| 29 মার্চ 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২০

এক টিকিটে দুই ছবি

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

এক.

শিরোনাম দেখে হৈ হৈ কাণ্ড রই রই ব্যাপার ভেবে যারা এই লেখায় ঝাপিয়ে পড়বেন বলে ভাবছেন, তাদের সবদিক থেকে হতাশ হবার সমূহ সম্ভাবনা। একটা সময় ছিল, দেশীয় সিনেমা হলগুলোতে ‘এক টিকিটে দুই ছবি’র নামে ব্যাপক শিল্প সাধনা চলতো। সে সাধনায় কতটা বকুলগন্ধ কিংবা কবির ছন্দ মিলেমিশে একাকার হতো, সেটা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা ভালো বলতে পারবেন। শুনেছি, খামোখাই সেসব সিনেমায় পাচার হয়ে আসা নানা মারকাটারি কিংবা রগরগে অরুচিকর দৃশ্য গুঁজে দেয়া হতো। তাতে সুষ্ঠু চলচ্চিত্রের মুখে ঝামা পড়লেও একশ্রেণীর দর্শকের বিপুল আগ্রহ ছিল হলমুখী হওয়ার। ব্যবসা চালু রাখতে হল মালিকেরাও দেদারসে তাদের হলগুলোতে কাটপিস ঠাসা সেসব সিনেমা চালিয়ে গেছেন। সে ধারাটা এখন আর নেই। অবাধ আন্তর্জালিক সুবিধা প্রাপ্ত এই সময়ে ওসব দেখার ঝোঁকে লোকজনের আজ আর হলমুখী না হলেও চলে। ‘যেও না দক্ষিণ দ্বারে বাতাস তোমায় উড়িয়ে নেবে’র নিষেধাজ্ঞাকে একক্লিকেই চুপ করিয়ে দেবার সব বন্দোবস্ত এখন হাতের নাগালে। তবে এই লেখা বিগত দিনের সেসব স্মৃতি কিংবা অবাধ আন্তর্জালিক সুবিধা নিয়ে নয় মোটেও। দুটো চলচ্চিত্র নিয়ে টুকটাক আলাপ একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে লেখাটাকে আরেকট্টু বড় করাই ছিল আসল উদ্দেশ্য, আর সেটাকে হালাল করতে এহেন শিরোনাম মানানসই মনে হলো। শিরোনামের হাঁড়ি হাটে ভেঙে দেবার পর্বটা সেরে নেয়া হলো, এখন মূল গপ্পো যাই চলুন…

“Children of Heaven(Bacheha-Ye aseman)” নামের অপার্থিব সুন্দরের সাথে যারা পরিচিত তারা জানেন এটা  Majid Majidi ‘র কতো চমৎকার একটা সৃষ্টি। এই শিল্প কর্মেরই হিন্দি ভার্সন “Bumm Bumm Bole”। একটা মাস্টার পীসকে ধ্বংসের চূড়ান্ত নমুনা হতে পারে ভারতীয় পরিচালক Priyadarshan’এর এই সিনেমা। ‘চিল্ড্রেন অফ হেভেন’এর নিখাঁদ সারল্য, অপার্থিব ভালোলাগার বুকে প্রিয়দর্শনের নিজস্ব উটকো ভাবনা, যেমন: বোমাবাজি, মালিকপক্ষ কর্তৃক চা-বাগানের নারী কর্মীকে ধর্ষণের চেষ্টা, উদ্ভ্রান্ত সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি অনাবশ্যক অযাচিত বিষয়গুলো ঢুকিয়ে তিনি হয়ত ভেবেছিলেন দিলাম মেরে! বাস্তবে তিনি মাজিদ মাজিদির ওয়ার্ল্ড সিনেমার ইতিহাসে নাম লেখিয়ে ফেলা সৃষ্টিটাকেই মারবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন সন্দেহ নাই। এতে দর্শককে তব্দা খাইয়ে দেবার মতো কিছুই দিতে পারেননি তিনি। দর্শক হৃদয় কব্জা করা তো দূর কী বাত! বরং দর্শক(আমার মতো) এমনটাই ভাবতে বাধ্য হবেন এমন একটা সিনেমার গলা টিপতে কেন তিনি এতোটা উৎসাহিত হলেন? এমনটা না করলেই কী চলছিল না!!!

কিছু বিষয় থাকে না চাইলেও তুলনাটা বুক ফুলিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়দর্শনের’ বাম বাম বোলে’র বেলাতেও সেটা বার বার এসে যাচ্ছিল ‘চিল্ড্রেন অফ হেভেন ‘এর নানান অসাধারণ দৃশ্যের রেশ ধরে ধরে। পিনু (চরিত্রের নাম ঠিক বিনু না পিনু এটা একটা ধন্দ সৃষ্টি করে সাবটাইটেলের কারণে) রিমঝিম, আলি আর জারা’র দাপুটে ছায়াকে এক মুহূর্তের জন্যেও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি তাদের যথাসাধ্য অভিনয় কলা দিয়েও। আলি আর জারা কে মনেই হয়নি যে তারা অভিনয় করেছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই পিনুর অতি অভিনয় ধরা পড়ে যায় এবং ‘তারে জামিন পার’ এর সেই স্পেশাল নীডস্ কিডটার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে তুলনায় রিমঝিমের সারল্যমাখা অভিনয় মনে দাগ কাটে।

মাজিদ মাজিদির যে বিষয়টা আমার সবচে’ বেশি ভালো লাগে সেটা হলো কথাহীনতার মাঝেও অনেক কথা বলে দেবার অদ্ভূত কৌশল। বারানের(Baran) কথাই ভাবুন। ভালোলাগার মেয়েটার জন্য ছেলেটা কতো কী করে গেলো…অথচ তাদের মধ্যে কোনো বাক্য বিনিময় হলো না! …এমন সংলাপহীন প্রেমের দৃশ্য কল্পনা করা যায়! আমি নিশ্চিত, প্রিয়দর্শন এটাকে হিন্দিতে করলে( ইয়াআল্লা মাফ চাই! এদিকে যেন লোকটার নজর না পড়ে) জানুমানু হাম্মাহুম্মা গান নাচ দিয়ে এক্কেবারে নরক গুলজার করে দিতেন। সঙ্গে আইটেম সং এর হিড়িম্বা উৎপাত ফ্রী! ইতং বিতং বাদ দেই, ফিরে যাই ত্যানা পেচানিতে…..

বলছিলাম খুব কম কথায় বা প্রায় সংলাপহীন দৃশ্যে কতোটা সাবলীল মাজিদি।

‘চিল্ড্রেন অফ হেভেন’ এর সেই দৃশ্যটা মনে করার চেষ্টা করুন, যেখানে হারানো জুতার খোঁজ পেয়ে ভাই বোন দু’জনেই অকুস্হলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা যা দেখে, তাতে করে জুতা ফেরত নেবার ইচ্ছাটাই উবে যায় তাদের। আলি আর জারার ব্যথায় জড়ানো মুখের অভিব্যক্তিতেই সেটা স্পষ্ট ফুটে ওঠে…দৃশ্যায়নের এই রেসে প্রিয়দর্শন শুধু ব্যর্থই হননা… যেন আত্মবিশ্বাস খুইয়ে চরিত্রদের মুখে সংলাপ ঠুসে দেন। সিনেমার দৈর্ঘ্যেও যেকারণে হুদাই বেশি এটার।

মাজিদি কী চমৎকার ভাবে দেখান একটা জুতা দুই ভাই বোনের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবার পর্বটাকে। সকালের শিফটে বোনের স্কুল, দুপুরের শিফটে ভাইয়ের। বোনের দেরিতে উৎকণ্ঠিত ভাইয়ের সাথে সাথে দর্শকও হাত কামড়ায় উত্তেজনায় বোন ঠিক সময়ে পৌঁছাবে তো! যেটা বাম বাম বোলেতে সেভাবে আসেনি দেখে চরম হতাশ লাগে। প্রিয়দর্শন মোটামুটি ভালো সিনেমা বানানেওয়ালা নামে বাজার পাওয়া মানুষ। তার কাছ থেকে সিনেমার এই মূল বিষয়টাতে আরো যত্ন আশা করা অন্যায় আবদার না বলেই মনে করি। মনে আছে এক দিন জারার পা থেকে জুতা খুলে ড্রেনে পড়ে যায় সে দৃশ্যটা? ওটা যেন জুতা না দর্শকের হৃৎপিণ্ড ঝপাং করে পড়েছিল ড্রেনের পানিতে! রেসে আলি যেন প্রথম না হয়ে তৃতীয় হয় এমন প্রার্থনা করতে থাকা দর্শকও নেহায়েত কম পাওয়া যাবে না মনে হয়। প্রিয়দর্শনকে রেসের চেয়ে এডিটাসকে বিজ্ঞাপিত করতেই বেশি উৎসাহী মনে হয়েছে, কেন জানি। সাবানের ফেনার বুদ বুদ বানিয়ে দুইজন শিশুর অপার্থিব আনন্দ দেখে চোখ ভিজেনি আপনার? প্রিয়দর্শন এসবের চেয়ে উটকো বিষয়েই উচাটন ছিলেন অধিক। কুয়ার ধারে কাপড় ধুতে থাকা মহিলার মতোই প্রিয়দর্শন ‘সাবানের ফেনা তুলে পানি নষ্ট করিসনে’র মতোই ছন্দপতন ঘটানোর ভূমিকায় ছিলেন যেন!

এটা কোনো ভাবেই দুটো সিনেমার তুলনামূলক আলোচনা নয়। সেটা করার যোগ্যতাও আমার নাই। নিজের খুব পছন্দের একটা চলচ্চিত্রকে রিমেইকের নামে তাকে ফালুদা বানানোয় মর্মাহত ব্যাপক। এটাকে ক্ষোভ উগরে দেবার একটা চেষ্টা বলা যায়। তবে সেটাও গুছিয়ে করাতে সফলভাবেই ব্যর্থ হয়েছি সন্দেহ নাই। ‘বাম বাম বোলে’র প্রাপ্তির মধ্যে চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফির কথা না বললে খুব অন্যায় হয়ে যায়। সুন্দর লোকেশন, আর ছোট্ট রিমঝিম হতাশ মনকে দুদণ্ড শান্তি দেয়। যারা ‘চিল্ড্রেন অফ হেভেন’ দেখেননি, কিংবা সেটা দর্শনের অপার্থিব অভিজ্ঞতা এক্কেবারে ভুলে গিয়ে ‘বাম বাম বোলে’তে ডুব মারতে পারবেন প্রিয়দর্শনের এই কর্মকাণ্ড তাদের ভালো লাগতে পারে।

দুই.

প্রায় ৯৬ মিনিটের ‘Q’ নামের হিন্দি এই সিনেমা বর্তমান সময়ে দেশ-দেশান্তরে ঘটে যাওয়া হিংসাত্মক জঙ্গিবাদের বাস্তব এক চিত্রায়ন। নানান মুখোশে ধ্বংসাত্মক একমুখী লক্ষ্য নিয়ে দুনিয়া জুড়ে যে তাণ্ডব থেকে থেকেই নাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব, ‘কিউ’ সেরকম এক বাস্তবতার খণ্ডাংশ মাত্র। বেশ র্নিলিপ্ত আর একঘেয়ে জীবন যাপনকারী দুই সন্তানের এক মা নিরাসক্তভাবে তাদের ভয়াবহ পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে টেনে নেবার ক্ষেত্রে কতটা দক্ষ; সেরকম এক গল্পকে ক্যামেরা বন্দী করেছেন পরিচালক সঞ্জীব গুপ্ত। এটি পরিচালকের প্রথম প্রয়াস। সময়োপযোগী, সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য একটি প্রয়াস সে কথা না বললেই না।

সাম্প্রতিক সময়ে মূলতঃ ধর্মের নামে অলীক এক স্বপ্ন পূরণের আশায় এসব সন্ত্রাস ঘটানো হলেও ‘কিউ’ সিনেমায় এমন কিছু স্পষ্ট করে বলা হয় না। পরিকল্পনার আসল উদ্দেশ্য, তাদের কর্মকাণ্ড চালাতে থাকাদের বিষয়টা হিডেন এখানে। পরিচালক দর্শকদের এটুকু শুধু জানিয়ে দেন, গ্রাম থেকে আট হাজার রূপীতে কিনে আনা ছয় বছরের ছিন্নমূল শিশুটিকে ভয়াবহ এক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যহার করতে যাচ্ছে পরিকল্পনাকারীরা। গল্পের প্রধান চরিত্রে থাকা নারী দুটি শিশুর জননী এবং ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসী দলের সক্রিয় সদস্য। নারীটি কেন এমন জঘন্য কাজে জড়ালো, তার পারিবারিক জীবন, বাচ্চা দুটির বাবা অর্থাৎ মহিলার স্বামী কোথায়, কী করে ইত্যাদি বিষয় গল্পে অনুচ্চারিতই থেকে যায়। দেয়ালে টাঙ্গানো একখানা ছবির দিকে কিছু সময় নারীটির তাকিয়ে থাকার দৃশ্যে ‘তাহার একটা স্বামী ছিল’র আভাস পাওয়া যায় মাত্র।

সিনেমায় বাড়তি কোনো শব্দ সংযোজন করা হয়নি। সমুদ্র তীরবর্তী ওরকম একটা জায়গাতে একটা ভয়াবহ কিছু ঘোট পাকাচ্ছে,  পরিচালকের ক্যামেরাকে তাই পরিস্হিতির গুরুত্ব অনুযায়ী বাইরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য নিয়ে মাতামাতি করতে দেখিনা(হয়ত)। দম বন্ধ একটা পরিবেশে এক চিলতে হওয়া খেলা করে যায় বাচ্চা দুটি যখন মায়ের সাময়িক অনুপস্হিতিতে মনের আনন্দে খেলা করে; খোলা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে স্বাধীন জলের আছড়ে পড়া দেখে! নিজের সন্তানের বয়সী আরেকটি সন্তানকে বলির পাঠা ভাবতে বিন্দুমাত্রও বিচলিত দেখিনা আপাত ক্রু চোখ মুখের নারীটিকে। অথচ  সেই মেয়েটির জ্বরের অজুহাতে পরিকল্পনার দিনটি পিছিয়ে দেয়, সমুদ্রের জলের কাছে নিয়ে যায়, অনেক যত্নে তাকে স্কুলের পোশাক পরায়। মানুষ একই সাথে দানব আবার মানবিক, মুদ্রার এপিঠের সাথে ওপিঠের বৈপরীত্যটাও চমৎকার অথচ নিমোর্হ ভঙ্গিতে তুলে এনেছেন সঞ্জীব গুপ্ত।

আপাত র্নিলিপ্ত প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাসিরুদ্দীন শাহের মেয়ে হিবা শাহ । ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার এই ছাত্রীটি ‘কিউ’তে তার অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। অন্ততঃ তার অভিনেতা দুই ভাইয়ের তুলনায় হিবা শাহকে বেশ খানিকটা এগিয়ে রাখছি।

‘কিউ’ বানিজ্যিকভাবে পয়সা কামানোর পায়তারায় অযথাই উ লা লা আইটেম গান ভিত্তিক নাচে গানে সমৃদ্ধ হিন্দি সিনেমা না। এ সিনেমা পরিস্হিতি বিবেচনায় আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া সামান্য ঘটনার প্রতি সর্তক দৃষ্টি দেবার ওয়েক আপ কলের একটা প্রচেষ্টা। পরিচালক সঞ্জীব গুপ্তকে ধন্যবাদ এমন একটা বিষয়ে আলো ফেলবার জন্য।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত