ঈদ সংখ্যার ভ্রমণ : কাঠগোলাপের দেশে । ক্ষমা মাহমুদ
সিংগাপুর এয়ারলাইনসের বিমানটি ঢাকা থেকে সিংগাপুর চার ঘন্টায় পৌছে, দুই ঘন্টা ট্রানজিট শেষে আরও দুই ঘন্টা উড়ে উড়ে অবশেষে ভারত মহাসাগরের নয়নাভিরাম নীল পানির উপর দিয়ে ধীরে ধীরে যখন নামতে লাগলো, বিমানের ঠিক জানালার পাশের আসনটিতে বসে ‘আমি ভালোবাসি মেঘ… চলিষ্ণু মেঘ… উঁচুতে… ঐ উঁচুতে, আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল’ এ নিমগ্ন আমি হঠাৎ চমকে উঠে ভাবলাম, একি প্লেনটা পানির মধ্যে নেমে যাচ্ছে কেন! নিঃশ্বাস বন্ধ করে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখলাম, না, পানিতে না, পাশেই মাটি মানে রানওয়ে, একেবারে গায়ে গা লাগানো তাদের মনোরম মিতালি। আসলে বালির রাজধানী ডেনপাসার এর এই উরাহ্ রাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ( Ngurah Rai International Airport, উচ্চারণটা খটমট, ngটা সাইলেন্ট থাকে) অবস্থানটি এরকমই, রানওয়ের বেশকিছু অংশ ভারত মহাসাগরের মধ্যে পড়েছে, নামার সময় তাই মনে হয় বিমানটা বুঝি আত্মঘাতী হয়ে সমুদ্রেই নেমে পড়লো। বালির অনেক জায়গা থেকেই দেখে মনে হয়, একটু পর পরই বিমান পানির মধ্যে এসে নামছে, আবার পানির মধ্যে থেকে উঠে নানান দিকে উড়ে যাচ্ছে। এই ছোট্ট, সুন্দর, কোলাহলহীন বিমানবন্দরের অবস্হানটা তাই এই সুন্দর শহরের অন্যতম আকর্ষন।। পুরো দ্বীপটাই ভারত মহাসাগর এর নীল পানি পরিবেস্টিত অপূর্ব, মোহনীয়, শান্ত, স্নিগ্ধ এক শহর!
যাহোক as smooth as silk ছোটবেলা থেকে শুনে আসা সিংগাপুর এয়ারলাইনসের টিভি বিজ্ঞাপনের সত্যতা একশো ভাগ সত্যি প্রমাণ করে চোখ জুড়ানো ডানা দুটি খুবই মোলায়েম ভাবে নেমে এসে প্রায় শূণ্য ঝাঁকুনিতে আলতো করে রানওয়ে স্পর্শ করলো। প্লেনের ল্যান্ডিং তো অনেকই দেখা হয়েছে কিন্তু এই অবতরণটি জীবনের অন্যতম সুন্দর এক অভিজ্ঞতা হয়ে চীরস্থায়ী ভাবে মনের মধ্যে গেঁথে রইলো আর পুরো ব্যাপারটার সৌন্দর্যে মনটা এক সুখানুভূতিতে ছেয়ে থাকলো।
ঢাকা থেকে অন এ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে এসেছি। অনেক টুরিস্ট এসে নামলেও প্রায় নীরব এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনে কোন ঝামেলাই পেলাম না। পাসপোর্টে শুধু সিল দিয়েই শেষ। কি আনন্দ! বাইরে এসে আমাদের গাইডকে খুঁজতে থাকি, বেশি খুঁজতে হলো না, দেখি ইংরেজীতে আমার ছেলের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে মহামান্য চেংগিস খানের একজন বংশধর দাঁড়িয়ে। ছেলেতো মহাখুশী! তার নাম লিখে একজন দাঁড়িয়ে আছে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে! তার এইটুকু জীবনে সেটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তো বটেই। যাহোক পরিচিত হলাম আমাদের এজেন্সীর ঠিক করা গাইড সুধিয়ানার সাথে, সমস্ত ট্রিপেই শেষ পর্যন্ত সুধিয়ানা আমাদের সুধীজন হয়ে থাকলো। আমাদের চারজনকে এক বালিনিজ মেয়ে এসে গ্লাসে লেমন ড্রিংকস দিলো সেই সাথে প্রত্যেককে কাঠগোলাপ ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নিল! আমরা তো এই অভ্যর্থনা পেয়ে খুবই আপ্লুত, মনে মনে ভাবলাম, বাকী সবকিছুও এমন হলেই হয়! এরপর সুধি আমাদেরকে গাড়ি করে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে ভাঙা ইংরেজীতে বললো, আজকে তোমাদের মত থাকো, বিশ্রাম নাও, ঘোরো, কালকে থেকে আমরা শিডিউল অনুযায়ী ঘোরা শুরু করবো।
যতই সিল্কের মত মসৃণ ভাবে আসি না কেন বিমান পাল্টানো, ট্রানজিট ইত্যাদি মিলিয়ে রাত জাগার একটা ক্লান্তি ছিলই! রুমে ঢুকেই আমরা বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘন্টা খানেক ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম। ঘুমটা ভাংতেই প্রথমে মনে হলো রাত হয়ে গেছে, তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দেখলাম, না, এখনও যথেষ্টই বিকেল। আমরা উঠেছি কুটা এলাকায়, যেখানে সাধারণত পর্যটকরা এসে ঘাঁটি গাড়ে কারণ এটা এয়ারপোর্টের একেবারে কাছে। একটুও আর আলসেমি করে সময় নষ্ট না করে উঠে আগে হোটেলের সবকিছু একটু ঘুরে দেখে শহর দেখতে বের হয়ে গেলাম। এই শহর যেন সেই রূপকথা’র ঘুমকুমারী, সারাদিন চারদিক সুনসান নিরবতা আর সন্ধ্যা হতে না হতেই জীয়ন কাঠির যাদুর স্পর্শে গোটা শহর জেগে ওঠে, জমজমাট হয়ে যায় চারদিক। হোটেলগুলো রাস্তার দুধারে সন্ধ্যার আপ্যায়নের সব প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে, গান ভেসে আসছে কোথাও থেকে। সারা পৃথিবী থেকে আসা টুরিস্টদের কলতানে মুখর সন্ধ্যা বা রাতের শহর বালি। মাঝে মাঝে ঘোড়ার গাড়িও চলছে এক দুইটা। একদম শেষের দিনে আমরাও একবার এই গাড়ীতে করে শহরে টহল দেয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। ঘোরাঘুরির পাশাপাশি কিছু জরুরী কাজও সারার ছিল যেমন মানি এক্সচেন্জ থেকে আমাদের ডলার ভাঙাতে হবে। ডলার ভাঙিয়ে তো আমাদের চক্ষুচড়ক গাছ। এক মুহূর্তে আমরা লাখ লাখ টাকার মালিক বনে গেলাম। ১ ডলার সমান ১১ হাজার ৩০০ রুপিয়া আর ১ লাখ রূপিয়া সমান বাংলাদেশী ৬১৫ টাকা, তবেই এবার বুঝুন। মুহূর্তেই লাখ লাখ টাকা খরচ করার জায়গা হচ্ছে বালি। প্রথমদিকে তো হিমশিম খেয়ে যেতাম টাকা-পয়সার হিসাব বুঝতে, পরে আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়েছি। এদেশে সর্বোচ্চ এক লাখ রুপিয়ার নোট আছে। বালির থাকা খাওয়া খুব সস্তা বলেই পৃথিবীর অন্যতম নাম করা পর্যটন বান্ধব দ্বীপ হিসাবে খ্যাত। যাহোক বেশ রাত পর্যন্ত ঘুরে ফিরে মজার মজার খাবার দিয়ে ডিনার শেষ করে হোটেলে ফেরত, সকালে উঠতে হবে, সুধিয়ানা সময় দিয়েছে সাড়ে ৮ টা।সকালে উঠেই যাবো ঐতিহ্যবাহী বারোং ড্যান্স দেখতে।
সেই কোন ছোটবেলা থেকে রামায়ন ও মহাভারতের কাহিনী আমার অতি প্রিয় পাঠ্য। এখনও আমি এই মহাকাব্যদ্বয়ের রূপকথার রাজ্যে শিশুদের মতই হারিয়ে যেতে ভালোবাসি, তাই যখন জানলাম বালিনিজদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নাচ বারোং ও কেচাক নাচ এই দুই মহাকাব্যের নানারকম চরিত্রদের নিয়ে তৈরী হয়েছে তখন থেকেই তুমুল উৎসাহী ছিলাম কখন এটা দেখতে পাবো। রাতের বেলা এই চিন্তা নিয়েই ঘুমাতে গেলাম যে পরের দিন সকালে উঠেই এই নাচ দেখতে পাবো সুতরাং অবশ্যই সকাল ৯টার মধ্য বের হতে হবে। কিন্তু ও হরি! ঘুম থেকে উঠে দেখি সময় ৯:১৫। সর্বনাশ! কিভাবে এটা হলো! সবারইতো এলার্ম দেয়ার কথা ছিলো! একজন আরেকজনকে দোষারোপ করতে লাগলাম। বেচারা সুধী সেই থেকে হোটেলের রিসেপশনে বসেই আছে! কিন্ত সেও তো আমাদেরকে রুমে একটা ফোন দিতে পারতো! দোষটা এবার সুধীর দিকে চলে যাওয়াতে সবাই একটু শান্ত হলো। শেষমেষ বোঝা গেল আমাদের উনি এলার্ম ঠিক সময়েই দিয়েছেন তবে সেটা am নয়, pm, ঘড়ি তার নিয়মে তাই রাত ৮ টাতেই পরে জানান দিয়েছিল। যাহোক প্রথমদিনের টানা বিমান যাত্রার ক্লান্তির কারণেও এটা হয়ে থাকতে পারে বলে আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিলাম। মন খারাপ করে বারোং নাচ দ্বিতীয় দিনের ঘোরার সম্ভাব্য তালিকায় রেখে সুধি’র রিজার্ভ করা গাড়ী নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম যেটা পুরো ভ্রমণকালীন সময়ে আমাদের সাথে থাকবে যেন প্রতিদিনের গাড়ী ভাড়া করার ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে না হয়।
প্রথমদিনের শিডিউল অনুযায়ী গেলাম বাটিক, সোনা রুপার অলংকার ও কাঠের কাজ হয় এমন তিনটি আলাদা আলাদা জায়গা দেখতে। শো রুম আর তার সাথে বড় বড় কারখানা। কারখানা বলতেই আমাদের চোখে যে ছবি ভেসে ওঠে এগুলো মোটেও সেরকম না। খুব শৈল্পিক পরিবেশে শান্ত, সুন্দর ভাবে বসে আর্টিজানরা ধীরে ধীরে কিভাবে এসব জিনিসগুলো তৈরী করে তা চাক্ষুষ করা এক দারুণ অভিজ্ঞতা বটে! দারুণ সব বাটিকের কাজগুলো তৈরী করার পাশাপাশি প্রদর্শনীও চলছে। শিল্পীদের সোনা, রূপার গহনা তৈরী করাও খুব মুগ্ধ হয়ে ঘুরে ফিরে দেখলাম। কাঠের কাজ দেখে সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। স্থানীয় শিল্পীরা ওখানে বসেই যে অপূর্ব কাঠের কাজগুলো করছিলো বেশ কিছু সময় নিয়ে সেগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। যেখানেই যাই সেখানকার মুখোশ কেনা আমাদের খুব শখের একটা ব্যাপার তাই বালির স্মৃতি হিসাবে এখান থেকে কিনে ফেললাম পছন্দের কয়েকটা মুখোশ, নিজেদের জন্যে আর কাছের কয়েকজন মানুষের জন্যেও উপহার হিসাবে। ওখান থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক এমনিতেই হেটে বেড়াতে লাগলাম যেন জায়গাটাকে আর একটু খুঁটিয়ে দেখতে পারি। আশেপাশের বাড়ী ঘরগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। প্রতিটি বাড়ীর মূল ফটকের স্হাপত্য রীতি যেন শৈল্পিক রুচির চরম পরাকাষ্ঠা। মনে হয় কয়েকশো বছরের পুরনো শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি যার অধিবাসীরা প্রতিদিনের পূজায় নৈবেদ্য দেয়ার মত করে খুব যত্ন করে গোটা শহরটা সাজিয়ে রেখেছে। রাস্তায় দাড়িয়ে এগুলো দেখতে দেখতেই গোটা দিন পার করে দেয়া যায়।
বালিনিজরা এমনভাবে ফুল, বাঁশ, মাটি, পাথর, সিমেন্ট বা স্হানীয় উপকরণ তাদের বাড়িঘর সবকিছুতে ব্যবহার করেছে যে মনে হয় প্রতিটা স্হাপনাই শিল্পী আর ভাস্করদের নিজের হাতে তৈরী। কিছুটা সময় এগুলো খুটে খুটে দেখে আবার যাত্রা শুরু করলাম কিন্তামানির পথে।
ধীরে ধীরে পাহাড়ী পথের দেখা মিলতে লাগলো। পথে এক জায়গায় কমলা বাগানে থরে থরে কাঁচা পাকা কমলা ঝুলে থাকতে দেখে আবারও যাত্রা বিরতি। সেখানে একটু নেমে কিছুক্ষণ কমলাবাগানে কাটিয়ে, ছবি টবি তুলে আবার পথে বের হই। যাত্রা পথে সুধীর সাথে গল্প চলাকালে জানতে পারলাম তার ১ম স্ত্রী ২০০৩ এ বালির নাইটক্লাবে বোমা হামলার ঘটনায় নিহত হয়েছে। শুনে আমরা মর্মাহত হলাম। অবশ্য পরে সে আবার বিয়ে করেছে, ছেলেমেযে নিয়ে এখন তার ভরা সংসার।
যেতে যেতে একটু পরপর চোখে পড়ে নানা রঙের স্থানীয় ভাষায় ফ্রান্জিপানি (যার অর্থ পাঁচ পাঁপড়ি) বা কাঠগোলাপের বড় বড় গাছে থোকা থোকা ফুল ধরে আছে। কাঠ গোলাপের শহরও এটি বটে! সামনে, পিছনে, ডানে, বায়ে, চারিদিকে লাল, গোলাপী, হলুদ, সাদা, বেগুণী রঙের কাঠ গোলাপ! বালিনিজদের প্রতিদিনের পূজা অর্চনা বা জীবনযাপনের অন্যতম অনুসঙ্গ এই ফুল। বাঙালি হিন্দুদের যদি বারো মাসে তেরো পার্বন হয় তাহলে বালিনিজ হিন্দুদের বারো মাসে তেইশ পার্বন চলে। রাস্তাঘাটে হর-হামেশাই মেয়েদের চুলে, কানে শোভা বর্ধন করে হরেক রঙের কাঠগোলাপ। মুসলিম প্রধান দেশ হলেও বালির ৮৫ শতাংশই হিন্দু অধিবাসী। মন্দিরের শহর বলে একে বলা হয় দেবতাদের দ্বীপ বা শান্তির দ্বীপ। প্রকৃতির সাথে মানুষের মিলেমিশে বসবাসের অনন্য এক উদাহরণ প্রায় ৪৫ লাখ মানুষের বসবাসের এই দ্বীপ।
মাউন্ট বাটুর দেখতে যাওয়ার পথেই আর একটি সুন্দর জায়গায় নামলাম আমরা, কফিপ্ল্যান্ট। মনে রাখার মত এও ছিল অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা। স্বপ্নে এরকম একটা জায়গাতে বসে চা কফি খেতে চাইবে যে কেউই ! কিছুটা ঢুকতেই চোখে পড়লো খড়ের চালে বাঁশের গায়ে একটা সাইনবোর্ডে লেখা ‘GOOD TIMES With GOOD FRIENDS Makes GOOD Coffee’ এমন পরিবেশ বান্ধব একটা প্রশান্তিময় জায়গাতে বসে কে না চাইবে দারুণ এক কাপ কফি! কফি খাওয়ার জন্যে প্রলুব্ধকর নানারকম signboard একশো ভাগ সফল বলতেই হবে!
দেখলাম কিভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফি লুয়াক তৈরী হয়। ওখানকার গাইড আমাদেরকে গল্পের মত করে সেটা বলে গেল। প্রথমেই লুয়াক (Luwak) নামের বেজির মত দেখতে এক প্রাণীর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলো, যে একটা গুহার মত জায়গায় এক মিনিটও বিরতি না দিয়ে অনবরত পায়চারী করে চলেছে। এই লুয়াক প্রাণীটিকে কফিবেরি খাওয়ানো হয় যা তার মলের মধ্যে দিয়ে বীজ হিসাবে আস্ত বেরিয়ে আসে। সেই বীজটি সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে বিভিন্ন পরিশোধন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেয়ে অবশেষে লুয়াক কফি তৈরী হয় (হায় হায়! একি জানলাম!) এই প্রাণীর নামও শুনিনি জীবনে! জানার আছে কত কিছু! এভাবে প্রাপ্ত কফিবেরি থেকে যে কফি পাওয়া যায় সেটা হলো পৃথীবির সবচেয়ে দামী কফি যার প্রতি কাপ এর দাম বাংলাদেশী টাকায় আড়াই হাজার মত। দাম শুনে মনে হলো থাক আর খেয়ে কাজ নেই, শুনেই তৃপ্তি! আমরা ঘুরে ঘুরে আরো নানারকম কফি তৈরীর প্রক্রিয়া দেখলাম যা সত্যিই দেখার মত, তবে তারও থেকে উল্লেখ করার বিষয় হলো জায়গাটার পরিবেশ! পুরাই যেন জেন কন্ডিশন। অবশ্য আমার কাছে গোটা বালি দ্বীপটাকেই জেন গার্ডেন মনে হয়েছে। চারদিকে সবুজে ঘেরা উচুঁ পাহাড়ী এক বিশাল খোলা জায়গাঁ, তার এক দিকে রেঁস্তোরার মত করে সাজিয়ে রাখা টেবিল চেয়ার, এটাই কফি শপ। খোলা জায়গা মানে মাথার উপরে খড়ের চাল দিয়ে টালির মত করে আচ্ছাদন আছে কিন্তু জানালা বলে কিছু নেই চারদিকে সব খোলা, যতদূর চোখ যায় চারদিক পাহাড় বেষ্টিত সবুজ জংগল, এক অপার্থিব অনুভূতিতে মন আচ্ছন্ন হয়ে রইলো।
একজন এসে ছোট ছোট কাপে প্রায় ১২ রকমের কফি দিয়ে গেল, স্বাদ নিয়ে পরখ করে দেখবার জন্যে কোনটা আমরা পান করতে চাই আর চাইলে কিনে নিয়েও যেতে পারি। অনেকক্ষন বসে গল্প করতে করতে আমরা সব রকম কফির স্বাদ একটু একটু করে চেখে দেখলাম, যদিও লুয়াক কফি কেনার ইচ্ছা হলো না। পুরো আয়োজনটাই মনে রাখার মত, যদিও সবকিছুর শেষে উদ্দেশ্য এটাই যে, সব রকম তো চেখে দেখালাম হে, এবার চলো কোনটা কিনবে। এখানে ঢুকতেই প্রথমে খেয়াল করেছিলাম যে শো রুমে সাজানো রয়েছে হরেক রকম চা, কফি এবং নানারকম হারবাল পন্য। তবে কেনাটা উসুল হয়েছে, যা যা কিনেছি দারুণ মানসম্পন্ন পণ্য, ব্যবহার করে মন ভরে গেছে, বিশেষ করে সুগন্ধি গুলো তো অতুলনীয়। মন চাইছিল না এখান থেকে ফিরতে, তবে ফিরে তো আসতেই হবে। টুরিস্টদের জন্যে এদের কত যে আয়োজন তা বলে শেষ করার নয়। আগে বালি পুরোপুরি কৃষিনির্ভর হলেও এখন এর অর্থনীতির ৮০ শতাংশ পর্যটন শিল্পের উপর দাঁড়িয়ে এবং ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ক্ষুদ্রতম (আয়তন মাত্র ৫ হাজার ৭৮০ বর্গ কিমি) হলেও অন্যতম ধনী প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত।
শহর থেকে বেশ দূরে চলে এসেছি, জায়গাটার নাম কিনতামানি, যেখানে আছে মাউন্ট বাটুর, ১৭০০ মিটার উঁচু এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। পুরো ইন্দোনেশিয়া সাড়ে তেরো হাজার দ্বীপের সমন্বয়ে গড়া, যার পুরোটাই আগ্নেয়গিরি থেকে উৎপন্ন। এই এলাকাতেই অনেকগুলো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে। কুটা থেকে এখানকার দূরত্ব প্রায় ঘন্টা দুই। কিন্তু একি! যেতে যেতে সকালের ঝকঝকে রোদ মিলিয়ে গিয়ে রাস্তার দু’ দিকে পাহাড়ী পথ তো একেবারে কালো হয়ে আছে, আবছা ভাবে শুধু বোঝা যাচেছ মাউন্ট বাটুরের অস্তিত্ব। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। গুগল সাহেবের কাছ থেকে আগেই জেনেছি এখানে মোটামুটি দুইটি ঋতুই রাজত্ব করে গোটা বছর জুড়ে। গ্রীষ্ম আর বর্ষাকাল। আমরা ঝুম বৃষ্টি পেয়েছি মোটামুটি সব কদিনই। সকালে ঝকঝকে রোদ তো দুপুর গড়াতেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা। সকালের আবহাওয়া দেখে দিন কেমন যাবে সেটা বুঝতে পারার (Morning shows the day) কথাটা বালির জন্যে অন্তত একদমই প্রযোজ্য নয় তা হলফ করে বলতে পারি। সুধী বললো, কপাল ভালো থাকলে আবহাওয়া একটু পরে চেন্জ হলে তোমরা এখানকার অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখতে পাবে, সেই ফাকে বরং খাওয়া শেষ করো। যাহোক মন খারাপ করে আমরা পাহাড়ী এক রেঁস্তোরায় খেতে বসে মেন্যুকার্ড দেখে কি খাবো সেদিকে মনোযোগ দিলাম। খাওয়ার মেন্যু নিয়ে গবেষণা করার পাশাপাশি পাহাড়ী রেস্তোরার চারপাশের অপরূপ দৃশ্য দেখতে থাকি। রেঁস্তোরার চারদিক খোলা রাখা হয়েছে এমনভাবে যেন সবাই এই সুন্দর জায়গায় বসে খাওয়ার পাশাপাশি চারদিকের প্রকৃতির মনোরম দৃশ্যও প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারে। একদিকে দৃষ্টিনন্দন পাহাড় আর একদিকে যতদূর চোখ যায় মনকাড়া সবুজে ঠাসা ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত রাইস টেরাস, অসংখ্য ধাপে ধাপে সাজানো দিগন্ত বিস্তৃত উঁচু সব ধানক্ষেত। আমাদের এখানে জুমচাষ করলে যেমন দেখায় তেমন দেখতে।
পর্যটন বালির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি হলেও বেশী সংখ্যক মানুষ এখনও কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল যার সিংহভাগই আবার ধানচাষের দখলে। ধানচাষটা যে কত দৃষ্টি নন্দন ভাবে করা যায় তা দেখার জন্যে হলেও বালি আসতে হবে। দূর থেকে রাইস টেরাস গুলোকে মনে হয় শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোন ছবি। হাল্কা বৃষ্টি হচ্ছে বলে কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দূর থেকেই দেখতে থাকি এই সবুজ গালিচা। এর মধ্যেই আমাদের অর্ডার করা পছন্দের খাবার চলে এসেছে। ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় খাবারের মধ্যে ভাত ও নুডুলস থাকে সবকিছুতে। সকালে হোটেলের নাস্তাতেও ভাত জাতীয় আইটেমের খুব দাপট দেখেছি। আমরা পছন্দমত খাবার অর্ডার দিয়ে খেতে খেতে গল্প করি আর একটু পর পর বাইরের দিকে তাকাই যদি সূর্যদেব তার ঝলমলে চেহারাটা একটু বের করেন। বেশ অনেকটা সময় ধরে এমন মশগুল হয়ে খাচ্ছি যে খেয়াল করিনি গোমড়া মুখো মেঘ কখন জানি সরে গেছে। জানালা দিয়ে বাইরে হঠাৎ তাকাতে এক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য দেখে খাওয়া গলার কাছে আটকে গেল! ঐতো মাউন্ট বাটুর স্ব-মহীমায় দাঁড়িয়ে আছে! তার সাথে যোগ হয়েছে বিকেলের লাল কমলা আভায় মাখানো কনে দেখা আলোয় সূর্য অস্ত যাওয়ার আয়োজন, সেই সৌন্দর্য থেকে চোখ সরানো দায় হলো। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম যেখান থেকে সবচেয়ে ভালো দেখা যাবে বাটুরকে।
পাহাড়ের এক অংশ থেকে ধোয়া উঠছে, যেকোন সময় আবার লাভা স্রোত বয়ে যেতে পারে। আগের অগ্ন্যুৎপাতের কারণে জমে যাওয়া লাভা কালো হয়ে আছে দেখলাম পাহাড়ের নীচে। পাহাড়ের বুক জুড়ে মেঘ বালিকাদের দৌড়াদৌড়ি এক দেখার মত বিষয় হয়ে থাকলো, ইচ্ছামত ছবি তুলতে ভুল হলো না একটুও, সাক্ষী হয়ে থাকলাম এক অবাক করা স্বর্গীয় সৌন্দর্যের! বেশ অনেকটা সময় ধরে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম রাশভারী পাহাড়ের ভারি অহংকারী কিন্তু মোহনীয় রূপ। আরো একটু থাকতে পারলে ভালো হতো কিন্ত ঐযে আমাদের সুধী আছেন একজন, গাইডদের যা কাজ, তাড়া দিয়েই যাচ্ছেন! ফিরতে হবে আজকের মত।
গল্প করতে করতে হোটেলে ফিরলাম সন্ধ্যার একটু পরেই। সুধী গাড়ি নিয়ে বিদায় নেয়ার আগে বললো বারোং নাচ দেখতে হলে কিন্ত সকালে সময় মেনে যেতে হবে! তথাস্তু বলে আমরাও রুমের দিকে রওয়ানা দিলাম। কিন্তু রুমে কি আর মন টেকে! কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে পড়লাম আবার শহর ঘুরতে। চারিদিক যেন গমগম করছে পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে জীবনের আনন্দ খুঁজতে ছুটে আসা মানুষের কলরবে। রাতের জীবন এখানে দারুণ উপভোগ্য! যার যেমন ইচ্ছা বসে কাটাচ্ছে সময়। হরেক রকম মানুষ , বসে বসে দেখতেও ভালো লাগে। দূর থেকে কোন কোন হোটেলের সামনে আয়োজন করা লাইভ ইংরেজী গান ভেসে আসছে। মন হারিয়ে যায় তরুণ বয়সে এইসব গানগুলো নিয়ে মেতে থাকার দিনগুলোতে! বেশ রাত পর্যন্ত গল্প করতে করতে এটা সেটা খুঁটে খুঁটে দেখে শুনে রুমে ফিরলাম – তবে মনে ঠিকই আছে পরদিন সকালেই কিন্তু বারোং নাচ দেখতে হবে।
দ্বিতীয় দিন আর কোন ভুল হলো না, সকালে প্রথমেই আমরা বারোং নাচ দেখতে চলে গেলাম। সুধী টিকেট কেটে থিয়েটার হলে আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলো। হল বলা যাবে না সেই অর্থে, খোলা জায়গা বা যাকে বলে ওপেন প্রসেনিয়ামে পুরো কাহিনীটা মঞ্চস্থ হলো। এই সাত সকালেও সাদা, হলুদ, কালো, বাদামী দর্শকে সিড়ির ধাপে ধাপে বসার জায়গাগুলো একেবারে টইটম্বুর হওয়া দেখে বুঝলাম কেমন জনপ্রিয় এখানে বারোং ড্যান্স!
নাট্যতত্ত্বের ছাত্রী ছিলাম, নিজেও মঞ্চে নাটক করেছি অনেকগুলো বছর, সেই স্মৃতি যেন এদের পরিবেশনা দেখে অনেক বছর পরে আমার মনে কেমন অদ্ভুত ভাবে ফিরে এলো আর আমাকে ঘন্টা দুই ধরে মন্ত্রমুগ্ধের মত আটকে রাখলো ওদের যাদুকরী থিয়েটার পরিবেশনার মধ্যে।
বালিনীজ পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে বারোং বালি গ্রামগুলোর ‘বনের দেবতা’। নানারকম ঘটনার মধ্যে দিয়ে শুভ আর অশুভ শক্তির অন্তহীন লড়াই এর পরিবেশনা চমৎকার অভিনয় কুশলতা দিয়ে দর্শকদের মন ভরিয়ে দিল কুশীলবরা! নানারকম মুখোশ আর ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ব্যবহারের কারণে মনে হলো কিছুক্ষণের জন্যে কোন পৌরাণিক যুগে চলে গিয়েছি। কাহিনীর মধ্যে অনেক কিছুই যে আজকের যুগের জন্যেও কতটা প্রাসঙ্গিক সেটা দক্ষ মুনসিয়ানায় তারা ফুটিয়ে তুললো। কমিক রিলিফে ডোনাল্ড ট্রাম্প সহ আজকের পৃথিবীর নির্বোধ তথাকথিত নেতাদের অধিকতর নির্বোধ কর্মকান্ড খুবই হাস্যরসাত্মকভাবে ফুটিয়ে তুলে পুরো পরিবশনাটাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল। হাস্যরসের মাধ্যমে জগতের নানান অসংগতির দারুণ উপস্থাপন বলতেই হবে।
বালির ঐতিহ্যবাহী আরো নানা ধরণের নাচ এবারে আর সময়ের অভাবে দেখা হলো না, বরং সেটা দেখার জন্যে আরেকবার আসার তাড়না নিয়েই আমরা পরবর্তী গন্তব্যর দিকে যাত্রা শুরু করলাম।
ঘুরতে বের হয়ে এই যে পরিযায়ী পাখির মত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় প্রতিদিন চলতেই থাকা, সে আমার ভীষণ প্রিয়। যেতে যেতেই যে বিচিত্র কত কিছু দেখা হয়! এখানে পথে চলতে চলতে একটু পর পরই বিশাল আকারের রামায়ন ও মহাভারতের চরিত্রদের সাথে দেখা হয়ে যাবে। ইন্দ্র, দ্রৌপদী, পঞ্চ পান্ডবেরা যেন ট্রয় বীর হেক্টরের মত পাহারা দিয়ে চলেছে তাদের প্রিয় এই দ্বীপ শহরকে। বালির পথে পথে যে ব্যাপারটা আরো চোখে আরাম দেয় তাহলো দোতলা, তিনতলা টালি দেয়া বাড়ী বা নানান স্থাপনাগুলো, যেনবা বালির মানুষগুলোর মতই কথায় কথায় হাত জোড়ের ভঙ্গিতে মানুষকে বিনীত হতে শেখাচ্ছে। প্রায় ৯৮% ঘরবাড়ীতেই দৃষ্টিনন্দন টালির ব্যবহার আমার কাছে এই শহরের সবচেয়ে সুন্দরতম বিষয় বলে মনে হয়েছে । উঁচু স্থাপনা চোখেই পড়েনি, আকাশ এখানে ছড়িয়ে আছে আকাশে আকাশে! স্থাপনাগুলে মাথা উঁচু করে নিজেকে জাহির করছেনা বরং গৌতম বুদ্ধের মত ধ্যানমগ্ন হয়ে, নত হয়ে সবাইকে কুর্ণিশ করছে, ভালোবাসা ছড়াচ্ছে। এই ধ্যান মগ্নতার বিষয়টা সবজায়গাতেই পেয়েছি, এদের জীবন যাপন, আচার আচরণ, সবকিছুতে।
পথে যেতে যেতে বেশকিছু মন্দির দেখেছি। বালির বিভিন্নস্থাপনার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে অসংখ্য কারুকাজ সমৃদ্ধ মন্দির । তিরথা ইম্পুল টেম্পল নামে একটা মন্দিরে ঢুকে খুব ভালো লাগলো। শান্ত, সমাহিত, ধ্যানমগ্ন জায়গা, কোন হৈ হল্লা নেই, চুপচাপ। এই মন্দিরে ঢোকার আগে সারাং (স্থানীয় পোষাক) জড়িয়ে নিতে হয় লুঙ্গির মত করে। মন্দিরের ভিতরে একটা পুকুরের মত আছে যার ভিতরে পরপর অনেকগুলো নল লাগানো, স্থানীয়দের মতে প্রত্যেকটি নলে মাথা ঠেকিয়ে স্নান করলে সব পাপ মোচন হবে। অনেক মানুষই একসাথে দেখছে, ঘুরছে, ফিরছে, নানারকম আচার পালন করছে কিন্তু সবই বলতে গেলে নিঃশব্দে। প্রকৃতির সাথে মাখামাখি হয়ে আছে এখানকার জীবন, আচরণ। মন্দিরের কাছে কোথাও অকারণ খাবারের ভীড় নেই, পুরোটাই নিয়ন্ত্রিত। যত্র তত্র খাবার! উহূ একদম না! মানুষের অকারণ কেনার বাতিককে কঠিন হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। যেন পৃথিবীর বুকে একটুকরো স্বর্গ! সুধীকে বললাম সেটা, সেও হেসে সম্মতি দিয়ে বললো, এখান থেকে কোথাও গেলে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। একবার সে জাকার্তা গিয়েছিল কোন কাজে, বড় বড় বিল্ডিং, মানুষের ভীড় এসব দেখে আবার তাড়াতাড়ি ফেরত এসেছে। পরে আমি অবশ্য নিজেও জাকার্তা গিয়েছি কিন্তু সুধী যেমন বললো আমার কাছে অতটা মনে হয়নি, হবে কিভাবে! আমি ঢাকার মানুষ না? মনে মনে বললুম, যদি একবার আমাদের ঢাকা শহরে আসতে তো বুঝতে ভীড় কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি!
সমুদ্রতীরে এক বিশাল পাথরের উপর দাড়িয়ে আছে সাগরপারের মন্দির, অপরুপ সুন্দর পুরা তানাহ লট, জোয়ারের সময় দেখতে ছোট্ট একটা দ্বীপের মত দেখায় আর ভাটার সময় পানি সরে গেলে এই মন্দিরের একদম কাছে যাওয়া যায়।তবে মূলমন্দিরে ঢোকার অনুমতি নেই। এই জায়গা সারাক্ষণ পর্যটকে গমগম করছে। এত ভীড় আমার আবার ভালো লাগে না, এসব সময় সবচেয়ে করণীয় বিষয় হচ্ছে ভীড় এড়িয়ে কোন চিপা, কোনা জাতীয় জায়গা খুঁজে বের করা, যেখানে দাঁড়িয়ে চুপচাপ এই ব্যাখ্যাতীত সৌন্দর্য আপন মনে উপভোগ করা যায়। এক এক জায়গা থেকে এক এক রকম সুন্দর লাগে বলে বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে ঘুরে দেখলে আরো মনোহরিণী রূপে দেখা যায়, এমন সময় এখানে যেতে হবে যেন এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা যায়। মন্দিরের ঠিক পেছনে অস্ত যেতে থাকা সূর্যের আভায় সবার মুখগুলো যেন আলোকিত হয়ে আছে, এক অলৌকিক দৃশ্য সেটা। সূর্যাস্ত দেখলাম বসে বসে, মানুষের তৈরী করা সৌন্দর্য আর প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন মাখামাখি হয়ে মনে এক স্বর্গীয় অনুভূতির পরশ বুলিয়ে দিলো। সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন আস্তে আস্তে সেদিনের মত বিদায় জানালো আমাদের। আমরাও সূর্যের শেষ আভা মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত মৌন মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশের নয় শুধু মনে গেঁথে নেওয়ার, সারা জীবন যা মানসপটে আঁকা থাকবে।
সন্ধ্যার পর ফেরার পালা আবার হোটেলের দিকে। আজ সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি হলো। কোথাও ঘুরতে বের হয়ে দুতিন দিন পরেই আমার নিজেকে যাযাবরের মত লাগতে শুরু করে, সে এক অদ্ভুত জীবন! এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে, শুধু ঘুরতেই থাকা, যেন পাখির মত জীবন! বড় সুন্দর এই জীবন! পরের দিন কোন কোন জায়গা যাবো সেটা সুধির কাছে শুনতে শুনতে সুধী আমাদেরকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে গেল। রুমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার আমাদের মত করে শহরটা ঘুরতে বের হই, এদিক সেদিক ঘুরি ফিরি খাই দাই, হেটে বেড়াই কোথাও বসি, যতভাবে সম্ভব এই শহরের সবটুকু চেখে দেখার চেষ্টা করি। পরেরদিন সরাসরি ভারত মহাসাগরের পানিতে নেমে জলকেলি করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বেশ রাতে হোটেলে ফেরত এসে শেষ করি তৃতীয় দিনের মত আমাদের যত ঘোরাঘুরি।
যতদূর চোখ যায় শুধুই নীল পানি! ভারত মহাসাগর কতগুলো দেশকে একসাথে যে কোলের মধ্যে নিয়ে বসে আছে! সকালে রওনা দিয়েই আমরা পৌছে গেছি এখানে মানে সমুদ্রের কাছে। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকম আনন্দ ফূর্তি নিয়ে ব্যস্ত। কেউ উড়ে উড়ে প্যারাগ্লাইডিং করছে তো, কেউ আবার সমুদ্রতলে ডুব দিচ্ছে। সব রকমের আনন্দ উপকরণই আছে। এখান থেকেও দেখা যাচ্ছে সেই মনকাড়া দৃশ্য, একটু পরপরই এক একটা প্লেন নীল পানির মধ্যে এসে নামছে আবার কোনটা পানি থেকে উঠে উড়ে যাচ্ছে এক এক দিকে, প্রথমবার তো প্লেনের মধ্যে থেকে দেখেছি আর এবার বাইরে থেকে অনেকক্ষণ ধরে তারিয়ে তারিয়ে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখা যেন আমার শেষই হতে চাইছিল না। আমাদের স্পীডবোটের বসে থাকার পায়ের কাছেই আয়না মত একটা লম্বা জায়গা, সেটা দিয়ে বোট চলার সময় সমুদ্রতলের মাছ দেখা যায়। আবার মাছ যেন বেশী করে আসে সেজন্য বোটম্যান আমাদের হাতে পাউরুটিও দিল যেন মাছের খাবার হিসাবে আমরা দিতে থাকি। বোট চলতে থাকলো আর রুটির লোভে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছও আমাদের সাথে চলতে লাগলো, কাচের গ্লাস দিয়ে আমরা সেটা উপভোগ করতে করতে এগিয়ে যাই। বোটে করে বেশ অনেকটা ঘুরে আমরা গেলাম কচ্ছ্বপ দ্বীপে। একশো বছরের বৃদ্ধ, অর্ধ শতক হাঁকিয়েছে এমন, অল্প বয়সী ছোকরা ছুকরী, সব ধরণের কাছিমের সাথেই সময় কাটলো দারুণ, ছবিও তোলা হলো। এগুলো শেষ করে আমরা একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে রিল্যাক্স করতে চাইলাম। পাশেই ছিল সুন্দর করে কয়েকটা স্ট্যান্ডের উপরে সাজানো ডাব, মুহূ্র্তেই সবার হাতে হাতে উঠে গেল। তার সাথেই এখানে নানা ফলের আয়োজন করে রাখা। টাটকা আম ও নানারকম মৌসুমী ফল ফলাদি সব স্লাইস করে কেটে একটু বিট লবন ছড়িয়ে যত পারি গলধকরন করতে থাকি। যত বেশী এদের প্রাকৃতিক জিনিসে উদর পূর্তি করা যায় আর কি!
আমাদের ঘোরার সময়টা যেহেতু ওদের হিসাবে একেবারেই গ্রীষ্মকাল তাই প্রচুর ফলের সমাহার দেখলাম। এখানকার ওষুধছাড়া ফলের প্রাচুর্যে জীবন বড় আনন্দময়। যে কদিন ছিলাম কব্জী ডুবিয়ে ফল ফলাদি খেয়েছি। আমাদের গীষ্মকালীন সব ফলই প্রচুর পরিমানে ফলে এখানে- খাবার টেবিলে তরমুজ, আনারস, আমের ছড়াছড়ি; এছাড়া ওদের আরও দেশীয় ফলগুলো তো আছেই…রাম্বুতান, স্নেক ফ্রুট যা কিছুটা আমাদের কাঁঠালের ছোট সংস্করণ। আমাদের গাইড সুধিয়ানাকে জিগজ্ঞসা করলাম, তোমাদের এখানে ফলমূলে কোন ওষুধ দাও টাও নাকি! সুধি হেসে বললো কি যে বলো! একেবারেই না। শুনে দীর্ঘশ্বাস চাপলুম এই ভেবে যে, দেশে চোখের সামনে রাশি রাশি ফল সাজানো থাকে আমাদের দোকানগুলোতে, কিনি এবং খাই ঠিকই কিন্তু ফরমালিনের ভয় এবং তার কারণে অসুস্থ হওয়ার আশংকাও সিন্দাবাদের ভূতের মত আমাদের ঘাড়ে চড়ে থাকে। আমাদের মত খাদ্য নিয়ে শংকা তাই সুধীর কল্পনারও বাইরে। ব্যাটা কি সুখী, ঈর্ষান্বিত হয়ে ভাবলাম। এখানে টুরিস্ট অনেক থাকলেও আশেপাশে তেমন কোন কোলাহল নেই, সবাই শান্ত ভাবে যার যার মত সময় কাটাচ্ছে, পাশাপাশি সাউন্ড স্পিকারে চলছে একধরণের সম্মোহিত হয়ে যাওয়ার মত বালিনিজ মিউজিক যার অদ্ভুত এক মাদকতা আছে, ওদের জীবন যাপনের সাথে যেন এই সংগীত একেবারে মিশে গেছে। শুধু অর্থহীন ছুটে বেড়ানোর জীবন নয়, শান্ত , বুদ্ধের মত জীবন, মনকে প্রশান্তি দেয়, জীবন নিয়ে ভাবায় , শুধু তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় না। সমুদ্রের কিনারে বসে চারদিকের সবুজ গাছপালা পরিবেষ্টিত হয়ে এই অদ্ভুত মাদকতাময় সংগীত শুনতে শুনতে কোন এক অপার্থিব জগতে মন হারিয়ে যায়! অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতা এমনভাবে গ্রাস করে যে আর উঠতেই ইচ্ছা হয়না সেখান থেকে! মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল ধরে সেখানে বসেই থাকি!
যাহোক নীল সাগরের বীচের মায়া কাটিয়ে আমাদের ফেরার সময় হলো। দুপুর প্রায় গড়িয়ে যাচ্ছে আর সবারই বেশ ক্ষুধাও পেয়েছে। গাড়িতে উঠে লান্চ করার জন্যে সুধি আমাদের নিয়ে যায় আগে থেকেই ঠিক করে রাখা তাদের পছন্দমত জায়গায়। জায়গাটা আমাদের অনেক পছন্দ হয়েছিল এবং রেঁস্তোরাটাও। সুনসান নীরব একটা জায়গা নাম নুসা দুয়া। বিশাল এক গোলাপী কাঠগোলাপ ঠিক রেঁস্তোরাতে ঢুকতে যাবার মুখে, অনেক ছবি তুললাম সেই কাঠগোলাপ গাছটির সাথে তার নীচে পড়ে থাকা ফুল কুড়িয়ে কানে গুঁজে নিয়ে। বড় বেশী সুন্দর সবকিছু, চোখ ফেরানো যায়না। একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে কাঠিয়ে হোটেলের দিকে আস্তে ধীরে রওনা দিলাম আমরা।
এটা ছিল আমাদের বালি ঘোরার শেষ দিন। সময় শেষ হয়ে আসছে এই মায়াবী জায়গা ছেড়ে যাবার। বালি একটা ছোট্ট দ্বীপ হলেও দেখার মত এত কিছু আছে যে অন্তত গোটা ১৫ দিন লাগে কিছুটা হলেও সেই মোটামুটি সৌন্দর্যের পূর্ণ স্বাদ পেতে। এ শহর যেন প্রকৃতির সাথে মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক অপূর্ব উদাহরণ, এখানকার মানুষ জানে প্রতি মুহূর্তে কিভাবে প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে বাঁচতে হয় । বহুতল ভবনের ভীড়ে দিগন্তরেখা এখানে হারিয়ে যায়নি কারণ আইন করেই পাঁচ তলার উপরে বাড়ি করা নিষিদ্ধ! দাদাদের শর্তযুক্ত উন্নয়নের করাতের নীচেও ওরা গলা পেতে দেয়নি, নিজেদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি নিয়ে মগ্ন হয়ে আছে নিজেরা, অন্যদেরও প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে, মন কেড়ে নিচেছ। হাজার হাজার টুরিস্ট ঢোকে প্রতিদিন এই শহরে, কিন্তু তার কোন কুপ্রভাব এখানে নেই, পুরোটা শহরে একটাও পুলিশ দেখিনি, অথচ সবকিছুই চলছে খুবই শৃংখলা’র সাথে। জীবন এখানে সত্যিই সুন্দর! পৃথিবীর বুকে যেন এক টুকরো স্বর্গ। আবার এরকম প্রকৃতিবান্ধব কোন শহরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত, বালি, ‘দ্য লাস্ট প্যারাডাইস অন আর্থ’ আমার চোখে লেগেই থাকবে!
প্রচ্ছদ ও ছবি : লেখক

জন্ম যশোর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। এক দশক ধরে বাংলাদেশ বেতারে সংবাদ পরিবেশনার সাথে যুক্ত আছেন। ছাত্রজীবনে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও লেখালেখির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকলেও পেশাগত কর্মব্যস্ততার কারণে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে বর্তমানে ছোটগল্পের মাধ্যমে আবারও লেখালেখির জগতে বিচরণ শুরু করেছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত তার ছোটগল্প প্রকাশিত হচ্ছে।