| 24 এপ্রিল 2024
Categories
সাক্ষাৎকার

ঋতুপর্ণ ঘোষ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আলাপচারিতা ( শেষ পর্ব )

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

চিত্রপরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতেন। সে-ই অনুষ্ঠানে শিল্প-সাহিত্য-সিনেমাঙ্গনের গুণী শিল্পীদের অতিথি ক’রে আনতেন তিনি। একবার ঋতুর অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁদের সে-ই আলাপচারিতা ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে শেষ পর্ব।


ঋতুপর্ণ ঘোষ: আজকে ঘোষ এন্ড কোম্পানিতে আমাদের সাথে আছেন সুনীল দা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যার ব্রান্ডনেমই হয়ে গেছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এই নামেই সবাই এখন চেনেন। আমি মনে করি সুনীল দা কোলকাতা শহরের একজন ক্রনিকলার। কোলকাতা শহরকে অনেকটা চিনিয়েছেন সুনীল দা। আমরা আড্ডার বিষয়টা সেটা রাখতে পারি, দেখা যাক সেখান থেকে কোথায় যাওয়া যায়।

ঋতুপর্ণ: একটা বিতর্ক চলে না যে রবীন্দ্রনাথ লালনেরটা কিংবা লালন রবীন্দ্রনাথেটা ধার করেছিলো। এমন কোনো প্রমাণ কি তুমি কাজ করতে গিয়ে পেয়েছ?

সুনীল: একটা গুজব চালু আছে। একদল লোক বলে, লালনের গানের খাতা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আর ফেরত দেননি। বরং নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন। লালনের শিষ্যরা দাবি করেন যে রবিঠাকুর লালনের আসল খাতাটা নিয়ে গেছেন তাই অনেকগান আর পাওয়া যাচ্ছেনা। আসলে এটা বাজে কথা। অনেক গবেষক প্রমাণ করে গেছেন, লালন আর রবীন্দ্রনাথের কখনও দেখাই হয়নি! লালনের সাথে রবীন্দ্রনাথের দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিলো যিনি লালনের স্কেচটা আঁকিয়েছিলেন। যদিও স্কেচটা তেমন একটা ভালো নয় তবুও ওই একটাই লালনের ছবি আছে।

ইনফ্যাক্ট আমিও লালনকে নিয়ে লিখছি তো তাই এসব নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বাউল শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত তো বটেই। তিনি গগন হরকরার গান, লালনের গানসহ এই সমস্ত বাউলের গান থেকে কিছু নিয়ে সেগুলোকে আবার অসাধারণ রূপে উন্নীত করেছেন। যেমন, গগন হরকরার একটা গান আছে। ‘হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে দেখো একলা নিতাই, একলা নিতাই, একলা নিতাই।’

এটা সাধারণ একটা পল্লীগীতি। এটাকে অসাধারণ স্তরে নিয়ে গেয়ে রবীন্দ্রনাথ বানিয়ে ফেললেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ মনের মানুষ কথাটা বা সমস্ত নানান কথা উনি অনেক সময় অনেক জায়গা থেকে নিয়েছেন। তারপরে উনি নিজেকে বলেছেন বাউল। রবীন্দ্র-বাউল। কিন্তু লালনের থেকে চুরি করে লিখিছেন এসব বোগাস কথা।

ঋতুপর্ণ: তুমি কালীপ্রসন্ন সিংহকে ঠিক ওখানে আনলে কী মনে করে?

সুনীল: ওইযে বললাম, আমি যেহেতু ইতিহাসকে ইন্টারপ্রেট করতে চেয়েছিলাম মনে মনে। কিন্তু সেটাও আবার ছিলো যে উপন্যাসটা যেন প্রকট না হয়। কারণ প্রকট হলে তো আবার উপন্যাস হয় না। সেজন্য আমি ভেবেছিলাম, আমার এমন একটা চরিত্র দরকার যে কোন দলেই যায়নি।

তখনকার দিনে তো দুটো দলে ভাগ ছিলো। একটা রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের দল, আরেকটা হলো ব্রাহ্মের দল। যে এই কোনো দলেই যায়নি, আমার তেমন একটা চরিত্রের দরকার ছিলো। এটাই হচ্ছে কালীসিংহ! সে রামকৃষ্ণে গিয়ে কাঁদেনি আবার ব্রাহ্মদের দলেও ভেড়েনি। কিন্তু তিনি সাহায্য করেছেন অনেক।

বিধবা বিবাহ যখন আন্দোলন হয় তখন সাহায্য করেছেন, নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। গল্প আছে এগুলো তবে প্রমাণ করা শক্ত। দীনবন্ধু মিত্র যখন নীলদর্পণ লিখলেন কিন্তু সেটা বাংলায় লিখলে তো আর হবে না। ওটা সাহেবদের পড়া দরকার। সেজন্য ইংরেজিতে পড়া দরকার।

তখন লিবারেল লংকে দিয়ে বলা হলো মাইকেলকে দিয়ে অনুবাদ করতে। এখন অনুবাদ তো হলো কিন্তু ছাপবে কে? লিবারেল লং নিজ দায়িত্বে সেটাকে ছাপালেন। লংয়ের নামে তখন মামলা হলো। ১০০০ টাকা জরিমানা করা হলো। অল্পবয়সী এই ছোকরা কালীসিংহ ১০০০ টাকা নিজের পকেট থেকে বের করে ঝনাৎ করে ফেলে দিলো আর বললো যে ‘ওর হয়ে টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি।’

কেন করলো বলতো? কারণ এরা তো চরিত্র একটা। অল্পবয়সী একটা ছেলে কিন্তু তেজ কি তার? মহাভারতকে সে বাংলায় অনুবাদ করবার অতবড় প্লান। নিজে করেনি, পন্ডিতদের দিয়ে করিয়েছে যদিও। কিন্তু মহাভারতটা অতবড় বই ছাপিয়ে প্রথমে বিনা পয়সায় বিলি করছিলেন। তারপরও যখন দেখলেন বিলি হচ্ছে না তখন বললেন যে ডাক খরচাটাও আমি দিয়ে দেব।

ঋতুপর্ণ: ভান্ডারকরের মহাভারতাটা কি তখন হয়ে গেছে?

সুনীল: তখন পুনা থেকে অনেকগুলো ইডিশন নানারকম ছিলো। তা পুনায় ওখান থেকেই সংস্কৃত মহাভারতের অথেনটিক সব বেরিয়েছে। তো সেখানকার এগুলো থেকে এখনকার পন্ডিতদের দিয়ে জেনারেল একটা ভার্সন তৈরী করলেন। জানো বোধ হয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজেও অনুবাদ করার কথা ভেবেছিলেন।

তিনি খানিকটা এগিয়ে যখন শুনলেন যে, কালীপ্রসন্ন করছেন তখন ভাবলেন যে ‘আমার আর করার দরকার নেই।’ কারণ ওর অনেক পয়সা আছে, এ আছে ও আছে, ও শেষ করতে পারবে। ওর উদ্দেশ্য ছিলো লোকে মহাভারতটা যেন পড়ে। তার অনেক আগে থেকেও কাসীরাম দাসের মহাভারত ছিলো। কিন্তু পদ্য আকারে লিখা বলে মানুষ ওটা পড়তে চাইতো না।

ঋতুপর্ণ: সেটা কেমন পপুলার হয়েছিলো?

সুনীল: সেরকম পপুলার হয়েছিলো। আমরা যখন করেছিলাম তখন হরিদা’র সিদ্ধান্তে। তিনিও করেছিলেন মহাভারত। তিনি আবার মহাভারত মূল মহাভারত, মল্লীনাথকৃত টীকা, নিজের অনুবাদ, কখনও কখনও নিজের টীকাও ছিলো। সে বিশাল ব্যাপার। সেটা আবার নিজের খরচে ছাপা।

উনি আবার গ্রাহক সিস্টেম শুরু করেন। তিনি বললেন, ‘আমি খন্ড খন্ড বার করছি, গ্রাহক না হলে নিজের খরচায় এত চালাতে পারবো না।’ রবীন্দ্র্রনাথ পয়সা দিয়ে গাহক হয়েছিলেন! কালীপ্রসন্নের সময়ে রবীন্দ্রনাথ ছোট। ওই সময়ে আসতে রবীন্দ্রনাথ পারেননি।

ঋতুপর্ণ: কিন্তু একদিকে এটা অন্যদিকে হুতুম প্যাঁচার নকশা?

সুনীল: ওটাও কালীপ্রসন্ন সিংহের। কালীপ্রসন্ন তো ধুুরন্ধর ছেলে ছিলো তো। ১৩/১৪ বছর বয়সে বিদ্যোৎসাহী সভা, আত্মীয় সভা এই সমস্ত স্থাপন করে। এত অল্পবয়সী একটা ছেলে এসমস্ত করে কোত্থেকে সেটা বিস্ময়কর। ইঁচড়ে পাকা কিন্তু ভালো কাজে এসব কাজে লাগিয়েছিলো।

হাংরি আন্দোলন: বাংলাসাহিত্যের এক উথালপাথাল (পর্ব এক)

ঋতুপর্ণ: সেসময় ওর ওপর ইনফ্লুয়েন্সটা কার ছিলো?

সুনীল: বিদ্যাসাগর ছিলো। বিদ্যাসাগর ওকে স্নেহ করতেন। মাইকেল ওর থেকে একটু বড়। লোকে যখন মাইকেলকে পছন্দ করতো না তখন মাইকেলকে বাড়িতে ডেকে এনে সে সংবর্ধনা দেয়। সংবর্ধনাতে কিছু একটা উপহার দিতে হয় তো। লোকে বলে, ও নাকি মাইকেলকে বড় একটা মদ্যপানের পাত্র উপহার দিয়েছিলো।

হরিশ মুখোপাধ্যায়, নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন যিনি একা, তাতেও সাহায্য করেছে কালীপ্রসন্ন গিয়ে। এরা তো অদ্ভুত চরিত্র তাই ওকে আমি প্রতীকী চরিত্র করেছি। সে কোনও ধর্মে যোগ দিলো না অথচ দেশের জন্য অনেক কাজ করলো। এখনকার দিনে রাজনীতি করলো না অথচ দেশের জন্য কাজটাজ করলো অনেকটা সেরকম আরকি।

ঋতুপর্ণ: আমরা হরিশ রোডের ওপর দিয়ে অনেকবার গিয়েছি, কিন্তু ইতিহাসটা জানতাম না! তুমি সব বিখ্যাত লোকদের নিয়ে এমনটা ভেবো সুনীল দা।

সুনীল: আসলে সবাইকে নিয়ে তো আর করা যায় না। একটা গল্প করতে হলে একটা চরিত্র করতে হবে। কিন্তু সবাইকে নিয়ে তো আর চরিত্র করা যায় না।

ঋতুপর্ণ: কিন্তু পরবর্তীতে যখন তুমি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখছো কোথাও কোথাও নায়ক প্রায় রবীন্দ্রনাথ! সেটা কী তুমি কনাসাসলি লিখেছো না এমনি লিখতে লিখতে?

সুনীল: আমি ওটা ভেবেই শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথকেই নায়ক বানাবো। ত্রিপুরা রাজবাড়ি থেকে আরম্ভ হচ্ছে। ঠাকুরবাড়ির এক ছেলে ভালো কবিতা লিখেছে, ওকে উপঢৌকন দিতে হবে। ঐ পর্যন্ত লিখে আমি দেখলাম, রবীন্দ্রনাথকে তো নায়ক করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ হলো বাংলাদেশের আইকন। তার কোনো দোষ বলা যাবে না। সবসময় ভালো ভালো বলতে হবে। কিন্তু তা দিয়ে কি উপন্যাস হয়?

তখন আমি রবীন্দ্রনাথকে নায়কের জায়গা থেকে পাশে সরিয়ে কাল্পনিক চরিত্র ভরতকে নিয়ে এলাম। যেন তাকে নিয়ে যা ইচ্ছে করতে পারি। তো এভাবে লিখতে লিখতে বিবেকানন্দকে নিয়ে সেইম ভয়টা আবার হয়েছিলো। ওরে সর্বনাশ! বাঙালীরা তো বিবেকানন্দের একটু এদিক ওদিক হলে ছাড়বে না। আর আমাদের বিবেকানন্দ স্পেশালিস্ট হচ্ছেন আমাদের সংকরীপ্রসাদ বসু। প্রত্যেক সপ্তাহেই তিনি পড়তেন বোধ হয় আর আমাকে বলতেন তোমার এইটা ভুল হয়েছে।

যেমন- আমি লিখেছি, স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বজয় করলেন। আমেরিকায় বক্তৃতা দিলেন। তারপর বাংলায় আসার সময় ছাত্ররা ওকে খুব সংবর্ধনা দিলো। তারপর শোভাবাজার রাজবাড়িতে তিনি বাংলায় বক্তৃতা দিলেন। সংকরীপ্রসাদ বসু আমায় বললেন, ‘নাহ! উনি বাংলায় বক্তৃতা দেননি; ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়েছেন।’

আমার মাথায় আসেনি কোলকাতা শহরেও কেউ ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে পারেন! আসলে তখনকার দিনে লোকেরা ভাবত, বাংলায় বক্তৃতা দেয়া যায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সেটা ভালো লাগতো না। তিনি বলতেন, ‘আমাদের দেশের ভাষা কি ব্যবহার করা যায় না?’

একবার এক কংগ্রেসের সভার জন্য রবীন্দ্রনাথ একটা গান লিখলেন। গানটা এমন যে সংস্কৃত, উর্দু, বাংলা সকলেই বুঝতে পারে! ‘অয়ি ভুবনমনোমোহিনী’। শব্দচয়ন করলেন এমনভাবে যেন সব ভাষার লোকই গানটা বুঝতে পারে।

তখনকার দিনে লালমোহন নামে একজন বক্তা ছিলেন। খুব ভালো বক্তৃতা করতেন। রবীন্দ্রনাথ একদিন তাকে বললেন, ‘এই যে আপনারা জম্পেশ ইরেজিতে বক্তৃতা দেন। কিন্তু চাষা ভুষারা শুনতে আসে, ওরা কী বুঝবে?’ লালমোহন বাবু তখন বললেন, ‘আমরা তো ইংরেজি ছাড়া বক্তৃতা দিতে পারি না। তাহলে আপনি একটা কাজ করুন, আমরা ইংরেজিতে বলবো আপনি বাংলায় অনুবাদ করে দেবেন।’

বোধহয় রাজশাহীতে একবার হলো, বড়বড় নেতারা ইংরেজিতে বক্তৃতা করছেন। রবীন্দ্রনাথের মত লোক সেখানে বসে থেকে অনুবাদ করছেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়। অনুবাদ যখন হয়ে গেলো তখন রবীন্দ্রনাথকে লালমোহন বোস বললেন, ‘ওয়েল রবিবাবু, ডিড ইউর চাষাজ এন্ড ভুষাজ আন্ডারস্টুড ইউর ফ্লাওয়ারি বেঙ্গলি?’ এখন ঐ বাংলাও তো চাষাভুষারা বুঝতে পারবে না! এই হলো সে সময়কার গল্প আরকি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু বাংলা নিয়ে সারাজীবন লড়ে গেছেন। দেখো ১৯০৫ এর যে বঙ্গভঙ্গ, তাতে রবীন্দ্রনাথ প্রথম রাস্তায় নামলেন। মোজা ছাড়া ঠাকুর বাড়ির লোকজনকে রাস্তায় দেখা যেত না। সেই ঠাকুরবাড়ির ছেলে রবীন্দ্রনাথ প্রথম খালি পায়ে রাস্তায় নামলেন ঠাকুর বাড়ির সমস্ত নিয়ম ভেঙে।

তিনি আরেকটা ডেঞ্জারাস কাজ করেছিলেন যেটা আমার লেখাতে আছে। সেটা হলো উনি ওই যে রাখি পরাচ্ছিলেন। মুসলমানদের তো রাখি পরানো যায় না, সেটাতো হিন্দু রিচুয়্যাল। কাজেই অনেক মুসলমান প্রথমে ইতস্ততঃ করছিলো। যাহোক রবীন্দ্রনাথের চেহারা, কার্যকলাপ এসমস্ত দেখে অনেকে এটা মেনেও নিচ্ছিলো। বিশেষ করে উনি যে নাকোলা মসজিদে ঢুকে পড়লেন গিয়ে। সেখানে ঢুকে ইমামকে বললেন, ‘আমি রাখি পরাবো।’

খুবই সাহসের পরিচয় বলতে হবে। অন্য সবাই রাগ করছিলো কিন্তু ইমাম হাত বাড়িয়ে রাখি পরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। পরে রাখি পরানো নিয়ে গন্ডগোল হয়েছে। তখন হয়নি তবে পরে হয়েছে। পূর্ববাংলায় রাখি পরানো নিয়ে মারামারি হয়েছে, খুনোখুনি অবধি হয়েছে, ধর্ষণ হয়েছে!

ঋতুপর্ণ: সেটা ঠিক কিসের জন্য? মানে গন্ডগোলটা কিসের জন্য?

সুনীল: বঙ্গভঙ্গের জন্য। পূর্র্ববঙ্গের অনেকেই তো বঙ্গভঙ্গ চেয়েছিলো। আমরা অনেকেই মনে করি ব্রিটিশরা জোর করে বঙ্গভঙ্গ করে দিয়েছে তা নয়। পূর্ববাংলার অনেকেই চেয়েছিলো এডমিনস্ট্রিটিভ কারণ দেখিয়ে। প্রভিন্স বলতো তখন। প্রভিন্সটাতো এতবড়, এটাকে ভাগ করো। কিন্তু এমন একটা কায়দা করে বলেছিলো, ওই ভাগটাতে মুসমান বেশী হয়ে যাবে। ন্যাচারালি মুসলমানদের ওটা অধিকার হয়ে যাবে।

লর্ড কার্জন একবার বলেই ছিলো, কি ব্যাপার কোথাও থেকে এক বাঙালি এসে ভাইসরয়ের বাড়িতে বসবে নাকি! তিনি আসলে বুঝতে পেরেছিলেন, প্রতিবাদটা এলে এখান থেকেই আগে আসবে। ঢাকার নবাব ছিলেন সলিমুল্লাহ । তাঁকে তখনকার দিনে এক লক্ষ পাউন্ড দিয়েছিলো ওরা। ধার বলে হোক আর যা বলেই হোক। তখনকার এক লক্ষ পাউন্ড তো বহু টাকা।

কেন দিয়েছিলেন তা জানি না তবে ইতিহাসে আছে যে লর্ড কার্জন দিয়েছিলেন। সে ছিলো এক নম্বরের সাম্প্রদায়িক। তখন এখানকার তরুণরা যখন বুঝতে পারলো সাহেবরা বিচারের পথ বাদ দিয়ে ডিভাইডের পথে যাচ্ছে, তখন বোমাবাজি শুরু করলো।

বাঙালিদের একটা দোষ আছে। তারা কতগুলো বিষয় নিয়ে অনেক গর্ব করে প্রায় না জেনেই! সকলের মধ্যে একটা বিশ্বাস ক্ষুদিরামই প্রথম ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছিলো। কিন্তু সেটা ঠিক না। তারও অনেক আগে মহারাষ্ট্রে চাপিকার ভাইয়েরা, তিন ভাই প্রাণ দিয়েছিলো। তিলক তাদের ইন্সপায়ার করেছিলো।

কিন্তু ক্ষুদিরামকে পাঠানো হয় পিস্তÍল দিয়ে যে সাহেব মেরে আসো তার কারণ আছে। তার মা-বাবা নেই। গেল তো গেল আর সমস্যা হবে না। নেতারা যে পাঠিয়েছিলো তার কারণ ছিলো এটা। তবে প্রফুল্ল সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। ধরা তো দেয়নি বরং সে আত্মহত্যা করেছিলো রেলস্টেশনে। কিন্তু প্রফুল্লকে নিয়ে কিছু জানা যায় না। অবদান তারও তো কম নয়।

এই যে ফাঁসিতে যাবার কারন একটাই বারিন্দ ঘোষ বলেছে, এগুলোতে দৃষ্টান্ত ন্থাপন করা। তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা। তুমি যদি আন্দামানের কারাগারে যাও, সেখানে দেখবে একটা তালিকা করা আছে কারা সেখানে ছিলো তাদের। আশ্বর্য হবে, সেখানে ৯০% বাঙালির নাম!

ঋতুপর্ণ: সেটার কারণ কি এমন যে কোলকাতাটা ক্যাপিট্যাল?

সুনীল: না, ক্যাপিটালের জন্য না। ক্যাপিটাল তো ১৯১৩ সালে শিফট হয়ে গেছে। তারপরে তো আর কোলকাতা ক্যাপিটাল না। তারপর তো অনেক চলেছে। সেটা প্রায় ২০ দশকের শেষ পর্যন্ত চলে এসেছে।
তারপরেই গান্ধীজির প্রভাবটা খুব বেশী আসে ৩০ দশকের গোড়া থেকে। গান্ধীজির ওই অহিংসা অস্ত্র যেটা। সত্যাগ্রহ-টত্যাগ্রহ এসব আরকি। কিন্তু বাংলায় বাঙালিরা সেটাকে নেয়নি। কিন্তু বাংলার কংগ্রেস মেনে নিয়েছিলো।

ঋতুপর্ণ: এই যে গান্ধীজীর নেতৃত্ব সর্বভারতীয়দের স্তরে, সেটা কি অনেকটা অঘোষিত নেতার মত?

সুনীল: না,গান্ধীজীর গ্রেটনেস স্বীকার করতেই হবে। উনি কী করে বুঝলেন যে ভারতের অধিকাংশ জনতার পরবার মত পোষাক নেই। নেংটি পরে ঘুরে বেড়ায়! টাই পরে, কোর্ট পরে আমি তাদের নেতা হব? চিরকাল তো তাই হয়েছে। অন্য নেতারা তো তাই করে এসছে। গান্ধীজি সেই কোর্ট প্যান্ট খুললেন, ছোট্টো একটা ধুতি পরলেন আর বললেন, ‘আমি তোমাদেরই একজন।’

ঋতুপর্ণ: উনি বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়বার অস্ত্র ইংরেজি ভাষা?

সুনীল: না, সেই সঙ্গে সঙ্গে উনি গুজরাটিতেও লিখতেন। গুজরাটিতে উন্নয়ন করবার চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনী পড়লে তুমি বুঝতে পারবে। গান্ধীজি যখন গুজরাটে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গেছেন বক্তৃতা দিয়ে বিশ্বভারতীর জন্য ফান্ড কালেকশনে।

কল্পনার বাস্তব চরিত্রগুলো

রবীন্দ্রনাথ গুজরাটিতে কী করে দিবেন? তিনি তো আর গুজরাটি জানেন না। ইংরেজিতে দিচ্ছিলেন। গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথকে বললেন, তুমি হিন্দিতে দাও। তবু সাধারণ লোকে বুঝতে পারবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো আর হিন্দিতে অভ্যস্থ নয়। হিন্দিতে বক্তৃতা দিয়েছেন বেশ কয়েক জায়গায়। এগুলো ছিলো আগে।

ঋতুপর্ণ: রানু-ভানু যখন লিখলে, আমার মনে হয় প্রবীন রবীন্দ্রনাথের প্রতি তোমার একটা মমতা এলো?

সুনীল: আমি নিজেও তো প্রবীণ হচ্ছি। শোনো, আমরা যখন তরুণ ছিলাম তখন আমরা ভাবতাম ৬০ বছরের লোক একদম বুড়ো যা তা। কিন্তু নিজের ৬০ বছর হবার পর দেখলাম খুব তো খারাপ না! সবই তো ঠিকঠাকই রয়েছে। ব্যাপার কিছু কিছু আগের থেকে অন্যরকম হয়েছে যদিও।

ছোট বেলায় যখন পড়তাম রবীন্দ্রনাথ ৫৮ বছর বয়সে ১৮ বছরের একটা মেয়ের সাথে প্রেম করছে তখন ভাবতাম, এটা কী হচ্ছে! ভালো না। কিন্তু নিজের ৫৮ বছর হবার দেখলাম মন্দ নয়!

ঋতুপর্ণ: আমাদের তো ইতিহাসগুলো সত্যিতে কিছু রইলো না। নাকি এগুলোও থেকে যাবে বলে মনে হয়?

সুনীল: দেখা যাক!

ঋতুপর্ণ: যদি পারো তবে লিখো। ধন্যবাদ সুনীলদা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত