জলপ্রপাতের দেশে
ভ্রমণকাহিনী লেখার ক্ষেত্রে বিমান যাত্রা একটা বাধাই বটে। চট্টগ্রাম থেকে কোলকাতা হয়ে রাঁচি পৌঁছে যাই ১৮ জানুয়ারি দিনে দিনেই। ইন্ডিগোর বিমানের ভেতরের হঠাৎ ছড়িয়ে পড়া দুর্গন্ধ মনে না পড়লে উল্লেখের তেমন কিছুই থাকে না।
১৯ জানুয়ারি সকালে উঠেই রিমস্ অডিটোরিয়মের দিকে দৌড়। দীপ জ্বেলে শুরু হয় সিএমই (কন্টিনিউড মেডিকেল এডুকেশন)। থাইরয়েড গ্রন্থির রস টানতে টানতে ছিবড়ে বের করার যখন সময় সমাগত, আমার ডাক পড়লো। কোনোমতে বক্তৃতা দিয়ে শেষ করলাম। মন পড়ে আছে কখন দেখবো অপরূপ সৌন্দর্যের পীঠস্থান এই রাঁচি।
সিএমই-তে আমার বক্তৃতা শেষ করেই উদ্যোক্তাদের ত্যক্ত করে তুললাম একটি গাড়ির ব্যবস্থা করার জন্যে। দুপুরের সুস্বাদু খাবারের আয়োজন নিজ চক্ষে দেখেও দুপুর একটায় বেরিয়ে পড়লাম। কবি মৃদুল দাশগুপ্ত পরামর্শ দিয়েছিলেন রাঁচি গেলে দুটো জায়গায় যেন অবশ্যই যাই। ট্যাগোর হিল আর হুন্ড্রু ফলস্। গাড়িকে বললাম সরাসরি হুন্ড্রু যাব। ড্রাইভার জানালেন ১ ঘন্টার পথ। আমি আশেপাশের প্রকৃতি ও মানুষ দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। রাঁচি ঝাড়খণ্ডের রাজধানী। তবে বেশ ছিমছাম।একসময় ঝাড়খণ্ড বিহারের অংশ ছিল। এখন নতুন রাজ্য। তবে অনেক বাংলা ভাষীও দেখলাম। নতুন জায়গা মানেই একটা আলাদা সৌন্দর্য। এই অচেনা জনপদের এবং অজানা প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে এগুচ্ছি। কিন্তু আমার বুঝা উচিত ছিল, ১ঘন্টা পথ গাড়িতে গেলেও ঝরনার পাদপ্রান্তে পৌঁছাতে হলে আরো ৪০ মিনিটের ভয়াবহ কসরতে ডিঙোতে হবে বিশাল বিশাল সব পাথরের স্তুপ, যার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে বরফ শীতল জলের ধারা।
হুন্ড্রুর কাছে যাবার দুটো পথ আছে। একটি উপর থেকে প্রায় দেড়শ ধাপ সিঁড়ির তুল্য পাথর মাড়িয়ে নামতে হবে, অপরটিতে গাড়িনিচে পৌঁছে দেবে, তবে বেশ কিছুটা পথ পাথর ডিঙিয়ে ঝরনার নৈকট্য পাওয়া যাবে। সময়ের কথা ভেবে ২য় পথটি বেছে নিলাম।ভাবলাম ২ মিনিটে পৌঁছে যাব। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমেই অনুধাবন করলাম যে বেশ বিপদসংকুল সে পথ। কোথাও বিশাল ঢালুপাথর, কোথায় সুন্দর সমতল বিশিষ্ট অথচ পিছল পাথরের চাঁই। কখনো হাঁটু ধরে আসে, আবার কখনো ধরার কোনো অবলম্বনই নেই। এক অদ্ভুত বুনো পাথুরে পর্বতের অতলে যেন চরে বেড়াচ্ছি। কোথাও ছোট ছোট পিকনিক গ্রুপ রান্নার আয়োজনে মগ্ন, কোথাও নিরিবিলি পরিবেশে একাত্ম কপোত-কপোতীর যুগল হয়তো গুনগুন করছে “কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা”।
আমিও যেন হারিয়ে গেলাম হুন্ড্রুর বুনো পাথুরে প্রান্তরে।পাথর পেরুতে পেরুতে দেখলাম একটা জায়গায় বেশ বড়-সড় উঁচুপাথরের গা বেয়ে ঝপঝপ করে নেমে আসছে জল প্রচন্ড বেগে। ৩-৪ জন তরুণ সেই প্রচণ্ড জলবেগের সাথে সমান উচ্ছ্বাসে পাল্লাদিয়ে স্নানে মগ্ন। আমি জুতো খুলে জলে নেমে দেখি এমন শীতল সে জল যে পা অবশ হয়ে আসছে। বেশীক্ষণ পা জলে ডুবিয়ে রাখতে পারলাম না। অথচ সেই জলে এই তরুণেরা দীর্ঘসময় স্নান করে চলেছে। সে কি উচ্ছ্বাস তাদের! এভাবে একসময় পৌঁছে গেলাম ভয়াল সুন্দর হুন্ড্রুর তলায়। এই শীতেও তার জলের কমতি নেই। তবে, জানলাম বর্ষায় তার কল্লোল অভাবনীয় হয়ে থাকে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। এক সুবিশাল জল প্রপাতের তলদেশে বিপুল জলস্তম্ভের সামনে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনেহলো, তুচ্ছ মনে হলো। বাক্যহীন চিন্তাহীন সময়গুলো শুধু নিষ্পলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই পার করে দিলাম এই বিস্তীর্ণ প্রস্তর স্তুপের মধ্যে বসে।
তারপর একসময় ফিরতিপথ যখন ধরলাম, বুঝতে পারি, আবেগের উচ্ছ্বাসে যে দুর্গম পথ পাড়ি জমিয়েছিলাম, এখন ক্লান্ত পায়েতা অতিক্রম যেন ভীষণ দুরূহ। তবু এক সময়ে পথ তো ফুরায়, যেমন ফুরিয়ে আসছে জীবনের পথচলা…
যাই হোক, সময় অনেক পেরিয়ে গেল। দ্রুত ফিরতে হবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। খাওয়া দাওয়া হয়নি। পথে থেমে মধ্যাহ্ন ভোজন সারতেই হলো। সন্ধ্যায় স্যাক কনফারেন্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। স্যাক-এর সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে আমাকেও উপস্থিত থাকতে হবে। ড্রাইভারকে তাড়া দিতে লাগলাম। কিন্তু যখন পৌঁছালাম তখন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।চারিদিকে সিকিউরিটির কড়াকড়ি দেখে হকচকিয়ে গেলাম। তার মধ্যেই হলে ঢুকে দেখি যারা মন্চে যাবার তারা মঞ্চ আলোকিত করে বসে আছেন। বিভ্রান্ত বোধ করছিলাম কী করা যায়। একজন আমাকে বললেন, “আপনাকে তো মঞ্চে ডেকেছে, চলে যান মন্চে তাড়াতাড়ি”। আমিও হুড়মুড় করে মঞ্চে উঠে পড়ি। কিন্তু সিট খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হলো। পরে দেখি। একটা খালি সোফার সামনে টেবিলে আমার নাম লেখা দেখে বসে পড়লাম। ভ্রমণ শেষে আনুষ্ঠানিকতার জন্যে রাখা জামাকাপড় আর পড়া হলো না। দেখি একপাশে সে রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব, আরেক পাশে আয়োজক চক্রের সম্পাদক। আর তাঁদের কাছ থেকে চিনে নিলাম রাজ্যের গভর্নর আর স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে। যাই হোক, আমার এবেলায় বক্তৃতা যে আমার মন মতো হলো না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে চারদিকের করতালি আমাকে বেশ আস্বস্ত করেছে।
২০ জানুয়ারি ২০১৮
আজ আমার বক্তৃতা স্যাক একাডেমি ওরেশান। স্যাক মানে সাউথ এশিয়ান একাডেমি অব সাইটোপ্যাথলজি এন্ড হিস্টোপ্যাথলজি। একাডেমি ওরেশান দেওয়া একটা বিরল সম্মানজনক ব্যাপার বটে। এখানকার লোকজন মনে হয় সকালে কিছুটা আলসেমির মধ্যে দিন শুরু করে। বক্তৃতাপর্ব শুরু হতেই ১ ঘন্টা দেরি হলো। আর আমার ১ ঘন্টার ভাষণ। ব্রেস্ট ক্যান্সার গবেষণা ও রোগ নির্ণয়ের অগ্রগতি নিয়ে নিজের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে কিছু কথা বললাম। বেশ প্রশংসিত হলো বক্তৃতা। তবে বিদেশে গেলে আমার মন পড়ালেখায় একদম বসে না। তাই যত দ্রুত পারলাম, বেরিয়ে এলাম কঠিন কঠিন গবেষণা বিষয়ক আলোচনার হলরুম থেকে।
গাড়ি যোগাড় করে ছুটে গেলাম “দশম ফলস্”-এর দিকে। এর নামকরণের হেতু — তার ১০টি ধারা।তবে এই শীতে প্রবাহিতহচ্ছে মাত্র ৫টি ধারা। বর্ষায় এর পরিপূর্ণ রূপে প্রপাতটিকে দেখা যায়। কিন্তু যা দেখলাম তাতেই মন ভরে গেল। এই প্রপাতের কাছেযাবার পথ হুন্ড্রুর মতো দুরূহ নয়। তাই এখানে ট্যুরিস্টের আধিক্য বেশি; দোকানপাটও অনেক। আমি বেশ তরতরিয়ে নেমেপড়লাম দশম ফলস্-এর তলায়। তারপর পাথুরে গা বেয়ে বেশ সহজেই জলধারাগুলোর বেশ কাছে পৌঁছে গেলাম। রিমসের পিজি ছাত্র ডা. শহীদ আনোয়ার আমাকে সঙ্গ দিয়েছিল।
২১ জানুয়ারি ২০১৮
কিছুটা আলসেমি নিয়ে সকাল শুরু করলাম। আজ আমার কোনো বক্তৃতা নেই।টার্গেটের মধ্যে প্রথম বক্তৃতাটি শোনার ইচ্ছে আছে। সাড়ে নটায় হলে পৌঁছে দেখি বক্তৃতা শুরু হয়ে গিয়েছে। সে বক্তৃতা শেষ হলে পরের যে বক্তৃতাগুলো শুনবো ভেবেছি সব দেখলাম লাঞ্চের পরে। পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্র সুনীলকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ট্যাগোর হিল দেখতে। রাঁচির জনবসতির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে উঁচু জায়গাটি জোড়াসাঁকোর জমিদার নন্দন সংস্কৃতিসেবী সাহিত্যানুরাগী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ দখলে রেখেছিলেন। এখানে বিদ্যোৎসাহী কাদম্বরী দেবী দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন তাঁর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বেশ কিছু কাল এখানে অতিবাহিত করেন, যখন কাদম্বরী দেবী তাঁর কাব্য প্রতিভার অনুপ্রেরণা হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নৈকট্য রবি প্রতিভার বিকাশের ভিত্তি হয়ে ওঠে। বলা হচ্ছে শেষ জীবনটা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এখানেই নিরিবিলি কাটিয়ে দিয়েছেন।
যেমন ছিমছাম সেই রাজকীয় বাড়ি, তেমনি আবার তার বনেদী স্টাইল। ২০ বছর হলো রাজ্য সরকার এই পরিত্যক্ত বাড়িটির রক্ষণা-বেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। অবশ্য ঘরের দরজা জানালা তালাবদ্ধ। জানা গেলো, কোনো চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি অনুষ্ঠান হলেই কেবল খুকুমনিদের জন্য দোর খোলা হয়।
বিশাল পাথুরে পাহাড়ের গায়ে বাড়ির আঙিনাটিতে দাঁড়িয়ে যেন জোড়াসাঁকোর বাতাস পাওয়া যায় প্রতিবেশে-পরিবেশে। চূড়ায় যখন উঠলাম, দেখি, পুরো রাঁচি শহর এক লহমায় চোখের সামনে এসে ধরা দিল।
ঠাকুরের পাহাড় থেকে নেমে আবার শহরে যখন পৌঁছালাম, তখন মনে পড়ল শৈশবে দুটি শহর নিয়ে আমাদের ভীষণ আগ্রহ ছিল।বন্ধুদের কেউ উল্টাপাল্টা কথা বললেই সেই শহর দুটিতে পাঠিয়ে দেবার কথা বলা হতো। আপনাদের নিশ্চয় মনে পড়ছেরাঁচি আর পাবনা শহরের নাম। তখনই বললাম সুনীলকে যে, আমাকে সেই বিখ্যাত সাইকিয়াট্রি হাসপাতালের সামনে নিতে যেতে। আপনারা নিশ্চয় বলবেন পাগলা গারদ। আগে তেমনটিই বলা হতো মানুষের মুখে মুখে। যখন পুরনো রাঁচির কাছাকাছি পৌঁছলাম তখন প্রকৃতি শান্ত সৌম্য হয়ে এল। তার একটু পরেই ভারতের প্রাচীনতম মেন্টাল হাসপাতাল সেন্ট্রাল ইন্স্টিটিউট অবসাইকিয়াট্রি; সংক্ষেপে সিআইপি। সুপরিসর ফটক বন্ধ। বন্ধ থাকাটাই স্বাভাবিক। ফটকের দেয়ালে লাগানো আছে প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১৮। এর ভেতরে ঢুকার পূর্ব অনুমতি না থাকাতে বাইরে থেকেই অনুভব করতে চাইলাম কতো বেদনার কতো দুঃখের স্মৃতি জমে আছে এই নিরিবিলি প্রান্তরে।
২২ জানুয়ারী ২০১৮
রাঁচির পাট চুকিয়ে কোলকাতায় নেমেই ছুটলাম হাওড়া রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। হুড়াহুড়ি করে টিকেট কেটে বড় ঘড়ির নীচে দাঁড়াতে হবে। তড়িঘড়ি করে পৌঁছে দেখি কবি মৃদুল দাশগুপ্ত এসে দাঁড়িয়ে আছেন। বলেছিলাম, ট্রেনের ব্যাপারগুলো আমার জটিল লাগে। তাই শ্রীরামপুরে নিয়ে যাবার জন্যে সশরীরে এসে হাজির। চেপে বসলাম লোকাল ট্রেনে। মুড়িভাজা আর গজা চিবাতে চিবাতে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কথার শুরুতেই বললাম পশ্চিমবঙ্গের এই দিকটা আমার দেখা হয়নি। তখন দক্ষ ঐতিহাসিকের মত মৃদুলদা বলে গেলেন কিভাবে ডেনিস কলোনীর এই অঞ্চলটি ভারতীয় ফেডারেশনে যোগ দেয়। জানতে পেলাম ফরাসি অধ্যুষিত চন্দন নগরে গণভোটে ৯% লোক ফরাসি নিয়ন্ত্রণ থেকে ভারতীয় ফেডারেশনে সংযুক্ত হবার বিপক্ষে ভোট দিলে, তারা বংশ পরম্পরায় ফরাসি নাগরিক সুবিধা ভোগ করছেন। তাদের মধ্যে একজন মৃদুলদা’র বন্ধুও আছেন। জানতে পেলাম, এখানকার ইন্দুবতী ভট্টাচার্য বুদ্ধদেব বসুর আগেই সরাসরি ফরাসি থেকে বোদলেয়র অনুবাদ করেছিলেন, যিনি পরে কংগ্রেসের সাংসদ হন। তিনি দেখতে ছিলেন অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর মতো। পরে জেনেছি এই ইন্দুমতী ভট্টাচার্য প্রকৃত-অর্থে বিদুষী। উনি চন্দন নগরের প্রবর্তক নারী মন্দির নামে এক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি কেবল ফরাসি নয়, কিছুটা স্প্যানিশও জানতেন।
আলাপ চলতে চলতে লিলুয়া, বালি, উত্তরপাড়া, রিষড়া পার হয়ে শ্রীরামপুর থামলাম। শ্রীরামপুর শহরের বুক চিরে রেললাইন দূরে ছুটে চলে যায়। রেললাইনের একপাশে গঙ্গার তীরে প্রাচীন শহর, যার পুরনো বাড়িঘর সব ডেনিস গথিকে তৈরি। কিছু ভবনভেঙে ফেলা হয়েছে, কিছু সংস্কার করা হয়েছে, আবার কিছু ভবনের পলেস্তারা খসে ভেতরের ইট বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু নিশ্চিতবুঝা যায়, এসব বাড়িঘর বৃটিশ গথিকের নয়।
রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরলাম গঙ্গার উল্টো দিকের পাড়ে গড়ে ওঠা নতুন শহরের দিকে।এদিকের বাড়িগুলো গত ৬০-৭০ বছরে উঠেছে। রেলস্টেশনের খুব কাছেই মৃদুলদা’র বাড়ি। বৌদি দরজা খুলে দিলেন, চায়ের আয়েজন করলেন। তারপর বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে।
প্রথমেই গেলাম প্রাচীনতম ডেনিস চার্চের সামনে।এই গির্জার প্রধান ফটক, তার কডিবরগা, এমনকি ঝুলন্ত বাতিও ডেনিশ।গির্জার সামনেই একটি ছোট মতন পার্ক। তাতে সাজিয়ে রাখা সাতটি কামান দেখিয়ে মৃদুলদা জানালেন কৈশোরে দেয়ালে বসে বসে তিনি দেখেছেন ডেনিস রাজকুমারী কামানগুলো রং করতে। সেই শিশু রাজকুমারী পরে ডেনমার্কের রাণী হয়েছিলেন। আরোজানা গেল, সিরাজউদ্দৌল্লা যখন ডেনিশদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, তখন এই ক’টা কামান নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে পারা যাবে না বুঝে ডেনিশরা সিরাজকে সাহায্য করেননি। সিরাজ এতে বেশ মনক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। এর পরে এগিয়ে গেলাম আদালত ভবনের দিকে। পরিত্যক্ত আদালত ভবনের স্তম্ভের দিকে তাকালেই তার বুনন যে বৃটিশ আদলে নয়, তা পরিষ্কার বুঝাযায়।
বলা হয়নি, ২২ জানুয়ারি স্বরস্বতী পূজা।এখানে এই দিনে ভ্যানেনটাইন দিবসের মতো তরুণ তরুণীরা ঘুরে বেড়ায়। মৃদুলদা’র বাড়িতে ঢুকার মুখেই একটি পূজা মন্ডপ দেখলাম। যে মেয়েটি মন্ডপের রক্ষণা বক্ষণ করছে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।জানলাম সে বাঙালি হয়ে যাওয়া অবাঙালি। আমার বিস্ময় দেখে, মৃদুলদা আবার খুলে ধরলেন ইতিহাসের ঝাঁপি। শ্রীরামপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার ওপারেই সিপাহী বিদ্রোহ খ্যাত ব্যারাকপুর। এখনো সেখানে সেনানিবাস আছে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় অবাঙালি সৈনিকদের পরিবার পরিজন পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় এখানে। পরে বৃটিশ সরকার তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে যখন জুটমিল স্থাপন করে তাদের কর্ম সংস্থান করে তারা এখানেই থেকে যায়। ১৫০ বছরের সময় বিবর্তনে তারা ধীরে মিশে যায় বাংলার আচার সংস্কৃতির সাথে। তারা বাংলায় ভাবে বাংলায় কথা বলে, এমনকি বাংলার পূজাপার্বণে মেতে ওঠে উৎসবে। তাই যতই বেলা গডাচ্ছে তরুণীরা সেজেগুজে বেরিয়ে আসছে তরুণদের সাথে স্বরস্বতী পূজার আনন্দ মুখরতায়। তাই কোলকাতা শহরের কেন্দ্রে মাড়োয়ারীদের হিন্দি বাৎচিতে যারা মনে করেন বাংলা ভাষা এখানে বিপন্ন তাদের জানিয়ে রাখতে পারি যেমন করে মৃদুলদাও বলেন যে, উন্নত সাহিত্য সংস্কৃতি বাংলা কখনো হিন্দির কাছে বিপন্ন হতে পারে না। বরং যেসব অবাঙালি আগে বা পরে বাংলায় আশ্রয় নিয়েছে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যারা থাকছে তারা বাঙালি হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
তাই দেখছি সারাদিন কলেজ পেরুনো কী কলেজ পডুয়া তরুণ তরুণীরা জোড়া বেঁধে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের অধিকাংশ ইবাঙালি বনে যাওয়া অবাঙালি সিপাহীদের বংশধর।
ঘুরতে ঘুরতে আদালত পাড়া থেকে গঙ্গার ধার দিয়ে আবার শহরের উপকণ্ঠে নিয়ে এলেন কবি। বাড়িতে স্বরস্বতী দিবস উপলক্ষে নিরামিশ আয়োজন থাকাতে আমাদের নিয়ে গেলেন চমৎকার এক রেস্টুরেন্টে। রেস্তোরাঁ মালিক কর্মচারী সকলেই কবিকে খুব ভালবাসেন। এলাকায় তাঁকে সবাই খুব সম্মান ও খাতির করেন, বুঝা যায়। বেশ উপাদেয় খাবার খেয়ে আমরা আবার এগিয়ে গেলাম গঙ্গা ধার ধরে। আগে ইউরোপের মতো করে গঙ্গার ধারে বাগান করা ছিল। এখনো ২০০ বছরের পুরনো ভাঙা রেলিংয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তবে সে ফুলের বাগান অযত্নে মরে আগাছায় ভরে আছে।
এই শ্রীরামপুরকে বাঙালি ভুলতে পারে না। এখানেই ভারতবর্ষের প্রথম ছাপাখানার বিকাশ। একসময় বাংলাসহ ভারতের সব ভাষায় ছাপার জন্যে শ্রীরামপুরের উপর নির্ভর করতে হতো। কাঠ কেটে কেটে হরফ বানানো হতো। আমরা যারা লেটার প্রেসে কাজ করেছি, সীসার হরফ দেখেছি—তারা নিশ্চয় বুঝতে পারবেন কাঠ খোদাই করে “ক্ষ” কিংবা “জ্ঞ” জাতীয় যুক্ত বর্ণের ছাঁচ তৈরি করা কতোটা দুরূহ। আজকের কম্পিউটার প্রিন্ট যুগের তরুণেরা কখনোই বুঝবে না ছাপানোর কাজ সে যুগে কতো বড় বিপ্লবাত্মক ব্যাপার ছিল।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে জুটমিলের চৌহদ্দি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম এক বিশাল সুপরিসর গাছপালায় ঘেরা বিদ্যায়তনের সামনে। দূর থেকে দেখে মনে হলো যেন দাঁড়িয়ে আছি ইউরোপের কোনো রাজ ভবনের সামনে। ভাবতে পারেন? আজ থেকে ২০০বছর আগে ১৮১৮ সনে এই শ্রীরামপুর কলেজ স্থাপন হয়। আর এই কলেজের কারিগর স্বয়ং উইলিয়াম কেরি। এই কলেজ বাংলা তথা ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। সেসময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে কেবল স্নাতক ডিগ্রী দেওয়া হতো। আর এই শ্রীরামপুর কলেজ থেকে থিয়োলজিতে মাস্টার্স ডিগ্রী দেওয়া হতো সে যুগের ডেনমার্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে। এর প্রধান ফটকটি উপহার দিয়েছিলেন ডেনমার্কের রাজা। সেকালে পুরো ঢালাই লোহার তৈরি ফটকটি বানাতে খরচ পড়েছিল ১০০০০ টাকা। কলেজটির প্রাঙ্গনে যখন প্রবেশ করি দেখি নানারকম অচেনা বৃক্ষের ছায়ায় এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়ে আছে। মৃদুলদা বললেন, কেরি ছিলেন একজন বোটানিস্ট, তারও উপরে এক অসাধারণ সংগ্রাহক। তিনি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এসব গাছ সংগ্রহ করে এখানে লাগিয়েছিলেন। এখানে নাকি ইউরোপ আফ্রিকা মালয়েশিয়াসহ নানাদেশের গাছ রয়েছে। প্রথমদিকে এসব গাছের নাম ও বৈজ্ঞানিক নাম লাগানো থাকলেও এখন আর তার চিহ্ন দেখলাম না। আহা, আমাদের রোবেন থাকলে ধরে ধরে গাছগুলোর নাম হয়তো জেনে নিতে পারতাম। মৃদুলদা তো যুলজির ছাত্র।
মজার ব্যাপার হলো, সাহেবরা ‘শ্রীরামপুর’ উচ্চারণ পারতেন না। তাই শ্রীরামপুর ইংরেজিতে Serumpore হয়ে গেল।
শ্রীরামপুর কলেজের বৃক্ষশোভিত প্রান্তর ছেড়ে যখন আবার গঙ্গার ধার ধরে ফিরছিলাম তখন কিছুটা ঠান্ডা লাগছিল। সোয়েটার মাফলার এনেছিলাম ঠিকই, তবে তা মৃদুলদা’র বাড়িতে রেখে এসেছি। দাদা টের পেয়ে নিজের গা থেকে জ্যাকেট খুলে পরতে দিতে চাইলেন। এতো আন্তরিক সে আহবান। তবে অবশ্য তাঁর ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা হেতু আমি। জ্যাকেট নিলাম না। দাদা দেখালেন গঙ্গার ওই তীরে বৃক্ষাচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ব্যারাকপুর সেনানিবাস। মনে পড়ে ১৮৫৭ সালে এখানেই দানা বেঁধেছিল সিপাহী বিদ্রোহ। আমরা এগিয়ে যেতে যেতে মনে পড়তে লাগল সেইসব কথা। মনে পড়ল মঙ্গল পান্ডে ও তার ফাঁসীর কাহিনী। কার্তুজে শুকর ও গরুর চর্বি ব্যবহারের অভিযোগ ইত্যাদি অনুষঙ্গ টেনে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল এই ব্যারাকপুরে অল্প সময়ের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ভারতে। মৃদুলদা’র কাছে জানলাম তাঁর শৈশবে ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁদের মাথার উপর দিয়ে বাড়ির উপর দিয়ে ছুটে যাওয়া গোলগুলির রোমহর্ষক সব কাহিনী। তিনি নিজ চক্ষে দেখেছেন ভূপাতিত পাকিস্তানী বিমানের টুকরো যার গায়ে চাঁদ তারা সুসজ্জিত। শুনতে শুনতে ফেরি পারাপারের টিকিট কেনা হয়ে গেল। আমাদের ফেরি যখন গঙ্গা অতিক্রম করছে তখন মৃদু বাতাস থাকলেও তেমন শীত অনুভব করলাম না। যেন মঙ্গল পান্ডে আর সিপাহী বিদ্রোহের উত্তাপ গায়ে এসে লাগছিল। যখন ব্যারাকপুরে ফেরি ভীড়েছে, ততক্ষণ সন্ধ্যা হয়েছে। অন্ধকারে যেন ভূতুরে আলোয় ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সেই বহু প্রতীক্ষিত স্তম্ভের দিকে। যাতে লেখা আছে মঙ্গল পান্ডের নাম। এখানেই ফাঁসীতে ঝুলানো হয়েছিল সেদিনের স্বাধীনতা সংগ্রামী মঙ্গল পান্ডেকে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ বাক্যরহিত হয়ে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর সম্বিত ফিরতে দেখি দাদা ডাকছেন। সিপাহী বিদ্রোহের সূতিকাগারে পা পড়লো আজ সূর্যসেনের দেশের এক সন্তানের। এ আমার পরম অর্জন। ফাঁসীস্তম্ভের প্রতি নীরব স্যালুট জানিয়ে মৃদুপায়ে হেঁটে গেলাম লোকালয়ের দিকে। গাঢ় গভীর বৃক্ষছায়ায় বাড়ি ঘর গুলো নিরিবিলি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবগুলো সেনানিবাসের ঘর—হয়তো কোয়ার্টার বা বাসা, হয়তো অফিস ঘর। বাইরে থেকে বুঝার জো নেই। প্রধান সড়ক দিয়ে লোক চলাচলে কোনো বাধা নেই।কিছুদূর গিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
সেই মধ্যদুপুর থেকে আমার জন্যে শ্রীরামপুর থেকে হাওড়া হয়ে আবার শ্রীরামপুরে এসে সারা শহর চক্কর দিয়ে ব্যারাকপুর পর্যন্তঘুরে কিছুটা ক্লান্ত নিশ্চয় মৃদুলদা। কিন্তু তার কোনো প্রকাশ তার মুখ ভঙ্গিতে নেই।তবু জানতে পেলাম, চারবছর আগে তাঁর হৃৎপিন্ডে পেসমেকার বসানো হয়েছে। তবে তিনি সেসব ভুলে গিয়ে ক্রমাগত ধূম্রসেবন করে চলেছেন। যুক্তি দিতে লাগলেন— ধূমপানে ক্যান্সার হবার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর অসুস্থ হবার যে কাহিনী শুনলাম তা যেন সরলা এরেন্দিরার শতবর্ষের নির্জনতার কোনো অতীন্দ্রিয় গল্প। একদিন তিনি হেঁটে চলেছেন কোথাও কোনো কাজে। হঠাৎ মনে হলো তিনি অনেকতারা দেখতে পেলেন চোখে। সেই তারা দেখতে দেখতে তিনি হেঁটে চলেন সামনের দিকে। তাঁর মনে হতে লাগলো তিনি কোনো ঘনগাঢ় তরলের মধ্যে নেমে যাচ্ছেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে গভীর ঘন তরলে যেন ডুবে যান। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একসময়তিনি কোনো সিঁড়ির ধাপ ভেঙে উঠে এলেন উপরে। তখন তাঁর মাথা টলছে, লোকজন চারদিকে জড়ো হয়ে তাঁর দিকেতাকাচ্ছেন। সবাই জানতে চাইল আপনি এভাবে হেঁটে হেঁটে নর্দমার ভেতরে ঢুকে গেলেন কেন? তিনি জানালেন যে তিনি কোনো মদ্যপান করেননি। তাঁর কেমন যেন মাথাটা ঘুরে উঠেছিল। এরপরে লোকজন তাঁকে একটি বাড়িতে নিয়ে স্নান করিয়ে তারপরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
এই কাহিনী শুনতে শুনতে পৌঁছে গেলাম ফেরিঘাটে। মৃদুলদা’র হাতে সিগারেট। টিকেট চেকার সিগারেট ফেলে দিতে বললেন। ভাবছি, কতো কতো ফেরিঘাটেই না ঘুরলাম। সব জায়গায় দেখেছি এসব অন্চলে লোকজন প্রচুর ধূমপান করে। কিন্তু যুগপাল্টাচ্ছে। মৃদুলদা মৃদু হেসে ফেলে দিলেন ধূম্রশলাকা। তারপর আবার ভেসে যাওয়া গঙ্গার বুকে। ফিরে আসি শ্রীরামপুর—যেন চির চেনা পথঘাট। কেবল বর্তমান নয়, এ শহরের রাস্তাঘাট বাড়িঘরের সাথে জ্যান্ত হয়ে ওঠে শতবর্ষের ইতিহাস।
ফিরে আসি মৃদুলদা’র ঘরে। চা খেয়ে যখন বৌদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেলস্টেশনের দিকে এগুলাম, কেমন বিষণ্নতা ভীড়করে আসে মনে। মৃদুলদা’র সাথে গল্প করতে করতেই ট্রেন এসে গেল। তাড়াহুড়া করে ট্রেনে উঠে পড়লাম। ভীড় এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার পেছনে। আমি আর মৃদুলদা’র কাছে সৌজন্যের বিদায় নিতে পারলাম না; পারলাম না একবার হাতটিতে হাত মেলাবার। হলো না বিদায়ের আলিঙ্গন।
৩
দুপুরের আগেই পৌঁছে গেলাম যোধপুর পার্ক রোডের বাসায়। সেই আন্তরিক আবাহনে সাড়া দিয়ে ঘরে ঢুকলাম। অনেক কথা যেনজমে আছে। হাতে তুলে দিলেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই ‘স্পর্শে বিষ নেই’। কার্ল মার্কসের Das Capital-এর সার্ধশতবর্ষ ও নকশালবাডি আন্দোলনের ৫০ বছর উপলক্ষে লেখা অসাধারণ কবিতাগুলো পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চলছে আলাপচারিতা।
এদিকে বৌদির ডাকে খেতে গিয়ে জানলাম দাদা স্নান সারেননি।বললাম, তবে দাদা স্নান করেন, আমি অপেক্ষা করি। তাঁর সব যেন উৎসব মুখর, স্নান করতে যাবেন—সে এক কাণ্ড। তিনি স্নানের প্রস্তুতি নিতে নিতে বললেন ‘আমি স্যার আপনার একটু ইন্টারভিউ নিই’। বললাম নেন। তিনি শুরু করলেন আমার কবিতায় অক্ষরবৃত্তের নিয়মকে মাঝে মাঝে অস্বীকার করার ভঙ্গিনিয়ে আমার বক্তব্য কি। বললাম, সে আমি সচেতনভাবেই করে এসেছি ‘কথনের স্পন্দন’ হিসেবে। তিনি খুব চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, এইদিকটা আমার কাছে বেশ ভিন্ন মনে হয়েছে। আমি এই বিষয়টা নিয়ে লিখব’। এর মধ্যে ২টি সিগারেট শেষ করে ফেলেছেন। আমি বললাম দাদা এবার স্নানটা সেরে নিন। তিনি বললেন এই যাচ্ছি। তার আগে মিথ সম্পর্কে আপনার চিন্তা ভাবনাটা একটু জানাবেন কি? এরপর আমরা মশগুল হয়ে গেলাম দীর্ঘ আলোচনায়। একসময় বৌদির ডাকে আমি আর পেটের ভেতরের ছুঁচোর কেত্তন চলায় দাদাকে রেখেই খেতে বসে গেলাম। তারও বেশ পরে তিনি স্নানঘরে প্রবেশ করলেন। আমি খেতে বসে দেখি সব খাবার বেশ ঠান্ডা। স্বরস্বতী পূজার পরদিনকে বলে ‘শীতল ষষ্ঠী’। আমাদের দেশে এই ব্যাপারটা কখনো শুনিনি। এদিন সব ঠান্ডা খেতে হয়। আর ‘গোটা’ রান্না করা হয়। অনেকগুলো সব্জি না কেটে গোটা গোটা মিশিয়ে সিদ্ধ করা হয়েছে, মশলাও দিতে হয় গোটা গোটা—মানে ছুরি লাগানো চলবে না। তারপর ঠান্ডা করে পরিবেশন করা হচ্ছে। শীতল ষষ্ঠী আর ‘গোটা’ খাওয়ার এই রেওয়াজটা আমার জানা ছিল না। বৌদি আমার অবস্থা বুঝে অবশ্য ভাত গরম করে আনলেন। গোটা-র সাথে সর্ষে-কাতাল, মুরগী, আলুর দম-সহ অনেকরকম ব্যন্জন সহকারে সে খাবার খেয়ে উঠলাম যখন, স্নান সমাপন করিয়া তখন কবি এসে বাহিরিলেন। শীতে কাঁপতে কাঁপতে যখন তিনি এলেন তখন গৃহ পরিচারিকা তাঁর হাতে তুলে দিলেন কড়া রং-চা’র কাপ। চা-সিগারেট চালাতে চালাতে আমার সাথে আবার মিথ বিষয়ক আলোচনা চালিয়ে গেলেন। বিকেল তখন চারটা, এর মধ্যে অচ্যূতদা পৌঁছে গেছেন। অনেকটা ঠেলেঠুলে স্যারকে ভাত খেতে বসানো হলো। আমরা গল্প করছিলাম, তার মধ্যে কবি অতনু ভট্টাচার্য উপস্থিত। স্যার কোথায় বলতেই উত্তর এলো — এইতো চল্লিশতম লোকমা গ্রহণ করছি। ভাতপর্ব শেষ হলে আবার চা-পর্ব। হাজির হলেন চিত্র-পরিচালক দেবরাজ। দেবরাজ জানালেন স্যারের সাথে সৌজন্য দেখালেন তো কেইস খেয়ে গেলেন। উদাহরণ স্বরূপ জানা গেল একবার একজন অমিতাভ গুপ্তকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন। তিনি বিদায় নেবার সময় অমিতাভদা তাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে তবে ছেড়েছেন।
যাই হোক, এর মধ্যে একে একে হাজির হলেন কবি বিপুল চক্রবর্তী, নাট্যকার শবর রায়, সঙ্গীত শিল্পী অনুশ্রী চক্রবর্তী, গীতি কবি শিল্পী উৎপল ফকির, কবি ফাল্গুনী দে, আরও বেশ কয়েকজন। কিন্তু আড্ডা আর গডিমসি করতে করতে সাড়ে ৪টার অনুষ্ঠান শুরু হতে হতে সোয়া ৬টা। এর মধ্যে উপস্থিত হলেন কবি সৈয়দ হাশমত জালাল। এই মাসের শুরুর দিকে তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন কবি খুরশীদ আনোয়ার ও কমলেশ দাশগুপ্তের আমন্ত্রণে। শিল্পকলা একাডেমির হলে তাঁর সাথে সেদিন আলাপ পরিচয় হয়েছিল। বড় সজ্জন ব্যক্তি। আমার কাব্যগ্রন্থ ও পত্রিকা তাঁকে উপহার দিয়েছিলাম।
যোধপুর পার্কে কবি অমিতাভ গুপ্তের বাড়িতে বসে গেল ‘উত্তর আধুনিক চেতনা’ বিষয়ক চমৎকার এক আলোচনা সভা। মনে হলো, আমার আসা উপলক্ষেই এই ঘরোয়া আয়োজন। তবে নিঃসন্দেহে খুব মূল্যবান ছিল এই আলোচনা সভা। প্রথমে আমার সদ্য প্রকাশিত বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করলেন কবি অমিতাভ গুপ্ত ও বিপুল চক্রবর্তী। তারপর আমাকে উপহার দেওয়া হলো ‘ঋত্বিক’ সাহিত্যপত্রের সবগুলো (মোট ৮টি) সংখ্যা। সম্পাদক অলক রায় স্বয়ং সেসব উপহার দিলেন। এর মধ্যে অবশ্য কিটস সংখ্যাটা আমার আগে থেকেই ছিল। উপহার পেলাম আরো কিছু বই। বিপুল চক্রবর্তীর ‘দল পড়ি পাতা পড়ি’, সৈয়দ হাশমত জালালের ‘ক্ষুধাশিল্পের দেশ’, উৎপল ফকিরের ‘দিব্যপাগলের একতারা’ এবং অতনু ভট্টাচার্যের ‘পারমিতাকে ডাকছিলাম’—এ মুহূর্তে এসব মনে পড়ছে। আজই প্রকাশিত অতনু সম্পাদিত ‘কুবোপাখি’ কাগজটিও পেলাম। এতে বাংলাদেশে উত্তর আধুনিকতা চর্চা ও লিরিক প্রসঙ্গে আমার স্মৃতিকথাটি ছাপা হয়েছে। (সব মনে আসছে না, আরও দুএকটি বই পেয়েছি। এখনো লাগেজে পতে গেছে।)
উপস্থাপক শবর রায়ের আমন্ত্রণে আমি বললাম বাংলাদেশে উত্তর আধুনিকতা চর্চা ও ছোট কাগজ লিরিকে আমাদের লেখালেখির কথা, সাম্প্রতিক কবিতাচর্চার কথা। কবি বিপুল চক্রবর্তী, কবি অচ্যুত ভট্টাচার্য, শবর রায়, অতনু ভট্টাচার্য ও উপস্থিত তরুণরাও অংশ নিলেন আলোচনায়। নানাবিধ প্রশ্নের উত্তরসহ সামগ্রিক আলোচনাটি শেষ পর্যন্ত গড়ালো কবি অমিতাভ গুপ্তের হাতে। তিনি বিস্তৃত আলোচনায় গেলেন উত্তর আধুনিকতা কি এবং কেন এবং আরো বললেন কেবল মাত্র সৃজনশীলতাই বিত্তবানদের করায়ত্ত নয়। তাই আজ ‘আমি’র পরিবর্তে ‘’আমাদের’ উচ্চারণের জন্যে উত্তর আধুনিকতা এখনো অপরিহার্য। পরে কবি ও সঙ্গীত শিল্পী বিপুল চক্রবর্তী ও অনুশ্রী চক্রবর্তী গান গেয়ে শোনালেন। মাটির গন্ধমাখা অসাধারণ গান।সবশেষে চপ, পিঠে আর চা-সহযোগে আড্ডা গড়িয়ে চললো। বেরোলাম তখন রাত দশটা। কবি সৈয়দ হাশমত জালালের সঙ্গ পেলাম একেবারে হোটেল পর্যন্ত। নিরাপত্তা চিন্তায় এতো রাতে আমাদের তিনি একা ছাড়তে চাইলেন না। তাঁর এই ঋণ মাথায় নিয়েই আমি ফিরে এলাম হোটেলে। এবার বাঁধা-ছাঁদা সারতে হবে। অনেক তো ঘোরাঘুরি হলো, বাড়ির জন্যে মন কাঁদছে, মেয়েদের রেখে এসেছি- মন কাঁদছে, যাই।
নিবাস: চট্টগ্রাম।
কবিতাই প্রধান বিচরণ।তবে নন্দনতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণগদ্য এবং অনুবাদকর্মেলিপ্ত।
কবিতার বই:
অন্যমন্ত্র(লিরিক১৯৯৫),
শাদা অন্ধকার(লিরিক২০১০),
ডায়োজিনিসের হারিকেন(ভিন্নচোখ২০১৮)
দীর্ঘ কবিতার পুস্তিকা:
শতখণ্ড(বাঙময়২০১৭)
আত্মজার প্রতি(বাঙময়২০১৭)
প্রবন্ধ/নিবন্ধ:
উত্তর আধুনিকতা: এ সবুজ করুণ ডাঙায়(লিরিক২০০১, পরিবর্ধিত২য়সংস্করণ: খড়িমাটি২০১৯)
অমৃত কথা(লিরিক২০১০)
অনুবাদ:
আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব: কয়েকটি অনুবাদ(লিরিক২০১০)
নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ(বাতিঘর২০১৮)
এমিলি ডিকিনসনের কবিতা(চৈতন্য২০১৮)