আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিটআশির দশকের কবি ফরিদ কবির। ১৯৮৫ সালে ‘হৃদপিণ্ডে রক্তপাত’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে তার যাত্রা। আশির দশকে নিজস্ব কাব্যভাষাণ্বেষী একদল কবি যাদের সচেতন বাছ-বিচার দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলেছিল বাংলাদেশের তৎপরবর্তী ভাষা-সাহিত্যে, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আজ ২২ জানুয়ারি কবি ফরিদ কবিরের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
মেঘ-অরণ্যের মধ্যে
ঘরসুদ্ধ শূন্যে উঠে গেছি
নিচে মেঘ, চারপাশে মেঘের পাতাল
সবুজ মেঘের চুলে হাত আর পা জড়িয়ে যাচ্ছিলো
আমার শকট এসে মেঘ বনে থামে।
বাতি নেই, এতো অন্ধকারে
পাশের ঘরটি কোনদিকে চলে গেলো?
মাত্র কিছুক্ষণ আগে তুমি
রূপালী চন্দ্রকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেছো
আর আমি, তোমাদের ফেলে দেখো কোথায় এসেছি!
দু`চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে
বহুদূর থেকে উঁকি দিচ্ছে বিচ্ছেদের ছুরি, আর
একটানা ঘেউ-ঘেউ শব্দে ডেকে যাচ্ছে অন্ধকার!
কিছুতেই আমার আপত্তি নেই, শুধু তাকে ডেকে
এই মেঘ-অরণ্যের মধ্যে নিয়ে এসো
তাহলে শূন্যেও আমি কখনো ঘুমুতে চাইবো না
আরো পড়ুন: তুষার দাশের কবিতা
সমুদ্রের এপার থেকেও পাওয়া যায়
স্পর্শ করি, তোমাকে না ছুঁয়েই!
তোমাকে স্পর্শের পর মনে হয়
বন্দি নয়, তোর হাত নিজে এসে আশ্রয় নিয়েছে
তোর কাছে নিরাপদ নয় কোনো কিছু
সামান্য যে গাছ, সেও অরক্ষিত রাখে না পাতাকে
তুলে ধরে যতটা সম্ভব শূন্যে, স্পর্শের বাইরে
যে কারণে পাতা থাকে নিতান্ত সবুজ
যে রকম হাতের ইশারা বুঝে তোর হাত
আরো পড়ুন: একগুচ্ছ সুজিত দাস
বিভ্রম কাটে নি, এই ভয়ে চুপচাপ বসে থাকি
পকেটে অগ্নির বাক্স খুঁজতে গিয়েই এত বিপত্তি বেঁধেছে
বারবার উঠে আসে তোমার আঙুল
চুম্বন-মুহূর্তে আমি সতর্ক থাকি না
তোমার একটি চোখ আমার পেটের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল
ফলে আমি বাইরে বেরোলে তুমি সব দেখতে পাও
কিন্তু তুমি বেরোলেই আমি কিছু দেখতে পাই না
তুমিও তো আমার একটা চোখ খেয়ে ফেলেছিলে!
একটি বাড়ির দিকে উঁকি দিল আরেকটি বাড়ি
ভেতরে মানুষ নেই, সিগারেট ঠোঁটে
বুক-শেলফ হেঁটে গেল পয়মন্ত চেয়ারের দিকে
বিছানায় শুয়ে আছে বালিশের প্রেত
মৌমাছির মতো টেবিলের ওপর উড়ছে ঘুম
কার্নিশে কার্নিশ ছুঁয়ে শাদা বাড়িটিকে
বাড়িতে কেউ কি আছে? সারা রাত জেগে
খুব ভোরে ঘুমিয়ে পড়ল আলনায় ঝুলে থাকা
হাত-পা আঙুল খুলে আলনায় ঝোলে মুণ্ডুহীন শার্ট
হেঁটে গেল পয়মন্ত চেয়ারের দিকে
টেবিলের ওপর উড়ছে ঘুম, ডায়েরির পাতা
একটি বাড়ির দিকে হেঁটে এল আরেকটি বাড়ি…
আমি নিচে, রাস্তা ছিল আমার ওপরে
উঠে দাঁড়াতেই রাস্তা মুখোমুখি হলো
সমুদ্রের মতো বাড়ালাম সম্মুখে পা
আমার শরীর থেকে ঝনঝন ছিটকে পড়ল
সে তার তরল জিভে তুলে নিল রাস্তার শরীর
চুলে-চোখে যন্ত্রণার চিহ্ন
গেঁথে নিয়ে রাস্তা তাকালো আমার দিকে
এখন ছায়াকে আমি কোথাও দেখি না!
রাস্তাকে যতটা সহজ মনে হয়, আসলে সে তত সরল না
পথে নেমে আমিও বুঝেছি রাস্তামাত্র রমণীস্বভাবী
সঙ্গে আছে, কিন্তু সঙ্গে নেই
ঘুরপাক খেতে থাকি রাস্তার সন্ধানে
ডেকে নিয়ে ফেলে দেবে তুমুল বিভ্রমে
না রাস্তা না পথ তুমি কাউকেই পাবে না
পাবো না জেনেও আমি বারবার রাস্তায় নেমেছি
রাস্তাও মানুষ খোঁজে, সেও জানে
যে পথে যায় না কেউ, সে পথ কখনো পথ নয়…
পড়তে পড়তে ধরো, কবিতার তিনটি অক্ষর খসে মাটিতে পড়েছে
তুমি কি কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ঢোকাবে?
রাত্রির বর্ণনা—ধরো, দুধশাদা বকের শরীর
তুমি তার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে
দিনকে বলছি আমি রোমশ ভালুক
তুমি হাত বাড়াতেই কামড় বসালো
এখন রাত্রি না দিন, তুমি স্থির করো
তোমার চোখের মতো নিকষ ভালুক
ধরো, এই বক উড়ে গেল ভালুকের দিকে
শুয়েছিলে, তুমি ঘুম থেকে উঠে দেখো—
যদিও সেটাকে আমি বিছানা বলছি
বিছানা চেয়ার হলে তুমি দ্বিধাগ্রস্ত
আসলে কি ঘরে? নাকি, বাইরে রয়েছ?
বাইরে থাকলে ধরে নাও ঘরে আছ
পড়তে পড়তে ধরো, বই ফেলে আচম্বিত বাইরে বেরোলে
বাইরে বেরিয়ে তুমি আসলে তো ঘরেই রয়েছ!
মন্ত্র-১
অন্তত ধানের দর্প চূর্ণ করে দাঁড়িয়েছি মোমের সিঁড়িতে
এসো, এইবার দেখি, এইটুকু শস্য ফেটে কোন স্বর উত্থিত হয়েছে!
সমস্ত মৃত্তিকাগর্ভে ছড়িয়ে পড়েছে ভাঙা কাচ
এখন ছত্রিশ টুকরো দেহ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ঝিনুক-কুমারী।
এই মুক্তো তুলে রাখো ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরের জন্য
শুধু আমি পবিত্র গ্রন্থের চোখে তুলে দিচ্ছি ক্রন্দন-কৌশল।
যদি কেউ ডাকে, যদি রাতের উনুন জ্বলে ওঠে, জ্বলতে দাও
চতুর্দিকে তার চিৎকারের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়–ক
সকল প্রস্তরীভূত জ্যোৎস্নাবাগানের কাছে পৌঁছে দাও তাকে
যেন সেও সূর্যমোরগের ডাক শুনে
দেহের চামড়া খুলে দেখতে পারে মাংশের ধনুক।
প্রেম
তোমার চুল থেকে চান্দ্রমাছগুলি মাটিতে নেমে গেলো
গলা ও বুক জুড়ে তিনটি ঝর্ণার নরম স্রোত দেখে
হাসলো স্বপ্নের বেড়ালছানাটিও।
তোমার একদম কাণ্ডজ্ঞান নেই
ধনুকে ছুঁড়ে দিলে প্রবল বৃষ্টির ধারালো ফোঁটাগুলি
তুমি কি ভেবেছিলে, পৃষ্ঠে ডানাঅলা মোমের চাঁদ আমি?
পারদে প্রস্তুত শরীর নিয়ে হাঁটি
তোমার জানা নেই
ধারালো জলছুরি আমার এই দেহ কাটতে পারবে না।
আমার হাত দুটো কখনো হাত নয়
রুমাল-খণ্ডের মতোই পারি তাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিতে
তোমাকে হাতে পেলে মুঠোই খুলবো না
তুমি তো তাই চাও, নীলিমা-চক্ষুর অন্তরালে বসে
আমাকে খুলে দেবে গরম নিঃশ্বাস
তোমার গ্রীবা থেকে স্বর্ণ-জল নামে
পাহাড়ি ঢালু থেকে আলোর চিলগুলি হঠাৎ উড়ে যায়
কোথায় উড়ে যায়?
এক শূন্য থেকে ঢুকে যাচ্ছি
… … …অসংখ্য শূন্যের মধ্যে
আর, সরে যাচ্ছি ডান দিকে, ক্রমাগত
মানে, কিছুক্ষণ আগেও তুমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলে
ফোঁটা ফোঁটা আলোকবৃষ্টিতে…
আদ্যোপান্ত যেন এক বাতাসপ্রতিমা,
তবু আমি নিঃশ্বাসে তোমাকে নেই
ঘ্রাণেই সম্পূর্ণ স্নান, তবু খোঁজো তুমি জল-সাবানের ফেনা
চামড়ার নিচে যদি রয়ে যায় অন্ধকার
কিভাবে নিজেকে ভাবো তুমি শতভাগ পরিষ্কার
যে-কারণে বলি, ফুলই প্রকৃত সমুদ্র
কেননা, তাকেই আমি ঘ্রাণসহ বর্ণিল রেখেছি
কাঁটার সংঘাতে যদি ঝরে কিছু রক্তের গরম
আর, পাপড়ির বর্ণে করো জন্মোৎসব
এতকাল পুষ্পপূজা নিষিদ্ধ করি নি
উড়লেই পতনের ডাক, তবু উড়ে যাও
মাটি দখলের পর রক্তচিহ্ন এখনো ডানায়
আজকে নেমেছো তুমি আকাশ দখলে
শিরোস্ত্রাণে হেসে উঠছে নক্ষত্রমণ্ডলী
আকাশকে পাখিমুক্ত রেখে তুমি কেবল ঘুমোবে
আর, জেগে উঠে প্লাস্টিকের স্বপ্ন সাজাবে টেবিলে
প্রকৃত তোমার স্বপ্ন এতকাল পাখিরাই বহন করেছে
নিজেকে যতই ভাবো দীর্ঘ, আজ বলি—
পাখিদের চোখে তুমি সর্বদাই ছোট
নিজেকে জানার জন্য মাঝে-মধ্যে তোমার বাড়িতে
নদীকে সরিয়ে দিয়ে তুমি বিছিয়ে দিয়েছো রাস্তা
যত দূর দৃষ্টি যায় মাইল-মাইল ধুধু পথ
গাড়ি চলছে পালতোলা নৌকোর বদলে
এখন খুঁজছো ঢেউ, নদীকুল রাস্তায় রাস্তায়
পথই মানুষকে নিয়ে যেতে পারে যে-কোনো রাস্তায়
এখন পথের সব পৃষ্ঠা বসে বসে মুখস্থ করছো
সন্ধান করছো নদীতীর, ঢেউয়ের আক্ষেপ
রাস্তা চেনে সব পথ, যেতে পারে যে-কোনো ঠিকানায়
নদীর ঠিকানা শুধু জানা নেই তার
এখন রাস্তায় বসে কাঁদো ঢেউয়ের আশায়
কাঠের শরীরে গাঢ় নীল দাগ দেখলে বুঝবে
…. ……. . … দুঃখে ছিল বৃক্ষ-সম্প্রদায়
কিভাবে মুছতে হয় বেদনার জল
সেই মন্ত্র তোমাদের জানা হয়ে গেছে
কবে তুমি নদীগর্ভে পিছলে পড়েছো
তোমাকে উল্লেখ করে গোল দুঃখ এঁকে রাখে মনে
বলি আজ, তোমাদের জন্য নয় এই গাছপালা
গাছের জন্যই তুমি ধীরে ধীরে যুবক হয়েছো
হৃদয়ের চর্চা তুমি কিভাবে করবে
………. . জেনে নাও বৃক্ষদের কাছে
ক্ষিপ্র, কিন্তু দারুণ নিরীহ
…… … স্বপ্নে বাস্তবে ডানায়
পশুর হিংস্রতা তারা অবিকল মুখস্থ করেছে
বিনা কারণেও দেখি, কামড় বসায়
সমস্ত শরীর তার কেঁপে উঠছে পাতার সন্ত্রাসে!
তাকে ঘিরে আছ তুমি চারপাশ থেকে
তীব্র ঝড়ও থমকে গেছে তোমার ইঙ্গিতে
এখন বুঝতে পারি, গাছ নয়, পাতাই আসল
সমস্ত গাছের নাম লেখা আছে পাতার সবুজে
বিশ্বাসে মেলে না যদি তবে খোঁজো তর্কে
সেখান থেকেই শুরু হোক বৃক্ষরোপণের ধুম
তোমার চাইতে উঁচু নয় কোনো গর্বিত পাহাড়ও
তুমি ছোট হতে হতে তাকে এই উচ্চতা দিয়েছ
মানবিক ঝর্ণাধারা ঢুকিয়ে দিয়েছ মৃত পাথরের দেহে
তোমার অজ্ঞাতে সবুজ পাহাড়গণ
পর্বতই মানুষ যদি, অধীনতা মেনে নাও তার
পাহাড়ের পরিচর্যা হোক আজ তোমার নিয়তি
যে-কোনো সমুদ্র থেকে ধানক্ষেত জেনো—
তার নিচে থাকে সন্তরণশীল বীজ
আর, পর্দা খুলে দেখো—বীজের ভিতরে
তোমার জীবন আর স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ বইছে সেখানে
তুমিও নদীর মতো হিংস্র, কিছুটা ভাঙনপ্রিয়
এখন নির্মাণ ফেলে তুমি লিপ্ত মানবসংহারে
শোনো বলি, তোমাদের জন্য নয় উদ্ভিদসকল
ধানের চর্যাই জেনো—তোমার নিয়তি
তোমার ঘরের মধ্যে উড়ছে শকুন
তার ভয়ঙ্কর ডানা ঝাপ্টানির শব্দে
থরথর কাঁপছে পুরো বাড়ি, ছাদ, ঘরের আসবাব
তবে কি মাংসের গন্ধ পেয়ে উড়ে এল
সুদূর পাহাড় থেকে এত দূরে, তোমার বাড়িতে
সেও খায় মাংস, ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ঠুকরে-ঠুকরে
তুমি খাও সব কিছু, এই কথা শকুন জানে না!
করো চলাফেরা ধমনিতে, উপশিরায়, শিরায়
আমাকে রঞ্জিত করে আপাদমস্তক তুমি বয়ে চলো
টগবগ ফুটতে থাকো হৃদয়ে, মস্তিস্কে
আমাকে পুড়িয়ে দাও তোমার গরমে
বলো, কেন হলে তুমি এতটা আগ্রাসী!
মিশে যাচ্ছ রক্তের প্রচণ্ড লালে, শুভ্র কণিকায়
ছুটে যাচ্ছ শরীরের আনাচে-কানাচে!
তোমাকে ছিনিয়ে নিতে এখন তৎপর
ভয়ঙ্কর আলপিন, ঘাতক ছুরিও…
তোমার একটা ফোঁটাও আমি কাউকে দেব না…
Related