| 28 মার্চ 2024
Categories
ঈদ সংখ্যা ২০২০

আঁধার কিংবা সূর্যনদী

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
উদভ্রান্ত হাওয়াকে ঠিক মাঝখানে ভাগ করে ছুটে চলছে গাড়িটা। দু’পাশের সারি সারি গাছগুলো অনবরত পেছনদিকে দৌড়ে গাড়িটাকে জিতিয়ে দিতে চাইছে সুপরিকল্পিত ভাবে। পাপড়ি বসে আছে কিঙ্করের পাশে, ফ্রন্ট সিটে। অনেকদিন বাদে এরকম হলো। মাঝে মাঝে কিঙ্করকে আড়চোখে দেখছে পাপড়ি। গাড়ির গতি বাড়ছে, তার সাথে কিঙ্করের অস্থিরতা। প্রায় মিনিট দশেক হলো কিঙ্কর একটা ঢাউস সাইজের মালবাহী ট্রাকের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে। কখনো ট্রাক এগিয়ে যায় আবার কখনো কিঙ্করের গাড়ি। ওর এই এক স্বভাব, সবকিছুতেই অস্থির। সবকিছুতেই বেপরোয়া। কিঙ্কর অবশ্য বিশ্বাস করে এই বেপরোয়া ভাবটাই ওকে জিতিয়ে দেয় রাজার মতো। জীবনকে জয় করে নেবার ওর বাজী হলো এই বেপরোয়া ভাব। কিন্তু পাপড়ি জানে মজ্জায় মজ্জায় মিশে থাকা এই বেপরোয়া ভাবটাই কিঙ্করের সবচেয়ে অন্ধকার দিক। এজন্যই জিতে গিয়েও কিঙ্কর আজ অন্ধকারের মতো নিঃসঙ্গ। গাড়ির ঠিক গাঁ ঘেষে এবার এগিয়ে গেলো ট্রাকটি। আচমকাই এক্সিলারেটরে পায়ের চাপ পড়ায় গাড়িটি ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস শব্দ করে উঠলো। পাপড়ি নিঃশব্দে নিজের আতঙ্ক গিলে ফেললো। এরপর প্রায় ফিসফিস করে বললো, এভাবে কেউ ড্রাইভ করে? সেই শব্দগুলো অবশ্য ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস আওয়াজের কাছে বিনা দ্বিধায় আত্মসমার্পন করলো, কিঙ্করের অজান্তে।
‘ধুর’ ট্রাকটির কাছে হেরে যাওয়ায় ততক্ষণে কিঙ্কর প্রচন্ড বিরক্ত। এবার সে বাতাসকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে ছুটতে লাগলো। পাপড়ি এবার আর আড়চোখে নয়, সরাসরি তাকালো কিঙ্করের দিকে। মাপতে চাইলো কিঙ্করের আচরণকে। কিঙ্কর কী আজ দিনের বেলায় ড্রিংক করেছে? হ্যাঁ, কিঙ্কর প্রায় প্রতিরাতেই ড্রিংক করে। আসলে ড্রিংক করার পর প্রতি মুহূর্তে নিজের বদলে যাওয়া অনুভব করতে ভালবাসে কিঙ্কর। দু’এক গ্লাস শেষ করার পর তার মনে হয় সে আস্তে আস্তে নির্ভার হচ্ছে। এর আরোও পরে মনে হয় সে ভাসছে। একদম শেষে সে উড়তে থাকে। সব অন্ধকার ছাপিয়ে সে উড়ে যায় দুরের একবিন্দু রঙিন আলোর দিকে। এই যে ভাসতে থাকা, উড়তে থাকা, অন্ধকার ফেলে রঙিন আলোর দিকে ছোটা—-এই অনুভূতিগুলোর জন্যই কিঙ্কর ড্রিংক করে। 
পাপড়িকে অবাক করে দিয়ে হঠাতই গাড়ির গতি কমিয়ে দেয় কিঙ্কর। মুখটা সরাসরি পাপড়ির দিকে ফিরিয়ে প্রশ্ন করে,
‘ভয় পাচ্ছো?’
আর তখনি রাজ্যের সব বিতৃষ্ণা এসে জড়ো হয় পাপড়ির মনে। কিঙ্করের এই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য সারাজীবন অপছন্দ করে এসেছে সে।নিজের অস্বস্তি বিসর্জন দিয়ে খুব ঠান্ডা স্বরে বলে,
‘না। কতদূর পৌঁছালাম?’
ওরা ততক্ষণে বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যার বেলাভূমিতে। আকাশ রঙ বদলে নিয়েছে কিছুক্ষণ। কোবাল্ট ব্লু রঙে তখন মিশে গেছে রক্তজবার লালরঙ। নিঃশেষিত দিনের মোৎজার্ট তখন বেজে চলছে প্রকৃতিতে। এতই সুদিং চারপাশের প্রকৃতি যে এরমাঝে এই বেপরোয়া ছুটে চলা খুবই বেমানান। কিঙ্কর তা বুঝতে পেরেই হয়তো গাড়ির গতি কমিয়েছিলো অল্প সময়ের জন্য। এরপর দপ করে নিভে আসা সন্ধ্যাটুকু অন্ধকারের গহ্বর নিয়ে ছুটে এলো ওদের দিকে। মনে হলো গিলে ফেলবে। কিঙ্কর বাড়িয়ে দিলো গাড়ির গতি। কতদূর পৌঁছালো, এই প্রশ্নের উত্তর নেই কিঙ্করের। বা ইচ্ছে করেই জানার চেষ্টা করেনি কিঙ্কর। কারণ কিঙ্কর শুধু জানে ছুটতে। ছায়াপথের মতো অনন্ত পথ ধরে ছুটতে জানে। ঠিক কোথায় থামতে হবে তা ভাবেনি কখনো। তবে আজ অনন্ত পথ ধরে ছুটলে হবে না। আজ কিঙ্করকে থামতে হবে। রিভু হাসপাতালে অপেক্ষায় আছে ওদের।পাপড়ি অন্ধকার ঠাওরে আন্দাজ করতে চায়, আর কত পথ বাকী। তবে নিজের মনেই হুট করে হেসে ওঠে পাপড়ি। পথিক হয়ে পথের হিসেব করে আর কী লাভ!
আর কতসময় লাগবে?
কথাটা কিঙ্করকে নাকী নিজেকে বলেছে, তা ঠিক বুঝতে পারে না পাপড়ি। তবে গাড়ির ভেতরের সীমিত দূ্রত্ব শব্দগুলো অবলীলায় পৌছে দেয় কিঙ্করের কাছে।
খুব বেশী সময় নয়, সময়ের আন্দাজ তাই তো বলে… কিঙ্কর সামনের চাপ চাপ অন্ধকারে চোখ রেখে বলে।
পরের কিছু সময় শুধুই নীরবতার। গাড়ির উইনশিল্ডে একটা দুটো তারার ঢেউ আর অন্ধকার ভেদ করা হেডলাইটের তীব্র আলোয় কিঙ্কর আর পাপড়ি একটু একটু করে এগোয় সামনের দিকে। ওরা পৌছে যায় ঠিক ভোরের মুখে। 
হাসপাতালের খুব কাছেই একটি হোটেলে চেক ইন করে। এই শহরে ওরা আগেও এসেছে। তবে পরিচিত শহরে আজ ওরা এসেছে খুব অপরিচিত পরিস্থিতিতে। সবচেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপার হচ্ছে ওদের দু’জনকে খুব কাছের মানুষ হবার ভান করতে হচ্ছে। এই অস্বস্তিটুকু ঘুণ পোকার মতো কুটুর কুটুর করছে মনের ভেতর।যদিও রিভু জানে সবটা। তবুও ওরা ভান করে যাচ্ছে অবলীলায়। আর এই অনিচ্ছাকৃত ভান পাপড়ির ভেতরে নোনাস্রোতের ধারা নামায়। নিজেকে বিপন্ন মনে হয় ওর। 
তোমরা একসাথে এসেছো?
রিভুর এই প্রশ্নে কিঙ্করের বেপরোয়া উত্তর,
‘তা না করে উপায় ছিল? তোমার যে কোনো প্রয়োজন আমাদের সব অপারগতার উর্ধে।’
রিভু কী একটু হাসলো? পাপড়ি মনোযোগ দিয়ে রিভুকে দেখে।
সারাদিন দুরত্ব বোজায় রেখে রিভুর সামনে কাছের মানুষ হবার ভানটুকুর জন্য কিন্তু ওদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয় না!
মাঝেমাঝে পাপড়ি দ্বিধায় পড়ে যায় তো মাঝেমাঝে কিঙ্কর। দু’জনেই এক মুহূর্তের জন্য হলেও দু’জনের দিকে প্রশ্নের চোখে তাকায়।
‘তুমি কী এখন ভান করছো?’
এই প্রশ্নটির অবশ্য কোনো অবকাশ থাকার কথা ছিল না ওদের জীবনে। পাপড়ি আর কিঙ্কর দু’জনেই খুব স্পষ্ট ছিল নিজের অবস্থানে। আগাগোড়াই কিঙ্কর বেপরোয়া। আর বেপরোয়া ভাব দিয়েই সে আমূল কব্জা করেছিলো পাপড়িকে। বাড়ির কাউকে তোয়াক্কা না করেই বিয়ে করেছিলো পাপড়িকে। আর পাপড়িও বেপরোয়া কিঙ্করে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো যে প্রগাঢ় প্রেমের তুমুল দিনের আহবানে বিনা দ্বিধায় পা বাড়িয়েছিলো কিঙ্করের জীবনে। প্রেমঘোরের সেই দিনগুলোয় ওরা বুনে গেছে কেবল অনিন্দ্য ভবিষ্যতের স্বপ্ন। দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ তখন ওদের দিনগুলো। আহ্লাদী সে সময় ওদের দু’জনকে সুখানুভূতিতে ভরিয়ে রেখেছিলো। তখন ওরা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি আলোর ঠিক ওপাশে এক বিশ্রী অন্ধকার অতল রাক্ষুসী হাঁ নিয়ে ওদের জন্য অপেক্ষায় আছে। প্রথম এক টুকরো অন্ধকার সেদিন ছুটে আসে যেদিন পাপড়ি চাকরীর এ্যাপোয়েন্টম্যান্ট লেটার এনে কিঙ্করের হাতে দিলো।
‘চাকরী করার সিদ্ধান্ত কবে নিলে? আমাকে আগে কিছু জানাওনি কেনো?’
বলতে বলতে একটা অদ্ভুদ ছায়া খেলে গেলো কিঙ্করের চোখেমুখে।
সে ছায়ায় অজানা পাপড়ি একটু হেসে বলে,
‘তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছিলাম।’ 
এরপর থেকে অনন্তবার সেই অদ্ভুত ছায়া খেলে গেছে কিঙ্করের চেহারায়। কখনো অফিস থেকে ফিরে পাপড়িকে বাড়িতে না পেয়ে, আবার কখনো অফিসের ট্যুরে পাপড়ির যাবার কথা শুনে। তবে সেই অদ্ভুদ ছায়া এক তীব্র অন্ধকার হয়ে আছড়ে পড়লো সেদিন, যেদিন পাপড়ি প্রেগন্যান্সির ঘোষণা দিলো।
‘এবার চাকরীটা ছেড়ে দাও।’
আসন্ন সন্তানের খবরে রীতিমতো  অভিভূত তখন কিঙ্কর। তাই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইলো না।কিঙ্করের এই অসংলগ্ন কথাকে নিজের প্রতি ভালবাসা ভেবে আহ্লাদে ডুবে যায় পাপড়ি।
‘তুমি ভেবো না। আমি সাবধানে অফিস করবো।’
এবার কিছুটা হুকুমের সুরে কিঙ্কর বলে,
‘বলেছি তো ছেড়ে দাও। এটা নিয়ে কথা বাড়িও না।’
হঠাৎ একটা ধাক্কা খায় পাপড়ি। নিজের ভেতরে বিদ্রোহ হয়।
‘তুমি আমাকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছো?’
কিঙ্কর ঠিক স্পষ্ট শব্দে বলে,
‘হ্যাঁ’
আর ঠিক তখনি সেই অদ্ভুত  ছায়াটা প্রগাঢ় অন্ধকার হয়ে এসে দাঁড়ালো দু’জনের মধ্যে। তবে কিঙ্করের কথায় শেষ পর্যন্ত চাকরী ছাড়েনি পাপড়ি।  বরং একটু একটু করে সেই অন্ধকার, অতল খাদের রূপ নিয়েছে ওদের জীবনে। যার কিনারে দাঁড়িয়ে পাপড়ি দেখেছে কিঙ্করকে অতলে হারিয়ে যেতে।
রিভুর সামনে যতই ভান করুক, হোটেল রুমে এসে ওরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়।পাপড়ি ব্যস্ত হয়ে পড়ে অফিসের প্রয়োজনীয় কিছু মেইল চেক করতে। আর কিঙ্কর কিছু সময় নিজের বিজনেসের খোঁজ খবর নিয়ে ফিরে যায় সেই বেপরোয়া সময়ে। যে সময়ে সে উড়তে পারে মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে। প্রবল ভানহীন সময়টুকু ওদের। তবে এই সময় প্রলম্বিত হবার সুযোগ পায় না। তার আগেই বিপন্ন এক সময়ে পৌঁছে যায় ওরা। সময়ের বিপন্নতা কতটা ভয়াবহ হবে, তার আঁচ অবশ্য আগে থেকে ছিল না ওদের।
‘কতদিন চলবে এই লকডাউন?’
রিভুর জন্য নতুন কিনে আনা কিছু  ড্রেস গোছাতে গোছাতে কথাটা বলে পাপড়ি। 
কিঙ্করের ছোট্ট উত্তর,
‘সপ্তাহ দুয়েক।’
কী জানি কেন পাপড়ির ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। রিভুর জন্য কষ্ট হয়। রিভু, কিঙ্করের বোনের মেয়ে। কিন্তু পাপড়ির কাছে ও নিজের সন্তানের মতোই। বা তারও বেশীকিছু। পাপড়ির জীবনে রিভু এসেছে খুব বিপর্যস্ত সময়ে। তখন সবে মিসক্যারেজ হয়েছে পাপড়ির। পাঁচমাস ধরে বুনে চলা স্বপ্নটা অফিস ফেরত পাপড়ির হাত ফস্কে একদিন আচমকাই হারিয়ে গেলো। খুব বেশীকিছু মনে পড়ে না পাপড়ির। শুধু মনে আছে, অফিসের গাড়ি থেকে নেমে সেদিন ও খুব ধীরেই তিনতলার সিঁড়ি ভাঙছিল। প্রথমে খুব মৃদূ এরপর হঠাৎ করেই পৃথিবীর সমস্ত ব্যাথা এসে জড়ো হলো ওর তলপেটে। ব্যাথায় বিবশ হয়ে আসে ওর পা দুটো। এরপর উটকো এক অন্ধকারের স্রোত এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ওকে। আর কিছু মনে পড়ে না পাপড়ির।
অন্ধকার সময়ের পর যখন হাসপাতালের সাদা আলোয় ও চোখ মেললো, তখন ব্যাথাটা সারা শরীরজুড়ে। তখনো পাপড়ি জানে না, ওর পাঁচমাসের স্বপ্ন বিসর্জন হয়ে গেছে কিছু আগেই। এর অল্প সময় পরেই কিঙ্কর এসেছিলো পাপড়ির বেডের পাশে। কিছু সময়ের জন্য। শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিল পাপড়ির দিকে। পাপড়ি খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে।  বুঝে গিয়েছিলো এই শূন্যতা ওদের জীবনে সংলগ্ন হয়ে গেছে সবার অলক্ষ্যে। এদিনের পর কিঙ্কর একটু একটু  সরে গেছে পাপড়ির কাছ থেকে আর রিভু একটু একটু করে আপন হয়েছে পাপড়ির।
সেই শূন্য সময়ে বছর তিনেকের রিভুই ছিল পাপড়ির একমাত্র সঙ্গী। এরপর একদিন কিঙ্করকে ছেড়ে চলে এসেছিলো পাপড়ি। ঘুণে খাওয়া সম্পর্ক থেকে অবসর নিয়েছিলো স্বেচ্ছায়। কিন্তু রিভুর সাথে যোগাযোগটা থেকেই গিয়েছে। বছর দশেক পরে রিভু এখন তের বছরের কিশোরী। কিন্তু এই কৈশোরেই এক দুর্মর বিশ্রী রোগ ওকে আক্রান্ত করেছে। লিউকেমিয়া, ডাক্তার বলেছেন বড় জোর কয়েক মাস। এটা সবাই যতই লুকিয়ে রাখুক কিন্তু রিভু ঠিক বুঝে গিয়েছে। তাই শেষ ইচ্ছা, পাপড়ি মা আর কিঙ্কর মামাকে একসাথে দেখতে চাওয়া। কলকাতার এক হাসপাতালে চলছে রিভুর চিকিৎসা। আর ঠিক এ কারণেই পাপড়ি আর কিঙ্কর এতদিন পর একসাথে এসেছে এই পরিচিত শহরে, এক অপরিচিত সময়ে। দু’দিন থেকেই চলে যাবার কথা ওদের। কিন্তু এরমধ্যেই শুরু হয়ে গেলো কোভিড-১৯ এর দিন।
লকডাউনে বন্দি হয়ে পড়লো ওরা। এ বড় ভয়ংকর শাস্তি ওদের জন্য। একে তো দীর্ঘদিনের অভ্যাস বিরতীতে দু’জনেই আড়ষ্ট। তার উপর এই ভানহীন একাকিত্ব।লকডাউনের প্রথম দু’একদিন দু’জন প্রায় বিনা কথায় পার করলো। কিন্তু এরপর ক্রমেই তা অসহ্য হয়ে উঠলো। নীরবতায় হাঁসফাঁস করতে লাগলো ওদের ভানহীন সময়গুলো। তবে খুব তাড়াতাড়িই সময়ের উলটো স্রোত ধীরে বইতে শুরু করলো।
‘তুমি, আগের চাকরীতেই আছো?’
বা
‘তোমার ব্যবসা এত ছড়িয়েছো কেন? একা সামলাতে পারো?’
পুরোনো সময়ের জলস্রোত একটু একটু করে ভিজিয়ে দিতে থাকলো ওদেরকে।বাইরে কোভিড-১৯ এর তান্ডব, মৃত্যু জিতে যাচ্ছে জীবনকে হারিয়ে আর হোটেল রুমে বন্দি ওদের আতংকিত সময়। বিষন্নতা মগ্ন সেই মুহূর্ত একটু একটু করে ভাঙছে দু’জনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা পাথর সময়।
‘তুমি ইদানিং অনেক বেশী ড্রিংক করো’
অথবা
‘তুমি একদম পাল্টাওনি। এখনো কাজের সময় গুণগুণ করে গান গাও।’
কিংবা
‘তোমার মনে আছে, বিয়ের পর প্রথমদিন একসাথে জ্যোৎস্না দেখার নাম করে তুমি বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছিলে।’
আজো ভীষণ আকুতিতে সেই অনেক আগের সময়ের ভাঁজ, তরঙ্গ ওদের মনকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। 
চারপাশের সীমাহীন অনিশ্চয়তা হোটেল রুমে এসেই পরিব্যাপ্তি হারিয়ে ফেলে। যেন বিপর্যস্ত সময় মিহি রোদেরও অধিক কিছু হয়ে ওদের জীবনে আসন পাতে। সামনে যেন অযুত নক্ষত্রের কলরোল। ফুরিয়ে যাওয়া স্বপ্ন কুড়ানো দিন প্রচন্ড উচ্ছ্বাস নিয়ে আছড়ে পড়তে থাকে ওদের জীবনে। লকডাউনের কুৎসিত সময় মেরুদণ্ডহীন প্রাণী হয়ে আটকে থাকে হোটেল রুমের দরজার ওপাশে। প্রথমে অবশ্য কিঙ্করই সব ভান ঠেলে এগিয়ে যায় পাপড়ির দিকে। প্রথম দিনের মতো ঘোর আছন্ন হয়ে এগিয়ে যায় সে। পাপড়িও একটু একটু করে প্রসারিত করে হাত। করোটিতে আবদ্ধ করে কিঙ্করের বেপরোয়া আহবান। উলটো স্রোতের মহাসমুদ্র ওদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ভানহীন এক সুন্দর সময়ের দিকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত