ঘর
লটারির পুরনো টিকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে দিতে তনিমার নিজের উপর রাগ লাগে। কেন এসব ছাইপাঁশ কেনে সে! সেই কবে এটার তারিখ পেরিয়ে গেছে! আসলে নিজে থেকেও কেনেনি। সপ্তা দুয়েক আগে জোর করে গছিয়ে দিয়েছিল মেয়েটা। কখনো লটারিতে একটা লজেন্স যার ওঠেনি সে নাকি চল্লিশ লাখ টাকা পেয়ে যেতে পারে। এ মুহূর্তে এরচেয়ে কম সময়ে তো লাখ লাখ টাকা পাবার আর কোনো উপায় নেই।
সেদিন সুলতা বলছিল- আগে পান নাই বলে এবারেও পাবেন না এরকম কথা কেউ কি কাগজে লিখে দিয়েছে?
কী বোকা বোকা যুক্তি! যেন কাগজে লিখে দিলেই বিশ্বাস করতে হবে যেকোনো অবান্তর কথা। মাঝেমাঝে এসব কারণে বড্ড ছেলেমানুষ মনে হয় লতাকে। এমনকি ন্যাকা বলেও মনে হয়। তবু এই লতার সাথেই জড়িয়ে গেছে সে। আদর করে তাকে সে সুলতা বলে ডাকে। অফিসে এই একটি মাত্র মেয়ের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়।
সুলতা বড্ড অস্থির প্রকৃতির। অল্পতেই তুষ্ট আবার অল্পতেই রেগে আগুন। প্রায় প্রতিদিন গজগজ করতে করতে বলে- আজই শেষদিন, চাকরিটা ছেড়ে দেব, বুঝছেন আপা। আবার একটু পরেই বলে -একটা নাকফুল দেখছি সেদিন রাজলক্ষ্মীতে, এত সুন্দর জানেন! বেতনটা পেলে এ মাসেই কিনব।
তনিমা জানে সুলতা তার মতো দাঁত কামড়ে পড়ে নেই। দেবর-ননদ শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ভরা সংসার ওর। বর মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরি করে। দু’মাস অন্তর নতুন শাড়ি, গয়না বা ফ্যামিলি ট্যুর লেগেই আছে ওর জীবনে। এই হতচ্ছাড়া গোছের চাকরিটা সে করছে কেন জানতে চাইলে বলে -নিজের কিছু সাধ আহ্লাদ তো নিজেকেই পূরণ করতে হয়! অন্যের কাছে বারবার হাত পাতা যায়!
বরের সাথে বোধ হয় অভিমান চলছে সুলতার। তাই এই যুক্তি। তবু মাথা নেড়ে একমত হয় তনিমা। ওর নিজের জীবনে অবশ্য তেমন কিছু সাধ আহ্লাদ নেই। হাত পাতার জন্যও কেউ নেই ওর। বেতনের সিংহভাগ সংসারের খরচে চলে যাবার পর মাস শেষে কিছু টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারলেই সে বর্তে যায়। শাড়ি গয়নার শখ কখনো ছিল না। শুধু নতুন নতুন জায়গায় ঘুরে বেড়াবার ঝোঁক ছিল। বিয়ের পর বছর দুয়েক ঘুরেছেও খুব। একা একা সমুদ্রে যাবার ইচ্ছেটা শুধু পূরণ হয়নি কখনো৷ তা চাইলে সে এখন যেতেই পারে। সেজন্য অফিসের কম্পিউটারে বসে ট্রাভেল এজেন্সির ওয়েবসাইটে চক্কর দেয় মাঝেমাঝে। ফোন নম্বর, প্যাকেজের অপশনগুলো টুকে রাখে রাইটিং প্যাডে। রাতে শুয়ে শুয়ে হিসাব কষে। তিনদিন দুইরাতের প্যাকেজটা মন মতো। কিন্তু অন্তত দশ হাজার টাকার ধাক্কা। তাও আবার চারজনের গ্রুপ হতে হবে। সুলতা ছাড়া অফিসের আরো দু’জনকে রাজি করানো যায় কিনা ভাবে সে। সত্যি কথা হলো সুলতাই রাজি হবে না যেতে। শুরুতে ভদ্রতা করে আগ্রহ দেখালেও পরে ঠিক বেঁকে বসবে। ধুস! এরচেয়ে মনে মনে সৈকতে ঘুরে আসাটা নির্ঝঞ্ঝাট বলে মনে হয়। বড় বড় ঢেউ এসে কী সুন্দর ভিজিয়ে দিয়ে যায় ওকে। সূর্যাস্তের পরেও ছোটা যায় একা একা। এক টাকাও খরচ হয় না তাতে। পরদিন ঘুম ভাঙলে সব দিব্যি ভুলে থাকা যায়।
সাধের কথা বলতে গেলে সেরকম একটা গোপন সাধ অবশ্য আছে তনিমার। সুলতাকে বিস্তারিত কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। এই ব্যাপারগুলো ও আসলে বুঝে কিনা কে জানে! হয়তো বুঝে কিন্তু মুখে স্বীকার করতে যত আপত্তি। যুক্তি দিয়ে ওর মতো মানুষকে পরাস্ত করাও সহজ। কিন্তু অত কথার খেলা খেলতে আজকাল আর ভালো লাগে না তনিমার। কী হয় তাতে। দিনশেষে দুনিয়ার চোখে সে ঠ্যাটা মেয়েমানুষই থেকে যায়। সেই ভালো। এই ভাবমূর্তি নিয়ে ওর খুব একটা মাথাব্যথা নেই।
সুলতাও কিন্তু কম ঠ্যাটা নয়৷ জেরা করতে পারে খুব। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওর পেটের কথাটা ঠিক বের করে নেয়। সব শুনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তারপর টেনে টেনে বলে- আপা আপনি একটু সেলফিশ আছেন।
হ্যাঁ সে বরাবরই সেলফিশ, আত্মমগ্ন। এমন অভিযোগ শুনে শুনে ভেতরটা পুড়ে যেতো একসময়। আজকাল বেশ মজাই লাগে। সুলতাকে হাসতে হাসতে উত্তর দেয়- আমার নিজের বাড়িটা হলে তোমার জন্য কিন্তু একটা ঘর রাখবো সেখানে। বরের সাথে ঝগড়া হলে চলে এসো যখন খুশি।
সুলতা তার কথায় আর প্রতিবাদ করে না। হাসিখুশি ঘরকন্নার মুখোশটা তনিমার সামনে খসে পড়েছে অনেকদিন আগেই। হয়ত সে কারণে সুলতা মাঝেমাঝে ওকে এড়িয়েও চলে। একটা অস্বস্তি তো আছেই। তাছাড়া ক্রমাগত ওর মুখে সংসার বিষয়ক পর্যবেক্ষণগুলো শুনে মনে মনে সিঁটিয়ে যায় মেয়েটা। তনিমা টের পায় সেসব। তাতে খুব অনুতপ্তও হয়। নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বিব্রত বোধ করে। সুলতার গল্পটাও যে ওর মতো হতে হবে তাতো জরুরি নয়।
প্রসঙ্গটা তাই চাপা দেয় সে। হালকা চালে অন্য কথাবার্তা বলে। শাড়ির গল্প, সিনেমার গল্প করে। সুলতাও জড়তা কাটিয়ে ওঠে দুয়েক দিনের মাঝে। মানসিক গড়নের দিক দিয়ে দু’জন একেবারে আলাদা হলেও ওর সঙ্গটা তনিমা হারাতে চায় না। নিজের বোনের সাথেও তো প্রায় এমন একটা সম্পর্ক ছিল। নানান জটিলতায় সেসব আর অবশিষ্ট নেই। তাই হাতের মুঠোয় যা আছে তাই তরতাজা রাখার আন্তরিক চেষ্টা ওর।
সুলতাও ওকে ভালোবাসে, সমীহ করে। সেদিন অফিস থেকে বের হবার পর সেই তো জোর করে লটারির টিকেটটা কিনিয়েছে। বলেছে নিজের নামে বাড়ি করতে হলে এ ছাড়া তো আর উপায় নেই। তনিমা কিন্তু তখন ওর কথায় যুক্তি দেখতে পেয়েছে। লটারির টিকেট জেতা ছাড়া অত টাকা সে পাবে কোথায়! তাছাড়া এই ভাড়া বাড়িতে থাকবার হাঙ্গামা থেকে বাঁচতে হলে নিজের একটা ঠিকানা তার লাগবেই। হাজারটা কৈফিয়ত দিতে দিতে মনটা তেতো হয়ে থাকে সবসময়। তিনতলার ছাদে চিলেকোঠার ঘরটায় জীবন অভ্যস্ত হয়ে এলেও বাড়িওয়ালির নিত্যদিনের বাক্যবাণ আর ভাল্লাগছে না ওর।
আজকে সিঁড়িতে পা রাখতে না রাখতেই গলাটা শুনতে পেয়েছে। ভদ্রমহিলা ওকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছে- আজ পর্যন্ত এই বাড়িতে চোর-ছ্যাচ্চোর আসে নাই। এমন ভাড়াটিয়া রাখছি তারে দেখতে রাইত-বিরাইতে লোকজন ছাদ বাইয়া উঠে।
মনে হচ্ছিল ওর কানে কেউ যেন গরম কিছু ঢেলে দিচ্ছে। কোনোভাবে ঘরে এসে দরজায় খিল দিয়েছে তনিমা। তারপর অসাড় শরীরটা বিছানায় ছেড়ে দিয়েছে। যেন বুকের ভেতর থেকে সব জল শুষে নিয়েছে কেউ। এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় চোখ দিয়ে ক্রমশ জল গড়াতে থাকে।
আরেকবার মনে পরে দু’দিন আগের ঘটনাটা। একফোঁটা ঘুমায়নি সেদিন রাতে। পরদিন সকালে অফিসে অ্যানুয়াল মিটিং ছিল। এগারোটার মধ্যে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল তনিমা। তারপর খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলে টের পায় ছাদে কেউ পায়চারি করছে ।
ওর চিৎকার শুনে কয়েক মিনিটের মধ্যে যখন পুরো বিল্ডিংয়ের সবাই জেগে গেল ততক্ষণে চোরটা পালিয়েছে। অনেকক্ষণ আলোচনার পর যে যার ঘরে ফিরে গেলেও তনিমা আর ঘুমোতে পারেনি। বিছানায় তলিয়ে যেতে থাকা শরীরটা আতঙ্কে কাঁপছিল বারবার।
দু’দিন ধরে বিল্ডিংয়ের সবাই এই ঘটনা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছে। তনিমা খুব একটা কথা বলে না প্রতিবেশীদের সাথে। এবারেও দস্তুরমতো চুপচাপ রইলো। কিন্তু সে ভাবেনি এরকম একটা ব্যাখ্যা কারো মাথায় আসতে পারে।
বিছানায় শুয়ে থেকেও এত ক্লান্ত লাগছে যে ঘুম এলো না আর। খিদেয় পেটটাও চুঁইচুঁই করছে। বিছানা ছেড়ে উঠে অফিসের ব্যাগ থেকে খাবারের বক্সটা বের করতে গিয়ে লটারির টিকেটটা বেরিয়ে এলো। আর সেই থেকে বিতৃষ্ণা তুঙ্গে উঠেছে ওর। কেন এমন কঠিন পথটা সে বেছে নিল? আরেকটু মানিয়ে নিলে কি এমন একটা দিন ওকে দেখতে হতো! নিজের একটা বাড়ির লোভ কেন হলো ওর? এমন উচ্চাশার বীজ কোত্থেকে ঢুকলো ওর মনের মধ্যে? সুলতার মতো স্বস্তিতে জীবন কাটানোর সুযোগ তো ওরও ছিল। সে ধরে রাখতে পারেনি তাকে। ‘আত্মসম্মান’, ‘বিশ্বাস” এসব বড় বড় কথা ঘাড়ে চেপে বসেছিল। এখন দিনকে দিন সেসবের ভার অসহনীয় হয়ে উঠছে।
কে শুনবে আজকের এই উপলব্ধির কথা? সে তো কারো নিষেধ কানে তোলেনি তখন। ওর ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত শুনে মা বলেছিল- এই মেয়ে জন্মের সময়ই মরলো না ক্যান। ছোটবোন কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। শুনেছিল তার বিয়েটাও নাকি ভেঙ্গে যেতে পারে এমন ঘটনার পর। আব্বা বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল। তাহলে নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নাও-এই অমোঘ বাণী শুনিয়েছিল মানুষটি।
তারপর নিজের পথ নিজে বেছে নিতে গিয়ে বানভাসির মতো বন্ধু আর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সাহায্য নিতে হয়েছিল ওর। কর্মজীবী হোস্টেলেও থাকতে হয়েছে কয়েকমাস। অনেক চেষ্টার পর যখন এই চাকরিটা পেল তখন যেন একটু থৈ পেয়েছিল তনিমা। কিন্তু হোস্টেলও ভাল লাগেনি বেশিদিন। তাই রোজ অফিস শেষে হন্যে হয়ে বাসা খুঁজতো। নানা জায়গায় ঘুরে বুঝতে পারলো স্বামী নেই এমন মেয়েকে কেউ বাসা ভাড়া দেয় না। এই চিলেকোঠার ঘরটা ভাড়া নেবার সময় সেই জ্ঞানটা কাজে লাগিয়েছিল। তবে বাড়িওয়ালি এখনো ওকে জিজ্ঞেস করে- তোমার মায়েরে খুলনা থেকে কবে আনবা? এত অসুস্থ যখন নিজের কাছে রেখে ডাক্তার দেখাও। তুমিও একা থাকলা না।
তনিমা আজকাল নিরুত্তর থাকে। আগে এটা সেটা উত্তর দিতো। এখন সে বুঝে গেছে মুখ খুললেই প্রশ্নের তীর বরং বাড়বে। তারচেয়ে চুপচাপ থাকাই নিরাপদ। কিছুদিন আগে সুলতা এখানে বেড়াতে এসেছিল। তখন কথায় কথায় ওর মুখে তনিমার ডিভোর্সের খবরটা জানতে পারে বাড়িওয়ালি। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই কথার বান ছোটায়।
তবে মানুষটা ওর প্রতি সন্তুষ্ট। বাসা ভাড়াটা যে প্রতিবারই সে নির্দিষ্ট সময়ের আগে দিয়ে দেয়। তাছাড়া বলতে গেলে ওর কাছে কেউ আসে না কখনো। অন্য কোনো দাবি দাওয়াও তনিমা করে না। তাই হয়তো ওকে বাসা ছাড়তে বলেননি। কিন্তু এই চোরের ঘটনার পর থেকে মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেছে তনিমার। কখন যে ডেকে পাঠায় ওকে এই দুশ্চিন্তায় পাগল পাগল লাগে। এ মুহূর্তে বাসা ছাড়তে হলে কোথাও কোনো আশ্রয় পাবেনা সে।
পরদিন সব শুনে সুলতা বলে -আমি তো আছি তনু আপা, এত টেনশন করবেন না।
তনিমা জানে সুলতা তেমন কিছু করতে পারবে না। একরাত থাকবার জন্য জায়গাও সে দিতে পারবে না৷ সংসারে সেই জোর নেই ওর। এত যে প্রেম বরের সাথে তবু মাঝেমাঝে তুমুল ঝগড়া হয় ওদের। বোধ হয় লোকটা ওর গায়েও হাত তোলে। সুলতা সেসব কখনো বলতে চায় না। ওর ফোলা ফোলা চোখ, লালচে গাল দেখে তনিমা যা বোঝার বুঝে নেয়। সেরকম দিনগুলিতে কাজ করতে করতে হঠাৎ শুকনো করে হেসে ওঠে সুলতা। বলে- আপা, আপনিই ভালো আছেন। একটু পর আবার জিজ্ঞেস করে হুট করে ওর বাসায় গিয়ে উঠলে তনিমার বাড়িওয়ালি কি খুব রাগ করবে?
সেই সুলতা যখন ওর হাত ধরে বলে ‘আমি আছি’ তখন এই আশ্বাসের কথাটি এক মুহূর্তের জন্য হলেও ওকে আরাম দেয়। মনে হয় এই আন্তরিকতাটুকু কত দামী৷ তারপর দু’জন একে অপরকে কথার তোড়ে ভুলিয়ে রাখে। বক্সে আনা বাসার খাবার পড়ে থাকে ওভাবে। দু’জনে ক্যান্টিনে বসে পোলাও আর চিকেন রেজালা অর্ডার দেয়। গল্প করতে করতে মুরগির রান চিবোয় সুলতা। তনিমা তাই নিয়ে হালকা খোঁচাও দেয়। তারপর হাসতে গিয়ে বিষম খেয়ে উঠে দু’জন। লাঞ্চ ব্রেক শেষ হবার পরেও বসে থাকে সেখানে।
অফিস শেষে সুলতা বলে- চলেন একটু আড়ংয়ে যাই।
আজ থাক। তনিমা আমতা-আমতা করে। সুলতা ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে বলে- কিছু কিনতেই হবে এমন তো কথা নাই। তাছাড়া আমার কার্ডটা সাথে আছে।
অনেকগুলো ড্রেস ট্রায়াল দেবার পর নিজের জন্য একটা থ্রিপিস কেনে সুলতা। জোর করে তনিমার জন্য দুল আর পার্স কেনে। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে বলে -চলেন এবার ফুচকা খাই।
তনিমা বলে -আজ আমি খাওয়াই৷
এমনিতেই কত ঋণ তোমার কাছে। কবে যে শোধ করতে পারবো জানিনা। তার মধ্যে আজ এতসব শপিং! তনিমার হাসিটা শেষ হতে হতে কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায়।
সুলতাও হাসে। মুখে ফুচকা নিয়েই বলে-লটারিতে যেদিন চল্লিশ লাখ জিতবেন সেদিন ফেরত দিয়েন।
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময় দেখা হয় বাড়িওয়ালির সাথে। তনিমা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ওখানেই। হাসিমুখ দেখে তনিমার বিভ্রান্ত লাগে। আজই বোধ হয় সেই দিন। পাততাড়ি গোটাবার সময় হলো এবার। মুখে কোনো কথা ফোটে না ওর। চুপচাপ ঘামতে থাকে সে।
কাল আমাদের বাসায় মিলাদ। আমার হাসব্যান্ডের মৃত্যুবার্ষিকী। তাই তোমারে বলতে আসছিলাম।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে ওর। তনিমা সাথে সাথে ঘাড় কাত করে বলে সে যাবে। ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে থাকেন তখনো। তারপর শপিং ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বলেন- কত আনন্দ না জীবনে? একলা একলা ভালই আছো তাইলে!
তনিমার ভেতরটা তেতো হয়ে ওঠে আবার। সুলতার সাথে সময় কাটিয়ে এতক্ষণ যে আনন্দটা জমা হয়েছিল তা মুছে গিয়ে ঝুপ করে ক্লান্তি নেমে আসে পুরো শরীরে। মনে হয় চারদিকে থিকথিকে কাদা। আর সে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে।
ভদ্রমহিলা আরেকটু কাছে এসে চাপা স্বরে বলেন- দশ বছর হইছে লোকটা নাই। এত অত্যাচার করতো, জানো! এখন আমিও আনন্দে আছি।
কথাগুলো বলতে বলতে ওর কাঁধটা আলতো করে ছুঁয়ে দেন তিনি। তনিমা ভালো করে তাকায় মুখটার দিকে। হঠাৎ করে ওর মনে হয় হয়তো এই মানুষটিও কখনো নিজের একটা ঘরের অপেক্ষায় ছিলেন। শুধু মুখ ফুটে বলতে পারেননি কাউকে। ওর মতো। হয়তো সুলতার মতোও।
জন্ম ২ এপ্রিল, চটগ্রামে। বাবার চাকুরীসূত্রে তার শৈশব কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন মফস্বল শহরে। তিনি পেশায় চিকিৎসক। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা এবং খবরের কাগজে নিয়মিত লেখেন। ব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখিতেই তিনি মনের খোরাক খুঁজে পান।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ -কিছু গল্প অবাঙমুখ (২০১৮), নৈর্ঋতে (২০২০)।