| 19 ফেব্রুয়ারি 2025
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২০

করোনা ভাইরাস ও পুঁজিবাদের ব্যর্থতা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

করোনা ভাইরাস আকারে অণূবীক্ষণনিক, কিন্তু তার প্রকার প্রকান্ড। ছোট্ট পারমানবিক বোমা হিরোশিমা, নাগাসাকিতে তার তান্ডব দেখিয়েছিলো। তারচেয়ে অসংখ্য গুণ ছোট্ট করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী জানান দিলো, ছোট বলিয়া কাউকে অবহেলা করিবেন না।
ব্যক্তি মানুষের প্রাণ সংশয় কিংবা অর্থনৈতিক ক্ষতি তো আছেই, কিন্তু করোনা ভাইরাস সবচেয়ে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে ধনতান্ত্রিক আর পুঁজি ব্যবস্থাকে। পুঁজি ও ধন কেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ‘উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’ চেহারাটা তুলে ধরেছে করোনা ভাইরাস। বিরাট সব দালান, ঝলমলে শপিংমল, বিলাসবহুল রেঁস্তোরাগুলো যেন করোনার আতঙ্কে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। কথিত মাতব্বর রাষ্ট্র খোদ আমেরিকার সামরিক মাস্তানিও কোন কাজে আসেনি করোনা মোকাবেলা। মহাশূন্য গবেষণা, সামরিক উত্থানের চেয়ে খাদ্য চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন যে অনেক বেশি এই সরল সত্যটি কানে চড় দিয়ে শিখিয়ে দিলো করোনা ভাইরাস।

আমেরিকার মতো বড় শক্তিও হিমসিম খেলো করোনার আক্রমণে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের দূর্বলতা ধরা পড়লো করোনাদ্ভুত কোভিড ১৯ রোগের কারণে। বিজ্ঞানীরা ২০১৩ সালেই সাবধান করেছিলো (সার্স মহামারী সময়) যে সামনে আরো ভয়ঙ্কর মারণঘাতি ভাইরাস আসবে। কিন্তু রাষ্ট্র অথবা ওষুধ কিংবা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এ সব পাত্তা দেয়নি। লাভ জনক মনে না হওয়ায় তারা গবেষণা তথা পূর্ব প্রস্তুতির কথা ভাবেনি। রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা— সবখানেই চিকিৎসা ব্যবস্থার দূর্বলতা তার মলিন দাঁত দেখিয়ে দিয়েছে এই করোনা মহামারীর কালে। শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থার দূর্বলতাই নয়, শিক্ষা ব্যবস্থার চরম দূর্বলতা ধরা পড়েছে করোনাকালেই। সাধারণ মানুষের দায়িত্বহীন আচরণ, নানা রকম টোটকা, গুজবে মন দেয়া, রাজনৈতিক নেতাদের বাতুল আচরণ আদতে দূর্বল শিক্ষা ব্যবস্থারই বাই প্রডাক্ট।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের প্রধান সুবিধা (এবং প্রধাণ সমস্যাও) হলো এই যে সে সব কিছুকে টাকার অঙ্কে চিন্তা করে। ফলে মানুষের জন্ম, মৃত্যু, রোগ, শোককেও গণনা করা হয় লাভ-লোকসানের দিক থেকে। চাহিদা, যোগান, সঞ্চয়, লগ্নি, কেনা-বেচা, আয়-ব্যয় এগুলো সবই পূঁজিবাদের অগ্রগণ্য প্রভাবক। এইসব প্রভাবক করোনা ভাইরাসের প্রথম আক্রমণেই অন্তসার শূন্যতা তুলে ধরেছে। লক ডাউনের কারণে মানুষের আরেকটি মৌলিক অধিকার খাদ্যের যোগান ও চাহিদার টানা পোড়ন শুরু হয়ে গেছে। কৃষিজ এবং খাদ্য উৎপাদন কারখানার স্থবিরতা মানুষকে দূর্ভিক্ষ আর অনাহারে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাবে। যাদের টাকা আছে প্রচুর তারাও এখন চাইলে ভিআইপি, সিআইপি সুবিধা ব্যবহার করতে পারছে না। যতো বড় ভিআইপিই হোক না কেন রাষ্ট্র ব্যবস্থার অদূরদর্শীতার শিকার হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে পূুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অবহেলা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার ফলাফল এখন হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছে। স্পষ্টতই কর্পোরেট ইমেজ, ব্রান্ড ভ্যালু, দামী পণ্য, বিলাসী বিজ্ঞাপণে মোড়া সেভেন স্টার জীবনের জৌলুস আজ হুমকির মুখে। দৈনিন্দিন মজুর, শ্রমিক, কর্মচারীরা জীবনের দায়ে ঘর থেকে বেরুচ্ছে। তাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নেই, কিন্তু ক্ষুধা আছে। পেট দায় মিটাতে বেরিয়ে আসা মানুষ উপদেশ, হুমকি, ধামকি মানছে না। ধনী গরীবের তীব্র বৈষম্যময় রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইসোলেশন, লক ডাউন দিয়েও সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। ড্রাইভার, পাচক, আয়া, বুয়া, মালি, দারোয়ান সমাজের এই নিচু স্তরের মানুষগুলোর নূন্যতম মৌলিক চাহিদা আমরা নিশ্চত করতে পারিনি, আবার নিজেদের আয়েশের সুবিধার্থে এদেরকে বাদও দিতে পারিনি। এখন এই শাসক ও শোষক শ্রেণীর মধ্যকার নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করতে গেলে এদেরকে একেবারে বাদ দিতে হবে। সেই বাদ দেয়া অঙ্গহানির চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়। উভয়ের প্রতি পারস্পরিক অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা সত্ত্বেও টাকার চক্রে এরা জড়িত। এই জড়াজড়ি আকস্মিক বন্ধ করতে গেলে নানা রকমের সামাজিক বিশৃঙ্খলা হতে বাধ্য। ফলত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে মালিক-শ্রমিক, দাতা-গ্রহীতা সহ বিবিধ সম্পর্ককে নতুন করে ভাবতে হবে এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার পুরো প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিরাপত্তা বলতে তো এখন আর বিদেশি শত্রুর আক্রমণকে বুঝলে হবে না, ক্ষমতা বলতে শুধু অর্থনীতি আর রাষ্ট্রনীতিকে বুঝলে হবে না। মানুষের শারীরিক ক্ষমতা, মানসিক ক্ষমতা, রোগ শোক কাটিয়ে ওঠার উপযুক্ততা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। কেবল রেডিমেড অফিস কর্মচারী কর্মকর্তা বানানোর শিক্ষা ব্যবস্থা এখন যথার্থই অচল। ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষাকে চ্যালেঞ্জ করার সময় এসেছে। যুগোপযোগী, মানব কল্যাণমুখি, বিজ্ঞানমনস্ক মানব সমাজ গড়তে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে এখন। নইলে টিকে থাকার রেসে বিশাল ডাইনোসরের মতো মানুষকে হারিয়ে যেতে হবে। পূঁজিপতিদেরও বুঝতে হবে মানুষ কেবল তার ক্রেতা নয়। পণ্যের সাথে মানুষকে সেবা দিতে হবে এবং সাধারণ মানুষকে পণ্য মনে করা যাবে না। পণ্য উৎপাদনের চক্রে জড়িত শ্রমিক আর কর্মীকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত রাখার ফলাফল আকস্মিক বিরাট আকারে দেখা দেবে। মনে রাখতে হবে ধারাবাহিক শোষণ আর অবহেলা ক্যান্সার সেলের মতোই। এই ক্যান্সার সেল পুরো শরীরকেই খেয়ে ফেলতে চায়।
পুঁজিবাদী পন্য সভ্যতা সব কিছুই খেতে চায়। ফাঁকা মাঠ দেখলে তাদের মগজে শপিংমল ঢং ঢং করে ওঠে, অরণ্য দেখলে তা কেটে সাফ করে কারখানা বানাতে চায়, নদী মানে পণ্য পরিবহনের পথ আর বর্জ নিষ্কাসনের পন্থা মনে করে তারা। পণ্য সভ্যতার উন্নয়নও পণ্য কেন্দ্রিক। পরিবেশ, প্রকৃতিকে ধারাবাহিক ধর্ষন করেছে পণ্য সভ্যতা। প্রাণীদের আবাস আর বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে অর্থ আর প্রবৃদ্ধির উন্মদনায়। ফলে প্রাণীদের অসুখ মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। কারণ তারা বাধ্য হচ্ছে মানুষের খাদ্যচক্র তথা জীবন চক্রে বেমানানভাবেই মিশে যেতে। অন্য কোন প্রাণের সুবিধার কথা চিন্তা করেনি টাকা চেনা মানবকুল। ফলে প্রাকৃতিক নানা বৈরিতা যেমন নেমে আসছে তেমনি নানা রকমের নয়া রোগজীবানু উন্মোচিত হচ্ছে। এই সংকট পরিস্থিতি আরো কিছু হুমকির দিকে ইঙ্গিত দেবে। এই যে কর্পোরেট ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র চিন্তা তা থেকে গড়ে উঠেছিলো বিশ্ববাজার। কিন্তু গ্লোবালাইজেশনের প্রবাহকে বন্ধ করে দেবে করোনার মতো ভাইরাস। 

রাষ্ট্র তো দূরের কথা ব্যক্তি মানুষও এখন একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখবে। কার মাধ্যমে রোগ ছড়াবে, কে নিরাপদ আর কে ভাইরাস নামের অদৃশ্য ঘাতক বোমা শরীরে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নিশ্চিত করা সুদূর পরাহত। সেই দিক থেকে বিশ্ববাজার, বিশ্বগ্রাম এইসব ধারণা ব্যবহারিক দিক থেকেই কার্যকর করা জটিলতর হয়ে যাবে। চীন যে কিনা বিশ্ববাজারে বিরাট ভূমিকা রেখেছে তার সঙ্গে পণ্য আদান প্রদান, তার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখা কঠিন হয়ে উঠবে। একইভাবে নানা দেশের পণ্য আদান-প্রদান, আন্তর্জাতিক শ্রম বাজার, ট্যুরিজম, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি আর আগের মতো সরল থাকবে। এবং প্রকারান্তরে এইসব কিছু অর্থনীতির বুনিয়াদে যেমন চাপ ফেলবে তেমনি পুঁজিবাদের অস্তিত্বে আঘাত হানবে।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত