছো উদ্ধার। তাকে ঘিরে
রন্ধ্রহীন রক্ষাব্যূহ করেছো রচনা
–অপরূপ লীলার ভেতরে তাকে করিয়েছ অপার্থিব স্নান;
নররাক্ষসের বনে বিষভল্ল তুচ্ছ করে
তার ওষ্ঠে তীব্রতম করেছ চুম্বন
তারপর তার হাতে তুমি তুলে দিয়েছ কুঠার
তুমি তাকে বিষহর মন্ত্র শিখিয়েছ
তুমি বর্ম ও আয়ুধ নিয়ে তার পাশে ছিলে
তুমি সৌগন্ধের নম্র পসারিণী
অপচ্ছায়ার প্রতি সদা অকরুণ তোমার ভ্রূকুটি;
বহুছিদ্র-স্তনের বোঁটার শীর্ষে সঞ্চিত রেখেছ তুমি শিশুতোষ মদ
লাবণ্যের ক্রীড়া ও উদ্ভাস। ক্ষতে ও জখমে উপশম
ভোর অব্দি ঘুমন্তকে অমিত আড়াল দিয়ে রক্ষা করো তুমি
অয়ি স্নায়ুশিখরে চিরসমাসীনা
তোমার হৃদয় যেনো অপত্যের অনবদ্য বীণা
পঙ্কজলে শুয়ে শুনি অমরার সে-সুরমূর্ছনা
রাত্রির কান্তারে তুমি অবিরত ছড়িয়ে চলেছ বসন্তের কুহু
মাতৃগাছেদের ছড়ানো পায়ের কাছে বসে
ঘাসের আড়াল থেকে, মাটির ফাটল থেকে
নানা সম্ভাবনা, নানা-বিকাশের বীজ ও পরাগ
সযতনে আপন গর্ভথলিতে তুমি কুড়িয়ে এনেছো
ওই তো সমুদ্রশিয়র থেকে ধীরে ধীরে চোখ মেলছে
তোমার প্রণয়ে তৃপ্ত তীব্র লাল সূর্য ও গোলাপ
জুয়েল মাজহারের জন্ম ১৯৬২ সালের ২০ জানুয়ারি। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানাধীন গড়াডোবা ইউনিয়নের সাখড়া গ্রামে। পিতা মুকদম আলী, মা বেগম নূরজাহান (সরু)। দুজনই প্রয়াত। বন্ধু শিরিন সুলতানা ও পুত্র অর্ক মাজহারের সঙ্গে থাকেন ঢাকায়। পেশা সাংবাদিকতা।
কৈশোরে নিরুদ্দেশযাত্রা। দীর্ঘ ভবঘুরে জীবন। যৌবনের একটা বড় অংশ কেটেছে বৃহত্তর সিলেটের হ্ওারে-পাহাড়ে। বিশেষত হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারে। ঘৃণা করেন বৈষম্য, জাতিবৈর, সকল প্রকারের অন্ধতা ও পৃথিবীকে খ-ক্ষুদ্র করে দেওয়া সীমান্ত নামের ‘খাটালের বেড়া’।
#
#
প্রকাশিত কবিতাবই:
—————————
১.
দর্জিঘরে একরাত (২০০৩ আগামী; ২০১৪ শুদ্ধস্বর)
২.
মেগাস্থিনিসের হাসি (২০০৯ বাঙলায়ন; ২০১৫ শুদ্ধস্বর )
৩.
দিওয়ানা জিকির (২০১৩; শুদ্ধস্বর)
৪.
নির্বাচিত কবিতা (২০১৯ ; বেহুলাবাঙলা)
৫. রাত্রি ও বাঘিনী (২০২০); কবিতাভবন (বাতিঘর, ঢাকা)
#
#
প্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থ:
——————————-
১.
কবিতার ট্রান্সট্রোমার টোমাস ট্রান্সট্রোমারের বাছাই করা কবিতার অনুবাদ সংকলন। প্রকাশক শুদ্ধস্বর; বাংলা একাডেমীর ফেব্রুয়ারি বইমেলা,২০১২। এটি নতুন রূপে প্রকাশ করেছে বেহুলাবাঙলা বাংলা একাডেমি বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
২.
দূরের হাওয়া ২০০ বিশ্বকবিতার অনুবাদগ্রন্থ। প্রকাশক চৈতন্য প্রকাশন। বাংলা একাডেমি ফেব্রুয়ারি বইমেলা, ২০১৬।
#
#
পুরস্কার ও সম্মাননা:
————————
১.
’জীবনানন্দ দাশ কবিতাপুরস্কার ২০১৯’
২.
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের (কলকাতার) ঐহিক সাহিত্যগোষ্ঠির ’ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা ২০২০’
৩.
’নির্বাচিত কবিতা’ বইয়ের জন্য পেয়েছেন ’বেহুলাবাঙলা বেস্টসেলার বই সম্মাননা ২০১৯’
Related