| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

ভাষা দিবসের প্রবন্ধ: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

আমরা মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি রক্তের বিনিময়ে। লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশে মে বা পয়লা নভেম্বর তাই আমাদের কাছে নিছক এক একটি দিন নয়। আমাদের আত্মানুসন্ধানের ঠিকানা। বাঙালি হিসেবে নিজেদের গর্বিত হয়ে ওঠার এক অনন্য উপলব্ধির দিন।

অবিভক্ত ভারত ভেঙে দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয় পাকিস্তান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ইসলামাবাদের শোষণ ও শাসন অব্যাহত থাকে। বাড়তে থাকে সাংস্কৃতিক নিপীড়ন। বাংলাভাষী মানুষদের ওপর পাকিস্তান চাপিয়ে দিতে চায় উর্দুর আগ্রাসন। ভাষার সাম্রাজ্যবাদী চেহারা যারা দেখেছে তারা জানে কী ভয়ংকর হতে তার আধিপত্যকামী অবয়ব । আমরা মানভূমের মানুষ, পুরুলিয়ার মানুষ, আমাদের জেলা গঠনের ইতিহাসের ভেতর লুকিয়ে আছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার লড়াই। আমাদের শেকড়ে যে কাহিনি যে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার আছে,এই ইতিহাস থেকেই এই পরম্পরা থেকেই আমরা বুঝতে পারি কী তীব্র ছিল একুশের সেই লড়াই। অনেকে ভাবতেই পারেন ১৯৫২ সালে শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। ইতিহাস সে কথা বলে না। ১৯৪৮ সালে উর্দুভাষা জোর করে চাপানোর স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে।তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীরা উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’।

২৩ ফেব্রুয়ারি বীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে শুরু হয় প্রতিবাদ। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার লড়াই শুরু হয়ে যায় সর্বত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত স্তরের ছাত্রছাত্রীরা সেই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল।ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক তাদের ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য বইয়ে লিখেছেন, “প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ”। কারণ এর সরাসরি ধাক্কা লেগেছিল শিক্ষিত এবং সংস্কৃতিমনস্ক সমাজে। অর্থনীতি ও রাজনীতির পরিসর এই ভাবনার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদি পত্রিকায় লেখক সাংবাদিক আবদুল হক লিখলেন , “উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি উর্দু-শিক্ষিতই চাকুরীর যোগ্যতা লাভ করবেন, এবং প্রত্যেকটি বাংলা ভাষীই চাকুরীর অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন”।একই দেশে এই অসাম্য নীতি শিক্ষিত যুবসমাজে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটিয়েছিল। কেননা রুটি রুজির প্রশ্নটি সরাসরি যুক্ত ছিল এই ঘোষনার মধ্যে। পরে সাধারণ মানুষের আবেগ এর সংযুক্ত হয়। সেসময়কার গুরুত্বপূর্ন ‘মিল্লাত’ পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, “মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না।”

 ফলে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন নিছক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ রইল না । এই আন্দোলনের চরিত্র বুঝতে গেলে আমাদের গভীরভাবে আত্মস্থ করতে হবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অসাম্যের ইতিহাস।বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন জাতীয় চরিত্রের একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। সূচনায় ছাত্র-আন্দোলন হিসেবে এর প্রকাশ ঘটলেও পরবর্তী ক্ষেত্রে তা দেশজুড়ে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয় সমস্ত স্তরের মানুষের সমর্থন নিয়ে।

১৯৫২ সালের ২৭ শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যা বলেছিলেন ‘পাকিস্তানকে আমরা ইসলামী রাষ্ট্ররূপে গঠন করিতে যাইতেছি।…প্রাদেশিক ভাষা কি হইবে তাহা প্রদেশবাসীই ঠিক করিবেন, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে উর্দু’ (দৈনিক আজাদ, ২৮ জানুয়ারি ১৯৫২)।

এই পরিস্থিতিতে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক পরিবেশ তখন অস্থির উত্তপ্ত। টগবগ করে ফুটছে যুবসমাজ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে ছাত্র এবং যুবসমাজে শাসকবিরোধী প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবের বারুদ জমতে থাকে। দেশের আর্থিক সমস্যা- সামাজিক সংকটের পাশাপাশি ভাষাগত আবেগের বিষয়টি আরও সক্রিয় হয়ে উঠে। এমন এক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আগুনে ঘিয়ের সংযোগ ঘটায়।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নিজামুদ্দিন জানতেন না যে আটচল্লিশ এবং বাহান্ন দুটো আলাদা সংখ্যামাত্র নয়। সময় এবং পরিবেশ সবকিছু বদলে দেয়। ফলে আটচল্লিশে ভাষার অধিকার রক্ষার যে লড়াই শুরু হয়েছিল পরিস্থিতি বিচারে বাহান্নতে এসে তা অগ্নিগর্ভ রূপ লাভ করবে। রাজনৈতিক অপশাসন এবং অসাম্যের যে পরিসংখ্যান তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে চার বছরে , শাসকের প্রতি ঘৃণা সঞ্চারিত হয়েছে জনমানসে। ফলে আটচল্লিশে যাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল সুকৌশনে তা আর চাপা দেওয়া সম্ভব হল না । এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় পরদিন থেকেই যুবশক্তির ভেতরে আগুন জ্বলতে শুরু করল ।

পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের পাতায় আমরা কী দেখলাম? দেখলাম যে, ৩০ জানুয়ারি সব শিক্ষায়তনে ধর্মঘট। প্রতিটি এলাকায় প্রতিটি মহল্লায় মানুষের মিছিল।ছাত্র যুবদের ডাকে পথে পথে মানুষ। স্লোগানমুখর মিছিলের দাবি —‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দুর্বার উচ্চারণে কেঁপে উঠল বাতাস। এখানেই শেষ নয়। পরদিন ৩১ শে জানুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হল । মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা। ৪০ সদস্যের ওই পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হলেন কাজী গোলাম মাহবুব।

 রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটি, যুবলীগ এবং বিভিন্ন কলেজ ইউনিয়নের মতো একাধিক ছাত্র এবং যুব সংগঠন গড়ে তোলা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৪ ফেব্রুয়ারির ছাত্রসভায় ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। গৃহিত কর্মসূচির মধ্যে ছিল দেশ জুড়ে হরতাল, সভা, শোভাযাত্রা এবং ঢাকায় অ্যাসেম্বলি (আইন পরিষদ) ঘেরাও। উদ্দেশ্য ছিল আইন পরিষদের প্রথম দিনের অধিবেশনেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য প্রস্তাব পাস করানো।

 ৪ ফেব্রুয়ারির ছাত্রসভা শেষে ১২-১৩ হাজার ছাত্রছাত্রীর বিশাল মিছিল নেমে এসেছিল রাজপথে। সেখান থেকে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বাসভবন বর্ধমান হাউসের সামনে জড়ো হয়ে তারা স্লোগান তুলেছিল : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’, ‘ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র চলবে না’ ছাত্রদের মিছিলে বেশ যুক্ত হয়েছিল অসংখ্যা সরকারি কর্মচারী ও সাধারণ শ্রেণীর মানুষ। তাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ অন্য মাত্রা যোগ করেছিল আন্দোলনে।


আরো পড়ুন: বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে যা কিছু প্রথম

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ekushe-february

একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সফল করার জন্য ঢাকায় বিভিন্ন হোস্টেলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বামপন্থী ছাত্র-যুবনেতারা সংগঠন গড়ার কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তাদের সঙ্গে ছিল রাজনীতি-সচেতন বৃহত্তর ছাত্রসমাজ। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিতে অংশগ্রহণ করে বিশাল জমায়েত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা পড়ার অধিকার চাই। উর্দুর আগ্রাসন মানছি না। মাতৃভাষার অসম্মান বরদাস্ত করা হবে না। ঔপনিবেশিক ভাষা চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। এই ছিল সেদিনের আন্দোলনের অভিমুখ। পাক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নির্ভীক বাঙালি সেদিন গর্জে উঠেছিল। তা মেনে নিতে পারেনি পাক সরকার। নেমে আসে দমন পীড়ন এবং নির্মম অমানবিক অত্যাচার। পাকিস্তানি নিরাপত্তারক্ষীদের বন্দুক গর্জে উঠে । কেঁপে উঠে আকাশ বাতাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পাক–‌গুলিতে লুটিয়ে পড়েন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর। অগণিত মানুষ গুলিবিদ্ধ হন। 

এতগুলো বললাম শুধু প্রেক্ষিত তুলে ধরার জন্য। কোন পটভূমির উপর দাঁড়িয়ে রচিত হয়েছিল এই ইতিহাস। যে সমস্ত ভাইদের রক্তে সেদিন রাঙা হয়েছিল রাজপথ। রক্তের নদী নেমেছিল দিকে দিগন্তে । তাদের কথা না বললে একুশের কথা কিছুই বলা হয় না। একুশ এই রক্ত শপথের নাম। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় সীমান্ত পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন। কবিতার কয়েকটি লাইন স্মৃতি থেকে তুলে দিলাম, ভুল হলে মার্জনা করবেন।
‘ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রোদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়…
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত…’

এই চল্লিশজনের নাম আজও আমরা জানতে পারিনি। প্রকৃত শহীদের সংখ্যা এভাবেই গোপন করে যায় শাসক। লাশ গায়েবের রাজনীতি তো আজকের নয়। কোন বিস্মৃত অতীত থেকে তার সূচনা। যেহেতু এই মৃত্যুর মিছিলে কোন প্রভাবশালীর নাম নেই। যারা শহীদ হয়েছিল তারা ছিল আমার আপনার ঘরের ছেলে। আমাদের মতো কাদামাটি থেকে উঠে এসেছিল তাদের ধুলোমাখা শৈশব। তাই প্রকৃত তালিকা প্রকাশিত হবে না কোনদিন। তবু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষই বদলে দেয় সমাজ। ইতিহাসের দিকচিহ্ন এঁকে যায় পাতায় পাতায়।  

রফিক । পুরো নাম রফিক উদ্দিন আহমেদ।প্রথম ভাষা শহীদ। বাবা আবদুল লতিফ মিয়া এবং মা রাফিজা খাতুন।মানিকগঞ্জ জেলার পারিল একটি ছোট্ট সবুজ গ্রাম। এই গ্রামের মানচিত্র থেকে উঠে এসেছিল রফিক। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল সে । গাঁ থেকে ৭ মাইল দুরে বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় । এখান থেকেই ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশ পাশ করে সে ।বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হয় মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে।বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিক ছিল তার বাবা।  ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তেই বাবার প্রিন্টিং ব্যবসা দেখাশোনার কাজে হাতেখড়ি রফিকের ।রাহেলা খাতুন পানু তার গ্রামেরই একটি মেয়ে।তাকে খুব ছোটবেলা থেকেই ভালবাসতো রফিক। হাসিখুশি চঞ্চল মেয়েটি স্বপ্ন দেখত এক সুখী সংসারের। দুই পরিবারের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে  বিয়ের দিনও ঠিক করা হয়। সেই উপলক্ষ্যেই বিয়ের বাজার করার জন্য ঢাকায় এসেছিল রফিক। ২১শে ফেব্রুয়ারী বিয়ের শাড়ি -গহনা ও অন্যান্য জিনিস কিনে সন্ধ্যায় পারিল গাঁয়ে নিজের বাড়িতে ফেরার কথা ছিল তার । কিন্তু সে যখন শুনতে পেল ছাত্রদের দাবি, বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করতে হবে। সেও পা মেলাল মিছিলে। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলে ঢুকে স্লোগানে আকাশ কাঁপাল রফিক। জনতার এই ভয়াবহ শক্তি দেখে ভয় পেল শাসক। র্নিবিচারে গুলি চালাল জনতার উপর । একটি গুলি এসে লাগল রফিকের মাথায়। ঘটনাস্থলেই মারা গেল সে। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। তার লাশ গায়েব করে দেয় পুলিশ। তার মৃতদেহকেও ফিরতে দেওয়া হয় না তার পারিল গ্রামে। গ্রামের এই কৃতি সন্তানকে শেষবারের মতো কোলে নিতে পারল না পারিল গ্রাম। বিয়ের অপেক্ষায় বসে থাকা তার প্রেমিকা, তার ভালোবাসার মানুষ শেষবারের মতোও দেখতে পেল না প্রিয় মানুষের মুখ। কান্নাভেজা গলায় রাহেলা শুধু বলেছিল- “তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে সন্ধায় বাড়ি ফিরবে। কথা রাখলে না। আমি কী দোষ করেছি বলো?”

 জনরোষের ভয়ে পরদিন সেনাদের সাহায্যে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদ রফিককে দাফন করা হয়। কিন্তু তাঁর কবরের কোন চিহ্ন মেলেনি। শরীরের রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে সে লিখে গেল ভালোবাসার আরেক নাম বাংলা ভাষা।

আব্দুল জব্বার ১০ অক্টোবর ১৯১৯ ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে। তার বাবা হাছেন আলী এবং মা সাফাতুন্নেসা খুব সহজ সরল মানুষ। শত দারিদ্রেও  তাদের মুখের হাসি অমলিন। স্থানীয় ধোপাঘাট কৃষ্ণবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিল জব্বার। ঘরে অভাব। পড়তে পারেনি বেশিদূর। প্রাথমিকেই ইতি টানতে হয় তাকে। পেটে খাবার না থাকলে লেখাপড়া তো বিলাসিতাই। তার চেয়ে  চাষবাসে বাবাকে সাহায্য করলে ঘরে দুটো পয়সা আসবে। সংসারে সুখ ফিরবে। তখন তার বয়স মাত্র ১০ বছর। শত পরিশ্রমেও অভাবের থাবা থেকে নিস্তার নেই। চাষবাসে কতই আর আয়। নুন আনতে পান্তা ফুরোনো দশা। এতগুলো পেটের খাবার জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাই পনের বছর বয়সে ঘর ছেড়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে জব্বার। নারায়ণগঞ্জে এসে সেখানে জাহাজ ঘাটে এক ইংরেজ সাহেবের সাথে দেখা হয়। সাহেব তাকে একটি চাকরি দিয়ে বার্মায় পাঠান। সেখানে দশ-বারো বছর কাজ করে রফিক। সেও ছিল হাড়ভাঙা খাটুনি। তাই  পরে নিজ গ্রামে ফিরে পিএনজিতে যোগদান করে। সেও ভালো লাগে না তার। তাই শেষমেশ ট্রেনিং নিয়ে ‘আনসার কমান্ডার’ হিসেবে কাজে যোগ দেয়।

১৯৪৯ সালে তিরিশ বছর বয়সে  আমেনা খাতুনের সাথে বিয়ে হয় তার । নূরুল ইসলাম বাদল নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। দেড় বছরের ছেলে ও স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ক্যান্সার আক্রান্ত শাশুড়িকে চিকিৎসা করাতে ঢাকা মেডিক্যালে আসে জব্বার।অসুস্থ শাশুড়ির জন্য দুশ্চিন্তা।আর্থিক স্বচ্ছলতাও তেমন নেই। পকেটে সামান্য কিছু পয়সা। গ্রামের এক বন্ধুর কাছে  ঢাকার ছাত্রাবাসেই রাতটা কাটায় জব্বার। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ শাশুড়ির জন্য ফল কিনতে বাজারে এসেছিল জব্বার। বাজারে জনতার মিছিল। জব্বার দেখতে পায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে হবে এই  দাবি নিয়ে ব্যানারসহ সমবেত হয়েছে অগণিত ছাত্রছাত্রী। আব্দুল জব্বার আর স্থির থাকতে পারেনি । নিজেকেও যুক্ত করে ফেলে এই আবেগের সাথে। এ দাবি তো তার নিজের দাবি। যে ভাষায় সে তার মাটির সাথে কথা বলে, গাছগাছালি পাখিদের সাথে কথা বলে সেই ভাষার অধিকার রক্ষার দায় তো তারও। অসুস্থ শাশুড়ির কথা ভুলে যায় সে। ফল আনতে বেরিয়েছিল ভুলে যায় সেই কাজের কথাও। বাংলা ভাষা মা আমার… বলতে বলতে ব্যানার হাতে নিয়ে সে মিছিলের সামনের সারিতে এসে দাঁড়ায়।

 পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হয় মিছিলের উপর, সামনের সারিতে থাকা  আব্দুল জব্বারের রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে পড়ে। তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। ক্ষতস্থানে  রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি তার। মাতৃভাষার জন্য প্রচুর রক্ত ঝরিয়ে ওইদিন রাতে মৃত্যু হয় তার। প্রতিটি মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া জনচেতনা স্পর্শ করেছিল তাই বিরুদ্ধ মত  ভিন্নমত পদ্মায়  ভাসিয়ে দিয়ে একাত্ম  হয়েছিল সমবেত  ছাত্রদের প্রতিবাদী চেতনা। এর বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় মানুষের শোকে কান্নায় ও স্তব্ধতায়।   দলে দলে মানুষ ছুটে আসতে থাকে হোস্টেল প্রাঙ্গণে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

 ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা এমন ভাষা আর যে নাই

এ ভাষাতে মা-কে ডাকি ডেকেছে মোর সালাম ভাই।’

মোহাম্মদ মাতু মিয়ার গানে উঠে আসে আমাদের সালাম ভাই।ফেনী জেলার দাগনভুঁইঞা উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামে  ১৯২৫ সালে তার জন্ম । লক্ষণপুরের নাম আজ সালাম নগর। কেউ যদি এই গ্রামে যান বুঝতে পারবেন সালাম আজও বেঁচে আছে। আজও সবাই গর্ব করে বলে এ  গ্রাম সালামের গ্রাম। এ মাটি শহীদের মাতৃভূমি। সালামের বাবা মোহাম্মদ ফাজিল মিয়া এবং মা দৌলতুন্নেসা। ক্লাস নাইন অবধি পড়েছিল সালাম। তারপর জীবিকার সন্ধানে চলে আসে  রাজধানী ঢাকায়। চাকরি একটা জুটেও যায় তার। কম বেতনের চাকরি। অবশ্য বড়সড় চাকরি কেইই বা তাকে দেবে।পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগে পিওনের কাজ পায় সে। সামান্য বেতন। ঘরে তেমন স্বচ্ছলতা নেই। কাজের জন্য ঢাকাতেই থাকতে হত তাকে। ভাইবোনেদের মধ্যে বড় সে। তার দায়িত্ব তো কম নয়। চারদিকে তাকিয়ে সালাম দেখল কেমন একটা থমথমে, অস্বস্তিকর, গুমোট ভাব। প্রকৃতিতে ফাল্গুন এসেছে। হালকা ঠান্ডায় একটা চাদর জড়ানো আছে গায়ে। বাজার  থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুব বেশি দূরে তো নয়, সে বুঝতে পারছিল কিছু একটা হচ্ছে চারপাশে। বুকের ভেতর উথালপাথাল করছে সেই উত্তেজনা। ছাত্রদের মিছিল, মিটিং, উচ্চকণ্ঠ স্লোগানের খবর কানে আসছে তার।১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা মিছিল করছে।

মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে  বছর ছাব্বিশের তরুণ সালামের হৃদয় ছুঁয়ে যায় সেই বিপ্লবের কথা । তার মনে হয় “ বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আমিই লেনিন”। দিনটা ছিল ৮ই ফাল্গুন ১৩৫৯  ইংরেজি ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ,  তাই আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় সালাম। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে  আসে সে। পা বাড়ায় মিছিলে।  বিকেল তখন  তিনটা।  পুলিশের বেগালাম এবং অমানবিক গুলিবর্ষণে গুলিবিদ্ধ হয় সালাম। তার পেটে গুলি লাগে।  রক্তাক্ত  অবস্থায় আবদুস সালামকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।  ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় টেলিগ্রাম মারফত  ফাজিল মিয়াকে খবর দেওয়া হয় । ফাজিল মিয়া ছেলেকে দেখতে  ঢাকা মেডিক্যালে ছুটে আসেন। ঢাকা হাসপাতালেই ২৫ ফেব্রুয়ারী বেলা সাড়ে ১১টার সময় বাবার কোলে মাথা রেখে  আবদুস সালামের মৃত্যু হয়। 

কেউ কেউ খুব লম্বা হয়। শুধু শারীরিক উচ্চতায় নয়, কাজেও। আবুল বরকত লম্বা একটা ছেলে। তার বাবা লম্বা।  তার কাকা লম্বা। সবাই বলত তালগাছের বংশধর। কিন্তু তার কীর্তি তার শারীরিক উচ্চতাকে অতিক্রম করে  আকাশস্পর্শী। সবার মাথা নুয়ে আসে তার কথা বললে। বরকতের বাবা শামসুজ্জোহা দিলদরিয়া মানুষ, গাঁয়ের সবাই ডাকে ভুলু মিয়াঁ নামে।সব সময় খুশমেজাজে থাকেন।হবে নাই বা কেন? সিরাজউদ্দোলার মুর্শিদাবাদের মানুষ তো।মা হাজী হাসিনা বেগম সাধারন গৃহবধু । বরকত পড়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। থাকত বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পুরানো পল্টন ঢাকা।পলিটিক্যাল সায়েন্সের  কৃতি ছাত্র সে। অনার্স পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিল। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সে বুঝেছিল যতই কাঁটাতার দেওয়া হোক না কেন, পেন্সিল দিয়ে গভীর ভাবে এঁকে দেওয়া হোক বিভাজনের দাগ ঢাকা আর মুর্শিদাবাদ তবু একটাই তো দেশ। একই মাটি জল আর ভাষা ছুঁয়ে থাকা অভিন্ন ভূখন্ড। বাংলা ভাষাই তো জুড়ে রেখেছে সম্প্রীতির বন্ধন। এই ভাষা আমাদের সবার মা। ঢাকা আর ঢাকুরিয়ার মানুষ এক ভাষায় কথা বলে। পুরুলিয়া মিলে যায় পাবনার সাথে। উচ্চতায় লম্বা বরকত তার গমগমে গলায় এই কথাগুলো বলত। মানুষ শুনত আগ্রহ নিয়ে। সুউচ্চ দেওয়ালের  গায়ে পোস্টার টাঙাতে তার জুড়ি ছিল না।  

তার নিজের হাতের লেখায় জ্বলজ্বল করত সেই পোস্টার – ‘নাজিম, চুক্তি পালন কর, নইলে গদি ছাড়। রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম আমাদের জীবন-সংগ্রাম’।সাদা কাগজের উপর গাঢ় লাল কালিতে লেখা আগুনের বর্ণমালা। হাসান হাফিজুর রহমান তার বন্ধু।  বিপ্লবের কবিতা লিখত। পোস্টারে কখনও কখনও উঠে আসত সেইসব কবিতা।

২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২  ১৪৪ ধারা অমান্য করে এগিয়ে যাচ্ছে ছাত্রদের মিছিল।প্রতিবাদী হাতগুলো যেন  আকাশ নামিয়ে আনবে মাটিতে।ক্রোধী যুবকদের দিকে প্রথমে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করে পুলিশ। টিয়ার গ্যাসের সেলে ধোঁয়ায় ধোঁয়াময় হয়ে যায় চারদিক।চোখে জ্বালা নিয়ে সামনের ভাঙা পাঁচিল থেকে একটা তুলে নিয়ে দূরের দিকে ছুঁড়ে মারে বরকত। তার লম্বা হাতের নিশানা অব্যর্থ। ইটটা সঠিক জায়গায় গিয়ে আঘাত করে। শুরু হয় প্রত্যাঘাত। ইটের বদলে ছুটে আসে গুলি।মাটিতে পড়ে যায় আবুল বরকত। সবাই ভেবেছিল টিয়ার গ্যাসের প্রতিক্রিয়া।মাথায় জল ঢালা হয়। চোখে জল দেওয়া হয়। ধোঁয়ার মধ্যে দেখা যাচ্ছিল না কিছুই। গলগল করে রক্ত ঝরছে । লাল হয়ে গেছে জামা। এই সত্যটা যখন পরিষ্কার হল সবাই মিলে ধরাধরি করে স্ট্রেচারে শোয়ানো হলো বরকতের লম্বা শরীরটাকে । স্ট্রেচার বেয়ে রক্ত গড়িয়ে  পড়ছে মাটিতে ।মাটিতে ফুটে উঠছে এক একটি অক্ষর।

 মুর্শিদাবাদের  ভরতপুরের বাবলা গ্রামে তখন আকাশে  জ্বলজ্বল করছে দুটি তারা।  ঘড়িতে সময় সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা, বাংলাদেশের সময় রাত্রি আটটা। শেষবারের মতো নিঃশ্বাস ছাড়ল বরকত, কাওকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার স্বপ্ন দেখা চোখ। মৃদু ও মর্মরিত একটি নিঃশব্দ উচ্চারণ ভেসে উঠল তার ঠোঁটে – মা।

 আজ আকাশ এত লাল কেন? মুর্শিদাবাদ জেলার  ভরতপুরের বাবলা গ্রামের কয়েকটা ছেলে নিজেদের মনকেই প্রশ্ন করল। তাদের গাঁয়ের লম্বা ছেলেটার মাথা ঠোকা যেত চৌকাঠে। আজ আরও ঢ্যাঙা হয়ে গেছে সে। চোখদুটো আলোকিত করে দিয়েছে সারা আকাশ।

শফিউর রহমান। জন্ম ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, হুগলি জেলার কোন্নগরে। বাবা মওলানা মাহবুর

রাহমান । মা কানেতাতুন্নেসা। কলকাতা গভর্ণমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আই কম পাশ করার পর বি কম পড়ার ইচ্ছে ছিল তার, সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি।১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তারা সপ্রিবারে ঢাকায় চলে আসে। সেখানেই  হাইকোর্টের হিসাবরক্ষক শাখায় কেরানীর কাজ নিতে হয় তাকে।১৯৪৪ সালে কলকাতার সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে আকিলা বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। 

 ২২ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। সেদিন সকাল সকাল স্নান করে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছিল শফিউর।তিন বছরের মেয়ে শাহনাজ। বাবাকে কিছুতেই ছাড়বে না। তার হাজার রকম বায়না। আকিলাও বলেছিল- আজ কি না গেলেই নয়?  কাল যা ঝড় গেছে সারা শহরের উপর দিয়ে। মা কানেতাতুন্নেসাও নিষেধ করেছিল অফিস যেতে। মুগ ডাল, বেগুনপোড়া আর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে তার পুরানো সাইকেল্টা নিয়ে রাস্তায় বেরুতে যাচ্ছিল শফিউর। আকিলা কালো রঙের কোটটা হাতে দিয়ে বলল- পরে নাও। ফেরার সময় ঠান্ডা লাগবে। সিজন চেঞ্জের সময়।এখন সাবধানে থাকতে হবে।আরেকজন আসছে ঘরে, ওর জন্য তোমাকে এখন সুস্থ থাকতে হবে। বেশি বেশি পরিশ্রম করতে হবে। শফিউর আকিলার দিকে তাকাল। দ্বিতীয়বার বাবা  হতে আর কয়েকমাস মাত্র বাকি তার । স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে আছে আকিলার সর্বাঙ্গে। স্ত্রীকে আদর করে, মেয়েকে কোলে নিয়ে উজ্জ্বল এক বুক স্বপ্ন বুকপকেটে রেখে সাইকেল নিয়ে অফিসের দিকে রওনা হল শফিউর। একটা মোড় ঘুরে সাইকেল চালিয়ে রথখোলা নওয়াবপুর রোডে থামল সে। এত এত মানুষ আজ রাস্তায় বেরিয়েছে প্রতিবাদে । সাইকেল থামিয়ে সে নামল। ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এমনি সব স্লোগানে চারদিক মুখরিত।  সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে সে ভিড় পেরিয়ে যেতে চাইল। যেতে যেতে  কখন যে নিজে এই মিছিল এবং  প্রতিবাদের ভেতর মিশে গেছে সে নিজেও জানে না। তার মনে হতে লাগল তার গলার ভেতর যেন অজস্র বাঙালীর চিৎকার। তার পা মিশে গেছে  অগণিত পায়ের মিছিলে। তারপর হঠাৎ কয়েকটা গুলির শব্দ হল । শফিউর রহমানের পিঠে এসে লাগল একটা গুলি।সাইকেল ছেড়ে সে  রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়ল, কাতরাতে লাগল। তার চোখের সামনে আবছা হয়ে যেতে লাগল আকিলার মুখ, শাহনাজের হাসি, আসন্ন সন্তানের স্বপ্ন।তার কালো কোট লাল হয়ে গেছে রক্তে।তখনও বুকের ভেতর ধুকপুক করছিল প্রাণ। সরকারি এম্বুলেন্সে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।সেখানে তার অস্ত্রোপচার হয়। শরীরে গেঁথে থাকা বুলেট বের করে আনা যায় না। অপারেশন সাকসেস না হওয়ায় ঐ দিন সন্ধ্যে সাতটায় তার মৃত্যু হয়।   

ভাষা সৈনিক এবং গবেষক আহমদ রফিক তাঁর একুশ থেকে একাত্তর বইয়ে নিহতদের মধ্যে আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেছেন।এদের সম্পর্কে আমরা সামান্য যে সব তথ্য জানতে পারি তা হল- আবদুল আউয়ালের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১১ মার্চ ঢাকার গেন্ডারিয়ায়।পেশায় রিক্সাচালক। ২২ ফেব্রুয়ারি যখন শোক মিছিল বেরোয় রাস্তায়।  আবদুল আউয়াল সেই শোক মিছিলে অংশ নিয়েছিল।মিছিলটি  কার্জন হলের সামনের রাস্তা দিয়ে  যখন যাচ্ছিল তখনই সশস্ত্রবাহিনীর একটি ট্রাক তাকে পিষে দেয়।একে নিছক পথদুর্ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করে হলেও এটি পরিকল্পিত হত্যা। হত্যা এই কারণে যে সশস্ত্র বাহিনির ট্রাক দিয়ে শোক মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করাই ছিল শাসকের নির্দেশ।বাবার রক্তাক্ত দেহ দেখে সেদিন স্তব্ধ ও বোবা হয়ে গিয়েছিল  ছ বছরের মেয়ে বসিরণ।  আবদুল আউয়ালের সাথে সেদিন আরও একজন ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়েছিল তার নাম জানা যায়নি। 

মোঃ অহিউল্লাহ জন্ম ১৯৪১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, জানা যায়নি তার গ্রামের ঠিকানা। অহিউল্লাহর বাবা পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রি। ঘরে অভাব নিত্যসঙ্গী। ফলে শিশুশ্রমিকের কাজ করতে হত অহিউল্লাহকে। অবসর সময়ে সুন্দর ছবি আঁকত সে। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র অহিউল্লাহ মনের আনন্দে জনতার সমাবেশ দেখতে এসেছিল সেদিন।ঢাকার নবাবপুর এলাকায় বংশাল রোডের মোড়ে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে  দাঁড়িয়েছিল সে। তখনই পুলিশের গুলি তার মাথায় লাগে। তার খুলি উড়ে যায়।পুলিশ তার লাশ গায়েব করে দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারির দৈনিক আজাদ পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়।

 সিরাজুদ্দিন থাকত তাঁতিবাজারের বাসাবাড়ি লেনে। নবাবপুরের নিশাত সিনেমাহলের বিপরীত দিক থেকে একটি মিছিল আসছিল। সেই মিছিলে ছিল সিরাজুদ্দন। ঐ সময় ই পি আর জওয়ানের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। এই খবর জানা যায় কলকাতাবাজার মহল্লার অধিবাসী নান্না মিয়াঁর জবানবন্দী থেকে। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল সে।

 একুশ এলে বুকের ভেতর পলাশ ফোটে। পলাশে পলাশে লাল হয়ে যায় ডাহা ও ডহর। এই প্রান্তরের ভেতর আমরা দেখতে পাই সেই রক্তাক্ত স্মৃতিচিহ্ন।আকাশে জ্বলজ্বল করে কত তারা। আলোয় আলোয় উজ্জ্বল এই ভাষাপথে ওরা এক একটি অক্ষর লিখেছে রক্ত দিয়ে।তাদের সবার নাম জানা হয়নি আমাদের।  

তথ্যঋণ –

ভাষা আন্দোলন উপর প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকা।

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিত-  জোবায়ের আলী জুয়েল।

অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত বিভিন্ন তথ্য।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত