গণেশ মুৎসুদ্দির পোর্ট্রেটেই তো আজকের ফেসঅ্যাপ
একটা গল্পের কথা কয়েকদিন ধরে খুব মনে পড়ছে। আমি যখন গল্পটা পড়ি তখন আমি তখন দশ। বানান করে করে পড়েছিলাম। তারপরে আরো বেশ কয়েকবার পড়েছি। ফেইসঅ্যাপের কল্যাণে আবার মনে পড়লো। গল্পটা অনেকটা এমন ছিলো-
বয়স পঁয়ত্রিশের সুখময় সেন। ওই বয়সেই যে চিত্রকর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। পোর্ট্রেটেই দক্ষতা। সুখময় সেন কোনও মানুষের প্রতিকৃতি আঁকলে সেই মানুষের জ্যান্ত রূপ দেখতে পাওয়া যায়। শিল্পীরা সব সময় একপথে চলতে ভালবাসে না। তাই ল্যান্ডস্কেপ। শিলংয়ে শিল্পীর জীবনের একাকীত্ব প্রবলভাবে অনুভব করতে করতে হঠাৎ এক আগন্তুকের আগমন। সেই আগন্তুকের ‘বাহ! আপনার আঁকার হাত তো দারুণ মশাই!’’ বলে ওঠা। সেই গণেশ মুৎসুদ্দির সঙ্গে আমাদের পরিচয়। ইনসিওরেন্সের লোক। তারপরই তো সেই অদ্ভুত প্রস্তাব সুখময়ের কাছে, ‘আপনি আমার একটা ছবি এঁকে দেবেন?… পোর্ট্রেট আঁকবেন, তবে সাধারণ পোর্ট্রেট নয়।’’ সুখময়ের কৌতুহল। গণেশের বলে ওঠা, ‘‘প্রস্তাব, ব্যাপারটা হল এই, আপনি আমার একটা ছবি আঁকুন। আজ থেকে পঁচিশ বছর পরে আমার যে চেহারা হবে, সেইটে আপনাকে অনুমান করে আঁকতে হবে। আজ হল ১৫ অক্টোবর, ১৯৭০। আজ থেকে ২৫ বছর পর নাইন্টিন এইট্টি ফাইভে আপনার সঙ্গে দেখা করব। যদি দেখা যায় আমার তখনকার চেহারার সঙ্গে আমার চেহারা মিলে গেছে, তাহলে আরও কিছু টাকা পুরস্কার দেব।’’ এটাই তো ফেসঅ্যাপের কনসেপ্ট! যা নিয়ে হইচই!
লাইমখরায় স্মিথ সাহেবের বাংলোয়, ২৫ বছর পরের ছবিটা আঁকতে সময় লাগল পাঁচদিন। এতদিন যা হয়েছে পর্যবেক্ষণে, সেই জায়গায় প্রয়োগ করতে হয়েছিল দূরদৃষ্টি। গণেশ মুৎসুদ্দির মাথাভর্তি চুল কিন্তু তার জাত পাতলা। তাই মাথায় একটা বিস্তীর্ণ টাক দিয়েছিল সুখময়। সে আন্দাজ করে নিয়েছিল, এ ব্যক্তি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মোটা হবে না। রোগাই থাকবে। তাই ছবিত মুখের ভাবটা শীর্ণ। গাল বসা, চোখের কোণে বলিরেখা। কানের পাশে চুলের পাক। থুতনির নীচে ঈষৎ লোলচর্ম। ঠোঁটের কোণে একটা হাসির আভাস। তার মন বলেছিল, গণেশ মুৎসুদ্দির জীবনটা মোটামুটি সুখের হবে। কিছুটা গণেশ মুৎসুদ্দির বাবার এখনকার চেহারার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। গণেশ বলেছিল, ‘‘মনে হয় মেকআপ দিলে আমাকে এই চেহারায় দাঁড় করানো যায়।’’ সবই যে মিলে যাচ্ছে! ফেসঅ্যাপ নিয়ে এত চর্চা, এত এফবিআই বনাম কেজিবি— কিন্তু কবেই তো এক বাঙালি এ নিয়ে বলে দিয়ে গিয়েছিলেন!
২৫ বছর পর, অক্টোবরের ১৫, বিজয়া দশমী। ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। সুখময় দরজা খুলে দেখল বৃদ্ধ ভদ্রলোককে। মাথায় ঢেউ খেলানো চুল আর নাকের নীচে জাঁদরেল গোঁফ। ভদ্রলোকের হাতে চারকোণা খবরের কাগজের মোড়ক। বিরক্ত সুখময়। কিন্তু ভদ্রলোকের মুখে হাসি, ‘ভুল গেছেন বুঝি?’ তারপর সেই ছোট্ট কথোপকথন—
‘আজ কী তারিখ?’
‘১৫ অক্টোবর।’
‘কী সন?’
‘১৯৯৫।’
‘তা-ও কিছু মনে পড়ছে না?’
সুখময়ের মনে পড়ে সে একটা পোর্ট্রেট করেছিল ভদ্রলোকের। ২৫ বছর আগে। কিন্তু লোকটির মাথাভর্তি চুল। তার গোঁফ তার ঝুলপি এসব তো কিছুই সুখময় আঁকেনি। মনে মনে সুখময়ের নিজেকে অকৃতকার্য ভাবা, এবং শেষমেশ গণেশ মুৎসুদ্দির একটানে তাঁর গোফ-চুল খুলে ফেলা। যাঁরা এত ফেসঅ্যাপ নিয়ে মাতামাতি করছেন, তাঁদের হয়তো এবার কিছু মন পড়ছে! পড়ছে তো, নাকি?
‘গণেশ মুৎসুদ্দির পোর্ট্রেট’-এ। যা ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ১৯৮৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। সত্যজিৎ ভক্তেরা মনে করতে পারছেন নিশ্চয়। ইদানীং প্লে স্টোর থেকে ফেসঅ্যাপ নামানোর হিড়িক পড়েছে। টাইম মেশিনে চেপে ভবিষ্যতে গিয়ে নিজের বুড়িয়ে যাওয়া মুখটা দেখার খেলায় মেতেছেন সেলেব থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই! চিত্রকর সুখময় সেন আর তার আঁকা গণেশ মুৎসুদ্দির পোর্ট্রেট তো ফেসঅ্যাপেরই মতো। যা নিয়ে ফেসবুকে মিম, ‘‘আই অ্যাম গণেশ মুৎসুদ্দি, অ্যান্ড আই হ্যাভ কপিরাইট অন ইয়োর কনসেপ্ট!’
ফেসঅ্যাপ এ কনসেপ্ট রাশিয়ায় কেন বাবা, এশিয়াতে তো এ জিনিস কবেই লিখে দিয়ে গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়।