মুম্বইয়ে বহুজাতিক সংস্থার উচ্চ পদে চাকরি। সকলের চোখে তিনি সফল। কিন্তু অফিসের পরে ফ্ল্যাটে ফিরতে ইচ্ছে করত না বছর বত্রিশের তমসা রায়ের। বাবা-মা থাকেন কলকাতায়। অন্য সময় তা-ও কোনও রকমে কেটে যায়। কিন্তু উৎসবের সময়ে সেই চেনা মুখ-চেনা পার্টির পরিসর থেকে বেরিয়ে এলেই গ্রাস করত একাকিত্ব। শেষমেশ নতুন বছরের রাতে প্যানিক অ্যাটাক এবং পরে মনোবিদের দ্বারস্থ হওয়া।

চার বছরের ব্যবধানে মৃত্যু হয়েছিল বাবা-মায়ের। বছর উনিশের কলেজ পড়ুয়া তরুণীর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় মায়ের মৃত্যুর কিছু দিন পরেই। পরিবারের সদস্য ও পুলিশের অনুমান ছিল, মানসিক অবসাদ ও একাকিত্বের জেরেই আত্মঘাতী হয়েছেন চৌবাগার বাসিন্দা ওই তরুণী।

মনোবিদ এবং মনোরোগ চিকিৎসকদের মতে, এই ধরনের ঘটনাগুলি বিচ্ছিন্ন নয়। সামাজিক মেলামেশার জায়গা কমে যাওয়ার কারণে শহরাঞ্চলে সব বয়সের মানুষের মধ্যেই বাড়ছে একাকিত্ব। তা থেকে বাড়ছে মানসিক অবসাদ। পরিস্থিতি চরমে পৌঁছলে ঘটছে আত্মঘাতী হওয়ার মতো ঘটনাও। কর্মসূত্রে একলা থাকা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সহিষ্ণুতা কমে যাওয়াও একাকিত্ব বাড়ার কারণ।

এই ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার জন্য সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র আধুনিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনধারাকেই দায়ী করছেন। তাঁর মতে, ছোট থেকেই শিশুদের সেরা হওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন বাবা-মায়েরা। পিঠে বিশাল স্কুলব্যাগের ওজন আসলে তাদের মাথার উপরে একাকিত্বের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে দূরত্ব। নিজের অনুভূতির কথাটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রকাশ করে উঠতে পারছে না তারা। পরে চাকরি জীবনে গিয়ে চাপ আরও বাড়ছে।

প্রবীণদের একাকিত্বের প্রসঙ্গে অভিজিৎবাবু বলেন, ‘‘বয়সের চেয়ে বড় অসুখ আর নেই। বয়স হওয়া মানে অনেক ক্ষেত্রেই আস্তে আস্তে বর্জিত হয়ে যাওয়া।’’ এই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা কৃষ্ণা ঘোষের (নাম পরিবর্তিত) মুখে। তিনি বলেন, ‘‘বয়সের সঙ্গে নিঃসঙ্গতা অনিবার্য।’’ কৃষ্ণাদেবীর দুই মেয়ের এক জন থাকেন ভিন্‌ শহরে। অন্য জন এই শহরেই থাকলেও যতটা সম্ভব সাবলম্বী থাকার চেষ্টা করেন কৃষ্ণাদেবী। একলা থাকার ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বেশি ভয় নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে। ডেলিভারি বয় বা মিস্ত্রি— বিশেষত সন্ধ্যার দিকে অপরিচিত কেউ এলে নিরাপত্তার তীব্র অভাব বোধ করেন তিনি। সেটুকু বাদ দিলে নিঃসঙ্গতা কাটানোর উপকরণ তিনি খুঁজে নেন টিভির অনুষ্ঠান বা আবাসনের অন্য বাসিন্দাদের মধ্যে।
সব বয়সের মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এই একাকিত্ব নিয়ে সম্প্রতি শহরে মঞ্চস্থ হয়ে গেল নাটক ‘ছোট ছবি’। পরিচালক সোহাগ সেন জানান, চারপাশে দেখা একাকিত্বের বিভিন্ন ঘটনা জায়গা পেয়েছে এই নাটকে। তাঁর আশা, এ ভাবে শিল্পমাধ্যমে একাকিত্বের বিষয়টি উঠে এলে তা নিয়ে চর্চা বাড়বে, বাড়বে সচেতনতাও।

একাকিত্ব ঠেকাতে তিন-চার জন মানুষকে নিয়ে আবেগের সুরক্ষাবলয় তৈরির পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। একা বা অসহায় লাগলে যাতে ওই ক’জনের কাছে পৌঁছনো যায় যে কোনও সময়ে, নিঃসঙ্কোচে বলে ফেলা যায় মনের কথা। তাঁর মতে, সমাজ হিসেবেও একটা জায়গা তৈরি করা দরকার যেখানে সর্বক্ষণ আতসকাচের তলায় ফেলে কাউকে বিচার করা হবে না। তাতে একাকিত্বে ভোগা মানুষেরা নিজেদের সমস্যার কথাটা বলতে পারবেন সহজে।

একাকিত্বের এই ছবির পাশাপাশি অবশ্য উঠে আসছে আরও একটা ছবি। যেখানে অনেকে একা থাকতেই পছন্দ করছেন। কলেজ শিক্ষিকা সায়ন্তী পোদ্দার বা তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী কৌশিক ভট্টাচার্যের কথায়, পরিবার-বন্ধু নিয়ে তাঁদের একটা নির্দিষ্ট জগৎ আছে। কাজের বাইরেও রয়েছে ছবি তোলা বা বিতর্কসভায় যোগ দেওয়ার মতো নানা শখ। আর যখন একলা থাকেন, তখন নিজের সঙ্গটাই তাঁদের কাছে যথেষ্ট। ‘ছোট ছবি’-র অন্যতম অভিনেতা সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, স্কুলে কথা বলা বা খেলার সঙ্গী পেতেন না তিনি। তবে এখন একলা থাকা শিখে গিয়েছেন। আর মঞ্চে অভিনয় করার সময়ে তাঁকে ঘিরে অন্য রকম একাকিত্বের একটা বৃত্ত অনুভব করেন, যা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে ভালবাসেন তিনি।