| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

ফারুক মঈনউদ্দীনের গল্প: শারীরবৃত্তীয়

আনুমানিক পঠনকাল: 17 মিনিট
আজ ০৮ অক্টোবর গল্পকার, অনুবাদক, পর্যটক,ব্যাংকার ও আলোকচিত্রশিল্পী ফারুক মঈনউদ্দীনের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।

 

গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মতো লম্বা টানা ভাড়া ঘরগুলোর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালো ময়লা জলের নালাটা লাফ দিয়ে পার হওয়ার মুহূর্তে চারপাশের ছাড়া ছাড়া টিম টিম করে জ্বলতে থাকা হলদেটে আলোর বাতিগুলো নিভে যায়। আলকাতরার মতো কালো কাদায় পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয় রাজিয়া। কিছুক্ষণ আগে মাগরেবের আজান পড়ে গেছে, এ সময়টাতে চারপাশের সবকিছু কেমন যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কেবল আশপাশের ঝোপঝাড় থেকে পতঙ্গের ডাক করাতের মতো শব্দ করে আধো অন্ধকারের ভেতর গেঁথে যেতে থাকে। দিনের আলো নিভে যাওয়ার পর পচা পানির নালা এবং ময়লার ডাঁই থেকে নিশাচর দুর্গন্ধ চোরের মতো চুপি চুপি বাতাসের সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে ময়লা ভেজা কাপড়ের মতো ভারি হয়ে ঝুলে থাকে যেন। বিভিন্ন ফ্যাক্টরি থেকে উগড়ে দেওয়া মেয়েদের ক্লান্ত অবসন্ন মিছিল থেকে কিছু কিছু অংশ খসে পড়তে পড়তে এ দিকটায় পৌছে মিছিলটা মরা নদীর মতো মিলিয়ে যায়। রাজিয়াদের সঙ্গে একই বস্তিতে থাকা কয়েকটা মেয়ে স্যান্ডেল ঘষটাতে ঘষটাতে ওকে ছাড়িয়ে চলে গেলে চলার গতি বাড়িয়ে দেয় ও। একটা কুনো ব্যাঙ এ সময় ওর পায়ের পাতায় পেচ্ছাব করে দিয়ে লাফিয়ে সরে যায়। এসব উপেক্ষা করে দ্রুত ঘরে ফেরার তাগিদ অনুভব করলেও পা দুটো আর চলতে চায় না যেন।
মাসখানেক আগেও রাজিয়া টুনির সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে একসঙ্গে ফ্যাক্টরি থেকে ঘরে ফিরতো। তখন ঘরের জন্য ওর মন এতো উচাটন থাকতো না। প্রোডাকশন মানেজারকে বহু বলে কয়ে মেয়েটাকে ওদের গার্মেন্টসে হেলপারের একটা চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিল রাজিয়া। পি এম লোকটা খুব সুবিধের না হলেও ওর অনুরোধ ফেলেনি, অবশ্য হেলপার দরকারও ছিল ওদের। টুনিকে দেখে পি এম বলেছিল, ‘এক্কেরে দুধের বাচ্চা নিয়া আইলা, এডারে দিয়া দিনের রাইতের কুনো কামই চলবো না। ’রাজিয়া লোকটার খবিশ কথার অর্থ বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে বলে, চৈদ্দ বছরের মাইয়া সার, খাওন দাওন ঠিকমতো পায় নাই গতিকে বাচ্চা মনে অয়। কাম দিয়া দ্যাহেন, না পারলে বাদ দিয়া দিয়েন। এই মাইয়া একলা ঘরে থুইয়া আইলে আমার মন পইরা থাহে গরে, আতে কাম ওডে না।’ মেয়েটাকে ভবিষ্যতের শিকার ভেবেই হোক কিংবা মায়ের উচাটন মনকে উৎপাদনমুখী করতেই হোক – টুনির চাকরি জুটে যায়।

প্রথম যেদিন বিশাল কালো বাক্সের মতো দমবন্ধ করা পাঁচতলা বিল্ডিংটার অন্ধকার, প্লাস্টার-খসা সিড়ি বেয়ে মায়ের সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছিল টুনি, দলে দলে উঠতে থাকা মেয়েদের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে বলে, ‘হেরা হগলতেই আমাগো লগে কাম করবনি মা? রাজিয়া মেয়েকে উৎসাহ নিয়ে বোঝায়, ‘এই বিল্ডিংয়ে তিনডা গার্মেন্ট আছে, বুঝছস? কেউ যাইব দোতালায়, কেউ তিনতলায়, একেক জন এককডায় যাইবো, আমরা যামু পাঁচতলায়।’

মেয়েটা অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পড়ার আগেই রাজিয়া ওর পলকা শরীরটা এক টানে তুলে নেয়। পেছন থেকে একজন বলে, ‘তোমার মাইয়া নি, বুবু? এক্কেরে পোলাপান, কি কাম করব হ্যায়?
রাজিয়া মেয়ের ডানা ধরে সিড়ি ভাঙতে ভাঙতে বলে, ‘কাম না করলে খাইব কি? হেলপারের কাম হিকতে কতক্ষণ? তরা আছস না?

মেয়ে যেন সিড়ি বেয়ে ওঠা ঊর্ধ্বমুখী বিবর্ণ রঙিন স্রোতের মধ্যে আরো ছোট্ট হয়ে মিশে যেতে বলে, ‘আমি পারুমনি মা? এহানে কাম খুব কঠিন নি?
রাজিয়া মেয়েকে আশ্বস্ত করে, ‘তুইতো হেলপারের কাম করবি, পারতি না ক্যারে? দেখলেই বুঝবি।’
রাজিয়া টুনিকে সুপারভাইজারের কাছে নিয়ে বলে, ‘সার আমার মাইয়া, আইজ জয়েন দিতে আইছে। অর কাড বানান লাগব।’ লোকটা টুনির দিকে ভালো করে তাকায়, বলে, ‘ফিনিশিংয়ের কাম পারব নি অয়?
রাজিয়া মেয়ের কাঁধে হাত রেখে ওর হাত থেকে আশ্বাস আর সাহস চালান করে দিতে চায় ছোট হাড্ডিসার দেহটিতে, ‘একদিনেই বুইঝা যাইব, মাইয়া চালাক আছে।’
সুপারভাইজার যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলে, ‘কার্ড দিমুনে। তুমি অরে ফিনিশিংয়ে নিয়া যাও, হেরা বুঝাইয়া দিব। আমি পরে গিয়া দেখুমনে অর কাম।’
ফিনিশিংয়ের ফ্লোরে বড়ো বড়ো প্লাস্টিকের বাক্সের ভেতর গাদা করা প্যান্টি ঘিরে বসা মেয়েদের সঙ্গে টুনিকে বসিয়ে দেয় রাজিয়া। হালকা গোলাপি, নীল প্যান্টিগুলোর সেলাই থেকে বের হয়ে থাকা সুতোর মাথাগুলো কেটে ফেলতে হবে কাঁচি দিয়ে। রাজিয়া কয়েকটার সুতো কেটে কেটে মেয়েকে দেখিয়ে বলে, ‘এ্যালায় বুঝছস? এক্কেরে সোজা কাম, পারতি না?
টুনি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে পারবে। রাজিয়া অন্য মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তরা ইট্টু খেয়াল রাহিস, পয়লা দিন তো।’ টুনি কাঁচি দিয়ে আনাড়ি হাতে কাজ শুরু করে দেয়। পাশের মেয়েটা টুনিকে বলে, ‘তরগুলান আলাদা রাখ, সুপারভাইজারে আইসা চেক করব।’
টুনি মাথানিচু করে কাজ করে। ওর সামনে সুতো কেটে ফিনিশিং করা প্যান্টির স্তুপটা অন্যদের তুলনায় দ্রুত বড়ো হয় না। ও আরো তাড়াতাড়ি হাত চালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু অনভ্যস্ত আঙ্গুল ব্যথায় টন টন করে, গতি খুব একটা বাড়ানো যায় না। কিছুক্ষণ পর সুপারভাইজার এসে ওর সামনের স্তুপ থেকে কয়েকটা প্যান্টি তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে। ভালোভাবে উল্টেপাল্টে দেখে বলে, ‘ঠিক আছে, তয় আরো জলদি করন লাগব।’ টুনি ভয়ে ভয়ে ঘাড় কাত করে বলে, ‘আইচ্ছা।’ লোকটার কথা শুনে ও আঙ্গুলের ব্যথার কথা ভুলে যায়। ফ্লোরের অন্যদিকে মেশিনে বসা মাকে দেখার চেষ্টা করে ও, দেখা যায় না। অন্য যাদেরকে এখানে বসে দেখা যায় তাদের হাত আর মেশিনের ফাঁক-ফোকর গলে ফড় ফড় করে সেলাই হয়ে বেড়িয়ে আসে নীল গোলাপি প্যান্টিগুলো। টুনি নিজেকে মেশিনের সামনে কল্পনা করে উদাস হয়ে যেতেই আঙ্গুলের ব্যথাটা ফিরে আসে আবার। লাল হয়ে ওঠা জায়গাটাতে ফোস্কা পড়ে যাবে বলে মনে হয় ওর। একটা মেয়ে বলে, ‘বুইড়া আঙ্গুলে ত্যানা পেচায়া ল, না অইলে ঠোসা পইরা যাইব।’ টুনি কাটিং সেকশনের মেঝে থেকে কয়েক টুকরো কাপড় তুলে এনে বুড়ো আঙ্গুলটায় ব্যান্ডেজের মতো করে পেঁচিয়ে নেয়। এতে লাল হয়ে ওঠা জায়গাটায় আরাম পাওয়া যায় বেশ। দুপুর পর্যন্ত একনাগাড়ে ঠায় বসে থেকে কাজ করে টুনি। ওর হাত থেকে ব্যথাটা বাড়তে বাড়তে কখন ঘাড় পিঠ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে টেরই পায়নি ও।
কাজ শুরু করার পর ভাবছিল কাজের ফাঁকে ফাঁকে পাশের মেয়েগুলো ওর সঙ্গে গল্প করে ওর সম্পর্কে এটা ওটা জানতে চাইবে। কিন্তু প্রায় দুপুর পর্যন্ত কাজ করার পরও বুঝতে পারে গল্প করার মতো ইচ্ছে ও সুযোগ কারোরই নেই। ওদের হাসিহীন, বিষন্ন তেলতেলে মুখ দেখে টুনির কাজের কষ্ট আরো বেড়ে যায়। হাতের ছোট কাঁচিটাকে দর্জির দোকানের বড়ো কাঁচির মতো ভারি মনে হয়।
দুপুরের খাবার বিরতি হলে আশপাশের মেয়েরা উঠে ছুটতে থাকে সিড়ির দিকে। টুনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। ওর সারা শরীরে ছোট ছোট সুতোর টুকরো সেঁটে ছিল, সেসব পরিষ্কার করতে করতে রাজিয়া ফ্লোরের অন্য মাথা থেকে এসে টুনির পিঠে হাত রেখে বলে, ‘কিরে খুব কষ্ট অইছেনি? পয়লা কদিন এমুন লাগব, হ্যাশে দেখবি সব সইয়া যাইব। ল, খানা খাইয়া আহি।’ টুনি কুষ্ঠ রোগীর মতো আঙ্গুলে বাঁধা কাপড়টা খুলে মাকে দেখায়, ‘দ্যাহো কেমুন লাল অইয়া গ্যাছে, ঠোসা পইরা যাইব।’
রাজিয়া জায়গাটার ওপর আঙুল ছুঁইয়ে বলে, ‘না ঠোসা পরতনা। ত্যানা পেছাইয়া কাম করিস, কিচ্ছু অইব না।’
খাবার খেয়ে মেয়েদের অনেকেই ফ্যাক্টরির ছাদে ঘোরাঘুরি করে। ভাদ্র মাসের রোদ ছাদের ওপর পড়ে যেন ছিটকে ওঠে চারপাশে। তবুও ফ্যাক্টরির দমচাপা বিশাল ঘরটাতে অনর্গল ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাসে ঘুরপাক খাওয়া ঘাম আর কাপড়ের গন্ধের চেয়ে রোদে ভাজা খোলা ছাদের হাওয়াতেই অনেক আরাম পাওয়া যায়। টুনি পানির ট্যাঙ্কির একচিলতে ছায়ায় দলা পাকিয়ে বসে থাকা মেয়েদের ভেতর বসে চোখ কুঁচকে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর মা একটু দুরে দাড়িয়ে গল্প করছে কজনের সঙ্গে।
বিকেলে ফ্যাক্টরি থেকে আসার সময় সুপারভাইজার টুনির হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিলে বলে, ‘বিহান বেলা ফেকটরিতে যহন ঢুকবি, এইডা গেইটে দারোয়ানের কাছে থুইয়া আইবি, আবার বিকালে যাওনের সময় আমার থেইকা নিয়া যাবি, বুঝছস?
ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলে বিকেলের হলুদ তেজী রোদে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায় টুনির। ও মাকে বলে, ‘রিকশায় যাইবা, মা? এতদূর আটতে পারুম না।’
রাজিয়া মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘এ্যাহন রিকশার ভাড়া লইব ডবল, আস্তে আস্তে হাইট্টা যামুগা, এডাও অভ্যাস করন লাগব।’
ঘরে ফিরে রাজিয়া বলে, ‘তুই হুইয়া থাক, আমি ভাত বহাইয়া দেই।’

টুনি চৌকিতে শুয়ে ভর সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়ে। রাজিয়া ভাত-তরকারি রান্না শেষ করে টুনিকে ডেকে ওঠায়, মেয়েটা ঘুমজড়িত গলায় ঘ্যান ঘ্যান করে, ‘ভাত খাইতাম না, সারা শইলডায় বিষ করতাছে আমার।’ রাজিয়া মেয়ের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে বলে, ‘চাইড্ডা খাইয়া ল মা, দেখবি আরাম লাগতাছে। ভাত খাইলে চা বানায়া দিমু তরে।’ টুনি ঘুম-চোখে ঢুলতে ঢুলতে গিয়ে ঘরের কোণায় নিচু পানির ট্যাপ খুলে হাত-মুখ ধোয়। গরম ভাত মুখে দিয়ে ওর ঘুম ভাব কেটে যেতে থাকে। ভাত মাখাতে মাখাতে বলে, ‘তোমার লাহান মেশিন চালাইতে আমার কতদিন লাগব মা?’

– হবায় হেলপারের কাম শুরু করলি, আস্তে আস্তে বেবাক হিকতে পারবি। আগে এডি হিক্যা ল।
টুনি বলে, ‘আমার কাডখান রাখছনি ঠিক কইরা? রাজিয়া বাম হাতে গ্লাস ধরে তলায় ডান হাতের তালুর পিঠ ঠেকিয়ে পানি খেয়ে বলে, ‘হ রাখছি।’
টুনি বাসন চেটে খেতে খেতে বলে, ‘কাড দিয়া কি করে হেরা? রাজিয়া বুঝিয়ে দেয় মেয়েকে, ‘গেইট দিয়া ঢুকনের সময় কাড জমা রাখলে অরা বুঝব তুই কামে আইছস, জমা না দিলে এবসেন। এইডা দেইখা তরে বেতন দিব অরা।’
– আমারে কত ট্যাকা বেতন দিবো মা?
রাজিয়া খাওয়া শেষ করে হাড়ি-বাসন গোছাতে শুরু করে। কাজ করতে করতে বলে, ‘পয়লা দুই মাস ছয়শ ট্যাকা কইরা দিব। হের বাদে তুই ঠিকমত কাম হিকলে দিব আটশ’ ট্যাকা।’
টুনি নিজের বাসনটা ধুতে বসে বলে, ‘বেতন পাইলে আমারে নতুন জামা কিনা দিবা কইলাম।’
রাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘দিমুরে মা’।
কয়েক সপ্তাহের ভেতর টুনির হাত চালু হয়ে যায়। এখন আর ওর সুতো কাটা প্যান্টিগুলো আলাদা রাখতে হয় না। অন্য মেয়েদের সঙ্গে একই প্লাস্টিক বাক্সের ভেতর রাখতে পারে। বাক্সগুলো যখন উপচে পড়ার মতো হয়, তখন কেউ একজন ওটা সরিয়ে নিয়ে খালি একটা বাক্স ওদের সামনে রেখে যায়।
টুনি কাজ করতে করতে ক্লান্ত চোখে ফ্লোরের স্টিচিং সেকশনের দিকে তাকায়। সারি সারি সেলাই মেশিনের সামনে ব্যস্ত মেয়েগুলোকে মেশিনের একটা অংশ বলে মনে হয় ওর কাছে। মাথার ওপর থেকে নেমে আসা সাপের মতো তারগুলো দিয়ে যেন সবাই একেটা মেশিনের সঙ্গে বাঁধা। সুপারভাইজারকে এগিয়ে আসতে দেখে টুনি চোখ নামিয়ে কাজ করতে থাকে। সেদিন একটা মেয়ে কাজ বন্ধ করে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল বলে লোকটা মেয়েটার সামনে এসে দাঁত-মুখ খিচিয়ে ধমক দিয়ে ওঠে, ‘অই ছেরি, তর কোন লাঙের কথা চিন্তা করস, এক্কেরে হান্দায়া দিমু কইলাম।’ মেয়েটা কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে কাজ করতে থাকে। টুনি মনে মনে ভাবে, ‘আমার মায়ে জানি এমুন কত গাইল খায়।’ সুপারভাইজার ওকে কিছু না বলে ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেলে টুনি বুকের ভেতর আটকে রাখা দমটা সাবধানে বের করে আনে।
সেদিন খেতে যাওয়ার সময় কাটিং সেকশনের কয়েকটা ছেলে ওদের পিছন পিছন আসছিল, একজন অনুচ্চ গলায় গেয়ে ওঠে, ‘পেন্টিকা নিচে ক্যায়া হ্যায়, পেন্টিকা নিচে। চোলিকা পিছে ক্যায়া হ্যায় চোলিকা পিছে।’ টুনির সামনের কয়েকটা মেয়ে একজনকে আরেকজন কনুইর গুঁতো মেয়ে হাসে। কান গরম হয়ে ওঠে টুনির। ওর পাশের মেয়েটা বলে ওঠে, ‘তর মায়েরে জিগা গিয়া।’
টুনি ওকে বলে, ‘থাউক কিছু কইস না, আরো খারাপ কিছু কইব।’ মেয়েটার রাগ কমে না, বলে, ‘কইয়া দেহুক, এমডি সাহেবের কাছে কইয়া দিমু, এক্কেরে চাকরি নট।’
খাওয়ার পর মেয়েরা যখন ছাদে উঠে ঘোরাঘুরি করছিল সেই মেয়েটা টুনি পাশে এসে বসে। খেতে যাওয়ার সময় যে মেয়েগুলো ছেলেটার গান শুনে মজা পেয়ে হাসছিল ওদের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা টুনিকে বলে, ‘অইড যে ছেরিগুলান দেহস, ছেমরাগো অসভ্য কথা হুইনা হাসতাছিল – এক্কেরে বদ। খেয়াল কইরা দেখবি ফেকটরি থেইকা বাইর অইবার পর কুনো কুনো দিন বাড়িত যায় না, ব্যাডাগো লগে ট্যাক্সিতে উইঠা কই কই যায়, রাইতে ফিরা আহে।’ টুনির চোখ বড়ো হয়ে যায়, ‘এমডি সাবে জানলে?’
মেয়েটা চুলের ফিতে খুলে ফের শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘জানলে কি অইব, ফেকটরির কাম ঠিকমত করলে বারাইয়া কেডা কি করে কে জিগায়।’
টুনি উঠে দাঁড়ায়, ‘থাউক, আমগো কি, এগুলান কথা কেউরে কওন ঠিক না।’
তারপর মাথাটা সামান্য তুলে আকাশের দিকে তাকায়, বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। রোদতপ্ত কঠিন নীল আকাশে ধুনা তুলোর মতো ফেঁপে ওঠা মেঘের আশপাশে কয়েকটা চিল স্থির ছড়ানো দুই ডানার মাঝখানে ভেসে বেড়ায়। তার বহু নিচে তপ্ত ছাদের ওপর থেকে এ ঝাঁক মেয়ে ধীরে ধীরে নেমে একঘেয়ে ক্লান্তিকর ব্যস্ততায় ডুবে যায়। টুনি সবার সঙ্গে নেমে আসে ফ্লোরে। ওর মা এরই মধ্যে মেশিনের সঙ্গে মিশে গেছে দেখে দ্রুত কাজ শুরু করে ও।
প্রথম মাসের বেতন পেয়ে টুনি রাজিয়ার হাতে দিয়ে বলে, ‘আমার জামা কিননের সময় তোমার লেইগা একখান শাড়ি কিনা ফালামু।’
রাজিয়ার চোখে পানি এসে যায়, সামলে নিয়ে বলে, ‘আমার শাড়ি সামনের মাসে কিনন যাইবো, তর লাইগা একটা দুধের পেকেট কিনা লই, তর শরীলডা বাড়তাছে না মোডে।’
টুনি বলে, ‘দুধ লাগব না, ঘরের কত কিছু কিনন দরকার। মশারি, চাদর এগুলান আগে কিনতে অইব।’
ঘরে ফেরার পথে পাড়ায় ঢোকার মুখের দোকান থেকে দুধের একটা ছোট প্যাকেট, চাপাতা, চিনি এসব কেনে রাজিয়া। দোকানের সামনের দিকে মিনি প্যাক শ্যাম্পু, লজেন্স, রাজা কনডম, সাবান ইত্যাদি ঝালরের মতো ঝোলানো। টুনি বলে, ‘একডা শ্যাম্পু কিনবা, মা?’
রাজিয়া বলে, ‘ল, একডা সাবানও লইয়া ল তয়।’
এসময় দোকানটাতে বেশ ভিড় হয়, আরো সব মেয়েরা এটা ওটা কেনে। দোকানের ছেলেটা ঝোলানো কনডমের পাতায় হাত রেখে একটু হেসে বলে, ‘আর কিছু লাগবনি?’ কথাটা কাকে উদ্দেশ্য করে বলা বোঝা যায় না। কিন্তু রাজিয়ার ইচ্ছে করে ছেলেটাকে স্যান্ডেল দিয়ে দুইগালে মারে। নিজেকে সামলে নিয়ে টুনির হাত ধরে অন্যপাশে সরে আসে ও। দাম মিটিয়ে দেওয়ার সময় কারো মুখের দিকে তাকায় না, এমনকি মেয়ের মুখের দিকেও তাকাতে পারে না। সওদাগুলো পলিথিন ব্যাগে নিয়ে আচমকা টুনিকে ধমকে ওঠে, ‘কেলাইয়া চাইয়া আছস ক্যান, এগুলি নিতে পারস না?’
টুনি হঠাৎ মায়ের গলার ঝাঁঝ অনুভব করে মুখের দিকে তাকায়, কিছু বুঝতে পারে না। ঘরমুখো হাঁটার সময় ওদের ফ্যাক্টরির একটা মেয়ে রাজিয়াকে ডাক দেয়, ‘কি বুবু, মাইয়া পয়লা মাসের বেতন পাইল, আমগো কিছু খাওয়াইতা না?’ রাজিয়া মুখ না ফিরিয়ে বলে, ‘বাসাত যাইস চা খাওয়ামু।’ মেয়েটা বলে, ‘চা না মিঠাই খামু।’
রাজিয়া কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত হেটে যায়। মায়ের হয়ে টুনি বলে, ‘আইচ্ছা খাওয়ামু।’ তারপর পা চালিয়ে পিছন থেকে মাকে অনুসরণ করে। রাজিয়া পিছন ফিরে মেয়েকে দেখে নিয়ে কড়া গলায় বলে, ‘এই দোহানে কুনোদিন একলা যাবি না, বুঝছস?’
টুনি বলে, ‘আমি একলা কুনো জায়গায় গেছিনি কুনোদিন?’
রাজিয়া কোনো কথা বা বলে দ্রুত হাটতে থাকে।
আরো কদিন পর দিন আরো ছোট হয়ে আসে। আগে কাজ শেষ করে ঘরে ফেরার পরও দিনের আলোর রেশ থেকে যেতো, এখন ছুটির পর ঘরে পৌঁছতে পৌঁছতে দিনের আলো ফুরিয়ে যায়। বিবর্ণ আলোয় আটপৌরে দোকানগুলো থেকে ঘর ফেরতা মেয়েরা টুকটাক কেনাকাটা করে। রাজিয়া টুনিকে নিয়ে রাস্তার পাশে বসা অস্থায়ী বাজার থেকে আলু, মলিন তরকারি কিংবা একভাগা আধপচা মাছ কিনে ঘরে ফেরে। ততক্ষণে মা মেয়ে কারোরই আর কথা বলার মতো শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। বড় রাস্তার মোড়ে আখের রস মাড়াইর দোকানের পাশে পড়ে থাকা ছিবড়ার মতো শরীরটা ফালি ফালি হয়ে খুলে আসতে চায়। ঘরে ঢুকে নড়বড়ে চৌকির পায়ের কাছে কেরোসিন চুলোটা জ্বেলে ভাত বসিয়ে টুনি বলে, ‘চা খাইবা, মা? রাজিয়া মাছ কুটতে বসে গেছে ততক্ষণে, মেয়ের দিকে স্নেহে তাকিয়ে বলে, ‘ভাত খাইয়া লই, হ্যার বাদে চা খামু। তুইও সেসুম খাইস, ফেরেশ লাগব।’
টুনি বলে, ‘পয়লা পয়লা শইলডা যেমুন বিষ করত, এ্যাহন করে না।’
এসময় আশেপাশের অন্যান্য ঘরেও মৃতপ্রায় জীবনের স্পন্দন জেগে ওঠে যেন। ঘরে ঘরে রাতের রান্নার ব্যস্ত শব্দের ভেতর থেকে শব্দহীন ক্লান্তির ক্ষীণ কলরব শোনা যায়। ঘরের সামনে অপ্রশস্ত রাস্তার ময়লায় মাখামাখি করা বাচ্চাগুলো মায়েদের রান্নার অপেক্ষায় কান্না ভুলে বসে থাকে। টুনি চুলোর পাশে মেঝেতে বসে আলু কুটতে কুটতে বলে, ‘আমগো ফেকটরির এতা জাইঙ্গা কই যায় মা?
রাজিয়া বলে, ‘এগুলানরে কয় পেন্টি, তরে আরেকদিন কইছি না? এগুলান মেমসাবেরা পিন্দে। বেবাক পেন্টি যাইতাছে ইসি দ্যাশে। হ্যারা কি সেলোয়ার কামিজ পিন্দেনি? ইস্কাটের নিচে পেন্টি পিন্দে হ্যারা।
ইসি দ্যাশ কুনদিকে মা? আমেরিকাত নি?
এ প্রশ্নে রাজিয়া বড়ো ধন্দে পড়ে যায়, বলে, অইব কুনো একদিকে, লন্ডনেও অইতে পারে।
টুনি ভাতের হাঁড়ির ঢাকনা খুলে চামচে করে ভাত নিয়ে মাকে দেখায়, রাজিয়া দুআঙ্গুলে ভাত টিপে বলে, আরো মজব।
টুনির আলু কোটা শেষ, তাই হাতগুটিয়ে বসে থাকে ও। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে, ফোলোরের ছ্যারাগুলান পেন্টি লইয়া খারাপ খারাপ কতা কয়। কতডি ছেরি হেগোর কতা হুইনা খালি হাসে।
রাজিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। মেয়েকে চাকরিতে ঢোকানোর আগে এব্যাপারে ভয় পাচ্ছিল ও, খুব কঠিন গলায় টুনিকে ধমক দিয়ে বলে, খবরদার বদমাইশ ছ্যারারা কত কিছু কইব, এক্কেরে কানের মইদ্দে তুলা দিয়া রাখবি, কেউর কতা হুনবি না। গার্মেন্টসের মাইয়াগোরে হগলতে খুব হস্তা মনে করে।
টুনি মায়ের গনগনে মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি কি কান লাগাইয়া হুনছিনি, আমার লগে চেইতা কি অইব?
রাজিয়া একটু নরম হয়, তর লগে চেতছিনারে মা, চেতি অই জাউরাগো উপর, হেগো নজর খারাপ। যেই ছেরিরা খারাপ কথা হুইনা হাসে কইলি হেই খানকিগো লগেও কতা কবি না।
ভাত খাওয়ার পর টুনি থালাবাসন ধুয়ে রাখতে রাজিয়া দুধ ছাড়া দুকাপ রং চা বানিয়ে ফেলে। চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার আগেই লোডশেডিংয়ের জন্য আশপাশের সব বাতি নিভে গিয়ে ছেদহীন আঁধারে ঢেকে যায় সবকিছু। দূরের রাস্তা দিয়ে চেঁচিয়ে গালাগাল দিয়ে ওঠে কে যেন। রাজিয়া মেয়েকে নিয়ে দরজার চৌকাঠে বসে চুপচাপ চায়ে চুমুক দেয়। হাওয়াবিহীন রাত অন্ধকারে যেন আরো গুমোট হয়ে ওঠে। রাজিয়া খালি কাপটা একপাশে সরিয়ে রেখে বলে, আইজ তর বাপে বাঁইচা থাকলে তরে চাকরি করন লাগেনি? ইসকুলে পড়তে পাড়তি। হে ব্যাডাত মইরা বাঁচছে, অহন তরে নিয়া আমি য্যান বাঁইচাও মইরা আছি।
টুনি ততক্ষণে ঘুমে ঢলে পড়ছে। রাজিয়া মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে বলে, যা বিছানায় গিয়ে ঘুমা। বেহান বেলায় তরে ডাইকা দিশ পাই না। টুনি কোনো কথা না বলে ঢুলতে ঢুলতে চৌকিতে উঠে শুয়ে পড়ে। রাজিয়া চৌকাঠের ওপর বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। আশপাশের ঘরগুলোতে মৃদু কথাবার্তার ধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যায় না। দূরের অনেক উঁচুতে ওয়ারলেস টাওয়ারের মাথায় একটা বাতি জ্বলন্ত কয়লার মতো লাল হয়ে জ্বলতে থাকে। রাজিয়া বসে থাকতে থাকতে পাশের ঘরগুলো থেকে মানুষের উপস্থিতি ও ব্যস্ততার শব্দ আরো কমে আসে।
এ সময় মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা শাড়ির খস্ খস্ আওয়াজ তুলে দরজার সামনে দিয়ে কে যেন পেরিয়ে যায়। সেন্টের গন্ধে বোঝা যায় শেষ মাথার ঘরের হেনা। প্রায়ই সন্ধ্যায় সেজেগুজে বেরিয়ে এ রকম রাত করে ফেরে মেয়েটা। রাজিয়া অনুচ্চ গলায় বলে, কেডারে হেনা নি?
মেয়েটা সস্তা কাঠের হিলের খটখট আওয়াজ তুলে ফিরে এসে চাপা গলায় বলে, হ আমি। ঘুমাও নাই অহনতরি? লাইট গেছে কতক্ষণ?
রাজিয়া এককথা জবাব না দিয়ে বলে, কই গেছিলিরে?
হেনা অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, দাওয়াত আছিল। রাজিয়া গলার উত্তাপ চেপে রাখতে পারে না। এতো দাওয়াত খাওন বালা না, বুঝলিনি। জীবনডা শ্যাষ করিস না ছেমরি। হ্যাশে এমুন বিপদে পরবি কাঁইদাও কুল পাইবি না।
হেনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, ওর শরীর থেকে সস্তা সেন্ট এবং ঘামের গন্ধ মিলেমিশে অন্ধকারে ভেসে যায়। তারপর বলে, তুমি বুঝবা ক্যামনে, মায়ে বেডিতে চাকরি কর, ট্যাকার ভাগ দিতে অয় না। আমার লাহান মাসে মাসে বাড়তি ট্যাকা পাডান লাগতে বুঝতা। বাড়িত বইয়া বুইড়া বাপে মনে করে আমি বহুত ট্যাকা বেতন পাই। কইলে বিশ্বাস যায় না। হেরা মনে করে আমগো হাতে সিলি করা কাপড় বিদেশে যায়, আমরাও বিদেশের লাহান বেতন পাই। তোমরা আমার পিছে বহুত কথা কও আমি জানি, কি করুম কও।
রাজিয়া চুপ করে থাকে, হেনার কথার জবাব দিতে পারে না ও। এসময় বাইরের রাস্তার দিকে থেকে কারো জড়ানো কন্ঠে গান ভেসে এলে বলে, ঘরে যা, বহুত রাইত অইছে। হেনা ধীরে ধীরে ঘরের দিকে চলে যায়। কিছুক্ষণ আগেও রাজিয়ার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল, এখন সেটা কেটে গেছে। অন্ধকারের আড়াল থেকে দুশ্চিন্তাগুলো এবার সুযোগ পেয়ে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন।
দিনের বেলায় কাজের চাপে ব্যস্ততার ফাঁক গলে ভাবনার কালো ছায়া সামনে আসতে পারে না। অন্ধকারের ভেতর বসে তাই দিনের আলোর অপেক্ষা করে ও। সকালে ওঠার তাড়া থাকলেও গুমোট অন্ধকারে নির্ঘুম বিছানায় শুতে ইচ্ছে করে না ওর।
টুনি দ্বিতীয় মাসের বেতন পাওয়ার কিছুদিন আগে রাজিয়া শোনে ফ্যাক্টরির মেয়েরা বলাবলি করে, হুনছস চৈদ্দ বছর না অইলে গার্মেন্ট ফেকটরিতে চাকরি করন যাইবো না বলে। কেউ কেউ ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয়, হ তরে কইছে, চৈদ্দ বছর হেরা মাপবো ক্যামনে। বয়স কুনো জাগায় লেখা আছে নি?
খবরটা প্রথম দেয় মালতী। ও ক্লাসে টেন অব্দি পড়াশোনা করেছিল, টাকা পয়সার অভাবে চালাতে পারেনি। চাকরি করে টাকা জমিয়ে পরীক্ষাটা দেবে সে, সে কারণে খোঁজখবর রাখে চারদিকের। মালতী বলছে বলে অনেকেই কথাটা বিশ্বাস করে না। সে বলে, দেইখা চৈদ্দ বছর মনে না অইলেও চাকরিত রাখব না হেরা।
রাজিয়া কথাটা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ে টুনির চৌদ্দ বছর পার হলেও ওকে দেখে কিছুতেই বোঝা যায় না। রাজিয়া মালতীকে জিজ্ঞেস করে, তরে কইছে কেডা? মালতী বলে, চৈদ্দ বছরের কম যারা চাকরি করে হেরা অইলো শিশু, হেগোরে দিয়া কাম করাইলে শিশুশ্রম অয়। যেই ফেকটরিতে শিশুশ্রম অইবো, হেই ফেটকরি মাল বায়াররা কিনব না কইছে।
রাজিয়া রেগে ওঠে আমগো পোলাপান যদি অল্প বয়সে ট্যাকা কামাইতে পারে হেই ব্যাডাগো ক্ষতি কি? মালতী হেসে বলে, আমারে জিগাও ক্যান? কতাডা হারকিন সাবরে জিগাও।
রাজিয়া বোঝে না বলে, হারকিন সাব কেডা? মালতী বলে, আমরিকার এম.পি না কি জানি। হে ব্যাডাই বলে পয়লা কতাডা তুলছে।
রাজিয়ার মাথার ভেতর সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। আমরার মাইয়া যদি দশ বছরেও কাম ঠিকমত করতে পারে তো হেগোর কি? জিজ্ঞেস করে ও।
বোঝলা না? এডারে কয় মার থেইকা মাসির দরদ বেশি। রাজিয়া প্রসঙ্গটা ছেড়ে দেয় না। ফেটকরির মালিকে যদি কাম করতে দেয় হেরা বিদেশে বইসা বুঝব কেমনে? হেরা কি চাইয়া থাকবনি?
হেরা না দেখলেও বিজিএমি হেগোর পক্ষ অইয়া এইডা দেখবো। আৎকা আইয়া চেক করলে মালিক ধরা পইরা যাইব না? তহন কি অইব?
সামনে কোনো রাস্তা দেখতে পায় না রাজিয়া। মেয়েটার শরীর যদি একটু বেড়ে উঠতো তাহলে কোনো চিন্তা ছিল না। মেশিনের সামনে বসে ওর হাত চলতে চায় না। বারবার মাথা ঘুরিয়ে ফিনিশিং সেকশনের দিকে তাকিয়ে টুনিকে দেখতে চায় ও Ñ ওকে অন্যদের তুলনায় খুব ছোট লাগে কিনা। কিন্তু ওর জায়গা থেকে ফিনিশিংয়ের ফ্লোর ভালো করে দেখা যায় না। ঘাম তেলতেলে মুখে নিশ্চিন্তে মেশিন দাবড়িয়ে কাজ করতে থাকে মেয়েদের দেখে রাজিয়ার মনে হয় ওর মতো বিপদ ও দুশ্চিন্তায় আর কেউ নেই, ঈর্ষার বুকের ভেতর অম্বলের জ্বালার মতো জ্বালা করে ওঠে ওর।
সেদিন সন্ধ্যার ঘরে ফিরে মেয়ের ওপর চড়াও হয় রাজিয়া, তরে যে এত কই বেশি কইরা খাবি, কতা কানে যায় না, তরে দেইখা কেউ বিশ্বাসনি যাইব তর বয়স চৈদ্দ বছর? বছর আন্দাজে তর শরীল বারতাছে না, এডা বোঝস্ না হারামজাদি?
টুনি কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়, কহন আমারে বেশী কইরা খাইতে কইলা, শরীল না বারলে আমি কি করতাম?
রাজিয়া অবশ্য নিজেও নির্দিষ্ট করে মনে করতে পারে না, কখন মেয়েকে বেশি করে খেতে বলেছে। তবুও দমে না ও, ক্যান আমি না কইলে খাওন যায়না নি? এ্যাহন তরে হেরা চাকরিত রাখত না। টুনি চমকে ওঠে, ক্যান রাখত না? আমার কাম বালা অইতাছে না? রাজিয়া মালতীর কাছে শোনা ব্যাপারটা ওকে বুঝিয়ে বললে টুনি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে ওর হাতের ঝাড়– নড়ে না। রাজিয়া কোনো কথা না বলে রান্না বসায়। টুনি ঘর ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে একটা পিঁড়ি নিয়ে চুপচাপ আগুনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। ঘরের বাইরের আশেপাশের পরিচিত বিভিন্ন শব্দ মাঝে মাঝে ভেতর ছিটকে এলেও ছোট ঘরখানার ভারি নিস্তব্ধতা টোল খায় না।
খেতে বসে রাজিয়া টের পায় টুনি জোর করে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যদিনের চেয়ে বেশি ভাত খাচ্ছে। খেয়ে উঠে টুনি বলে, বেশি কইরা খাইলাম মা, গলাতক ভাত উইঠা আইছে, লরতে পারতাছি না।
রাজিয়া হাঁড়ি পাতিল তুলে রাখতে রাখতে বলে, লরন লাগব না, যা হুইয়া থাক। টুনি অতিকষ্টে উঠে দাঁড়ায়, অহন বিছানায় কাইত অইলে প্যাডে বিষ করব। মনে অয় গলা দিয়া বেবাক বারাইয়া আইতাছে।
মুখের বমিভাব দূর করার জন্য টুনি কৌটা থেকে সুপুরির টুকরো নিয়ে কুটকুট করে চিবোয়। রাজিয়া মেয়েকে একবার দেখে নিয়ে বলে, কিরে বেশি খারাপ লাগেনি?
টুনি দুপাশে মাথা নাড়ে। তারপর পিঁড়িটা নিয়ে দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে বসে থাকে। রাজিয়া হাতের কাজ সেরে মেয়ের পাশে বসে বলে, কাইলকার থন কামে যাওনের সময় তর লাইগা ভাত নিয়া যামু, দুফরে তর রুডি খাওনের কাম নাই।
ভরাপেট ভাতের প্রভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে টুনি ঢুলতে শুরু করলে রাজিয়া ওকে বিছানায় পাঠিয়ে দিয়ে পাহারাদারের মতো দরজায় বসে থাকে নির্ঘুম চোখে।
সপ্তাহখানেক পর টুনি তৃতীয় মাসের বেতন পায়, একই সঙ্গে ও সহ আরো জনাকুড়ি মেয়েকে জবাব দিয়ে দেয় কোম্পানি। অবশ্য ছাঁটাই করার সময় স্বয়ং এমডি সাহেব সবাইকে ডেকে বলেছেন ওদের বয়স চৌদ্দ বছর হলে অথবা চৌদ্দ বছর বয়স হয়েছে মনে হলেও আবার চাকরিতে নেওয়া হবে ওদেরকে। রাজিয়া সবাইকে ঠেলে সামনে এগিয়ে এসে টুনিকে দেখিয়ে বলে, বিশ্বাস করেন সার, আমার মাইয়ার বয়স চৌদ্দ বছর, দেইখা মনে অয় না। এমডি সাহেব টুনির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলেন, দেখে মনে না হলে কোন লাভ নেই। বায়াররা এসে দেখে যদি চৌদ্দ বছর হয়েছে বলে মনে না করে তাহলে অর্ডার বাতিল, এতে অল্প কয়েকজনের জন্য সবাইকে ভুগতে হবে।
ফ্লোরে সবার সঙ্গে ভিড় করে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে রাজিয়া টুনির কাঁধে হাত রেখে নিজের অজান্তে সরু কাঁধটা এতো জোরে চেপে ধরে যে টুনি ব্যথা পেয়ে হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়।
সেদিন ঘরে ফিরে আসার পর রাজিয়া অসুস্থের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ে। টুনি মার দিকে তাকিয়ে বলে, চা খাইবা মা?
রাজিয়া শুয়ে থেকে ধমকে ওঠে, চা খাওন আর লাগবে না। চুলায় ভাত বহা। কাইল থাইকা তরে ক্যামনে একলা ঘরে থুইয়া যামু হেই চিন্তায় গলাদা কিছু নামবদি হারামজাদি।
টুনি কোনো কথা না বলে চাল ধুতে থাকে। রাজিয়া বলে, বেহান বেলায় আমি বারাইয়া যাওনের বাদে ঘরের কাইজ-কাম সাইরা ভাত খাবি, হের পর ঘুম যাবি।
দরজা খোলা থুবি না, বুঝছস? ঘরের বাইরে যাবি না এক্কেরে।
টুনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, তামাম দিন দরজা ভেজাইয়া থাকন যায়নি?
রাজিয়ার ক্লান্ত স্বর কঁকানির মতো শোনায়, তামাম দিন বন্ধ রাখবি ক্যান? কহনো বেদরকারে দরজা খুইলা থুবি না।
টুনির চাকরি যাওয়ার পর প্রথম কদিন রাজিয়া যখন ফিরে আসে যখন টুনিকে দরজার পাশের ছোট জানালাটাতে ওর শুকনো মুখটা জাগিয়ে বসে থাকতে দেখে ওর বুকের ভেতরটা কে যেন চেপে ধরতো। টুনিকে খুশি মুখে দরজা খুলতে দেখার পর রাজিয়া বুক কাঁপিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। আবার কখনো ফিরে এসে জানালা দিয়ে দেখে ভর সন্ধ্যাতেও মেয়েটা গভীর ঘুমে কাত হয়ে পড়ে আছে। টুনিকে একা ঘরে রেখে চারকিতে গিয়ে ফেরার আগ পর্যন্ত প্রাণটা যেন গলার কাছে এসে ধুকধুক করে রাজিয়ার। এলাকার ছেলে-ছোকরাদের চলাফেরা মতিগতি দেখে সর্বক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকে। কদিন আগেও মহল্লা থেকে সোয়েটার ফ্যাক্টরির রুবিকে সন্ধ্যার সময় শেয়ালের মুরগি ধরার মতো করে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে গেলো। একটি মুরগী বাঁচাবার জন্যও লোকজন শেয়ালকে তাড়া করে, কিন্তু ওদের পিছনে কেউ ধাওয়া করেনি। পরদিন ফিরে আসে রুবি। কাউকে কিছু না বলে সে রাতের লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে মহল্লা ছেড়ে চলে যায়।

এ ঘটনার পর কয়েক ঘর ভাড়াটিয়া বাড়িওয়ালা মফিজ চৌধুরির কাছে গিয়েছিলো। লোকটা আগেই ব্যাপারটা শুনেছে বলেই বোধ হয় জবাব প্রস্তুত ছিল। বলেছিল, ভাড়ার ঘর দিতাছি, কিন্তু কেউরে সিকুরিটি দিমু এমুন কতাতো আছিল না। রাস্তা থেইকা তুইলা নিল, আর তোমরা আইসা ধরলা আমারে। দিনকাল কেমুন নিজেরাই দেখতাছ, আমি কি করার পারি কও। এ কথার জবাব কারোরই জানা ছিল না, তাই মাথা নিচু করে চলে আসে সবাই।

কিন্তু রাজিয়ার বুকের কাঁপুনি যায় না। সকালে ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার সময় ইচ্ছে হয় মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদে। চারপাশে দুঃসময়ের খাঁচার দেওয়াল, ভেতরে ঘুরে বেড়ায় শেয়ালের মতো মানুষেরা, তাদের মুখে ফেলে রেখে যেতে হয় মেয়েটাকে। রাতে বিছানায় শুয়ে মেয়েটাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখতে ইচ্ছে করে, মনে হয় পরদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরেইতো আর পাবে না ওকে।
পাশের ঘরের মেহের ওর বুড়ো মাকে এনে রেখেছে গ্রাম থেকে। রাজিয়া যেন বুকে সাহস পায়। সকালে রওয়ানা হওয়ার সময় রোজ বুড়িকে বলে আসে চাচী গো, মাইয়াডারে একলা রাইখা গেলাম ঘরে, ইট্টু নজর রাইখো।
বুড়ি তখন চামড়ার মতো খসখসে দুখানা মোটা রুটি দিয়ে ভাজি মুড়ে মেহেরের জন্য ছোট টিফিন বাটিতে ভরে দিচ্ছিলো, বলে হেইডা তো কওন লাগে না মা, আমার নিজের কইলজাডাও খালি কাঁপে। দুফর কালে বেবাক মাইনষে খায়াদায়া চইলা গেলে চাইর দিক কেমুন চুপ মাইরা যায়। হেসুম ডরে আমার আতপাও ঠান্ডা হয়া আসে। আমারে যদি জব কইরা যায় কেউ টেরনি পাইব। তুমি যাও, আল্লা ভরসা।
প্রথম দিকে রাজিয়ার উৎকন্ঠা দেখে কয়েকজন বলে, তোমার মাইয়া অহন তরি সেয়ানা অইছে না, চোখে লাগেনি অরে? এত চিন্তা কর ক্যান? রাজিয়ার বুক থেকে ভারি পাথরটা পুরোপুরি না নামলেও অনেক হালকা হয়ে গিয়েছিলো। নিজের মেয়ের বুক পাছার দিকে ভালো করে ঠাউর করে দেখতো ও। এখনো সুপুরির মতো বুকও হয়নি। কাঠের তক্তার মতো চ্যাপ্টা সমতল পাছা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাজিয়া। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে, মেয়েটার শরীরে এসব নেই বলেইতো চাকরিটা থাকলো না। বুকটুক ঠিকমতো না হওয়া পর্যন্ত চৌদ্দ বছর বয়স হয়েছে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না, চাকরিটাও হবে না।
কদিন পর শোনা যায় কোথায় যেন সাত বছরের মেয়ের সঙ্গে খারাপ কাজ করে আধমরা করে ফেলে রেখে গেছে কে যেন। আরেকদিন শোনে কোর্ট বিল্ডিংয়ের ভেতর ছয় বছরের মেয়েকে ফুসলিয়ে খারাপ কাজ করে রক্তাক্ত করে ফেলেছে এক শয়তান।
কথাগুলো রাজিয়ার বিশ্বাস হতে চায় না, তবুও বুকের ভেতর এক অজানা ভয়ের চাদর যেন ফড় ফড় করে সেলাই হয়ে আটকে যায়। রাজিয়া বলে, যাহ, কি হুনতে কি হুনছস্ ঠিক নাই। এইডা কুনো মাইষের কাম নি? কয়েকজন একসঙ্গে বলে ওঠে, হুনছিনা, পেপারে লেখছে। ব্যাবাক পেপার মিছা কথা লেখছেনি? তুমি কুন দুইন্যাত থাহ, এইডা নিয়া কত্ত গন্ডগোল শুরু অইছে। ওদের সমবেত জবাবের তোড়ে যেন খাবি খেয়ে তলিয়ে যায় রাজিয়া। মেয়ের অপুষ্ট শরীর দেখে যেটুকু স্বস্তি ছিল সব ভেঙেচুরে মুহুর্তে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। কোনো পথ না পেয়ে কোয়ালিটি কন্ট্রোলের সবিতাকে ধরে ও। সবিতা মেয়েদেরকে বহু ব্যাপারে বু্িদ্ধ পরামর্শ দেয়। চৌদ্দ বছরের নিচে কোনো মেয়ে কাজ করছে কিনা দেখার জন্য কদিন আগে যারা এসেছিল তাদের সঙ্গে সবিতা বেশ কথাবার্তা বলেছে। রাজিয়া বলে, দিদি আমার মাইয়াডা তো বাদ দিয়া দিল, এ্যাহন হেরে একলা ঘরে থুইয়া আইতে ডর লাগে। হের যে চৈদ্দ বছর অইছে কেউ বিশ্বাস যায় না। আপনে দেখছেন না অরে?
সবিতা অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ায়, হ দেখছি মনে অয়। অরে নিয়া আইস একদিন কতা কইয়া দেহি। বয়স পরীক্ষা করার লাইগা আইএলোর হেরা কতডি কতা জিগায়। দেহি হে পারব নি।
পরদিন টুনিকে সঙ্গে করে ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আসে রাজিয়া। দুপুর পর্যন্ত গেটের কাছে সিঁড়িতে বসিয়ে রেখে খাবার বিরতিতে টুনিকে সবিতার কাছে নিয়ে যায়। সবিতা টুনির দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলে, দেইখাতো আসলেও চৈদ্দ বছর অইছে বইলা মনে অয় না। মেন্স শুরু অইছেনি অর?
রাজিয়া মাথা নাড়ে উপর-নিচ। সবিতা টুনিকে জিজ্ঞেস করে, কতদিন অইছে? টুনি মাথা নিচু করে রাখে। রাজিয়া মেয়ের হয়ে জবাব দেয়, পেরার এক বছর অইব।
সবিতা বলে, দুই বছর না অইলে এমনেও চৈদ্দ বছর ধরে না। দুই বছর আগে শুরু অইলেও আসল কতা অরে দেইখা চৈদ্দ বছর মনে অয় না। এ্যাহন তো নিবো না হেরে। আরো কদিন যাইতে দাও, শরীলডা একটু বারুক।
রাজিয়া অধৈর্য হয়ে পড়ে কতদিন ঘরে বইয়া থাকব হে। ঘরে রাইখা আইলেও ডরে আমার কইলজাডা এদ্দুর অইয়া থাহে।
সবিতা ওকে প্রবোধ দেয় কি করবা কও। বায়ারগো কতা না মানলে ফেকটরি বন্ধ অইয়া যাইব। তহন কেউর চাকরি থাকব না।
ঘরে বসে থাকার কারণে টুনিকে আগের চেয়েও কিছুটা উজ্জ্বল মনে হয় রাজিয়ার কাছে। ও তীক্ষèদৃষ্টিতে মেয়েকে দেখে, মুখটা আরো একটু টান টান তেলতেলে মনে হচ্ছে না? ওর মনের ভুলও হতে পারে। ঘরে ফেরার পর থেকে মেয়ের শরীরের দিকে তাকাতে তাকাতে রাজিয়ার আর অন্য কিছু ভাবার সময় থাকে না। রাতে খাওয়া শেষে পাহারাদারের মতো দরজায় বসে থেকে প্রায়ই মাঝরাত পেরিয়ে যায়। অনেক দূরে কোথাও রাতের পাহারাদাররা লাইটপোষ্টে ঠন ঠন শব্দ করে রাতের প্রহর ঘোষণা করে। রাজিয়া বসে বসে নির্ঘুম চোখে সেই শব্দে গোনে। তিনমাস টুনির বেতনের টাকাটা হাতে পেয়ে যে বাড়তি সুখটা ছিল হঠাৎ নিভে গিয়ে যেন আরো দিশেহারা হয়ে পড়ে ও। রোজ সন্ধ্যায় অনেকগুলো মেয়েলি পায়ের স্যান্ডেল ঘষটানোর শব্দের মিছিলের সঙ্গে রাজিয়া ফিরে আসার সময় রাস্তা যেন ফুরোতে চায় না। ওদের পাড়া পর্যন্ত আসতে আসতে সম্মিলিত পদশব্দ ক্ষীণ হয়ে আসে, তারপর কেবল ওর পায়ের আওয়াজ জেগে থাকে। মাঝে মাঝে সময় মিলে গেলে আরো দ্এুক জোড়া পায়ের শব্দ ওর সঙ্গে থাকে। যেদিন অন্য কোনো মেয়ে ওর সঙ্গে থাকেনা সেদিন একা হওয়ার পর থেকে এক ধরনের অজানা ভয় যেন ওকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় ঘরের দিকে।

সেদিন বিকেলটা মেঘলা থাকায় অন্ধকার যেন সময়ের আগেই ছড়িয়ে পড়েছে। বড় রাস্তার মোড়ে উজ্জ্বল বাতির পিছনের আকাশটা মাছের পিত্তের মতো অদ্ভুত নীল দেখায়। দ্রুত পা চালিয়ে রাজিয়া যখন ঘরের সামনে পৌঁছায় ততক্ষণে আকাশে আর আলোর চিহ্নমাত্র নেই। ঘরের দরজার পাশের ছোট জানালাটা বন্ধ, দরজা পুরোপুরি বন্ধ নয়। ভেতরের আলো জ্বালানো নেই দেখে রাজিয়ার বুকের ভেতর তড়াক করে কি যেন একটা ঘাই দিয়ে ওঠে। কপাটে ঠেলা দিতেই মরচেপড়া দরজা আর্তনাদ করে ওঠে। অন্ধকারে বিছানায় টুনির শরীরের ছোট-খাট কাঠামোটা বোঝা যায়। কান্নায় ভেঙে পড়া কন্ঠে মেয়েকে ডাক দিয়ে সুইচ টিপে বাতি জ্বালায় রাজিয়া। কুন্ডলী পাকিয়ে অসহায়ের মত ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। ও দ্রুত গিয়ে মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়। এক ঝাঁক মশা শন্ শন্ করে অস্থির ভঙ্গিতে এদিক ওদিক উড়ে যায়। বাকিগুলো ভারি বিবশ ভারি শরীর নিয়ে টুনির শরীর থেকে খসে পড়ে। রাজিয়ার আতঙ্কিত ঝাঁকুনিতে টুনি বিভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে মায়ের মুখের দিকে অপরিচিতের মতো তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। রাজিয়া কষে থাপ্পড় মারে মেয়ের গালে, কিরে হারামজাদি দরজা খোলা থুইয়া সন্ধ্যাতক ঘুমাইলি! কেউ ঘরে ঢুইকা তরে উঠায়া নিলে কি অইত?
টুনি মশার কামড়ে ফুলে ওঠা হাত পা চুলকাতে চুলকাতে বলে, দুফরে বাত রান্দি নাই, রাইতের পান্তা বাত খাইয়া আৎকা এমুন ঘুম আইল। কিছু চুরি গেছেনি মা?
রাজিয়া এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, চুরি যাওনের কিছু আছেনি আমাগো? আমি তরে লইয়া সে ডরে মরতাছি। আল্লায় রহম করছে আইজ।
এমন সময় লোডশেডিংয়ের জন্য বাতি নিভে গেলে অন্ধকারে ঢেকে যায় সবকিছু। রাজিয়া মেয়ের গায়ে হাত রাখে, ওর নিজের বুকের ধড়াস ধড়াস শব্দ কমেনি এখনো। রাগে, স্বস্তিতে, ক্লান্তিতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, কত বড় মুসিবত থেইকা বাঁচাইল আল্লা মাবুদ, এমুন কইরা আর কতদিন বাঁচাইব? তরে নিয়া আমি কি করি, কই যাই হারামজাদি।
রক্তের স্বাদ পাওয়া বাধাপ্রাপ্ত মশাগুলো দ্বিগুণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের ওপর। ঘুমে অবশ শরীরে মেয়ে কিংবা উদ্বেগ আর শ্রমের ক্লান্তিতে মা কেউই ওগুলোকে বাধা দেওয়ার মতো যতেষ্ট শক্তি পায় না। দুজনই একরাশ অন্ধকার কোলে নিয়ে আলো আসার আশায় অনিশ্চিত বসে থাকে।

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত