বাদশার সঙ্গে কিছুক্ষণ
— একটা ইন্টারভিউ আছে। তোকেই নিতে হবে।
— আমি কেন ভাই? বাপ্পা কে বল না।
— বাপ্পাকে দিলে বস আমায় ছেড়ে দেবে! বস তোকেই চায়। কিছু করার নেই। ফাইনাল হয়ে গেছে।
— কার? কবে? কোথায়?
— স্থান মেটিয়া বুরুজ। পাত্র তফজ্জুল আশরফ।
— কে তফজ্জুল আশরফ? কী টপিক?
— বলছি বলছি। টপিক খানিক সেনসিটিভ। পাত্র মানে তফজ্জুল সাহেবের কোন এক পূর্ব পুরুষ নাকি বাদশার খুব কাছের লোক ছিলেন। ঠাকুরদা টাকুরদাই হবে মনে হয়। বাদশা মানে ওয়াজিদ আলি শাহ। নাম শুনেছিস তো?
— শুনেছি, ব্যস ওইটকুই। হাতি ঘোড়া কিছু জানি না।
— একটু গুগল করে নিস। শোন, তফজ্জুল সাহেব খাঁটি মুসলমান। খাঁটি মানে খাঁটি। মেমরি নাকি সাংঘাতিক। বিস্তর পড়াশোনা। পাঁচটা ভাষা জানেন। বয়েস অনেক। কিন্তু দেখলে বুঝতে পারবি না। ওনার কাছ থেকে যতটা পারিস সেই সময়কার খবর গুলো নিবি। একটু হোম ওয়ার্ক করে যাস। বসের কাছে আরও ডিটেলস পাবি। ওয়াজিদ আলি শাহ। বই পত্র কিছু আছে?
— বই নেই। গুগল মাতা আছে। এনাফ। কবে যেতে হবে?
— সোমবার।
— সোমবার! সোমবার তো ভাইফোঁটা!
— ইয়েস স্যার বাট উনি ওইদিনই যেতে বলেছেন। সক্কাল সক্কাল। ডেট চেঞ্জ করা যাবে না। অন্য কোনও ডেট নেই। সোমবার ছাড়া জাস্ট ইম্পসিবল।
— কী ঝামেলা! এতো উটকো চাহিদা। উনি নিশ্চয়ই ভাইফোঁটার ব্যাপার ট্যাপার কিছু জানেন না?
— সে আমি জানি না।
— শালা আমার ভাগ্যটাই খারাপ। ভাটের চাকরি।
প্রান্তিক ঠিকানা ধরে যখন পৌঁছল তখন সময়টা আর সক্কাল সক্কাল নেই। তফজ্জুল সাহেবের বাড়িটা কামাল টকিসের কাছেই। চট করে ধরে নিলে পুরনো পৈত্রিক বাড়ি বলেই মনে হয়। প্রান্তিক ভেবেছিল বাড়ির প্রচ্ছদে একটা মুসলিম মুসলিম ব্যাপার থাকবে। তেমন কিছুই চোখে পড়ল না।
তফজ্জুল নিজেই দরজা খুললেন। প্রান্তিক মনে মনে যে চেহারাটা এতক্ষণ পুষে রেখেছে তার সঙ্গে এই মানুষটির একেবারেই মিল নেই। পিসেমশাই আর মেসোর চেহারা মিলিয়ে দিলে অনেকটাই যেন তফজ্জুল আশরফ।
তফজ্জুল বসার জায়গা দেখিয়ে বসতে বললেন। গ্লাসে জল এল। চুমুকের সঙ্গে প্রান্তিক ঘরের এদিক ওদিক খুঁটিয়ে দেখছিল। তফজ্জুল বলে উঠলেন, এখন যেটা গার্ডেন রীচ সেটার আগে নাম ছিল গার্ডন রিজ। ওই মহল্লা তখন কত শান্ত ছিল আপনি এ যুগে বসে তা ভাবতেই পারবেন না। এখন চারপাশে শুধু হট্টগোল। ওখানে একটা মাটির ঢিবি ছিল। তাই বলত মটিয়া বুর্জ। নদীর পারে যে বাড়ীগুলো ছিল, এখন আর এসব নেই, সেগুলো সরকার বাদশাহকে দিল। সেখানে বাদশাহর জন্য যারা কাজ করত তারাও থাকত । সেখানেই থাকতেন আমার বড়ে আব্বা মুহম্মদ আশরফ। বাদশার একদম খাস লোক। সলা পরামর্শর দরকার পড়লে তার ডাক পড়ত।
দিব্যি বাংলা বলেন তফজ্জুল! ভণিতা না করে সোজা টপিকে ঢুকে পড়েছেন। দরকারের চেয়ে বেশি জল খেয়েও কী বলে কথা শুরু করবে প্রান্তিক বুঝতে পারছিল না। সুবিধাই হল।
— বাদশাহ মানে ওয়াজিদ আলি শাহর কথা বলছেন তো?
— হ্যাঁ। আর কে আছে? আমাদের বাদশাহ। ওয়াজিদ আলি শাহ। আসাদ মঞ্জিল! সুভান আল্লাহ্। ওখানেই বাদশাহ থাকতেন।
— বাদশাহর আর তার রাণীরা। বাদশাহর তো শুনেছি অনেক—
— রানী? বেগম বলুন বেগম। সেকি আর একটা। ঝুমুরওয়ালি , নথওয়ালি , ঘুংঘটওয়ালি আর কত নাম করব! এরা নাচে গানে সব উস্তাদ ছিল। এই সব দলে যাদের সঙ্গে বাদশাহর মুতআ হয়েছিল তারা সবাই ছিল বেগম।
প্রান্তিক রেকর্ডার অন করে ফেলেছে। বাদশাহ আর তার অনেক বেগম। শুরুটা মন্দ নয়। সে খুশি।
— মুতআ কী?
— ও একধরনের শাদী বলতে পারেন। খাস সুলতানখানায় এরা থাকত। যাকে বলে একদম বাদশার কাছাকাছি।
— তা বাদশার আর অন্য কারোর সাথে… মানে রাজা মহারাজারা যেমন করে আর কি। নানারকম নেশা টেশা থাকে না, মানে তেমন কিছু–
—হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন। না না একদম না। বাজারের বেশ্যার মুজরো কখনও বাদশাহ দেখেননি। মদ আফিম চরস এসব থেকে শ ক্রোশ দূরে থাকতেন। নমাজে দেরি হত না। তিরিশ দিন রোজা রাখতেন। মহরমের মাতমদারী পালন করতেন একদম মন দিয়ে।
— মাতম—
— কেউ মারা গেলে আপনারা কী করেন। শোক করেন তো?
—হি—মানে আমাদের যেটা শ্রাদ্ধ?
— ঠিক ঠিক। ওইরকম।
—আচ্ছা বাদশাহ তো সিয়া ছিলেন , তো সুন্নীদের সাথে কোন ঝামেলা টামেলা…? এখন তো দেখছেন টিভিতে, যা সব ঘটছে চারিদিকে।
— দেখছি দেখছি ভাই ……আরে কী মুশকিল! আপনার নামটাই তো জানা হয়নি?
— প্রান্তিক ব্যানার্জী। আমায় আপনি বলবেন না প্লিস।
— হ্যাঁ ভাই প্রান্তিক কী জানেন তো সিয়া সুন্নী সবই তো আসলে এক । ইনসান। তা সিয়া সুন্নী কারা জানা আছে তো?
— না তা তো ঠিক মানে—
— কোই বাত নেহি। সবাইকে সবকিছু জানতে হবে এমন তো কথা নেই। আসলে ইরানে সফুইয়ারা যখন ছিল তখন সেখানকার ধর্ম ছিল শিয়া ইস্না অশীরী। মানে শিয়া। আর এদিকে আমাদের হিন্দুস্থানে মুঘলরা যখন ছিল তারা মেনে চলত চুগতাইয়া মহজব-উল-মিন্নত। মানে সুন্নী। আমাদের বাদশাহ ছিলেন সিয়া। বাদশাহ কী বলতেন জান ভাই? বলতেন, আমার এই দুই চোখের একটা শিয়া আর একটা সুন্নী। যারা সিয়া সুন্নী এসব নিয়ে মারামারি হইচই করত তাদের সবকটাকে বাদশাহ তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাদশাহর বড় কর্তা মুনশি উসসুলতান সুন্নী ছিলেন। যারা মজলিস আয়োজন করতেন তাদের মধ্যে কত লোক সুন্নী ছিল আপনি জানেন? আরও কত সুন্নী বাদশাহর কর্মচারী ছিল। কোন বাছবিচার ছিল না বাদশাহর। এসবই আমার আব্বার থেকে শোনা। আমার আব্বা তার আব্বাজানের কাছে এসব শুনেছেন। এখন আমি আপনাকে শোনাচ্ছি। কী সুন্দর না!
— আপনি কিন্তু এখনও আমায় আপনি বলছেন।
তফজ্জুল হেসে বললেন, অভ্যেস ভাই আমার। সহজে ছাড়তে পারব না। মাফ করবেন।
প্রান্তিক মুখ টিপে খানিক হেসে বলল, আচ্ছা বাদশাহর তো শুনেছি পশু পাখীর খুব শখ ছিল। তাই না? একটু বলুন না।
— আরেব্বাস! আপনি তো পুরো হোম ওয়ার্ক করে এসেছেন দেখছি। ভালো ভালো। একদম ঠিক শুনেছেন। পাখি হরিণ এসব তো ছিলই পুকুরের ধারে খাঁচায় বাঘ থাকত। কুড়ি জাতের বাঁদর ছিল। খোদাই জানেন কোথা থেকে বাঁদর গুলো এসছিল। তামাশা না দেখিয়ে কাউকে ছাড়তই না। এমন বাঁদর সব!
হেসে উঠলেন তফজ্জুল। বললেন, মাছও পোষা হত। খাবার দিলে নেচেকুদে কী বাহার তাদের! আরও কী জানেন শুনলে অবাক হবেন। এ ছিল খাস বাদশাহর আবিস্কার। পাহাড়ে সাপ থাকত। বড় বড় লম্বা লম্বা সাপ পাহাড়ে উঠত আর নামত। ব্যাঙ ছাড়লে সাপগুলো সব এঁকে বেঁকে পিছু নিত। লোকেরা এসব দেখত আর খুব মজা নিত। বাদশাহর ইচ্ছা ছিল দুনিয়ার সব জাতের পশু পাখী একসাথে রাখবেন। সব মিলেমিশে বাঁচবে। কেউ নতুন পশু পাখি আনলে মনের মত দাম পেত। একজোড়া রেশম্পরা পায়রা বাদশাহ চব্বিশ হাজার টাকায় কিনেছিলেন। এই শহরে এসব আপনাকে কেউ জানাবে না। এসব খবর আপনি আমার কাছেই পাবেন। আফ্রিকার জিরাফ ছিল, জানেন! কোহানের দুটো বাগদাদি উট। এ শহরে তখন হাতি পাওয়া যেত না। পঁচিশ হাজার পায়রা ছিল! পিতল পিঞ্জরে থাকত। এত কিছু ছিল তবু কোথাও পাখানা বা পাখির পালক কিন্তু চোখে পড়ত না। এত সাফ সুতরা রাখা হত।
তফজ্জুল আশরফ চোখ বুঝলেন। সেকেন্ড দশ চুপ করে থেকে সুর করে বললেন, খোয়াব থা জো কুছ ভী দেখা, জো সুনা আফসানা থা। উচ্চারণের মাধুর্যে মনে প্রান্তিকের মনে হল তিনি পরম স্নেহে শব্দগুলোকে আদর করছেন। খুব আস্তে চোখ খুললেন তফজ্জুল। বললেন, আব্বাজানের চোখ দিয়ে সব কিছু দেখতে পাই। কেমন স্বপ্নের মত লাগে। একটা তিলিস্-ম ! ভানুমতীর খেলা ! হঠাৎ কেমন সব নষ্ট হয়ে গেল। সেই সুন্দর শহর — আজ কেমন একটা! কিচ্ছু নেই । কিচ্ছু নেই। সব শেষ। শুধু ধুলো পড়ে আছে। আপনি ধুলো সরিয়ে দেখুন কিচ্ছু দেখতে পাবেন না। বাদশাহর দেহান্তের পর পুরো মেটিয়াবুরুজের সর্বনাশ হল। বাদশার সম্পত্তি বাঁটোয়ারা হল।
চোখের জল মুছে তফজ্জুল বললেন, যেখানে আপনি বসে আছেন সেখান থেকে সাফ দেখা যেত নূর মঞ্জিল সুলতানখানা আসাদ মঞ্জিল। কবিদের কত মুশায়েরা হত। কত লেখক বন্ধুরা কথার জাদু দেখাতেন! আফীমচীদের জমায়েতে উছলে উঠত গল্পের পর গল্প! কত পায়রা উড়ত জানেন?
— আচ্ছা শুনুন না আমার কতগুলো অন্য প্রশ্ন ছিল। খানিক ঝাঁঝিয়েই প্রান্তিক কথাটা বলল।
প্রান্তিক আসলে ছটফট করছিল। ভাইফোঁটার সময় হয়ে আসছে। দিদি এবার খুব রাগ করবে। আর এই মানুষটা তো প্রশ্ন করলে থামতেই চায় না। কবে বাদশা মরে ভূত হয়ে গেছে। আবেগে পড়ে এমনভাবে কথা বলছেন যেন নিজেই বাদশা। আসল প্রশ্নগুলোই করা হচ্ছে না। খালি টপিক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন! এভাবে চললে তো বিকেল গড়িয়ে যাবে! হাল্কা রাগ তেঁতে উঠছে প্রান্তিকের ভেতর! বাদশা কী খেত কী পরত কটা সাপ কটা ব্যাঙ পায়রা বাঁদর এসব লিখলে থোড়াই কেউ পড়বে!
প্রান্তিক ঠিক করল লিখে আনা প্রশ্নগুলোর ছোট ছোট উত্তর নিয়েই সে এবার ট্যাক্সি ধরবে। ফোঁটা নেবে।
— আচ্ছা আপনি তো বাদশাহ নিয়ে এত কিছু বললেন। সিয়া সুন্নী সব এক। সে তো খুব ভালো কথা। শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু এখন কী সব ঘটছে সে খবর নিশ্চয়ই রাখেন? আপনাকে একেবারেই বলছি না কিন্তু সত্যি কথা বলতে আপনাদের মতোই শিক্ষিত উচ্চ শিক্ষিত মানুষেরাই কিন্তু ছেলেদের উস্কাচ্ছে। আর উস্কানিতে যা হচ্ছে সে তো সবাই জানে। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?
তফজ্জুল মাথা নিচু করলেন। মুখ তুলে প্রান্তিকের চোখে চোখ রেখে বললেন, উর্দুতে একটা কথা আছে জানেন, বুঢ়াপে মেঁ ইনসান কী কূওঅতে শহ্ওআনী যবান মেঁ আ জায়া করতি হ্যয়। মানে বুড়ো হলে মানুষের কাম বাসনা যা আছে সব জিভের আগায় এসে ঠেকে। এদেরও হয়েছে সব একই হাল। বুড়ো বয়েসে মানুষ মারার তামাশা দেখছে সব। তামাশা।
এমন সাদামাটা কেতাবি উত্তরে প্রান্তিকের মন ভরল না। এত নিরুত্তাপ কেন মানুষটা! রাগ টাগ কিছুই নেই। আজব! তফজ্জুল সাহেবের বেশ একটা জাঁদরেল গোছের কুমন্তব্য নিয়ে লিখলেই অর্ণবদার সুনজরে আসবে প্রান্তিক। এসব অফবিট ইন্টার্ভিউতে সেই একমাত্র ভরসা । লোকের পেট থেকে কীভাবে কথা খুঁচিয়ে বার করতে হয় অর্ণবদা ভালো করেই শিখিয়েছে।
প্রান্তিকের সোজা প্রশ্ন, আপনাকে কেউ সন্দেহের চোখে দেখেন না?
— কেন? সন্দেহ করবে কেন ভাই?
প্রান্তিক খোলসা করে সবকিছু বলতে চায় না। ফেসবুকের সমস্ত পোষ্ট আর ঘটনাগুলো দেখলে গা শিউড়ে ওঠে। এই ভাবটুকু প্রান্তিকের মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠল। তফজ্জুল সবটুকু পড়ে নিয়ে বললেন, আচ্ছা বুঝেছি আপনি কোন দিকে ইশারা করছেন। সে বহুকাল আগে বাসে দু এক বার হয়েছে। বিশেষ এক কারণে তখন দাঁড়ি রাখতাম। লোকজন কেমন একটা নজরিয়া সে দেখত বটে। আমি তখন বাদশার কথা ভাবতাম। আমার আব্বাজানের কথা ভাবতাম। দরবারী চালে আমার পূর্ব পুরুষ এখানে ঘুরে বেড়াত। তখত –ও- তাজ দেখেছিলেন তারা। ওদের কথা ভেবে মনে মনে বলতাম , অ্যায় গুল বতূখুর সন্দম তূ বূঅ্যায় কসে দারী। ওগো ফুল তোমার ওপর আমি খুব খুশি। ও তোমার কীসের সুরভি ওগো ফুল! এখন কেউ আমাকে দেখে বুঝতেই পারে না আপনি যেদিকে ইশারা করছেন। তাই কেউ সন্দেহর চোখে তাকায়ও না।
— সন্দেহ—
—প্রশ্ন পরে হবে ভাই প্রান্তিক। আমার নামাজ পড়ার সময় হয়েছে। আপনি একটু বসুন। আমি আসছি। আজ তো ভাইফোঁটা।
প্রান্তিকের মনে হল এই বাড়িতে এমন একজন মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে ভাইফোঁটা শব্দটা বড় ফ্যাসাদে পড়েছে। শব্দটা ওর মতোই এ তল্লাট ছেড়ে বেরোতে চায়। যত তাড়াতাড়ি ততই ভালো। ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনি জানেন আজ ভাইফোঁটা?
হোশেনারা—তফজ্জুল ডাকলেন।
সালোয়ার পরা একটা লাজুক মেয়ে মাথায় ওড়না জড়িয়ে ঘরে এসে ঢুকল।
—বাবুসোনা এসেছে?
—হ্যাঁ।
—এ হচ্ছে তোমার নতুন দাদা। প্রান্তিক দাদা। ওকেও নিয়ে যাও।
প্রান্তিকের নিজেকে বলির পাঁঠা মনে হচ্ছিল। সে কোথায় যাবে? কেন যাবে? এই মেয়েটাই কে? কিছুই তো পরিষ্কার হল না।
তফজ্জুল প্রান্তিকের অস্বস্তি পড়ে বললেন, হোশেনারা আমার নাতনি। আপনাকে ফোঁটা দেবে। আমি নামাজটা সেরে নি আর আপনি ভাইফোঁটা।
হোশেনারার সঙ্গে অগত্যা প্রান্তিক পাশের ঘরে গেল। ফোঁটা নিতে অস্বীকার করলে ব্যাপারটা মোটেই ভালো দেখাবে না। পাশের ঘরে আসনে আরও একটি ছেলে বাবু হয়ে বসে। বয়েস অনেকটাই কম। প্রান্তিকের জন্য আরও একটি আসন পাতা হল। এই ছেলেটিই মনে হয় বাবুসোনা। হোশেনারা আর ওর মা ধান দুব্বোর আয়োজনে ব্যস্ত। এই ফাঁকে প্রান্তিক ফিসফিসিয়ে পাশের ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি বাবুসোনা?
—হ্যাঁ।
—ভালো নাম কী তোমার?
—ময়ূখ।
—ময়ূখ কী?
—ময়ূখ চক্রবর্তী।
—এখানেই থাক?
— নীচে ভাড়া থাকি।
— এই বাড়িতেই? ভাড়ায় থাকো?
— হ্যাঁ।
—তোমার বাবা মা জানে তুমি এখানে এসেছ।
—জানার কী আছে! প্রত্যেক বছরই তো আসি।
আয়োজন শেষ। প্রান্তিকের কপালে হোশেনারার আঙুল ছোঁয়ানো। প্রান্তিক চোখ বুজে বুকের ভেতরের ঢিপ ঢিপ টের পাচ্ছে। হোশেনারা মিঠে গলায় বিড়বিড় করে কী বলছিল মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করল। চোখ খুলে দেখল হোশেনারা হাসিমুখে ওর কপাল ছুঁয়ে বলছে , আমি দি আমার ভাইকে ফোঁটা। হোশেনারার ওড়না ফ্যানের হাওয়া উড়ছে। ওড়নার শেষ প্রান্ত ছাড়িয়ে একটু দূরেই আধখোলা দরজার ভেতরটা চোখে পড়ছে। আড়চোখে প্রান্তিক দেখল, নামাজ পড়ছেন তফজ্জুল আশরফ। হোশেনারার মা সামনে দাঁড়িয়ে সমস্ত ব্যপারটা যাতে নিখুঁতভাবে ঘটে সেদিকে নজর রাখছেন। হাসিটা একদম ছোড়দির মত।
প্রান্তিকের সামনে প্লেটে সাজানো ফুলে ওঠা লুচি। আলুর দম। মাংস। দুটো রসগোল্লা। হোশেনারার কাজ শেষ। দরজার ফাঁক দিয়ে এখন উঁকি মেরে সবকিছু দেখছে। তার মা কাঁচের গ্লাসে জল এনে রাখল । বললেন, তুমি খেয়ে নাও বাবা। উনি আসছেন। লুচি লাগলে বলবে কিন্তু। একদম লজ্জা করবে না। কেমন।
প্রান্তিক লুচির টুকরোতে কিছুটা আলুর দম পুরে মুখে তুলল। স্বাদ অতুলনীয়। চারটে লুচি নিমেষে শেষ হল। মাংসে হাত পড়েনি এখনও।
তফজ্জুল নামাজ সেরে এসে বললেন, আরে তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না ভাই প্রান্তিক। তোমার বয়সে তো আমি লুচির ডেচকি নিয়ে বসতাম। হোশেনারা দাদাকে আরও লুচি এনে দাও।
— না না , আমার হয়ে গেছে। আমি আর খাব না।
হোশেনারা ততক্ষণে খান পাঁচেক লুচি প্লেটে রেখেই আবার পর্দার আড়ালে জায়গা নিয়েছে।
— আরে আপনি তো মাংস খাননি দেখছি। খান খান। নিশ্চিন্তে খান। পাঁঠার মাংস।
প্রান্তিক মাংসের ঝোলে এবার লুচি ভেজাল। হোশেনারা আরও পাঁচটা লুচি আনলেও সে আর যাই হোক মনের গভীরে আপত্তি করবে না। এমনই স্বাদ খাবারের।
— তোমাকে আর খাওয়াতে পারলাম কোথায় ভাই প্রান্তিক। আমি তো আর নবাব আবুলকাসেম খাঁর মত রইস লোক নই।
তফজ্জুল হাসলেন। দিলখোলা হাসি।
— আর একদিন আসতে হবে ভাই। বাড়ির সবাইকে নিয়ে আসবে। নিমন্ত্রণ রইল। পুলাও খাওয়াব। আমার বেটির হাতে খুশবুদার পুলাও খেলে আপনাদের দিল খুশ হয়ে যাবে। বাদশা যখন ছিলেন তখন সত্তর রকমের পুলাও হত জানেন! সে কতরকম কেতার পুলাও তোমায় কী বলব! গুলজার পুলাও। নূর পুলাও। কোকো পুলাও। চমবেলী পুলাও। বেটি প্রান্তিককে মাংস দাও। সুখা সুখা লুচি খাচ্ছে।
— না না আর খাব না। আমায় এবার বেরোতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্রচুর খেয়েছি।
হোশেনারার মা প্রান্তিকর শূন্য বাটি মাংসে ভরিয়ে তুলল। প্রান্তিক তাই চাইছিল।
— এসব খাবারের নাম শুনে জিভে জল আসে ভাই । চৌত্রিশ সের গোশত ফুটিয়ে তার ইয়াখ্নি বার করে তাতে চাল দম সেদ্ধ করা হত। মুখে দিতে না দিতেই মনে হত তামাম চাল গলে গিয়ে নিজেই হজম হয়ে গেছে। বাদাম পেস্তার খিচুড়ি । মছলী মুসল্লম। কোরমা। কেসর ও কস্তুরির গুলি খাইয়ে খাইয়ে… আহা হা…শিরায় শিরায় ছড়িয়ে থাকত আতরের খুশবু।
একটা ঢেঁকুর তুলে প্রান্তিক বাকি প্রশ্নগুলোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিল। যত তাড়াতাড়ি সারা যায়। পোলাও কোর্মা জবরদস্ত খাবার বটে কিন্ত খবর হিসেবে নেহাতই মামুলি। দিদিরা অপেক্ষা করছে। আর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছতে না পারলে জ্যেঠিমার সামনে আর কোনদিন দাঁড়াতেই পারবে না।
তফজ্জুল ইশারায় ডাকলেন প্রান্তিককে।
— আসুন আসুন । পাশের ঘরে বাদশার সঙ্গীত আছে। ও না শুনলে বাদশাকে বুঝবেন কী করে!
তফজ্জুল গ্রামাফোন রেকর্ডের সামনে সুর ভাজছেন। প্রান্তিক স্মার্ট ফোনে ছবি নিল। ঘরের বেশিরভাগ জায়গাই বইপত্রে ঠাসা। কিছু বই জায়গা না পেয়ে মেঝের ওপর এ ওর পিঠে। ঘরের ছাত অনেক উঁচুতে। সেখানে ঝুল জমেছে। এক নজরে কোনও সরকারি সংরক্ষণ শালা মনে হয়।
— গান শোনানোর আগে দুটো কথা বলেনি। আমার আব্বাজান বলতেন আমার আব্বা বাদশার সঙ্গে এক মেহফিলে গান শুনেছেন। রাগ রাগিনী নিয়ে কথা বলেছেন। বাদশা নিজে রাগ রাগিনী তৈরি করতেন। জূহী শাহপসন্দ। সব বাদশার তৈরি। আরও আছে। খাম্বাজ, ভৈরবী, কামোদ, পীলু এসব বাদশার পছন্দ ছিল। বুড়ো হয়ে গেছি কিন্তু এ ঘরে এলে আমি সেই মেহফিলের গন্ধ পাই। সাফ দেখতে পাচ্ছি তুমি যেখানে বসে আছো সেখানে বসে আছে প্যরে খাঁ, বাসিত খাঁ , মিয়াঁ সারঙ আর আমার আব্বা। কদরপিয়া ঠুমরীতে মেহফিল গুলজার হয়ে উঠছে। বাদশা আস্তে আস্তে গানে বিভোর হয়ে যাচ্ছেন। লয়ের মধ্যে লীন হয়ে যাচ্ছেন।
তফজ্জুল গ্রামাফোনে হাত দিলেন। কোনও এক প্রাচীন মানুষের গলার আওয়াজ আস্তে আস্তে ঘর ভরিয়ে তুলল। প্রান্তিক গজল শুনেছে। কিন্তু এ যেন গজলের চেয়ে অনেক বেশি মাদকতায় ভরা। অচেনা। অন্যরকম। অদ্ভুত এই জাদুভরা কণ্ঠ।
তফজ্জুল চোখ বন্ধ করে ঠিক উল্টোদিকে বসে। গানের তালে তালে তার প্রতিটি অঙ্গ চঞ্চল হয়ে উঠছে। এক অনায়াস স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিমায় শরীরটা আপনাআপনি নেচে উঠছে। প্রান্তিকের প্রথমে মনে হল তিনি সত্যিই নাচছেন । পায়ের আঙুলগুলো পর্যন্ত তালে তালে ভালোরকম নড়াচড়া করছে।
দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হল। প্রথমে প্রান্তিক শুনতে পায়নি। মেহফিলে খানিক সেও মজে গিয়েছিল।
হোশেনারার মা ডাকছেন। ইশারায়। প্রান্তিক পা টিপে ঘরের বাইরে এল। তফজ্জুল সাহেব বুঁদ হয়ে আছেন। খেয়াল করলেন না।
— বাবা এখন হুশে নেই। তুমি ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারো। বাবাকে আমি বলে দেব। একবার ওই ঘরে ঢুকলে আর বেরোতে চায় না। অনেকদিন পর বাবাকে দেখলাম এত কথা বলতে। সারাদিন ওই ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। বাইরে যাওয়া অনেকদিন বন্ধ করে দিয়েছে। লোকজন হাসি ঠাট্টা করে। একটু সেকেলে মানুষ তো! এই রূমালটা তোমার জন্যে। তুমি আসবে বাবা বলেছিল। হোশেনারা নিজের হাতে বানিয়েছে।
একটা সাদা রুমাল। তাতে কাঁচা হাতের সেলাইয়ে লেখা ‘দাদাকে হোশেনারা’। হোশেনারা ওর মায়ের শরীরের পেছনে নিজেকে আড়াল করেছে। কত আর বয়েস হবে। বছর দশ বারো। মুখটা বাড়ানো। প্রান্তিককে হাসিমুখে দেখছে।
প্রান্তিক রূমাল হাতে নিয়ে বলল, আজ তাহলে আসি। অনেক ধন্যবাদ। খুব ভালো সময় কাটল। আপনি একটু তফজ্জুল বাবুকে বলে দেবেন। আবার অফিস ফিরতে হবে তো। তাই আর কি। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
— সে আমি বলে দেব। আপনি নিশ্চিন্তে যান। আবার আসবেন কিন্তু। কোন কারণ ছাড়া এমনিই আসতে পারেন। বাবার ভালো লাগবে। আমাদেরও।
প্রান্তিক খানিক ছুটেই বড় রাস্তায় এসে পড়ল। একশো মিটার মতো দ্রুত হেঁটে সে দেড়শ বছর পুরনো আসাদ মঞ্জিল সুলতান মঞ্জিল আর তামাম মেহফিল মজলিশ দস্তরখানা পিছনে ফেলে এসেছে। একটা ভালো রিপোর্টের সম্ভাবনা এখন উজ্জ্বল।
হাওড়া হাওড়া বলতে বলতে মিনি বাসটা মুখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় আজ প্রচণ্ড জ্যাম। ছুটির দিনেও নিস্তার নেই। ট্যাক্সি না পেয়ে উবার ধরল প্রান্তিক।
দুষ্টু হাসি নিয়ে চুপি চুপি ঢুকতেই জ্যেঠিমা বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলিস রে? কখন থেকে তোর দিদি অপেক্ষা করছে।
ইন্টারভিউ ছিল গো। দেরি হয়ে গেল। রাগ কোরও না প্লিস। সে এক দারুণ ব্যাপার। সময় নিয়ে বলব।
আজকের দিনেও ইন্টারভিউ? কার? কে সেই আহাম্মক? আমার সোনাটাকে আটকে রেখেছিল।
প্রান্তিক হাসল। বলল, ওয়াজিদ আলি শাহ্।
— অ্যাঁ! কে?
— ভালো নাম ওয়াজিদ আলি শাহ্। ডাকনাম তফজ্জুল আশরফ।
— তফজ্জুল! আলি! মানে … যা যা তুই হাত মুখ ধুয়ে আগে ভেতরে যা। দিদি কখন থেকে ধান দুব্বো নিয়ে বসে আছে। লুচিগুলো তো সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
প্রান্তিক আয়নায় দেখল কপালে ফোঁটা। ভাগ্যিস জেঠিমা খেয়াল করেনি। তুলকালাম হয়ে যেত! প্রথমে সে ভাবল জলে ধুয়ে ফেলবে চিহ্নটুকু। শেষে কপালের অংশটুকু বাদ দিয়েই সে মুখ ধুলো। কপালে সামনের চুল ফেলে আড়াল করল ফোঁটা। দিদি যখন ফোঁটা দেবে কৌশলে ম্যানেজ করে নেবে সে।
আসনে বসল প্রান্তিক। অনেকক্ষণ আগের পরিপাটি ব্যবস্থা এখন একটু ফিকে। দুব্বোগুলো মিইয়ে গেছে। লুচিগুলোর ফুলকো ভাব উধাও। দিদির মুখ ভারী। নির্ঘাত রাগ করেছে।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা। আমি দি আমার ভাইকে ফোঁটা। প্রান্তিকের কপাল ছুঁয়ে তার দিদির অভিমানী আঙুল। হোশেনারার আঙুল ঠিক এইখানেই তো রাখা ছিল। ফোঁটাদুটো মনে হয় মিশে গিয়েছে। আর লুকোতে হবে না। কপালে হাত দিয়ে হোশেনারা ভুল করে বলেছিল, যমুনার গায়ে পড়ল কাঁটা। মনে পড়তেই প্রান্তিক মুচকি হাসল।
— অ্যাই ফাজিল হাসছিস কেন রে? দেরি করে এসে আবার ফিচলেমি হচ্ছে।
তফজ্জুল আশরফ নিশ্চয়ই এখনও ওই ঘরে। কদরপিয়া ঠুমরীতে বিভোর হয়ে আছেন। আর হোশেনারা—
প্রান্তিক দেখল জ্যেঠিমা মন্ত্র পড়তে পড়তে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিচ্ছে সারা ঘরে। তখনই খেয়াল করল, তাড়াহুড়োয় হোশেনারাকে আশীর্বাদ করতেই সে ভুলে গিয়েছে।
শঙ্খদীপের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে। বেড়ে ওঠা সেখানেই। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে গণিতের স্নাতক। স্নাতকোত্তর কম্পিউটার বিজ্ঞানে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ পরিষেবা সীমার বাইরে ‘ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ বইমেলায়। ছোট গল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে সমাজ ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে থাকেন।