| 21 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

জোৎস্না রাত্রি

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
এক.
‘এই, কি করছো? ছাদে যাও তো?’
‘কেন? এই রাতে আবার ছাদে কি?’
‘আরে যাও না বাবা। রাত কি খুব বেশি হয়েছি নাকি? মাত্র তো নয়টা বাজে।’
‘তোমাকে নিয়ে না আর পারা গেলো না। একেক সময় একেক রকম পাগলামি। ভোরে বাগানে যাও। শিশির ভেজা ঘাসে পা রাখো। দুপুরে দখিনের জানালা খুলে দাঁড়িয়ে থাকো। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা পাখিদের দেখো। আর রাতে ছাদে যাও।’ ‘আর কোন কাজ নাই তোমার?’
‘আহহা ছাদে যাও না। গিয়ে পূর্ব দিকে তাকাও। দেখো আকাশজুড়ে চাঁদ উঠেছে বিশাল একটা। কেমন যেন আগুনরঙা আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ। তাড়াতাড়ি করো…’।
‘আচ্ছা বাবা যাচ্ছি যাচ্ছি। গিয়ে তোমাকে ফোন দিচ্ছি।’
‘হ্যা, মিতু। কি দেখছো বলো? চমৎকার না? আমি তো মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। আহ্ প্রকৃতি এতো চমৎকার হতে পারে!’
‘পারে। প্রকৃতিই চমৎকার। আমরা, মানুষেরাই তো নষ্ট করি প্রকৃতিকে। কষ্ট দেই, কুড়েকুড়ে খাই।’
‘তা ঠিক। কিন্তু আকাশটা দেখো। চাঁদের দিকে তাকাও। দেখো মনে হচ্ছে সমস্ত হৃদয় উজার করে দিয়ে চাঁদ যেন ডাকছে।’
‘আমার কি মনে হচ্ছে জানো?’
‘কি।’
‘আমার মনে হচ্ছে আমি ছাদ থেকে একটা ঝাঁপ দেই। ঠিক চাঁদের বুকে!’
‘ধূর! কি যে বলো! আমি বুক পেতে আছি কি জন্যে? ঝাঁপ দিতে হলে আমার বুকেই দিবা।’
‘হা হা হা।’
আকাশের বুক জুড়ে মোহনীয় সৌন্দর্য নিয়ে জেগে উঠেছে চাঁদ। চারদিক ভাসিয়ে দিচ্ছে আলোয়। আকাশে ছিট ছিট মেঘের আস্তরণ। হালকা বাতাস বইছে। প্রকৃতি তার সমস্ত সৌন্দর্য উজার করে দিয়েছে যেন। যেন হাসছে কখনো মন উজার করে। আবার কেন যেন মনে হচ্ছে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে আমাদের দিকে তাকিয়ে! আসলেই কি তাই? প্রকৃতি কি তাহলে দেখিয়ে দিচ্ছে, মানুষ নস্যি! বিজ্ঞান তার সৌন্দর্যকে নষ্টই করে যাচ্ছে শুধু। কষ্ট দিতে দিতে পাথর করে ফেলছে!
‘সৈকত?’
‘হুম।’
‘কি ভাবছো?’
‘কিছু না। জানো মিতু, আজ আমেরিকাতে কতজন মানুষ মারা গেছে? ১৭৩৬ জন! কত মানুষ মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। হাজার হাজার মানুষ নিরুপায় হয়ে ঢলে পরছে মৃত্যুর কোলে। মানুষ কত অসহায়, তাই না!’
‘আমাদের দেশেও বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। মৃত্যুও। কি হবে আল্লাহই জানেন।’
‘আমার কিছুই ভালো লাগছে না ইদানিং। ফেসবুক, টিভি খুললেই শুধু মৃত্যুর পরিসংখ্যান! ভালো লাগে না। কতদিন তোমাকে দেখি না। খুব দেখতে ইচ্ছে করে।’
‘ধুর পাগলী। কাঁদছো কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার মাঠ-ঘাট সড়ক ব্যস্ত হয়ে উঠবে মানুষের পদভারে। ভুতুরে এই নগরীতে ফিরবে প্রাণ?  আবার আমরা শিল্পকলায় যাবো। রমনার বেঞ্চে বসবো। বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ডুবে যাবো দু’জনের মাঝে গল্প-কথার উচ্ছ্বাসে; আগামীর দিনগুলোতে! সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন;সব।
দুই.
‘আব্বা…? মায় ডাকে। তাড়াতাড়ি যাও।’
‘তোর মায়রে এট্টু আইতে ক এইহানে,যা।’
ছোট্ট রুবেল ছুটে যায় মায়ের কাছে। রাত নয়টা বাজে। এখনো খাওয়া হয়নি তাদের। চুলায় ছোট্ট একটা হাঁড়িতে সামান্য কিছু চাল বসিয়ে জ্বাল দিচ্ছে রুবেলের মা জমিলা খাতুন। রুবেলের ছোট বোন ভাত ভাত করতে করতে চুপসে যাওয়া দু’মুঠো মুড়ি খেয়ে অগোছালো ভাবে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছে সে। বাধ্য হয়ে মুড়ি খাওয়ার কষ্ট তার চোখের কোণে লেগে আছে এখনো শুকিয়ে যাওয়া জলের রেখা হয়ে!
বাইরে চাঁদের আলোয় ভরে আছে চারপাশ। আকাশে বিশাল চাঁদ। খলবলে আলো ছড়াচ্ছে। রুবেলের বাবা আক্কাস শিকদার বাড়ির বাইরে বাঁশের চাটাই দিয়ে বানানো একটা বেঞ্চে বসে আছে। চেয়ে আছে আকাশের দিকে। শূন্য দৃষ্টিতে।
পেশায় ভ্যান চালক আক্কাস শিকদারের নিজের কোন ভ্যান নেই। অন্যের ভ্যান দিনচুক্তিতে ভাড়া নিয়ে চালায় সে। সারাদিনে দু্ইশ টাকা জমা দিতে হয় মালিককে। বিদ্যুতের চার্জের খরচ বাদে বাকী টাকা তার। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যা আয় রোজগার হয় তাতে করে চারজনের সংসার চলে যায়। হয়তো অনেক কিছুই হয়ে উঠে না সংসারে। কিন্তু পেট ভরে ভাত খেতে পায় তারা। তিন বেলা পেটভরে ভাত খেতে পারার সন্তুষ্ট নিয়েই সুখ আছে সংসারে।
কিন্তু হঠাৎ করেই সব পাল্টে গেছে। মৃত্যু ভয় তাড়া করে ফিরছে মানুষকে। করোনা ভাইরাসের কারণে হিসেব-নিকেষ পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবীর! গত এক মাস ধরে সব বন্ধ হয়ে আছে। ঘরের বাইরে কেউ বের হচ্ছে না। যাচ্ছে না কোথাও। ভ্যান চালক আক্কাসও ঘরবন্দী। বাধ্য হয়েই। কারণ ভ্যানে কোথাও যাওয়ার মতো কেউ নেই। বাজার-ঘাট সব খালি। ঘরে বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ আর নেই। ওদিকে হাঁড়ি শূণ্য। পেটের যন্ত্রনা তো আর থেমে নেই। জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিয়েছে গত সাতদিন ধরে। কেউ জিজ্ঞেস আর করেনি।
‘কি হইছে…. ডাকছো ক্যান।’ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ায় জমিলা খাতুন। হালকা বাতাস তার ঘামে ভেজা শরীরে শীতল ছোঁয়া দিয়ে যায়।
‘তারাতারি কও। কিজন্যে ডাকছো।’ কিছুটা কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠে জমিলা।
‘বহো এহানে। চাইয়া দেহো কি সুন্দর চাঁন উঠছে। চান্দের আলো যে এত সুন্দর হয় আগে বুঝি নাই।’
‘চাঁন দ্যাখলে প্যাট ভরবো। প্যাট তো চাঁন বুঝে না।’ দুঃখী গলায় বলে জমিলা।
আক্কাস শিকদার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। চাঁদের সৌন্দর্য বোঝার চেষ্টা করে ভুলে থাকতে চায় পেটের ক্ষুধা। জমিলা তাকায় স্বামীর মুখের দিকে। স্বামীর চোখ অনুসরণ করে চাঁদের দিকে। চাঁদ ঘিরে আকাশে ছিট ছিট মেঘ। সামনের খোলা মাঠ ভরে আছে জোৎস্নায়।
‘আব্বা…?’ সন্তান রুবেল কখন যেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সন্তানের দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয়,‘হু…’।
‘আজকের চাঁদ দেখতে ঠিক পরাটার মতোন….ঠিক না আব্বা!’
বলেই হেসে উঠে রুবেল।
পরোটার গন্ধে ভরে উঠে চারপাশ। বুক ভরে শ্বাস নেয় রুবেল। দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। ঝিঁঝিঁ পোকারা তাদের সংগীত থামিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়!
তিন.
‘লাইট জ্বালানো লাগবো না। চান্দের আলো দেখছোস….। একবারে ফকফকা। তয় দূর থেকে ঠিক ঠাহর করা কষ্ট হইবো। কিন্তু লাইট জ্বাললেই দূর থেকে কেউ দেইখা ফেলতে পারে।’
‘বস্তা কয়টা আনছোস? চাউল কিন্তু ম্যালা।’
রাত নয়টা। সুনসান চারপাশ। বাজারঘাট সব বন্ধ। ভোরে কিছু সময়ের জন্য খোলা থাকবে। তারপর আবার বন্ধ। বাজারের গলির একেবারের শেষের দোকানের একটি ঝাঁপ খোলা। চাঁদের আলো তেড়ছা হয়ে ঝাঁপের ফাঁকা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে। কয়েকজন মানুষের ব্যস্ত সময় কাটছে ভেতরে। ডিজিটাল পরিমাপ যন্ত্রে বেশ দ্রুততার সাথে বস্তা বদল হচ্ছে। বাজারে বিক্রি হবে আগামীকাল, কিছুটা গোপনে!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত