তালাশ তালুকদারের গুচ্ছ কবিতা
পরিস্থিতি
ব্যথার আঁশ গায়ে জড়িয়ে ওই নাম্নী লোক -মূলত সচকিত আনন্দ ছিঁড়ে
কাগজের মতো টুকরো হয়ে মোটা মোটা বাতাসের সাথে আবারো
উড়লো খানিক।
ঝড়ে বিধ্বস্ত হওয়া বাড়িঘর পঙ্গুদের মতো দেখাল। মাঝে মাঝে
আমাকেও এ রূপে দেখা যায়। যেনবা এ শরীর ভাঙা খাটের হাড়
কট্ কট্ করে তার ভয়াবহ বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে।
আর এ পথ দিয়েই প্রচন্ড রৌদ্রগুলি তার ঝিল্লি ছড়াতে ছড়াতে দেখে
ওই শরীরের শিরায় শিরায় রক্তের বদলে গ্লিসারিন আসা যাওয়া করে।
কিন্তু তোমাদের তো বলেছিলাম আমি আবার নতুন ভাবে ভালোবাসবো
টিউবওয়েলে নতুন বাকেট তুলে হরহর করে জল তুলে তোমার মুখে
যত ভালো নোংরা দাগ, ব্রণ সবকিছু ধুয়ে একেবারে জলের মতো ফর্সা করে
বালতিতে কিংবা ভরা গামলার চকচকে জলের ভেতর আবার মুখ
দেখবো তোমার।
নিঃসঙ্গ টিপ
বহুদিন হলো আলেয়ার সাথে মাথা ঢিপেঢিপি হলেও চোখে চোখ রাখা ছাড়া
কোনো কথাই মটরশুঁটির মতন মুখ পিছলে বের হয়নি।
কেননা আমার বাড়ি থেকে নদীর দূরত্ব যতদূর হয় ততোধিক দূর
আজ তোমার আর আমার মাঝে সাপের মত লেজ বিছিয়ে রয়েছেÑ
যার পায়ে পাড়া পড়লেই ফনা তুলে ফোঁস ফোঁস করে
চতুর্ষ্পাশে মুখ থেকে আগুন ছিটাতে থাকে। আরো রক্তবর্ণ হলে
মাথার উপর দিয়ে উঠে যেতে দেখি লোহার ট্রেনকে।
কেউ বলেছিল কি, কেউ বলেনি, শুধু মিতা বলেছিল
রোজ রোজ চুমু খেতে কেন আসো অগ্নিকে!
প্রেশার কুকারের চিৎকার
মহিষের দু’টি চোখে লোহার শিক ঢুকে দিয়ে রেখেছি
তাই চন্দ্র, সূর্য থাকার পরও এত এত অন্ধকার
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
২
জানি, ককটেলের ভেতর ক্রোধ থাকে-
ককটেলকে মাঝে মাঝে হোমিও ডাক্তারের দেয়া ছোট ছোট বড়ির মতো লাগে
রোগ নিরাময়ের জন্য প্রায়ই নিয়ে যায় এ পাড়ার ছোট খাটো তামাটে ছেলে
বোঁটা খুলে সূর্য ফেটে দিয়ে আসে।
গনগনে আঁধার
এত এত গোসলে শরীর ভেজালে-
তবু কখনোই পারলে না ভেতরের মানুষটাকে ভেজাতে।
দেখো পুকুরের জলগুলোকে বাতাস ঠেলে ঠেলে কূলে পৌঁছে দিচ্ছে
আর আমার শরীর থেকে মর্গের মতন গন্ধ উঠে এসে
তার উপস্থিত থাকার কথা জানিয়ে যাচ্ছে।
গ্রামের বাড়িতেও দেখি
স্ত্রী তার স্বামীর বুকের ভেতরের জায়গা বুঝে না পেয়ে
সেই ফজরের নামাযের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির মত
দুইজন দু’দলে বিভক্ত হয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে।
সবখানেই গনগনে আঁধার
পারলে শুকনো কাঠের তক্তাতেও ছোবল মারে!
ন্যাড়া কাঠের টেবিল
ওই তারার পরিবেশে টিলা হয়ে ঊর্ধ্ববাহু গাছ হয়ে জন্ম হয়নি আমার
হয়তো আমার চেয়ে বড় গাছের ফুলগুলি সাহেবপুরে ফুটেছিল-
সাহেবপুর কতদূর চাচিমা ?
প্রায়ই রাগত হয়ে মুখ ফুলে কুষ্ঠরোগীর মতো একা একা শারীরিক হয়ে থাকি
বুঝি-বা অভিশাপ সেই প্রতুষ্যের পর থেকে গুপ্তরোগ হয়ে তার স্বাতন্ত্র্যতা
ধরে রেখেছে আর ধনুষ্টংকার রোগীর মতো মাঝে মাঝে রুষা হাড়
ওই শিমুল গাছের শিকড়ের মতো নরম হয়ে এঁকেবেঁকে মাটিতে সেঁধে থাকে।
পাতিলে ভাত নেই কেঁচো রাঁধা আছে শুধু- এও বলেছিল কুচকুচে কালো
টাইপের লোকটা
বলতে বলতে পথ থেকে ছোট্ট ছোট্ট মানব বন্ধন উঠে এসেছিল চোখে।
চুপ হয়ে যাই
-বেলা হোক সকল সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে ফেলব, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসা
লোকেদের বিশ্বাস তোমার ওপর থেকে এভাবেই কাচের গ্লাসের মতো
ভেতরে ভেঙে দেব, বালির মতো ঝুরঝুরেও করে ফেলব খানিকটা-
একথা বলে রবারের মতো গলা ফুলে শার্টের কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে
এই এরিয়া দিয়ে রাস্কেলের মতো কেউবা শাসিয়ে গেল।
ও নিজেও বোঝে ‘ওর ভেতরে আনারস পাতার প্রকৃতি আগেকার মতো নেই আর’
শরীর হাজারো তাপে থাকে, একটি পাখি হাওয়া খেতে ডালের উপর ঘুরে বসে।
গন্ধবিবৃতি
সুন্দর আজ তার বুকের পশমগুলি জড়ো করে খড়কুটোর মতো জ্বালিয়ে রেখেছে
যেমত আমিও ছুরিতে কেটে লাল দগদগে তরমুজ হয়ে ফালি ফালি আছি
প্লেটে ছড়িয়ে।
মাধবীদের জমি দখলে নিতে যেমত একদল লাঠিয়াল দলবেঁধে
হুংকার ছেড়ে শাসাতে শাসাতে জায়গা ফাঁকা করে আসে
তেমনি ফাঁকা হয়ে আছে এই ভ্যানিটি ব্যাগের মেঝে।
২
বহুদিন হলো আপেলের শরীরে হাত দেবো দেবো করেও হাত দেয়া হয়নি
রস চেপা হয়নি, বাসি লুচির মতো গ্লোবও চুপসে আছে।
শীতের সকালে নদীর জল থেকে আশ্চর্য্য কুয়াশাকে তাই ঘেমে ঘেমে
উঠতে দেখা যায়। বুকের ভেতরে লেদমেশিনের মতো ঘর্ঘর শব্দ শোনা যায়
যেন জেলি জাতীয় কিছু উৎপাদনে ইউজার ব্যস্ত হয়ে আছে।
আবার দেশি যন্ত্রনায় টাল খেতে খেতে ঘুরেও দাঁড়াই
কোমড় প্যাঁচিয়ে আসে লেদারের বেল্টে।
পাতার অলিন্দ থেকে কেউ টুকি দিয়ে গেলে পোশাকের নিচে থাকা
যুবকটিকে শক্তসামর্থ্য- দক্ষ হয়ে উঠতে দেখি।
সমুদ্র সেঁচে মাটি
একেকটা দিন অতিবাহিত হয় আর মনে হয় ছুরি দিয়ে
আমার নিজেরই পা’ টাকে বাঁশ চেঁচার মতো আনমনে চেঁচে চলেছি।
বুকের ভেতরে রাশি রাশি অন্তর্জালা তাকেও ফুঁ দিয়ে নেভাতে যাই না আর
আমি চাই আগুন পেয়ে এ সিসার চামড়া মুহুর্মুহু জ্বলে উঠুক।
যেহেতু আমি নিজে সমুদ্র সেঁচে মাটি নিয়ে এসে গরুর চূড়ের মতো মাথা তুলে
আকাশ দেখতে চাইছি। মানুষ যেমন বিশাল টমেটো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
আমিও তাই, পাশে চুনকাম করতে এর পাশে ওই জিনিস ওই বনসাই
ওই সামনে ড্রেসিংটেবিল বসাতে মিস্ত্রি খুঁজতে ঢাকার দিকে যাচ্ছি।
পাথর ঘ’ষে ভোর
আমার বুকের ভেতর থেকে পাথরগুলো সরাতে নিশ্চয় কোনো
একজন নারীশ্রমিক পথে ঘাটে কাজ করবে।
নম্রভাবে খুব নম্রভাবেই আত্মহনন থেকে ফিরে আসা লাকি’র মতো কেউ
আমার ভেতরে নড়াচড়া করা দু’খানা পাতার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে
এই শরীরের অন্ধকারগুলো সেই এক চুমুকে খেয়ে নিতে পারবে জানি।
গনগনে সমুদ্রের নিম্নাঙ্গ ফুঁড়ে যেদিক দিয়ে ঢুকে পড়ে জীবনের প্রথম শাটি মাছ
সেইদিকে চিত্রের চকলেট হতে ফলের স্যালাইন হয়ে তোমার শরীরে
আমিও ফুঁড়ে যাব। জানি, আমাদের ভবিষ্যৎ চমৎকার এক বৃষ্টির ভেতর
দিয়ে চলে যাবে।
এসব রোমান্টিক কথা লিখব না লিখব না করেও পেঁয়াজের খোসার মতো
একে একে পাঁজর খুলে খাতায় ছড়ালো।
লালকার্ড
এয়ারগানটা আংকেলের মতো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে
কোনো সিনক্রিয়েট হওয়ার আগেই গলা খাঁকারি দিয়ে যায়
-হাত উঁচিয়ে ঝড়কে ডেকে আনে।
কারা তারা? মরুভূমি ঠেকাতে নিজেদেরই রক্ত নিজেরাই জিঁইয়ে রাখে
আর সচিত্র ক্ষয়ক্ষতি দেখতে স্বয়ংক্রিয় হাতবোমা হয়ে
ওই অসম্ভবের পায়ের কাছে পড়েই বলে -সক্রে আজ যাই যাই!
এরকম অনেক ফিলিস্তিনিদের দেখেছি সকাল দশটার দিকে বিছানা ছেড়ে
পরিখার দিকে চলে যেতে।
হেই চিরআবিস্কারক ভাস্কর-দা-গামা কিংবা ঝানু, চটপটে চিত্রল ম্যাকগাইভার
তোমরা কি শিশুপার্কে খেলতে যেয়ে বন্দুকের খোসাগুলিকে
কখনো ব্যাডমিন্টন খেলার কর্ক ভেবে বাড়িতে কুড়ে এনেছিলে?
তালাশ তালুকদার
জন্মঃ ১৯৮৩ ইং, বগুড়া।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
(কবিতার বই)
খড়ের কাঠামো-২০১৩।
সকল প্রকৃতি জঙ্গলে বসে থাকে-২০১৮।
কবিতা সংকলন:
প্রথম দশকের নির্বাচিত কবিতা-২০১০।
সম্পাদনা:
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা কবিতা সংকলন
কীর্তিকলাপ.কম (অনলাইন ভার্সন)
ভার্চুয়াল যোগাযোগ
https://www.facebook.com/talash.talukder