| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

ভাষা দিবসের প্রবন্ধ: উন্মাতাল বায়ান্ন | মণিকা চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সময় প্রবাহের বৃহৎ চিহ্নগুলো ক্রমেই এক অসীম ইতিহাস হয়ে মনের পাতায় স্থির হয়ে থাকে। এই অনিবার্য স্থিরতার পিছনে রয়েছে, ওই নির্দিষ্ট উত্তাল সময়টির স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা। সময়কে পিছন ফিরে দেখতে গেলেই সেখানের ফাটলগুলো এই বয়সে এসে আমাকে ভাবায়। সেই সব কথা আমার জন্মেরও অনেক আগের। তবু বাবা-মা, দিদা-দাদুর মুখে রূপকথার মতো বারবার শুনতে শুনতে, যেন খুব শৈশব থেকেই টের পেয়েছিলাম ঘটনাগুলোর আওয়াজ যেন তখনি কানে পৌঁছাচ্ছে। সেসব অভিজ্ঞতা, চিন্তা, ইতিহাসের পাঠ,এৗতিহাসিক চলচিত্র, সব মিলিয়ে নিজের মধ্যে এক ভাবনার জগৎ তৈরি করে। চিন্তাগুলো যেন টান-টান হয়ে ওঠে।

দেশের সঙ্গে,ভাষার সঙ্গে, মানুষের প্রাণ এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা। আস্ত একটা বড়দেশ ভাগ হবার নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে, গল্পগুলো এসে দাঁড়াতো বায়ান্নোর রক্তাক্ত ফাগুনের নীচে। সালাম, রফিক, বরকত নামগুলো যেন এক একটি দীপ্র কবিতা। ক্রমশ টের পাই, নিজের অজান্তেই, বাঙলা ভাষার টিকে থাকার রক্তাক্ত সময়টিকে। মদনমোহন তর্কালঙ্কার এর বাল্যশিক্ষার প্রভাত কবিতাটি (পাখীসব করে রব রাতি পোহাইল), বা সত্যন্দ্রনাথ দত্তের ‘কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল’ অথবা আল মাহমুদের ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে’-এই সবই যেন প্রবলভাবে প্রচন্ড তাঁদের নিশ্চিত মর্যাদা আর ব্যক্তিত্বে। স্পষ্টতই সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্থানের ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বাঙলা ভাষার এক নতুন জন্মের আর্তি, ও এক সুস্পষ্ট অর্জন। গভীর অন্তরঙ্গতায়,আর শ্রদ্ধায় মিলেমিশে থাকে বাংলা ভাষার এইসব কবিতার সঙ্গে ইতিহাসের কন্ঠস্বর। ভাষার ভিতরে পাথরের মতো কঠিন সাধনার স্থির পথটিকেও দেখতে পাই একইসঙ্গে।


আরো পড়ুন: একুশের কবিতা ও গান

ক্রমেই বুঝতে পারি, ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য ছিলনা। এখানে ছিল বাঙালি ও অবাঙালি মধ্যবিত্তের শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থানের ভারটির সঙ্গে সামগ্রিকভাবে জড়িত ছিল ছাত্রসমাজ। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্থানপন্থী বুর্জোয়া শ্রেণি বিকাশের ক্ষেত্র ও বৈশ্বিক পুঁজিবাদ একটি গভীর অনিবার্য সম্পর্কে ছিল। পূর্ব পাকিস্থানের উৎপাদনশীল মূল কাঠামোর সঙ্গে ভাষার যে সমাজতত্ত্ব রয়েছে, সেখানে বাঙলা ভাষা ছিল সরাসরি সংযুক্ত। তাই কৃষিনির্ভর পরিবারের ছাত্রসমাজ অন্য একটি আরোপিত ভাষাকে নিজের করে নিতে চায়নি। পশ্চিম পাকিস্থানের ভাষাভিত্তিক এই আগ্রাসন ছিল পরবর্তী নৈরাজ্য সংঘটনের অস্থির কাঠামো।

ভাষা সৃষ্টি হয় বহু শতাব্দী ধরে। ঊনিশ শতকের আগে বাঙলা ভাষার রূপটিকে আমরা অবিকশিত হিসেবেই দেখি। বিদ্যাসাগর মনে পরিয়ে দেন বাঙলা ভাষার সাধুরীতি ও গদ্যকে। সুস্থির বাক্য-কাঠামো ও সুশৃঙ্খল চিন্তার প্রকাশের জন্য আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। ভাষার মধ্যে দিয়ে সুশৃঙ্খল চিন্তার প্রকাশ যে কত দুরূহ, কত সাধনার ধন তা বুঝতে পারি। বিদ্যাসাগর পূর্ববর্তীদের সঙ্গে পরবর্তীদের ভাষারূপ দেখে। অনেক বেশি সুপরিকল্পনা ও সুস্থিরতার মাধ্যমে তিনি চর্যাপদের আলো আঁধারির ভিতর থেকে পরিশ্রুত করেছিলেন তাঁর জাতির ভাষা। ধ্বনি, রূপ, শব্দ, বানানরীতি ও সুস্থিত চিন্তার প্রকাশের জন্য, একটি মান বাঙলা ভাষার জন্য, তাঁকে অনিবার্যভাবে হাত পাততে হয়েছিল সংস্কৃতের কাছে। তিনি তৎসম, তদ্ভব, ও বিদেশি শব্দের অনুপাত স্থির করেছিলেন গভীর অর্ন্তদৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। ঊনিশ শতকের মাঝভাগে বিদ্যাসাগরের সাধুরীতির কাঠামোটিই, লিখিত বাঙলার মানকাঠামো হয়ে দাঁড়ায়। এই সাধুরীতিটি আমরা পরবর্তীতে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য রচনাতেও দেখতে পাই। যদিও তিনি তাতে মিশিয়ে নেন তাঁর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই সময়েই বাঙলা মানভাষার পাশাপাশি মৌখিকভাবে চলতি ভাষারও বিকাশ ঘটছিল।

শ্রীমধুসূদনের রচনাবলী অভিনব ধরনের। পশ্চিম থেকে তিনি নিয়েছেন অনেক, ঋদ্ধ করেছেন বাঙলা ভাষাকে।ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতায় বাঙালীর স্বাভাবিক চলনটি পাওয়া যায়। তারপরে রবীন্দ্রনাথের বেলায় আমরা পেলাম এক অভুতপূর্ব ও অসামান্য প্রকাশ। পশ্চিমের সাহিত্যবোধের সঙ্গে মিলিয়ে, তিনি তৈরি করলেন নতুন সাহিত্যবোধ, ভাষাকে দিলেন স্থবিরতা থেকে মুক্তি।

আমাদের অতীতের যাঁরা ছিলেন, এই বাঙলায়-আলাওল, কায়কোবাদ, মীর মশাররফ হেসেন তাঁরাও তাদের নিজস্ব বৈশিষ্টে স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমবঙ্গের যেমন নিজস্ব, এই বাংলায় তা নয়। একুশে ফেব্রুয়ারির অনেক রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীতকে আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে মাতৃভাষার প্রতি প্রেমের আলোড়ন জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ছায়ানটের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। সানজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক এবং আরও অনেকে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। পঞ্চকবির গানগুলো ক্রমেই হয়ে উঠেছিল গণজাগরণের প্রেরণা। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পীড়নের মধ্যে দিয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে পরবর্তী একাত্তরের যুদ্ধ। এই পুরো সময়টিতে রাজনৈতিক পীড়ন যত বেশি হয়েছে, ততই এই বাংলার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির ভিতর প্রতিষ্ঠিত আশ্রয়ের কাছে। এই সময় মানুষ স্বপ্ন দেখেছে এক শোষণহীন সমাজের। কবি আহসান হাবীব, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, চৌধুরি ওসমান, আব্দুল গাফ্ফার চৈৗধুরি, হাসান হাফিজুর রহমানদের কবিতায় আধুনিক চেতনার উপলব্ধি পাওয়া যায়। বাঙলা ভাষাকে আশ্রয় করেই উত্তরোত্তর গণচেতনা জাগাবার গানগুলোও একাত্তরের যুদ্ধে বাঙালীকে দেয় সংগ্রামী মনোভাব। একটি দশক ধরে বাঙলা ভাষার এই নতুন স্রোত এই বাঙলার মানুষদের মননে ও চিন্তায় অভিনব অনুপ্রেরণা নিয়ে আসে। একটি নতুন দেশ-নতুন মানচিত্রের জন্য আমরা এই ভাষার কাছে সর্বোতোভাবে ঋণী।

‘একুশে ফেব্রুয়ারি’-‘শহীদ দিবস’- ‘এখন আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পরিগণিত, ২০১০ সালের জাতিসংঘের গৃহিত প্রস্তাব অনুযায়ী। নিজের ভাষার জন্য, এত ত্যাগ, অতীতের কাছে এভাবে দায়বদ্ধ থাকার পরেও কোথাও এক স্থবিরতা যেন আমাদের ক্লান্ত করে। পুরো বিশ্বের সঙ্গে আমরা এখন সহজেই থাকতে পারি,তবু আর্ন্তজাতিক মানের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এক গভীর হতাশাবোধ রয়েছে। সৃষ্টি,বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের জায়গাগুলো যেন এক গভীর অন্ধবোধ দ্বারা সীমাবদ্ধ। রাজনীতি ও ধর্মের পীড়ন ও সঙ্গে পুঁজিবাদের চেহারাটি যেন অতীতের মতোই পরাক্রমশালী। এখন মাতৃভাষা ছাড়াও আমাদেরকে চর্চা করতে হয় কম্পিউটারের ভাষা। ইংরেজী ভাষা, ইমোজীর ভাষা। একসময় জার্মান ও ফরাসীরা তাদের ভাষার শুচিতা ও শুদ্ধতা নিয়ে খুবই কঠোর ছিলেন। দিন পাল্টাচ্ছে। নিজ মাতৃভাষার বিষয়ে উদ্বিগ্নতা থাকার পরও। ওরা এখন কম্পিউটারের গুগলের ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। পুঁজিবাদের সঙ্গে এই ভাষা সাম্রাজ্যবাদ পরবর্তী সময়ে মাতৃভাষার শরীরকে কতটা সুস্থ রাখবে, তা ভবিষ্যৎই বলবে। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের ঐতিহ্যকে সম-সাময়িকতার সঙ্গে সৃষ্টিশীল ও তাৎপর্যপূর্ণ করবার একটি দায় রয়েছে সকলেরই।

আমাদের এখানেও চলিত ভাষার রীতি নিয়ে নতুনেরা এগিয়ে আসছেন পরম্পরায়। ভাষায় বদলও ঘটেছে। অনুবাদ হচ্ছে আমাদের সাহিত্য। বিদেশী সাহিত্যকেও আমরা খুব নিজের করে পাচ্ছি অনুবাদের মাধ্যমে। আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ, ইংরেজী শব্দের প্রয়োগ, আমাদের ভাষা, সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে এখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই উপস্থিত। খুব বেশি মাত্রায় মৌলিক না হলেও, নতুন ধারাটি এক স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে নিজস্ব বৈশিষ্ট মন্ডিত। নিজ দেশ ও নিজ ভাষার মৌলিক চিন্তাগুলোকে যেন আমরা আরও উৎকর্ষতার দিকে নিয়ে যেতে পারি, আরও বেশি করে মূল্যায়ন করতে পারি।

ভাষা দিবসের কাছে,আমাদের অঙ্গীকার থাকুক, আজকের যুগে অনেক ভাষার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও, আমাদের মাতৃভাষাটি যেন হয় অন্তরঙ্গতম। আমাদের একান্ত অনুভবগুলো মাতৃভাষাতেই আলোড়িত হোক আমাদের নিজস্ব অর্ন্তলোকে।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত