| 18 এপ্রিল 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২১

সম্পূর্ণ উপন্যাস: পাহাড়ের ঢাল বেয়ে । অদিতি ফাল্গুনী

আনুমানিক পঠনকাল: 29 মিনিট

পেয়ারার সুবাস

বিপ্লব কোনো ভোজসভা নয়, বা প্রবন্ধ রচনা কিংবা চিত্র অংকন অথবা সূচিকর্মও এটা নয়,
এটা এতো সুমার্জিত, এতো ধীর-স্থির ও সুশীল, এতো নম্র, এতো দয়ালু, বিনীত, সংযত ও উদার হতে পারে না। বিপ্লব হচ্ছে একটি অভ্যুত্থান- উগ্রপন্থী প্রয়োগের কাজ, যার দ্বারা এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীকে উৎখাত করে।
– মাও সেতুঙ

এক কিলো কাজি পেয়ারা…

‘বিদ্যুৎ কান্তি বাবু! একাউন্টসে আপনাকে একবার ডেকেছে!’
‘ওহ্!’ জার্নি ফর বেটার বাংলাদেশ (জেবিবি)-এর পাবলিক রিলেশন্স অফিসার শ্রী বিদ্যুৎ কান্তি ধর একগাদা ফাইল থেকে মুখ তুলে তাকালে পাশের টেবিলের নাজিম মুচকি হাসে, ‘যান দাদা। আপনাদের এই এক সুবিধা- দুর্গা পূজা আর কালী পূজা গায়ে গায়ে লাগোয়া…তাই পরপর দুইটা বোনাস। আমাদের এক ঈদ গিয়া আর এক ঈদ আসতে বহু দেরি!’

‘স্যরি ধর দা, আপনার কাগজ-পত্র ঠিক করতে করতে আজ দিন শেষ হয়ে এলো,’ একাউন্টসের শারমিন বোনাসের খাম আর আনুষঙ্গিক কাগজ-পত্রও এগিয়ে দেয় স্বাক্ষর করার জন্য। দস্তখত শেষে বোনাসের খাম নিতে নিতেই ঘড়ি পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। এবার অক্টোবর না আসতেই শীত পড়েছে। তার আগে অবশ্য ধুন্ধুমার বৃষ্টি হয়েছে কয়েক মাস। আজ কি আরো ঘন্টা খানেক বেশি অফিসে থাকবেন যেমন রোজ থাকেন? না, ছোট মেয়েটার জ্বর আজ দু’দিন ধরে। সে বায়না ধরেছে পেয়ারা খাবে। আপেল কমলা নয়, ছোট মেয়েটার প্রিয় বস্তু ঐ এক পেয়ারা। অথচ, পেয়ারা দেখলেই বা পেয়ারার গন্ধ নাকে এলেও তার যে কেমন লাগে তা’ এই পৃথিবীতে সে একাই জানে। তার স্ত্রীও জানে না। পেয়ারা দেখলেই বুকের ভেতর এক অদ্ভুত জ্বালা হয় তার। বাজারে কাঁচা কি ডাঁশা, সবুজ ও সুরভিত পেয়ারা দেখলেই মনে হয় ঐ পেয়ারাগুলো সব রক্তের ছোপে লাল। রক্তের উৎকট গন্ধ চারপাশ থেকে চেপে ধরে তাকে। অথচ, রিনি…তাঁর ছোট মেয়ে…মহা পেয়ারা ভক্ত।

ছুটিতে দেশের বাড়ি গেলে খুঁজে খুঁজে সে পেয়ারা গাছে চড়বে। অথচ, পেয়ারা কেন… পেয়ারা গাছ কি পেয়ারা গাছের একটা ডাল বা পাতা পর্যন্ত সহ্য হয় না বিদ্যুতের। সে কি বিদ্যুৎ কান্তি ধর? নাকি রামকৃষ্ণ পাল? গত শীতে দেশের বাড়ি গিয়ে রিনির পেয়ারা গাছে চড়ার বাড়াবাড়ি দেখে লোক ডাকিয়ে এনে পেয়ারা গাছ দু’টো অবধি কাটিয়ে ফেলেছে বিদ্যুৎ কান্তি ধর অথবা রামকৃষ্ণ পাল…অথবা…আরো একটা নাম আছে না তার? ছয় বছরের রিনির এই নিষ্ঠুরতা সহ্য হয় নি! গাছ কাটার দৃশ্য তাকে অসহ কষ্ট দিয়েছে।

‘তুমি গাছ কাটিয়ো না বাবা- ও বাবা- আমি আর কোন দিন পেয়ারা গাছে উঠব না! তবু তুমি গাছ কাটিয়ো না- মা- বাবাকে বলো না- ও মা!’

বিদ্যুৎ কান্তি সে কথায় কান দেয়নি। এর পর থেকে রিনির মাঝে মাঝেই জ্বর আসে। জ্বরের ঘোরে তার একটাই বায়না, ‘মা- বাবা যেন পেয়ারা গাছ না কাটে- পেয়ারা খাব মা! একটা পেয়ারা!’

আশ্চর্যের আশ্চর্য, বিদ্যুৎ থুক্কু রামকৃষ্ণেরও একটা বস্তুই প্রিয় ছিল ছোটবেলায়। গ্রামে বাড়ি লাগোয়া নানা গাছের ভেতর পেয়ারা গাছেই উঠতে বেশি ভাল লাগত। পেয়ারা… পেয়ারা বাগান…ন্না, ভুলে যাও পেয়ারা বাগান! ভুলে যাও রক্ত, হুইসেল আর বন্দুক কি গ্রেনেড হাতে ছোটাছুটি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দ্যাখো… তুমি বিদ্যুৎ কান্তি ধর! কি চমৎকার পরিপাটি ডেনিম জিন্স আর সাদা ফুল হাতা শার্টে বেসরকারী অফিসের স্বচ্ছল চাকুরে!

‘স্যার…পেয়ারা দেখবেন? কাজি পেয়ারা এক কিলো ষাট টাকা!’

লালমাটিয়া থেকে ধানমন্ডি সাতাশের দিকে আসতে বড় রাস্তার ফুটপাথে এক ভ্রাম্যমান পেয়ারাঅলা তার ভ্যানে সবুজ ও এমনকি পাতা সম্বলিত গাদা গাদা পেয়ারা সাজিয়ে বিদ্যুৎ বা রামকৃষ্ণকেই ডাকল। এই প্রাক-অক্টোবরেও এমন সতেজ, সবুজ পেয়ারা! ত্রিশ বছর আগেও এমনটা ভাবা যেত না! এগ্রো সায়েন্সের বলিহারি! সারা বছরই বলতে গেলে সব ধরণের ফল পাওয়া যায়। কিন্তু পেয়ারাঅলা কি আর মানুষ পেল না ডাকার? বেছে বেছে তাকেই? সকালে অফিসে আসার আগে বউয়ের ক্রুদ্ধ গলা মনে পড়লো তার, ‘কিছুতেই বুঝি না পেয়ারা জিনিসটা তোমার কি এমন ক্ষতি করলো? বাচ্চা মেয়েটার জ্বর উঠছে একশো চার। না হয় ও আপেল, কমলা কি হরলিক্স কিছুই খেতে চাইছে না। ওর পেয়ারার উপর টান ত’ তুমিই বাড়াইছ! গতবার শ্বশুরবাড়ি গিয়া নিজের বাপের ভিটের দুইটা পেয়ারা গাছ কাটাইলা! বাচ্চাদের যা মানা করবা, তাই ত’ বেশি বেশি চাবে! আজকে বাড়ি ফেরার পথে দুইটা পেয়ারা আইনো! সামান্য পেয়ারা নিয়া যা করতেছো তুমি…তাতে মনে হয় তোমারে না সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতে হয় শেষমেশ!’

অফিস যাবার তাড়া ছিল বলেই বউয়ের এতটা মুখ নাড়া সয়েও রা-টি না কেড়ে চুপচাপ জামা-কাপড় পরে বের হয়ে পড়েছিল বিদ্যুৎ বা রামকৃষ্ণ বা কেউ একজন। পেয়ারাঅলার ডাকে সাড়া দেবে না ভেবেও কি মনে করে পেয়ারা ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। তার আগে আড় চোখে রাস্তার চারপাশে একবার চকিতে দেখে নিল সে। না, চেনা-জানা কেউ নেই। গোটা গ্রহটাই বদলে গিয়েছে। সেই সাথে এর বাসিন্দারাও। কেউ তাকে দেখলেও সে বিদ্যুৎ কান্তি ধর। অথবা কেউই নয়। অন্তত এমন কেউ নয় যার নামের সাথে পেয়ারা বা পেয়ারা বাগান শব্দটি জড়িয়ে থাকবে। তা’ বিদ্যুৎ কান্তিকে পেয়ারা ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে উৎসাহিত পেয়ারাঅলা খুশি মুখে কলকল করে, ‘ডাঁশা পেয়ারা স্যার। কয় কেজি নিবেন কন! দুই কেজি নেন স্যার। শরত কাল আইতেআছে। বাড়িতে এই সময় গুঁড়াগাঁড়াদের (বাচ্চাদের) জ্বর-জ্বারি। পেয়ারা খাওয়ান আর জ্বর-জ্বারি শেষ…ইনশাল্লাহ! ঢাকার বাইরে…বরিশালের পেয়ারা স্যার…একদম ফ্রেশ। আইজ সকালের স্টিমারে সদরঘাট পৌঁছাইছে। সেইখান থন আসছে এই পেয়ারা। বাস নেন স্যার!’

এই বলে পেয়ারাঅলা একটা আস্ত পেয়ারা বিদ্যুৎ কান্তির নাকের সামনে ধরে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় তার। পেয়ারাঅলার কথা শুনেই মনে হয়েছিল সে বরিশালের মানুষ। এখন আবার এই ফল বিক্রেতা তাকে জানাচ্ছে যে এই পেয়ারাগুলো বরিশাল থেকেই এসেছে। একেই কি গ্রহের যোগ বলে?

‘মাহতাব ভাই! মাহতাব ভাই!’

চমকে…হ্যাঁ, বিদ্যুৎস্পৃষ্টই বলা যায় বা যেতে পারে…বিদ্যুৎ কান্তি অথবা রামকৃষ্ণ অথবা মাহতাব হাশিম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
‘মাহতাব ভাই! কেমন আছেন? আপনার চেহারা দেইখা ত’ চেনাই যায় না। আমি কিন্তু ঠিক চিনছি। কত রাত একসাথে পাশাপাশি ঘুমাইছি!’

মাহবুব না? হ্যাঁ, মাহবুব-ই ত’। দু’জন মাহবুব ছিল দলে। একজন কালো আর একজন ফর্সা। এ হচ্ছে কালো মাহবুব। স্মৃতিশক্তি বুঝি তারই খুব খারাপ?

‘স্যরি, আপনি ভুল করছেন- আমার নাম মাহতাব না!’

‘হা- হা- আসল নাম ত’ দাদা আপনার রামকৃষ্ণ! কিন্তু অপারেশনের সময় আপনার ঐ নামটাই ত’ আসল নাম হইয়া গেল! আমরা ত’ আপনারে ঐ নামেই রাতদিন ডাকতাম!’ পরক্ষণেই পেয়ারাঅলার দিকে তাকিয়ে মাহবুব বলে, ‘চলেন- রাস্তার ঐপাশে গিয়া দাঁড়াই। কতদিন পর দেখা!’
‘আপনি ভুল করছেন। আমার নাম রামকৃষ্ণও না!’

এবার অপরপক্ষও ঈষৎ বিচলিত হয়।
‘কি যে কন মাহতাব ভাই…না…মানে রামকৃষ্ণ দা!’
‘স্যরি, আপনি ভুল করছেন…আসি!’
‘না- না- দাদা- ভাই শোনেন একবার!’

মাহবুব পেছন থেকে উদভ্রন্তের মতো ডাকে। বিদ্যুৎ কান্তি ধর সেই ডাক শোনে বা শোনে না। এক/একটা নাম এক/একটা জীবনের সমান অতল ও ভারি। শ্রী রামকৃষ্ণ পাল অথবা মাহতাব হাশিম ফেলে আসা জীবনের দু’টো আস্তর। দেয়ালের দু’টো আস্তর খসে গিয়ে যে নতুন রঙ, নতুন বার্নিশ আর চুনকাম করা হয়েছে তাই যেন ধ্রæব সত্য হয়। আয়না- আয়না- তুমি কার? যে যখন সামনে দাঁড়ায় তার- বিদ্যুৎ কান্তি ধর, জনসংযোগ কর্মকর্তা, জার্ণি ফর বেটার বাংলাদেশ- জেবিবি…

মাও সে তুঙ চিন্তাধারা গবেষণাগার…

‘এই ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টে কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস হইলো ‘এলিট কমিউনিস্ট’দের ইতিহাস। এম,এন. রায়ের কথাই ধরা যাক। সে ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলো কোথায়? না, তাশখন্দে- ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে। রায় এইটা করলো তার পলিটিক্যালি এ্যাম্বিশাস গুরু বারোদিনের পরামর্শে। সামনেই থার্ড কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে কোন পোস্ট হোল্ড করতে হইলে একটা ন্যাশনাল কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বারশীপ লাগবে। তা’ রায় পাবে কেমনে যদি ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি গঠন না করে?…’

যুবক বক্তার সামনে টেবিলে নিঃশেষিত চায়ের কাপ।

‘এক মিনিট। এম,এন, রায়কে এক কথায় কি এভাবে বাতিল করা যায় না উচিত?’

রামকৃষ্ণ আর শামিউল্লাহ হাত তোলে।

‘হা-হা- আমিও এক সময় এম,এন, রায়ের ভক্ত ছিলাম। কিন্তু, তাশখন্দে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাত জন মেম্বারের দিকে তাকাও। এম,এন, রায় আর তার মার্কিনী বউ এভেলিনা ট্রেন্ট রায়, অবনী মুখার্জি আর তার রুশ বউ রোজা ফিটিংগোফ, মুহম্মদ আলী, মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী আর রায়ঙ্কর আচার্য। সব কয়টা ভারতের এলিট ফ্যামিলির পোলা…বিদেশে গিয়া ব্যারিস্টারির পাশাপাশি মার্ক্সবাদও পড়ছে, বিদেশী মেয়ে বিয়া করছে, বিদেশে থাইকা দেশে সাম্যবাদের থিওরি কপচাইছে…দ্যাখো মস্কোতে বইসা ১৯২১ সালে এম,এন,রায় পার্টির প্রথম যে ইশতেহার রচনা করে তাতে ইন্ডিয়ান রুরাল সোসাইটিতে মহাজনী শোষণের স্বরূপ আর শোষণ বন্ধ করার বিষয়ে রায়ের ভুল শোধরায় দেয় স্ট্যালিন…’

যুবক বক্তার ঠোঁটে বিদ্যুতের মতো খেলছে অজস্র যুক্তি।

‘তাতে কি প্রমাণ হয়?’ শহীদ ওরফে মাহবুব ভ্রু কুঁচকাল।

‘আরে মিঞা! আগে কথা শেষ করতে দাও! প্রমাণ অনেক কিছুই হয়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ছয়/সাত মাস আগেই কিšত্ত ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি এস্টাবলিশড্ হইছে। চীণা কমিউনিস্ট পার্টি মানে তোমার সি.পি.সি. গঠন হইছে ১৯২১ সালের মে মাসে সাংহাইয়ে। তাদেরও ভারতের মতো বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর গ্রামীণ সামন্তবাদের একই কন্ডিশন ছিল। মাও সেতুঙ কিšত্ত ঠিকই আইডেন্টিঠফাই করলেন পরাধীন চীনে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব আর গ্রামভিত্তিক দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের লাইন নিতে হবে। তিনি ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও’য়ের পলিসি নিলেন। কিন্তু ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি কি করলো? তারা রাশান পার্টির অভিজ্ঞতাকে ব্লাইন্ডলি, মেকানিক্যালি ফলো করতে গেল। তারা শহরভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে গেলো। অথচ, গোটা বৃটিশ কলোনিয়াল পিরিয়ড জুইড়া এই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ…গ্রামের সাধারণ কৃষকেরা সংঘঠন করেছে হাজার হাজার বিদ্রোহ। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলো কি মেদিনীপুর বিদ্র্রোহ, শমসের গাজীর বিদ্রোহ, সন্দীপ থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, আমাদের ময়মনসিংহের পাগলপন্থী বা গারো বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ…গুইনা শেষ করা যাবে? কিšত্ত বাবু কমিউনিস্টরা কি করলো? তেভাগা বা তেলেঙ্গানার মতো বিপুল গণবিদ্রোহগুলা তারা প্রথমে বৃটিশ আর দেশভাগের পরে ভারতে গান্ধী-নেহেরুর কংগ্রেসের কাছে আর পাকিস্থানে মুসলিম লীগ সরকারের হাতে স্রেফ তুইলা দিলো। আর্মড মুভমেন্ট বাদ দিয়া ভোটের পথ ধরলো।’

‘এতটা ব্লেইম কি করা যায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে যে তেভাগা বা তেলেঙ্গানার ফলাফল তারা পুরা বুর্জোয়াদের হাতে তুইলা দিছে?’ হুমায়ুন তার নোট খাতায় একটি স্কেচ আঁকিবুঁকি করতে করতেই প্রশ্ন করে। ছবি আঁকতে আঁকতেই সব কথাই সে কাণ খাড়া করে শুনছে। মনোযোগ তার অখন্ড। অবশ্য স্কেচ খাতায় প্রথমে সে লিখছিল একটি কবিতা। লাইন তিনেক লিখবার পরেই নিজের কাছেই পছন্দ না হওয়ায় কবিতা কেটে তার উপর সে ছবি আঁকতে শুরু করে। এই ছবি যোগ কবিতা বা ছবিতা অনুশীলন ভারত উপমহাদেশীয় ও বৈশ্বিক স্তরে সাম্যবাদের ইতিহাস নিয়ে তাত্তি¡ক আলোচনায় তার মনঃসংযোগে এতটুকু বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি।

‘ইয়েস। অফ কোর্স করা যায়। তেলেঙ্গানার কথাই ধরো। নিজাম শাহীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা আর জমি রক্ষার জন্য হায়দ্রাবাদের স্থানীয় কমিউনিস্টরা সেইখানে গইড়া তুলছিলো দলম বা নিয়মিত বাহিনী, গেরিলা বাহিনী আর গণস্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। হায়দ্রাবাদের মোট ২২,০০০ গ্রামের মধ্যে ২৫০০ গ্রামেই ছড়ায় পড়ছিলো কৃষক সংগ্রাম…এই আড়াই হাজার গ্রামকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হইছিলো যেখানে লোক সংখ্যা ছিল প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ বা আধা কোটি। তিন হাজার নিয়মিত গেরিলা যোদ্ধা ছাড়াও গ্রামরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছে দশ হাজার কৃষক। ১৯৪৮ সালের মধ্যেই ৩৬ লক্ষ বিঘা জমি চাষীগো মধ্যে বিলি কইরা দেওয়া হইলো। বাট হোয়াট রণদিভে ডিড? দ্য আই,পি,সি, অর ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি আন্ডার দ্য লিডারশিপ অফ রণদিভে ফাইন্যালি অপোজড্ দ্য লাইন অফ তেলেঙ্গানা স্ট্রাগল। এ্যান্ড ইট সারেন্ডরড্ আনকন্ডিশন্যালি টু দ্য ইন্ডিয়ান গর্ভনমেন্ট ইন নাইন্টিন ফিফটি ওয়ান। সেইম ফেইট অকারড্ টু দ্য তেভাগা এ্যান্ড টঙ্ক মুভমেন্টস্ ইন আওয়ার ইস্ট বেঙ্গল অর ইস্ট পাকিস্থান। পূর্ব পাকিস্থানেও কমিউনিস্ট পার্টি তেভাগা ও টঙ্ক আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক কৃষক জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে কন্টেইন করতে, প্রপারলি চ্যানেলাইজ করতে পারলো না। …’

‘বুঝলাম। বাট নাউ হোয়াট শুড উই ডু?’ ডা: রকিবুলের গতকাল নাইট ডিউটি ছিল। ফলে আজ দুপুরের পর থেকেই তাঁর ছুটি। সাদা এপ্রন খুলে ফেলেছেন। গলায় স্টেথিসস্কোপ অবশ্য ঝুলছে।

‘চারু মজুমদারের নাম ত’ শুনতেছ আজকাল তাই না? হি হ্যাজ অলরেডি মোবিলাইজ্ড আ সাকসেসফুল আর্মড পিজ্যান্টস্ স্ট্রাগল ইন নকশালবাড়ি অফ শিলিগুড়ি। হি ইজ শোয়িং অরোরা ইন নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি এ্যান্ড ফাঁসিদেওয়া এরিয়াজ অফ দার্জিলিং। অবশ্য এর আগেই দার্জিলিং জেলা কমিটিতে তিনি ক্রুশ্চেভের সংশোধনবাদী মতের বিরোধিতা কইরা নিজের জাত চিনাইছেন। ১৯৫৭ সালে ক্রুশ্চেভের নেমকহারামির পর সিপিসি মানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি আর আলবেনিয়ার পার্টি অফ লেবারই শুধু ‘শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ’-এর সংশোধনবাদী দাওয়াই অপোজ কইরা লেনিনবাদী স্ট্যালিনরে আপহোল্ড করছে। ইন্ডিয়ায় সিপিআই আর সিপিএম দুইটাই ক্রুশ্চেভের রাস্তায় হাঁটলেও চারু মজুমদার বাপের বেটা। কলকাতার কোন বড় নেতা না…ছিল দার্জিলিংয়ের এক অখ্যাত মফস্বল নেতা। কিন্তু সবাই এখন তার নাম কইতাছে। ‘গ্রাম দিয়া শহর ঘেরাও’য়ের নীতি এই সাব-কন্টিনেন্টে তিনিই প্রথম ডিক্লেয়ার করলেন।’

‘বাট হোয়াট শুড উই ডু ইন ইস্ট পাকিস্থান? শুড উই ফলো হিম? মজুমদার্স লাইন?’ রামকৃষ্ণ আর বাবুল মাথা নাড়ে।

‘সেইটাই চিন্তার কথা। একদিকে মণি সিংহ-খোকা রায়গো রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি আর একদিকে আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা আর সুখেন্দু দস্তিদারদের ইপিসিএমএল। রুশপন্থীরা ত’ বটেই, খোদ ইপিসিএমএলও বলতে চায় যে মাও সেতুঙ চীণের নেতা। তার কথাকে আমরা কেন তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসাবে নেব। মাও সেতুঙ যে সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন ফান্ডামেন্টাল কনফ্লিক্টস্ বা মৌলিক দ্বন্দের মাঝে প্রধান দ্বন্দ চিহ্নিত করেছেন, সেটা তোয়াহা-দস্তিদাররা মনে করেন দরকার নাই।’

‘কেন? কেন এমন মনে করছেন তারা?’

‘তারা মনে করেন পূর্ব পাকিস্থানের সমাজে প্রধান দ্বন্দ নির্ণয় করতে গেলে শত্রæর সহায়তা হবে। ওনরা বোঝেন শুধু কিতাব। কিতাবে বলছে যে আধা উপনিবেশের উপনিবেশ হতে পারে না। তাই পাকিস্থান নিজেই যেহেতু আমেরিকার এক ধরণের উপনিবেশ, তাই পাকিস্থানের পক্ষে পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশ করা সম্ভব না। কিšত্ত বাস্তবে ত’ আমরা আসলে পশ্চিম পাকিস্থানের উপনিবেশ। কিšত্ত ইপিসিএমএল মনে করে যে পাকিস্থান আমাদের উপনিবেশ করতে পারে না। ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের সাথেও আমাদের কোন ফান্ডামেন্টাল ক্লাশ বা মৌলিক দ্বন্দ থাকতে পারে না। ওনরা মনে করেন এখনো এদেশে সশস্ত্র সংগঠন ও সশস্ত্র সংগ্রামের সময় হয় নাই। কিন্তু সশস্ত্র সংগঠন ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রক্রিয়া গইড়া তুলতে হবে। আর পশ্চিম পাকিস্থান আমাদের উপনিবেশ বানায় ত’ রাখছে। সেইটাকেই আজকের পূর্ব বাংলার প্রধান দ্বন্দ হিসাবে স্বীকার না করলে এদেশের সাধারণ মানুষ আমাদের ভুল বুঝবে। যেমন তারা রণদিভেকে ভুল বুঝছিলো ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়-এর শ্লোগানে!’ এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁফায় সিরাজ।

ছোট্ট এই চালা ঘরে ‘মাও সেতুঙ চিন্তাধারা গবেষণাগার’-এর ক্লাস চলছে গত কয়েক মাস ধরে। মালিবাগ মোড় থেকে যে সরু গলিটি শান্তিবাগ-গুলবাগের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেখানে এই চালাঘরটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে হুমায়ুনের বোণের কাছ থেকে। ভাড়া কিন্তু একেবারে কম না। মাসে ষাটটি টাকা। বারো জন সভ্য প্রায় নিয়মিত এখানে ক্লাস করে। ক্লাসের মূল মানুষ সিরাজ। সিরাজ সিকদার। সি এ্যান্ড বি’তে এ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনীয়ার হিসেবে তার চাকরির বেতনের মোটা অংশটাই এই গবেষণাগার পরিচালনায় চলে যায়। শামিউল্লাহ, শহীদ, মাহবুবউল্লাহ, আবুল কাশেম ফজলুল হক, বাবুল এনাম, হুমায়ুন কবির, নুরুল হাসান, আবুল হাসান, ইসহাক, ডাঃ রকিবুল, রামকৃষ্ণ, হামিদ ও জলিল…এ ক’জন মানুষ ঝড়-বন্যায় শহর উল্টে গেলেও স্টাডি সার্কেল কামাই দেয় না। প্রতিদিন বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে রাজনৈতিক ক্লাস।

‘আর এক রাউন্ড চা হইবো নাকি সিরাজ ভাই?’ ইসহাক জিজ্ঞাসা করে। ইসহাকই এই পাঠচক্রের সকল সভ্যের মাঝে একমাত্র অ-মধ্যবিত্ত সদস্য। সে একটা কারখানার অস্থায়ী শ্রমিক। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। কিন্তু জটিল পাঠচক্রের এই জটিলতর বিষয়গুলো বুঝুক কি না বুঝুক কি সে গোগ্রাসে গেলে।

‘আনানো যায়,’ আবুল হাসান শার্টের পকেট থেকে টাকা বের করেন।

২. অগ্রযোদ্ধা

‘যে পার্টি সবচে’ অগ্রসর তত্ত¡ দিয়ে পরিচালিত
একমাত্র সেটাই অগ্রযোদ্ধার ভূমিকা পালন করতে পারে।’
: লেনিন।

সিরাজের বামপন্থী রাজনীতির হাতে খড়ি শুরু হয়েছিল ইস্ট পাকিস্থান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বা ইপিসিপি (এম-এল)-এর ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি হিসেবে। কিšত্ত কিছুদিন না যেতেই সিরাজের মনে হলো যে ইপিসিপি (এম-এল) সংসদীয় পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ক্রুশ্চেভীয় নীতির বিরোধিতা করলেও তারা মাও সেতুঙ চিন্তাধারাকে তত্ত¡ হিসেবে স্বীকার করছে না, সমাজে বিরাজমান অসংখ্য দ্বন্দের ভেতর প্রধান দ্বন্দ নির্ণয়টা অপ্রয়োজনীয় মনে করছে, নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণীর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ইত্যাদি বিষয়ে তাদের কোন জরুরি কর্মপন্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেই। নাহ্, একটা ইনার-পার্টি স্ট্রাগল বা আন্ত:পার্টি সংগ্রাম শুরু করতেই হবে। ইপিসিপি (এম-এল)-এর কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি হিসেবে সিরাজ যেবার নির্বাচিত হলো, সেবছরই সে তার থিসিস খাড়া করা শুরু করে। দূর চীনের মাওয়ের ভাবনা ও সেখানকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব আর বাড়ির কাছেই দার্জিলিংয়ে চারু মজুমদার ও তাঁর প্রদর্শিত পথ ততদিনে তার ধমনীতে গুঞ্জরণ শুরু করেছে। দেখতে দেখতে সিরাজের নোট খাতা ভরে উঠলো নানা আত্ম-সমীক্ষামূলক প্রশ্নে: ১. মাও সেতুঙ চিন্তাধারাকে বর্তমান যুগে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের যুগোপযোগী বিকাশ হিসেবে স্বীকার করা এবং তাকে পার্টির তাত্তি¡ক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হবে কি হবে না, ২. সমাজের বিভিন্ন মৌলিক দ্বন্দ্বের মাঝে প্রধান দ্বন্দ্ব নির্ণয় করার প্রশ্নে মাও সেতুঙ চিন্তাধারার শিক্ষাক্ষা দ্বারা পরিচালিত হতে হবে কি না, ৩. জাতীয় সমস্যার ক্ষেত্রে লেনিনবাদী ও মাও সেতুঙ চিন্তাধারানুসারী শিক্ষা নীতিমালা দ্বারা বিশ্লেষণ করা হবে কি না। ‘বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ’-এই মার্কসবাদী মৌলিক প্রতিপাদ্যের প্রতি অনুগত থাকা হবে কি না। ৪. বিপ্লবের রণনীতির প্রশ্নে মাও সেতুঙ চিন্তাধারার ভিত্তিতে সশস্ত্র সংগ্রামকে ও গেরিলা যুদ্ধের রণনীতিকে গ্রহণ করা হবে কি না এবং ৫. লেনিনবাদী সাংগঠনিক মূলনীতি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে পার্টি গড়ে তোলা হবে কি না।

গোলমালটা বাঁধলো যখন সিরাজ এই প্রশ্নগুলো শুধু নোট বুকে লিখেই ক্ষান্ত হলো না। উল্টো ইপিসিপি (এম-এল) নেতাদের কাছেও সে যখন এসব বিষয়ে তার ভাবনা জানাতে গেল। শুধু কি জানানো? পূর্ববাংলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি আর ইতিহাস বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিরাজ রীতিমতো একটি খসড়া থিসিসও পেশ করে ফেললো। থিসিসে পূর্ব বাংলার সমাজের বিরাজমান মূল যত, দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, বিপ্লবের স্তর আর রণনীতিও উপস্থাপিত হলো। সে বছরই পাবনায় ভাসাসী এক সম্মেলন ডাকলেন। সিরাজও গেল সেখানে। বাঘা বাঘা যত বুড়ো কমিউনিস্ট সেখানে আসবেন। তাদের কাছে থিসিস পেশ করার জন্য তরুণ সিরাজ এর চেয়ে ভাল সময় আর কই পাবে? কিšত্ত বুড়োরা কাণই দিল না তার কথায়। ‘অল্প বয়েসী বাচ্চা ছেলে’ বলে তারা ঠোঁট বাঁকালো। বুড়ো কমরেডদের এই আচরণে একা সিরাজই নয়, কষ্ট পেল তার সাথিরাও। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর বিদ্রোহী অংশ। এদের গড় বয়স বাইশ। অধিকাংশেরই শ্রেণী ভিত্তি মধ্যবিত্ত বা ক্ষুদে বুর্জোয়া। শ্রমিক শ্রেণিরও প্রতিনিধি কেউ কেউ।

‘কমিউনিজম এই বুড়ো নেতাদের হাতে মাদ্রাসার কিতাবের মতো অজর অক্ষর হয়ে গ্যাছে। তারা সবরকম সৃজনশীলতার শত্রু। আমাদের ইয়াংদের নতুন রাস্তা খুঁজতে হবে,’ পাবনা থেকে ফিরে ঢাকার পল্টনে এক চায়ের দোকানে বসে সিরাজ বলেছিল। তার চোখে মুখে পাবনায় বর্ষীয়ান কমরেডদের কাছে থিসিস রিজেক্ট হবার কোন হতাশা নেই। বরং নতুন কোন ভাবনা ও উদ্যোগের স্বর্ণাভ দীপ্তি। আকাশে গোধূলি বিধূ আর রাস্তায় তখনি জ্বলে ওঠা সোডিয়াম বাতির মিশ্র আভায় তাঁর সতীর্থদের মুখেও সোনালী রেণুরই বিস্তার।

‘আমরা কি এখনি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করবো?’ রামকৃষ্ণ প্রশ্ন করে।

‘দূর পাগল!’ সিরাজ হেসে ফ্যালে, ‘আগে বছর খানেক আমাদের তাত্তি¡ক ভিত্তিটা মজবুত করা দরকার। মার্কস-লেনিন-মাও রচনাবলী থরোলি পড়া, সংশোধনবাদের সাথে লড়াই করতে…সংশোধনবাদকে যুদ্ধে হারাইতে আর একটা পারফেক্ট রেভল্যুশনারি লাইন তৈরি করতে আর ডেভেলপ করতে আগে আমরা কিছুদিন রিগোরাস স্টাডি সার্কেল করবো। তারপর ধীরে ধীরে সশস্ত্র বিপ্লবের লাইন!’

‘কি নাম হবে স্টাডি সার্কেলের?’

‘সেটা হুমায়ুন ঠিক করুক। হুমায়ুন কবির?’

‘বলুন জাঁহাপনা!’ হুমায়ুন রসিকতা করে।

‘আপনি ত’ কবি মানুষ। আমাদের স্টাডি সার্কেলের নাম কি হতে পারে?’

‘আজকের রাতটা ভাবতে দিন শাহেনশাহ!’

‘কি সব ফিউডাল বুলি হুমায়ুন! কমরেড-এর চেয়ে শুদ্ধ সম্বোধন কিছু হতে পারে?’

‘আজকের রাতটা ভাবতে দিন কমরেড!’

৩. আক্রান্ত হলে পাল্টা আক্রমণ

সিরাজ কিন্তু ঠান্ডা মাথার ছেলে। প্যাশন আছে তার। তবু প্যাশন তাকে কখনো দিকহারা করে না। কাজেই মাও সেতুঙ চিন্তাধারা গবেষণাগার-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খুব ঠান্ডা মাথায় আর হিসাব-নিকাশ কষেই বর্ষীয়ান তাবৎ কমিউনিস্ট নেতা যেমন, সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন সবাইকেই সে নিমন্ত্রণ করেছিল। শুরুতে সিরাজের সতীর্থরা এই নিমন্ত্রণ মেনে নিতে চায় নি।

‘আসবে না কেউ। শুধু শুধু আমরা অপমান হতে যাব কেন?’

‘আগে ইনভাইট ত’ করি। তারপর ওনরা আসলে আসলেন। না আসলে না আসলেন। যদি না আসে তবে বুঝতে হবে আমরা সত্যিই নতুন কিছু, ভাল কিছু করতে চলছি যা দেখে ওনাদের হিংসা হইতেছে!’

না, সিনিয়র কমিউনিস্ট নেতারা কেউই আসেন নি। এমনকি তরুণ সিরাজের বিরুদ্ধে অচিরেই বাম পাড়ার নানা শাখা-প্রশাখায় রটলো কুৎসা আর ঠাট্টা-

‘এটা সিআইএ-র এজেন্টদের কারসাজী,’

‘এই মাও সেতুঙ চিন্তাধারা ও গবেষণাগার আসলে বিপ্লব বিরোধী!’

‘মাও সেতুঙ গবেষণাগারে কি মাও-এর ব্রেইন এক্সামিন আর ওয়াশ করা হচ্ছে?’

সিরাজের হাতের লেখাকে পর্যন্ত কাঁচা বললেন কোন কোন সিনিয়র কমরেড।

তবে, বামরা মৌখিক ঠাট্টা বিদ্রুপ করলেও তার বেশি কিছু করে নি। জামায়াতে ইসলাম হঠাৎ করেই সিরাজদের মাও সেতুঙ গবেষণাগার বন্ধের জোরালো দাবিতে নিয়মিত মিটিং, মিছিল আর পত্রিকায় বিবৃতি দানের মাধ্যমে আইয়ুব সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি শুরু করলো।

‘এই জামায়াতে ইসলামকে কোন বিশ্বাস আছে? আয়ুব খান আর মোনায়েম খানের চাকর। ক্যাম্পাসে এরাই পাসপাত্তুর মতো গুন্ডাদের পোষে। মিটিংয়ে বোমা মারে আর সাপ ছোঁড়ে। কবে এরা আমাদের উপর শারিরীক আক্রমণ না চালায়!’

‘আক্রান্ত হলে পাল্টা আক্রমণ সাচ্চা কমিউনিস্টদের রণকৌশল। মাও সেতুঙ গবেষণাগার গত এক বছর শুধু পড়াশোনা করেছে। এবার আমরা অস্ত্র তৈরি করবো.’ মাহবুবউল্লাহর উদ্বেগের জবাবে সিরাজ ধীর গলায় স্টাডি সার্কেলের ক্লাস সমাপনান্তে উত্তর করে।

‘কি অস্ত্র তৈরি করবো আমরা?’ সতীর্থরা কৌতুহলে কেটলিতে ফোটা চায়ের জলের মতোই উত্তপ্ত ও অধীর।

‘ শুরুতে বেশি কিছু না। খান সাতেক লাঠি আর বারটা চাক্কু!’ এটুকু বলেই হেসে ফ্যালে সিরাজ।

৪. শীতল, কালো, ময়লা সৌরভের প্রিয়তমা

‘কোনো প্রক্রিয়াতে যদি অনেকগুলো দ্ব›দ্ব থাকে
তা হলে তাদের মধ্যে অবশ্যই একটি হবে প্রধান দ্ব›দ্ব
যা নেতৃস্থানীয় ও নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।’
: মাও সেতুঙ।

‘তাহলে কমরেড পূর্ব পাকিস্থান বা পূর্ব বাংলার সমাজে মূল দ্বন্দ্বগুলো আপনি কি মনে করছেন?’ হুমায়ুন একটা কিং স্টর্ক সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট সিরাজের দিকে এগিয়ে দেয়।

‘আমার থিসিসে ত’ উল্লেখ করছিই। পুরাটা কি মন দিয়া পড়া হয় নাই?’

হুমায়ুন ঈষৎ হেসে মাথা চুলকায়, ‘আপনাদের একটা দিক ভাল। মার্ক্সবাদ আপনাদের একমাত্র ঈশ্বর। আমার যে আর এক ঈশ্বরী আছেন…’

‘কে, আপনার ওয়াইফ?’ সিরাজও মুচকি হাসে।

‘ওহ্, তাকে গুনলে ত’ তিনটা। আমি কবিতার কথা বলছিলাম।’

‘ওহে হুমায়ুন…আপনি একেশ্বরবাদী হইতে শিখুন। মার্ক্সবাদ ব্যতীত আমাদের অন্য কোন উপাস্য নাই। কবিতা ও নারীর পেছনে অনর্থক ছোটাছুটি করিবেন না!’ বলে সিরাজ উঁচু স্বরগ্রামে হেসে ওঠে। খোলা গলার হাসি। স্টাডি সার্কেলের বাদবাকিরাও জোরে হাসতে থাকে।

‘অর্ডার- অর্ডার-’ সিরাজ টেবিলের উপর মুঠো করে আঘাত করে, ‘সবাইকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছি যে মাও সেতুঙ চিন্তাধারা গবেষণাগার-এর বিবেচনায় পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় যে মূল দ্ব›দ্বগুলা আছে সেগুলা হইলো: ১. পূর্ববাংলার জনগণের সাথে পাকিস্থানী উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব ২. পূর্ববাংলার বিশাল কৃষক-জনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব, ৩. পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে (ক) সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ (খ) সংশোধনবাদ বিশেষত সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও (গ) ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব (৪) পূর্ববাংলার বুর্জোয়াশ্রেণীর সাথে শ্রমিকশ্রেণীর দ্বন্দ্ব।

‘কিšত্ত ইপিসিপি (এম-এল) ত’ আমাদের বলতেছে যে আমরা খুব বেশি জাতীয়তাবাদী আবেগে আচ্ছন্ন। ওরা ত’ বারবার জোর দিচ্ছে যে পাকিস্থান নিজেই পশ্চিমা শক্তির উপনিবেশ। তারা আমাদের কি কইরা উপনিবেশ করবে?’ ড: রকিবুল প্রশ্ন করেন।

‘আসলে আমার যেটা মনে হয় যে ’৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আধা উপনিবেশ থাকলেও যতই জাতীয় নিপীড়ন বাড়ছে ততই আমরা ধীরে ধীরে পাকিস্তানের উপনিবেশ হইয়া গেছি।’

‘তাহলে করণীয়?’

‘পূর্ববাংলাভিত্তিক বিপ্লব ও পূর্ববাংলাভিত্তিক পার্টি গঠন যা বিশ্ববিপ্লবের সাপোর্টিং ফোর্স বা সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করবে। আর এটা করতে হইলে রাতারাতি একটা কমিউনিস্ট পার্টির ব্যানার নামালেই হবে না। আমাদের এই স্টাডি সার্কেলে…আমি আমাকে ইনক্লুড করেই বলতেছি…আমাদের অধিকাংশই আসছে ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী শ্রেণী থেকে। এদের কনক্রিট প্রসেস আর হার্ড এক্সারসাইজের মাধ্যমে ডিক্লাসড কইরা ইডিওলজিক্যালি বা মতাদর্শিকভাবে সর্বহারা শ্রেণীর ক্যাডারে পরিণত করতে হবে। একইসাথে বিপ্লবী সংগ্রামের শর্ত হিসাবে প্রোলেতারিয়েত ক্লাসের ভ্যানগার্ড সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। গইড়া তুলতে হবে পলিটিক্যাল, ইডিওলজিক্যার, অর্গ্যানাইজেশনাল এ্যান্ড মিলিটারি লাইনস। আর এই লাইনগুলো গইড়া তুলতে হইল সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পাটির প্রেপারেটরি অর্গ্যানাইজেশনও গঠন করতে হবে…কাল সারা রাত চিন্তা-ভাবনা কইরা আমি একটা নামও ঠিক করছি…‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন।’

‘দশ মিনিটের একটা ব্রেক নেওয়া যায় কি? মাথাটা ধরছে। একটু ধুঁয়া দরকার!’ রামকৃষ্ণ হাত তোলে।

‘এ্যাপ্রæভড। দশ মিনিটের চা ও ধূমপান বিরতি উইথ কবিতা। হুমায়ুন, আপনি ত’ সমকালীন কবিতার খোঁজ-খবর রাখেন। আমি ত’ আপনার মতো কবিতার ব্যপারে এত আপ টু ডেট নই। কিšত্ত কবিতা আমারও উপাস্য। পুরাপুরি একেশ্বরবাদী আর কই হইতে পারলাম?’ সিরাজ পুনরায় সিগারেট ধরায়।

‘কাল না জানেন সারারাত ধরে একটা অসাধারণ কবিতার বই পড়লাম। শহীদ কাদরির লেখা। তাঁর প্রথম কবিতার বই। এই লোকটা কবিতার মাস্তান। বইটা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ও ব্যাগে সাথে রাখছি। একটা কবিতা ত’ অসাধারণ লাগলো। কবিতার নামটা একবার ভাবেন…কি না…আলোকিত গণিকাবৃন্দ?’

শহরের ভেতরে কোথাও হে রুগ্ন গোলাপদল,
শীতল, কালো, ময়লা সৌরভের প্রিয়তমা,
অস্পৃশ্য বাগানের ভাঙাচোরা অনিদ্র চোখের অপ্সরা,
দিকভ্রান্তের ঝিলিক তোমরা, নিশীথসূর্য আমার!
যখন রুদ্ধ হয় সব রাস্তা, রেস্তোরাঁ, সুহৃদের দ্বার,
দিগন্ত রাঙিয়ে ওড়ে একমাত্র কেতন,- তোমাদেরই উন্মুক্ত অন্তর্বাস,
-অদ্ভুত আহ্বান যেন অস্থির অলৌকিক আজান।

আর পড়ব? আপনারা বোরড্ হচ্ছেন না ত’?’

‘হ্যাঁ- হ্যাঁ- থামলেন কেন? আরে দূর-’

‘সেই স্যাঁতসেতে ঠান্ডা উপাসনালয়ে পেতে দাও
জায়নামায, শুকনো কাঁথা, খাট, ¯তপ্ত তপ্ত রেশমের স্বাদ!
আলিঙ্গনে, চুম্বনে ফেরাও শৈশবের অষ্ট আহ্লাদ!
বিকলাঙ্গ, পঙ্গু যারা, নষ্টভাগ্য পিতৃমাতৃহীন,-
কাদায়, জলে, ঝড়ে নড়ে কেবল একসার অসুস্থ স্পন্দন
তাদের শুশ্রুষা তোমরা, তোমাদের মুমূর্ষু স্তন!

ক্ষণকাল সে নকল স্বর্গলোকের আমি নতজানু রাজা
কানাকড়ির মূল্যে যা দিলে জীবনের ত্রিক‚লে তা নেই
অচির মুহূর্তের ঘরে তোমরাই তো উজ্জ্বল ঘরণী…’

সিরাজ একধরণের শ্রুতিধরই বলা যায়। কবিতা পাঠ শেষ হলে স্বগতোক্তির মত সে বিড়বিড় করে, ‘শীতল, কালো, ময়লা সৌরভের প্রিয়তমা…যাদের প্রতিদিন দেখি রমনার বেঞ্চিতে, পল্টন আর গুলিস্তানের ফুটপাথে…কমরেডস্,’ সিরাজের চোখে জল, ‘বিপ্লব এলে কেউ আর শীতল, কালো, ময়লা সৌরভের প্রিয়তমা থাকবে না। কোন নারীর স্তন আর মুমূর্ষু রইবে না!’

৫. পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন

দেখতে দেখতে ১৯৬৭ সালটা যেন বা চোখের পলকে পার হয়ে নতুন একটা গোটা বছর চলে এলো! সময় পার হয় অবিশ্বাস্য দ্রুতিতে। আজ রবিবার। ছুটির দিন। জানুয়ারির ৮ তারিখ। বুড়িগংগা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের মীরেরবাগ যেতে দু’টো বড় নৌকা ভাড়া করা হয়েছে। মীরেরবাগে ঢাকা জুট মিলের শ্রমিক আবুল হোসেনের বাড়ি। সেখানেই আজ সিরাজের স্বপ্নের ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’ প্রতিষ্ঠা করা উপলক্ষ্যে একটা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। ‘মাও সেতুঙ চিন্তাধারা গবেষণাগারে’র বলতে গেলে সবাই নৌকায় উঠেছে। এখন সকাল সাতটার মতো বাজে। ভোরের কুয়াশা পুরোটা কাটে নি। প্রায় সবার গায়েই সোয়েটার কি চাদর। কারো কারো গলায় মাফলার।

‘আসুইন আসুইন- পথে কুনো কষ্ট অয় নাই তো?’ আবুল হোসেনের দেশের বাড়ি ময়মনসিংহ। বহু বছর ঢাকা জুট মিলে চাকরি করলেও কথা সে বলে ময়মনসিংহের ভাষাতেই।

‘না- না- বেশ ছায়া ঢাকা ত’ তোমার বাড়ি আবুল হোসেন!’ আবুল হোসেনের বাড়ির পেছনে নদীর একটি অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত ঘাট। সেখান থেকে খাড়া বেয়ে উপরে উঠতেই টিনের চাল আর মাটির লেপা-পোছা দাওয়া আর উঠানের ঘর। দাওয়ায় দু’টো বরই গাছ। হাঁস-মুরগী কিছু উঠানের উপর ছড়িয়ে রাখা খুদ-কুঁড়ো খাচ্ছে। বড় উঠানে কিছু চেয়ার পেতে আর মাদুর বিছিয়ে ৪৫ থেকে ৫০ জনের বসার ব্যবস্থা করা হলো। একপাশে একটি চেয়ারে মাও সেতুঙের একটি বড় প্রতিকৃতি টাঙানো হয়েছে। আবুল হোসেন মাথার উপর সামিয়ানার ব্যবস্থাও করেছে। শীতের দিন হলেও দিন ভর সম্মেলন চলবে। কাজেই দুপুরের রোদ যেন অতিথিদের বিব্রত না করে সেদিকেও সে নজর রেখেছে।

‘সবাই সরবত লন-’ আবুল হোসেনের ঘোমটা ঢাকা স্ত্রী লেবু চিনি আর মাটির কলসে রাখা ঠান্ডা পানির সরবত বানিয়েছে।

‘কমরেডস্,

পাকিস্থানী ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণি নিজেরা সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। এ কারণে পাকিস্থান নিজেই একটি আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্তবাদী দেশ। এই পাকিস্থানী ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণি অখণ্ড পাকিস্থান, ধর্মের ভিত্তিতে এক জাতি, তথাকথিত ইসলামী সংস্কৃতি, পূর্ববাংলা একটি প্রদেশ প্রভৃতি প্রচারের মাধ্যমে শোষণের ঔপনিবেশিক চরিত্র গোপন করে। পাকিস্থানী উপনিবেশবিরোধী জাতীয় সংগ্রামে শ্রমিক-কৃষক, ক্ষুদে বুর্জোয়া, মাঝারি বুর্জোয়ার একাংশ এবং দেশপ্রেমিক ধনী চাষী ও জমিদারদের অর্থাৎ সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। কাজেই বর্তমান সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় পূর্ববাংলার জনগণের সাথে পাকিস্থানী উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব।

প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪৭ সালে বৃটিশের উপনিবেশ ভারতবর্ষের বিভক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট ভারত ও পাকিস্থান- এই উভয় রাষ্ট্রই তাদের জন্মলগ্ন থেকে প্রবেশ করেছিল সাম্রাজ্যবাদের নয়া ঔপনিবেশিক অধীনতার প্রক্রিয়ায়। প্রথমাবস্থায় সামন্তবাদের অস্তিত্ব ব্যাপক ও শক্তিশালী থাকলেও সাম্রাজ্যবাদের লগ্নি পুঁজি ও রাষ্ট্র-ক্ষমতায় আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রাধান্যে পাকিস্থানী আমলের মাঝামাঝি সময়ে কৃষিসহ পাকিস্থানের সমগ্র অর্থনীতির প্রধান ধারায় পরিণত হয় পণ্য অর্থনীতি। এই পণ্য অর্থনীতি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের নয়া ঔপনিবেশিক অধীনতায় বিকৃত পুঁজিবাদ…’

‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’-এর থিসিস পাঠ শেষে এখন মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। ‘মাও সেতুঙ চিন্তাধারা গবেষণাগার’-এর সভ্যদের চাঁদায় সম্মেলনে উপস্থিত সবার জন্য খিচুড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবুল হোসেনের বউ একাই এতজন মানুষের খিচুড়ি রান্না করেছে বিশাল দু’টো হাড়িতে। খাওয়ার পর এক দফা চা ও ধূমপানের পর শুরু হয় সদস্যদের ভোটে থিসিস অনুমোদন আর ‘বিপ্লবী পরিষদ’-এর নির্বাচন।

অন্য কমরেডদের সাথে মিলে আবুল হোসেনের স্ত্রীর বানানো চায়ে চুমুক দিতে দিতে রামকৃষ্ণের মনে হয় সে ঠিক করছে ত’? বরিশালের আগৈলঝাড়ায় রামকৃষ্ণের ঠাকুরদা’র বিস্তর জমি-জমা ছিল। পাকিস্থান হবার পর মুসলিম লীগ সরকারের নানা অত্যাচার আর এসি ল্যান্ড অফিসের নানা মিথ্যা মামলায় তাদের অধিকাংশ জমি-জমা নিয়ে কোর্টে মামলা চলছে। রামকৃষ্ণের দুই কাকাই তাদের শরিকের অংশ মুসলিমদের কাছে বিক্রি করে ওপারে চলে গেছেন। রামকৃষ্ণের বাবাই বড় তার ভাইদের ভেতর। দেশভাগের পর পর ভদ্রলোক গোঁ ধরে এদেশে থেকে গেলেও পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বরিশালের নানা জায়গায় বেশ কিছু খন্ড খন্ড দাঙ্গার পর রামকৃষ্ণের তিন বোণকে তিনি ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রামকৃষ্ণের বড় দাদাও ওপারে চলে গেছে। ওপারে গিয়ে সে ঘটি মেয়েও বিয়ে করে ফেলেছে। বাবা মা চাইছে যে রামকৃষ্ণ আর তার ছোট ভাইও ওপারে চলে যাক। বুড়ো-বুড়ি শেষ বয়সে অবশিষ্ট ভিটে জমিতে যদি মুসলিম লীগ গুন্ডাদের হাতে মরেও তাতেও দুঃখ নেই। ছেলে-মেয়েগুলো অন্ততঃ স্বস্তির জীবন যাপন করুক। কিšত্ত রামকৃষ্ণের ছোট ভাই চন্দ্রকৃষ্ণ ঘোরতর আওয়ামি লীগার। বিএ পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ কি ‘পিন্ডি না ঢাকা’ শ্লোগানে সে এখন বরিশাল ব্রজেন্দ্রমোহন কলেজে শেখ মুজিবের উপর থেকে আইয়ুব শাহীর দায়ের করা আগরতলা ষঢ়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে মুখর। মাঝে মাঝে ঢাকায় নাকি খোদ শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাড়িতেও যায়। ফিরে এসে বুড়ো বাবাকে নানা গল্প শোনায়। আওয়ামি লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের ছেলেরা শেখ মুজিবকে এখন নাকি ধরে পড়েছে পূর্ব বাংলার পূর্ণ সায়ত্ত¡শাসন কায়েমের দাবিতে। পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ দিনদিন অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। শেখ মুজিব ত’ পার্টি মিটিংয়ে কি বিভিন্ন জনসভায় এখন একটাই কথা বলেন, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান- আমরা সবাই বাঙালী।’ বাবা হরেন্দ্রকৃষ্ণের তাতে শঙ্কা দূর হয় না, ‘কিন্তু তাতে কি হিন্দুরা সাতচল্লিশ থেকে বেহাত হওয়া সব জায়গা-জমি ছাড়া পাবে? ক না! অ চন্দ্র, তোগো শেখ মুজিব কি হিন্দুগো ভিটে বাড়িতে শান্তিতে থাকতে দেবে? দিতে পারবে? গাছে বেল পাকলে তাতে কাকের কি? তা-ও ত’ তোর কথা আমি কিছু বুঝি। রামকৃষ্ণ যে ঢাকায় কাগো সাথে মেশে, কি করে না করে কিছুই বুঝি না। হিন্দুর পোলা চীন-ভারত যুদ্ধে চীণের পক্ষে! এ ত’ পশ্চিম পাকিস্থানীগো মত কথা-বার্তা!’
‘মেজদার কথা আর কইয়ো না বাবা! মাথাটা পুরা আউলায় গেছে ওর!’

‘কমিটি সিরাজ সিকদারকে সর্বসম্মতিক্রমে বিপ্লবী পরিষদের সম্পাদক নির্বাচিত ঘোষণা করছে। একইসাথে কমিটি শামিউল্লাহ আজমি তাহেরকে বিপ্লবী পরিষদের সহ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করছে।…’

৬. বোকা বুড়ো পাহাড় সরিয়েছিলেন

একটা প্রাচীন চীনা উপকথা আছে, তার নাম ‘বোকা বুড়ো পাহাড় সরিয়েছিলেন।’ এ উপকথায় প্রাচীন কালের এক বুড়োর কাহিনী বলা হয়েছে, তিনি বাস করতেন উত্তর চীনে। উত্তর পাহাড়ের বোকা বুড়ো নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর বাড়িটার দক্ষিণে ছিল দু’টা উচ্চ পাহাড়, একটার নাম থাইহাং, অন্যটার নাম ওয়াংউ। এই দু’টা পাহাড় তাঁর বাইরে যাবার পথ রুখে দাঁড়িয়েছিল। তিনি দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হয়ে এই পাহাড় দু’টাকে কোদাল দিয়ে খুঁড়ে উপড়ে ফেলবার জন্য তাঁর ছেলেদের নিয়ে গেলেন। আর একজন বুড়ো, জ্ঞানী নামে তিনি পরিচিত- এদের দেখে উপহাস করে বললেন, ‘তোমরা কি বোকার মতোই না কাজ করছো! এই বিরাট পাহাড় দু’টোকে খুঁড়ে উপড়ে ফেলা তোমাদের পিতাপুত্র ক’জনের পক্ষেক্ষ একেবারেই অসম্ভব।’ বোকা বুড়ো জবাব দিলেন, ‘আমি মরলে আমার ছেলেরা এ কাজ চালিয়ে যাবে, তারা যখন মরবে তখন থাকবে আমার নাতিরা আর তার পরে তাদের ছেলেরা ও নাতিরা। এমনি চলবে অনন্ত কাল ধরে। পাহাড় দু’টি অনেক উঁচু, কিšত্ত আর তারা উঁচু হতে পারবে না। আমরা যতটুকু খুঁড়ে ফেলব, ততটুকুই তারা নীচু হবে। তা’হলে কেন আমরা তাদের খুঁড়ে সমান করতে পারব না?’ জ্ঞানী বুড়োর ভুল অভিমতটা খন্ডন করে তিনি অবিচল বিশ্বাসের সাথে প্রতিদিন খুঁড়তে থাকলেন। এই দেখে ভগবান মুগ্ধ হলেন, তিনি দু’জন দেবদূতকে পৃথিবীতে অবতরণ করালেন। তাঁরা এসে পাহাড় দু’টাকে পিঠে করে নিয়ে চলে গেলেন। আজ চীনা জনগণের মাথার উপরেও দু’টা প্রকান্ড পাহাড় চেপে আছে। একটা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, আর অন্যটা সামন্ততন্ত্র। এ দু’টাকে খুঁড়ে উপড়ে ফেলবার জন্য অনেক আগেই মনস্থির করেছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। আমাদের অবশ্যই অধ্যবসায়ী হতে হবে এবং কাজ করতে হবে বিরামহীনভাবে, আমরাও তখন ভগবানের মন গলাতে পারবো। আমাদের ভগবান কিšত্ত চীনা জনসাধারণ ছাড়া আর কেউ নন। তাঁরা যদি একযোগে উঠে দাঁড়ান এবং আমাদের সঙ্গে নিয়ে খুঁড়তে থাকেন, তা’হলে এই দু’টা পাহাড়কে উপড়ে ফেলা যাবে না কেন?’

“বোকা বুড়ো পাহাড় সরিয়েছিলেন (১১ই জুন, ১৯৪৫: সভাপতি মাও সেতুঙের উদ্ধৃতি)।”

টেবিলে বসে রেড বুকের এই জায়গাটায় এসে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল সিরাজ। প্রতিভা বোধ করি একেই বলে। কিভাবে মাও সেতুঙ পেরেছেন স্বদেশের উপকথা, রূপকথা, নীতিগল্পকে রূপকের আবরণ সরিয়ে জায়মান বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেখতে ও দেখাতে! সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্র এই বাংলারও দু’টো পাহাড়! সেই পাহাড় দু’টো কেটে ফেলতে হবে বৈকি। ঈশ্বররূপী জনগণকে কি সাথে পাওয়া যাবে না যদি অবিচল বিশ্বাসে রোজ পাহাড় খননে নামা যায়?

‘আপনারে চাইরজন খোঁজে!’ বাড়ির কাজের মেয়ে এসে সিরাজের পড়ার টেবিলে এসে চায়ের কাপ রাখে। গতরাতে শবে বরাত ছিল। আজ তাই অফিস ছুটি। তাতে গোটা সকাল আর দুপুরটা মনমতো পড়াশোনা করা যাবে।

কারা আর হবে? স্টাডি সার্কেলেরই কেউ, মনে মনে ভাবে সিরাজ।

‘ওদের আমার এই রুমেই সোজা আসতে বলো।’
দ্যাখা গেল হুমায়ুন, হামিদ, জলিল আর ইসহাক এসেছ।
‘চা চলবে?’
‘অফকোর্স। সানন্দে।’
‘আমাদের পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের চিকায় ত’ ঢাকার দালান-পাট সব ভইরা গেল। মালিবাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, পুরানা পল্টন, মগবাজার আর বাসাবো’র দালান পাট ত’ সব আমাদের শ্লোগানে ঝলমল করতেছে,’ হুমায়ুন চায়ে টোস্ট ভেজায়।
‘কিšত্ত আমাদের যে টাকা বড্ড কম। দলিল, ইশতেহার, লিফলেট…কত কি ছাপানো প্রয়োজন! ‘লালঝান্ডা’ নামে আমাদের পার্টির একটা পত্রিকা বের করবো ভাবছি আজ কতদিন! তাও ত’ হচ্ছে না! একটা সাইক্লোস্টাইল মেশিন যদি কিনতে পারতাম! কিšত্ত, অনেক দাম!’ হতাশ চোখে তাকায় সিরাজ সাথিদের দিকে।
‘একটা কাজ করলে হয় না?’ জলিল উসখুস করে।
‘কি কাজ?’
‘আমরা যেহেতু সশস্ত্র বিপ্লব করার আশা নিয়েই মাঠে নেমেছি, আমরা কেন আমাদের প্রথম অপারেশন একটা সাইক্লোস্টাইল যোগাঢ় করা দিয়েই শুরু করি না?’
‘কিšত্ত সেটা কিভাবে?’ ইসহাক সপ্রশ্ন চোখে তাকায়।
‘পুরানা পল্টনে ত’ অনেক অফিস আছে। এমন কোন একটা অফিসে গিয়া একটা সাইক্লোস্টাইল ছিনতাই কইরা আনা যায় না?’
‘শেষমেশ ছিনতাই?’ হামিদ একটু ভয়ে ভয়ে বলে।
‘ওরে আমার সাফ-সুতরা, ছিঁচকাঁদুনে মধ্যবিত্ত রে! বৃটিশ বিরোধী স্বদেশী বিপ্লবীরা ত’ সেই সূত্র মানলে সব ডাকাইত ছিল? কিšত্ত সত্যিই কি তারা ডাকাইত ছিল না বিপ্লবী ছিল?’ জলিল উত্তর করে।
‘না- মানে সেটা ত’ ধরো ব্রিটিশের বিরুদ্ধে…’ হামিদ অস্বস্তি নিয়ে বলে।
‘হুঁ…তোমার হামিদ রবীন্দ্র সঙ্গীত আর সাদা পাঞ্জাবি ইহজীবনে ঘুচবে না। বৃটিশ গেছে ত’ কি? ওদের উত্তরসুরী দেশী পুঁজিপতিরা আছে না? তাদের শোষণের বিরুদ্ধেই ত’ আমাদের লড়াই। মতিঝিল কি পুরানা পল্টনের সওদাগরি অফিসগুলোর এই লাখ লাখ টাকার পুঁজি কোত্থেকে আসে? সবই ত’ নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর গরীব জনসাধারণের রক্ত চুষে। কাজেই ওদের সম্পত্তি ছিনতাই করা কোন অপরাধ নয়। এইটা বিপ্লবী কাজ। এই সাইক্লোস্টাইল ছিনতাইয়ের মাধ্যমে যে লিফলেট, ব্যানার, ইশতেহার কি পত্রিকা আমরা ছাপবো সবই জনগণের বিপ্লবী ভাবমানস তৈরিতে ব্যবহৃত হবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?’ সিরাজ উত্তেজনায় হাঁফাতে থাকে, ‘ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া জলিল। সাইক্লোস্টাইল ছিনতাইয়ের এই আইডিয়াকে আমি নিঃশর্ত সমর্থন দিচ্ছি।’

৭.ঘাটের কথা

‘ধান, নদী, খাল/এই তিনে বরিশাল।’
বরিশাল জলের দেশ। চন্দ্রদ্বীপ, বাখরগঞ্জ, বরিশাল…নানা নাম এর। নদীর পর নদী আর খালে খালে সংযুক্ত এই প্রসারিত জলভূমি। এক প্রান্তে সমুদ্র। এ জেলার মানুষেরা আজো রাজধানী বা দেশের অন্যান্য নানা এলাকায় প্রধানতঃ জলপথে যাতায়াত করে। দেশের অন্যান্য শহরের প্রাণকেন্দ্র ছুঁতে হলে আপনাকে যদি যেতে হয় সেই শহরের বাস টার্মিনাল বা ট্রেন স্টেশনে, বরিশালকে বুঝতে হলে আপনাকে যেতে হবে শহরের প্রবেশদ্বার বা নদীঘাটে। ‘ইস্ট পাকিস্থান ইর্ন্টাণাল ওয়াটারওয়ে অথরিটি (ইপিইওডব্লুএ)-র সাইনবোর্ড টানানো এক বড় লঞ্চঘাট আর লঞ্চঘাটের সাথে লাগোয়া ওয়েটিং রুম, প্রচুর কুলি, সকাল আর সন্ধ্যায় দেশের নানা জায়গা থেকে আসা-যাওয়া রত বিশালকায় দোতলা বা তেতলা লঞ্চ আর স্টিমার এই শহরের এক প্রধান দর্শনীয় ব¯ত্ত। এতদিন এখানে মুসলিম লীগ ঘাট শ্রমিক সমিতি আর আওয়ামি লীগ ঘাট শ্রমিক সমিতির পোস্টারই চোখে পড়তো। ইদানীং নতুন আর একটি দলের পোস্টার চোখে পড়ছে। সেটা হলো ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’-এর পোস্টার। আরো যেটা অদ্ভুত তা’ হলো ঘাট শ্রমিকদের ভেতর বেশ কিছু ভদ্রঘরের লেখাপড়া জানা ছেলেও নাকি যোগ দিয়েছে। কিছুদিন আগেও এই ছেলেদের দেখা গেছে ভদ্রলোকের মানে ছাত্রদের মিছিলে অংশ নিতে। এরা হঠাৎ এই ঘাট শ্রমিকদের আন্দোলনে কেন?

‘এই কুলি!’ রামকৃষ্ণ সচকিত হয়ে তাকালো। ভদ্রলোকত্বের মিহি চামড়া এত সহজে কি মুছবার? ঢাকা থেকে তারা জনা দশেক কর্মী আজ মাস চারেক হয় বরিশালে এসেছে এখানকার ঘাট শ্রমিকদের ভেতর আন্দোলন করতে। সিরাজ সিকদার সহ ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’-এর অনেকেরই দেশের বাড়ি বরিশাল বলে বরিশাল ও বরিশাল শহরকে কেন্দ্র করে আশপাশের ঝালকাঠি, ভোলা, গৌরনদী, মেহেন্দিগঞ্জ, বাউফল, মাদারীপুর, গোয়ালন্দ, খুলনা শহর আর খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রামকৃষ্ণের নিজের বাড়িও বরিশাল। ফলে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাটা অনর্গল বলতে পারে সে। ঘাটের কুলিদের ভেতর নিজেদের ‘ভদ্রলোক’ পরিচয়টা গোপন রাখতে আঞ্চলিক ভাষার এই দখল যথেষ্ট কাজে লাগছে। এই ঘাটে রামকৃষ্ণের নাম অবশ্য রামকৃষ্ণ নয়। তার নাম এখানে মাহতাব। এই ঘাট শ্রমিকদের মাঝে অধিকাংশ বা বলতে গেলে একশ’ ভাগ কুলিই মুসলিম। রামকৃষ্ণকে সিরাজ ভাই (সিরাজ সিকদার) তাই পরামর্শ দিয়েছে মাহতাব নামেই এখানে সংগঠনের কাজ করতে। এখানে মাহতাবের সাথে ঢাকা থেকে আরো ন’জন কমরেড এসেছে। তাদের ভেতর ছয়জনেরই বাড়ি বরিশাল। চারমাস আগে তারা দশজন এই ঘাটে এসেছিল। এ চারমাসে বরিশাল ব্রজমোহন বা বি,এম, কলেজের আরো জনা কুড়ি ছাত্র…সবাই পূর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর হতাশ ছাত্র কর্মী…যারা ঢিমেতালা ছকে কাটা বা সোজা কথায় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ে আর একটু দ্রæত গতিতে কিছু করতে চাইছে…এসে মাহতাবদের সাথে যোগ দিয়েছে। ঢাকা থেকে মাহতাবদের কাছে খবর আসছে যে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর ছেলেরা শুধু বরিশালের ঘাট শ্রমিক আন্দোলন না, ঝালকাঠির তাঁত, লবণ, বিড়ি ও ঘাট শ্রমিক, খুলনা আর খালিশপুরের মিল এলাকায়, নারায়নগঞ্জের আদমজী মিল, চট্টগ্রামের চা বাগান শ্রমিক আর দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাঠ মিস্ত্রীদের ভেতর গত দেড় কি দু’বছর ধরে গড়ে তোলা ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’-এ গিয়ে দলে দলে যোগ দিচ্ছে। এরই ভেতর জানুয়ারি মাসে বরিশালের নলচিড়া, রামারপোল, গৌরনদী আর ফরিদপুরের মাদারীপুর মহকুমায় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে চাষীরা তহশিল অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে।

‘এই কুলি!’ ভদ্রলোক আবারো মাহতাবকে ডাকেন।
‘জ্বি, স্যার?’ ভুগোলের ছাত্র রামকৃষ্ণ পাল বা মাহতাব উত্তর করে। এই ঘাটের কুলির কাজ যে তার খুব মন্দ লাগে না তার একটি প্রধান কারণ বোধ করি রাতে ঘাট থেকে আনমনে বা একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মন সহসাই উড়ে যেতে পারে সুয়েজ খাল, উত্তমাশা অন্তরীপ, বেরিং প্রণালীর নিটোল মুক্তো প্রবালে।
দেখা গেল ভদ্রলোকের নিতান্ত হাঁসফাঁস অবস্থা। বউ, দু’জন তরুণী-কিশোরী কন্যা, একটি শিশু পুত্র আর একটা বেডিং, দু’টো স্যুটকেস নিয়ে তিনি ঘামছেন।
মাহতাব নিঃশব্দে হাত লাগায়।
‘আগে কও, কত নেবা?’
‘দুই আনা দেবেন স্যার!’
‘ইসশ্…মগের মুল্লুক নাকি? দুই আনা না- এক আনা!’
‘তাহলে স্যার আমি আসি!’

মাহতাব ভদ্রলোকের দিকে পিছন ফিরে হাঁটা লাগায়।
‘এই- এই কুলি! শোন-’
‘জ্বি, বলেন!’
‘নাও- সাথে মহিলা মানুষ দেখলেই তো তোমরা বোঝ যে এই লোক অসহায় আর দাম চড়াও। নাও…দু’আনাই…বেডিং তোল!’

মাহতাব একটা দম নেয়। দু’আনা করে পার্টি বা ক্লায়েন্ট পেলে দিনে ছ’টি বোঝা টানলেই বারো আনা। বারো আনাই ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’-এর হোল টাইমার কর্মীদের পার ডে বাজেট। এর থেকে বেশি আয় করতেও পার্টির নিষেধ আছে। তাহলে ঘাট শ্রমিকদের ভেতর প্রচারণা আর রাজনৈতিক শিক্ষার ক্লাস, নিজেদের পড়াশোনার সময়, আন্দোলনের পরবর্তী স্ট্র্যাটেজি কখন ঠিক করা যাবে?

মাথায় বেডিং আর দু’হাতে দু’টো স্যুটকেস ব্যালান্স করে মাহতাব যখন ঘাট থেকে বেরিয়ে এসে ভদ্রলোকের পরিবারকে রিক্সায় তাদের মালপত্র তুলে দিতে গেল, একটা স্যুটকেস তার সুন্দরী তরুণী কণ্যার বুড়ো আঙুলের নখে আঘাত করলো।

‘উহ্…এই কুলি, দেখে মাল নামাতে পারো না?’
‘স্যরি আপা- আই এ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি!’ তড়িঘড়ি বলে ওঠে মাহতাব।
‘ওহ্ আল্লা- আবার ইংরেজিও বলছে!’ বলে তরুণী মেয়েটি তার কিশোরী ছোট বোনেরর দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে। আর বেমালুম ঘাবঢ়ে গিয়ে, ঘেমে একসা হয়ে ওঠে মাহতাব। আশপাশে তাকায় সে। সাধারণ কুলিরা কেউ চারপাশে নেই ত? কেউ শুনে ফ্যালে নি ত’ তার ইংরেজি বুলি? আহ্, পাতিবুর্জোয়া শ্রেণি চরিত্র এত সহজে কি ঘুচবার?

রাত দশটার মতো বাজে। এই ঘাটের পাশেই কুলি বস্তির কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়েছে মাহতাবরা। আজ নূরুল হাসানের ঘরে রাতের দলীয় আলোচনা। সেখানেই রাতের খাওয়াও হবে। রোজ রাতে রাঁধতে ইচ্ছে করে না। রোজ ঘাটের সস্তার হোটেলের খাওয়া খাওয়াও যায় না। এত তেল-মশলা থাকে যে পেট গরম হয়ে যায়। নূরুল হাসানের ঘরে টিমটিমে বাতি জ্বলছে কেরোসিনের। আবুল হাসানও আছে সেখানে।
‘দাদা- এই যা- মাহতাব ভাই, আসেন!’

বেশি কিছু করে নি নূরুল হাসান। আলু সেদ্ধ, গরম মুসুরির ডাল, গরম ও ধোঁয়া ওঠা ভাত। একটা বাটিতে মরিচ লাল দু’টুকরো গরুর মাংস নিজের আর আবুল হাসানের মাঝখানে রাখলো নূরুল। মাহতাবের থালায় সে চামচ দিয়ে তুলে দিল একটি ডিম ভাজি।

‘আমার জন্য আবার আলাদা করে ডিম ভাজা ক্যানো? আমি আপনাদের খাবার খেতে পারতাম!’

‘পারলে ত’ পারাই যায়, দাদা! কত কি-ই ত’ আমরা পারতেছি। ঘরে আমাদের সবাইর মা আছে। আমার মা যদি শোনে যে আমি শুওরের মাংস খাইতেছি ত’ মহিলা মারাই যাবে। আপনার ঘরেও মা আছে। বিপ্লব করতে হবে বইলা সব কিছু একবারেই বাদ দেবার দরকার নাই!’

ক্ষুধার্ত মুখে গোগ্রাসে আলু সেদ্ধ মাখা ভাতের দলা তুলতে গিয়ে থমকে গেল মাহতাব। কি বললো নূরুল হোসেন? বিপ্লব করতে হলে সব কিছু বাদ দেবার কি দরকার নাই? কিšত্ত বিপ্লব করতে হলে যে সব কিছু বাদ দিতে হয়!

‘আচ্ছা-সরকারি পুলিশ আর জামাত ইসলামীর গুন্ডারা ত’ আমাদের সমানে হুমকি দিচ্ছে…ঘাট শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন ত’ তারা নির্মূল করবার হুমকি দিছে। সাধারণ ঘাট শ্রমিকরা কিšত্ত খুবই উত্তেজিত। তারা আমাদের সাথে নিয়ে এই অন্যায়ের বিপ্লবে দাঁড়াতে চায়। কি করবেন দাদা?’ আবুল হাসান গরুর মাংসের হাড় তৃপ্তির সাথে চিবাতে চিবাতে বলে।

‘সিরাজ ভাইয়ের চিঠি পাইছি। আজ রাতেই কয়েকটা মলোটভ ককটেল বানাইতে হবে। প্রিপারেশন এমন কঠিন কিছু না। আপনারা বানাইছেন না একবার ঢাকায়?’
‘আপনার বোমা বানানোর হাত দারুণ দাদা! ঢাকার পল্টনে একবার দেখলাম। মশলাগুলা এমন ভাবে মাখেন য্যানো ঝালমুড়ি মাখাইতেছেন- হা-হা-’ আবুল হাসান হাসে।

৮. চন্দ্রদ্বীপ থেকে চট্টলা

পুলিশ আর জামাতে ইসলামী ক্যাডারদের সাথে বরিশালের ঘাট শ্রমিক আর ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’-এর কর্মীদের রাস্তার লড়াইটা দূর্দান্ত জমেছিল। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর ছেলেরাও ঘাট শ্রমিক আর শ্রমিক আন্দোলনের সদস্যদের পক্ষে যোগ দিয়েছিল। সারাদিন ধরে গোটা শহরে খন্ড খন্ড রাস্তার লড়াই চলেছে। মাহতাব-আবুল হাসান-নূরুল হাসানদের বানানো বোমাও দারুণ কাজ করেছিল। কিšত্ত, এর পরপরই বরিশাল শহরের চকবাজার বোর্ডের একটা অপারেশন থেকে গ্রেফতার হয়ে গেলেন ফজলু ওরফে সেলিম শাহনেওয়াজ, শাহীন আলম এবং আরো কয়েকজন। মাহতাব ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল। বিশেষ করে আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর সিএমএলএ বা চিফ মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা নেবার পর থেকে সারা দেশে সমানে বেসামরিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ধর-পাকড়, গ্রেফতার কি জেল-জুলুম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। বরিশালে ঘাট শ্রমিকদের ভেতর পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের লড়াইয়ের খবর দেশের সর্বোচ্চ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কাছে পৌঁছে গেছে। আপাততঃ বরিশাল শহর ছেড়ে দূরে কোথাও কর্মীদের গা ঢাকা দেওয়া দরকার। বরিশালের আশপাশেও ইন্টেলিজেন্স বা ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের স্টাফরা নজর রাখছে। কাজেই গা ঢাকা দিতে হলে দূরে কোথাও যাওয়াই ভাল। চট্টগ্রাম দূরে হলেও সুবিধা হলো রাতের বেলা লঞ্চ সার্ভিসে চুপচাপ যাওয়া যাবে। দু’টো শহরই উপকুলীয় শহর। মাঝখানে বিশাল বঙ্গোপসাগর। পুলিশ তার কমন সেন্স থেকে বরিশালের আশপাশ কি বড়জোর ফরিদপুর অবধি চষবে। চট্টগ্রাম পর্যন্ত খুঁজতে যাবে না। সুতরাং, চট্টলা চলো। চট্টলাই সই। সূর্যসেন প্রীতিলতাদের শহর দেখবারও একটা সুযোগ হলো এই উসিলায়। তবে, সমস্যা হলো বরিশাল থেকে চট্টগ্রামের সমুদ্রপথ অনেকটা লম্বা। এটা ঢাকা-বরিশাল এক রাতের লঞ্চ জার্নি নয়। ঢাকা-বরিশাল ওয়ান নাইট লঞ্চ জার্নি পৃথিবীর মধুরতম ভ্রমণ। বিশেষত যদি ট্যাঁকে পয়সা থাকে ও একটা কেবিন ভাড়া নেওয়া যায়। দোতলা বা তিন তলা লঞ্চের কেবিনের পাশে ডেকে বসে বয় বা বেয়ারাকে বলে মুরগী-পরোটা বা ইলিশ মাছ-ভাত আনিয়ে নিয়ে খেয়ে নদীর জল আর চাঁদ দেখতে দেখতে ভ্রমণ…যদি কখনো বিয়ে করে রামকৃষ্ণ…তবে তার হানিমুন হবে ঢাকা-বরিশাল নৈশ লঞ্চে নববধূকে নিয়ে কেবিনের ডেকে বসে নদী দেখা, ইলিশ-ভাত খাওয়া ও পরে আয়না, এ্যাটাচড্ বাথ আর বিদেশী কম্বল সহ শয্যায় ঘুমানো! এর চেয়ে সুখকর আর কি হতে পারে? কি সব পাতি বুর্জোয়া সুখ কল্পনা! কিন্তু, মনীষাকে এসব বোঝানো বৃথা। অনেক দিন যোগাযোগ নেই। শেষ খবরে জেনেছে মনীষার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ছ’মাস আগে মনীষার শেষ চিঠিতে অনেকটা রাগ ও আক্ষেপের সাথে জানানো হয়েছে যে রামকৃষ্ণের এই ছন্নছাড়া জীবন বদলানোর ক্ষমতা যেহেতু তার নেই, কাজেই সে এখন আলাদা জীবনের কথা ভাবছে। সংসারী হতে চাইছে। চাক না মনীষা। তেমনটা সে চাইতেই পারে। মনীষা বিয়ে করে পাঁচ সন্তানের মা হলেও রামকৃষ্ণ বা মাহতাব এই মূহুর্তে তাকে নিয়ে কল্পনায় ঢাকা-বরিশাল নৈশ লঞ্চের কেবিন ডেকে বসে নদীতে পূর্ণিমা দেখতে পারে। রানী এলিজাবেথকে প্রেমিকা কল্পনায় ভিখিরির কি অসাধ্য? এই কল্পনা করতে পারার ক্ষমতা থাকে বলেই কিনা মানুষ এত কষ্টের পরও গোটা একটা জীবন বাঁচতে পারে! বেঁচেও যায়…

রামকৃষ্ণদের ডেকে ভয়ানক বমি চলছে। বরিশাল-চট্টগ্রাম জলপথে প্রায় তিন দিনের জার্নি। দেড় দিনের মাথায় যাত্রীদের বমি শুরু হয় সমুদ্রের দুলুনিতে। দু’আড়াই দিনে অবস্থা চরমে ওঠে। আজ বিকেলে আড়াই বেলা হলো। কাল ভোরটা পার হলেই দুপুর বারটা নাগাদ তারা পৌঁছে যাবে চট্টগ্রাম। গোটা স্টিমারে এখন বমির অসহ্য ঘ্রাণ। মহিলা ও বাচ্চাদের অবস্থা আরো বেশি খারাপ। তারা থেকে থেকে বমি করছে। বমির গন্ধ আর সহ্য হচ্ছে না। রামকৃষ্ণ সোজা চার তলায় চলে যায়। এটা অনেক বড় স্টিমার। প্রায় জাহাজের মতো। এই চারতলায় শুধু সারেংয়ের কেবিনের পাশে অল্প কিছু খোলা জায়গা। এখানে আর কোন রুম নেই। হু হু সন্ধ্যার বাতাস আসছে। লাল সূর্যটা এখন সমুদ্রের ঠিক মাঝখানে। এখানে বমির গন্ধ নেই। এক ভদ্রলোক তার বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়েটি ভারি মিষ্টি দেখতে। দু’কাঁধে দু’টো বিনুনী। তার ফ্রকের লেসের ঝালর বাতাসে সমানে উড়ছে। বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠে রামকৃষ্ণের। আজ বহুদিন হয় সে ও তার সাথিরা বাড়ি ছাড়া। আরো অনেক অনেক দিন কি একটা গোটা জীবনই পথে পথে, ছদ্মবেশে আর ছদ্মনামে চলে যেতে পারে।

‘অনন্যা, দুষ্টুমি করে না। আমার হাত ছেড়ো না। তাহলে সমুদ্রে পড়ে যাবে!’
ভদ্রলোক হিন্দু না মুসলিম? হিন্দু হলে আসল নামটিই বলবে। মুসলিম হলে বর্তমান গেরিলা জীবনের নাম।
‘আপনার মেয়ের ত’ খুব সাহস। চারতলায় উঠে এইটুকু মেয়ে সমুদ্র দেখছে!’
‘আর বলবেন না। ওর মা, দাদা-দিদি ইয়ে মানে ভাইয়া-আপারা সব বমি করে শেষ…’
‘নমষ্কার। আমার নাম রামকৃষ্ণ পাল। দাদার নামটা কি জানতে পারি? আপনি বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন?’
‘বদলির চাকরি ত’! সাথে আমার তিন ছেলে, দুই মেয়ে আর ওয়াইফ। কি বলবো আমার ওয়াইফ আর সব ক’টা ছেলে মেয়ে পরশু থেকে বমিতে কাতর। শুধু এই ছোটটাই দেখছি লোহার মতো শক্ত। আমার ধাত পেয়েছে। এখনো একবারও বমি করে নি। ওকে উপরে নিয়ে এলাম…একটু ফ্রেশ বাতাস খাওয়াতে। হাজার হোক নিচে এত বমির গন্ধ যে ছোট মানুষ…কখন বমি করে ফ্যালে তার ঠিক নাই!’
‘বাহ্…চমৎকার মেয়ে ত! তুমি কি বড় হয়ে গেরিলা হবে মামণি?’ নিজের মনে কথাগুলো বলে শুধু বাচ্চা মেয়েটির চুলে হাত দিয়ে নেড়ে দেয় সে।

চট্টগ্রামের জে,এম,সেন হল রোডে ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’-এর কিছু কর্মী আগে থেকেই ঘাঁটি গেড়ে ছিল। সেখানে তাদের মেসেই উঠলো মাহতাব আর তার সাথের বরিশাল থেকে আসা আরো কিছু কর্মী। হঠাৎ করে বরিশাল থেকেও কর্মী আসায় পার্টির ফান্ড আরো বেশি ভাগ হতে থাকায় এক/একজন কমরেডের মাথা পিছু এক আনাও জোটে না। কোন কোনদিন সারাদিন উপবাস। তবে, এই জে,এম, সেন হল রোডেই একটি পার্কের মতো জায়গায় চট্টগ্রামের ব্রিটিশ বিরোধী অগ্নিযুগের কিছু বিপ্লবীর আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। পাশেই একটি গলিতে একটি আটপৌরে টিনের ঘরে থাকেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী। তিনি মাস্টারদা সূর্য সেন ও প্রীতিলতাকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। তাদের সাথে একই দলে ছিলেন। মাহতাব একদিন তার সাথে দেখা করে আসে। একদিন পাহাড়তলিতে রেলওয়ের পাশে ইউরোপিয়ান ক্লাবও দেখতে গেল সে যেখানে লেখা থাকত, ‘ওনলি ডগস্ এ্যান্ড ইন্ডিয়ানস্ আর নট এ্যালায়োড।’ প্রীতিলতা পুরুষের পোশাকে এই ক্লাবেই হামলা চালিয়েছিলেন। তারপর ইউরোপীয়দের হাতে অবমানিত হবার হাত থেকে আত্মরক্ষার্থে সায়োনাইড পানের সেই বিষাদ রূপকথা! কিন্তু..কিন্তু…এই ১৯৬৯ সালে মাহতাব হাশিম বা রামকৃষ্ণ পাল এখন কি করে? তার সাথিরাই বা কি করবে? ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে’র কোন কোন হোল টাইমার এর মধ্যেই আন্দোলন ও দল ছেড়ে পালিয়েছে। দিনে এক আনার কমে বাঁচবে কি করে মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্তত তিন বেলা ডাল-ভাতে মানুষ ছেলেগুলো?

‘আমার মনে হয় আপনাদের ভেতর অনেকেই যে লবণ ধোলাই কারখানায় কাজ নিয়েছেন, এতে দৈনিক বা সাপ্তাহিক যে মজুরি মিলবে, তাতে করে পার্টির আর্থিক চাপ কিছু কমবে।’
‘কিšত্ত লবণ কারখানার কাজে সমস্যাও আছে কমরেড! এক হাঁটু লবণপানির ভেতর সারাদিন দাঁড়িয়ে কাজ করতে করতে হাতে-পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়।’
‘আসলে আমরা সবাই ত’ মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসছি,’ সিরাজ বিষন্ন হাসে, ‘চাইলেও একদিনেই ছোটলোকদের মতো সব কষ্ট আমরা অভ্যাস করতে পারব না। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন-এর সবাই যে অসম্ভব কষ্ট করছে…আমি জানি আপনাদের কারো কারো এখানে রাস্তার পাশে কি বনজঙ্গলের লতা-পাতা পর্যন্ত সিদ্ধ করে খেতে হচ্ছে। পার্টির তহবিল চাপ কমাতে আপনারা কেউ পাহাড়-জঙ্গল থেকে বেত আর বাঁশ কেটে এনে বিক্রি করছেন। কেউ বা মাটি কাটছেন। হোটেলে বয় বেয়ারা এমনকি বাড়িতে চাকরের কাজও করছেন কেউ কেউ। এই ফিজিক্যাল আর মর‌্যাল স্ট্রাগল বলতে বা শুনতে যত সুন্দর…বাস্তবে করাটা ততটাই কঠিন। তবু আমার অনুরোধ যত কষ্টই হোক আপনারা হাল ছাড়বেন না। লড়াই চালিয়ে যান!’
‘আপনি যে সরকারী ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আমাদের এখানে…এই চট্টগ্রাম এলাকায় চলে এলেন…আপনি কোথায় কাজ করবেন? লবণ কারখানায়?’
‘না… আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করবো ভাবছি। এই এরিয়াটার উপর বিশেষ ব্যক্তিগত আগ্রহ আছে আমার। সমতল পূর্ব বাংলার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হিল ট্র্যাক্টসের ভূ-প্রকৃতি আর জনবিন্যাস। ১৯০০ সালে বৃটিশ এই এলাকাটাকে ‘দ্য হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়াল-’এর মাধ্যমে স্বতন্ত্র এলাকা হিসাবে স্বীকৃতি দিছিল। এখানকার চাকমারা বৃটিশ আমলের শুরুতে বিখ্যাত কার্পাস বিদ্রোহ করছিল। অবশ্য বর্তমান পাকিস্থানী শাসক শ্রেণীর সাথে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সম্পর্ক বেশ ভাল। আমাদের মতো সরকার বিরোধী বিপ্লবীদের তাই উচিত হবে তুলনামূলক আরো অনেক বেশি অনগ্রসর আর প্রান্তিক যে ইন্ডিজেনাস গ্রুপগুলা আছে…চাকমা আর মারমারা বৌদ্ধ আর মোটামুটি লেখা-পড়া, টাকা-পয়সায় তুলনামূলক অগ্রসর। ত্রিপুরারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী আর তাদের অবস্থাও একদম খারাপ না। ইন্ডিয়ার সাথে মিজোরাম সীমান্তে যে বম বা লুসাইরা থাকে… তাদের ভেতর মিশনারিরা এসে খ্রিষ্টান করতেছে বলে বম বা লুসাইরাও কিছু টাকা-পয়সা বা শিক্ষার মুখ দেখতেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হইলো ম্রো বা মুরংদের। পাহাড়ের একদম ভিতরে এরা থাকে। এদের মেয়েরা আজো টপলেস। ছেলেরা চুলে ফুল গোঁজে…যুবক হয়ে উঠলে চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়। এদের সেরকম কোন নির্দিষ্ট ধর্ম নাই। আগে তারা নিজেদের মতোই একরকম ছিল। ইদানীং পাকিস্থান ট্যুরিজমের কল্যাণে সো-কলড্ সভ্য মানুষরা তাদের ভেতর যাচ্ছে…তাদের মেয়েদের এ্যাবিউজ করতেছে যেহেতু ওদের কালচারে নারী কি পুরুষ সবাই টপলেস। আমার মনে হয় সবচেয়ে প্রান্তিক এই মানুষগুলার ভেতর আমরা যদি কাজ শুরু করতে পারি…গোটা হিল ট্র্যাক্টসে আজো প্রাইভেট প্রপার্টি বা প্রাইভেট ল্যান্ডের কোন কনসেপ্ট নাই…ল্যান্ড বিলঙস্ টু দ্য কম্যুনিটি…তবু, চাকমা কি মারমাদের ভেতর একটু একটু করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির কনসেপ্ট ঢুকতেছে…ম্রো’রা এই দিক দিয়া আজো এনশিয়েন্ট কম্যুনিজম একশ’ ভাগ ফলো করে…তাহলে সেখানেই যাই না ক্যান? ব্যক্তিগত মালিকানা আর পরিবার ব্যবস্থার আগে যে আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছিলো বইলা এঙ্গেলস বলছেন, হেনরী লুই মর্গ্যানও যা বলছেন…আমার দেশেরই এক কোণে যখন সেই সমাজ আছে সেইটা চাক্ষুষ দেখি, তাদের সাথে মিশি আর তাদের ভেতর সংগঠন গড়ার চেষ্টা করি! ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সমূহ সম্পর্কে লেনিনীয় দৃষ্টিভঙ্গিই হবে আমাদের সংগঠনের কাজের ভিত্তি।’

৯. পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যায় মুরং মেয়ে…

গোটা সাইখ্যই পাড়া ম্রো গ্রামে ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারে সত্তর বছরের বুড়ো সাইখ্যই আর তার চল্লিশ বছরের ছেলে নিয়া পিউ। বাংলা পারার কারণও আছে। সাইখ্যই বা এ গ্রামের সর্দারের নামেই গোটা গ্রামটির নাম। নিয়া পিউ তার ছেলে। সাইখ্যই আর নিয়া পিউ-এর নেতৃত্বেই শীতের শেষে বান্দরবানের থানচি বাজারে কার্পাস, পাহাড়ি কুমড়া, শসা, মারফা, তিল, ভুট্টা আর আদা বেচতে যায় এ গাঁয়ের অন্য পুরুষেরা। মেয়েরা এ গ্রামে একদমই বাংলা বলতে পারে না। তবে, পুরুষদের মাঝে সাইখ্যই আর নিয়া পিউ ছাড়াও ম্যান ইয়ং, কোন রুই, লা পো, নে নুম আর অং নে-ও গোটা পাঁচেক হতে দশেকের মতো বাংলা শব্দ বলতে পারে। পুরুষেরা যেহেতু হাটে-বাজারে যায়, বাঙালীদের সাথে বেচা-কেনা, দেন-দরবার করতে হয়, ফলে তাদের বাংলা পারতে হয়। মেয়েদের সে বালাই নেই। এদের মেয়েরাও বড্ড পরিশ্রমী। বান্দরবান এম্নিতেই পাহাড়ের তিন/তিনটি জেলার ভেতর সবচেয়ে দুর্গম। গ্রামের মতো ছোট্ট, মূল জেলা শহর ছাড়ালেই শঙ্খ নদী পার হলে ওপারে রুমা বাজার। রুমা বাজার থেকে আরো ভেতরে থানচি পার হয়ে বম আর লুসাই গ্রামগুলো ছাড়িয়ে তবে এই সার সার ম্রো গ্রাম। এই উঁচু পাহাড়ি এলাকায় উঠতে সিরাজের মতো অনুর্ধ ত্রিশ যুবককেও লাঠি বেয়ে চলতে হয়। অথচ, তরুণী মেয়েগুলোকে দ্যাখো? শুধু কি তরুণী মেয়ে? মাঝবয়সী, বৃদ্ধা এমনকি গর্ভবতী মহিলারা পর্যন্ত কাঁধে জল ভরা কলস বা পিঠে বেতের ঝুড়িতে এক মণ/ দুই মণ কাঠ নিয়ে মাইল মাইল পাহাড়ের পাকদন্ডি বেয়ে আসা-যাওয়া করছে। তবে, ইদানীং সভ্য মানুষদের ভয় পেতে শিখেছে এরা। সিরাজ ও তার সাথিদের মতো শার্ট-প্যান্ট পরা, শ্যামলা আর কাটা কাটা নাক-চোখের বাঙালীদের দেখলেই এদের মেয়েরা ইদানীং সঙ্কোচে কুঁকড়ে যায়। অনেকেই দু’হাত জড়ো করে টেনে আনে তাদের খোলা বুকের সামনে। অবশ্য শুরুতে যে ভয় আর সন্দেহ এদের ছিল, গত ছ’মাসে সেই ভয় আর সন্দেহ অনেকটাই দূর করতে পেরেছে সিরাজ আর তার সাথিরা।

‘ছাহেব- চা নেন,’ মিষ্টি গলায় বললো নিয়া পিউ। এটা ডিসেম্বর মাস। গোটা পাহাড় জুড়ে ভয়ানক শীত। সিরাজের গায়ে সাদা, গোলাপী আর কালো রঙের বিচিত্র ডোরা কাটা একটা চাদর। পাশের বম গ্রামের হেডম্যান তাকে দিয়ে গেছে সপ্তাহ খানেক আগে।

নিয়া পিউয়ের স্ত্রী…বছর পঁয়ত্রিশ বয়স…সিরাজের সামনে চা রেখে যায়। হ্যাঁ, সভ্যতা এখন ট্রানজিস্টার বা চায়ের কাপ হিসেবে এই দুর্গম পাহাড়ি জাতির সর্দারের বাড়িতে অন্তত: অল্প অল্প ঢুকে পড়েছে। ছ’মাসের মতো এদের মাঝে থাকা হলেও উন্মুক্ত নারী বক্ষের সামনে দৃষ্টি নত রাখার অভ্যাস সিরাজের আজো কাটে নি।

‘একটা কথা বলবো ছাহেব?’ ম্রো গ্রামে একমাত্র তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা স্কুলে পড়ার বিদ্যা সম্পন্ন নিয়া পিউ বলে।
‘হ্যাঁ, বলো না নিয়া পিউ।’
‘এই আপনারা- বাঙালী বা ফোরেনার যারা আসেন…ফোরেনাররাও ক্যামেরা নিয়া আসে…আমাদের মেয়েদের দেখলে দুই রকম ব্যবহার তাদের…এক দল বাজে কাজ করতে চায়…চেষ্টা করে সুযোগ খোঁজার…কখন ‘ছড়া’য় (ঝর্ণায়) আমাদের মেয়েরা গা ধুইতে যাবে ত’ তাদের ছোঁবার চেষ্টা করে ঐ শয়তানেরা…আর একদল বেছি ভদ্র…এই আপনার মতো…আচ্ছা আপনি আমার বউ বা যে কোন আমাদের জাতের মেয়েকে দেখলেই চোখ নিচু করেন কেন? এতে ওরাও যে লজ্জা পায়! আমার বউ আপনার সামনে আসতে চায় না! আপনি একদম ছাভাবিক থাকেন না কেন? আপনারা ও দু’টা জিনিষ এত লজ্জা পান কেন? সব মেয়েরই ত’ আছে। আপনার মায়ের ছিল…আমার মায়ের ছিল…তাদের দুধ খেয়ে বড় হইছি আমরা সবাই…আপনারা ক্যানো ওটা কাপড় দিয়া ঢাকতে চান? ও দু’টা ত’ খুব গর্বের জিনিস…পবিত্র জিনিস…মায়ের বুকের দুধ ছাড়া কেউ বাঁচে? সেইটা দেইখা আমার ক্যানো খারাপ ইচ্ছা হবে? আমি ত’ সম্মান করবো ঐ দুইটা দেখলে! ছাহেব?’

চমকে ওঠে সিরাজ! এভাবে ত’ ভাবে নি সে। আদিম সাম্যবাদী ও মাতৃতান্ত্রিক না হলেও অ-পুরুষতান্ত্রিক এই ম্রো সমাজে নারীর নগ্ন বক্ষ তবে পুরুষের কামনা বা লালসার বিষয় নয়…নিষিদ্ধ আর ঢেকে রাখার ব¯ত্ত নয়…বরঞ্চ সন্তানকে স্তন্য দিয়ে, মানব প্রজন্মকে বড় করে তোলার পবিত্র কাজটি হয় বলে উন্মুক্ত স্তন কি এই সমাজে পবিত্রতা ও সম্মানের প্রতীক? হ্যাঁ, তাই-ই তো হবে! এ সমাজের ছেলেরা কখনো সখনো উর্দ্ধাঙ্গে কাপড় ব্যবহার করলেও মেয়েরা করে না। ঢাকা থেকে টোকিও-টরন্টো-দিল্লি-নিউইয়র্ক-কায়রোর যে কোন রাস্তায় কোন নারী উন্মুক্ত বক্ষে বের হবার কথা…ওরে বাবা…ভাবাই যায় না! হয় সেই নারীকে হত্যা করা হবে, পাগল ভেবে পাগলাগারদে বা ব্যভিচারিনী ভেবে জেলে পোরা হতে পারে, এক হাজার পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তার উপর বা এক নারীর উর্দ্ধাঙ্গ প্রদর্র্শনীর অপরাধে কয়েক হাজার নারী এক বিকেলে বলাৎকার হতে পারে তাদের স্বজাতির জনৈক সদস্যা দ্বারা সামগ্রিক ভাবে পুরুষ জাতির চিত্ত চাঞ্চল্য ঘটানোর অপরাধে…সবচেয়ে বড় কথা একদম বেহেড পাগল ছাড়া কোন মেয়ে সাহসই করবে না… সভ্য সমাজে পতিতাকেও রাস্তায় খদ্দের ধরতে হয় রেখে-ঢেকে… প্রাচ্যদেশে বাতাসে কোন মেয়ের শাড়ির আঁচল বা ওড়না এতটুকু উড়লে বা সরে গেলে, পশ্চিমে নারীর স্কার্ট হাঁটুর উপরে উঠলে ধর্ষণ আজো আদালতে বৈধ হয়ে যায়…আর এই ‘অসভ্য’ বলে যাদের আমরা ভাবি…এই ম্রো সমাজে দিনের পর দিন সুস্থ, স্বাস্থ্যবতী যুবতীরা উন্মুক্ত বক্ষে একটি জীবন এদের পুরুষদের পাশে চলা-ফেরা করে কাটিয়ে দেয়…অথচ, ‘ধর্ষণ’ শব্দটি এদের অভিধান বা মনোজগতে নেই। কিছু হলেও তা’ পরষ্পরের সম্মতির ভিত্তিতে। নারীর উপর বলপ্রয়োগের ব্যপারটি এদের অজানা। কিকরে সম্ভব? ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা নেই বলেই কি কোন রকম কোন দখলদারিত্ব, বলপ্রয়োগের ধারণাও এদের নেই? ‘সভ্য’ সমাজে কথায় কথায় নারীকে প্রহার, ধর্ষণ, আক্রমণ বা এমনকি পুরুষের সাথেও পুরুষের এই লাগাতার মারপিট, পারষ্পরিক শঠতা, জুয়াচুরি, ছলনা…এসবই কি বন্ধ হয়ে যাবে যদি ব্যক্তিগত সম্পত্তি তুলে দেওয়া যায়? মানুষে মানুষে সমতা বা সবার ক্ষুধা নিবৃত্তি নয়…অপরাধ হতে মানব জাতিকে মুক্তি দেবার জন্যও কি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা কি খুব জরুরী নয়? কিšত্ত, এই ‘আনডুয়িং’ কি করে সম্ভব? যে মানুষ ব্যক্তিগত সম্পত্তি আর সম্পত্তির জন্য পারষ্পরিক ভ্রাতৃ বিবাদ থেকে শুরু করে গোত্র কলহ, জাতিগত সঙ্ঘাত বা বিশ্বযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গেছে, যে মানুষ গণহত্যা আর গণধর্ষণের উপর দাঁড়িয়ে বিজয়ের হর্ষোৎসব করে…তাকে সাম্যবাদ দিলেই বা অতীতের নেশা ধরানো অপরাধ প্রবণতা সে আন ডু করতে রাজি হবে কেন?

নিয়া পিউয়ের বাসা থেকে নিচের দিকে তাকালেই পাহাড়ের ঢাল নেমে আছে। শীতের কুয়াশায় সেই পাহাড় আরো নীল। একদল তরুণী সেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে চলেছে হাসতে হাসতে। নাভির নিচ থেকে হাঁটু অবধি পাহাড়ি ডুরে স্কার্ট। উন্মুক্ত গলা, কাঁধ ও বুক। সবার স্বচ্ছ, পীতাভ ত্বক। কারোর শরীরে এতটুকু মেদ নেই। স্বাস্থ্যে আর সৌন্দর্যে টলটল করছে। প্রকৃতি আর আজো আদিম সাম্যবাদী এই সমাজের সন্তান সন্ততিদের ভেতর বিপ্লবের কাজ করা যাবে কি? বারান্দায় সিরাজের বসার জন্য একটা বেতের টুলের ব্যবস্থা করেছে নিয়া পিউ। সেখানে বসে ডায়েরি খোলে সিরাজ। কলম খামচে ধরে ভাবে কিছুক্ষণ। তারপর তার মুখে ফুটে উঠে হাসি। বহুদিন পর কবিতা এলো কি তার হাতে?

পাহাড়ের
ঢাল বেয়ে
নেমে যায়
মুরাং মেয়ে।
অঙ্গে তার ছোট্ট আবরণী!
কী নিটোল স্বাস্থ্যবতী!
কবে তার কাঁধে-
শোভা পাবে
রাইফেল একখানি!

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত