।।অরণ্যজিৎ সামন্ত।।
বৃষ্টির শব্দ যেন। টুপ টাপ, টুপ টাপ। একটা একটা করে বার্তা আসছে অনির্বাণের মোবাইলে। সকালে নেট অন হতেই ইথার থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো যেন ঝরে পড়ছে তারা। অফিস বেরনোর আগে, টুকটাক গোছগাছের মধ্যে এই শব্দগুলো অনির্বাণের বেশ লাগে।
‘এই শুরু হল।’ তনিমার গলা। কিচেনে পাঁউরুটিতে স্যান্ডউইচ স্প্রেড লাগাচ্ছে।
‘যত সব পরীদের মেসেজ। ভাবি, এদের কি আর কাজ নেই। আমি দম ফেলার ফুরসত পাই না আর বিবিরা সব রাত জেগে মেসেজ পাঠাচ্ছেন।’
‘ইশারা অবিরত বুঝলে তনি।’ ফোড়ন কাটে অনির্বাণ।
‘হ্যাঁ, নিঃশব্দের তর্জনীটাও ভুলো না যেন। ওটাও আছে।’ তনিমার পালটা জবাব।
সকালের এই সময়টা তনিমা আর অনির্বাণ তবু একটু কথা বলার সময় পায়। ছেলেকে স্কুলে ছেড়ে এসে অনির্বাণ নিজের সারাদিনের কাজের প্রস্তুতি নেয় আর তনিমারও কাজে বেরনোর আগে একটু মুখোমুখি দাঁড়ানোর অবকাশ।
‘পরী না কি যেন বললে,’ বলে হাসে অনির্বাণ।
‘কেন, হাসি কিসের। এরা তোমার সব ভালবাসার লোকজন। যাদের সঙ্গে ওই ফোনে তোমার সারাক্ষণ টুংটাং চলছে।’
‘কী যে বলো! আজকাল বোঝোই তো। মেয়েরা সব ব্যাপারেই এগিয়ে যাচ্ছে। চাকরিতে আসছে সব। তুমিও সেকেলে রয়ে গেলে। খালি খালি সন্দেহ।’
‘সেকেলে টেকেলে বুঝি না। তোমার ব্যাপারে কিছু বলি না ঠিকই, কিন্তু আমি কিছু বুঝি না, এটা ভেবো না। এত্ত সব মেসেজ, সব অফিসের নিশ্চয়ই নয়। কিসের এত কথা। বাড়িতে কি এদের কথা বলার কেউ নেই নাকি। তোমার সঙ্গেই বা এদের এত কথা কিসের?’
অনির্বাণের নিজেকে খুব হাস্যকর লাগে। মনে হয়, সামনে একটা আয়না ধরে এই মুহূর্তে যদি কেউ দাঁড়ায়, নিজের মুখ দেখে অনির্বাণ কেঁদেও ফেলতে পারে।
দমদম সেভেন্ট্যাঙ্কস-এর মুখে টিনের ছাউনি দেওয়া একটা ছোট্ট ঘর অফিস যাওয়ার পথে রোজ দেখে অনির্বাণ। সামনে জলের কল। ঝোপঝাড় মতো। আর তার ঠিক পিছনেই আছে একটা পলাশ গাছ। ফুলে ভরে আছে। পুব আকাশে সকালের আলো দমদম রোডের ওপর পড়ে, আর বসন্তের নরম হাওয়ায় বাসের জানালায় যেন একখণ্ড সুইজারল্যান্ড ধরা দিয়ে যায় অনির্বাণকে। কোথাও বসন্তবৌরির ডাক কানে আসে।
মোবাইল ফোনটা খুলে হোয়াটস্যাপে সকালের মেসেজটা দেখে অনির্বাণ।
“আমি যাকে ভালবাসি সে অন্তত আমাকে গোপনে মেরেছে সহস্রবার।
কিন্তু আমি মরিনি একাকী,
দৃশ্যত নিস্তব্ধ হয়ে, তাকেও মুখর করে রাখি
ক্রন্দনে, মরিনি বলে তাকেও মুখর করে রাখি।”
অলিপ্রিয়ার মেসেজ। অলিপ্রিয়া অনির্বাণের সঙ্গে কলেজে পড়ত। বিয়ের পর কিছুদিনের বিদেশ বাস। দেশে ফেরা।
তারপরও যোগাযোগটা কী উপায়ে থেকে গেছে।
অনির্বাণ লিখল, সুপ্রভাত, বেরিয়েছ?
হুম।
স্কুলে?
ইয়েস।
ফিরবে কখন?
জানি না।
সে কী?
কী করব ফিরে? বাড়িতে ভাল লাগে না। বন্ধুর বাড়ি যাব। রাতে ফিরব।
বাড়িতে চিন্তা করবে।
আমার জন্য কেউ চিন্তা করে না। কে আছে আমার।
মা আছেন তো?
আমি আজ ড্রিঙ্ক করব।
সে কী। মা জানেন?
হ্যাঁ।
বাবা?
না। মা বলেছে বাবাকে বলিস না।
বাবা যদি জানতে পারেন, খারাপ লাগবে।
খারাপ লাগা মাই ফুট। আমারও তো কতকিছু খারাপ লাগে। হু কেয়ারস?
না মানে, তুমি রাগ করছ।
এসব ফ্যামিলি ড্রামা আমার আর ভালো লাগে না। আই হেট এই প্যানপ্যানানি। অ্যান্ড আই হেট ইউ টু।
বলেই অনির্বাণকে ব্লক করে দিল অলি। আপাতত কথা শেষ।
অলি এভাবেই প্রতিবার শুরু আর শেষ করে। অনির্বাণ বোঝানোর চেষ্টা করেছে অলিকে, সঙ্গ দেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অলি বুঝতে চায় না যে, তার পক্ষে স্বাভাবিক থাকা আর সম্ভব। অনির্বাণও জানে না, কোনটা স্বাভাবিক থাকা আর কোনটা সুস্থ থাকা।
অনির্বাণ ভাবে কথার আর কোনও জোর নেই। মোবাইলে ভর দিয়ে ইথারে পৌঁছে দু’জন মানুষের মনের কথা এভাবেই মুখোমুখি দাঁড়াবে, তারা পরস্পরকে কাছে পেতে চাইবে। নির্ভর করতে চাইবে, আর সেটাই হয়ে উঠবে স্বাভাবিক। অলির নিঃসঙ্গতা সেখানেই তার সঙ্গীকে পেয়ে যাবে একদিন। রাতের পাখিরা সকাল হলেই তাই জেগে ওঠে।
ফোনটা বেজে উঠল,
হ্যাঁ বলো।
অফিসে পৌঁছেছ? সময় করে ঠিক লাঞ্চ খেয়ে নিও। আর শোনো, ফিরতে দেরি কোরো না।