হাছন রাজার পিয়ারী
এক
হুট করে এই নদীর পারে এসে চিন্তায় পড়ে যায় ছেলেটি। এই শহরে তার কোন পরিচিতজন নেই। রাতে থাকার মতো নিশ্চয়ই কোনো হোটেল পাওয়া যাবে, এমনটা মনে করেই বিকেলবেলা সে চলে এসেছে এখানে। সুনামগঞ্জেই যে আসবে এমন তার পরিকল্পানাও আগে থেকে ছিলো না। শাহ্ আবদুল করিমের কবর দেখে দিরাইতে ফেরত এসে সে সিলেটের বাসেই উঠেছিল। ২০-২৫ কিলোমিটার যেতেই সিলেট সুনামগঞ্জ রোডের ইন্টার সেকশনে বাস থামলে তার চোখে পড়ে সুনামগঞ্জের সাইনবোর্ড। মাত্র ৭ কিলোমিটার পথই যদি হয় সুনামগঞ্জ তবে তার সেখানে যেতে সমস্যা কেনো? করিম সাহেবের আগের পুরুষ হাছন রাজা। না হয় তার বাড়িটা দেখেই আসুক।
এই জায়গাটিতে নানা রকমের বাস আর অটোরিকশা আসা যাওয়া করে। সিলেট যাবার জন্য সিলেটগামী যে বাসে সে উঠেছিলে, সে বাস থেকে আগে নেমে পড়লো। এবং মিনিট খানেকের মধ্যেই সিলেট থেকে আসা আরেকটা বাস যখন কিছু যাত্রী নামানোর জন্য একটু কড়া করে ব্রেক ধরলো, তখনই সে প্রায় বাদুর ঝুলা হয়ে বাসের ভেতর ঢুকে পড়ে।
এবার সে ঠিক কোথায় যাচ্ছে, একেবারেই জানতে চাইছে না। শুধু জানে এটা সুনামগঞ্জের রুট। এই বাস কোন একসময় সুনামগঞ্জে যাবে।
কিছুদূর যেতেই একটা কালভার্টের কাছে এসে রাস্তার দুই পাশে দুই দোতারা টাঙানো গেট দেখে বুঝে গেলো, হাছন রাজার দেশে সে চলে যাচ্ছে। এই পথ মিনিট দশেকের মাথায় শেষ হলো। বাসটি পুরনো বাস স্ট্যান্ডে এসে থেমে গেলে ছেলেটি নেমে যায়। ভাড়া মিটিয়ে রাস্থার উপর এসে দাঁড়ায়। আর ভাবে এখন সে যাবে কোথায় ?
বাসস্ট্যান্ডের ঠিক উল্টাদিকে কতোগুলো খাবারের দোকান। আস্ত ছাগল, মুরগী আর বোয়াল মাছের ছবি দেয়া সাইনবোর্ড। সে একটার ভেতরে চলে গেলো। পানির দেশে তাজা মাছ নিশ্চয় থাকবে। বোয়াল মাছের অর্ডার করলো। সঙ্গে ডাল। বোয়াল মাছ এলো সঙ্গে আলু আর টমেটো। খারাপ না, এ অঞ্চলের লোকেরা কি ভুনা কম খায়? পাতলা ঝোলের তরকারিতে ভরপেটা খেয়ে সে বেরিয়ে এলো। এখন তবে কী করবে?
সেল ফোনের ঘড়িতে সময় দেখলো। বিকেল পাঁচটা বাইশ মিনিট। এপ্রিল মাসে আকাশ মেঘলা থাকায় ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে তার কতো দেরী হবে। সময়টা হিসেব করে ভাবলো সন্ধ্যা হতে যখন ঘন্টা দেড়েক আছে, তখন সুরমা নদীর পারে কিছুটা সময় না হয় কাটিয়ে ফেরা যাক শহরে।
বাস থেকে যতোটা সে দেখেছে এই শহর, তাতে তার খুব ভালো লেগে গেছে। ঢাকা থেকে বেরিয়ে যে শহরেই যাক না কেনো, ভালো লাগে। ছবি তোলার কাজে ফুরসত পেলেই সে শহর থেকে বেরিয়ে যায়। পলাশী থেকে হেঁটে হেঁটে শাহবাগ, সেখান থেকে মহাখালী এসে ময়মনসিংহের বাসে উঠে মাঝখানে কোথাও নেমে যায়। গাও-গেরাম ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে। কেউ জিগ্যেস করলে নানারকম উত্তর দেয়। কারো কাছেই তার আসল পরিচয় জানায় না। যার কাছে যে পরিচয় দিতে হয়, সেটাই দিয়ে থাকে। কেউ জানে সে সাংবাদিক, কেউ জানে ফটোগ্রাফার। কেউ কেউ জানে সে জমির দালাল, কাউকে বলে সে তার এক আত্মীয়ের জন্য জমি দেখতে এসেছে।
আজ এই সুনামগঞ্জে নেমেই তার মনে হলো, এখানে দু চার দিন থাকা যায় অনায়াসে। দিরাইতে শাহ্ আবদুল করিমের বাড়িতেও তার থাকার ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু কেউ রাখেনি। দু’দিন আগে ভোরবেলা সিলেট নেমেই জগন্নাথপুরের কেশবপুর গ্রামে গিয়েছিল রাধারমণের বাড়িতে। সারাদিন রাধারমনের মন্দিরের পাশে পুকুর পারে বসে ছিলো। সন্ধ্যা হলে চলে আসে আছিম শাহ্-এর মাজারে। সেখানে সারারাত গান বাজনার মধ্যে থেকে, শেষ রাতের দিকে মাজারের পাশের বড় ঘরটির এক কোনায় ফ্লোরের উপর হ্যাভারসেক রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে চলে আসে দিরাই। সারা বেলা নৌকা নিয়ে কালনী নদী ঘুরে ক্লান্ত হয়ে দিরাই বাজারের এক হোটেলে তিনশো টাকায় রুম ভাড়া করে রাত কাটিয়ে গিয়েছিল উজানধল গ্রামে। শাহ করিমের কবরের পাশে কিছুক্ষণ বসেছিল। তার বসাবসি আবার খুব নিশ্চুপ থাকে না। সে ক্যামেরা ছাড়া নড়তে পারে না। আগে শুধুই স্টিল ক্যামেরা তার সঙ্গী থাকতো, পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ভিডিও ক্যামেরা। এই দুই ক্যামেরা বাদ দিয়ে নতুন একটা ডিএসএলআর নিয়েছে। এতে দুই ক্যামেরার কাজ হয় তার। পকেটে আছে ভয়েস রেকর্ডার। আর আছে ছোট্ট ক্লিপ মাইক্রোফোন। সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিলেটের হাওড় বাওড়ে সে একমাস ঘুরে বেড়াবে। সিলেটের এই ভাটি অঞ্চলে কী করে বা কেনো এতো আউল-বাউলের জন্ম হলো, তা সে উদঘাটন করেই ছাড়বে।
কিন্তু এই শেষ বিকেলে এই লোকালয়ে এসে কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। তার কাঁধে যে ব্যাগ এটা একটা বিশেষ ডিজাইনের। নতুন এসেছে বাজারে। এর একপাশে চমৎকারভাবে তার ম্যাকবুকটা রাখা। ভেতরে অনেকগুলো খোপ আছে। বড় খোপটা ক্যামেরার, বাকী খোপগুলো নানা রকমের ল্যান্স, হুড, চার্জার, এসবের জন্য। তার একটি মাত্র ল্যান্স ১৮-২০০ মি:মি। আর কিছু নাই। আছে ৩টা চার্জার। ম্যাকবুক, ফোন আর ক্যামেরার। এসব রাখার পর আরো তিনটা ছোট খুপরী পড়ে থাকে ব্যাগের ভেতর। একটিতে টুথপেস্ট, টুথব্রাস, আর একটা ছোট্ট ডিওডোরেন্ট। আগে শেভিং কিটস্ নিয়ে বেড়াতো ব্যাগে। এখন প্রয়োজন হচ্ছে না। এটা তার এখন লাগে না। গোঁফ-দাঁড়ি নিজের মতো একটু বাড়ছে। তাতে অবশ্য মাঝে মাঝে সমস্যা হয়। ছোকরা টাইপের ছেলেরা তার কাছে এসে জিগ্যেস করে- শুকনা কোথায় পাওয়া যায়? সে প্রথমে বুঝেনি। পরে ভদ্র ভাষায় জবাব দিয়েছে, না ভাই, গাঁজা আমি খাইনা। সিগারেটও না।
তার ব্যাগের অপর দুই খুপরিতে আরো দু টো জামা আছে। একটা ইলাস্টিক দিয়ে বানানো ঢিলাঢালা থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট। আরেকটা সুতির পাতলা টি শার্ট। এগুলো সে কখনো কখনো ঘুমানোর সময় ব্যবহার করে, আবার কখনো এই ঘুমের পোশাক পরেই ছবি তুলতে বেরিয়ে যায়।
ব্যাগের সাইড পকেটে ছোট্ট একটা নোটবুক। এখানে কতগুলো তারিখ, জায়গা আর কিছু মানুষের নাম লেখা। মাঝে মাঝে খুব সংক্ষেপে, তার নিজের বোঝার মতো কিছু শব্দ লেখা থাকে। তাঁর ইচ্ছা, পরবর্তীতে তার ফটোবুক যখন প্রকাশ হবে সেখানে সে এখান থেকে তথ্য নেবে। ব্যাগের ভেতর তার সবচেয়ে আদরের জিনিসটা, তার ক্যামেরা। ক্যামেরাটা সে নিজের টাকায় কিনেছে। তার এক টিচারের পুরস্কারজয়ী একটা আর্কিটেকচারাল প্রজেক্টের উপর ৫ মিনিটের একটা ডকুমেন্টারি বানিয়ে দিয়েছিল তিন দিনের মধ্যে। এই কাজটা তার টিচার যোগাড় করে দেন তার ক্লায়েন্টের জন্য। ভালো টাকা পেয়েছিল। আগের স্টিল ক্যামেরাটা সস্তায় বিক্রি করে আরো কিছু ভরে কিনে ফেলেছে এই ক্যামেরা। ছোট্ট একটা ম্যাকবুক তার সঙ্গে থাকে। খুব জরুরী কিছু হলে এই ম্যাকবুকেই এডিটের কাজটি করে ফেলে। সুতরাং তার কাজের জন্য বসার কোনো জায়গার দরকার হয় না।
ছেলেটি পড়ছে বুয়েটে আর্কিটেকচার নিয়ে। ৫ বছরের কোর্স। এর মধ্যে ৭ বছর তার হয়ে গেছে। এখনো ক্রেডিট শেষ হচ্ছে না। ধারণা করা যাচ্ছে আরো বছর দুই তার লাগতে পারে। গত টার্মে সে ওয়ার্কিং ড্রইং-এ ফেল করেছে । পরের টার্মে এটা রিপিট করে সে ফোর ওয়ানে উঠে যেতে পারতো। কিন্তু নেবে না। সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ইয়ার রিপিট করবে। ডিজাইন-এ একজেম্পশন পেয়েছে। থিয়োরি ক্লাস তার করা লাগে না। থিয়োরী দুইটাওতে ভালো নাম্বার আছে। বাকীগুলো পরীক্ষার আগে একটু দেখে নিলেই পারবে। এক সপ্তাহ আগে ওয়ার্কিং ড্রইং শেষ এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দিয়েছে। সুতরাং মাস দেড়েক সময় পুরাপুরি এখন তাঁর হাতে। এই সময়টা সে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বেরিয়ে গিয়েছিল ৩দিন আগে। আর কতদিন থাকবে, কেউ জানি না। ঢাকা থেকে বেরুনোর সময় ৭ হাজার টাকা তার পকেটে ছিলো। এখনো ৪ হাজারের উপরে তার পকেটে আছে। সুতরাং তার কোন চিন্তা নাই।
টানা ৬ দিন বৃষ্টি হয়েছে এখানে। বৈশাখ মাস আসতে এখনো কয়েকদিন বাকী। এই সময়ে বৃষ্টি হবার কথা ছিলো না। কিন্তু হয়ে গেলো। এতো বৃষ্টির পানি আটকানোর জন্য যে বাঁধ বানানোর কথা ছিলো সেই বাঁধের কাজ আগে শেষ করেনি তার ঠিকাদার। করবেই বা কেনো? শুকনো মৌসুমে বাঁধের কাজ শেষ করলে মাঝে চোরামি করা যায় না। অপেক্ষা বর্ষার। পানির তলে বাঁধ চলে যাবার পর ইচ্ছা মতো মাপ নিয়ে প্রজেক্টের লোকদের খুশি রেখে নিজের খুশি মতো বিল ওঠানো যায়। সুতরাং ধীরে চলুক বাঁধের কাজ। এই সুযোগে মেঘালয় থেকে গড়িয়ে আসা বাদলির পানি এসে অসময়ে ডুবিয়ে দিয়ে যায় ধানের ক্ষেত। ধানের বীজ তখনো দুধেল নরম। সপ্তাহ দুই সময় পেলে এই দুধেল ধানে বীজ গজাতো, চাল হয়ে যেতো, তারও সুযোগ ছিলো না। সব ধান পানির তলায় চলে যাবার পর সবুজ ক্ষেত এখন ভেটভেটা বর্ষার রূপ নিয়ে আছে।
ছয় দিন পর আজ রোদ উঠেছে। মানুষজন এখন ঘর থেকে বেরিয়েছে। নদীর পারে অনেক মানুষের জটলা।
ছেলেটি একটা রিকশা নেয়। এই শহরের রিকশাগুলোও মজার, ব্যাটারিতে চলে। চালকের খাটনি কম, ঝাকিঝুকিও লাগে না। এই ঝাকি না লাগার কারণে রিকশায় বসে বসে শহরের কতগুলো ট্র্যাকশট নিয়ে নেয়। সামনে বেশ উঁচু একটা ব্রিজ, সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। সে রিকশা নিয়ে ব্রিজের তলা দিয়ে গিয়ে নদীর ঘাটে গিয়ে রিকশা ছেড়ে দেয়।
নদীর পার ঘেঁষে কংক্রিটের পায়ে হাঁটা পথ। জায়গায় পৌঁছে মনে হলো, নৌকা বা স্টিমার বানানোর একটা কারখানা এটা। বেশ ক টা বড় বড় নৌকা পেট উল্টে শুয়ে আছে মেরামতের অপেক্ষায়। তার একপাশে কিছু দোকানপাটও আছে। সামনে কতগুলো স্টিমার ভিড়ানো। কোনো কোনটি ছইওয়ালা নৌকার মতো। ইঞ্জিন আছে। কিছু আছে একেবারেই সাধারণ নৌকা, মানুষ পারাপারের জন্য তার ব্যবহার। সে সবেও ইঞ্জিন লাগানো। একটি মাত্র নৌকা এতোক্ষণ একাকী নদীর হালকা স্রোতে দোল খাচ্ছিল, কিন্তু প্রায় সত্তর বছর বয়েসী এক লোক পার থেকে নৌঙর ছাড়িয়ে যেই না তার নৌকায় উঠতে যাবে, এমন সময় ছেলেটি তার সঙ্গে কথা বলে।
– চাচা, এই নদীটার নাম কি সুরমা ?
– অয় বা
– আমি এই নদীতে এক ঘন্টা ঘুরবো। কত নেবেন ?
– আমরা মাছ ধরি বাজান। আফনে সাববাড়ির ঘাটো যাউক্কাগি। হিকানো খেওয়া আছে, নাও আছে, মাঝিও আছে। ঘন্টা চুক্তিতে যায় তারা। দুই তিনশো টাকা ঘন্টা নেয়।
– চাচা, আমি আপনার নৌকায় কিছুক্ষণ বসি। একসময় আমি নেমে যাবো। যতক্ষণ থাকবো, তার জন্য পয়সা দেব আপনাকে।
– নামবায় খই?
– আপনি যেখানে নামাবেন, নেমে যাবো।
চিন্তায় পড়ে যায় নৌকার মাঝি। এমন কিছিমের লোক সে আগে দেখেনি। ধারণা করছে ঢাকা থেকে আসা কোনো সাংবাদিক, বা এ রকম কেউ হবে। সে যেই হোক, ছেলেটির আবেদনের মধ্যে যে সারল্য আছে, তাতে মুগ্ধ হয়ে মাঝি নৌকায় উঠিয়ে নিলে ছেলেটি নৌকার গলুইতে গিয়ে বসে। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে। মাঝি খানিকটা চমকায়। কিছুটা ভয়ও তার মধ্যে এসে গেছে। একটু হাসি মাখিয়ে বললো – আফনে সম্পাদিক? ঐ চুরগুলারে নিয়ে বালাখরি রিফোর্ট খরইন
হাসে ছেলেটি। বলে, না চাচা। এমনে আমি ফটু তুলি। আমি স্টুডেন্ট। বুয়েটে পড়ি।
মাঝি তার কিছু বুঝলো বলে মনে হলো না। আবার প্রশ্ন করে তা, বাজান, কুন বিষয়ের রিফোর্ট করবা?
ছেলেটি এবার আর জবাব দেয় না। নদীর পশ্চিম পারের গ্রামের আড়ালে চলে গেছে সূর্য। তারা নদী পার হয়ে উত্তর দিকের হাওড়ের দিকে নৌকা বাইতে শুরু করে। এক সময় নদীর পশ্চিম পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা খাল গিয়ে হাওড়ে মিশে যায়। ছেলেটির মন ফুরফুরা হয়ে ওঠে। সামনে আর লোকালয় নেই। অনেক দূরে উত্তর পাশে মেঘালয়ের পাহাড়। সন্ধ্যা হয়ে আসে। হাওড়ে কতগুলো বাতি জ্বলছে। বাতি জ্বলছে নৌকার গলুইয়ে রাখা হারিকেন থেকে। এগুলো সব জেলেদের নাও। সারারাত জেগে জেগে তারা জাল পাহারা দেবে।
মাঝি বলে, রাইত কুয়াই থাখবা বা?
ছেলেটি বলে, ঐ নৌকায়।
– খার নৌকায়?
– যেকোনো জেলের নৌকায়?
মজা পেয়ে যায় মাঝি। বলে- গান হুনবাইন? ই মাঝিরা সারারাইত ইনো গান খরে।
– কিসের গান? হাছন রাজার?
– শুধু হাছন নায়, আরো বউতর গান অয় ইনো। করিমর গান বেশি চলে, ধামাইলও গায়।
– হাছন রাজার গান হয় না?
– হাছন রাজা তো মাঝে মাঝে নিজেউ আইয়া ফড়ইন।
– মানে?
– মাইনষের মুখে হুনছি বাজান। হাছা-মিছা জানিনাবা। ভরা বারিষার চান্নি রাইত মাজে মাজে ই খাংলার আওর বা হ বাজুর ঔ দেখার আওর দিয়া তান নৌকা আয়। তাইন নিজেও গান গাইন, সঙ্গী সাথীরাও গায়।
– বলেন কী !
– ঘটনা হাছা। বহুত মাইনষে দেখছে। দুই চাইর জনের লগে খতাও অইছে তার।
– কী কথা ?
– ইতা জানি না। একবার এক মাজি তারে দেখিয়া ফিট অইয়া ফড়ি গেলো নৌকা তাকি। আর উঠলো না। মারা গেলো। এরফর তাকি তার নৌকা দেখলে লোকজন হরি যায়। খেউ খাছে যায়না, মাতেও না।
– আর কেউ দেখছে তারে?
– আমার বাজানে একবার দেখছইন তানরে। খাংলার আওরো কুড়া শিকার খরতে। বাজানোর নাম ধরি ডাখও দিছোইন। বাজানোর লগে ফরিচয় আছিল তান।
– তারপর?
– বাজান ডাক হুনি খান্দাত গিয়া দেখোইন, তান কুড়া আছে, ছাত্তি আছে, তাইন নাই, মিলাই গেছোইন।
ছেলেটি বুঝে, নিতান্তই তৈরি হওয়া একটা মীথ এটা। এমন মীথ পীর ফকির শ্রেণির নানা লোক সম্পর্কে শোনা যায়। হাছনওতো কিংবদন্তী চরিত্র। তাঁকে নিয়ে এমন গল্পগাঁথা তৈরি হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক।
ছেলেটি আকাশের দিকে মুখ করে নৌকার গলুইতে শুয়ে পড়ে। ছবি তোলার কাজ না থাকলে আকাশ দেখাকে বড় কাজ মনে করে সে। রাতের আলোয় ছবি হয় না, যা হয় তা নিয়ে তার কোনো উৎসাহও নাই। সে আকাশের তারা গুনার চেষ্টা করে। কিন্তু খুব অমাবশ্যা না থাকায় তারা গুনতে সুবিধা হচ্ছে না। সে দেখে সবগুলো তারা স্থির আছে। শুধু আকারে কোনটা বড়, কোনটা ছোট। একটি মাত্র তারা ফড়িং এর মতো ওড়াওড়ি করছে। যে আকা-বাঁকা পথ ধরে ছুটছে। একবার ভাবলো, এটা হয়তো কোনো স্যাটেলাইট। অন্যকোন গ্রহ থেকে এসেছে, বা সেখানে যাচ্ছে। পরে মনে হলো, না সেটা হতেই পারে না। স্যাটেলাইট তো সোজাসুজি যাবে। এটা তবে অন্য কিছু? কী হতে পারে? আকাশের তারার দিকে তাকালে সব সময় তার মনে এমন কিছু প্রশ্ন আসে যার জবাব সে জানে না। এসবের জবাব যেসব পুস্তকে লেখা আছে, সেগুলো নিয়েও তার অনেক সন্দেহ। কী আছে ওখানে? মানুষ মরে গেলে কি ঐ সব তারার রাজ্যে চলে যায়? নাকি কখনো কখনো সেই তারার রাজ্য থেকে আবার ফেরত আসে পৃথিবীর গ্রহে?
হাছনও কি তেমন করে আসতে পারে?
ছেলেটি নাওয়ের গলুই থেকে উঠে দাঁড়ায়।
পূবের আকাশে খুব বড় একটা চাঁদ উঠেছে আজ। কিন্তু এই চাঁদের আলো খুব একটা আসছে না। দুই দিন পর বড় চাঁদ উঠবে। এমন ভরা বর্ষার ফকফকে জোৎস্না রাতে পানির কী রূপ হয় সে আসলে খুব একটা অনুমান করতে পারছে না। বড় বড় লেখকদের লেখায় হাওড়ের পানি, চাঁদ, জোৎস্না, এসব নিয়ে অনেক কাব্যকথা পড়েছে সে, কিন্তু এমন কিছু দেখেনি। সে মাঝিকে জিজ্ঞাসা করে- আচ্ছা পরশু তো ফুলমুন, তাই না চাচা?
মাঝি কথা বলে না। মনে হয় বুঝে নাই।
ছেলেটি আবার বলে, পরশুতো পূর্ণিমা?
– অয়, বাজান। পরশু চান্নিরাইত।
– পরশু রাতে কিন্তু অনেক বড় পূর্ণিমা হবে। গত ৮০ বছরে চাঁদ এতো বড় হয়নি। পরশু কি হাছন রাজার নাও– আসতে পারে এই হাওড়ে?
মাঝি বলে, এর কোনো ঠায় ঠিকানা নাই। সব চান্নি রাইতে তার নাও আয় না। তবে দুই তিন বছর পরপর তাইন আইনই ই খতা হুনা যায়। গত বছর খেউ দেখসেনা। তয়- ইবার আইতা ফারইন। মাঝে মাঝে সাববাড়ির ঘাটর গেসে আইয়া আবার যাইন গিয়া।
ছেলেটি ব্যাগ থেকে তার ফোনটি বের করে। আজ সারাদিন ফোন খোলা হয়নি। সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছিল, যতদিন এই অঞ্চলে থাকবে, ফোন খুলবে না। ফোন থাকা, ফেসবুক থাকা মানে বিশাল যন্ত্রণা।
কিন্তু এখন তার ফোন বের করতে ইচ্ছা হচ্ছে। ফোনে চার্জ আছে পঁয়ষট্টি পারসেন্ট। বাহ্। মোবাইল ডাটা অন করলো। দেখে এখানে পুরো ফোর-জি নেটওয়ার্ক। ফেসবুক অন করতেই দশ বারোটা নোটিফিকেশন চলে এলো। সে কোনো দিকে খেয়াল না করে একটা স্ট্যাটাস লিখে পোস্ট করে দিলো।
স্ট্যাটাস পোস্ট করেই এক ধরনের রোমাঞ্চ বোধ করে সে। কিন্তু তার ফলাফলের জন্য আর অপেক্ষা করে না।
আকাশটা বেশ মেঘলা। মেঘের আড়াল হয়ে গেছে সন্ধ্যা রাতের চাঁদ। আজ আর বেশীক্ষণ থাকবে না এখানে। ফোনটা বন্ধ করে ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়ে মাঝিকে বললো, আপনি আমাকে নদীর পারে কোথাও নামিয়ে দেন চাচা। না হয় আপনার বাড়ি নিয়ে যান, আপনার সাথে ঘুমাই। আগামী পরশুর জন্য তৈরী হতে হবে আমার।
দুই
বেলা সাড়ে তিনটায় ঢাকা-সুনামগঞ্জের শ্যামলী বাস থেকে নেমেই রিকশা নিয়ে সাহেববাড়ির ঘাটের দিকে যেতে যেতেই চারু একটা ঘোষণা শুনতে পায়। – সম্মানিত এলাকাবাসি, আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে,আজ সন্ধ্যা ৭টা থেকে শহরের রাস্তার সব বাতি নেভানো থাকিবে। শুধু ঘরের ভেতর আলো থাকিবে, আর কোথাও আলো পাইবে না রাত তিনটা পর্যন্ত। সম্মানিত এলাকাবাসি, আপনাদের অনুরোধ করা যাইতেছে যে, আপনারা ঘরের বাতি নিভাইয়া রাখুন, কিংবা অল্প আলোতে রাখুন যাহাতে আলো ঘরের বাহিরে আসিতে না পারে। সম্মানিত এলাকাবাসি, আপনাদের নিরাপত্তার জন্য শহরে বিশেষ পুলিশের ব্যবস্থা রাখা হইয়াছে। আপনারা দলে দলে জোৎস্না দেখিবার জন্য রিভারভিউ ঘাট কিংবা নদীর পারের যে কোনো ঘাটেই নিরাপদে চলাচল করিতে পারিবেন। আদেশক্রমে, মাননীয় মেয়র, সুনামগঞ্জ পৌরসভা।
এক লোক রিকশায় বসে আছে মাইক হাতে। রিকশার সামনে-পেছনে দু টো চোঙাওয়ালা মাইকের স্পিকার। কিছু দূর গিয়ে রিকশাটি থামে। লোকটি বিশাল একটা ঘোষণা পড়ে শোনায়।
শহর পেরিয়ে আধা মাইলের মতো পথ পাড়ি দিয়ে দেখে একটা নদীর পার দিয়ে তার রিকশা চলতে শুরু করেছে। চলতে চলতে এক জায়গায় তাকে নামিয়ে দেয়। রিকশাওয়ালা বলে, এটাই সাহেববাড়ির ঘাট।
চারু তার ব্যাগের ভেতর থেকে পার্স বের করে। সে আসলে জানে না, ভাড়া কত হতে পারে। সে বিশ টাকার একটা নোট বের করবে বলে হাতে ধরে রেখে রিকশাওয়ালাকে জিগ্যেস করে কত ভাড়া?
– দশ টাকা।
চারু একটা লাল রং-এর দশ টাকার নোট খুঁজে বের করে তার হাতে দিতে দিতেই বুঝে ফেললো এই অঞ্চলের মানুষেরা এখনো যথেষ্ট গরীব আছে। খরচও কম তাদের। ঢাকায় হলে এই ভাড়া পঞ্চাশ টাকা চাইতো রিকশাওয়ালা।
জমিদার সাহেবের বাড়ির ঘাট যেমন হবে ভেবেছিল, সে রকম কিছু নাই। চারু দেখে- অনেকগুলো বালু ও পাথরের ট্রলার দূরে। কাছে কিছু ছোট ছোট নৌকা। রাস্তাটির এক পাশে কোন কোন বাড়ির সীমানা বরাবর কিছু দোকান। দোকানে চিপস-চানাচুর ঝোলানো। অপর পাশে নদী। নদীর উপর কয়েকটা খুঁটিতে ভর করে টিন শেডের এক মাচা। দেখেই বুঝে ফেলে- এটা চায়ের দোকান। সে দোকানের একটা জানালার পাশের বেঞ্চের উপর গিয়ে বসে পড়ে।
দোকানদার চারুকে দেখে চমকালো না। কারণ সাহেববাড়ির ঘাটে এমন অনেক কাস্টমার সে রোজই দেখে। হাছনরাজার বাড়ি ও জাদুঘর দেখা শেষ করে এখানে এসে শহরের ছেলে মেয়েরা জটলা পাকিয়ে চা বিস্কুট খায়, কেউ কেউ এখান থেকে নৌকা ভাড়া করে সুরমা নদীতে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এই মেয়েটি এসেছে একা। তার পরনে একটা কালো রং-এর ট্রাউজার, সঙ্গে ঢিলেঢালা নীল রং-এর টপস। আর কিছু নেই। সে তার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে কাঠের পাটাতনের উপর রাখতে গিয়ে তক্তার ফাঁক দিয়ে দেখে নিলো যথেষ্ট ঘোলা পানি প্রবাহিত হচ্ছে এবং বেশ স্রোতও আছে। চোখ থেকে চশমা নামিয়ে রাখে সামনের টেবিলে এবং প্রায় পরিচিত দোকানদারকে যেমন করে বলে, সে রকম স্বরেই বললো – মামা এক কাপ রং চা, চিনি ছাড়া, শুধু লিকার।
এটুকু বলেই দোকানের সামনে রাখা কতগুলো বৈয়ামের একটি থেকে একটা কেক বের করে নিল। পাশে আছে এক কাদি কলা। দুইটা কলা ছিড়ে হাতে নিয়ে বললো- মামা, খাবার পানি কোনটা?
দোকানী এমন কাস্টমার আগে পায়নি কখনো। সে প্রথমে ভেবেছিল এটা সম্ভবত; একটা ছেলে। কাছে আসার পর ভালো করে কথা শোনার পর এবং চুলের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এটা ছেলে নয়, মেয়েই।
চারু মাথা থেকে টুপি খুলে পাশের বেঞ্চিতে নয়, একটু দূরে গিয়ে একটা বড় পাথরের উপর বসে সিগারেটে আগুন ধরালো। এর মধ্যে তার পাশে চা চলে এসেছে। সারাদিন তেমন কিছু তার খাওয়া হয়নি। এখানে রাতে কোনো হোটেলও ঠিক করেনি। নৌকায় রাত কাটানোর কথা। কিন্তু নৌকা কোথায়? কাউকে কোথাও পাচ্ছে না।
চারু ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সুইচ অন করে। ভালো চার্জ আছে ফোনে। ষাট পার্সেন্ট। খারাপ না। পাওয়ার ব্যাংক সাথে আছে ফুল চার্জ দেয়া। চিন্তা নাই। সে ফোনে মোবাইল ডাটা অন করে। সে নিশ্চিত, ফেসবুকে গেলেই খবর পেয়ে যাবে।
আকাশ বালকের টাইমলাইনে যায়। দেখে একটা ইভেন্ট এর মধ্যে খুলে রেখেছে ছেলেটা – জোৎস্নাবিহার উইথ হাছন রাজা। সাহেববাড়ির ঘাটে রিপোর্টিং ৪ টায়। কনফার্ম গোইং ২৫০। বলে কী !
এই ইভেন্ট খুলেছে আকাশ বালক নামের আইডি থেকে। এটা ফেইক নাম। এ জন্য কথা বলতে ইচ্ছা হয়নি চারুর। কিন্তু এখন না বলে উপায় নাই। ভাব দেখে কিছুই মনে হচ্ছে না। সে কি প্রতারণার শিকার হতে যাচ্ছে?
আকাশ বালকের সাথে কথা বলা দরকার। সে ম্যাসেঞ্জারে জানায়, এসে গেছে।
আকাশ বালক সাথে সাথে জবাব দে – বিকেল ছয়টায় রিভার ভিউতে থাকবো। আসতে পারেন।
চারু ঠিক বুঝতে পারছে না, তার এখন কি করা উচিৎ। আকাশ বালক কারো নাম হতে পারে? নিশ্চিত ফেক আইডি। প্রোফাইলে তার যে ছবি আছে, এটা একটা ছায়ার। কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে পাথরের উপর ছায়া পড়েছে। এমন ছবিতে কারো চেহারা চেনা যায় না। আবার এবাউট -এ গিয়ে দেখেছে, স্টাডিড- বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি। এর মানে কি সে এখনো বুয়েটের স্টুডেন্ট, নাকি পাশ করে বেরিয়ে গেছে? পাশ করে যদি বেরিয়েই যাবে, তবে পলাশী এলাকায় থাকবে কেন ?
সে পাল্টা একটা ম্যাসেজ পাঠায় ইনবক্সে।
– আপনারা কোথায়?
– আমি সুনামগঞ্জ, আপনি?
– আমিও সুনামগঞ্জ
– কোথায় উঠেছেন?
– সাহেববাড়ির ঘাটে।
– আমিও তো এখানে। আপনি কোথায়?
– টং এর পেছনে একটা বালুর ট্রলার দেখেন। তার ছাদের উপর আমি শুয়ে আছি। এখানে অনেক জায়গা আসতে পারেন।
– আমি স্টিমারে যেতে পারবো না। আমি টং এর কাছেই, নদীর পারে। আপনি আসেন।
চারু দোকানে চায়ের বিল মিটিয়ে ডানে বামে তাকিয়ে, নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়ানো কয়েকটা বালুর স্টিমার দেখতে পায় এবং এক সময় লক্ষ করে যে একটা ছোট্ট নৌকা করে এক তরুণ নদীর পারের দিকে আসছে। নৌকাটি কাছে এলে সে তরুণটিকে সরাসরি প্রশ্ন করে-
– আপনি একা? আর কেউ নেই?
– আরো কয়েকজন আসার কথা। আপনি প্রথম এলেন।
– আমি কি এই নৌকায় উঠবো?
– উঠে পড়ুন
– আমরা যাবো কোথায়?
– আপতত এখানে থাকবো। এই নৌকা দিয়ে যাবো রিভার ভিউতে। একটা বড় নৌকা আসবে রিভার ভিউতে। ওখানে ৬টায় আসতে বলেছি সবাইকে। আমরা সন্ধ্যার পরপরই রওয়ানা দেবো। খাওয়া দাওয়া হয়েছে?
– না। আপনার?
– না।
– চলেন, খাই কিছু।
এই বলে তারা আবার সেই টং দোকানের কাছে নৌকা ভিড়ায় এবং মাঝিকে দিয়ে চা-বিস্কুট-বনরুটি- আনিয়ে নৌকায় বসে বসে খায়।
এই যুগের ছেলেমেয়েরা অনেক স্মার্ট। তারা অপরিচিত কারো সঙ্গে পরিচিত হতে সময় নেয় কম। পাঁচ মিনিটের মাথায় এই তরুণ-তরুণী দুজন নিজেদেরকে একই শহরের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসিন্দা হিসেবে নিজেদের আবিস্কৃত করে ফেলে। মেয়েটি থার্ড ইয়ারে, ছেলেটি ফোর্থ ইয়ারে। একজনের বিষয় এনথ্রোপলজি, আরেকজনের আর্কিটেকচার। মেয়েটি কবি, ছেলেটি ডকুফিল্ম মেকার। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই একে অপরকে তুমি বলে সম্বোধন করা শুরু করে দিলো।
– তোমার কবিতার বিষয় কি?
– প্রেম।
– প্রেম করেছো?
– হু
– কয়টা?
– অসংখ্য।
– বাহ! কতদিন ধরে কবিতা লিখ?
– হিসেব করিনি। প্রতিদিনই লিখি
– এ পর্যন্ত কতগুলো লিখেছো?
– গুণিনী।
– বই কয়টা বেরিয়েছে?
– একটাও না।
– ছাপা হয়েছে কতগুলো?
– একটাও না।
– ছাপাও নি কেন?
– কেউ ছাপতে চায় নি।
– তুমি দিয়েছো কোথাও?
– না।
– কেন ?
– আমি তো সবাইকে পড়ানোর জন্য লিখি না। সবার পড়ার জন্য কত কবিতা আছে। সেগুলো পড়বে। আমি লিখি আমার জন্য। তা তুমি কি নিয়ে ডকু বানাও?
– মানুষ নিয়ে।
– মানে?
– হিউম্যান ডকুমেন্টারি।
– কতগুলো বানালে?
– বেশ কিছু রাশ নিয়ে রেখেছি। মাথায় আছে অনেক কিছু। বসলেই হয়ে যাবে। এখনো বানাই নি।
কতদিন ধরে বানাচ্ছো ?
– বেশি না। দুই মাস হলো এই ডিএসএলআর পেলাম। আমার কোনো স্পেয়ার হার্ড ডিস্ক নাই। ফুটেজ নিয়ে ল্যাপটপে ঢেলে রাখি। কম কম ছবি তুলি। ডিস্ক খালি হলে চিন্তায় পড়ে যাই।
– এখানে কতদিন হলো?
– পরশু এসেছি। এই দুই দিনে ওস্তাদের লক্ষণশ্রীর যাবতীয় কিছু শ্যুট করলাম। তার বাড়ি, তার শথ্রু গোবিন্দ শর্মার বাড়ি, তার বাড়ির পাশের লাগোয়া গার্লফ্রেন্ড দিলারামের বাড়ি, তার কবর, মায়ের কবর, বৌ-এর নামের স্কুল, তার যা যা আছে এসব। কথাও বলেছি অনেকের সঙ্গে। তার পঞ্চম পুরুষের যাকে যাকে পেলাম, তাদের সঙ্গেও বসেছি, তার এক গার্লফ্রেন্ডের নাতিকেও পেয়েছি।
– গার্ল ফ্রেন্ডের নাতি-পুতির খোঁজ কেমনে পাইলা?
– আরে তিনি যে সকল মহিলাদের সঙ্গ নিয়েছেন, তাদের অনেককেই ঘরবাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। কাউকে দূরে, কাউকে একদম কাছে। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গীনি ছিলো দিলারাম। তাকে তিনি বিয়ে দিয়েছিলেন তার এক নায়েবের সাথে। তাদের বংশধরেরাও আছে, খুব সম্মানের সাথে।
– ইন্টারেস্টিং! আচ্ছা, এই উত্তরপুরুষেরা কি তাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তিকলাপ নিয়ে কিছু বলে?
একদম না। মজার ব্যাপার কথা জানলাম হাছনের শত্রুর বাড়িতে গিয়ে।
– কি?
– যে জমিদারের সঙ্গে তার সবচেয়ে বেশি শত্রুতা ছিলো, সেই জমিদারের পোতি এই শহরের সবচেয়ে ভালো হাছন রাজার গানের শিল্পী। নিজেই শুধু গায় না, শেখায়ও। আমি গিয়েছিলাম তাদের বাড়ি।
– বাহ্, মজা তো! কি বললো তারা?
– পরে বলছি। বেশি মজা পেয়েছি হাছন রাজার সেই প্রতিপক্ষের জমিদারের নাতির সাথে কথা বলে।
– মল্লিকপুরের জমিদার?
– হু। তুমি জানো কেমনে?
– পড়েছি। হাছনতো জেল খেটেছিল এই জমিদারের মামলায়। ডিটেইলস কিছু পেয়েছো?
– তেমন না। শুধু বলেছে যে তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে হাছন ঘোড়া চালিয়ে যেতে পারতো না?
– কেন?
– আরে জানো না, আগের দিনের জামিদারদের বাড়ির পাশ দিয়ে কোন সাধারণ লোককে জুতা পায়ে হাঁটতে দিতো না। ছাতি মাথায়ও যেতে পারতো না।
– কিন্তু হাছনতো জমিদার ছিলো। তাকে দেবে না কেন?
– বড় জমিদার, ছোট জমিদার নানা কিছিমের ব্যাপার ছিলো। শত্রুতা ছিলো।
– কি নিয়ে শত্রুতা?
– পৃথিবীতে সকল শত্রুতা দুই বিষয় নিয়ে মাত্র। দুই ম। হয় মাটি, নয় মহিলা। এর কোনো একটা নিয়েই হবে নিশ্চয়। আমি ভিডিও করেছি উনার কথা। পরে শোনাবো। এখন দেখা যাক। আজ যদি সত্যি সত্যি ওস্তাদকে পেয়ে যাই, এ জীবনে আর কিছু না বানালেও হবে। দিনের বেলা চিপস খালি করে, ব্যাটারি ফুল চার্জ দিয়ে রেখেছি।
– চারু বলে, লোকটাকে নিয়ে আমার অনেক কৌতুহল। কিন্তু বেশি কিছু জানি না। তোমার স্টাটাস দেখেই তাড়াতাড়ি আজিজ থেকে দুটো বই কিনেছি তার উপর। বাসে বসে পড়েছি কিছু। বেশি পড়াও হয়নি। তোমার স্ট্যাটাসটা পড়ে মনে হলো আসি এখানে। আর কিছু না হলে তার ঘর-বাড়িতো দেখা যাবে। আর হাওড়ে যদি একরাত কাটানোই যায়, মন্দ কী?
– আমিও বেশি কিছু জানতাম না। আজ আর কাল এই দুইদিন পুরো সুনামগঞ্জ শহর একা একা ঘুরেছি, ছবি তুলেছি, এই যা। আর হাছন দর্শনের বিষয়টা কিন্তু একেবারেই মীথ পর্যায়ের। কিছু না পেলে আমাকে দোষা যাবে না।
তারা মাঝিকে নিয়ে উজানের দিকে নৌকা বাইতে বাইতে প্রায় এক মাইলের নদীপথ পার হয়ে দেখে রিভার ভিউ ঘাটে এসে গেছে।
অনেক ভিড় আজ। এমনিতে মাঝে মাঝে ভরা পূর্ণিমা রাতে এখানে বেশ জটলা হয়। কিন্তু আজ সে রকম কিছু নাই। শুধু কিছু ঢাকাইয়া লোকের আগমন ঘটেছে। তার কারণ, আকাশ বালক নামক ফেসবুক আইডি থেকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিল। এটা ১২০টা শেয়ার হয়েছে প্রথম ঘন্টায়। বেশিরভাগই এই ফেক আইডির তরুণটিকে নিয়ে গালমন্দ করেছে। ট্রল করেছে প্রায় সবাই। কিন্তু বেশ কয়েকজন কমেন্ট বক্সে অনেক কিছু জানতে চেয়েছিল। সে কাউকেই জবাব দেয়নি। এর মধ্যে যে কয়জন তার সঙ্গে ইনবক্স-এ যোগাযোগ করেছিল তাদেরকেই সে জবাব দিয়েছে, কেউ কেউ তার ফোন নাম্বার চেয়েছিল। কাউকে নাম্বার দেয়নি।
আকাশ বালক ঘাটে গিয়ে দেখে তার সাথে যোগাযোগ করা সবাই চলে এসেছে। আরো দুইটা নৌকা নিয়ে দশ-বারো জনের দুই দল চলে গেছে হাওড়ে। এরা সবাই এই সুনামগঞ্জের। বাউল উঠেছে দুইজন। হারমোনিয়াম, তবলা নিয়ে চলে গেছে, তারা গান গাওয়া শুরু করে দিয়েছে। লন্ডন থেকে মিউজিক নিয়ে পড়ে আসা একজন এসেছে। তার সঙ্গে এক তরুণীও।
ডিটিভির হেনা এসেছে, সঙ্গে তাদের ক্যামেরাম্যান ফরিদ। হেনা দাঁড়িয়ে আছে নৌকার পাশে, তার হাতে ক্যামেরার বুম আর ট্রাইপয়েড। ট্রাইপয়েডটা যথেষ্ট ভারী। কিন্তু তার অভ্যাস হয়ে গেছে। ভারী ট্রাইপয়েড হাতে এক শুকনাশাকনা তরুণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নদীর পাড়ে ভিড় লেগে যায়। সে ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকিয়ে বলে, ফরিদ ভাই, এখানে ধরেন, আমি ঐ গুলুইটাতে বসে একটা পিটিসি দিয়ে রাখি। পরে কাজে লাগতে পারে। আর এই নদীর পারের ক্রাউডের সঙ্গে আমি কিছু কথা বলবো। আপনি ধরেন।
হেনা ক্যামেরার বুম মাইক হাতে নিয়ে শুরু করে কথা বলা- আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি সুনামগঞ্জ শহরের সুরমা নদীর পারের রিভার ভিউ ঘাট এলাকায়। বিকেলের পর থেকেই বেশ কিছু মানুষের সমাগম হয়েছে এখানে। মধ্যরাত পর্যন্ত এই জনসমাগম থাকবে। কারণ, আজ সেই মহাপূর্ণিমা। গত আশি বছরে এতো বড় চাঁদ কখনো আকাশে ওঠেনি। আগামী ত্রিশ বছরেও এমন চাঁদ আর উঠবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। আর এই মহাপূর্ণিমা উদযাপনের জন্য এই শহরে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের সব সড়কবাতিগুলো নিভিয়ে ফেলা হবে। শহরের মানুষেরা ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা মাঠে বা নদীর পারে এসে সারারাত ধরে জোৎস্না উপভোগ করবেন। আর এই আয়োজনের উদ্যোক্তা এই শহরেরই প্রশাসক, যিনি মরমী সাধক কবি হাছন রাজারই এক প্রো-পৌত্র ।
হেনা একটু হেঁটে প্রায় আশি বছর বয়েসি, লুঙ্গিপরা এক লোকের মুখের সামনে মাইক ধরে তাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা, আজ কি হাছন রাজা এই হাওড়ে তার নৌকার বহর নিয়ে আসবেন বলে আপনি মনে করছেন?
লোকটি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। কি বলবে বুঝতে পারে না। সে বলে, ইতা তো হুনাহুনী খতা আছে। খেউ খেউ দেখছইন তানরে।
– আপনি নিজে দেখেছেন ?
– না গো মাই
হেনা লোকটিকে বাদ দিয়ে প্রায় গোল হয়ে থাকা দর্শকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে, আপনারা কেউ কি কোন জ্যোৎস্না রাতে হাওড়ে হাছন রাজাকে দেখেছেন ?
– বউতেউ দেখছইন, ইতা বউত আগে- একজন পেছন থেকে বলে ওঠে।
ক্যামেরা তাকে ধরতে পারে না। হেনা ফরিদকে বলে, ফরিদভাই, কাটেন। পরে আবার ট্রাই করবো।
হেনার সঙ্গেও এই প্রথম দেখা আকাশের। মাঝে মধ্যে টেলিভিশনে দেখেছে তাকে। সম্ভবত খবর পড়তো মেয়েটি। যথেষ্ট ফর্সা মনে হতো তাকে স্ক্রিনে। কিন্তু এখন দেখে, মেয়েটি প্রায় কুচকুচে কালোই। কেনো যে কালো মেয়েরা ফর্সা হবার জন্য এতো মরিয়া থাকে বুঝে না। কালো মেয়েদের সৌন্দর্যই তো আলাদা। কিন্তু এটা বাংলাদেশের মেয়েরা মানে না। তারা বলে এই অঞ্চলের পুরুষেরা সবাই বর্ণবাদী। তারা নিজেরা কালো হলেও কালো মেয়ে বিয়ে করতে চায় না। না জানি পরে যদি তার ঘরে একটা কালো রং-এর মেয়ে হয়!
আকাশ এগিয়ে আসে কথা বলার জন্য। সে তার নাম জেনে গেছে, সুতরাং সম্বোধনে সমস্যা নাই। প্রায় পরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলার সময় যেমন আচরণ করে, এমন একটা ভাব ধরে বললো- হেনা, আপনি কি রিপোটিং-এ না, প্রেজেনটেশনে ?
– দুইটাই করি ভাইয়া। যখন যেটা দেয়। আমাদের এপোয়েন্টমেন্ট নিউজ রিপোর্টার হিসেবে। আমাদের স্টেশনে নিউজ প্রেজেন্টারের আলাদা কোনো পোস্ট নাই। খালি গেট-আপ বদল হয়। মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে স্পট থেকে নিউজরুমে বসিয়ে দিলে আরেক রকম। আপনার স্ট্যাটাসটা পড়ে আমি খুবই বিলা হয়ে আছি। ইনচার্জ বাতিন ভাইকে বললাম এই আইটেমটা করতে চাই। বাতিন ভাই বললো তুমি নিজে যাবা? বললাম, যাবো না কেনো ? ব্যস, ফরিদকে নিয়ে ভোর বেলা বেরিয়ে দশটার ফ্লাইটে উঠে পড়লাম। এগারোটায় সিলেট নেমে অফিসের গাড়ি পাওয়া গেলো। কিছুক্ষণ আগে এখানে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে সিলেট। কাল সকালে আবার এসে নিয়ে যাবে। আড়াইটার ফ্লাইটে ব্যাক করবো ঢাকায়।
– আপনাদের ব্যাগ, লাগেজ এসব কোথায়?
– আমার এই হ্যাভারসেকে যা যা আছে, চলবে। ফরিদের কিছুই লাগে না। আমি ২/৩ দিন এক কাপড়ে থাকতে পারি, সমস্যা নাই। আজ রাত তো আমরা হাওড়ে আছি, তাই না? দেখা যাক। উনাকে যদি সত্যি সত্যি পেয়েই যাই তাইলে তো কথাই নাই। না পাওয়ার চান্সই বেশি। আর না পেলেও এই শহরের মানুষ এই ব্লু মুনের রাতে কী করছে, হাছন রাজা থাকলে কী করতেন, তার নাতি-পোতি-প্রপোতিরা কী করছে, এসব নিয়ে আমার স্টোরি হয়ে যাবে। আমরা দুই-তিন ঘন্টা অনেক শুট করেছি। এবার চলেন, নাওয়ে উঠি। কোন নাওটা আমাদের?
রিভার ভিউ ঘাটে একটা ইঞ্জিন নৌকা লাগানো। আকাশ বলে- এটাই আমাদের বজরা। হাছন রাজার আমলে ইঞ্জিন ছিলো না, বাকি সবকিছু এমনই ছিলো। আমাদের সময় ইঞ্জিন লেগে গেছে। এটার ভেতরটায় ৮জন লম্বা হয়ে চিৎ হয়ে শুতে পারে ,১২ জন কাইত হয়ে। সমস্যা নেই, আমরা কেউই এখানে শুবো না, আমরা থাকবো ছাদের উপর। চিন্তা নেই, ছাদের চারপাশে রেলিং দেয়া আছে। সাঁতার না জানা কেউ নিতান্ত আত্মহত্যা করতে না চাইলে এখান থেকে পড়ে মরবে না। সাঁতার জানা কেউ কিন্তু অভার স্মার্টনেস দেখানোর জন্য ডাইভ দেবার চেষ্টা করবে না খবরদার। তবে কতগুলো লাইফ জ্যাকেট আমি নিয়ে এসেছি ভিন্ন কিছু চিন্তা করে। বাইচান্স ঝড়ইবা যদি চলেই আসে, তখন এর ব্যবহার হবে, নাইলে না। আর নিচতলায় একটা ছোট্ট ঘরও আছে। ইমার্জেন্সি আউটলেট ওখানেই দেয়া যাবে। কেউ চাইলে ভেতরে গিয়ে দেখেও আসতে পারো। অবাক হবে দেখে যে, এখানে পিওর সুনামগঞ্জী মডেলের হাছনী হাই কমোড আছে। আরে, হাসছো কেন? গিয়ে দেখো প্লাস্টিকের চেয়ারে বসার জায়গাটা গোল করে কাটা। পানির সাপ্লাই ঐ জাগয়ায় নেই। দুই লিটারী বোতল ভরা আছে ৪টা। ইন এডিশন টু দ্যাট- তোমাদের জন্য টিস্যু পেপারও আছে। সুতরাং চিন্তা নেই। ব্যাগ বোচকা নিচে রেখে, ঐ কাঠের মই দিয়ে ধীরে ধীরে ছাদের উপর উঠে যাবা। সারারাতের জন্য এর ভাড়া চার হাজার ঠিক করেছি। আমাকে বাদ দিয়ে বাকী সবাই ভাগভাগি করে দিয়ে দিবা। আমার অবস্থা কেরোসিন। এটা ঠিক করে দিয়েছি বলে আমি মাগনা যাবো, এটা আমার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সার্ভিস চার্জ। কারো আপত্তি আছে?
আকাশের দীর্ঘ বক্তৃতা সবাই খুব মন দিয়ে শুনলো এবং যথারীতি খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। ঘাট ছেড়ে তারা নৌকায় গিয়ে দেখে- গলুইয়ের কাছে দুইটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ চিনে ফেলে। বলে, তোমরা তো রত্না আর শিফা, তাই না?
শ্যামলা রং-এর মেয়েটা বলে, বলেন তো আমার নাম করে?
– রত্না।
– বুঝলেন কেমনে?
– নোটবুক বের করে কী কী লিখছো, কিছুক্ষণ পর, আর ঘড়ি দেখছো। তোমাদের পোর্টালে কিছু আপ হয়েছে কি?
– না, এখনো দেইনি। তবে একটা স্কুপ ছেড়ে দিয়েছি। লীড-এ আছে এটা – মহাপূর্ণিমায় হাছন রাজা, সুনামগঞ্জে তোলপাড়, রাতে বাতি জ্বলবে না শহরে।
– বাহ্।
– আর ও নিশ্চয়ই শিফা। তোমার রুমমেট।
– রুমমেট না। ভাইয়া, ফ্লাট মেট। আমরা একই ফ্লাটে থাকি, চারজন, চার রুমে। শিফা আমার ঘনিষ্টতম ফ্লাটমেট। আমরা দু’জনই সেকেন্ড ইয়ার, আইইউবিতে। পড়ছি বিজনেস স্টান্ডিজ, করছি সাংবাদিকতা। পার্টটাইম ভাইয়া। আমি এন্টারটেইনমেন্টে রিপোর্টিং, ও ফটোগ্রাফার। আমরা দুইজন একটা ওয়াশ রুম ব্যবহার করি, আমাদের দুজনের খাবার এক হাঁড়িতে রান্না হয়, দুজনের একটাই মানিব্যাগ। আমরা বিল করে যা যা পাই, এক মানিব্যাগে সব রাখি। এখান থেকে খরচ করি।
– বাহ্, মজার তো? আর কী কী এক সাথে কর?
– আমরা এক সাথে একই টিভি চ্যানেল দেখি। আমাদের যেকোনো একজনের হাতে রিমোট থাকে। ও জানে আমি কি পছন্দ করি। ও যখন রিমোট টেপে- তখন আমার পছন্দের চ্যানেল দিয়ে রাখে, আমি যখন রিমোট নিই তখন ওর চ্যানেল দিয়ে দিই।
– তোমাদের ঝগড়াঝাটি হয় না?
– আমাদের দুই জনের পছন্দের রং সাদা, প্রিয় নায়ক, আমাদের কমন ক্রাশ ও একজন। আমাদের দুজনের প্রিয় শিল্পী, প্রিয় গান, প্রিয় বই একই।
– আর তোমাদেও বয় ফ্রেন্ড?
– এখনো হয়নি ভাইয়া । আমরা আশা করি আমাদের দুই জনের একই বয়ফ্রেন্ড থাকবে, তাই নারে?
এবার সবাই মিলে হো হো করে হেসে উঠে।
হাসি থামলে শিফা বলে, বাট উই আর ভেরি আন লাকি। আমাদের কোনো ছেলেই পছন্দ হয় না। আমাদের কোনো বয়ফ্রেন্ড নাই। থাকলে আমরা দুইজন মিলেই তার সঙ্গে প্রেম করতাম। হাহাহাহা।
এর মধ্যে নৌকা ছেড়ে দেয়া হয়েছে উজানে, উত্তরের দিকে। আকাশ বালক দলনেতা হয়েই গেছে। তাকে কেউ নেতা বানায়নি। কিন্তু তার কথায় সবাই উঠছে বসছে। সে যা বলছে, মাঝি তাই শুনছে। একবার দাঁড়িয়ে গেলো আকাশ। বক্তৃতা শুরু করলো আকাশ। তার বক্তৃতা শুনে মনে হচ্ছে, সে যেনো কোনো টেলিভিশনের লাইভ ব্রডকাস্টিং-এর বিবরণ দিচ্ছে। তফাৎ হচ্ছে, টেলিভিশনের লাইভ ব্রডকাস্টাররা সবাই দর্শকের মতো ক্যামেরা গুটিয়ে বসে আছে আকাশের দিকে। হা করে। বক্তৃতা শুনছে তার।
আকাশ বলছে – বন্ধুরা মিনিট বিশেক হলো, আমরা সুনামগঞ্জের রিভারভিউ ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করেছি। আমাদের ডান দিকে হরিনা মাটি ঘাট। এটা দিয়ে সোজা উজানে গেলে আমরা পৌঁছে যেতে পারতাম একেবারে আসামের করিমগঞ্জে। সেখানে গিয়ে এই নদীকে পেতাম, কিন্তু ডাকতাম বরাক নামে। সমস্যা নাই, আমরা আসাম যাচ্ছি না, যাচ্ছি মেঘালয়ের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বিরামপুরের খালের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করবো। যদিও এখন আমাদের কাছে খাল-নদী-হাওড় একই হয়ে আছে, শীতের মৌসুমে এলে তিনটাকে আলাদা পেতাম, এখন সব একই। আমরা হাওড় বিলাসে নেমেছি। আধাঘণ্টা পর আমাদের নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে। আর নৌকটি নোঙর করে দেবো কোনোভাবে, তারপর এভরিথিং ফ্রী। আমরা তখন কে কী করবো সেটা তখনই ঠিক করা হবে।
হাত তুলে চারু।
আকাশের মনে হলো, সে কোনো কথা বলার জন্য পারমিশন চায়। তার দিকে তাকিয়ে আকাশ বলে, একটু অপেক্ষা করো, আমার বক্তৃতা শেষ হলে আমার নেতাগিরিও শেষ হয়ে যাবে। তারপর এই বহরে কেউ নেতা থাকবে না। যার যা মনে হয় সে তা বলতে পারবে।
চারু বলে, আমার যদি ইচ্ছা করে আলাদা কোনো জেলের নৌকায় চলে যেতে আমি কি যেতে পারি?
তুমি কি পারবা না, তা তুমিই ঠিক করবা, আমি কে?
ঠিক হলো, সামনের কাংলার হাওড়ে গিয়ে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে। তারা ছাদের উপর উঠে বসে থাকবে। আর কী কী করবে, এখনো ঠিক হয়নি। তবে আগে যে নৌকাটি ছেড়ে গেছে, সেখানে লোকাল দু জন বাউল শিল্পী উঠেছেন। তারা হারমোনিয়াম আর মন্দিরা নিয়েছেন। ঢোল একজন নিতে চেয়েছিল, শব্দ বেশি হবে এই বিবেচনায় ঢোল বাদ পড়েছে। আছে বাঁশি। কাংলার হাওড়ের নৌকা পৌঁছার পর সবাই নেতা। সবাই যা ইচ্ছা করতে পারবে। কেউ কাওকে বাধা দেবে না।
তিন
সুনামগঞ্জের রিভার ভিউ ঘাট থেকে দুটো বড় নৌকা ছাড়াও সাহেব বাড়ির ঘাট, হরিনামাটি ঘাট আর আমবাড়ি ঘাট থেকেও আজ বেশ কয়েকটা নৌকা এসেছে। সব নৌকা যে গায়ে গায়ে লাগানো, এমনটা একোবারেই না। সবাই নিজেদের মতো করে আছে, একটু দূরে দূরে। কোন নৌকা থেকে অন্য নৌকার কোন কথাবার্তা শোনা যায় না। দেখা যায়। তবে চাঁদের আলোয় নৌকাগুলোর কালচে অবয়ব ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। নৌকায় কেউ আলো জ্বালছে না, বাতি নাই। বাতি জ্বাললে দু’টো অসুবিধা হয়। প্রথম অসুবিধায় পড়ে নৌকার মাঝি। তারা অন্ধকারে ভালো দেখে, নিশানা ঠিক থাকে। আলোতে সমস্যা। আর দ্বিতীয় সমস্যা- পানির উপর অনেক ধরনের পোকা থাকে। তারা সুইসাইড করার জন্য কুপী বাতির দিকে চলে আসে। আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে সবগুলো মারা যায়। কিন্তু সব সময় আগুনের নাগাল পায় না। টর্চের বাল্ব বা অন্য আলোকেও আসল আগুন মনে করে সেখানে ঝাপাঝাপি করতে করতে মানুষের চোখে, মুখে, মাথায় চুলে বসে খোঁচাখুঁচি করে। এই বিড়ম্বনা থেকে বাঁচার জন্য বন্ধ রাখা হয় বাতি।
কিন্তু দূরে, বেশ কতগুলো সারি সারি বাতি দেখা যায়। বাতিগুলো বেশ বড়। সেগুলো দুইটা করে আছে। একটা নিচে, একটা উপরে। এর রহস্য বের করতে মাঝির সাহায্য দরকার হলো। মাঝি বলেন, ওটাই মেঘালয়ের পাহাড়। সামনেই ইন্ডিয়ার আসাম। বাতিগুলো আসামের পাহাড়ের উপর বিএসএফ এর ঘাটি আছে। তা থেকে জ্বলছে উপরের বাতি। নিচেরটা পানিতে তার রিফ্লেকশন। আরো কিছুদূর আলাপ করে বেরুলো যে, এটা এখান থেকে মাত্র ৪-৫ কিলোমিটার দূরে একটা বাজার আছে। এর নাম বাংলাবাজার। শুকনো মৌসুমে এ বাজারে অনেক ইন্ডিয়ান জিনিস পাওয়া যায়। এটা ছাড়াও আমাদের ডান দিকে আরো কিছু কালো কালো গাছের ছায়া দেখা যাচ্ছে। সেখানেও বাতি জ্বলে, সেটা মঙ্গখাটা বাজার। আমরা সেখানে যাবো না।
কাংলার হাওরে যতোটা নীরবতা থাকার কথা ছিলো, আজ তা নেই। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ যদিও একেবারে প্রায় মাথার উপর, এটা মাঝে মাঝেই কালো মেঘের ভেতর ঢুকে যায়। মাথা কাত করে চাঁদ দেখা বড় বিড়ম্বনার কাজ। রত্না বুদ্ধি বের করলো। সে শিফার হেভারসেক দিয়ে বালিশ বানিয়ে শুয়ে পড়ে। আরেক পাশে শিফা মাথা রাখে। দুই বান্ধবীর এখন এক বালিশ। তাদের শুয়ে পড়া দেখে দলের আরো তিনজনও চিৎ হয়ে শুয়ে যায়। দলের লোকেরা কেউ তেমন কথা বলেনা। নীরবে চাঁদ দেখাই যেনো তাদের এখনকার কাজ। এর মধ্যে হঠাৎ রত্না বলে ওঠে, জানিস, আমার সঙ্গে একবার হাছন রাজার দেখা হয়েছিল ?
-পাগলামি ছাড়। এটুকু বলে শিফা ফোন টেপা শুরু করে দিল।
– বিশ্বাস হচ্ছে না?
– না।
– তোদের ধর্মে তো পূনর্জন্ম বিশ্বাস করিস না। তোরা বুঝবি কেমনে?
– তোর কি আগে জন্ম হয়েছিল একবার?
– আমার মনে হয় হয়েছিল। এবং আমার বাস ছিলো সিলেটের বিশ্বনাথের রামপাশায়। ওখানে আরেকটা নদী আছে, এই সুরমার চেয়ে একটু ছোট। ওটা কাপনা নদী।
– এই নদীর নাম শুনেছি। হাছন রাজার গানে আছে এই নদীর কথা।
– যদি আজ দেখাই হয়ে যায়, জিজ্ঞেস করবো, চেনে কী-না। না চেনার চান্স বেশি। শালাতো লুইচ্চা দি গ্রেট ছিলো, কখন কারে ধরে টানছে তার কি আর এখন মনে আছে?
– মিস রত্না চক্রবর্তী
– বলুন মিস শেফালী হাসান
– মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ। হাছনকে নিয়ে বাজে কথা বলার আগে তাকে জেনে নাও ভালো করে।
– ঠিক আছে। জানবোইতো। কিন্তু কথা হচ্ছে, সত্যি সত্যি যদি তারে আজ পেয়েই যাই আমি কিন্তু ছাড়বো না।
পাশের নৌকায় গান বাজনা হচ্ছে বেশি। এই নৌকার লোকেরা চুপ। তারা সবাই চিৎ হয়ে আছে আকাশের দিকে চেয়ে। পাশের নৌকা এখন গান ধরে- ছাড়িলাম হাছনের নাওরে, আরে বৈঠা না ফালাইতে নারে শূণ্যে করে উড়া রে, ছাড়িলাম হাছনের নাও রে।
আকাশ বালক খুব চুপচাপ। তাকে দেখে মনে হচ্ছে হঠাৎ করে এমন একটা স্ট্যাটাস দিয়ে এই ছেলে-মেয়েগুলোকে নিয়ে এসে বিপদেই পড়লো কী-না।
সে চারুকে জিগ্যেস করে- হাও ইজ লাইফ?
চারু সিগারেটের শেষ টান দিয়ে নৌকার ছাদ থেকে হাওড়ের পানিতে সিগারেটের খোসা ফেলতে ফেলতে বললো – লাইফ ইজ অলওয়েজ বিউটিফুল। আজ রাজা এলে ভালো, না এলে আরো ভালো।
– মানে?
– গল্পটা জানো না?
– কি গল্প?
– এক রাজার অনেকগুলো রানী। এক রাণীর আলাদা বয়ফ্রেন্ড ছিলো। রাজা এই রাণীর ঘরে মাসে এক দুই রাত আসতেন। সিডিউল জেনে সেই বয়ফ্রেন্ড মাঝে মাঝেই দেয়াল টপকে রাতের বেলা রাণীর ঘরে এসে পড়তো। একদিন সেই বয়ফ্রেন্ড এসে জানতে পারে, আজ তার শিডিউল। কিন্তু রাজা প্রায়ই শিডিউল রক্ষা করেন না। তিনি আসেন না। এটা জানার পর বয়ফ্রেন্ড রাণীকে জিগ্যেস করেছিল- রাজা যদি আসেন, কি হবে? রাণীর তখন এই জবাব ছিলো- রাজা এলে ভালো, না এলে আরো ভালো।
হঠাৎ করে হাসির রোল পড়ে গেলো পুরো নৌকা জুড়ে। এদের হাসির শব্দে একটু দূরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নৌকার ছাদের উপর যে পরিমান গান বাজনা ছিলো, তা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। এবং কিছুক্ষণের জন্য বেশ নীরবতা নেমে আসে এই হাওড়ে। নীরবতার কারণ অবশ্য ভিন্ন। তারা লক্ষ্য করে দূরে একটা পাল তোলা নাও এদিকে আসছে। কিন্তু খানিক পরেই সবাই বুঝতে পারে, নৌকা আসলে একটা নয়, অনেকগুলো। সামনের নৌকাটাই শুধু পাল তোলা। তার পেছনে অনেকগুলো ভাওয়ালি নাও। তাদের সাথে দুই পাশে দুইটা করে চারটা ডিঙ্গি নৌকাও। ডিঙ্গি নৌকা কেন সঙ্গে থাকবে বুঝতে পারছে না আকাশ।
আকাশ বালক মাঝির কাছে যায়। আস্তে করে বলে- চাচা, দেখেনতো নাওটার কি অবস্থা?
মাঝি তাকায় নৌকার দিকে। ভট ভট শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝি বলে, হাছনের নাওয়ে ইঞ্জিন নাই বাজান, তবে পাল থাকে।
– এখানে তো পালও আছে, ইঞ্জিনও আছে।
– চুপ থাকেন আপনারা। একদম চুপ। মানুষের নিশানা দেখলে তার নাও মিলাই যায়, কেউ দেখে না। তিনি চলে যান।
চুপ মানে একেবারেই চুপ। বাতাসের শো শো ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই এই দুই নৌকায়। তারা স্পষ্ট শুনতে পায়, ঐ নৌকার মধ্যে রীতিমত নাচ-গান হচ্ছে। বজরার ছাদের উপর একজন দীর্ঘদেহী পুরুষ। তার চারপাশে কয়েকজন মহিলা মাত্র। তারা যে গানটি গাইছে, সেটাও বেশ পরিচিত- নিশা লাগিরো রে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলো রে। এই গানটি তাদেরও মুখস্ত। পাশের নৌকা থেকে এই গান গাওয়া হয়েছে অনেক বার। সেই নৌকায় একটা ইয়াং ছেলে আছে। তুহিন। লন্ডন থেকে ফোক মিউজিকের উপর তার পড়াশুনা। বাংলাদেশের লালন, রাধারমন, হাছন রাজা, আবদুল করিম এদের অনেক গান সে ফিউশনও করেছে। কিছু ইংরেজি বাংলা মিলিয়েও গেয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে সে এই গান গেয়েও ছিলো। এবার এই গান আসছে সামনের নৌকা থেকে।
দূর থেকে আসা গান-বাজনার নৌকার বহর খুব দ্রুতই তাদের কাছাকাছি এসে গেলো। এবং কিছুক্ষণ পরই তারা সবাই নিশ্চিত হয়ে গেলো এটা হাছন রাজার নাও নয়। এটা কোনো ফিল্ম ইউনিটের বহর। সেই বহরের নৌকাটি আসলে তাদেরকে লক্ষ্য করেই এদিকে আসছে।
শুটিং ইউনিটের চারটি বড় নৌকা। এক নৌকায় বোধ হয় সবাই গুরুত্বপূর্ণ আর্টিস্ট। নায়িকাসহ পরিচালক হয়তো এখানেই থাকবে। এবং এই নৌকাটিতে বাহারী রং-এর কাপড় দিয়ে বানানো পাল। এমন কাপড়ের পাল সচরাচর চোখে পড়ে না। নতুন কাপড় দিয়ে বানানো হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে। আরেক নৌকায় লাইট, জেনারেটর, জিবআর্ম এসব। সঙ্গে তাদের ক্রু। আরেকটি নৌকা খানিক দূরে। ঐ নৌকায় খাবার দাবারের সরঞ্জাম। রান্না হচ্ছে বজরার পেছনে।
চতুর্থ নৌকাটি সবচেয়ে শান্ত। সম্ভবত এখানে কিছু সিনিয়র আর্টিস্ট থাকবেন। মা-খালা চরিত্রের নারী বা দাদা চরিত্রের পুরুষেরা থাকবেন সেখানে। খুব কাছে আসার পর শুটিং ইউনিটের প্রথম নৌকাটা গান-বাজনার নৌকার পাশে এসে দাঁড়ায়। বুঝতে পারে একটা ফিল্মি ইউনিট এটা। সারাদিন হাওড়ে শ্যুট করে এখন ফিরছে।
এসে ওই বহরের নৌকাগুলো থেমে যায়। এদের একজন বলেন, হাছন রাজার উপর একটা সিনেমা হচ্ছে। সিলেটের এক ভদ্রলোক একটা নাটক লিখেছিল- হাছনজানের রাজা। সেটা নিয়েই ঐ নাটকের দলের পরিচালক একটা শুটিং করছেন। আগামি জুলাইতে একটা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে এই নাটকটি যাবে। পৃথিবীর ৪৫ টি দেশের নাটক আসবে সেখানে। এ নাটক কমপিটিশন সেকশনে প্রদর্শিত হবে। পুরস্কার টুরস্কার যাতে পেয়েও যেতে পারে এজন্য সরকার ভালো টাকা দিচ্ছে দলকে। দল এবারই নাটকটি ওডিও-ভিজ্যুয়ালে প্রদর্শিত করবে। ডায়লগের ইংরেজি সাবটেক্সট যাবে স্ক্রিনে, ম্যালা আয়োজন। নাটকের শুরুতে এক জোস্তনা রাতে হাছন রাজা নৌকার বহর নিয়ে হাওড় থেকে মঞ্চে নেমে আসবে। হাওড়ের অংশটুকু তারা শ্যুট করেছে শেষ বিকেলে, সূর্য ডুবে যাবার পর। ডে ফর নাইট মোডে শ্যুট করা। এই শ্যুটিং-এর জন্য খাটাখাটনির শেষ নাই পরিচালকের। তিনি মাসের পর মাস নাট্যকারকে সাথে নিয়ে সুনামগঞ্জ আর বিশ্বনাথ ঘুরে ঘুরে আর নানা লোকের সাথে কথা বলে বলে চরিত্র সাজিয়েছেন। প্রত্যেক চরিত্রকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে তাদের চরিত্র বুঝিয়েছেন। বারবার বলেছেন, চরিত্রের কোন অংশে তুমি এক্ট করছো এটা নির্ভর করবে চরিত্রের পুরা জীবনটা জানার পর। সবার হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন নানা রকমের বই। বলেন, এগুলো পড়ে নিজের চরিত্র বুঝে নাও। পুরা নাটকের ইউনিট এখানে এসেছে, বাইশ জন পারফর্মার। আর ষোলজন ক্রেুালো।
মাঝ খানের লোকটি সম্ভবত হাছন রাজা। কোটের চারদিকে জরীর কাজ। এই জোৎস্নার রূপালী আলোতে চিক চিক করছে তার কাপড়। তাকে ঘিরে ধরে সবাই।
– ভাই, আপনার নাম?
– রামিজ রাজা।
– কন কি? এটা কি অরিজিনাল, না ফেইক নাম আপনার?
– ধরেন অরিজিনালই। শিল্পকলায় আইসেন, সামনের শুক্রবার ঈর্ষা আছে। দেখবেন।
– আপনি এই নাটকের হাছন রাজা না?
– হ
– এজন্য নাম নিসেন রাজা?
– ভাই, আসল নাম আমার রমিজ রাজা। এই নামে এক কুলাংগার আছে। আমার নামের বানান ইংরেজিতে লিখি আর এ দিয়ে। নাটকের দল নিয়ে যখন আমরা বিদেশ যাই, সবাই ডাকে রামিজ বলে। আমি ভাবলাম- এই সুযোগ, পাকিস্তানী খেলোয়াড়ের নামে নাম বদলানো উচিত। তাই বানিয়ে দিলাম রামিজ। আর রাজা আগেই ছিল।
– এটা রাজা-বাদশাহ টাইপের কিছু না তো?
– আরে নাহ। হাছনের যেমন, অরিজিনাল নামে রেজা ছিল, ওহিদুর রেজা। সেখান থেকে নিজে করসে রাজা, এই রকম কিছু। রমিজ রাজা, রেজোয়ান রাজা, এরকম। আমার ছোট ভাইর নামের শেষে বাদশাহ, আমার নামের শেষে রাজা। আমার বাবা এক সাথে আমাদের দুই ভাইকে ডাকতেন, রাজা-বাদশাহ চলে আসো, ভাত খাও।
– মজার তো। আচ্ছা, আপনাদের ডিরেকটার কই?
– পেছনে। খুব টায়ার্ড। শুয়ে আছেন।
চারু সেই নৌকার পেছন দিকে চলে যায়। শুয়ে থাকা লোকটিকে সে জাগায় না। দেখে তার পাশে প্রায় পঁচিশ-তিরিশ বছর বয়েসী এক তরুণী গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। তাকে দেখে একবার মনে হয় তরুণী, আরেকবার মনে হয় মধ্যবয়স্কা মহিলা। চাঁদের আলোয় মানুষের চেহারা ভালো করে বোঝা যায় না। তার পরনে একটা আলখেল্লা। বোরখা পরা মহিলারা যেমন থাকেন, অনেকটা সে রকমই। এই মহিলা একটা ঘাঘরা পরেছেন কোমর পর্যন্ত। সম্ভবত: নীল রং এর এই ঘাঘরা, কিন্তু চাঁদের আলোয় এর রংটা ঠিক মতো বোঝা গেলো না। সেটা কালো রং-এর মনে হচ্ছে। মাথায় কাওবয় টুপী। টুপীর ফাঁক দিয়ে তার লম্বা চুল দেখা না গেলে বোঝা যেতো না, তিনি পুরুষ না মহিলা।
চারু তার কাছে গিয়ে বসে। পরিচিত হবার জন্য প্রথমেই বলে- আমার নাম চারু।
মহিলা কথা বলেন না।
চারু বলে, আমি একটু বসি এখানে?
মহিলা তার জায়গা থেকে খানিকটা সরে এসে বসে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন, এখানে বসতে পারো।
বসে পড়ে চারু। এবার সে নিজে থেকেই প্রশ্ন করে। কি নাম আপনার?
আমি ছইফা বানু। হাছনের বড় বোন। অবশ্য আপন না, সৎ বোন।
– আপনার আসল নাম কি?
– ইউনিটে আমাদেরকে কেউ আসল নাম ধরে ডাকে না। যার যে চরিত্র, সেই চরিত্রের নামে ডাকা হয়। আমাকে তুমি ছহিফা বলেও ডাকতে পারো। আসল ছহিফার বয়স কুড়ি থেকে ষাট। নকল ছহিফার বয়স তেত্রিশ। আমি এখনো মেকআপ তুলি নাই বলে তুমি আমারে চিনতে পারছো না।
– আমার আসল নাম ছিল সিতারা পারভিন। ডাক নাম চারু। আমি কবিতা লেখা শুরু করে নাম দিলাম চারুলতা চন্দ্রিকা। এই নামেই আমার ফেসবুক আইডি। ব্লগে আমি এই নামেই লিখি।
– আমার নাম লিপি আখতার। ঢাকায় একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে আমি পড়াই। বাচ্চাদের স্কুল। আমি ওদের নাচ শেখাই। নিজেও নাচি। কিন্তু এই ছবিতে আমার নাচের দৃশ্য নাই। আমি খালি ঝগড়া করি। নেগেটিভ চরিত্র।
– কার সঙ্গে ঝগড়া করেন?
– ওর সঙ্গে – বলে রামিজ রাজার দিকে আঙ্গুল দেখায়।
– কেন?
– আমি ওর বড় বোন। কিন্তু সে আমাকে সারাজীবন ঠকিয়েছে।’
– বলেন কী !
– বসো এখানে। তার হিস্টোরি বলি। আমি যা বলবো, সব সত্য মনে করবা। এর মাঝে ঝামেলার কিছু নাই। নানা লোকে নানা কথা লিখেছে। অনেক মনগড়া কথা। আসল খবর সবাই জানে না। তুমি জানতে চাইছো, তাই তোমাকেই বলছি- আমার বাবা বিশ্বনাথের রামপাশার জমিদার দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী পাঁচ বিয়া করেছিলেন।
– বলেন কি ? পাঁচ বৌ? একসাথে ?
– না না, এক সাথে না। বলছি, অস্থির হইও না।
– জ্বি, বলেন।
সে সময় এটাই তাদের কাস্টম ছিলো। ধন সম্পদ বেশি থাকলে বৌও বেশি থাকতো। বৌদের তো বাচ্চা বিয়ানো ছাড়া কাম ছিলো না। আমাদের বাবার প্রথম বৌ-এর সন্তান ছিলো না। দ্বিতীয় বৌর ঘরে আমাদের বড় ভাই উবেদুর এর জন্ম। বাবার সাথে জমিদারী তিনিই দেখতেন রামপাশায়। যেখানে বিয়ে করতেন সেখানে বৌ রেখে দিতেন, বৌ বৌ মিলে সতীনের সংসার হতো না। বাবা নিজে গিয়ে বাবাগিরি গলিয়ে আসতেন আমাদের মায়েদের সাথে। কী হলো, হাসছো কেন ?
– না না হাসছি না। আপনি বলেন। তিন নম্বর মায়ের কাহিনী বলেন।
– তিন নম্বর বিয়া করেন আমার মা নুর বিবিকে। এ বিয়ের প্রধান কারণ কি ছিলো জানো ?
– কি ?
– আমার মায়ের সম্পদ।
– আপনার মা নূর বিবি তো মহিলা, তাঁর সম্পদ কী করে হল?
– তখনকার দিনে মহিলারা সম্পদ মানে জমির মালিক হতেন জামাইর সম্পদ দিয়া। প্রথমে বিয়া করার সময় বেটারা অনেক জমি লিখে দিতো। আর আরেকভাবে হয়, কোন সম্পদশালি লোক মারা গেলে তাঁর বৌ পেয়ে যেত সম্পত্তি। সুতরাং, এগুলো সবই তকদিরের উপার্জন। নিজের কিছু না। একটা মেয়ে কত সম্পদের অধিকারি হলো এটা নির্ভর করতো কত বর সম্পদের মালিক তারে বিয়া করলো তার উপর।
– আপনার মার তো আপনার বাবার সাথেই বিয়া হলো।
– না, তার আগে মা র আগে আরেকটা বিয়া হয়েছিল। তাঁর স্বামী মারা গেলে বাবা দেখেন অঢেল সম্পদ নিয়ে এই মহিলা একা আছেন। সুতরাং তাকে বিয়ে করা দরকার। আর বাবাও ছিলেন সুপুরুষ। ছোট জমিদারের সুন্দরী বিধবাকে বিয়ে করলেন পুরো সম্পত্তি সহ। এই মায়ের ঘরে আমাদের দুই ভাই-বোনের জন্ম। আমি বড়, আমার দু বছর পর আসে মুজাফ্ফর।
– আপনার বাবার জমিদারি তো তখন রামপাশায়। বিয়ে করলেন কোথায়?
– মার আগের স্বামীর বাড়ি, সিলেটের তালতলার কাছে কুয়ারপার, সেখানেই বাবা গেলেন ঘরজামাই হয়ে। কারন, মা তাঁর বাড়ি ছেড়ে সতীনের সাথে ঘর করতে রামপাশায় যেতে রাজী হোন নি। আমাদেও জন্ম, বেড়েওঠা আর জীবন যাপনও এখানে। কিন্তু মা আমার বেশি দিন বাঁচেন না। তিনি অঢেল সম্পত্তি রেখে মারা যান। মা র সম্পত্তি দুই তরফের ছিলো। আমার নানাও ছিলেন বড়লোক। তাঁর কোন ছেলে ছেলেসন্তান ছিল না। আমার মা আর খালা এই দুইজন ছিলেন তাঁর উত্তরাধিকারী। নানার মৃত্যুর পর অর্ধে সম্পত্তি মা পান, বাকী অর্ধেক ছিলো আমার খালা জরিনা বেগমের। কিন্তু এই খালার কপাল ভালো ছিল না। যুবতী বয়সে তাঁর স্বামী মারা যান। তাঁর কোন সন্তান ছিলো না। আমার মা মারা যাওয়ার পর বাবা এই সদ্য বিধবা খালাকেও ঘরে তুলে আনেন তাঁর চার নম্বর স্ত্রী হিসাবে।
– বাহ। দিদি, আপনার পিতাজির তো রাজ কপাল না, মহারাজকপাল ছিল। একেকজন সম্পদশালী মারা যান আর তাঁর বিধবারা আপনার বাবার ঘরে আসেন। রাজকন্যাসহ অর্ধেক না, রানী তার পুরা রাজত্ব নিয়ে চলে আসে। মানুষের এমন ভাগ্য হয় !
– ঠিক বলেছো চারু। কথা মিথ্যা না। আমার রাজকপালী পিতাজীর কাহিনী এখনো শুরু হয় নি। আরো আছে।
– কিন্তু সিক্রেট কী ছিল দিদি? অয়াজ হি টু হ্যান্ডসাম?
– ইয়েস, হি অয়াজ ইন্ডিড। শোন, আমরা সিলেট শহর আর রামপাশাতেই বড় হই। আমার মায়ের অভাব পুরণ করেন আমার খালা। আমরা দুই ভাই বোন এক সাথেই হেসে খেলে বড় হই। আমার খালার ঘরে কোন সন্তান নেই। আমরা বড় হই খালার ঘরে। এর মধ্যে সবচেয় মজার ঘটনাটি ঘটে আমার শৈশবে।
কি সেটা?
– আমার বয়স যখন নয় কী দশ, তখন আমার এক সৎ ভাই সুনামগঞ্জ থেকে আমাদের সিলেটের বাসায় আসে। তাঁর নাম হাছন। সে আমার তিন বছরের ছোট।
– মানে ? আপনার বাবা আরেক বিয়ে করেন? পঞ্চম বিয়ে ?
– হু। সেটাই আসল কাহিনী। সেখানেও বাবা ঘর জামাই ছিলেন। সেখানেও রাজকন্যার সাথে পুরা রাজত্ব।
– ইন্টারেস্টিং। এই কাহিনী কার কাছ থেকে পাব?
ছহিফা পেছনের একটা ভাওয়ালি নৌকার দিকে হাত ইশারা করে। বলে ওখানে আমির বক্স আর আলী রাজা বসে আছেন। এরা এই নাটকের সাইড রোলে আছে। খুব বেশি ডায়লগ নাই তাদের। ইউনিটেও পাত্তা নাই। আমির বক্স মারা না গেলে তোমরা আলী রাজা পাইতা না। আর আলী রাজা না মরলে হাছন রাজাও পাইতা ।
– দিদি, বসেন আপনি একটু। আমি ওদিকটা হয়ে আসি।
চার
আকাশ বালকের দল যে নৌকাটির ছাদ দখল করে আছে, তাতে অনেক হৈ চৈ। সবাই রামিজ রাজাকে নিয়ে মশগুল। চারু দেখে এর পেছনে আরেকটি ভাওয়ালী নৌকা। সে নৌকার সাজসজ্জা একেবারেই সাধারণ। সেখানে ছাদের উপর কেউ বসে নেই। কিন্তু সামনের গলুইয়ের কাছে যে পাটাতন সেখানে চাদর গায়ে দু’জন বসে আছে। কিন্তু তারা কেউ কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। দেখে মনে হয় নিতান্ত অনিচ্ছায় তারা এই শুটিং দলে এসেছে। কোনমতে কামটা শেষ হলেই বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নেবে।
চারু কাছে যায়। জিগ্যেস করে, চাচা, আপনি কে হন ?
চাচা কথা বলেন না।
পেছনের গলুই থেকে মাঝি বলে- তাইন মাতইননা খাউরো লগে। সারাদিন মন খারাপ করি থাখইন।
– কারণ ?
– ই ফিলিমা তার কোনো ডায়লাগউ নাই। খালি এখবার তার চেরা দেখাইন, বিবির লগে। ওউ শেষ।
চারু জিগ্যেস করে, নাম কি উনার।
মাঝি বলে, আসল নাম যে কিতা গো মাই, জানি না। তয়, ই ফিলিমো তাইন আমির বখস ছদরি।
এই নাম শুনে অনেকটা চিৎকার করে উঠে চারু – আমির বক্স দি গ্রেট জামিন্দার! বাহ আপনার কথা অনেক শুনেছি। তবে বেশি কোনো তথ্য পাইনি। আমি হাছন রাজার পরিবারের লোকের লেখা দু’টো বই সুনামগঞ্জ আসার পথে বাসে বসে বসে কিছুটা পড়েছি। অনেক জায়গায় আপনার নামটিই আছে চাচা, তেমন ডিটেইল্স কিছু নাই। যতটুকু পড়েছি, তাতে মনে হয়েছে যে, লক্ষণশ্রীর জমিদারীর সবই আপনার ছিলো। কিন্তু কোথাও আপনার কোন চিনহ নাই, নাম দূরের কথা, কবর যে আপনার কোথায় তাও কেউ ঠিক মত জানে না।
ঝিম মেরে কথা শুনেন আমির বক্স। তাকিয়ে থাকেন চারুর দিকে। একেবারে আই বল টু আই বল লুক যাকে বলে। চারু একটু ভয় পেলো বলে মনে হল। অনেক ক্ষণ পরে আমির বক্সই কথা বলেন – বলো, কী জানতে চাও ?
– আপনি থাকেন কোথায়?
– গাঙের ঐপারে। ঐপারে আমাদের পরিবারের কবরস্থান। আমার বাপ-দাদাও ওখানে আছেন।
– আমাদের হাছন রাজার দুই বাবা এখন আমাদের সামনে। কী মজা ! একজন হাছন রাজার জন্ম দাতা, আরেকজন হাছনের মায়ের স্বামী। ভেরি ইন্টারেস্টিং। আচ্ছা, আপনারা নাকি স্পম্পর্কে আপন খালাতো ভাই?
– হ।
– কেমনে কী! আপনি হইলেন লক্ষণশ্রীর জমিদার, আর আলী রেজা হইলেন রামপাশার। এতো দূরে দূরে আপনাদের মা-খালাদের বিয়ে কি হত সে সময়, এই ধরেন ১৮৫০ সালের দিকে ?
– এখানে কাহিনী আছে।
– একটু বলেন।
– আমার নানা ছিলেন খাসিয়া রাজার এক সময়কার সীমন্ত রক্ষক, ধরো এখন যেমন বর্ডার গার্ড আছে, সে রকম কিছুর প্রধান। তিনি নবীর কোরাইশ বংশের আওলাদ, নাম ছিলো ওয়েজ উদ-দীন চৌধুরী। তার সাথে বিয়ে হয় এক নব্য মুসলিম জমিদারপুত্র। লোকটার নাম ছিলো বিরেন্দ্র সিংহ দেব। তিনি মুসলমান হয়ে গেলে তার হিন্দু বাপ তাকে সম্পত্তি থেকে ত্যাজ্য করে দিলে আমার এই নানার বোনের সাথে তার বিয়ে হয়। বিরেন্দ্র নাম পাল্টিয়ে রাখেন বাবু খান। দেব থেকে খান হয়ে যান আর লক্ষণশ্রীর তেঘরিয়া থেকে আমার নানার বোন এই নও-মুসলিম বাবু খানের সংসার করতে চলে যান রামপাশা। আর তখনই রামপাশায় হিন্দু-মুসলিম দুই রক্ত মিলিত হয়ে বাবু খানের বংশ বিস্তার লাভ করে। এই রক্ত চালাচালি আরো বাড়তে থাকে। নানীর দুই ছেলের জন্ম হয়। বড় ছেলে আনোয়ার খানের জন্য নিয়ে আসেন নিজের ভাই ওয়েজ উদ-দীনের বড় মেয়েকে।
এতো দূরে দূরে বিয়েসাদি হতো তাহলে ? যোগাযোগ ব্যবস্থাতো খুবই খারাপ। নৌকা ছাড়া তো গতি নাই। কিন্তু উপায় ছিলো না। অনাত্মীয়ের মধ্যে বিয়েসাদি হলে সম্পদ চলে যাবে অপরের ঘরে, সুতরাং নিজেদের হিসাবের মধ্যে সম্পদ রেখে দেয়ার জন্য তখন পরিবারের বা আত্মীয়দের মধ্যে বিয়েসাদি হয়ে যেত। এখানেও হলো তাই। আনোয়ার খানের দুই ছেলে হয়। একজন আলীরজা, আকেজন আলমরজা।
– এটা কি রজা না রেজা না রাজা ?
– আসলে রেজাই হওয়ার কথা। কিন্তু তখনকার দিনে কী আর বই পুস্তক ছিলো ? রেজাকে রজা রজাই ডাকতো। তবে বিটিশের খাতায় লেখা ছিলো রেজা নামে।
– আর রাজা ? হাছন রাজা ?
– রাজার বিষয় আমি জানি না। তুমি অন্য কাউরে জিগাইও। এটা অনেক পরে হয়। তো রামপাশার দুই জমিদার আলী রেজা আর আলম রেজা ছিলো আমার আপন খালাতো ভাই। আমার মা আর এই আলী রেজার আলম রেজার মার ছোট বোন। সেই হিসাবেই এই আলী রেজা আমার আপন খালাতো ভাই।
– বাহ। খুব ইন্টারেস্টিং । আমার কিন্তু এতোটা জানা ছিলনা। হাছন রাজার বাবার সাথে আপনার আগেই পরিচয় ছিল।
– বললাম তো, আমার আপান খালাতো ভাই। হিন্দু-মুসলিম রক্তে মিশানো সম্পর্ক। এখন তোমরা হাছন রাজার যে জমিদারীর কাহিনি শুনো সেই রামপাশা-তেঘরিয়ায় দুই পৃথক জমিদারী তখন দুই জমিদারের ছিল। এবং তার সূচনা করেছিলেন আমারই নানাজানের বাবা।
– কেমনে ?
– তোমাদের এই হাছন রাজার দাদা বাবা বাবু খান যখন আমার নানির বোনকে বিয়ে করে তেঘরিয়া থেকে রামপাশা নিয়ে যান তখন নানীর সাথে বিশাল সম্পদও উপহার বা যৌতুক যা বলো, তা নিয়ে যান এবং তা দিয়েই তিনি রামপাশায় তালুক কিনে জমিদারি শুরু করেন । আল্লাহর কী খেলা, তিনি মানুষকে সম্পদ দিয়ে বসে বসে খেলা দেখেন, এই সম্পদ গাঙের ঢেউ এর মতো, একবার সেটা বিশ্বনাথ, আরেকবার সেটা সুনামগঞ্জের দিকে এসে আছড়ে পড়ে। খোদা তা’য়ালা কারে কখন কী দিবেন বোঝা যায় না। তিনি এক দিকে নিয়ে যান, অপর দিকে ভরিয়ে দেন।
পাশে বসে ছিলেন আরেক ভদ্রলোক। এবার তিনি আস্তে করে কথা বলে ওঠেন। বলেন- ঘটনা সত্য।
চারু তাকায় তাঁর দিকে ।
তিনি বলেন, আমিই সেই আলী রেজা।
এবার আরেকটু চমকায় চারু। বলে, বাহ্, তাহলে আপনার কাছ থেকে শুনি আপনার গল্প।
আলী রেজা পাটাতনের উপর পা মেলে বসেন । পকেট থেকে সিগারেট বের করেন একটা। কিন্তু ম্যাচ খুজে পান না। চারু বলে, আমার কাছে আছে।
এই বলে সে ব্যাগ থেকে তাঁর নিজের সিগারেট প্যাকেট আর লাইটার বের করে।
আলী সিগারেটে টান দিয়ে কথা বলা শুরু করেন – আমার বড় ভাই আলম রেজাই আসলে বাবার জমিদারী দেখতেন। বাবার জমিদারী ছাড়াও তিনি নিজেও বিশাল জমিদারী খরিদ করেছিলেন। প্রায় ৮ লাখ বিঘার জমির দখলদার ছিলেন তিনি। কিন্তু মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে কোন সন্তানাদি না রেখে তিনি যখন মারা যান, তখন আমার বাবার ভাগে চলে যায় সকল জমি।
– কেমনে ? তার স্ত্রী তো ছিলেন, না নাই ?
– থাকলেও এখানে আইনের অনেক মারপ্যাচ আছে, সব তুমি বুঝবা না। আসল কথা হইলো, যখন আমার বড়ভাই আলম রেজা মারা যান আমি তখন বাপের একমাত্র ছেলে হিসাবে থাকি। আমার তখন আঠারো উনিশ বছর বয়স। আমি বাবার জমিদারী দেখার কাজ শুরু করে দেই। এর মধ্যে আমার বড় চাচা কিশোয়ার খান মারা গেলে তার সম্পত্তি পেযে যান আমার চাচাত ভাই কামদার খান। কিন্তু তিনিও চল্লিশ বছর বয়সে নি:সন্তান অবস্থায় মারা গেলে তার সম্পত্তি বাবার কাছে চলে আসে। বড় ভাই আলম রেজার মৃত্যুর ৬ বছর পর আমার বাবা আনোয়ার খান ইনতেকাল করলে বাবা, চাচা, চাচাতো ভাই, নিজের ভাই সবার জমি আমার ভাগে এসে পড়ে।
– আপনি দুর্দান্ত একটা কপাল নিয়া জন্মেছেন চাচা। আমার তো ইচ্ছা করতেছে আপনার কপালটা একটু আমার কপালের সাথে নিয়ে ঘষে দিতে, তাতে যদি আপনার কপালের শতভাগের একভাগও আমার জুটে যায়।
কথাটা আসলে খুব মিথ্যা নয়।
– আমি দেখলাম, বেশি কিছু করতে হয়নি আপনার। শুধু সুযোগগুলোই কাজে লাগিয়েছেন। ভলিবলে, যখনই ভালো লব পেয়েছেন, স্ম্যাশ করে দিয়েছেন, লুজ বল যতোগুলো পেয়েছেন চার-ছক্কা মেয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। ঠিক না ?
আলী রেজা কথা বলেন না। চারু আমার বলে – আচ্ছা, রাজ পরিবারে মৃত্যুটা তাহলে জীবিতদের জন্য আশীর্বাদ, তাই না চাচা?
– জগৎটা এমনইরে মা। যে যায়, সে যায়ই। আর যে বাঁচে সে নাচে। আমি বেঁচে রইলাম প্রায় ছিয়াত্তর বছর। বেঁচে থেকে জগতের এইসব নাচানাচি দেখে গেলাম। সয়-সম্পত্তির বিচারে আমি তো যথেষ্ঠ ভাগ্যবানই ছিলাম। দুই দিক থেকেই খালি পেয়েছি।
আপনার কথা যদি সব সত্য হয়, আমি ধরে নিচ্ছি সবই সত্য, তবে দেখি যে মারামারি কাটাকাটি দখলদারি করাকরি করে আপনার জমিদারি বাড়াতে হয় নাই।
– ঠিক। এই যেমন আমার বাপ-ভাই-ছেলে-চাচা থেকে যা যা পেলাম, নানার বাড়ি থেকেও পেলাম।
– কেমনে ?
– আমার নানা ওয়েজ-উদ-দীনের নিজের জমিদারী খুব বেশি ছিলো না। ছিলো আরেক লোকের। তার নাম মুরাগ বেগ। তিনি আমার নানার জায়গার চাকরী পেয়ে নিজে তালুক কিনেন। কিন্তু পরে তিনি মুর্শিদাবাদ চলে গেলে আমার মামা গোলাম আলীকে বিষয় সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে যান।
– বুঝিয়ে দিয়ে, মানে ? আপনার মামা কি কিনেছিলেন না দখল নিয়ে নিয়েছিলেন ?
– তিনি একেবারে দিয়ে গিয়েছিলেন, না বিক্রি করে গিয়েছিলেন, সেটা আমরা জানি না। কিন্তু মুরাদ বেগ মুর্শিদাবাদে ভালো সুবিধা পেয়ে সেখানেই থেকে গেলে এই তালুকটি আমার মামার দখলে চলে আসে। এবারও আমার কপাল খুলে যায়। মামা মারা গেলে তার একমাত্র বোন, আমার মা সরবজানের কাছে চলে আসে সম্পত্তি। একে একে মামা, বাবা, মা দুই ভাই মারা গেলে সম্পত্তি চলে আসে একা আমার কাছে।
– আচ্ছা চাচারা, একটা কথা বলেনতো দেখি, এইসব জমিজমার হিসাব, যা আমার একদমই মাথায় আসেনা এসবকে আপনারা সবাই আপনাদের আপনাদের বলে যে হাপিত্যেস করছেন-
– হাপিত্যেস কোথায় করলাম? আলী রাজা বলেন।
– করছেন তো। বখস্ চাচা বললেন যে সবই তার ছিলো, এখন তার নাম নাই।
আমির বখস্ বলেন- না, মনের দুঃখে বলিরে মা। আসলে জগতে থাকার সময় এই মাটি মনে হতো আমার সম্পদ। এই জগৎ ছেড়ে আসার পর মনে হয়েছে মাটি থেকে আসার পর মাটিতে মেশার আগ পর্যন্ত কেউ কেউ কিছু মাটির পাহারা দেবার সুযোগ পায়। এই সুযোগ পেয়ে তারা তাকে তার চিরস্থায়ী সম্পদ ভেবে সবচেযে ভুলটা করে। গতকাল যে এই মাটির পাহারা দিয়েছে, আজ দিচ্ছে অন্যজন, আগামীকাল তার হাত বদল হলে যাবে আরেকজনের কাছে। মাটির জায়গায় মাটিটা থেকে যায়, শুধু পাহারাদারের শিফট বদল হয় । এটা জগতের মানুষ কেউ বুঝে না। এ জগতে আসার পর সবাই টের পায়। তারপর এই নিয়ে হাসাহাসি করি, এই যা। তুমি কি কখনো তোমার ছোটবেলার পুতুল হারানোর কথা মনে করো নি?
– করেছি তো।
– এজন্য মন খারাপ করো নি ?
– তখন করতাম।
– এখন?
– এখন এটা ভেবে হাসি পায়। কিন্তু চাচারা, আপনাদেরকে আপনাদের সৃস্টিকর্তা আচানক এক বড় কপাল দিয়ে পাঠিয়েছিলেন এ দুনিয়ায়। আপনারা যেখানে ছাই মনে করে হাত দিয়েছেন, তুলে দেখেন সোনা হয়ে গেছে। আপনাদের নিজের কিছু করতে হয়নি। সবই আপনা আপনি এসে গেসে। তাই না, চাচারা ?
– কপাল কি একলা আমারই ছিলো? আমিরের ছিলো না?
আমির বখস্ ঘাপটি মেরে থাকেন। কথা বলেন না। খালাতো ভাইয়ের টিপ্পনীতে কাজ হলো। আস্তে আস্তে এবার কথা বেরোচ্ছে তার মুখ থেকে। বলেন- হ্যা, এরকমই আরো কয়েকটা মৃত্যু আমাকেও বড় জমিদার বানিয়ে দিয়েছিল।
চারু বলে, বুঝেছি। এই কারণেই রাজপরিবারের কাহিনী মানেই পরিবারের মধ্যে কলহ। আর এই কলহ মানে ঝগড়া করে কথা বলা বন্ধ করে দেয়া না। একেবারেই ডাইরেক্ট হিট, সেন্ড টু হ্যাভেন। কল্লা কেটে দিয়ে ছোট ভাই বড় ভাইর সম্পদ নিয়ে ফূর্তি-মশকরা করে জীবন কাটাবে। তবে আপনাদের দুইজনেরই কপাল ভালো ছিলো। খুনাখুনীতে যেতে হয় নি আপনাদের। এমনি এমনি এসে গেছে। তাই না বখস্ চাচা?
– হ্যাঁ, নানার আর দাদার কাছ থেকে পাওয়া দুই জমিদারী এক সময় আমার মা হয়ে আমার কাছে চলে আসে পুরোই। আমার আরো দুই ভাই ছিলো, পীর বক্স আর খোদা বক্স। তারা দুই জনই মারা গেলে একা আমিই বিষয় সম্পত্তি পেয়ে যাই। আমার মনে হয়েছে যে মানুষের কাছে সম্পদ দেয়া নেয়া নিয়ে আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদের নিয়ে লাই খেলেন। লাই খেলা কি জিনিস জানো?
– না।
– পানির মধ্যে ডুবে ডুবে ছুঁইয়ে দেখা। ডুবে যাকে ছোঁয়া হবে সে লাই হবে। সে যতক্ষণ না আরেকজনকে ছুবে ততোক্ষণ সে সাতরাবে বা ডুবে ডুবে কাউকে ধরতে যাবে। কাকে কখন ধরবে কেউ বুঝতে পারে না। যাকে লাই ছুতে পারে না, সে পানির উপর ভেসে বেড়ায়। তার অনেক ফূর্তি। যাকে ছোঁয়া হয়, সে পড়ে বিপদে। এই ডুবু ডুবু খেলায় কেউ জিতে না কেউ হারেও না। পালাক্রমে একবার হয়রানী পেতে হয়। যে যত কম হয়রানী পায় সে ততো ভাগ্যবান। আমি ভাগ্যবানও যেমন ছিলাম ভাগ্যহারাও তেমনি হয়েছি। হুরমতের কাছে সব জমা রেখে আমিই সবার আগে বিদায় নিলাম।
– হুরমতের সাথে বিয়েটা কেমনে হলো আপনার ?
– আমার যখন একুশ-বাইশ বছর বয়স, তখন আমার জন্য মেয়ে দেখা হলো। শোনা গেলো নেত্রকোনার খালিয়াজুড়িতে এক অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে আছে, তাজা গোলাপের মতো তার চেহারা, ১৬-১৭ বছর বয়স। আমার সাথে মহা উৎসব করে তার বিয়ে হয়ে যায়। ১৮ বছরের সংসার ছিলো আমাদের। তিন পুত্র এক কন্যা। আমার বছর চল্লিশ যখন বয়স, একে একে আমার ভাগাড় খালি হতে থাকে। আর আমি চেয়ে চেয়ে আমার শূন্যতাটুকু কেবল দেখি।
– এবার নৌকার পাটাতনে নেমে আসে মাঝরাতের হাওড়ি শূন্যতা। শুধু শো শো শব্দ করা বাতাসের ধ্বনি ছাড়া আর কিছু নাই। অনেকক্ষণ পরে পাশের ভদ্রলোক কথা বলেন।
– আমির বকস্ যা কইছে, সবাই হাছা। আমার চেয়ে ভালো কেউ তারে চেনে না। ওর কপাল খারাপ। অসময়ে মারা না গেলে এই সুনামগঞ্জের জমিদারী আমার হতো না। হাছনও হতো না। সবাই হতো, শুধু হাছনের জমিদারীটা পেতো না। আসল কথা শুনতে চাইলে নিশাতের কাছে যাও।
– নিশাত কে ? কোথায় উনি ?
– সে এসব হৈচৈ এর মধ্যে নেই। ছইয়ের ভেতর চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। হুরমত জাহান বানুর পাঠ করছে নিশাত । যদি তার মন ভালো থাকে, সব হিস্টোরি তার কাছ থেকে পাইবা।
পাঁচ
হুরমত বলতে থাকেন – আমাদের পূর্বপুরুষও হিন্দু, ক্ষত্রীয়বংশের জমিদার ছিলেন। তারা এখানে এসেছিলেন ভারতের রাজস্থান থেকে প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে। তাদের পঞ্চম উত্তর পুরুষের নাম লেম্বুধর রায় সিং। লেম্বুধর সিং এর পূর্বপুরুষেরা ঈশা খাঁর পক্ষের লোক হয়ে বারো ভূঁইয়াদের সাথে মিশে মুঘল সম্রাট খাঁন জাহানকে প্রতিহত করার কারণে তারা ঈশা খাঁর কাছ থেকে দেওয়ানী পান। সেখান থেকেই শুরু। আর সেই লেম্বুধর রায় সিংহ মুসলমান হয়ে নাম নেন বক্তার খাঁ। যদিও তিনি নিজে মুসলমান হোন, তার অপর ভাই অদ্বিনাথ কিন্তু হিন্দুই থেকে যান। তার উত্তর পুরুষেরা এখনো খালিয়াজুরি আছেন, হিন্দু হিসাবেই। আর মুসলমান হয়ে যাওয়া এই বক্তার খাঁ ছিলেন আমার দাদা।
দাদার জমিদারী এক সময় চলে আসে বাবার কাছে। বাবা মারা গেলে আমার বড় ভাই তুরন মিয়া জমিদার হলেন। তার কাছে গেলো সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীর জমিদার আমির বক্সের সাথে আমার বিয়ের আলাপ। আমার তখন ১৫-১৬ বছর বয়স। মহা ধুমধামে আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ের সময় দুইটা দাসী দেয়া হলো আমার সাথে। তারা খেদমত করবে আমার, আমার স্বামীর।
– এরা কি দাসীবাঁদী টাইপের কিছু?
– খাদিমা বলা হতো তাদের। এদের এক্সেস ছিলো বেড্রুম পর্যন্ত, যকোন সময়। মূলতঃ একসময় ঘরে বৌ আনা হতো ঘরকন্নার কাজে সাহায্য করার জন্য। তো জমিদারদেরতো শত শত লোক থাকে খেদমতের, তাদের বৌরা বাচ্চা বিয়ানো ছাড়া আর কোন কাজ করতো না। তাও বছর তিরিশ পর্যন্ত। তিরিশ বছয় হয়ে গেলে জামাইরা আর এই বউয়ের কাছে আসতো না, তারা তখন নতুন বউ আনতো।
– খাদিমাদের কাজ কি ছিল?
– জামাই-বোউ দুইজনের গা টেপা থেকে শুরু করে গোসলের পানি আনা, খানা সাজাই দেয়া এই আর কী। আমি জমিদারী বুঝি না। সবাই বলে আমি নাকি দিলদরিয়া মহিলা। আমার কাছে যে কারো চলে আসা মানেই তার খাজনা মাফ। সঙ্গে অনেক কিছু নিয়ে যাওয়া। এ কারণে আমার বাপের বাড়িতে কেউ আমার সাথে কোনো প্রজার দেখা সাক্ষাৎ করতে দিতো না। আবার এই লক্ষণশ্রীতে এসেও দেখি এই অবস্থা। সাহেব বলেন, তুমি শুধু রান্নাবাড়া দেখিয়া দিও, আর কুনো খাম নাই।
– আপনি কি নিজে রাঁধতেন ?
– আমি কাজের লোকের হাতের রান্না খাই না। নিজে রাঁধি। আমার পাক ঘরে ৪ জন মহিলা আমাকে সাহায্য করে। তারা মসলার বাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি নিজের হাতে ডেকচির ভেতর মসলা ঢালি আর আমার চার বাচ্চারে খাওয়াই। বাড়িতে নানা রকম পীর ফকির আর সন্যাসীদের আনাগোনা ছিলো। তাদের অনেকে হিন্দুস্থান থেকেও আসতো।
– মানে ইন্ডিয়া?
– হ্যা, ওই একটু দূরেই তো মেঘালয়। আসামের মধ্যেই তো ছিলাম আমরা। তখন তো আর বর্ডার ছিলো না। ঘোড়া চালিয়ে লোকেরা চলে আসতো। এরা আমাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতো, বখশিস চাইতো, আমি হাত ভরে দিয়েও দিতাম। এদের একজনের মুরীদ ছিলেন আমার সাহেব।
– হিন্দুস্থানী পীরের মুরীদ ছিলেন আমির বখস ?
– হ্যাঁ। একবার সাগরেদসহ সেই হিন্দুস্থানী ফকির আমাদের বাড়ি এসে কয়েকদিন থাকলেন। যাবার দিন দুপুরবেলা ভরপেটে খাওয়ার পর দেখি আর উঠান থেকে সরেন না। তাদেরকে জিগ্যেস করা হলো, তারা যাচ্ছে না কেন?
সাহেব গেলেন তার পীরের সাথে কথা বলতে। পীর বলে, সে আমাদের লাল ঘোড়াটি চায়।
বলে কী! এই লাল ঘোড়াটা আমার বড় ছেলে সিকান্দারের। তার বয়স ষোল হয়েছে, সে ঘোড়া চালায় এবং এই ঘোড়াটি ছাড়া সে আর কোনো ঘোড়ায় চড়ে না।
সাহেব তাদেরকে বলেন, ঠিক আছে, আমার ঘোড়াশালে আরো কয়েকটি ঘোড়া আছে, তোমাদের পছন্দমত একটি নিয়া যাও।
ফকির মানে না।
সাহেব এলেন আমার কাছে। বলেন- এখন কী করি?
আমি বললাম, আপনি এই পীরের মুরীদ হয়েছেন, তাঁকে নাখোশ করলে, তার অভিশাপ লাগতে পারে। আপনি তাঁকে কিছু টাকা দিয়ে দেন, তিনি এ রকম একটা লাল ঘোড়া কিনে নিবেন।
সাহেব বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখেন, ফকির ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে অনুমতি চায়। অনুমতি পেলে এই ঘোড়া নিয়ে তারা দু’জন চলে যাবে। সাহেব জানিয়ে দিলেন, এই ঘোড়া দেয়া যাবে না। এটা আমার ছেলের ঘোড়া। তার বিনিময়ে টাকা নিয়ে যাও। ফকির হাত থেকে লাগামের রশি সাহেবের মুখের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলো, টাকাও নিল না। যেতে যেতে সে বললো, তোর পোলার শখ মিটাবার জন্য তুই আমারে ঘোড়া দিলি না, তুই নির্বংশ হবি।
– কী বলেন ! অভিশাপ দিয়ে গেলো ? তারপর-
– এই ঘটনার কয়েকদিন পর আমার বড় ছেলের গুটি বসন্ত দেখা দিল। এসময় গ্রামে মড়ক এসেছে। বসন্ত রোগে গ্রাম ছেয়ে গেছে। ঘরে ঘরে এই রোগী। একজনের কাছ থেকে আকেজনের শরীরে চলে যায়। কোন টোটকায় কাজে আসে না। কোন কবিরাজের কোন অষুধ নাই। সবাই বললো এটা আল্লার গজব হিসেবে বালা এসেছে গ্রামে। গ্রামের কারো না কারো পাপের ফলে এই বালা এখানে এসেছে। এখন বের করো পাপী কে ?
– তারপর ?
– মসজিদে কোরান খতম হচ্ছে, জিকির হচ্ছে প্রতিদিন। মাগরেবের নামাজের পর মশাল হাতে নিয়ে নারায়ে তাকবীর, আল্লাহ আকবার আর জাল্লাল্লাহু জাল্লাল্লাহু বলে জিকির দিতে দিতে সারা গ্রাম মুসল্লিরা ঘুরতেন, বালা তাড়াবার জন্য। লোকজন একহয়ে সুর করে একটা ছড়া পড়তো। খুব মজার ছড়া।
– কী সেটা ?
– সেটা হচ্ছে – আলীর আতো জুলফিকার, ফাতিমার আতো তীর, যে পথে আইছো বালা সে পথে ফির ।
– ইন্টারেস্টিং। এই শ্লোক শুনে নিশ্চয়ই জীবানুগুলো চলে যেতো , তাই না ?
– আরে না। সেই বালা আর যায় না। আমি কী করবো, কার কাছে যাবো, উপায় বুদ্ধি পাই না। কবিরাজের পর কবিরাজ আসছেন, কত গাছের বাকল, পাতা নিজের হাতে পিষে পিষে খাওয়াইলাম, কাজ হয় না। প্রথমে মারা গেলো বড় ছেলে সিকান্দার। এরপর একে একে রেজোয়ান, সৈয়দ আর দুধের কন্যা সওয়ারী আমার চোখের সামনে মারা গেলো।
– তার মানে আপনারা একেবারেই সন্তানহারা হয়ে গেলেন ? সেই পীরের বদ-দোয়ার কারনে কি হলেন?
– জানি না। কিচ্ছু জানি না। এই ঘটনার কিছু দিন পর আমাদের বাড়ির ঘাটে আরেক পীর সাহেবের নাও ভিড়ে। তিনি হারুলিয়ার পীর সাহেব । এই পীর সাহেব আমাদের পূর্ব পরিচিত। আমার বাপের বাড়িতেও আমি তাঁকে দেখেছি। তিনি আমার খোঁজ নিতে এসেছেন। তিনি হিন্দস্থানী পীরদের পছন্দ করেন না। এবার ঘাটে নাও লাগিয়েই তিনি খবর পান যে, কিছুদিন আগে এই বাড়িতে সেই হিন্দুস্থানী পীর এসে গেছেন এবং সাহেব এই পীরের মুরীদ হয়েছেন, তখন তিনি সাংঘাতিক ক্ষীপ্ত হয়ে যান এবং সাথে সাথে ঘাট থেকে নৌকায় দড়ি খুলে তিনি ফেরত যাবার প্রস্তুতি নেন। পীর সাহেব জোরে জোরে চিৎকার করে মাঝিকে বলেন, ঐ আটকুড়া চৌধুরীর ঘাট থেকে যেনো তাড়াতাড়ি নৌকা সরানো হয়।
– আটকুড়া মানে ?
– এটা এখানকার ডায়ালেক্ট। আটকুড়া, মানে যার সন্তান নাই। এটা একধরনের গালি। এজ ইফ কারো সন্তান জন্মানোর ক্ষমতা নাই বা যে নির্বংশ।
– আচ্ছা, তারপর –
– তারপর লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সাহেব ঘাটে এসে শুনেন হারুলিয়ার পীর সাহেব তাকে ‘আটকুরা’ গালি দিয়ে চলে গেছেন।
সাহেবের মনে খুব কষ্ট লাগলো। তিনি বললেন, আমার এতোগুলো সন্তান মারা যাবার পর যে আমারে সমবেদনা না জানিয়ে গালি দিয়ে চলে গেলো, সেও যেনো নির্বংশ হয়।
খোদা তা’য়ালা দুইজনের কথাই সম্ভবত শুনেছিলেন। এই ঘটনার কিছুদিন পর গুটি বসন্তে ধরলো আমার সাহেবকে। আমাকে সুরমা গাঙে না ভাসাইয়া এই সংসার গাঙে একাকী ফেলে রেখে তিনি চলে গেলেন। হারুলিয়ার পীর সাব ও কোনো সন্তান না রেখে কিছুদিন পর মারা গেলেন।
আমি ঘরের ভেতর একটা চৌকির উপর দিন রাইত শুয়ে শুয়ে বিছানা বালিশ ভিজিয়ে শুধু কাঁদি আর কাঁদি। আমি দিনের আলো দেখি না, রাইতের চাঁদও না। আমি ঘরের ভেতর বসে বসে শুধু আল্লাহরে ডাকি।
এমন সময় একদিন আমারে দেখতে আসেন সাহেবের আপন খালাতো ভাই। তিনি রামপাশার জমিদার। নাম আলী রেজা দেওয়ান। আমি তাঁকে চিনি। কিন্তু এবার আমি তার সঙ্গে আমি দেখা করতে বাহির ঘরে যাই না। তাকে খাসি জবাই করে খাইয়ে বিদায় হতে বলি। তিনি খবর পাঠান, সামান্য কথা বলে বিদায় হবেন।
তাকে আমাদের ভেতরের ঘরে আসতে দেয়া হলো। আমি পর্দার আড়ালে, তিনি চেয়ারে বসা। আমাকে বললেন, জমিদারীর সব কায়দা কানুন তার জানা আছে। আমি যদি তাকে সুযোগ দেই, তিনি আমার হয়ে হিসাবপত্র বুঝে নেবেন। তিনি এসেছেন তার খালাতো ভাইয়ের জন্য সাহায্যের হাত নিয়ে।
আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি চলে যান।
এর কয়েকদিন পর শুনি প্রজারা কেউ খাজনা দেবেনা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার আমাদের বেশ কিছু জমিজমা অনেক লোক দখল করে নিয়ে কেউ ঘর তুলছে, কেউ নিজের মতো ক্ষেত করছে। এই খবর পেয়ে আলী রেজা সাহেব নিজে চলে আসেন, সঙ্গে বারোজন লাঠিয়াল। সবার হাতে লাঠি, জাটা। তিনি নিজে দুইদিন থেকে সবগুলো দখল মুক্ত করে দিয়ে, তার বারোজন লাঠিয়াল রেখে চলে যান। আমাদের লাঠিয়ালদের সঙ্গে তার লাঠিয়ালরাও সম্পত্তি পাহারা দিতে থাকে।
কিছুদিন পর এক লোক আমার কাছে একটা পত্র নিয়ে আসে। লিখেছেন আলী রেজা দেওয়ান। পত্র পড়ে আমি থ । তিনি আরো অনেক কিছু আমার জন্য করতে চান, তিনি আমার বাকী জীবন আমার সঙ্গে কাটাতে চান।
এ চিঠির আমি জবাব দেই না। মাস খানেক পরে আরেক লোক চিঠি নিয়ে আসে। আমি সেই চিঠিরও জবাব দেই না। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই, এই জীবনে আর বিয়া সাদী করবো না। বাকী জীবনটা মানুষের খেদমত আর আল্লাহ জিকির করে কাটিয়ে দেব।
কিছুদিন পর বিকেল বেলা এক বৈষ্ণবী দোতারা বাজাতে বাজাতে আমার বাড়ির অন্দরমহলে চলে এলো। তাকে বাহিরে আটকানো গেলো না। সে সবাইকে বলে যে, সে বেগম সাহেবের কাছেই এসেছে, বেগম সাহেবকে গান শোনাবে।
বৈষ্ণবীর মতলব বোঝা গেলো রাতের বেলা। অনেক গান শোনানোর পর সে আমার খুব কাছে এসে বলে, সুগন্ধী ফুলের লতার যেমন বড় গাছের আশ্রয় লাগে, তেমনি গুণবতী নারীর প্রয়োজন বলিষ্ঠ পুরুষের আশ্রয়। একথা সেকথার পর বলেন, রামপাশার জমিদার তাকে পাঠিয়েছে, আমার কাছ থেকে যেকোনভাবেই বিয়ের সম্মতি নিয়ে যেতে। রাতে সে উঠানে নিজের হাতে নিজের জন্য ডাল-ভাত রান্না করে খেয়ে বারান্দায় ঘুমাবে। আর এই সারারাত্রিতে আমি যেনো চিন্তা ভাবনা করে কাল সকালে তাকে আমার মতামত জানাই।
পরদিন ভোরবেলা বৈষ্ণবী বাড়ির পাশের সুরমা গাঙে স্নান করে এসে আমার পায়ের কাছে বসে থাকে।
আমি বৈষ্ণবীকে বলি, যাও তোমাদের দেওয়ানকে বলে দাও, আমি রাজী। তবে শর্ত আছে।
কী শর্ত মা-জননী?
আমার পক্ষে সম্ভব নয় সতীনের ঘর করা। রামপাশায় উনার জমিদারী আছে, স্ত্রী-পুত্র আছে। তারা সেখানেই থাকবে, তাঁর জমিদারীও সেখানে থাকবে। আমি থাকবো এই লক্ষণশ্রীতে তোমাদের দেওয়ান যদি এখানে এসে সারাজীবন থাকতে পারে, তবে আমি বিয়ে করতে রাজী।
ছয়
আলী রেজা খুব ফূর্তিতে আছেন। বলতে থাকেন – লক্ষণশ্রী থেকে আমার দূত ফেরত আসে। তার সঙ্গে একমন রসগোল্লা । লক্ষণশ্রীর চৌধুরাণী এটা পাঠিয়েছেন আমার জন্য। আমি বুঝে যাই, খবর ভালো। আল্লাহ পাক আমার মনের আশা পূরণ করেছেন। এমনিতে আমার আগের যেসকল জমির বন্দোবস্ত নেয়া আছে, সেগুলো আসলে খুব বেশি না। অন্য অঞ্চলগুলোর জমিদারীর তুলনায় তা অনেক কম। তাছাড়া নতুন কিছু তালুক কেনার জন্য লোক লাগিয়েছি। নগদ টাকারও খুব দরকার।
আমার তখন ষাইটের মত বয়স। এ আর এমন কিছু না। সারাদিন ঘোড়া মারতে পারি। হাতিও চালাই । কিন্তু এখন মনে হইলো হাতে আরো কিছু টাকা পয়সা দরকার। এমনিতে আমার তিন নম্বর সাদী আমার কপাল খুলে দিয়েছিল। সইফার মা, নুরু বিবির স্বামী অঢেল সম্পত্তি রেখে মারা যাবার পর যখন আমার বৌ হলো তখন, তার সম্পত্তি যোগ করে আমার জমিদারী বাড়ালাম। পরে নুরু বিবির ছোট বোন জরিনারে বিয়ে করে তার বাপের সম্পত্তিও পেলাম। এসব সয়সম্পত্তি আমাকে অনেক ইজ্জ্বত দিয়ে দিয়েছে। সেইসব নিয়াই আমি আরামে ছিলাম।
এদিকে আমার খালাতো ভাই আমির বখস্ সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে অঢেল সম্পত্তি রেখে গেছে, সব আমার জানা। আমির বখ্সের বন্দোবস্ত এখন সব হুরমতের নামে। হুরমত আমার বৌ হলে সেই সম্পত্তিও আমার হবে। সবাই এখানে চৌধুরী আছে, আমিও চৌধুরী। এবার এই সম্পত্তি আমার হলে আমি দেওয়ান হবো। নামের সাথে একটা দেওয়ান যুক্ত হওয়া মন্দ কিছু না। সিলেটের কোনো জমিাদারের নামের আগে পিছে দেওয়ান আর চৌধুরী আছে? আমি ঘোড়াশাল থেকে দশটা ঘোড়া একসাথে বের করে আনি। ডানে বামে যারেই দেখি, তার হাতে একটা লাগাম ধরিয়ে বলি, আও আইজ ঘুড়া দৌড়াইতাম।
আমার এই ফূর্তির মানে সবাই বুঝে না। আমি সারা বিকাল রামপাশার মাঠে দশবার ঘোড়া দৌড়ানো শেষ করে বাড়ি এসে আমার সবচেয়ে প্রিয় কুড়া পাখীটাকে খাঁচার ভেতর থেকে বের করে হাতে ধরি। তারে বলি, তুই কিতা চাস?
কুড়ায় বলে, আইজ আফনার খুব ফূর্তির দিন। আইজ আফনের মনের অবস্থা ভালা। আফনে নতুন বিবি ফাইবা, লগে পাঁচ লাখ কিয়ারোর জমিদারী।
– তুই জানস খেমনে?
– আমি হখলতা জানি।
– আর কিতা জানস?
– আফনার এমন এখ আওলাদ অইবো, যে আওলাদ আফনার নাম ভুলাইব।
– মানে ? নাম ভুলাইতো কিতা ? আমি যে সয় সম্পত্তি করি যাইয়ার তার এক কুনাউত তারা করতে ফারতো নায়।
– কিন্তু হে যা কামাইবো ইতার দাম জমিনো দামো থাকি বেশি।
– আর?
– হেই আওলাদের লাগি আফনার নাম বাচি থাকবো। আফনার জমিদারির কুন্তা লাগি নায়।
– আর আমি এমনি বাচতাম নায়? ওতো জমি, ওতো সম্পদ, ইতা আমার নাম নিতো নায় নি?
কুড়া পাখী কথা বলে না। সে চি চি চি শব্দ করে চারদিকে ঘুরতে থাকে। দেখে মনে হয় তার মনেও অনেক আনন্দ।
কুড়া বলে, যে নাই হে নাই, যে বাঁচে হে নাচে। বলেই আবার হি হি করে চারদিকে ঘুরতে থাকে। আমি বুঝতে পারি না কী এমন অস্থিরতা পেয়েছে যে আমার সবচেয়ে প্রিয় কুড়া পাখিটা আজ এমন করে কথা বলছে। আমি তাকে বলি, আজ তুই কিতা চাস কও?
সে বলে- তুমি যেমন নিজের মানুষ পাইবায়, আমিও আমার বন্ধুর লগে মিলিত অইতাম চাই। আমারে ছাড়ি দেও।
আমি হাত উঁচু করে কুড়া পাখীটারে ছেড়ে দেই। সে আমার মাথার উপর চারপাশ কয়েকটা চক্কর দিয়ে আমার ঘরের টিনের চালের উপর গিয়ে আমার দিকে মুখ করে বসে থাকলো।
আমি ইশারায় বলি , তুই চলে যা।
পাখিটা উড়ে চলে গেলো।
তার খানিক পর উবেদুর এসে আমার কাছে দাঁড়ায়। এই ছেলেটাই তখন আমার ভরসা। বয়স তার বাইশ-তেইশ। আমার সবকিছু সে-ই দেখে। একমাত্র পুত্র আমার। আমার বয়স ষাট এর কাছাকাছি তখন। আর কতদিনই বা আছি। আমার পর সব জমিদারী সে একাই দেখেবে। আমার সাথে তার খুব ভাব। আমরা বাপ-বেটা একসাথে ঘোড়া দৌড়াই, কুড়া শিকার করি। কিন্তু আজ তার কী হয়েছে জানি না, বিকাল থেকেই তার খুব মন খারাপ। গম্ভীর হয়ে আছে। সবাইকে নিয়ে যখন আমি ঘোড় দৌড়ে গেলাম, সে গেলো না। পুকুর পাড়ে বসে থাকলো।
সন্ধ্যার পর আমি লণ্ঠন জ্বালিয়ে আমার ঘরে শুয়ে আছি। তার মা নাফিজা, মানে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী, যার সাথে আমি এই বিশ্বনাথের রামপাশায় থাকি সে আমার জন্য শুপারী কেটে নিয়ে এসেছে। আজ তারও দেখি মন খারাপ। বুঝলাম, সবাই জেনে গেছে যে আমি আবার সাদী করতে যাচ্ছি।
আমি নাফিজাকে বললাম- তুমিতো রামপাশা আছো, রামপাশাত তুমি তাখবায়। আমার আরোখ বৌ নুরজাহান আছে, হে আছে তার বাফর বাড়ি, সিলেটর কুয়ার পার। এখন যেইন আইতা, তাইন থাকবা সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী, তাইনও কুনোদিন তুমার গেছে আইতো নায়। ডরাইও না, তুমার খান্দাত হতিন বওয়াইতাম নায়।
নাফিজা কোনো কথা বলেন না। তিনি পানের বাটা রেখে চলে যান। তার পেছন পেছন উবেদুর এসেছিল। সে আর যায় না, সে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমি বলি- বাজান, তুমার কুনো সমইস্যা?
ছেলেটা বেয়াদব আমার। মুখের উপর বলে বসে, বুড়া বয়সো তুমার আবার বিয়া খরার দরখার অইলো খেনে? যেতা সয়-সম্পত্তি আমি ফালিয়ার, দুইদিন বাদে সুনামগঞ্জি ফুয়া এগু আইয়া আমার ভাগিদার অইবো। তুমি তো আর তাখতায় নায়, হখল জামেলা আমা লাগি তইয়া যাইবায়।
আমি অনেকক্ষণ কথা বলি না। হুকাটা টেনে আনি। নিজেই চিলিম ধরাই। তারপর টানতে টানতে গিয়ে তাকে বলি- বাজান, ই বুজ আমারও আছে। ই বুড়াবেটিরে আমি বিয়া খরিয়ার তুমার খতা চিন্তা খরি। ই বেটির বয়স এখন চল্লিশোর কাছাকাছি। ই বেটির ঘরো আমার কুনো হুরতা মুরুতা অইতা নায়। বেটিরে বিয়া খরমু, তার সম্পত্তি ফাইমু। আর আমার সম্পত্তি ওয়া মানিতো তুমার সম্পত্তি ওয়া। আইজ বাদে খাইল আমি মরি গেলে ইতা হখলতা তো তোর বেটা।
উবেদ আমার যুক্তি মেনে নিল। সে কিছু না বলে চলে গেলো আর আমি ধুমধাম করে বিয়া করলাম হুরমতকে। চলে এলাম লক্ষণশ্রী। আমি থাকি লক্ষণশ্রী আর জমিদারী দেখি রামপাশা আর লক্ষণশ্রীতে।
লক্ষণশ্রী থেকে রামপাশা প্রায় ৩০ মাইল পথ। নৌকা করেই আসতে হয় বেশিরভাগ পথ। রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় না। মাঝখানে ৫ বার নদী পড়ে। নদীতে খেওয়া থাকে না। পালকিতে গেলে দুই দিনের পথ। নৌকায় গেলে ফজরে রওয়ানা দিলে আসরের সময় পৌছা যায়। রামাপাশার জমিদারী পুরাটাই উবেদুরের উপর ছেড়ে দেয়া। আমি মাঝে মাঝে যাই। আমার মনোযোগ লক্ষণশ্রীতেই বেশি। এখানে জমির পরিমান বেশি, আর ঝামেলাও বেশি। আশপাশে বেশিরভাগ হিন্দু পরিবার। অন্য পরগণার হিন্দু জমিদারেরা ওত পেতে থাকে, কখন কীভাবে কিছু জমি নিয়ে নেয়া যায় কী না। কালেক্টর অফিস থেকে আমার জমিদারের ব্যাপার চিঠি আসে। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী পরগণার বিভিন্ন গ্রামের দখলদার হিসাবে চিঠির উপর লেখা হয় নাম- হুরমত জাহান বেগম, পতি দেওয়ান আলীরজা। আমি এতেই খুশি।
কিন্তু আমার এই খুশী খুব বেশিদিন স্থায়ী হলো না। পোলা একটা জন্ম দিলো হুরমত। আমি নাম রাখলাম অহিদুর। বড় ভাই অবেদুরের সাথে মিলিয়ে। ওবেদুর রেজার ভাই অহিদুর রেজা।
কিন্তু বেশিদিন তার এই নাম রাখা গেলো না। সিলেট শহরের আদালতে এক নাজির ছিলেন। খুবই আল্লাহওয়ালা লোক, আমার দোস্ত মানুষ। তিনি নাম পাল্টাই রাখলেন হাছন রেজায়। মা তারে হাছন হাছন বলেই ডাকে । এই ছেলে তার মার কাছে সাত রাজার ধন। এরে পেয়ে হুরমত তার আগের চার বাচ্চার কষ্ট ভুলে গেলো। সে এখন আমাকেও পুছে না। হাছন যদি এমন বলতো, আম্মাজান, তুমি সুরমা গাঙ হিছাইয়া হুকনা খরি দাও , হুরমত হয়েতো সব লোক লাগিয়ে সুরমা নদী সেচতে শুরু করে দিত।
আমি তার মায়ের উপর কথা বলি না। পোলা বেয়াড়া । যা বলে তাই করে। তার কথায় তার মা উঠে আর বসে। আমি তার মাকে খুশী রাখার জন্য চুপ করে থাকি। বার তের বছর বয়েসে সে ঘোড়া চালাতে শিখে ফেলে। তার অসংখ্য বন্ধু। আমি বেশিরভাগ সময় রামপাশায় থাকি। লক্ষণশ্রীতে সে থাকে তার মায়ের সাথে, যেন সে নিজেই রাজা, নিজেই জমিদার। গ্রামের বুরুব্বিরা পর্যন্ত তার কথায় উঠে বসে। বড় বড় ছেলেরা তার বন্ধু। এদের সাথে মিশতে মিশতে বয়েসের আগেই সে পাকনা হয়ে ওঠে। তারা দলবেঁধে গুড্ডি উড়ায়। নদীতে সাতার কাটে। বন্ধুদের সবাই তার পিছে পিছে দৌড়ায়। মাঝে মাঝে তার কথার বরখেলাপ হলে কাওকে মেরে আসে। নানাজন নানা রকম নালিশ নিয়ে আসে তার মায়ের কাছে। বেশি বেশি লাগতো সে সুন্দরী যুবতী মেয়েদের সাথে। গাংপারের মেয়েরা গোসল করতে নামলে নাকি সে তাদের কাপড়-চোপড় নিয়ে আসে। আমি যখন সুনামগঞ্জে গিয়ে এসব শুনি, আমি তাদের বলি, আমার কাছে না, তোমরা তার মার কাছে নালিশ জানাও।
তার মা চুপ করে থাকেন। মার কাছে কেউ নালিশ নিয়ে গেলে মা নিজে ছেলেকে শাসন না করে নিজেই মাফ চায় হাছনের পক্ষে আর নালিশকারিদের হাতে তুলে দে বখশিস। বখশিসের বিনিময়ে ছেলে মাফ পেয়ে যায়।
হাছনের যখন পনের-ষোল বয়স তখন টের পেলাম, জমিজমার হিসাব কিতাব নিয়ে উবেদুরের বড় চিন্তা। এর মধ্যে তার বিয়ে হয়েছে দুইটা। প্রথম বৌ বাচ্চা জন্ম দেয়ার সময় মারা গেলো । কিন্তু বাচ্চাটা বেঁচে গেলো। তার নাম রাখা হলো আবুল হুছেন।
হুছেনের বয়স যখন ৬ তখন তার ঘরে সৎমা আসে। উবেদকে আবার বিয়ে দেই সাজিদার সাথে। সাজিদার ঘরে একটা ছেলে হয়, আজিজুর। এই নিয়ে রামপাশায় আমাদের সংসার। দুই নাতি আর জমিদারি। আমার দিন কাটে এভাবে।
ওদিকে সিলেটে আমার আরো দুই ছেলে-মেয়ে ছইফা আর মুজফ্ফর। ছইফার মা মরে গেলে তার ছোট বোন জরিনারে ঘরে আনি। তারা থাকে সিলেটের কুয়ারপার।
সুনামগঞ্জে আমির বক্সের জমিজিরাত সব হুরমতের নামে, কিন্তু আমিই চালাই। এগুলোর কিছু উবেদ পাবে কি না, এমন কিছু আমাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করে। এই নিয়ে তার মহা চিন্তা।
আমি একদিন উকিল ডেকে সব জমি ভাগাভাগি করে দিলাম। আমার তখন বয়স হয়েছে। সত্তুরের উপর বয়স। জমিদারী আর ভালো লাগে না। আমি শান্তি চাই। আমার জমিদারি সিলেট, রামপাশা, লক্ষণশ্রী। আমার সংসারও সিলেট-রামপাশা-লক্ষণশ্রী। দুইদিন পরে মারা গেলে সতভাই-বোনের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি হবে। আমি আগেই এদের একটা ব্যবস্থা করে যেতে চাই। আমি চাই, যার যতটুকু ন্যায্য পাওনা সে যেন ততটুকুর চেয়ে কম না পায়। আবার একজনকে বেশি দিতে গেলে আরেকজনের ভাগে কম যাতে না পড়ে।
প্রথমেই আমি লক্ষণশ্রীর পুরো জমি হাছনের নামে লিখে দেই। এই জমি তার মার কাছ থেকে এসেছে, তার সৎ পিতার সম্পত্তি, সুতরাং হাছনের সৎ ভাইবোন তা পাবে কেন? সেটা পাবে হাছন।
আর সিলেটের সম্পত্তি যেহেতু আমার নিজের করা না, আমার অপর দুই বৌদের, তাই সেই সম্পত্তিতেও আমি হাত দেই না। এটা আমার সেই তরফের পুত্র কন্যা ছহিফা আর মুজাফ্ফরের নামেই থাকে। রামপাশার সম্পত্তি আমি করেছি, আমি এটা আমার দুই পুত্র উবেদ আর হাছনকে ভাগ করে লিখে দেই। রামপাশার সম্পত্তি থেকে হাছনকে তো আমি বাদ দিতে পারি না। কারন হুরমতের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি খাজনা দিতে না পারলে আমার জমিদারি টেকানো যেতো না। ধারদেনা হয়ে গিয়েছিল অনেক। হুরমতের জমিদারি থেকে অনেক কিছু নিয়ে আমি রামপাশা সামলাই। সে কারনে এ জায়গার ভাগে হাছনেরও ভাগ থাকবে এটা আমি চাই।
আমি মুহুরী ডেকে আনি। এই মোতাবেক কাগজপত্র তৈরি করে আমি উবেদকে ডাকি। মুহুরী দলিলের লেখা পড়ে শোনালে দেখি রাগে উবেদের চোখ লাল হয়ে গেছে। তার তখন সাইত্রিশ বা আটত্রিশ বছর বয়স। সে আমাকে বলে, তুমি ঘাটে ঘাটে বিয়া খরবায় আর বছর বছর বাইচ্চা বিয়াইবায়। আর খানোর কিগু আইয়া আমার লগে শরিকদারী খরবো ইকান আমি আগেউ বুঝছিলাম। তখন আমার খতা তুমি হুনলায় না, বুড়া বেটিরে বিয়া খরি আমার লগে শরিকদার আনি বওয়াইছে। এখন তারে তুমি আমার সম্পত্তির ভাগিদার বানাইতায়, আমি তুমার ই খাগজফত্র মানি না।
এই কথা বলে মুহুরীর হাত থেকে দলিলখানা নিয়ে আমাদের সবার সামনে যে ছিঁড়ে ফেলে।
আমার খুব মনোকষ্ট হয়। আমি তারে বলি, তোর যেনো এমন মরণ হয় যে তোর কোন আওলাদও যেনো আমার সম্পদ ভোগ করতে না পারে।
আসলে রামাপাশায় আমার তখন খেলার সাথী আমার দুই নাতি, উবেদুরের দুই ছেলে। আমি যতটুকু উবেদুরের জন্য দিয়ে গিয়েছিলাম তা তার দুই পুত্র দুই-তিন পুরুষ ধরে বসে বসে খেয়ে শেষ করতে পারতো না। কিন্তু অতিরিক্ত সম্পদে ছিলো তার লোভ। এই লোভের কারণে আমি তাকে সেটা বলি।
পুত্রকে অভিশাপ দেয়ার পরপরই আমি টের পেলাম, কাজটা আমি ঠিক করি নাই। আমার চোখের কোন জুড়ে পানি জমে যাচ্ছে। কী করি এখন ? আল্লাহ কি এটা কবুল করে ফেললেন?
আমি খুব অস্থির হয়ে যাই। কী করে আমার কথা সরাই। আমি এশার নামাজ শেষে চলে যাই কাপনা নদীতে। বাড়ি থেকে আধা মাইল পশ্চিমে এই নদী । তখন ঘন অমাবশ্যা। শীতের রাত। কুয়াশা পড়েছে অনেক। সামনে পেছনে কিছুই দেখা যায় না। আমি নিজেকে কষ্ট দেয়ার জন্য গায়ের চাদর খুলি, পাঞ্জাবী খুলি, গেঞ্জি খুলি। গায়ের ধূতি পরে আস্তে আস্তে নদীতে নামি। আমার প্রচণ্ড শীত লাগে। সারা শরীর জুড়ে কাঁপুনি এসে যায় । তাও আমি নামি। নামতে নামতে বুকপানি পর্যন্ত গিয়ে পশ্চিম দিকে মুখ করে আল্লাহ্র কাছে ফরিয়াদ করলাম, হে আল্লাহ, রাগের মাথায় আমার এই অবুঝ শিশুটিকে আমি অভিশাপ দিয়েছি, তুমি এই বদদোয়াটা কোনোভাবেই কবুল করিও না। আমার ছেলে এমনিতে খুব ভালো, মাঝে মাঝে মাথা গরম করে ফেলে। হে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন, আমার পুত্র আমার সঙ্গে যে বেয়াদবি করেছিল, আমি তা মাফ করে দিলাম, তুমিও মাফ করে দিও।
কিন্তু আল্লাহ আমার কোন কথা রাখলেন আর কোনটা না, আমি বুঝতে পারিনি। এর কয়েকদিন পর উবেদ গেলো হাতি নিয়ে শিকারে। একসময় একটা বিষধর সাপ তাকে কামড় দেয়। আমি পুরো রাজ্য তছনছ করে বড় ওঝা আনালাম, কবিরাজ আনালাম, বেদী আনালাম। কাজ হলো না। কয়েকদিন পর সে দুনিয়া আন্ধাইর করে চলে গেলো। তখন মনে হলো, আমার কিয়ামত এসে গেছে। মাটির জমিদারী বাড়বার জন্য হা-হুতাশ করতে করতে এক সময় তার ঠিকানা হলো মাত্র সাড়ে তিন হাতের ভেতর।
তবে কিসের জন্য এই দুনিয়া? আওলাদের জন্য? আওলাদ কি তার বাপদাদার কথা মনে রাখে? নাকি আমি রাখি বাবু খাঁর নাম? আমার আওলাদ কি আমাকে মনে রাখবে? আমার সবকিছু আমার আওলাদের জন্য। এখন আছে এক হাছন। ও ছাড়া দুনিয়াতে আমার তো আর কিছু নাই। এই দুনিয়ারে আমিও আর চাই না।
সাত
চারুর সাথে বসে দুই চাচা যখন গল্পে মশগুল, রামিজ রাজাকে নিয়ে তখন আরেকদল ফূর্তিতে মজে আছে। এর মধ্যে ফেসবুকে দু তিনটা সেলফি পোস্ট করে দিয়েছে রত্না। হাছন রাজার গেট আপে এমন ভাব যে এটা যে অন্য কেউ তা বোঝা যাচ্ছে না। রামিজ রাজার গলা জড়িয়ে ছবি তুলে পোস্ট দিয়েছে, লিখেছে উইথ মাই পেয়ারা হাছন রাজা। চেক-ইন দিয়েছে, কাংলার হাওড় ইন সুনামগঞ্জ।
কিছুক্ষণ পর পর রত্না ফেসবুক দেখে। দশ মিনিটে লাইক পড়েছে ১৬২ টি। এতো লাইক তার ছবিতে পড়েনা। শেয়ার করেছে ২১ জন। শেয়ারে ক্লিক করে বুঝতে পারে, বেশিরভাগই তাকে ট্রল করছে। হাছন রাজা নিয়ে পাগলামি বন্ধ করতে অনুরোধ করেছে কেউ কেউ। কেউ লিখেছে হি ইজ জাস্ট এ মডারেট এক্টর, নট হাছন। আরেকজন ফটো কমেন্টে রামিজ রাজুর সাথে তার ছবি দিয়ে লিখেছে, আজ সন্ধ্যায় শিল্পকলায় আমার সাথে রামিজ।
রত্না খুব মজা পায় ছবি আর কমেন্টগুলো পড়ে। এখন তার ফেসবুকিং এর সময় নয়। সে সেলফোন পুরাপুরি বন্ধ করে দেয়।
সেলফোন এয়ারপ্লেন মোড-এ নিয়ে শুধু ভয়েস রেকর্ডার অন করে রাখে শিফা। ডিটিভির হেনা ভাবলো, একটা আপডেট এখন দিয়ে দিতে পারে। রাত মাত্র সাড়ে নয়টা। দশটার খবরে ধরানো যায় কী-না এটা জানার জন্য শিফ্ট ইন চার্জ বাতেন কে ফোন করে- হ্যালো, বাতেন ভাই। আর বইলেন না। বিষয়টা আসলে ভুয়া। হাছন ফাছন নাই। তবে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস পাইছি। হাছনজানের রাজা ফিল্মের পুরা টিমটা এখন আমাদের সঙ্গে।….হ্যাঁ, হ্যাঁ কাল আসছি, তাইলে লাইভ বাদ। আমরা রেকর্ড করে আনি।লোকাল করেসপন্ডেন্ট কিছু স্টক ফুটেজও দেবে। কাল বিকেলে ঢাকা পৌঁছে বানিয়ে দেবো। ওকে, না, না কোন সমস্যা নাই। আপনি থাকলে অনেক মজা হতো। মিস ইউ টু।
হেনা ক্যামেরাপারসন ফরিদকে ডাকে।
ফরিদ ভাই, আপনি জাস্ট ধরে রাখেন। মাইকের কানেকশনটা দিয়ে রাখেন। আমি কথা বলছি। ক্যামেরা নাড়ানোর দরকার নাই।
ফরিদ ক্যামেরার সাথে লাগানো ব্যাটারী সানগান জ্বালায়।
সাথে সাথে রাজার আপত্তি। না না। বাতি জ্বালবে না। আসমানের দিকে তাকিয়ে বলে, ঐ বাতি থাকতে এই বাতির দরকার নাই। আপনি বাতি নেভান।
ফরিদ বাতি নিভিয়ে ফেলে।
বাকীরা সবাই বসে আছে বজরার ছাদের এক কোনায়। তাদের কারো কোন আগ্রহ নাই এদের আড্ডায়। মাঝখানে রামিজকে রেখে প্রায় গোল হয়ে বসে আছে আকাশ, শিখা, রত্না আর হেনা। একটু দূরে ট্রাইপয়েডে ক্যামেরা বসিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফরিদ।
আলাপ শুরু করে আকাশ।
– রামিজ ভাই
এটুকু বলতেই রামিজ বেশ গম্ভীর স্বরে বলে বসেন, আমাকে রামিজ রামিজ করবা না। বুঝছো ?
– তাইলে কি বলবো ?
– আমরা সবাই কস্টিউমে আছি। যতক্ষণ কস্টিউম পরা আছি আমরা কেউ আর কেউ নাই। আমি হাছন। তোমাদের হাছন রাজা।
– বাহ, বাহ ! বেশতো। ঠিক আছে হাছন দা, শুরু করুন।
– হাছন দা ? আমি আবার হাছন দা হলাম কেমনে ? আমি কি হিন্দু ?
– তাইলে কি ? হাছন ভাই ?
– যা ইচ্ছা বলো। ভাই, চাচা, কাকা, দাদা, নানা, তোমাদের যেটাতে ফূর্তি লাগে।
– ঠিক আছে ওস্তাদ। যখন যেটা মনে হয়, ডাকবো আপনারে।
রত্না আস্তে করে বলে- বস, আমি কিন্তু ওস্তাদ ফস্তাদে নাই। আমি হাছনই ডাকবো। হাছন মিনস্ বিউটিফুল। ইউ আর অলওয়েজ সো।
হাসে সবাই।
এদের মধ্যে আকাশই পাকনা কিছিমের ছেলে। সে প্রথম শুরু করে- আচ্ছা আমরা আগে পরিচিত হই, আমার নাম আকাশ বালক।
– কী ?
– আকাশ বালক। এটা আমার আসল নাম না। শুনে অবাক হচ্ছেন? অবাকের কিছু নাই। নাম একটা সংকেত মাত্র। যেটা দিয়ে ডাক দিলে আমি বুঝতে পারি যে আমাকে ডাকা হচ্ছে, ব্যাস। আমার নিজের দেয়া নাম। সার্টিফিকেটে আমার নাম আছে মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান । মোহাম্মদ আবার ম-ওকার বিসর্গ দিয়ে লেখা। সাদিকুর বানান দন্তস দিয়ে, আপনার মতো ছ দিয়ে নয়। বাট ফেসবুকে আমার অরিজিনাল আইডি হাইড করা। এখানে যারা আছে, যেটা আছে, সেটা এই আকাশ বালকের। এই মুহূর্তে আপনাদের সামনে যিনি আছেন, তিনিই আকাশ বালক। এবং এই আমি এখানকার সবাইকে নিয়ে এসেছি ফেসবুকের একটা স্টাটাস দিয়ে। সেখানে লেখা ছিলো মহাপূর্ণিমার রাতে হাছনবিহার হবে সুনামগঞ্জে। হাছন রাজা স্বয়ং হাজির হবেন কাংলার হাওড়ে। এই কথা লিখে সবাইকে আমি ডেকে নিয়ে এসেছি। আপনার কী অবস্থা ?
– নাম কি তুমি একলাই বদলাইতে পারো ? আমরাও পারি। আমার জন্মের পর আমার নাম ছিলো অহিদুর রেজা। আমার এক ভাই ছিলেন, তার নাম উবেদুর রেজা। উবেদুরের সাথে মিল করে রাখা অহিদুর। কিন্তু আমার আম্মাজানের এই নাম পছন্দ ছিলো না। তিনি বললেন হাছন হবে আমার নাম। সিলেটের আদালতে কাজ করতেন এক নাজির। বাবার বন্ধু। তার নাম ছিলো আব্দুল্লাহ। তিনি কোর্টে আমার নাম বদলাই দিলেন। বললেন নাম হবে হাছন। আসলে হাছন বলে কোন শব্দ নাই। শব্দটা আরবি। আমাদের নবীজির এক নাতির নাম ছিল হাসান, আরেকজন হোসেন। কিন্তু আমাদের সিলেটিরা ছ এর উচ্চারনে ছ লিখে আর আকার উকার কমায়। যার নাম হাসান, তাকে ডাকে হাসন, যিনি হোসেন, তিনি হয়ে যান হুসেন। আমাদের নাগরীলীপিতেও স নাই, ছ আছে। আমার নাম লিখা হতো ছ দিয়ে হাছন, আমার বইনের নাম ছ দিয়ে ছইফা। এখন শুনি বুদ্ধিজীবিরা নাকি আমার নাম হাসন করে দিসে, ছইফারে সহিফা। নামের বানান বদলাইলো, আকিকা করসে নাকি ? করলে তো তোমরা দাওয়াত পাইতা, পাইতা না ?
– আপনার বাড়িতে যে যাদুঘর আছে, সেখানে আপনার ‘হাছন-উদাস’ বইয়ের কভার দেখেছি। সেটাও ‘ছ’ দিয়ে। বইয়ের নিচে আপনার নাম আছে লেখা ‘দেওয়ান হাছনরজা চৌধুরী’। সবই ‘ছ’ দিয়ে, অথচ আপনার বাড়ির নাম ‘হাসন রাজার বাড়ি, যাদুঘরের নাম ‘হাসন রাজার যাদুঘর’। এতো বড় বেয়াদবী আপনার নামের সাথে!
হাছন কথা বলেন না। তিনি আকাশ বালকের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এক সময় বলেন, কোন বুদ্ধিজীবী নাকি বদলাই দিসে।
– সে তো আপনার পেয়ারা নাতি । ঠিক কি না বলেন ।
হাছন জবাব দেয় না। মিটি মিটি হাসে । আকাশ বলে, ওস্তাদ আমরা আপনার লগে আছি। বুদ্ধিজীবির লগে নাই, আপনার পরিবারের লগেও নাই, যিনি আপনার নামের বানান বদলান। কাল সারাদিন আপনার বাড়ি, মিউজিয়াম, কবর এসব দেখলাম। হাসনই বেশি, হাছন নাই। এমনকি আপনার কবরেও আপনার নাম শুদ্ধ করে লেখা হাসন। কিন্তু আপনি ছাড়াও বাংলাদেশ বহু বিজ্ঞ লোকের নাম হাছান, হাছন আছে। কপাল আপনার, কী আর করবেন ? তবে মজার জিনিস দেখলাম দুইটা। এক- আপনার সেই সাহেব বাড়ি, যেটা হাছন রাজার বাড়ি, সেখানের ঘরগুলোতে মিউনিসিপ্যালিটি যে নাম লিখেছে তা ছ- দিয়ে, ‘হাছন রাজার বাড়ি’ লেখা। আর আরেকটা দেখলাম, শিল্পকলা একাডেমীতে সবচেয়ে বড় দালান যেটা মিলনায়তন, সেটা অস্তাদ তোমার নামে আছে, ছ দিয়ে লেখা- হাছন রাজা মিলনায়তন।
চারু নেট ব্রাউজিং করছে। অনেকটুকু খুব মন দিয়ে পড়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই বলে- কিন্তু আমারও খটকা আরো আছে বস। আপনি রজা, না রেজা, না রাজা ? কয়েক জায়গায় কয়েক রকম দেখছি। দেওয়ান ছিলেন আপনি জানি, রাজা কোন দেশের ? নাকি সুন্দরীদের মনের রাজা ?
ঠা ঠা করে হেসে ওঠেন হাছন। হাসি থামতে থামতে বলেন, সুন্দরীদের মনের রাজাতো ছিলামই, আর রাজার বংশও ছিলো, সে অনেক আগে, যখন আমরা হিন্দু ছিলাম। সেটার সাথে এই জমিদারির সম্পর্ক নাই। কিন্তু এই আমলের রাজা ছিলাম আমি নামের জোরে, গায়ের জোরে।
– কেমনে ?
– পূর্ব পুরুষেরা অনেকেই এই অঞ্চলের কোন সম্প্রদায়ের রাজা ছিলেন। তাঁরা হিন্দু ছিলেন। তাদের নামের আগে রাজা লেখা হতো, যেমন রাজা বীরেন্দ্র সিংহদেব। রাজার পুত্র প্রথমে রাজকুমার লিখতেন, পরে তিনি রাজা হতেন।
– তাইলে আপনি ?
– আমার নামের পরে রাজা মানে এটা রাজা-বাদশাহর রাজা নয়। এটা আমি করে নেই, আমার শান শওকত বুঝানোর জন্য। রেজা বা আঞ্চলিক উচ্চারনে রজা ছিল আমার বাপের নামের সাথে। আমাদের দুই ভাইর নামেও তা ছিলো। সেখান থেকে আমি এ কার সরিয়ে আকার করে দেই, রেজা থেকে রাজা। আমি তো জমিদার ছিলাম, চৌধুরী ছিলাম। জমিদার, চৌধুরী অনেকেই ছিলো। রাজা কেউ ছিলো না।
– আপনি আপনার রাজা ?
– হ। যেমন কেউ শাহ লিখে বাদশা বুঝায়, সম্রাট বুঝায়, আমিও হাছন রাজা। আমার পরের পুরুষেরাও কেউ রাজা ছিলো না। আমাদের হিন্দু রাজাদের রাজাগীরি বহু আগে শেষ হয়ে গেছে। তারপরও তারা আমার মতো রাজা রাজা লিখে বোঝায় যে তারা আমার বংশ। এটা খুব বড় কোন বিষয় না। বরং এটা তো আমার জন্য আনন্দের। এক সময় পাগল ছাগল বলে যারা আমারে অবজ্ঞা করেছিল, আজ তাদের বংশধরেরা আমার নাম তাদের নামের সাথে রেখে গর্ববোধ করছে, সেটা কম কথা নয়। রেজা-রাজার আগে আমরা ছিলাম খাঁ। আমার দাদার নাম আনোয়ার খান। তার বাবার নাম ছিলো বাবু খান। বাবু খান তার নাম ছিলো না, নাম ছিলো রাজা দেওয়ান বীরেন্দ্র রাম সিংহদেব।
– তিনিই বাবু খান ?
– আগের দিনের খান্দানী হিন্দুদের বাবু বলা হতো। বীরেন্দ্র সিংহ দেব এর বাবা ছিলেন বানারসী রাম। এই বানারসী রাম দেখলেন, তার ছেলে মুসলমানদের সাথে ওঠাবসা করছে। মুসলমান ধর্মের অনেক প্রশংসা করে। বড় বড় ওলেমাদের সাথে কাটায়। তিনি আশংকা করেছিলেন, ছেলেটা হিন্দু ধর্ম ছেড়েও দিতে পারে। তিনি যখন বুঝতে পারলেন, লাভ নাই, ছেলে মুসলমান হবেই, তখন সিলেটের ফৌজদারের কাছে আর্জি করেন ছেলেকে যেনো কোন সম্ভ্রান্ত ঘরে বিয়ে দেয়া হয়। কথা রেখেছিলেন সিলেটের মৌলভী ফৌজদার। বাবু খানের সাথে এক জমিদার কন্যার সঙ্গে বিয়ে দেয়া হল। তিনি আরব থেকে আসা কোরেশ বংশের লোক। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে তাদের জমিদারি আছে। সুন্দরী জমিদার কন্যার সঙ্গে যুক্ত হয় অর্ধেক রাজত্ব। কোড়িয়া পরগণার রামপাশার মৌজার বিশাল জমির বন্দোবস্ত দেয়া হয়ে যায় নও মুসলিম বাবু খানকে। তার নাম থেকে সিংহদেব উপাধী খসে পড়ে। সিংহদেব উপাধী ছিলো খাসিয়া সম্প্রদায়ের। সেটা বারানসী রামের উত্তর পুরুষদের কাছে রয়ে যায়। বাবু খানের দুই পুত্রের জন্ম হলে তাদের একজনের নাম হয় আনোয়ার খান, অপরজন কিশোয়ার খান। এই আনোয়ার খানই ছিলেন আমার দাদা।
– তার মানে খাসিয়া-আরব মিলে আপনাদের রক্ত ?
– রাজাদের কেউ আমাদের বংশে ছিলো, তবে তাদের রক্ত পুরোপুরি আসেনি। এর মধ্যে আরবের কোরেশ বংশীয় রক্ত এসে যুক্ত হয় খানের আমল থেকে । খান যদিও কোন নাম না, এক ধরনের উপাধী, আগে মঙ্গোলীর সেনাপতিদের খান নামে ঢাকা হতো- অনেকটা সেনাপতি, সেনাবাহিনী প্রধান টাইপের উপাধি ছিল সেটা। বোঝেতো, নাম একটা নামে কাউকে ডাকলেই হয়, যেটা দিয়ে কাউকে ডাক দিলে পাওয়া যায়। অচেনা মানুষের কাছে কাউরে তাঁর নাম দিয়া প্রথমে চেনা যায়। তার পেশাটা জানা যায়। আগের দিনে তো মানুষের নিজের পরিচয় তেমন থাকতো না। বংশ পরম্পরায় মুচির ছেলে মুচি, দর্জির ছেলে দর্জি, মাইমালের ছেলে মাইমাল হইতো। তখন তার পেশার পদবীটাও একই থাকতো। কিন্তু পাবলিকের কাছে নিজেকে আলাদা আর বড় কিছু বোঝানোর জন্য নানা রকমের নাম নিতে হয়। এখন বাপের পেশায় পুত্র থাকে না, কন্যা থাকে না। আগের দিনে কন্যাদেরতো আর পেশাও ছিলো না। কিলিয়ার ?
– হ অস্তাত।
– তোমাদের কার কী নাম ?
– আমি মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান, অথবা আকাশ বালক
– আমি হেনা জোবায়েদা, আমাকে হেনা নামেই ডাকে সবাই
– আমি ফরিদ আহমেদ। ফরিদ
– আমি রত্না চক্রবর্তী।
– আমি শেফালি হাসান। আমাকে শেফা, শিফু এসব নামেও ডাকা হয়। আর চারু আছে ঐ নায়ে, দুইজনের সাথে গল্প করছে। ও চারুলতা চন্দ্রিকা নামে কবিতা লেখে, আসল নাম সিতারা পারভীন।
– এই দেখো তোমাদের যে নামই হোক, সেটা তোমার চেয়ে বড় না। তোমারে চিনাবে তোমার নাম। আর আমাদের নাম চেনায় আমাদের নামের শেষের পদবী। আমাদের আমলের যেকোনো জনের চেয়ে তোমরা এখন অনেক বড়। চারুর কবিতা যদি ভালো হয় সে চারুলতা নামে লিখলো না পারমিতা নামে লিখলে সেটা বড় হবে না। তার নামকে টানবে তার কাম। ঠিক না?
– কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তিন রকমের রেজা-রজা-রাজা হলো কেন? এটাকি প্রিন্টিং মিস্টেক ?
– আমার হাছন উদাস যখন বেরোয়, ছিফারা, কায়দার আকারে, এমনকি বইয়ের শেষ পাতা থেকে উলটা দিকে কবিতা সাজিয়ে, সেটাতে আমার শিক্ষিত মুহুরীরা আরবী পুস্তকের কায়দাকে অনুসরন করেছিল। বাংলায় জ্ঞান আমার ভালো ছিলো না। কোনো মতে নাম দস্তখত করতে পারতাম, একটু একটু লিখতামও। বেশিরভাগ লেখাই আমার মুহুরীরা লিখে দিতো। ছাপাখানায় তারাই নিয়ে যেত। সেসব কারনে আমার নাম লিখেছিল দেওয়ান হাছনরজা চৌধুরী। অনেক দলীলে আমার আব্বাজানের নামও ছিল দেওয়ান আলীরজা চৌধুরী।
– আপনার মৃত্যুর পর আপনার বড় ছেলে হাছন-উদাস এর পরিবর্ধিত সংস্করণ যখন বের করলেন, প্রকাশক হিসেবে তাঁর নামও লিখলেন – দেওয়ান গণিউররজা চৌধুরী। এটা কেন ?
– আসলে ছিল রজা বা রেজাই। পরে আমি রাজা লিখি। সবাই রাজা হয়ে যাই। তুমি আসল ঘটনা না জানলে আমার নাম শুনেই মনে করতা আমি রাজা বাদশাহ টাইপের কেউ, এই আর কী! বিষয় হচ্ছে, আমার আব্বাজানের নাম ছিলো আলী রেজা। তিনিও দেওয়ান এবং চৌধুরী ছিলেন। আমার বড় ভাইর নাম ছিলো উবেদুর রেজা। বাবা আর বড় ভাই মারা যাবার পর জমিদারী যখন একলা আমার হাতে চলে যায়, তখন আর আমি হাছন রেজায় থাকি না। আমি হাছন রাজা, দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী। আর আমাদের নামের আগে দেওয়ান কেমনে যুক্ত হলো, জানো নাকি ?
– না, তো। দেওয়ান কি ? দেওয়ানী মামলার কথা জানি। জমিজিরাত নিয়া যেসব মামলা হয়, সেসব দেওয়ানী কি?
রত্না বলে- আমি জানি।
– কি ?
– যারা দিওয়ানা মাস্তানা থাকে, তাদেরকে দেওয়ান বলে।
হাছন চোখ গোল করে তাকান পাশের দিকে। মেয়েটা ফাজিল টাইপের। তিনি ধরে ফেলেছেন। কাছে ডাকেন তারে। সে আসে না।
বলে, আপনার মতলব ভালো না। চোখও ভালো না। এখন আপনার সেই সময় নাই। এখন বিপদ আছে, সাবধানে থাকুন। হাতে ধরে টান মারলেও যৌন নির্যাতন মামলায় ফেসে যাবেন। আপনার সেই ক্ষমতা, সেই ধন আর নাই যে, কোট কাছাড়ী, উকিল মোক্তার কিনে আপনি বেরিয়ে আসবেন।
হাছন তাকান আকাশের দিকে। কথা বলেন না। আকাশ বলে, আপনাদের দেওয়ানা হবার গল্প বলেন।
আমার দাদার দাদা রাজা বানারসী রাম সিংহদেব ছিলেন প্রথম দেওয়ান। বাংলার শেষ নবাবী শেষ হবার দু বছর আগে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর দু বছর পর সিরাজউদ্দৌলা মারা গিয়েছিলেন। জানো তো, সিরাজের ক্ষমতা হারানোর পর ধীরে ধীরে ইংরেজের হাতে এই পুরো ভারতবর্ষ চলে আসে। তখন আমাদের এই পূর্ব পুরুষেরা ইংরেজের কাছে জমির খাজনা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নেন। আমার দাদা আনোয়ার খান সিলেটের এক পরগনার খাজনা আদায়কারীর দায়ীত্ব দেয়া হয়। যারা খাজনা সংগ্রহ করতো তারা শতকরা পঁচিশ পার্সেন্ট কমিশন পেতো। এই টুয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট মানে চার আনা, ষোল আনার চার আনা, এক চতুর্থাংশধারীদেরকে চৌ-ধারী বা চৌধুরী বলা হতো। এই খাজনা আদায়ের কাজ বংশপরম্পরায় চলতো বলে বংশপরম্পরা জুড়ে সবাই নিজের নামের শেষে চৌধুরী লিখতেন। যিনি চৌধুরী, তার ছেলে চৌধুরী তার নাতী চৌধুরী, তার চৌদ্দ গোস্টি চৌধুরী। এ রকম, যিনি জমিদারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়ে তালুকের খাজনা আদায় করতেন, তিনি হতেন তালুকদার। আবার বড় পরগণার খাজনা আদায়ের বন্দোবস্ত যিনি করতেন তাকে দেওয়ান বলা হতো। ইংরেজ আমলের প্রথমে কয়েকজনকে চৌধুরী খেতাব দেয়া হলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা দশসনা বন্দোবস্তের পর এই খেতাব দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে যারা বছরে পাঁচশত টাকার বেশি খাজনা সরকারের তহবিলে জমা দিতে পারতেন তাদেরকে বলা হতো জমিদার। আর পঞ্চাশ টাকার বেশি যারা দিতেন তারা হতেন মিরাশদার। এর নিচে যারা খাজনা দিতেন, তারা তাপাদার, তালুকদার, এমন ছিলেন। সুতরাং যার অধীনে যত বেশি জমির লীজ নেয়া, সে ততো বেশি খাজনা নিতে পারে আর তার অংশ সরকারের তহবিলে দিতে পারে। যে যত বেশি দেবে, সে সরকারের ততো প্রিয়ভাজন। তার জন্য যত রকমের সম্মান, পদবী দেয়া যায়, বৃটিশ সরকার তা দিয়ে দিতো। কারণ এইসব সামন্ত প্রভুদের হাতে রাখতে পারলেই তারা রাজকোষাগার বড় করতে পারতো। আর তখন এক টাকারও অনেক মান। ৪ কৌড়িতে হতো সান্তা, ৪ গন্ডায় ১ পয়সা, ২০ পয়সায় ১ আনা, ১৬ আনায় ১ টাকা বা কাহন। এসব খাজনা জমা পড়তো সব বৃটিশ ডেপুটি কমিশনারের অফিসে। আমার জন্মের সময় ডেপুটি কমিশনার ছিলেন মিস্টার মজি।
আপনার পিতাজী নাকি গোস্মা করেছিলেন ইংরেজ কালেক্টরের কাছে? তিনি নাকি খালি চৌধুরীতে সন্তুষ্ট ছিলেন না ?
আলী রেজা আগে চৌধুরী লিখতেন। পরে বৃটিশ কালেক্টরের কাছে আর্জি জানালেন যে,অনেক চৌধুরীর চেয়ে তার বন্দোবস্তে জমির পরিমান অনেক বেশী। তাকে শুধু চৌধুরী বললে মানায় না, আর কিছু চান তিনি। তখন বলা হলো, ঠিক আছে, আপনি দেওয়ান এবং চৌধুরী দুইটাই। যদিও দুইটা শব্দের একই মানে এবং একই কাজ, তারপরেও ফুটানী মারার জন্য এমনটা তখন চাওয়াই হয়েছিল।
– আচ্ছা, এই দেওয়ান, চৌধুরী, এসবের স্ত্রীলিংগ নাই ? মহিলারা কেউ এই পদবী পেত না? – প্রশ্ন কওে রত্না ।
– মজার ব্যাপার, মহিলারা কেউ কিন্তু তখন এই উপাধী লিখতেন না। না আমার মা, কোন স্ত্রী বা কন্যা।
– কিন্তু এখন তো লিখছেন।
– সেসবে শেষ হয়েছে তো বহু আগে।
– এখন তবে দেওয়ান-চৌধুরী কেন?
– তোমার বাবা কি করেন ?
– আমার বাবা আর্কিটেক্ট।
– তিনি কি নামের সাথে এটা লিখেন?
– জ্বী
– তুমি কী লিখ তোমার নাম ?
– মোঃ সাইদুর রহমান
– কেন? আর্কিটেক্ট মোঃ সাইদুর রহমান কেন লিখ না?
– আমি ত আর আর্কিটেক্ট না।
– তাহলে যারা দেওয়ান লিখে তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করো, তারা কিসের দেওয়ানী করে, কার দেওয়ান তারা ?
– আচ্ছা, ওস্তাদ, একটা জিনিস কন তো দেখি। আপনার এই রাজাগিরির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদানটা কার?
হাছন কথা বলেন না। তিনি চুপ করে থাকেন । এক সময় পাশের একটা নৌকার পেছনের গলুই দেখিয়ে এক লোকের দিকে আঙ্গুল ইশারা করেন। বলেন- ওনার সাথে কথা বলো, সব খবর পাবা।
আট
চারু ভিড়বাট্টা দেখে আর হাছনের নৌকায় যায় না। সে ফেরত আসে ছইফার কাছে। এই কবির কাছ থেকে তার অনেক কিছু জানার আছে । পাশে এসে বসে। সাংবাদিকের মতো প্রশ্ন করে – দিদি আমরাতো আপনাকে কবি হিসেবে জানি। ১৮৫১ সালের আগে আর কোন বাঙালি মুসলমান মহিলা কি কবিতা লেখেন নাই ?
-সে আমি জানি না। কবিতা লেখা আমাদের পরিবারের চর্চা ছিলো। আমাদের বড় ভাই উবেদুর উর্দূ, আরবী, ফার্সী জানতেন। তিনিও বাংলা, উর্দূ, ফার্সীতে কবিতা লিখেছেন। আমাদের বাবাও কবিতা লিখতেন। দেখাদেখি আমিও লিখতাম। আমার বই ছিলো তিন খানা। বাংলায় দুইটা, উর্দূতে একটা। বাংলা কবিতার বইর নাম ছিলো ‘ছহিফা সঙ্গীত’ আর ‘ছাহেবানের জারি’। আর ‘ইয়াদগারে ছহিফা’ ছিলো আমার উর্দূ ভাষার কবিতার বই। আমি নাগরী জানতাম। কিছু ইংরেজিও। রাণী ভিক্টোরিয়াকে আমি একবার চিঠি লিখেছিলাম। চিঠির সঙ্গে সিলেটের একটা শীতল পাটিও পাঠিয়েছিলাম। রাণী আমার চিঠির জবাব দিয়েছিলেন।
– বাহ ! কিন্তু হাছনের সাথে আপনার সমস্যা কি ছিলো ?
– সমস্যা কিছু না। ওরে আমি খুব আদর করতাম। ছোটবেলা একসাথে খেলতাম। আমারে বুবুজান বুবুজান কইয়া ডাকতো। কিন্তু শেষ বয়সে এসে সম্পত্তির কারণে সে আমার কাছে অন্যরকম হয়ে যায়।
উনি না খুব দয়ালু ছিলো? সব দান খয়রাত করে দিয়ে গেছেন ?
সেটা শেষ সময়ে এসে। জমিদারির সময় জমিদাররা যেমন থাকে সে ও ছিলো সে রকম। জমিদারি রাখতে হলে লাঠিয়াল রাখতে হয়, প্রজারা খাজনা না দিলে তাদেরকে শাসন করতে হয়, যেউ জমি দখলে নিয়ে গেলে তা ঠেকাতে হয়, কত কী।
চারু বলে, সহায় সম্পত্তিতো আপনারও কম ছিলো না। আপনি জমিদারী করেন নি?
– করেছি তো?
– কিন্তু আপনার নামের আগে তো দেওয়ান, চৌধুরী এসব নাই।
আমি তা চাই নি।
– কিন্তু আপনাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেক মহিলাই তো নামের আগে দেওয়ান, নামের পরে রাজা, চৌধুরী এসব লিখেন। আপনাদের জেনারেশনের কোন মহিলার নামের আগে এসব ছিল না। আপনারা বানু, বিবি এসব লাগাতেন কেন?
– এসব মুসলমানী নাম। বানু, বিবি, জান বা জাহান, এসবই ছিলো। পরে কে কেনো এসব লাগিয়েছে, আমরা বলতে পারি না। কারো কাজে তাকে না চেনা গেলে নাম দিয়ে তার কাজ বা পেশা বোঝানো হতো। এখনতো এসব অন্যভাবে আছে। নামের সাথে পেশাও। কিন্তু বাপের পেশা তো কন্যার উপর বর্তায় না।
– আর বাবার নামের সাথে রাজা থাকলে কন্যা কি রাজা হয়?
– এসবও আছে নাকি!
– আছে। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন।
আমাদের সময় এসব ছিল না, মেয়েরা ঘরেই থাকতো আর বাচ্চা পালতো। তোমাদের যখন হাইস্কুলের যাবার বয়স সে বয়সে আমাদের সময় মেয়েরা স্বামীর ঘরে চলে যেতো। তাদের বাস হতো অন্দর মহলে। তারা রান্নাবাড়া দেখবে, দাসীবাদীর খেদমত নেবে আর বাচ্চা পালবে। বাচ্চা জন্ম দেয়ার সময় অনেক মহিলাই মারা যেতো। যারা মারা যেতো না তারা পরের বছর আবার মা হতো। বয়স তিরিশ হয়ে গেলে পয়সাওয়ালা স্বামীরা আর তাদের খুব কাছে আসতেন না। তারা তখন আরেক কিশোরী বিয়ে করে সতীন আনতেন তার জন্য।
– সতীনদের নিয়ে কি এক ঘরে থাকতেন?
– না। যার বেশি জমিজিরাত, সে আলাদা জায়গায় আলাদা আলাদা বৌ রাখতো। যেমন আমাদের আব্বাজান। তিনি সিলেট শহর, বিশ্বনাথের রামপাশা, সুনাগঞ্জের লক্ষণশ্রী, তিন জায়াগায়ই তিন বিবি রেখে দিয়েছিলেন। আর যারা একটু কম পয়সাওয়ালা তারা রাখতো আলাদা বাড়িতে। তারচেয়ে কম পয়সা যাদের তারা একই বাড়িতে রাখতো একই বাড়িতে আলাদা ঘরে।
– ছইফা দি, জিনিসগুলোতো এখনো আছে একইভাবে। শুধু জায়গাটা বদলেছে। আমার এমনও বান্ধবী আছে, এই বয়েসে বারিধারায় ফ্লাট নিয়ে একা থাকে। শুনেছি, এক ভদ্রলোক ফ্লাটটা তাকে উপহার দিয়েছে। তিনি মাঝে মাঝে ঐ ফ্লাটে গিয়ে তার কাছে থাকেন।
– বিয়ে করেছে তারা?
– না দিদি। করেনি। তবে সে বলছে করলে করতেও পারে। না করার চান্স বেশি। কারণ ঐ লোক বিবাহিত। বিয়ে করতে হলে আগের বৌ এর লিখিত পারমিশন লাগে। না হলে মামলা হলে এই লোক ফেঁসে যাবে।
– আমি তোমাদের এই সময়ের ঘটনা জানি না।
– আচ্ছা হাছনের কী এমন ছিলো যে এতো মাইয়া ক্রাশ খেত তার উপর। বিয়ে ছিলো কয়টা?
– ওর তো নয়টা বৌ ছিলো কাবিন করা। আর কোথায় কি ছিলো তার কিছু শুনছি। কিন্তু দেখিনি। তবে একটা কথা কি জানো যে, আমাদের সবচেয়ে বড় ভাই অল্প বয়সে মারা না গেলে এই পরিবারের কাহিনী অন্য রকম হতো। কিংবা তিনি নিজেই একটা লিজেন্ড হয়ে যেতেন।
– তাঁর কথা বলুন দিদি।
– তাঁর নাম ছিলো উবেদুর। তিনি আমার থেকে কুড়ি বছরের বড়। আমার বয়স যখন উনিশ, তখন তিনি অল্প বয়েসে মারা যান।
– কত ছিল বয়স ?
– মাত্র উনচল্লিশ বছর।
– সেই বয়সেই তো তাঁর আসল কাজ দেখানোর সময় ছিল। সে বাবার জমিদারি দেখতো রামপাশায়।
– আপনারা কি সেখানে থাকতেন ?
– না। আমি আর মোজাফফর, মানে আমার ছোটভাইকে নিয়ে আমরা থাকতাম সিলেট শহরে শেখঘাটের কুয়ার পারে। এ জায়গাটা আমার মা নুরু বিবির ছিলো। সেখানে আমাদের বাস। আমাদের শহরের বাড়িতে তখন বড় ভাই উবেদুর আসতেন, থাকতেন। তিনি কবিতা লিখতে পারতেন উর্দূ আর ফার্সীতে। মুখে মুখে কবিতা বানাতেন। গানও গাইতেন। নাচ-গানের আসর করতেন। তার সঙ্গে খাতির ছিলো ঢাকার নবাবের।
– তিনি কি আপনার বাবার প্রথম ঘরের ছেলে?
– না। আমার বাবার প্রথম স্ত্রীর ঘরে কোনো সন্তান হয়নি। অন্ত:স্বত্তা অবস্থায় আমাদের বড় মা মারা যাবার পর বাবা পণ করেছিলেন আর বিয়ে করবেন না। তিনি তখন পাগলের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকেন। এ সময় ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে তিনি এক ফকিরের মুরীদ হয়ে যান। সেই ফকির যেখানে যায়, তিনিও সেখানে। ফকির যেখানে ঘুমায়, বাবাও সেখানে ঘুমান। জমিদারী, দেওয়ানী এসবের কোনো কিছুতেই তার মন নেই। কখনো বাজারে, কখনো গাছতলায়, কখনো রাস্তার ধারে, নদীর কিনারে বাবাকে দেখা যায়। একদিন তার পীর সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাবাকে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করেন। বলেন, ব্যাটা, তুই ইনো কিতা লাগি। তুই তোর বাড়িত যা। আমি খাবো দেখছি, তোর আওলাদে দুনিয়া ভরি যার। তুই বাড়িত যা। বিয়া কর।
– বাহ ! পীরের কথায় বিয়ে !
– এই ঘটনার পর বাবা ফেরত আসেন রামপাশায় তার বাড়িতে। বিয়েতে মত দিলে আরেক দেওয়ান কন্যা নফিজা বানুকে বিয়ে করেন। আমাদের দুই নম্বর মাতাজী নফিজা বানুর ঘরে জন্ম হয় আমাদের সবচেয়ে বড় ভাই উবেদুর। এই মার ঘরে আর কোনো সন্তান নাই। বাবা এরপর তিন নম্বরে যে মাকে ঘরে আনেন তার গর্ভে জন্ম আমার আর মুজাফ্ফরের। মুজাফফর আমার দুই বছরের ছোট, হাছনের এক বছরের বড়। এই উবেদুর ভাইর আসলে গানের জগত ছিলো। গান, কবিতা লিখতেন। তবে মরমীবাদ তেমন ছিলো না। নানা বিষয়েই লিখতেন। হাছনও সে রকম লিখতো, খুব বড় চিন্তা নিয়ে সেসব লেখা ছিলো না। কিন্তু ছন্দ মিলিয়ে লিখে ফেলতে পারতো। সেগুলো আসলে আমাদের পরিবার থেকে শেখা। পরে অবশ্য তার গানে গভীরতা অনেক বেড়ে যায়।
– আরো সময় পেলে কি উবেদুর বড় হাছন হতেন?
– হাছন রাজাকে তোমরা যেভাবে জানো, তার সব কিছুরই আরো উন্নত সংস্করণ ছিলেন আমাদের এই বড় ভাই। তিনিও বড় শিকারী ছিলেন। নিজের হাতে বাজপাখী রেখে পাখী শিকার করতে পারতেন। তিনি অনেকগুলো হাতি, ঘোড়া পুষতেন। তার পোষা হাতির নাম ছিলো চম্পা। এই হাতি চড়ে তিনি বনে জঙ্গলে শিকারে বেরুতেন। সেই হাতি তার সব ইশারা এবং শব্দ বুঝতো। অন্যকারো কথায় হাতি নড়তো না।
– গল্প শুনে মনে হচ্ছে দিদি, আপনাদের এই ভাই আর হাছন যখন যেভাবে বড় হয়েছিলেন, সে সময় কলকাতা জোড়াসাঁকোতে বড় হচ্ছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ। তাদের দুই ভাইয়ের যে বয়সের তফাৎ উবেদুর আর হাছনের সম্পর্কও তাই। হাছনের চেয়ে উবেদ ছিলেন ২২-২৩ বছরের বড়, আর জ্যোতিরিন্দ্রের চেয়ে রবীন্দনাথ ১২ বছরের বড় । অবশ্য বয়সে ঐ দুজন এই দুজনের চেয়ে ছোট। হাছনের ৭ বছর পর রবীন্দ্রনাথের জন্ম।
– এতো হিসাব আমার জানা নাই। তবে উবেদুর আর অহিদুর গলায় গলায় মিল।
– অহিদুর কে?
– হাছনের আগের নাম ছিলো অহিদুর। বড় ভাই উবেদুরের তার নিজের নামরে সাথে মিল রেখে এই নাম রেখেছিলেন। তবে বয়সের পার্থক্য অনেক ছিলো। হাছনের দশ-বারো বছর বয়স থেকে দুই ভাই একসাথে ঘোড়া চড়তো, শিকার করতে যেতো। বড় ভাই গান গাইতো, গান লিখতো, ছোটভাই তা দেখতো। সেও দুইচার লাইন বানাতো মুখে মুখে।
– জ্যোতিরিন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথ যেমন।
– কিন্তু ওদের নিশ্চয়ই ওতো বিয়া ছিলো না। কারণ হিন্দু ধর্মে একের বেশি বিয়া নাই। তবে তোমার কথা শুনে আমার এইমাত্র মনে হলো ঐ দুই ভাইয়ের সাথে এই দুই ভাইয়েরও কাকতালীয় অনেক মিল আছে। রবীন্দ্রনাথের সাথে মধুর সম্পর্ক ছিলো তার বৌ-দির। কিন্তু হাছনের সাথে এসব কিছুই ছিলো না তার ভাবীর। রবীন্দ্রনাথের দুই বছরের বড় ছিলেন তাঁর বৌদি কাদম্বরী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন বিয়ে করেন তাঁর কিছুদিন পর বৌদি আত্মহত্যা করেন।
– হাছনের বয়সে বড় ছিল সাজিদা, উবেদের বৌ। এক সময় সাজিদাকে হাছন বিয়া করে।
– তাই!
– কিন্তু এটা আবার প্রেম পিরীতির জন্য না, আমার মনে হয়েছিল ঐ সম্পত্তির জন্যই।
– উবেদুরের কয় বিয়া ?
– উবেদুর ভাইর দুই বিয়া। প্রথম স্ত্রী সন্তান প্রসবের পর মারা যান। দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে বিয়ে করেন সাজিদা বানুকে। তার গর্ভে এক সন্তান হয়। সন্তানের আড়াই বছরের মাথায় উবেদুর মারা যান। তখন তার বয়স চল্লিশও হয় না। বড় ভাই উবেদুরের মৃত্যুটাই এই পরিবারের গল্প অন্যদিকে নিয়ে গেলো। অনেকে বলে থাকেন, বাবার বড় একটা অভিশাপ লেগেছিল তার উপর। এই অভিশাপই আলী রেজা আর উবেদুর রেজার কাহিনী ভুলিয়ে দিয়ে হাছন রাজার কাহিনীর সূচনা করে।
উবেদুর মারা যাবার পর তার বৌ সাজিদাকে বিয়ে করে হাছন। সাজিদার গর্ভেই একলিমের জন্ম। আর এই একলিমের প্রথম বিয়েটা দিয়েই আমি মহা একটা ভুল করে ফেলেছিলাম, যার খেসারত আমাকে অনেক দিতে হয়েছিল।
একলিম রেজা কি আছেন এখানে ?
– না। তার চরিত্র এই নাটকে নাই। সে রামপাশায় পুকুর পাড়ে শুয়ে আছে। এই ফিল্মে তার ক্যারেক্টার আসেনি।
– আসেনি কেন?
– হাছন পরিবারের সবাইকে আনা হয়নি। আমি একটু এসেছি, তার বৌ-বান্ধবীরা বেশি। এজন্য সবার সাথে তোমাদের দেখা হবে না। তবে একলিমের আসা উচিত ছিল। বাপের গুণের সবটুকুই সে পেয়েছে। লিখতোও ভালো। কবিতা লিখেছে, মহাকাব্য লিখেছে, উপন্যাস লিখেছে। বড় বড় লেখকদের সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিলো। হাছনের গান যদিও রবীন্দ্রনাথ কোট করেছেন হাছন রাজার সাথে তাঁর দেখা হয় নি। কিন্তু একলিমের সাথে হয়েছে। তাঁকে অনেক স্নেহ করতেন রবীন্দনাথ। আবার নজরুলের সাথেও বন্ধুত্ব ছিলো একলিমের।
– আচ্ছা দিদি, আপনি তাহলে ক্ষেপেছিলেন কেন ? হাছন রাজা জালিম ছিলো এমন কথা আপনি এক কবিতায় লিখেছেন। কেন ? কারন কী ?
– কারণ পৃথিবীতে তো ঐ দুইটাই , দুই ম ।
– মহিলা ও মাটি – তাই না!
– ঠিক।
– এখানে কি ছিল?
– দুইটাই।
– একটু খুলে বলুন।
– ঘটনা অনেক লম্বা, তা ও ছোট করে বলি – মনিপুরের এক মহারাজা ছিলেন, নাম- টিকেন্দ্রজিৎ । তিনি বৃটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। বৃটিশ তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা দিয়ে দিল। অবস্থা খারাপ দেখে সে সময় তার বোন আর কন্যাকে পাঠিয়ে দেন সিলেট। কন্যা রাজকুমারী নন্দিতা রায়। অপরূপ সুন্দরী। বারো-তেরো বছর বয়স।
এই দুই মেয়ে সিলেট এসে আমার সাথে থাকে। আমার বাসায় তাদের রাখি। এক সময় তার বাবা টিকেন্দ্র জিৎ বৃটিশের হাতে মারা গেলে তারা একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে। হিন্দু খান্দানী বংশের মেয়ে। আদব কায়দা, লেহাজ তমিজ সব ভালো। একসময় টের পেলাম, আমার এক বছরের ছোট ভাই মুজাফ্ফরকে সে খুব সম্মান করে। খাই খেদমত করতে চায়। মুজাফ্ফরও বলে, সে তাকে পছন্দ করে। আমি নন্দিতাকে বললাম, তুমি কি আমার ভাইকে বিয়া করবা?
সে মাথা নাড়ে।
বলি, তাহলে তো তোমাকে মুসলমান হতে হবে।
সে রাজি হয়ে যায়। আমি এই মেয়েটিকে মুসলমান বানিয়ে আমার ভাই মুজফ্ফর এর সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেই। তার নাম বদল করে রাখি সবুরা খাতুন। তাদের ঘরে ফুটফুটে দুই রাজকন্যার জন্ম হয়। একটার নাম রাখি নুরুন্নেছা, আরেকটা মনিরুন্নেসা।
আমাদের আরেক সৎ ভাই ছিলো। আমাদের মায়ের প্রথম স্বামী রহমান খানের ঔরসে তার জন্ম। তার নাম সুলতান খান। সেই সুলতান খাঁনের পুত্র সুবা খানের সাথে নুরুন্নেছার বিয়ে হয়, সেটা ১৮৯১ সালে। বিয়ের পর তাদের এক সন্তান হয়েছিল। কিন্তু ছোটবেলায় সে মারা যায়। শুধু তাই নয়, কিছুদিন পর নুরুন্নেছা আর সুবা খান দু জনই মারা গেলে সুলতান খানের আর কোন ভরসা থাকে না। তার সম্পত্তি আছে, কিন্তু খাওয়ার কেউ নাই। তিনি ভাবেন, এতো সহায় সম্পত্তি দিয়ে কী হবে জগতে ? শহরে ও গ্রামে কিছু জায়গা জমি রেখে বাকী সম্পদ ওয়াক্ফ করে তার মোতওয়ালী করে যান আমাকে।
আমার বৈপিত্রীয় ভাইয়ের সমস্ত সম্পদও আমার কাছে চলে আসে। এক সময় সুলতান খানও মারা যান। আলী রওশন বানু যখন ৭ বছরের নাবালিকা তখন আমার ছোটভাই মুজাফফরও মারা যায় । এদিক থেকে অনেকগুলো সম্পত্তির মালিকানা এসে যায় আমার কাছে। তখন তো আমাদের বাবাও বেঁচে নাই। বড় ভাইও নাই।রামপাশা-লক্ষণশ্রীর জমিদারি তখন পুরোটাই হাছন দেখছে একা। আমার ভাগে এসে পড়ে সিলেটের অনেক সম্পত্তি আর এই সম্পদের উপর চোখ পরে হাছনের। সে চায় তার পুত্র একলিমের সাথে রওশনের বিয়ে দিতে । আমার কাছে এসে ধর্না দেয়, বলে- বুয়াই আমার তুমি ইকান ঠিক করি দেলাও।
আমি তখন বুঝি, আলী রওশন বানু নয়, তার সম্পত্তির দিকেই চোখ ছিলো হাছনের। একলিমের মাত্র সতেরো বছর বয়স, রওশনের এগারো। ৫ হাজার টাকা নগদ আর ৬০ হাল জায়গার মোহরানা দিয়ে বিয়ে হয়ে যায় তাদের। সেটা ১৯০৬ সালে ।
এই বিয়ের পর থেকে অনেক ঝামেলা হয়, এমন কিছু পড়েছি নানা লোকের লেখায়। হাছনের উপর তুমি বিলা হয়ে কবিতাও লিখেছে, এমন কিছু ।
এই বিয়েটা যখন হয় তখন আমার বয়স ৫৫, হাছনের ৫২ বছর। হাছন রাজার মা হুরমত জাহান মারা গেছেন ২ বছর আগে। এখন হাছনের উপরে কথা বলার আর কেউ নাই। মিরাশদারি বাড়ানোর জন্য মন দিয়েছে। সুনামগঞ্জে আছে তাঁর দুই ছেলে গনিউর আর হাসিনুর। গনিউরের বয়স তখন ৩২, হাসিনুরের ৩০। রামপাশার যুবরাজ একলিম আছে তাঁর মা পিরানী বিবির সাথে।
– সঙ্কটটা তাহলে কী নিয়ে ছিলো ? ওদের সংসার কি সুখের হয় নাই ?
– একলিম এর পরে আর সাতটা বিয়া করে। ৮ বৌয়ের ঘরে তাঁর ১৪ টা বাচ্চা। কিন্তু রওশনকে আমার কাছ থেকে সরাই নি। সে এখানেই ছিলো আমার সাথে এই কুয়ায়পাড়ের দোতালা বাড়িতে । মামলা মোকদমা লেগেই ছিলো দুইজনের মধ্যে । আমার সাথেও বেয়াদবি করেছিল একলিম। আমার ঘর পর্যন্ত আগুন দিয়া পোড়ান হয়েছিল। রাগে, দুঃখে লিখেছিলাম –
আমার কেউ নাই রে ভবের বাজারে
আচম্বিতে ঘটলো দুঃখ আউয়াল জুম্মাবারে
তেরোশো চৌদ্দ বাংলার তিরিশ ফাল্গুনেতে
বাড়ি ঘর জ্বলিয়া সব গেলো ছারখারে
এমন বান্ধব নাই ডাকিয়া জিজ্ঞাস করে
ভবের মায়ায় ভুলিয়া রইলাম না ভজিলাম তারে
চারু বলে, আপনি তো উর্দুতেও একটা লিখেছিলেন হাছন রাজাকে নিয়া।
হ্যাঁ, লিখেছিলাম –
হাছন রাজানে এয়সা জুলুম কিয়া
এতিম বেকচকো লেকে আতশ মে ঢাল দিয়া
মালো মিলিক্ষা এয়সে লালস হুয়া
বেকস এতিম পর জরা রহম না কিয়া
এটা লিখেছিলাম এই কারনেই । তবে জীবনের শেষ দিকে এসে তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক অনেক ভালো হয়ে যায়। আমাদের দুইজনেরই বয়স যখন ষাইটের উপর হয়ে যায় আস্তে আস্তে মিরাশদারির দিক থেকে মন সরে আসে। আমার সমস্ত সম্পত্তি আমি ওয়াকফ করে দেই, হাছনও তাই করে। আমার যখন ৬৭ বছর বয়স আমি চলে যাই, তাঁর তিন বছর পর তাঁর যখন ৬৭ তখন সে ও চলে আসে। জীবনের শেষ দিকে এসে জীবন ও জগতের সয় সম্পদ নিয়ে আমার মনে হতো –
শাহ ছুলেমান কাহা, শাহ ছিকান্দর কাহা ?
খালি হাত সব কই গায়া, দুনিয়ামে কই না হা
ইয়ে দুনিয়া ফানি হায়, এক রোজ জানে হোগা
জুর ও জুলমকা মজা উদরজা চফন হোগা
আমি আর পিরানি বিবি আমরা বছরের পর বছর মক্কা-মদীনায় পড়ে থাকি। আমাকে হাজী বিবি বলে ডাকতে থাকে লোকজন।
দিদি, একটা কথা বলেন তো দেখি- হাছন রাজাকে আসল হাছন কে বানিয়েছিল ?
পিরানী বিবি। একলিমের মা আর আমাদের বড ভাইর বৌ।
চারু পিরানী বিবিকে এখন খুঁজে ।
হাছন আলী
আমার এক পাগলা ভাতিজার গল্প বলি। সে আসলে আউলিয়া টাইপের ছিলো। এদেরকে রিয়াজুল গায়েবও বলা হয়। তার নাম ছিলো দেওয়ান আবুল হাছান আলী রাজা।
বড় ভাইয়ের প্রথম বিবির ঘরে তার জন্ম। কিন্তু কপাল পোড়া। জন্মের কিছুদিন পরেই তার মা মারা যান। বাবা পরে বিয়ে করেন সাজিদাকে। সাজিদার ঘরে আজিজুরের জন্ম হয়েছে। হাছান আলীর যখন ৯ বছর আর আজিজুরের আড়াই বছর তখন বয়র ভাই উবেদুর মারা যান। থাকে সতমায়ের কাছে আর দাদার কাছে। কিছুদিন পর দাদা মারা গেলে ওর আশ্রয়ের কোন জায়গা থাকে না । এ সময় সিলেট থেকে এসে ওর মামারা তাঁকে নিয়ে যান ।
আমার তখন ১৬-১৭ বছর বয়স, নতুন জমিদারী আমার হাতে, আমি ভাতিজাকে খরচাপাতি দেই। সে সিলেটে মাদ্রাসায় পড়ে। সেখান থেকে কলকাতা যায় পড়তে। আরবী, ফার্সী, উর্দূতে সে পণ্ডিত হয়ে রামপাশা ফিরে আসে। আমার ইচ্ছা ছিলো আমার কোন এক মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেব। তখন সে ভালোভাবে জমিদারি চালাবে আর সম্পত্তিও নিজেদের মধ্যে থেকে যাবে। কিন্তু বিয়েসাদীতে তার মন নাই।
আমি থাকি লক্ষণশ্রী। একদিন আমার কাছে খবর এলো, রামপাশার পাশের গ্রামের কয়েকজন লোককে সে আমাদের লাঠিয়াল পাঠিয়ে ধরে নিয়ে এসেছে। সেই লোকগুলোকে বাড়ির পাশের জঙ্গলে গাছের সাথে বেঁধে রেখে লাঠিয়াল দিয়ে পেটানো হচ্ছে। হাছান আলী কারো কথা শুনছেন না। আমাকে যেতে হবে রামপাশা।
আমি রামপাশা গিয়ে দেখি ঘটনা সত্য। আমাদের একটা হরিণ ঐ গ্রামে কারো ক্ষেতে ঢুকে পড়েছিল বলে ঐ গ্রামের লোকেরা হরিণটি খেয়ে ফেলে। তাদের এই অপরাধের কারণে ঐ গ্রামের মানুষজনকে ধরে এনে সে এই শাস্তি দিচ্ছে।
শালিসে বসলাম আমি। ভাতিজাকে ডেকে বললাম, তুমি এটা করতে পারো না, তোমার অন্যায় হয়েছে।
সে বলে , আমি রামপাশার জমিদার। আমার হুকুম চলবে এখানে।
আমি বলি, তুমি জমিদার নও।
ক্ষেপে গেলো ভাতিজা। বলে, রামপাশার জমিদারী তার বাবার ছিলো। এখন বাবা নাই, সুতরাং তার ইচ্ছায় সবাই চলবে। তাকে পুরো জমিদারীর ক্ষমতা দিতে হবে।
– তার কথায় তো যুক্তি ছিলো ওস্তাদ। যে জমিদারি আপনি ভগ করছেন সেগুলোতো তার বাপের করে দেয়া। বাপ নাই বলে আপনি দখল করে নিয়ে তাকে কিছুই দেবেন না ?
– কিন্তু সে জানে না যে, নাবালক অবস্থায় তার বাবা মারা গেলে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী তার চাচা, মানে আমিই হই। সে কিছু পায় না।
চারু বলে, আচ্ছা, তখন কি মুসলিম পারিবারিক আইনটা হয় নি?
– না, তখনও হয় নি। এটা তো হয়েছে এই সেদিন, ১৯৬৫ তে। তার আগে পর্যন্ত এই বিধানই ছিলো। যেটা কোরানে-হাদিসে আছে।
– কিন্তু কোরান হাদিসেতো এমন কথাও আছে যে, তোমরা এতিমের প্রতি অন্যায় আচরণ করো না, তাদের সম্পত্তি বেদখল করো না।
– তাতো আছেই। আমিতো শরিয়ত মানি। আমিতো আর তাকে কোনো কিছুর কম দেইনি। তার যখন যা কিছুর প্রয়োজন ছিলো, সে করেছে, নিয়েছে। কিন্তু আমার ঐ কথা তার কানে লাগে। সে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছাড়া হয়ে যায়। তার খোঁজ পাওয়া গেলো ৯ বছর পর, যখন সিলেটের পুলিশ তাকে ডাকাত সন্দেহে আটক করলো।
– বাহ, ইন্টারেস্টিং। ডাকাত হয়েছিলেন তিনি?
– বিষয় সেটা না। সেই ঘটনায় ৯ বছর পর একদিন লাক্কাতুরা চা বাগানের এক লেবার শেডে সে হাজির হয়। সেখানে ১২ জন লেবারের খাবার রান্না করা ছিলো। কাউকে না জানিয়ে একাই সব খাবার খেয়ে ফেলায় শ্রমিকেরা বাগানের ইংরেজ ম্যানেজারের কাছে তার নামে নালিশ করে। ম্যানেজার এসে কথা বলে বুঝে ফেলেন, এটা সাধারণ গুন্ডা নয়। সে অনেক বিষয়ে জ্ঞান রাখে। তার মামার বাড়ির পরিচয় পাওয়ার পর ঘোড়ার গাড়িতে করে সিলেট শহরে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেযা হয়। কিন্তু সেখানে সে থাকে না, রাতের বেলা ঢুকে পড়ে সিভিল সার্জনের বাসায়। তার তখন লম্বা দাড়ি, লম্বা চুল, লম্বা নখ। এমনিতে উচা-লম্বা-ফর্সা চেহারা তার। তাকে দেখে ডাকাত মনে করেছিলেন সিভিল সার্জনের বৌ। ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ার পর বাহির থেকে ঘরের দরোজা বন্ধ করে দিয়ে পুলিশে খবর দেয়া হলো। এরপর যা হবার তাই হলো। পুলিশ রামপাশার জমিদার বাড়িতে তাকে পৌঁছে দিলো।
এখানে আসার পর খবর পাওয়া গেলো- এতোদিন সে এক মজ্জুফ পীরের আস্তানায় ছিলো। মারেফতের লাইনে চলে যায়। দুনিয়াদারীর কোনো কিছুতে তার মন বসে না। জগৎ সংসারের কোনো কিছু সে দেখে না। আমি তার জন্য একজন বডিগার্ড ঠিক করে দেই। তাকে মাসে মাসে বেতন দেই। আমার শর্ত সে যেন তাকে কখনো হাতছাড়া না করে। সেই বডিগার্ডকে সে দেখতে পারতো না। তাকে মারধরও করতো।
– আমার মনে হয় জমিদারীর সম্পদ এবং ক্ষমতা না পাওয়ার কারণে তিনি এমন হয়েছিলেন।
– বেশি বুঝো তুমি। এতো বেশি বোঝা ভালো না। এক বনে দুই বাঘ কি থাকতে পারে?
– দুই বনে দুই বাঘ থাকতো? আপনি লক্ষণশ্রী নিয়ে আছেন, থাকেন। রামপাশা তাকে দিয়ে দিলেই হতো।
– রামপাশার জমিদারী তো আমার নামের।
– আপনি সেখান থেকে দিতেন।
– সে এমন একটা লাইনে চলে যায়, জমিদারী দিলেও তারে পাওয়া যেতো না। সে রামাপাশায় খুব একটা থাকতো না। দোহালিয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ দৌড়াদৌড়ি করে করে বেড়াতো। এ রকম ১৪ বছর সময় কাটায় সে। বিয়াসাদীও করে না। উলুঝুলু চুল দাড়ি নিয়ে দরবেশের মতো চলাফেরো করে এবং একদিন আকাশে মিলিয়ে যায়।
– মানে?
– ঘটনা হাছা। একবার সে তখন আমার এখানে, সুনামগঞ্চের লক্ষণশ্রীতে ছিলো। আমার সাথে দেখা করার জন্য মনপুরা থেকে এক লোক আসে ঘোড়া চড়ে। সবাই দেখলো যে, ঐ ঘোড়ায় চড়ে সে খাসিয়া পাহাড়ের দিকে চলে গেলো। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। আমি লোক লাগিয়ে খাসিয়া পাহাড়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজলাম। কেউ তার কোনো হদিস দিতে পারে না। সে যে ঘোড়া নিয়ে এসেছে এদিকে এমন নজিরও পাওয়া গেলো না। এখানে ঘোড়ার পায়ের কোনো চিহ্নও নাই। কয়েকজন বললো- ঘোড়ায় চড়ে আসমানের দিকে তাকে যেতে দেখেছে। আকাশের দিকে ঘোড়া ছুটতে ছুটতে মিলিয়ে যায়। তার আর কোনো ঠিকানা পাওয়া যায় না।
– আপনার সম্পর্কেওতো অনেক কথা আছে।
– যেমন?
– আপনার সেই ভাতিজা হাছান আলীর সৎভাই আজিজুর রাজা সাহেবের জানাযায় নাকি আপনি ছিলেন? অনেকে দেখেছে?
– তাই নাকি!
– আরো শোনা যায়, আপনার গার্লফ্রেন্ড দিলারামের পুত্র সৎ পুত্র মোবারক সাহেব এক সময় বলেছেন, আপনার মৃত্যুর পর অন্তত চারজন লোক দেখেছে, আপনি সুরমা নদী পাড়ি দিচ্ছেন? আরেকজন বলেছে যেদিন আপনি মারা যান সেদিন লাউড়ে গড়ের বনে নাকি আপনাকে কুড়া শিকার করতে দেখেছে তারা? চাঁদনী রাতে নাকি অষ্টসখী নিয়ে নিজের বাড়ির কাছে আসেন?
রামিজ রাজা হো হো কের হেসে ওঠেন।
জন্ম ২২ নভেম্বর, ১৯৬৫ সালে। তিনি একজন স্থপতি, নাট্যকার, তথ্যচিত্র নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক। ভ্রমণকাহিনী ও জীবনী সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।