শোয়াইব জিবরান এর একগুচ্ছ কবিতা
যাত্রা, মহিষ পিঠে
ওঁ ‘শ্যামনৌকা’ নমো
মহিষ পিঠে চলেছি বহুকাল জল- জলাজঙ্গলা পেরিয়ে।
আমি কি রাখাল তবে ছিলাম বাথানের, নাকি দূর কোনো গাঁয়ে
বদ হাওয়া লেগে অসার দেহ। লোকে দিয়েছে তুলে
সাপে কাঁটা চাঁদ সওদাগর, মহিষডিঙায়।
মনে নেই কিছু। শুধু একটু একটু লোকালয় স্মৃতি, অস্পষ্ট মানুষের মুখ
হয়ত মায়ের, হয়ত প্রেমিকার।
চলেছি এই রাতে যেন জলাধারের ওপারে আছে স্বাস্থ্যসদন
আছে সবুজ গ্রাম, বৃক্ষশোভা, নগর কিনারে
কোনো ওঁ নিরাময়া।
কী অসুখ জানা নেই কারো-আমার কিংবা মহিষের
চলেছি বহুকাল যেন দূরত্বই আরোগ্য অথবা পথের ধারেই আছে
পথ্য সব বনৌষধি।
জলাজঙ্গলার পথে মহিষের খুরের জল আর কাদা ভাঙার শব্দ আর
আমার গোঙানি
অখনে এইখানে দূর হতে মৃদু মৃদু শোনা যায়।
ইচ্ছে, জন্মান্তরের
ক্ষুধার্ত মানুষ, ফের ফিরে আসব তোমার দরোজায়
দাঁড়িয়ে রবো ম্লানমুখে।
তুমি ছুঁড়ে দেবে এটোভাত, মাছের কাঁটা, শুকনো রুটি
খাবো না।
তাকিয়ে থাকবো তোমারই মুখের দিকে।
তুমি খুব বিরক্ত হবে। তোমার পড়ে আছে কত কাম
সংসারের। স্বামী তোমার জাগনা, ঐ ঘরে।
ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার বাচ্চারা
চাল ফেলছে, ডাল ফেলছে, বই ছিঁড়ছে
কত যে দিগদারি তোমার
আর আমিও দাঁড়িয়ে রয়েছি দরোজার সন্মুখে
ক্ষুধার্ত। আজিব, তবু কিচ্ছুটি খাচ্ছি না।
তুমি খুব বিরক্ত হবে
এ যে কী চায় আল্লাহ জানে-বলবে রেগে।
রাগবে তোমার স্বামীও
তাড়িয়ে দাও গদা মেরে- বলবে সে বিছানা থেকে।
তুমি তাড়াবে না। কত কাম তোমার সংসারে।
আর আমি দাঁড়িয়েই রবো দরোজায়
কেন যে আমি দাঁড়িয়ে আছি একবারও ভাববে না, চিনবে না সে বারও?
আমি যে গতজন্মেও এসেছিলাম
তোমাকে কিছু বলবো বলে।
ঠায় দাঁড়িয়েছি কতদিন তোমার পথে পথে।
তুমি বুঝোনি।
সে জন্মেও বুঝবে না? অমৃতা।
হরণ
আমাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছো দূরে তোমার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। যত যাচ্ছো তোমার দিকে
আমার গন্তব্য তত পিছে পড়ে যাচ্ছে।
চিবুকে বসে যাচ্ছে তোমার থাবার নখর
আর আকাশের লালিমায় ছড়িয়ে পড়ছে আমার গোঙানি, কেউ শুনছে না।
যে যার উড়ায় ব্যস্ত।
আকাশে ছড়িয়ে পড়া রক্তরং দেখে
কেউ একজন হাহাকার করবে
শুধু
এই আশায় আমি আমার মৃত্যুকে সয়ে চলেছি।
নদীর দুলুনি, গদ্যে
নদীকেই একমাত্র পথ ভেবেছিলেন তাঁরা, এই জলমগ্ন দেশে, প্রদোষে। চলেছেন জলের চালে হেলেদুলে, ছন্দসমেত। কিন্তু যারা জেগে ওঠা চরের বেপারি তারা তো হিসেবি, সম্ভাষণেও। পত্রে লিখেন, লিখনং কার্যঞ্চ এথা আমার কুশল জানিও নিরন্তরে তোমার কুশল বাঞ্ছা করি.. . তারপর পত্রাপত্রি গতায়ত হলে অঙ্কুরিত হতে থাকে প্রীতির বীজ- অশ্বখুরের সড়ক, আসাম থেকে বর্ধমানগামী। আর একদিন জেগে ওঠে সূতানুটি। তার নবীন গির্জার ঘণ্টির সাথে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো কলকল জেনেসিস..পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবস্থিতি করিতেছিলেন।
আমি তো সেই গসপেলের পাতা থেকে ছিঁটকে পড়া মুগ্ধ বালক। সেই সকল গদ্যের ধূলিউড়া, ভাঙ্গা ইটের আর পিচওঠা সড়ক দিয়ে রক্তধূলি পায়ে হেঁটে চলেছিলাম।।
সেই ক্লান্ত ঘোরলাগা দিনে, এক বিকেলে হঠাৎ পড়ি আপনার হৃৎ কলমের টানে, দূর সিদ্ধিশ্বরপুরে বসে, সংবাদের পাতায়। এতো যে বাহারী হতে পারে তার চাল, চলার ভঙ্গিমা, দীঘায়িত বাক্যে সামান্য একটা কমার গুণে, সেই বিস্ময়ের বিকেলে জানিয়াছিলাম। মনে হলো আপনি তো ফিরিয়ে দিলেন কেরির ক্যারিশমার, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, প্রমথ চৌধুরীর পথের পাকা গাঁথুনির সাথে আমার ভুলে যাওয়া নদীপথের জলজ দুলুনি, হে সৈয়দ শামসুল হক।
নিউ চন্ডিদাস
তুমি মাছ নও, আমি জানি।
তবুও অবুঝ আমি নিজেরে বুঝানোর ছলে
শত শত নদী আর ঝিলের দেশে
ছোট্ট পুকুরে ছিপ পেতে বসে আছি
পয়ত্রিশ বৎসর।
চÐিদাসও চলে গেছেন মুচকী হেসে
রজকিনীর পিছু পিছু, ঘাটের দিকে।
তুমি খুব বিজি আছো সাত সমূদ্রতের নদীর ওপারে
সুপার মার্কেট।
তবু প্রতিদিন আমি ভাবি নিশ্চয়ই ধরা দেবে
এই বড়শির ইতারে
কোনো খাদ্যলোভে নয়, স্নেহবশে
সেই আবেশে শীতল বাতাস মৃদু মৃদু বহে
এই পুকুরের তীরে।

জন্ম ৮ এপ্রিল, ১৯৭১; আযমত শাহ্ কুটির, মৌলবীবাজার। শিক্ষা : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চতর ডিগ্রি, প্রশিক্ষণ ও পাঠগ্রহণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সুকথাই থাম্মাথিরাত ওপেন ইউনিভার্সিটি, থাইল্যান্ড ও কুইন্স ইউনিভার্সিটি, কানাডা থেকে। পেশা : মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বর্তমানে কাজ করছেন জাতিসংঘ শিশু তহবিলের শিক্ষা পরামর্শক হিশেবেও। প্রকাশিত বই — কাঠ চেরাইয়ের শব্দ [বাংলা একাডেমি, ১৯৯৬; জেব্রাক্রসিং, ২০১৭] দুঃখ ছেপে দিচ্ছে প্রেস [মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৩] Birds and Dust from the East [Translated by Kamrul Hasan, Satantra, 2009] ডিঠানগুচ্ছ উঠান জুড়ে [শুদ্ধস্বর, ২০১০] ঘোর ও শূন্য জলধিপুরাণ [চৈতন্য, ২০১৭] গদ্য ও গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে— কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসের করণকৌশল [বাংলা একাডেমি,২০০৯] কথা কবিতা ও শিক্ষা [ধ্রুবপদ, ২০১০] কমলকুমার চরিতম্ [শুদ্ধস্বর, ২০১০] শিক্ষা পরিভাষা [জেব্রাক্রসিং, ২০১৬] ইত্যাদি। পুরস্কার ও সম্মাননা— মুক্তধারা একুশে সাহিত্য পুরস্কার আব্দুল মান্নান চৌধুরী স্মৃতি পদক সংহতি বিশেষ সম্মাননা ।