রম্য রচনা: শ নিয়ে শত কথা । তাপস রায়
শত কথা আছে, শতবার শুনেও মনে থাকে না। মেনে নিলেও অনেক সময় মনে নেওয়া যায় না বলেই এই স্মৃতি দুর্বল্য। এখানে বল শেষ কথা নয়, কথা ওই ঘাড়ের রগে! রগ ত্যাড়া হলে ন্যাড়া বারবার বেলতলা যাবে আর বলবে তাতে ব্যাটা তোর কী? আবার এমন কিছু কথা আছে, মন শতবার শুনতে চায়। শুনতে শুনতে কথায় কান উপচে পড়ে, তবু প্রাণ ভরে না।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা। পাকিস্তানকে হারাতে পারলেই বাংলাদেশের ফাইনাল নিশ্চিত। জনে জনে তুমুল উত্তেজনা।স্টেডিয়ামে বাঘের গর্জন। গ্যালারিতে বে অব বেঙ্গলের ওয়েভ। এর আগে টিকেট নিয়ে দেশজুড়ে সিডর বয়ে গেছে। সেই ধাক্কায় স্টেডিয়ামের বাইরে ছিটকে গেছেন দুলাভাই। ঘটনা হলো, শালা দুলাভাই খেলা দেখতে এসেছে। কিন্তু ভাগ্যজোড়ে টিকেট মিলেছে একটি। আর তাতেই শালা ইন, দুলাভাই আউট। খেলা শেষে দুলাভাই ফোন দিলেন শালাকে খেলার খবর কী? অপরপ্রান্তে শালা তখন হিপ হিপ হুররে মুডে! সে হিপ দুলিয়ে কণ্ঠে হি হি হি তুলে কোনোমতে বলল, দু-লা-ভাইইই, পাকিস্তান হাইরা গেছে!
তাই নাকি?
হ্যাঁ, পাকিস্তান হাইরা গেছে!
সত্যি?
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, তিন সত্যি। পাকিস্তান হারছে!
সত্যি বলছিস?
এবার শালার মেজাজ গেল বিগড়ে। সে খ্যামটা থামিয়ে খেঁকিয়ে উঠল তাইলে কি আমি মিথ্যা বলতেছি? দুলাভাই নরম সুরে বললেন, রাগছিস কেন? শুনতে ভালো লাগছে তাই বারবার জানতে চাচ্ছি। ছোটবেলায় একটু ভুল অথবা অবাধ্য হলেই নির্ধারিত কিছু শাস্তি ছিল। স্কুলে স্যার গুনে গুনে নামতা পড়াতেন একে শূন্য দশ, দশে শূন্য শও।
আমি একদিন সঙ্গে জুড়ে দিলাম একে শূন্য দশ, দশে শূন্য শও, বাড়ি মুখো হও। অর্থাৎ ছুটি। স্যার শুনে ফেললেন। শাস্তিও দিলেন ওই শ’য়ের হিসাবে। গাদা বন্দুকের মতো গর্জে উঠে বললেন, একশ বার কান ধরে ওঠ-বস কর। এ আর এমন কী! আমি ডোন্ট মাইন্ড মুডে শুরু করলাম। কিন্তু বিশের ঘরে গিয়ে মনে হলো এর চেয়ে গণিতে একশতে একশ পাওয়া ঢের সহজ। শত চেষ্টা করেও ত্রিশের কোঠা পার হতে পারলাম না। ইনজুরিতে পড়ে গেলাম।
অধমের শাস্তি মওকুফ হলো। কিন্তু একশ এড়ানো গেল না। স্যার সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, এই ফাজিলের কাছ থেকে তোরা সব সময় একশ হাত দূরে থাকবি!
বড় হয়ে দেখেছি বাস, ট্রাকের পেছনে ঠিক এই কথাটাই লেখা থাকে একশ হাত দূরে থাকুন।
আজীব ব্যাপার! জন্ম থেকেই বাস ও ট্রাক যেন দুজনে দুজনার। মুখোমুখি হওয়ার জন্য তারা সব সময় মুখিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে পাঁচশ হাত দূরে থাকলে দোষ কোথায়? গুরুজনেরা প্রায়ই আশীর্বাদ করে বলেন, শতায়ু হও। এই ডালডা, পামওয়েলের যুগে একশ বছর বেঁচে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। তবুও মানুষ শত বছর বাঁচতে চায়। কবিগুরু লেখেন : আজি হতে শতবর্ষ পরে…
একবার এক রোগী ডাক্তারের চেম্বারে এসে বললেন, সে অন্তত একশ বছর বাঁচতে চায়। কিন্তু চাইলেই তো হবে না। ইঞ্জিনে ময়লা জমেছে। শীতের রাতে ঘরঘর শব্দ করে। পার্টসগুলো ক্ষয় হয়েছে। পৌরসভার রাস্তা ভরাটের মতো প্রতিবছরই দাঁতের গোড়ায় নতুন মাটি ফেলতে হয়। সে ডাক্তারের কাছে আসল কথাটা জানতে চায়Ñ ডাক্তার সাব, আপনার কী মনে হয়, আমি একশ বছর বাঁচব?
ডাক্তার সাহেব পাল্টা প্রশ্ন করেন, এখন আপনার বয়স কত?
পঁয়তাল্লিশ।
আপনি মদ খান?
না।
আপনি অন্য কোনো নেশাটেশা করেন?
না।
আপনি ঘুষ খান?
না।
আপনার মেয়ে মানুষের দোষ আছে?
না। তাহলে আপনার একশ বছর বেঁচে থেকে লাভ কী? ডাক্তার সাহেব কিছুটা বিরক্ত হয়েই যেন পাল্টা প্রশ্ন করেন। আমি জানি একশ জনকে ডেকে এই প্রশ্নটি করলে একশ জন একশ রকম উত্তর দেবেন। শ নিয়ে শেষে শত কথা হবে। হওয়াই উচিত। কারণ একশ মানেই একটা মাইলস্টোন।
সেই ছোট্টবেলাতেই শিখিয়ে দেওয়া হয়, একবার না পারিলে দেখ শতবার। অর্থাৎ ট্রাই অ্যান্ড ট্রাই এগেইন। কিন্তু এটা শতবার বলেও আপনি বোঝাতে পারবেন না যে, ট্রাই পরিকল্পনামতো, সঠিকভাবে না হলে জীবন ফ্রাই হতে বাধ্য। কারণ প্র্যাকটিস মেকস এ ম্যান পারফেক্ট কথাটি অর্ধসত্য। পূর্ণসত্য এই পারফেক্ট প্র্যাকটিস মেকস এ ম্যান হান্ড্রেড পার্সেন্ট পারফেক্ট।
আমাদের বাচ্চাদের জানিয়ে দেওয়া হয় প্রয়োজনে হরলিক্স খাও তবুও স্কুল পরীক্ষায় একশতে একশ পেতেই হবে। শুধু একশ পেলেই হবে না, স্কুলে উপস্থিতির হারও শতভাগ হতে হবে। তবেই না ভালো ছেলে। এই ভালো ছেলে হওয়ার আরো কিছু শর্ত আছে। স্বাস্থ্য রাখতে হবে শতভাগ ফিট। এ জন্য চাই খাঁটি গরুর শতভাগ খাঁটি দুধ। অর্থাৎ এখানেও একশ। ক্রিকেটে যে যত বড় ব্যাটসম্যান তার তত সেঞ্চুরি। ব্যাটসম্যান নব্বইয়ের ঘরে গিয়ে আউট হলেই ইস্! নিরানব্বই করে আউট হলে সবটাই মাটি। বাসে উঠলেই দেখা যায় লেখা থাকে একশ, পাঁচশ টাকার ভাঙতি নেই। বিশ টাকার নোট দিলেও অনেক সময় শুনতে হয় শত কথা; বিষতুল্য আবদার ভাই ভাঙতি দ্যান।
ভাঙতি নাই।
ভাঙতি না নিয়া গাড়িতে ওঠেন ক্যান?
ঐ ব্যাটা, তর কাছে জিগাইয়া গাড়িতে উঠতে হইবো?
ব্যস, এক সময় দেখা যায় পুরো বাসযাত্রীদের বিপক্ষে র্যাম্বোর মতো কন্ট্রাক্টর ব্যাটা একাই একশ। সে চাপার জোড়ে লড়ে যাচ্ছে।
দাদা, কম দিলেন ক্যান? আরও এক ট্যাকা দ্যান।
এক টাকা মানে একশ পয়সা। সে দাবি ছাড়তে নারাজ। ওদিকে শতবার বললেও যাত্রীর কানে কথা ঢুকছে না। যাত্রী উল্টো বলছে, ওই ব্যাটা ড্রাইভার, গাড়ি জোড়ে চলে না? একশ একশ চালা ব্যাটা ফাজিল! অনেকেই আছেন, যারা কথায় কথায় বাজি ধরেন। এই বাজিতেও একশ’র ভ‚মিকা আছে। বন্ধু মহলে খাদক হিসেবে মোস্তাকের সুনাম ও দুর্নাম দুই-ই আছে। এক বসায় গোটা ত্রিশেক পরোটা পাপড়ের মতো খেয়ে ফেলার রেকর্ড তার আছে। বাশারের দোকানের আধুলি সাইজের ডালপুরি দেখে একদিন সে বলেই ফেলল, হ্যাহ্, এই পুরি একশ খাওয়া কোনো ব্যাপার না। মুহূর্তেই পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়ে গেল। এক পক্ষের ধারণা মোস্তাক পারবে। অপর পক্ষের ঘোষণা পারলেই একশ টাকা পুরস্কার।
মোস্তাকের সামনে গামলা ভরে পুরি রাখা হলো। তেলে ভাজা গরম পুরি।
শুরু হলো খাওয়া। এক দুই তিন করে এক বসায় ছিয়ানব্বইটা পুরি খেয়ে মোস্তাক সবাইকে হতাশ করে রণে ভঙ্গ দিলো। আর মাত্র চারটা খেলেই খেল খতম; একশ! মোস্তাককে এ কথা কিছুতেই বোঝানো গেল না। উল্টো দুই হাতের দশ আঙুল টান টান করে চোখের সামনে ঝাকিয়ে বলল, অ্যানাফ ইজ অ্যানাফ!
আমরা জানলাম, নো কা মতলব নো-হি হোতা হ্যায়।
এভাবে তীরে এসে তরি ডুবিয়ে দেওয়ার রহস্য কী? অবাক হয়ে মোস্তাকের কাছে জানতে চাইতেই সে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলল, তোরা কি আমাকে রাক্ষস মনে করিস? আমি রাক্ষস অ্যাঁ! এরপর বন্ধু মোস্তাকের দেখা নেই তিনদিন। বাসায় ফোন করতেই তাকে পাওয়া গেল। মোস্তাকের ক্লান্ত গলা দোস্ত, নেটওয়ার্ক লুস হয়া গ্যাছে। একটু পর পর মিসকল দেয়। খালি যাই আর আসি। এ কথা শুনে আকাশের তারা গোনার মতো প্রমাদ গুনলাম। ফোনের এপাশ থেকে নাক চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, আজ কতবার হয়েছে? ওপাশ থেকে বিধ্বস্ত গলায় মোস্তাকের উত্তর তা একশ তো হবেই।
শ নিয়ে শত কথা বলছিলাম। আমি এক শ’য়ের কথা জানি যিনি সুশ্রী ছিলেন না বলে জীবনে শতবার বিশ্রী কথা শুনেছেন। নোবেলজয়ী আইরিশ এই লেখক একবার এর মোক্ষম জবাব দিয়েছিলেন। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ইসাডোরা ডানকান একবার জর্জ বার্নার্ড শ’কে প্রস্তাব দিয়ে লিখলেন: আমাদের বিয়ে হলে তা হবে আদর্শ। কারণ আমাদের সন্তান দেখতে হবে আমার মতো, আর বিদ্যাবুদ্ধিতে হবে তোমার মতো। ফিরতি চিঠিতে শ লিখলেন: উল্টোটাও হতে পারে। যেমন ধরো, বিদ্যাবুদ্ধিতে তোমার মতো, দেখতে আমার মতো।
এরপর ইসাডোরা শ’য়ের সন্তানের মা হওয়ার বাসনা ত্যাগ করেছিলেন কিনা জানি না। তবে আরেকজন শ’য়ের কথা শত শত বছর আমাদের মনে থাকবে। বাংলাদেশের পক্ষে ভারত কেন দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে না। একাত্তরে শতদিক থেকে যখন শতলোকে এ প্রশ্ন তুলছিল, তখন তিনি ঠান্ডা মাথায় ইন্দিরা গান্ধীকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বর্ষায় নয়, শীতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযান করলে জয় সুনিশ্চিত। একেই বলে শত বুদ্ধির এক বুদ্ধি। এই শ আর কেউ নন, ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ।

কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক