| 19 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

মরার আকাল

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
ঘর থেকে বের হতেই যেন লক্ষকোটি ভাইরাস ঘিরে ধরে, তাই নিজের অজান্তেই হাতদুটো শরীর থেকে দূরে সরে যায় নিয়াজের। অদৃশ্য শত্রæগুলো যেন হাত দুটোকে ছেঁকে ধরেছে, কিংবা উড়ে এসে আছড়ে পড়ছে গায়ে। তাই হাত থেকে শরীর কিংবা শরীর থেকে হাতকে দূরে রাখার সচেতন চেষ্টায় হাঁটছে বলে কাঠপুতুলের মতো দেখায় ওকে। পাড়ার রাস্তায় দুচারজন মানুষকে ত্রস্তপায়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়, একঝলক মুখের দিকে তাকিয়ে পরস্পরকে পেরিয়ে যাওয়ার সময় গলির দুপাশের দেয়ালের সাথে প্রায় সেঁটে যায় দুজনই। পরিচিত চেহারার কেউ কাছাকাছি এলেও কুশল বিনিময় হয় না। পরিচিতির হাসি হাসলেও নাকমুখ ঢাকা মুখোশের আড়ালের সৌজন্যমূলক সেই হাসি দেখা যায় না, ভীত চোখজোড়ায়ও প্রতিফলিত হয় না হাসিমুখ। কাউকে হয়তো দেখেও সহজে চেনা যায় না, মুখোশের পাশ দিয়ে বের হয়ে আসা প্রশ্রয়ে বড় হওয়া দাড়ি আর অযতেœ বেড়ে ওঠা চুলের কারণে পরিচিত মুখ পুরোপুরি অপরিচিত ঠেকে। পরিচয়ের সীমাবদ্ধ গন্ডিতে এতদিনের অপরিচয় এখন সম্পূর্ণ একেকটা অচেনা দ্বীপে সরিয়ে দিয়েছে যেন সবাইকে। সামনের ছোট মাঠমতো পার্কটাতে সব সময় পাড়ার ছেলেছোকরাদের কাউকে না কাউকে দেখা যেত, আশপাশের বাচ্চাকাচ্চারা বিকেল থেকে সন্ধ্যাবাতি জ্বলে না ওঠা পর্যন্ত কিচিরমিচির করতো, বুকে অবাধ বেড়ে ওঠা লম্বা ঘাসের আড়ালে নিস্তেজ পড়ে থাকে সেই খোলা চত্বর। মোড়ের ছোট মুদি দোকানটার সামনে জবুথবু দুচারজন মানুষ রিলিফ নিতে আসা দুস্থ মানুষের মতো দূরে দূরে রাস্তায় দাঁড়ানো। সবাই একসাথে ঘেঁষতে না পারার জন্য দোকানের সামনে বড় প্লাস্টিকের ক্রেট দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া, ক্রেটের মধ্যে আলু, পেঁয়াজ, আদা Ñ আরো কি কি সব ফেলে রাখা। এই দোকানে এখন প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভেতর কয়েক ধরনের মাস্কও বিক্রি হয়। দোকানটা পেরোবার সময় রাস্তার উল্টোপাশে সরে গিয়ে জোরে পা চালিয়ে হেঁটে যায় নিয়াজ। ফেরার সময় ওকেও এখানে একবার দাঁড়াতে হবে। লবন, ডিম আর ডাল নিয়ে যেতে বলেছে রেজিনা।
ভাগ্যিস খুব বেশি কিছু নিতে বলেনি, হুইল সাবানগোলা জলের ঝাপটাটা কেবল ডিম আর লবণের প্যাকেটটার ওপর দিয়ে যাবে। অন্য সদাইপাতি নিলে আরো বড় হাঙ্গামা হতো। বাজার থেকে যা-ই আনা হোক, সবকিছু সাবানগোলা জলে ভিজিয়ে তুলে রাখতে গিয়ে একটা যক্ষদক্ষ কাÐ হয়ে যায় ঘরে। রেজিনার এই অতিসাবধানতাকে মাঝে মাঝে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি মনে হয় ওর কাছে, এসব নিয়ে প্রায়ই খটাখটিও বাধে ঘরে। ছেলে মেয়ে দুটো এসময় নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়,আবার কখনো বাবা কখনো মায়ের পক্ষ নিয়ে ওদেরও সামিল হতে হয়। দুজনেরই স্কুল কলেজ বন্ধ, বাইরে না যাওয়ার খবরদারি আর ঘরবন্দী হয়ে থাকা একঘেঁয়েমির ক্লান্তিতে বেশ খিটখিটে হয়ে গেছে সবাই।
বাইরে যাওয়ার জন্য প্রাণ আনচান করলেও এখন ওর ভেতরেও ভর করেছে ভয়, সে ভয় যতটা না অদৃশ্য অণুজীবটির জন্য, তার চেয়ে বেশি ঘরে ফেরার পর জামাকাপড় ছেড়ে সাবানজলে ভেজানো, গোসল আর লবণজলে গড়গড়া করার দীর্ঘ কষ্টকর প্রক্রিয়াটির কারণে। দুমাসেরও বেশি সময় পর ছুটি শেষ হলে পালটে গেছে জীবনযাপনের বহু চিত্র। দীর্ঘদিন ঘরে বন্দী থাকার সময় কর্মহীন বসে বসে টেলিভিশনে একের পর এক দুঃসংবাদের খবর শুনতে শুনতে এক প্রবল মৃত্যুভয় কাবু করে ফেলেছিল ওকে। নভোচারীদের মতো দেখতে সাদা সুরক্ষা পোশাক পরা গুটিকয় স্বেচ্ছাকর্মী যখন হন্তারক নিস্তব্ধতা ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে একেকটা শরীরকে মাটির গভীরে নামিয়ে দেয়, সেই দৃশ্য দেখে দেখে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল নিয়াজ। ওর নিজের এমন অবস্থা হলে পরিবারটির কী হবে সেই ভাবনাই বেশি দুর্বল করে ফেলে যেন। অফিসে যাওয়ার সময় খাবারের সাথে ফ্লাস্কে মসলা জ্বাল দেওয়া গরম চা-টাও নিয়ে যেতে হয় এখন, যাতে বাইরের চা খেতে না হয়। কাপড়কাঁচা সাবানের ক্ষার দিয়ে ক্রমাগত হাত ধুতে ধুতে হাতের কব্জি পর্যন্ত গোসাপের চামড়ার মতো খসখসে হয়ে উঠছে। এই আতঙ্ক আর হতাশা আরো নির্মম হাতে চেপে ধরে, যখন দেখা যায় খুব সাবধানে চলতে পারার মতো মানুষগুলো টপাটপ মারা যাচ্ছে। সুরক্ষার ঘেরাটোপে থাকা ওদের নিরাপত্তাবোধের দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে এক অদেখা শক্তি নিষ্করুণ হাতে জীবনের একেকটা বাতিকে হারিকেনের সলতের মতো ধীরে ধীরে ছোট করে নিভিয়ে দিয়ে যাচ্ছে রোজ।
পাড়ার নিষ্প্রাণ গলি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় উঠে এলে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে এসে মানুষের অনিঃশেষ জীবনচাঞ্চল্য টের পাওয়া যায়। ছায়াচ্ছন্ন গলির দমচাপা শোকাবহ পরিবেশ এখানে উধাও। রাস্তার পাশে মলিন পসরা সাজিয়ে বসেছে কয়েকটা অস্থায়ী দোকান, এগুলোকে দোকান বলা যায় কি না তা নিয়ে কিছুক্ষণ অন্যমনষ্কভাবে চিন্তা করে নিয়াজ, তবে সে চিন্তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। ইজি বাইকগুলো যাত্রী নিয়ে গুড়গুড় করে দুলতে দুলতে চলে গেলে পেছনে পড়ে থাকা রিকশার প্যাডেলে চাপ বাড়ানোর অক্ষম চেষ্টায় সায় দেয় না কুঁজো বৃদ্ধ চালকটির পায়ের শিথিল পেশি। কিছু দোকানপাট খোলা, খদ্দের প্রায় নেই কোথাও। যদুর চায়ের দোকানে থুতনির নিচে মুখোশ নামিয়ে চায়ের কাপ হাতে বসা কয়েকজন। মুখোশহীন কয়েকজন কিছু নিয়ে তুমুল আলোচনায় ব্যস্ত। বিসমিল্লা ফার্মেসির সামনে রাস্তার পাশে গাছের একচিলতে ছায়ায় দাঁড়িয়ে গোলগলা টাইট নীল গেঞ্জি আর চাপা প্যান্ট পরা ধূর্ত চেহারার একজন কানে মোবাইল লাগিয়ে কাকে যেন বলছে, ‘এন্টিবাইটিক হলোগেন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আপনি একটা শেষ করিছেন কচ্ছেন, তাই না? তাহলি আপনার একটা রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা হইসে, এহন আরেকটা . . .,’ হেঁটে যেতে যেতে এটুকু শোনার পর আর কী বলছে ওর কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। যেতে যেতে নিয়াজ ভাবে, চোখে দেখা না যাওয়া ভাইরাসের চেয়ে এই মূর্তিমান ভাইরাসগুলোও কম ভয়ংকর নয়। টেলিফোনের ওপারে কোন বেচারাকে মুরগি বানাচ্ছে কে জানে।
ছুটির দিনে এমনিতে ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করতো না নিয়াজের, কিন্তু টানা দুমাসেরও বেশি সময়ের অঢেল অবসর আর গৃহবন্দী উৎকন্ঠার বিষ সাপ্তাহিক ছুটির আলস্যের আমেজটাকে নষ্ট করে দিয়ে গেছে যেন। কিন্তু আজ বের হওয়ার দায়টা এড়াবার উপায় নেই। অন্য কিছু করার সুযোগ কম, তাই একবার গোরস্থানে যেতেই হচ্ছে। আজকাল কবরস্থানের মতো নির্জন জায়গাও মানুষের কাছে নিরাপদ ঠেকে না আর। পাঁচ ফুট মাটির নিচে নামিয়ে দেওয়া লাশও যেন মূর্তিমান হুমকির মতো মানুষের শেষ ঠিকানাটির বাতাসে চুপিসারে ভেসে বেড়াচ্ছে। মানুষের এই অমূলক ভয় ওর যুক্তিবাদী ধারণাকেও জয় করে নিয়েছে যেন। কিন্তু সেই ভয়কে জয় করে বাবার কবরের পাশে একবার দাঁড়াতেই হবে। আজ বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। তাই সব পরামর্শ উপেক্ষা করে এমন ছুটির দিনে বের হওয়া। দিনটা ছুটির না হলেও একবার যেতো। অন্য বছরগুলোতে মসজিদে কোরাণ খতম দিয়ে কিছু গরীব মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো, কিন্তু এবছর সব ওলটপালট হয়ে গেছে। কোনোকিছুই আর আগের মতো নেই। কিছু হাদিয়ার বিনিময়ে মৌলভি আর তালেবুল এলেমদের দিয়ে কোরাণ খতমের চেয়ে নিজ সন্তানের প্রার্থনা অনেক বেশি কার্যকর জেনেও কেবল বিশ্বাসের ভিত্তিতে পিতৃদায়টা করে গেছে এতদিন। এবছর স্বল্পজ্ঞানে এই কাজটা দীনহীনভাবে হলেও নিজেই করতে যাচ্ছে বলে একধরনের শান্তি আছে মনে।

উল্টোদিক থেকে একজনকে ওর দিকে তাকিয়ে হেঁটে আসতে দেখে পরিচিত মনে হয়, তবে মুখ ঢাকা থাকায় ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, কে। কাছে আসার পর চোখে পরিচিতির ইঙ্গিত দেখে বহু কষ্টে চিনতে পারে, ওদের খবরের কাগজ দিত ছেলেটা, অরুণ। থেমে দাঁড়িয়ে মুখোশটা নামিয়ে বলে, কোথায় চললেন দাদা?
মাস্ক সরায় না নিয়াজ, বলে এইতো সামান্য কাজ পড়িসে। তোমার বিলটিল বাকি নেই তো?

অরুণ বলে, না, আপনাগের বাকি নেই। কিন্তু পেরায় সব বাড়িতে বাকি, গেলেই কচ্ছে হাতে টাকা নেই। আপনারা তো কাগজ রাহা বন্ধ কইরে খালাস, আমাগের কী অবস্থা কন দি?
একটা অপরাধবোধে কুঁকড়ে যায় ও, বলে, কি করব? কচ্ছে খবরের কাগজেও ছড়াতে পারে ভাইরাস। জানের ভয় ছাড়াও পত্রিকা পড়ার খরচ কমায়ে দিতে হচ্ছে।
অরুণ ¤øান হেসে বলে, ক্যান, কাগজে তো বিজ্ঞাপন দিয়ে কচ্ছে, কাগজে ভাইরাস ছড়ায় না।
নিয়াজ জানে, কথাটা হয়তো সত্যি, কিন্তু ওর জানায় কী হবে? সেজন্য বলে, কিন্তু মানুষতো সহজে বিশ্বেস যাচ্ছে না ওগের কথায়। তারপর ছেলেটাকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য বলে, দেখ, বেশিদিন হয়তো থাকবে না এই অবস্থা। তারপর অরুণের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্যই হাঁটতে শুরু করে। ছেলেটার মলিন চেহারাটা কিছুক্ষণ মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে ওর।
এখন প্রথম কাজ কবরস্থানে গিয়ে কালুকে খুঁজে বের করা, মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এমাসের টাকাটা দেওয়া হয়নি এখনো। বাবার কবরটায় কয়েকটা গোলাপ চারা লাগিয়ে দিয়েছিল ছেলেটা, সেগুলোর যতœ নেওয়া আর সময়মতো ঘাস-টাস ছেঁটে দেওয়ার জন্য ওকে মাসে মাসে কিছু টাকা দেওয়া হয়। বাবার কবর জিয়ারতের পর নিয়াজ যাবে বন্ধু হামিদের বাসায়। ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধশক্তি বাড়ানোর একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধ দেবে বলেছিল, আর্সেনিক অ্যালবাম ৩০। অনেকেই নাকি জোগাড় করে খাচ্ছে ওটা। আজকাল ভাইরাস ঠেকানো এবং তার চিকিৎসার নানান টোটকা বের হয়েছে। ওষুধটার ব্যাপারে হামিদের পরামর্শের কথা রেজিনার সাথে আলাপ করতে গিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়েছিল ও, হোমিপ্যাথির কয়েক ডোজে যদি ভাইরাস ঠেকানো যায়, তাহলে এতগুলান মানুষ মরতিসে ক্যান। কয়েক পুরিয়া খায়ে নিলেই হতো।
রেজিনা বলেছিল, সবকিছু নিয়ে হাসি-তামাশা করা তোমার একটা স্বভাব। পরে তো দেখি সব ঠিকই মেনে নাও। আম্মা একটা কথা বলতেন, যারে নিন্দে, তারে পিন্দে। হোমিপ্যাথির কোনো সাইড এফেক্ট যখন নাই, বলছে যখন খেয়ে নিলেই তো হয়। হামিদ ভাই আমাদের ওয়েল উইশার বলেইতো বলছেন। ঘরের সবার জন্যই নিয়ে আসবে ওষুধ। বন্ধু দিচ্ছে বলে ফ্রিতে আনবে না। হিসেব করে দাম দিয়ে দেবে, ওষুধের দাম না দিলে নাকি সে ওষুধে কাজ করে না।

কথাটার যুক্তি ফেলতে পারেনি নিয়াজ। ওষুধটা জোগাড় করে রাখতে বলেছিল ঘরের সবার জন্য, সেটাই আনতে যাবে আজ। এরকম ভীতিপ্রদ অবস্থায় নিতান্ত বাধ্য না হলে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে, সেটা মেনে এতদিন দরকার ছাড়া পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হয়নি। আজ যে বের হলো, সেটা একেবারেই বিনা কারণে নয় বলে ওর মধ্যে কোনো অপরাধবোধ জাগে না।

একটা সওয়ারিবিহীন রিকশাতে বেশ আলস্যে প্যাডেল মেরে আসছিল ছোকরামতো একজন। আজ বেশ রোদ লাগানো হলো গায়ে, যথেষ্ট ভিটামিন ডি পাওয়া গেছে। এখন একটা রিকশা নেওয়া যায়। ওটাকে দাঁড় করানোর পর ছেলেটার মুখে মাস্ক নেই দেখে নিয়াজ বলে, মাস্ক পড়িসনি ক্যান?
ছেলেটা একটু গম্ভীর মুখে বলে, ওটা লাগালে দোম বন্ধ লাগে, রিকশা চালাতি পারিনে।
কথাটা একেবারে ফেলনা নয়, নিয়াজের নিজেরও এরকম লাগে, তবু বলে, পুলিশ দেখলি পর প্যাঁদাবেনে।
ছেলেটা এবার একটু ফিচেল হাসে, বলে, পুলিশ দেখার আগে ওডা মুখে লাগায়ে নিই। তহন মোনে অয় গরুর মুহি লাগানো ঠুসির মতোন।
নিয়াজ বলে, ওডা না লাগালি তোর রিকশায় উঠবো না নে।
তখন ছেলেটা ময়লা প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কালো মাস্ক বের করে মুখে লাগিয়ে নেয়।
কবরস্তানের গেটে শুক্রবারে যেরকম ফকির মিসকীন আর টোকাইদের ভিড় দেখা যায়, আজ সেরকম নেই। হয়তো জুমার নামাজের সময় এসে হাজির হবে। অথবা আসবে না, এখন জুমার নামাজ পড়তে বের হওয়া মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা, যে কয়জন আসে তাদের কেউই গোরস্থানে আত্মীয়-মুরুব্বিদের কবর জিয়ারতে যায় না। ঢোকার মুখে বড় ছাতার মতো কাঠবাদাম গাছটার নিচে সিমেন্ট বাঁধানো রোয়াকের মতো একটা গোল বেদি। ওটার ওপর বসে থাকা কয়েকজন পেশাদার ভিক্ষুক স্বভাববশতঃ ওকে ঘিরে ধরতে চাইলে দ্রæততার সাথে ওদের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে নিয়াজ।
ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে একধরনের স্তব্ধতা ঘিরে ধরে ওকে। জায়গাটার চৌহদ্দি ঘিরে গম্ভীরদর্শন বড় ঝুপসি গাছগুলোর ডালপালার ভেতর থম মেরে থাকা ছায়ার ভেতর থেকে অশ্রæত ফিসফিসানি নিঃশব্দে নরম আঠার মতো চুঁইয়ে পড়ে একাকী কবরগুলোর ওপর। বৃষ্টিভেজা মাটি থেকে জ্যৈষ্ঠের উত্তাপে উঠে আসা গরম ভাপের গন্ধ নাকে এসে লাগে। ভেতরে কোনো মানুষের সাড়াশব্দ মেলে না, অন্যসময় দুচারজন মানুষের দেখা মিলতো, আজ একেবারেই শুনসান। গল্প-উপন্যাসে যেরকম লেখা হয়, কবরের নিস্তব্ধতা, তারই স্বরূপ যেন সত্য হয়ে নেমে এসেছে কোথাও চারপাশ খোলা, বাঁশের বেড়া কিংবা অনুচ্চ দেয়াল ঘেরা চতুষ্কোণ ক্ষেত্রগুলোর ওপর।
খুব উদাসভাবে হাঁটতে হাঁটতে বাবার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় নিয়াজ। গোলাপ চারাগুলো বড় হয়েছে, ফুল আসেনি এখনও। তবে সাফসুতরো দেখে বুঝতে পারে ছেলেটা ফাঁকি দিচ্ছে না। অনেক বেশি দোয়া দরূদ জানা নেই বলে সুরা ফাতিহা আর সুরা ইখলাস পড়েই জিয়ারত সারে ও। বুক চেপে ধরা নিস্তব্ধতার মধ্যে ওর সুরা পড়ার ফিসফিস ধ্বনিও যেন শব্দ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। সারবাঁধা কবরগুলোর শিথান ও পায়ের মাঝখান দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘামে ওর পাঞ্জাবি ভিজে পিঠের সাথে সেঁটে গেছে। এসময় এক ঝলক বাতাস বয়ে গেলে একটা ভৌতিক পরশে যেন ঘামেভেজা শরীর শিরশির করে ওঠে নিয়াজের। গেটের ভেতর একপাশে মুর্দা ধোয়ানোর জায়গাটার পাশে দুটো খাটিয়া কাত করে রাখা, একটা স্টেইনলেস স্টিলের, আরেকটা কাঠের। সেখানে অফিসঘরের বারান্দায় মারফত আলিকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে যায় ও। ষাটোর্ধ ঢ্যাঙা শরীরটাকে বারান্দার থামে ঠেকিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে একদিকে তাকিয়ে বসে ছিল লোকটা। কবরস্থানে কাজের তো নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যে কোনো সময় কবর খোঁড়ার ফরমায়েশ আসতে পারে বলে এই লোককে দিনের বেশিরভাগ সময় এখানেই থাকতে দেখা যায়। কাছে গেলে ‘সেলামালেকুম’ বলে একইভাবে বসে থাকে লোকটা, সাদা চুল আর দাড়ির মাঝখানে কালো মুখটার ওপর চোখজোড়ায় খোসা ছেলা লিচুর মতো ঘোলাটে আভা। আগে দেখা হলে বেশ তমিজের সাথে কথাবার্তা বলতো ওর সাথে, আজ সেরকম মেজাজে নেই লোকটা। বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার কবর খোঁড়ার অভিজ্ঞতার বহু গল্প শুনেছে লোকটার মুখে। একবার এক গল্প শুনে বহু রাত ভয়ে ঘুমাতে পারেনি ও। কবর খুঁড়ছিল মারফত আলী। এসময় পাশ থেকে এক চাঙ্গর মাটি ভেঙে পড়লে একটা সুড়ঙ্গের অন্ধকার মুখ খুলে যায়। ‘ওডা দেইখে ভয়ে লাফ দিয়ি উপরে উইঠে আলাম। কি কবো, বুক ধড়ফর করতি লাগলো। পরে চিন্তা করলাম, আরে, আমাগের বসবাস মুর্দাগের লগে, অত ভয় এরলি চলে? একটা হেরিকেন জ্বালায়ে আবার নামলাম কবরের মদ্যি। সুরঙের মুখটা বড় কইরে হেরিকেন ঢুকোয়ে দিলাম, এহন মাথা মাথা ঢুকোয়ে দেখবার সাহস অলো।’ এটুকু বলে মারফত আলী একটু থামে। আশপাশে আরো দুয়েকজন গল্প শুনছিল, দিনের বেলাতেও পরস্পরের গা ঘেঁষে আসে ওরা। মারফত আলী একটু হাসে, ‘মাথা ঢুকোয়ে কি দেখলাম কতি পারেন?’ কেউ একথার কোনো জবাব দেয় না। একটু থেমে মারফত আলী বলে, ‘দেখলাম, পুরো শরীল পোকায় খায়ে ফেলাইসে, শুয়ে আছে কেবল হাড্ডিগুলান।’ বলে হা হা করে হাসে লোকটা, ‘ভাবলাম কি না কি দেহি। আরে বাবা, বেশি রাইতে লাশ দাফন করতি গেলে, কবর খোদার সোময় কেউরে পাওয়া যায় না, এমন দিনও গেছে পুরো গোরস্তানে হ্যাজাক জ্বালায়ে একলা কবর খুদিসি। তাই কচ্ছিলাম, আমাগের ভয় পালি চলবে?’
মারফত আলীর কাছ থেকে কবর দেখাশোনা করার ছেলেটার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। বলে, ‘ওরে দেখিতিসি না বহুদিন ধইরে। কোয়ানে কোয়ানে যায় কতি পারবো না নে। কাজ কাম তো নেই বিশেষ।’ ছেলেটাকে দেওয়ার জন্য আনা টাকাটা ওর কাছে রেখে আসতে চাইলে রাজি হয় না ও, বলে, ‘আমার দারে রাইখে যাওয়া ঠিক অবে না। অভাবে পড়লি খরচ কইরে ফেলায়ে গুনাগার হতি পারবো না নে। ওরে খুঁইজে নিয়ি ওর হাতে দিলি ভালো অয়।’ লোকটার হাতে পাঁচশ টাকার দুটো নোট তুলে দিয়ে নিয়াজ বলে, ‘এইডে আপনার জন্যি। অ্যাহন এই ছাওয়ালডারে পাই কোয়ানে। ওর ফোন বন্ধ।’ মারফত আলি বলে, ‘আমার সাথে দ্যাহা হলি পর আপনারে ফোন দেওয়ার জন্যি কবানে।’

বের হওয়ার আগে নিয়াজ বলে, ‘অ্যাহন তো আপনাগের কাম বাইড়ে গেছে, এত মানুষ মারা যাচ্ছে রোজ। ’
মারফত আলি বলে, ‘কিডা কলো কাম বাড়িসে? কবর খোঁদার পর লাশ আনলি পর আমাগের হ্যাট হ্যাট কইরে তাড়ায়ে দেয়। মুর্দার মতোন সাদা সাদা পোশাকের কয়েকজন দূরে দূরে দাঁড়ায়ে জানাজা পড়ে, বস্তার মতো কইরে লাশ নামায়ে মাটি চাপা দিয়ে পেরায় পালায়ে যায় য্যান। এডারে দাফন কয়?’
নিয়াজ বলে, ‘হয়, টিভিতে দেহিসি। করোনার লাশ ছাড়াও তো লাশ আসে। তহন তো আপনাগেরই সব করতি অয়।’
মারফত আলি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ভালো লাশ তো বহুত কইমে গেছে অ্যাহন।’
“ক্যান, করোনা ছাড়া মানুষ মারা যাচ্ছে না?”
মারফত আলির কথায় চমকে ওঠে নিয়াজ, “মানুষ মরবে কোয়ানে? লকডাউনির মদ্যি ক্লিনিকগুলান সব বন্ধ আছে না?”

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত