আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিটভূমিকা- এটগার কেরেট ইজরায়েলি লেখক। ১৯৬৭ সালে ২০ আগস্টে জন্ম। হিব্রু ভাষাতেই লেখালিখি করেন। মূলতঃ গল্প, উপন্যাস আর চিত্রনাট্য লেখেন। পশ্চিমা দুনিয়ার সাহিত্য জগতে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি এরই মধ্যে। তাঁর কয়েকটি গল্পসমগ্র ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। ২০১৯ এ প্রকাশিত ‘ফ্লাই অলরেডি’ গ্রন্থটিও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। নিজের দেশের বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুস্কার তিনি পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৯ এর ‘ন্যাশনাল জুউইশ সাহিত্য পুরস্কার’ অন্যতম। লেখালিখিতে ফ্রানৎজ কাফকা, উইলিয়াম ফকনার তাঁর অনুপ্রেরণা। সহজ এবং প্রাত্যহিক কথ্যভাষাতেই তিনি লেখেন। যাদুবাস্তব নয়, তবে বাস্তবজীবনে ঘটার সম্ভাবনা নেই, এধরণের কাহিনি তার গল্পে খুঁজে পান পাঠকেরা। ১৯৯০ এর পরে ইজরাইলের কথাসাহিত্যকে তিনি বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয়তার সাথে হাজির করতে পেরেছেন। কেরেট-এর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘দ্য সেভেন গুড ইয়ারস’, ‘সাডেনলি আ নক অন দ্য ডোর’, ‘মিসিং কিসিন্জার’ অন্যতম।
“উঁহু! ওটা ধোরো না তুমি”। সে বলল।
“কেন? কী ওটা?” জানতে চাইলাম আমি।
“এটা আঠা। বিশেষ ধরনের একটা আঠা। বাজারের সেরা আঠা”।
“আমার কাজে লাগবে তাই কিনেছি। অনেকগুলো জিনিস আছে, আলগা হয়ে যাচ্ছে। জোড়া লাগাতে হবে আমাকে”।
“আমাদের ঘরে এমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, যা জোড়া লাগাতে হবে। ইশ্, একটু যদি বুঝতে পারতাম তোমাকে আমি! কেন যে এসব কেনো”? আমি বললাম।
“হুম, কেন যে কিনি? ঠিক এই কারণেই বোধহয় তোমাকে বিয়েও করেছিলাম আমি। সময়টা কাটিয়ে দিতে!” সে আপন মনে বলতে থাকল।
আমি আসলে তখন ঝগড়া করতে চাইছিলাম না। তাই আর কথা বাড়ালাম না। সে-ও চুপ করে গেল।
“এই আঠাটা কি খুব ভালো?” জিজ্ঞেস করলাম। সে তখন আঠার বাক্সটা আমার দিকে এগিয়ে দিল, বাক্সের গায়ে আঁকা ছবিটা দেখাতে। একটা লোক ঘরের সিলিং-এর সাথে পা লাগিয়ে উলটো হয়ে ঝুলে আছে ছবিটাতে।
আমি বললাম, “কোনো আঠারই সাধ্য নেই এভাবে একজন মানুষকে সিলিং-এর সাথে সেঁটে রাখার। ওরা কেবল ছবিটাকে উলটো করে ছেপেছে। নইলে টেবল-ল্যাম্পটা ওরা মেঝেতে রাখতে পারত; সিলিং-এ না সেঁটে!” ওর হাত থেকে আঠার বাক্সটা নিয়ে উলটেপালটে দেখলাম ভালো করে। “এই দেখো, ছবিটা তুলে শুধু উলটে দিয়েছে। কিন্তু এতই বেখেয়াল, জানালার পর্দাটাও যে উলটে গেছে সেটা আর খেয়াল করেনি। সত্যিই যদি লোকটা উপরে লটকে থাকত তাহলে জানালাটা সোজাই থাকত”। আমি আঙুল দিয়ে ছবির জানালাটা দেখাতে চাইলাম ওকে। সে সেদিকে তাকালোও না ফিরে। আনমনে আঠার টিউবটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
মুখের ব্রেডটোস্টটা শেষ করতে করতে বললাম, “এই রে, আটটা বেজে গেল এরই মধ্যে। আমাকে এখন দৌড়ুতে হবে। সারাদিনে আজ অনেক কাজ জমা। আসছি। ফিরতে দেরি হবে আজ”।
“জানি। তোমাকে ওভারটাইম করতে হবে”। কী একটা ভাবতে ভাবতে সে বললো।
কাজের এক ফাঁকে অ্যাবিকে ফোন করলাম একবার। “আজ আর তোমার ওদিকে যাওয়া হবে না। অফিসে কাজ সেরে বেরোতে এমনিতেই দেরি হয়ে যাবে। বাড়িতে যেতে হবে আজ তাড়াতাড়ি”।
“কেন? কোনো সমস্যা?” অ্যাবি ঠান্ডা গলায় জানতে চাইল।
“না। সেরকম কিছু নয়। আমার গা-ছাড়া ভাবটা ও পরিস্কার বুঝতে পারছে। কথা বলে নেয়াটা ভালো হবে”।
দীর্ঘ নীরবতা ফোনের ও প্রান্তে। এরপর অ্যাবি বলে উঠল, “হ্যাঁ। আরো আগে বললে আরো ভালো হত। তোমাদের এই থাকাথাকির মানেটা আমার কাছে সত্যিই অর্থহীন। তোমরা এমন কী, দুজনে ঝগড়াও তো করো না!”
“তা ঠিক। আমি বুঝতে পারছি। এ নিয়ে তুমি এত ভেবো না। শিগগির আমাদের দেখা হবে, কথা দিলাম। এখন রাখছি। অনেকটা কাজ জমে আছে। আজকের জন্য সত্যিই দুঃখিত আমি”। ব’লে রেখে দিলাম ফোনটা।
বাড়িতে যখন ফিরলাম, সবকিছু কেমন একটু বেশিই চুপচাপ মনে হলো। এ ঘর-ও ঘর ঘোরাঘুরি করে ওকে নাম ধরে কয়েকবার ডাকলাম। কোনো সাড়া নেই। নিচের ঘরগুলোতে ওকে কোথাও দেখতে পেলাম না। রান্নাঘরে উঁকি দিলাম একবার। সব খালি, শুধু খাবার টেবিলটার ওপরে সকালে দেখে যাওয়া আঠার টিউবটা পড়ে আছে। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, সেটা পুরোটাই খালি! সারাদিনের ক্লান্তি, ভাবলাম একটু বসে যাই এখানে। চেয়ারটা টানতে গিয়ে বুঝলাম, কোথাও আটকে আছে। আরো জোরে টানলাম। সরাতে পারলাম না এক ইঞ্চিও। মানে, আঠা দিয়ে মেঝের সাথে লাগিয়ে রেখেছে কেউ! ফ্রিজ খুলতে গিয়েও সেই একই অবস্থা। হাতল ধরে টানছি; কিছুতেই ফ্রিজের দরজা খোলা গেল না। এটাও আঠা দিয়ে আটকানো! আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কী হচ্ছে এসব। কেনই বা সে ঘরের এসব আঠা দিয়ে আটকে রেখেছে! এত ডাকছি, কোন সাড়াও নেই।
বসবার ঘরটায় গেলাম আবার। দেখি, ফোন করি, কোথায় গেল! ভাবলাম, ওকে না পেলে ওর মাকে একটা ফোন করবো। সেকী! ফোনের ক্রাডল থেকে রিসিভারটা উঠছে না কেন? টানাটানি করেও রিসিভারটা আলাদা করতে পারলাম না। এবার অসহ্য লাগতে লাগলো। ফোনের সাথে রিসিভারটাও সে আঠা দিয়ে আটকে গেছে। মাথা গরম করে টেবিলে দিলাম এক লাথি। টেবিল তো নড়লোই না; বরং মনে হলো আমার বাম পায়ের বুড়ো আঙুলটা মচকে গেল, টেবিলে ধাক্কা লেগে!
হঠাৎ কোথা থেকে যেন ওর হাসির আওয়াজ ভেসে এলো। দৌড়ে উপরের ঘরে এলাম। হ্যাঁ, আমাদের ঘর থেকেই আসছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাথাটা একটু তুলতেই দেখলাম, সে ঘরের সিলিং-এর সাথে লেগে দাঁড়ানো। উলটো হয়ে ঝুলছিল আর হাসছিল। ঠিক ওই আঠার বাক্সের ছবিটায় লোকটা যেমন ছিল। আমি কতক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইলাম। এটা কীভাবে সম্ভব! কিছুতেই কোনো হিসেব মেলাতে পারলাম না।
“এগুলো কী হচ্ছে? তোমার মাথা ঠিক আছে? কেন করেছ এরকম?” গলা দিয়ে অস্ফুট স্বরে এ কথাগুলো বেরলো আমার।
ও উত্তর দিল না কোনো কথার। শুধু অদ্ভুত এক হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল। উলটো করে ঝুলে ছিল উপর থেকে আর ওর ঠোঁট দুটোও যেন মধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে মেঝেমুখি হতে চাইছিল। হাসিটা যেন আরো বিস্তৃত দেখাচ্ছিল সেই কারণে।
খানিকক্ষণ সময় নিয়ে ওকে বললাম, “কিছু ভেবো না তুমি। দেখি, আমি কীভাবে তোমাকে ওখান থেকে নামাতে পারি!” শুনে ওর কোনো ভাবান্তরই হল না। হাসতেই লাগলো! হাসতেই লাগলো সেই রহস্যময় হাসি।
মাথায় কী একটা এলো। দৌড়ে গিয়ে বুকশেলফ থেকে সবচেয়ে মোটা মোটা বইগুলো বেছে নিয়ে এলাম আমি। এনসাইক্লোপিডিয়াগুলো নিয়ে এসে সাজাতে লাগলাম একটার ওপরে একটা। বই দিয়ে একটা উঁচু স্তম্ভের মতো বানাতে চেষ্টা করলাম, ও ঠিক যেখানটায় উলটো হয়ে ঝুলছিল, সেখানে। ওটার ওপর দাঁড়িয়ে ওকে টেনে নামাতে চাইলাম আমি। বললাম, “একটু হয়তো ব্যথা পেতে পারো তুমি এই টানাটানিতে। চিন্তা কোরো না, আমি নামিয়ে ফেলতে পারবো”। ওর কানে যেন কোনো কথাই ঢুকছিল না। সেই হাসি! হেসেই যাচ্ছে! কোনোভাবেই ওকে সিলিং থেকে একবিন্দু আলগা করতে পারলাম না।
আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে এবার খুব সাবধানে নেমে এলাম। বললাম, “অপেক্ষা করো। কিছু একটা উপায় বের হবে। দাঁড়াও, আমি পাশের বাড়ির কাউকে পাই কিনা, দেখে আসি। ওদের কারো সাহায্য পেলে ছাড়াতে সহজ হবে”।
সে তখন হাসতে হাসতে বললো, “আচ্ছা। খুব ভালো। কিন্তু কী বলো তো! আমি তো এখান থেকে কোথাও যাচ্ছি না। যাব না কোথাও”।
ওর দিকে তাকিয়ে এবার আমার কী একটা হলো যেন, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো আমারও। ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। প্রেম নয়, অন্যকিছু। খুব মায়াবী দেখাচ্ছিল ওকে। সিলিং থেকে যেভাবে ঝুলে আছে, সেটা ওর সৌন্দর্যের সাথে একটু বেমানান মনে হলো, ওই মুহূর্তে। ওর খোলা চুলগুলো বাতাসে দুলছিল অল্প অল্প। সাদা টি-শার্টের গলার কাছ দিয়ে ওর স্তন দুটো সামান্য বেরিয়ে এসেছিল। অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল, যেন দুটো অশ্রুবিন্দু; এখুনি অশ্রুর ফোঁটার মতো ঝরে পড়বে। আমার ভেতরে কী হলো কে জানে! দরজার কাছ থেকে আমি আবার ফিরে গেলাম ওই বইয়ের স্তম্ভের কাছে। উঠে দাঁড়ালাম ধীরে ধীরে। কাঁধের কাছটায় ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে শুরু করলাম। ওর জিভ আকড়ে ধরলো আমার জিভকে। টের পেলাম পায়ের নিচ থেকে বইয়ের স্তম্ভটি কোনোভাবে ভেঙে গেল। আমিও তখন হাওয়ায় ভাসছি, পেন্ডুলামের মতো দুলছি। সিলিং-এর সাথে ও, ওর জিভ আর ঠোঁটের সাথে আমি… এভাবেই আটকে থাকা… এভাবেই দুলতে থাকা, আমৃত্যু।
কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
Related