| 28 মার্চ 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২০

প্রুফ রিডার

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
সাতশ স্কয়ার ফিটের এই ছোট্ট অফিসের একেবারে দক্ষিণ কোনায় প্রশান্ত বাবুর টেবিল। নিয়ম করে ঠিক ন’টা ত্রিশে অফিসে ঢোকেন। টেবিল পেড়িয়ে নিজের চেয়ার অব্দি পৌঁছুতে গিয়ে নিয়ম করেই ডান পাশে রাখা টেবিলের কোনায় একটা গোত্তা খান এবং এর পরই একটা বাক্যই বিরবির করে বলেন,” বাল একটা পাইতা থুইসে।ইচ্ছা করে লাত্থি মাইরা টেবিলটা বাইর কইরা দেই।”
প্রশান্ত বাবুর পা অতটা শক্তিশালী নয়। গলার আওয়াজের মতই দূর্বল। আজকাল এই কাজে পোলাপানের যে ডিমান্ডতাতে মালিক তারেই যেকোনো সময় লাথি মেরে বের করে দিতে পারে। ইদানীং তো এক বেশুমার সুন্দরী অফিসে এসে পারলে প্রকাশকের কোলে বসে থাকে। কাজেই যতই বিড়বিড় করুক দুর্মূল্যের বাজারে এই চাকরি ছাড়া আর একুশ তলা বিল্ডিং এর ছাদ দিয়ে হাসতে হাসতে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করা একই ব্যাপার।
শুক্রবার ছুটির দিন। তবু তিনি ছুটি নেন না। বাড়তি কাজের জন্যে কোন বাড়তি টাকাও চান না প্রকাশকের কাছে। প্রকাশক সাহেব প্রথম দিকে টেনশনে থাকতেন তাকে নিয়ে। বাড়তি টাকা দাবী করেন যদি। এক সময় এই টেনশন বিস্ময়ে রূপ নিলো। বিস্ময়ের ধাপও অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন প্রকাশক সাহেব বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছেন। বিগত তেইশ বছর এ নিয়মের কোন রদবদল হতে দেখেনি কেউ। বিশ বছর বয়সে বাবা শ্যামল কান্তির হাত ধরে সেই যে এসেছিলো এই প্রকাশনীতে তারপর আর ফিরে যাননি। টানা তিনমাস বাবা প্রশান্ত বাবুকে কাজ শিখিয়েছেন হাতে ধরে ধরে। এরপর কোন কারন ছাড়াই প্রশান্তর হাতে সংসার নামক এক সার্কাসপার্টির চাবি তুলে দিয়ে চির বিশ্রামে গেলেন। ব্যাপারটা এমন যে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে যাবার আগে নতুন কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবার মতন। বাবা কি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন? কে জানে।
বাবার উপহার দেয়া সেই সার্কাসপার্টিতে ক্ষুধা আছে , দারিদ্র আছে , ভাই-বোন নামক সদস্যদের বিয়ে লেখাপড়া আছে ,বিক্ষোভ, অসহযোগিতাও আছে। আরও আছে মা নামক এক অসহায় জোকার। যার কাজই হচ্ছে নিজের দুঃখ চেপে পার্টির সদস্য ও দর্শকদের মুখে হাসি ফোটানো। এমন দূর্বল এক সার্কাসপার্টির পার্টিপ্রধান হবার কোন ইচ্ছে তার যদিও ছিলো না কিন্তু তার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য দেবে এমন বাজারব্যবস্থা এ বিশ্ব এখনও তৈরি করতে পারেনি। বাবার পথ অনুসরণ করলে তারও দ্রুত বিয়ে করে গোটা কয়েক বাচ্চা জন্ম দেয়া উচিত ছিলো। যাতে সেও তার ছেলের হাতে এমন আর একটি সার্কাস পার্টি তুলে দিয়ে টুপ করে মরে যেতে পারে। কিন্তু প্রশান্ত বাবু তা করেননি। পার্টিতে দূর্বল সদস্য বাড়িয়ে কি লাভ? ভেবেছিলেন বোন দুটোর বিয়ে হয়ে গেলে নিজের বিয়ের কথা ভাববেন। কিন্তু এ ব্যাপারে পার্টির বাকী সদস্যদের অনুৎসাহী মনোভাব তাকে বানরের ভুমিকায় অবতীর্ণ করিয়েছে। এক পা আগান তো তিন পা পেছান। এই পেছাতে পেছাতে প্রকৃতি তার কাছ থেকে তেতাল্লিশটা বছর কেড়ে নিয়েছে। তা নিক। তবু ক্ষীণ একটা আশা পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর শীর্ণ জলরেখার মতন এখনও তার হৃদয়ে তিরতির করে বয়ে যায়। সেই আশার জলে অবগাহন না হলেও চড়ুই স্নান তো হয়। সেই বা কম কি…
কিন্তু স্নানরত চড়ুইদের ভেবে বা দেখে যতটা উদ্দীপনা তৈরি হয় ধরতে গেলে ততোধিক উৎকন্ঠা বাড়ে। কিছুতেই ধরা দিতে চায় না। ফুরুৎফারুৎ করে কোন ফাঁক গলে টুক করে বেড়িয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। প্রশান্ত বাবুর অবশ্য এইসব ধরাধরিতে বিশেষ আগ্রহও নেই। এক্সিডেন্টে বেঁকে যাওয়া রিক্সার চাকার মত তোবড়ানো গাল, চাকা থেকে বেড়িয়ে যাওয়া লোহার শলাকার মত ভাঙাচোরা চোয়াল, গর্তজীবি চোখ, এসব দেখে কোন চড়ুইয়ের দায় পড়েনি এসে তার শুকনো পাজর দখল করার।
আবার এসবে ভেবে নেবার প্রয়োজন নেই যে প্রশান্তবাবু একেবারেই নির্জীব, নিরাসক্ত। মাঝেমধ্যে তাকে শখ করে ধুতি পরতে দেখা যায়, গুনগুন করে গানও গাইতে শোনা যায়। এবং আশ্চর্যজনক সত্যি যে ধীরস্থির এই মানুষটির গাওয়া গানগুলো তার স্বভাবের একেবারেই বিপরীত।
“এমন মানব জনম আর কি হবে , মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে।” মনমেজাজ ভালো থাকলে লালন সাঁইজির এই গান প্রায়ই তাকে গাইতে শোনা যায়। অফিসের দুইমাত্র স্টাফ বাদশা মিয়া তার গান শুনে আগে হা হয়ে থাকতো। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে যে সময় নেয় পাঁচ মিনিট, টিফিন ক্যারিয়ার থেকে খাবার বের করে প্লেটে এমন ভাবে রাখে যেন অপারেশনের পরে রোগীকে আই সি ইউ তে রাখা হচ্ছে আর খেতে তো এত সময় নেয় যে বাদশা মিয়া তার এক খাবারের সময়ে মনের ও দেহের দুই খাবারই শেষ করে। আর সেই লোক কিনা সব ত্বরায় করার গান গায়!
মনের খাবার ও দেহের খাবারের কথায় মনে পড়লো, বাদশা মিয়ার একজন প্রেমিকা আছে। সেও আসে এই অফিসে। প্রশান্ত বাবু খাবার খেতে পাশের রুমটাতে গেলে বাদশা মিয়া এদিকে অফিস সামাল দেয়। এক সাথে দুইজনের খেতে বসা নিষেধ। প্রশান্ত বাবু খেতে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কেমন করে বাদশা মিয়ার প্রেমিকা এসে হাজির হয় সেও এক রহস্য বটে। তার হাসি, ডায়লগ সব মুখস্থ প্রশান্ত বাবুর। মনে হয় এই ক’টা বাক্য মেয়েটির ভিতরে কেউ ইনপুট করে চাবি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এর বেশি কথা সে জানে না। দরজাটা হালকা খুলে মাথাটা গলিয়ে দেবে, একটা হাসি তারপরই বিখ্যাত বাক্যবর্ষণ যা মেয়েটি বলার আগেই প্রশান্তবাবু বলা শুরু করেন মনে মনে।
– ও কাকা, খাতি বয়েছেন? ভালো করিছেন। একটু আগে দেকতি পারলে আচার দি যাতাম৷ মায়ের নিজ হাতে বানানো আচার। একবার যদি খাতেন গো কাকা জিবে পানি আসি যাতো।
এরপর গলাটা আরেক ধাপ উঁচু করে,
– ও বাদশা ভাই। আপ্নেও কি খাতি বয়েছেন? না হলি পরে ছারের রুম দুডো মুছে দেতাম। আপ্নে না থাকলি পরে যাবো না কলাম। শেষে কালে কি না কি কয়ে দেবেন। সে আমি শুইনবার পারবো না। আপনে দাড়োয় থাকেন। আমি ঝাড়পোঁছ দি একসাথে বারোয় যাবো।
বাদশা ভাই তো আগে থেকেই প্রস্তুত। শুধু ডাকের অপেক্ষায় ছিলো। এর পরের দৃশ্যায়নও মুখস্থ প্রশান্ত বাবুর। বাদশা মিয়া চোখেমুখে খুব বিরক্তি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করবে কিন্তু মুখের রহস্যময় হাসিটার রেখা খুব একটা ঢাকতে পারবে না। বাদশা মিয়া অভিনয়ে পারদর্শী নয়। এর পরের তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট এদের আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাবে না। দু’পক্ষই হাফ ছেড়ে বাঁচে। এই তিরিশ চল্লিশ মিনিটে প্রশান্ত বাবু আরাম করে তার খাওয়া শেষ করে টিফিন ক্যারিয়ার ধুয়ে গুছিয়ে এক খিলি পান মুখে দিয়ে বসতে বসতেই দুজন পাশের রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। বেড়িয়ে আসতে আসতে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বাদশা মিয়ার কপট ধমক , চোখ টেপাটেপি সবই নজরে আসে তার।
তবে অভিনয় জানে তাদের বস মি. প্রকাশক। যেই মেয়েকে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে বসে থাকে তাকেই বউয়ের সামনে মা মা করে অজ্ঞান। শুধু তাই না তার নিখুঁত অভিনয়ে প্রশান্ত বাবুও ভীমড়ি খায়। কোনটা আসল কোনটা নকল। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে। সব তালগোল পাকিয়ে যায়। খেতে খেতে এসব ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে । মানুষ কেমন করে পারে এত? সেদিনও প্রশান্ত বাবুর সামনে প্যান্টের চেইন তুলতে তুলতে বের হল চেম্বারের পিছনের রুম থেকে আর সে কিনা বউয়ের সামনে মেয়েটিকে মা জননী বলে সম্বোধন করে। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে বমি আসতে চায় তার। একের পর এক প্যাচ বাড়তে থাকে চোখের সামনে। এইসব প্যাচের চিন্তা মাথা থেকে নামিয়ে সে খেতে শুরু করে। বাবা বলতেন, ‘মনি রে খাওন সামনে থাকলে যত কাজই থাকুক খাওন না খায়া উটবি না। এতে খাওনের অসম্মান হয়। সংসারের অকল্যাণ হয়। এই খাওনের জন্যেই তো এত কিছু।’ খাওয়ার অসম্মান বা সংসারের অকল্যাণ এসব নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু বাবার কথা বলেই কেন যেন ফেলতে পারে না । বাবার কোন কথাই অবশ্য কখনোই ফেলতে পারেনি প্রশান্ত বাবু। যেমন পারেনি এইচ এস সি পরীক্ষার পর তাকে এই অফিসে এনে প্রুফের কাজ শেখানোর ইচ্ছেটাও৷ খুব ইচ্ছে ছিলো চারুকলায় ভর্তি হবে৷ ছবি আঁকার নেশাটা এখনো যায়নি তার। এ ইচ্ছেটা থেকেই প্রুফ দেখার পাশাপাশি কয়েকশো বইয়ের প্রচ্ছদ করে দিয়েছে এই প্রকাশনীর। অথচ প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে তার নাম যায় না। লেখা থাকে ‘সেতু প্রকাশনী প্রচ্ছদ টিম।’ এই টিমের একজনই মেম্বার। এসবে আবার ভেবে নেবেন না যে প্রশান্ত বাবু প্রুফের কাজে অনিহা বা অবহেলা করছেন। প্রচ্ছদের পাশাপাশি প্রুফের কাজেও সে সমান দক্ষ। একটা বানানও চোখ এড়িয়ে ভুল হবার উপায় নেই। একটি বাক্যও এলোমেলো হবার চাঞ্চ নেই। একাডেমিক বানানরীতি কঠোর ভাবে মেনে চলেন। এ ব্যাপারে তার সুখ্যাতি রয়েছে রীতিমতো। কষ্ট তার একটাই। যে কাজটায় সে নিজেকে প্রমাণ করতে পারতো তা করছে বটে কিন্তু নিজেকে আড়াল করে আর যা সে করতে চায়নি তাই করতে হচ্ছে নিজের নামে। প্রচ্ছদের কাজ এলেই তার চোখমুখ আলোয় ভরে যায়৷ যেদিন মনের মত প্রচ্ছদ তুলতে পারে সেদিন সবার আগে টের পায় তার টেবিল। টেবিলে জোরে একটা তাল ঠুকেই শুরু হয় কবিতা আওড়ানো ,
‘কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরাণ ঢালি।
শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব,
হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি।’
তার সার্বক্ষণিক একঘেয়ে ,নিরাসক্ত, নিরবিচ্ছিন্ন যাপিত জীবন থেকে এ সময়টুকু বড়ই আলাদা, বড়ই সৃষ্টিসুখের। তার করা প্রচ্ছদে একটা বই যখন পরিপূর্ণ রূপ পায় সবার আগে সে বইটি হাতে নেয়। এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশের না। আবেগে, অভিমানে তার গলা বুজে আসে। এক একবার ভাবে সে প্রকাশককে বলবে, ‘স্যার সারাজীবন আপনাকে ফ্রি প্রচ্ছদ করে দেবো, দয়া করে আমার নামটা দিন প্রচ্ছদ শিল্পীর জায়গায়।’ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে ওঠে সার্কাস পার্টির চেহারা। কম হোক তবু বেশ কিছু টাকা তো হাতে আসে। নাম দিলে কী হবে? তার একার সুখ, একার স্বস্তি। আর টাকা দিয়ে কিনছে সবারটা। সামনে ছোট বোনটার বিয়ে। মায়ের অসুস্থতা দেশের উন্নয়নের মত। উপর থেকে দেখলে ছবির মত, ভেতরে ঘুণপোকা ঝাঝরা করে দিয়েছে সব। নাহ, এ মুহূর্তে কোন ভাবেই প্রকাশককে চটানো যাবে না। কাজেই আবার সে বানর হয়ে যায়। পোষ্য বানর। সংসারের শিকল গলায় পেঁচিয়ে প্রকাশক মনিবের কথায় ওঠো, বসো, ডিগবাজি খাও ব্যাস।
এই এক চিমটি আনন্দেরও অবশেষে পাখনা গজালো । প্রকাশক ব্যাটা সেদিন যখন তার আঁকা প্রচ্ছদ হাতে নিয়ে মুখটা ইঁদুরের মত চোখা করে তার বেশুমার সুন্দরী এসিস্ট্যান্টের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘ আল্পনা, দেখো তো ঠিকঠাক আছে কিনা। তুমি ঠিক বললেই ঠিক ‘ তখন পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলতে থাকে প্রশান্ত বাবুর। মনে মনে বিশ্রী ভাষায় গালি দেয় সে। ‘মাগীটা তোর সাথে শোয়া ছাড়া আর কোন কাজটা জানে? কুত্তি মাগী বুঝবো চিত্রকলা, বুঝবো প্রচ্ছদ। ‘ যদিও এসব মনে মনেই বলা। আওয়াজ হলে তো চাকরিটা অই মূহুর্তেই শেষ।
এক রবিবারের সকালে এক কার্টন বই এলো। প্রশান্ত বাবু যথানিয়মে দৌড়ে গেল কার্টন খুলতে। আহ! কী শান্তি। ঝকঝকে প্রচ্ছদ। এই প্রচ্ছদটা সে খুব যত্ন নিয়ে করেছে। এক্রিলিকে এত ভালো কাজ এর আগে সে কমই করেছে। বইটা অনেকটা সময় নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো। প্রতিটা বানান সে কী যত্ন করে দেখেছে। প্রচ্ছদটা কতখানি যত্ন আর ভালোবাসা নিয়ে করেছে তা শুধু সেই জানে। পরম মমতায় হাত বোলালো বইটার গায়ে। সত্যিই সকালটা আলো হয়ে গেল। সেই আলো যে ন’টা ত্রিশ থেকে দশটা ত্রিশ অবধিও পৌঁছুবে না তা কে জানতো। দশটা বিশের দিকে একজন ফুলের তোড়া নিয়ে এলো আল্পনা ম্যাডামের জন্য। চমৎকার তোড়াটার দিকে তাকিয়ে আরো মন ভালো হয়ে গেল প্রশান্ত বাবুর। কী সুন্দর তোড়াটা। এ পর্যন্তই ঠিক ছিলো। কিন্তু তোড়াটার গায়ে সেটে থাকা কার্ডটার দিকে তাকিয়ে তার বুকটা ধক করে উঠলো। সে কি ঠিক দেখছে? হুড়মুড় করে নিজের টেবিল থেকে উঠে এসে যা দেখলো তাতে আগের দেখার কোন পরিবর্তন হয়নি৷ অযথাই টেবিলের কোনে আরেকটা ধাক্কা খেল।
‘আল্পনা ম্যাডামকে অসাধারণ সুন্দর ও নান্দনিক প্রচ্ছদের জন্যে শুভেচ্ছা। ‘ কার্ডের এই একটা লাইন তার সব আলো নিভিয়ে দিলো। সুন্দর ফুলগুলো থেকে এক নির্মম খুনে গন্ধ পাচ্ছে সে এখন। তার গা গুলিয়ে মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কর্কশ অন্ধকারে তলিয়ে যাবার আগে দ্রুত বইটি হাতে নিয়ে প্রিন্টার্স লাইনে চোখ বোলালো সে। হ্যাঁ, মিলে গেছে কার্ডের সত্যতা। স্পষ্টই প্রচ্ছদ শিল্পীর নামের জায়গায় লেখা রয়েছে আল্পনা লায়লা। প্রশান্ত বাবুর চোখ, বুক সব জ্বলছে। মাথা ঘুরে পড়ে যাবার ঠিক আগ মূহুর্তে বাদশা মিয়া তাকে ধরে ফেলেন।
বিকেল চারটা নাগাদ প্রকাশক আর প্রশান্ত বাবুর মধ্যে নিম্নবর্ণিত আলাপচারিতা হয়।
– স্যার, আপ্নে এইটা কি করলেন?
– কিসের কথা কও প্রশান্ত?
– স্যার আপ্নে ভালো কইরাই জানেন কিসের কথা কই।
– না জানি না। খুইলা কও।
– ঠিক আছে। খুইলাই কইতেছি ৷ প্রচ্ছদে কার নাম দিছেন?
-ক্যান ? দেখো নাই নাম?
-হ ,দেখছি
-তাইলে আবার জিগাও ক্যান? মিয়া কথা কম কইয়া নিজের কাজে মন দাও।
-কাজটা ঠিক হয় নাই।
– অ ।
এই অ শব্দটার মানে কি? অচ্ছ্যুৎ? হতে পারে। এমন ভাবেই যেন উচ্চারিত হলো শব্দটি। প্রকাশকের দিকে তাকিয়ে তার চোখে অবহেলা আর ঠোঁটের কোনে তিরস্কারের হাসি দেখতে পেল। আর ঠিক তখনই কি যেন হয়ে গেল প্রশান্ত বাবুর। ভুলে গেলো বিশ্ব সংসারের কথা, সার্কাস পার্টির কথা, তার জোকার মায়ের কথা। টাকা নামক প্যাথেডিনের গন্ধে ঘুমিয়ে থাকা আসল প্রশান্ত বাবু যেন ঘুমঘোর থেকে সহসাই জেগে উঠলেন। হাতে রাখা বইটি তীব্রবেগে প্রকাশকের গায়ে ছুড়ে মেরে বাঘের মত হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
– আমার করা প্রচ্ছদে তোর পোষা মাগীর নাম দিলি ক্যান। এত বড় দুঃসাহস তোরে কে দিলো? কয়টা টাকা দিয়া কি দুইন্নাইটা কিন্না লইছস? একটা বেশ্যারে লয়া দিনরাইত থাকোস। দাঁড়া তোর জারিজুরি সব ফাস কইরা দিতাছি। ফাইজলামি চোদাস শয়তানের বাচ্চা। মোছ, নাম মোছ এই মাগীটার।
দাত কিড়মিড় করে হিংস্র এক দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে গেল সে প্রকাশকের দিকে। কয়েক সেকেন্ড প্রকাশকের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না। বিস্ফারিত চোখে সে শুধু চেয়ে থাকলো তার পোষ্য, আজীবনের মাথা নুইয়ে চলা, আদেশ মানা প্রুফ রিডারের দিকে। কিছুতেই মেলাতে পারছে না। এ কাকে দেখছে সে? কিন্তু ততক্ষণে তার ঘাড় চলে গেছে প্রশান্ত বাবুর হাতের মুঠোয়। অসুরের মত শক্তি নিয়ে সে টেবিলে মাথা চেপে ধরলো প্রকাশকের। তার আর্তনাদে ছুটে এলো বাদশা মিয়া, পাশের অফিস থেকে আরো জনাকয়েক। সবাই মিলে অনেক কষ্টে তাকে ছাড়িয়ে আন্লো। আল্পনা এরই ফাঁকে কখন অফিসে ঢুকেছে কেউ টের পায়নি৷ পরিস্থিতি বেসামাল দেখে সে পুলিশকে ফোনও দিয়েছে।
তারপরের ঘটনা সামান্যই। বসকে শারীরিক নির্যাতনের অপরাধে প্রশান্ত বাবুকে জেলখানায় পাঠানো হল। আদালতে আল্পনা মাননীয় বিচারকের সামনে কেঁদে আকুল হয়ে জানালো প্রশান্ত বাবুর সাথে তার দীর্ঘদিনের প্রেম। তার নাম প্রচ্ছদে প্রশান্ত বাবুই ব্যবহার করেছে। এ ব্যাপারে প্রকাশক কিছুই জানতেন না। এমনকি বিয়ের নাম করে তাকে ভোগও করেছে প্রশান্ত বাবু। ইদানীং আল্পনা বিয়ে নিয়ে চাপ দিলে সে সন্দেহজনক আচরণ শুরু করে। এসব বিষয় সে তার পিতার মত প্রকাশককে জানায়। তিনি প্রশান্ত বাবুকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রকাশকের সাথে এমন ভয়াবহ আচরণ করে এমনকি তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়।
ব্যাস। মামলা ডিসমিস। গত তিন মাসে মোট সাতটি মামলা দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে। আরো হবে কিনা আমাদের জানবার দরকার নেই। যা হয়েছে তা মিটিয়ে বেড়িয়ে আসতে বছর পাঁচেকের ধাক্কা। পরিস্থিতি পুরোপুরি প্রকাশকের নিয়ন্ত্রণে আর আমাদের গল্পের সেই শান্ত শিষ্ট প্রুফ রিডারও ততদিনে ফিরে এসেছে পুরানো ফর্মে। এই তিন মাসে বাড়ি থেকে একটা মানুষও আসেনি তার খোঁজ নিতে। কোন বন্ধু না, স্বজন না কেউ না। খুব আশায় ছিলো ছোট ভাইটা অন্তত আসবে। তাও এলো না। তার আত্মবিশ্বাসে চির ধরেছিলো আগেই। এবার ধ্বসে পড়লো মাত্র।
রবিবারে কয়েদীদের আত্মীয়স্বজনেরা দেখা করতে এলে সে জেলখানার খালি মাঠটায় বসে শুধু ভাবে, এত এত বইয়ের প্রচ্ছদ আর প্রুফ রিডিং সে কত নিখুঁতভাবে করেছে কিন্তু নিজের জীবনের প্রচ্ছদ আর প্রুফ রিডিং এ বিরাট ভুল করে বসে আছে। শব্দ, বাক্য আর রঙের কী অপরিকল্পিত, অপ্রয়োজনীয় আর অযাচিত ব্যবহার !
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত