| 25 এপ্রিল 2024
Categories
সাক্ষাৎকার

ইরাবতীর মুখোমুখি উত্তরউপনিবেশি তাত্ত্বিক কবি ফয়েজ আলম

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

পশ্চিমারা শাসন শোষণের স্বার্থে, উপনিবেশ কায়েম রাখার স্বার্থে যে জ্ঞানভাষ্য তৈরি করেছে তাতে উপনিবেশিতদের মানসিকভাবে দাসে পরিণত করেছে। মনোজগতের এই উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই উত্তর উপনিবেশী ভাবচর্চা জরুরি। উত্তরউপনিবেশি তাত্ত্বিক কবি ফয়েজ আলমের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শৌনক দত্ত।


 

শৌনক দত্ত:  উত্তরউপনিবেশবাদ হলো উপনিবেশবাদের প্রতি প্রবল সমালোচনামূলক এক দৃষ্টিভঙ্গি বা এক কথায় উপনিবেশবাদের আধিপত্যকে অস্বীকার করা, আপনি কিভাবে দেখেন?

ফয়েজ আলম: ‘উত্তরউপনিবেশবাদকে উপনিবেশবাদের প্রতি প্রবল সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি’ বলে শেষ করলে কথাটার মধ্যে একটা নেতিবাচক মনোভঙ্গি লেগে থাকে। এটি উপনিবেশবাদের প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি তো পোষণ করেই, সন্দেহ নাই। কিন্তু কেন করে, এই প্রশ্নটা আগে আসতে হবে, না হলে এর নৈতিক অধিকার ও ব্যাপ্তিটা বোঝা যাবে না। উপনিবেশ ও উপনিবেশ মনোভঙ্গি বা জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে যাকে বলা যায় উপনিবেশবাদ  তার প্ররোচণায় উপনিবেশক শক্তি ভিন্ন একটা জাতির জায়গাজমি গায়ের জোরে দখল তো করেই সেই জমিনের মানুষগুলোর বিশ্বাস, আচার সংস্কৃতি, জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছু ধ্বংস করে চাপিয়ে দেয় নিজেদের সংস্কৃতি ও জ্ঞান। এভাবে তাদের মনোজগতকে দখল এনে সেখানে এই ধারণা রুইয়ে দেয় যে, উপনিবেশি শক্তি সব দিক হতে শ্রেষ্ঠ, তাই উপনিবেশি শাসন তাদের প্রয়োজন। এভাবে তাদের কাছ থেকে উপনিবেশি শাসনের বৈধতা আদায় করে নেয়, গ্রামসির হেজেমনি বা ভাবাধিপত্য ধারণা দিয়ে যে অবস্থাটাকে কতকটা বোঝানো যায়। উপনিবেশ চলে যাওয়ার পর এই ভাবাধিপত্য জারি থেকে যায় স্বাধীনতা-পাওয়া মানুষের মনোজগতে। মনোজগতের উপনিবেশি প্রভাব কাটিয়ে উঠার যৌক্তিক ইচ্ছা ও তৎপরতার ঐতিহাসিক পরম্পরাগত প্রয়াসের একীভূত একটা রূপ হলো উত্তরউপনিবেশবাদ। কেবল সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি হওয়ার মধ্যেই এর অস্তিত্ব বা ব্যাপ্তি বোঝা যায় না। হ্যাঁ, এর লক্ষ্য উপনিবেশের প্রভাব ও আধিপত্য সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব ঐতিহ্য ও পরম্পরাগত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় রেখে যৌথ জাতিগত বিকাশের দিকে আগানো। 

প্রশ্ন: আচেবে প্রথম সৃজনশীল সাহিত্যে উত্তরউপনিবেশবাদ শুরু করেনযদিও পরে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত অরিয়েন্টালিজম-এর লেখক আমেরিকা প্রবাসী ফিলিস্তিনি পণ্ডিত এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদকেই তাত্ত্বিক গুরু মনে করা হয়আরেকজনের নামও করা হয় তিনি হোমি কে ভাবাপরে আরো লেখকের কথা সামনে আসে, যেমন ফ্রানৎজ ফানো, এইমে সিজার, গায়ত্রী স্পিভাকসহ আরো অনেকেআপনি কার দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং কেন?

ফয়েজ আলম: চিনুয়া আচেবের থিংস ফল এপার্ট  উত্তরউপনিবেশি সাহিত্যের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিক কালের আগে থেকে বিকশিত একটি সমাজ ব্যবস্থা সাদাদের আগ্রাসনে কিভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং এ দুর্ভোগে পতিত হয় তার একটা দারুণ বয়ান তিনি হাজির করেছেন বইটাতে। এইটা বেরুনোর পর নাইজেরিয়ার সাহিত্যে যে প্রভাব পড়ে এবং ইতিবাচক বদল ঘটে অনেকে সেটিকে রেনেসাঁসের সাথে তুলনা করেন। অন্যান্য উপনিবেশিত দেশেও কিন্তু উপনিবেশ-বিরোধী সাহিত্য লেখা হয়েছে, এমনকি উপনিবেশ শুরু হওয়ার সাথে সাথে। ঈশ্বরগুপ্তের কোনো কোনো ছড়ায় ঠাট্টার মধ্যেও জড়িয়ে আছে উপনিবেশিতের দুর্বল মনের নীরব বেদনা আর প্রত্যাখ্যান। পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কিত কোনো কোনো লেখায় উপনিবেশের বিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ করেছেন নজরুল। সব উপনিবেশেই এগুলো হয়েছে। উপনিবেশ-বিরোধী বা উত্তরউপনিবেশি সাহিত্য বিচারে এগুলো যথাযথ গুরুত্বও পায়। এ সত্ত্বেও বলতে হয় সংস্কৃতি ও জ্ঞানকান্ডে উপনিবেশি প্রভাব মোচনের জন্য উত্তরউপনিবেশবাদ নামে যে জ্ঞানতাত্ত্বিক তৎপরতা তার শুরুটা আরো পরে, এডওয়ার্ড সাঈদের অরিয়েন্টালিজম বের হওয়ার পর। এর আগে এইমে সিজার এবং ফ্রান্ৎজ ফানো বেশ গুরুত্বপুর্ণ কাজ করেছেন। বিশেষত ফানো, দ্বারা থেকে সাঈদও নিয়েছেন বলে মনে করি আমি। কিন্তু সংগঠিত জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ হিসাবে উত্তরউপনিবেশবাদের সূচনা অরিয়েন্টালিজম-এর প্রণোদনাতে বলে মনে হয় আর, যতদূর জানি, এই অর্থে পরিভাষাটার ব্যবহারও এর পরে। এটি সুগঠিত রূপ পাওয়ার পর সিএলআর জেমস, এইমে সিজার, ফ্রানৎজ ফানো, এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, হোমি কে ভাবা এইসব চিন্তকদের নাম এক সারিতে এবং কালক্রমে উচ্চারিত হয়ে থাকে।

আমি ফ্রানৎজ ফানো এবং এডওয়ার্ড সাঈদকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। উত্তরউপনিবেশবাদ সম্পর্কে আমার যা লেখাজোকা ভাবনাচিন্তা সেখানে এই দুজনের চিন্তার ছাপ আছে। তার কারণটাও পরিষ্কার। অরিয়েন্টালিজম বইয়ে সাঈদ উপনিবেশী আগ্রাসনের জন্য উপযোগী সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক মনোভঙ্গির গোড়াটা দেখিয়ে দেন। তিনি দেখান যে পশ্চিমের মানুষ সেই আদিকাল থেকেই পুবকে নিজেদের থেকে ভিন্ন কিছু বা ‘আদার’ হিসাবে দেখেছে। নিজের বিপরীতে এই আদার বা ‘আন’-কে কল্পনা করেছে তার থেকে নিকৃষ্ট ও অপূর্ণ, আর নিজেকে  ভেবেছে উৎকৃষ্ট, পূর্ণাঙ্গ। সাঈদ  পশ্চিমের বহু গুরুত্বপূর্ণ রচনা ঘেঁটে দেখান এই মনোভাবই পশ্চিমের সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে কুড়ির শতক পর্যন্তও। প্রাচ্য নিকৃষ্ট এবং পশ্চিম উৎকৃষ্ট– এই মনোভাবের ওপর ভর করে কীভাবে পশ্চিমে বিশাল একগুচ্ছ রচনা বিকশিত হয় এবং ক্রমে তা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখার প্ররোচনা জোগায় পশ্চিমের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মনে, তার একটি অসামান্য বিশ্লেষণ পাওয়া যায় অরিয়েন্টালিজম গ্রন্থে।

অন্য দিকে, ফানো দেখান উপনিবেশি প্রশাসকরা কীভাবে স্থানীয়দের উপর দমন-নিপীড়ন চালিয়ে তাদের মনোজগতকে বিকৃত করে দেয় এবং সেখানে স্থায়ী করে দেয় হীনমন্যতার বোধ। এই হীনমন্যতার কারণে উপনিবেশ স্বাধীন হওয়ার পরও উপনিবেশিত মানুষেরা সাদাদের মত হওয়ার চেষ্টা করে। এইটিই উত্তরউপনিবেশিকতা বা উত্তরউপনিবেশি পরিস্থিতি। এডওয়ার্ড সাঈদ আর ফ্রান্ৎজ ফানোর লেখা উত্তরউপনিবেশী ভাবনার ভিত্। এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।

প্রশ্ন: অনেকে বলে থাকেন বাংলায় উত্তরউপনিবেশবাদ নিয়ে তেমন কাজ চোখে পড়ে নাআপনি কি মনে করেন?

ফয়েজ আলম: ‘বাংলা ভাষায় উত্তরউপনিবেশবাদ নিয়ে তেমন কাজ চোখে পড়ে না’ কথাটা সত্য না, আবার একেবারে মিথ্যাও বলা যাবে না। সে ব্যাখ্যায় যাচ্ছি। একুশ শতকের সূচনা থেকে আমিই প্রথম যতদূর সম্ভব বাংলাদেশের পটভূমিতে এর তাত্ত্বিক দিকটা নিয়ে লেখালেখি শুরু করি, এখনো করছি। এ নিয়ে আমার তিনটা বই বেরিয়েছ: ‘উত্তর-উপনিবেশী মন’ (২০০৬), ‘ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে’ (২০০৮), ‘বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব’ (২০১২)। এরপর বেশ কয়েকজন লেখক-অধ্যাপক এ নিয়ে কাজ করেছেন, করছেন, অনেকদিন থেকে। যেমন ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষ, অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, ফকরুল চৌধুরী, হুমায়ুন কবির, এরা। অনেক তরুণ এসে যুক্ত হয়েছেন আমাদের সাথে।  উত্তরউপনিবেশবাদের তাত্ত্বিক দিকটা নিয়ে ভালো কাজ হয়েছে, হচ্ছে, বলবো।

যেটা হয়নি, সেটি হলো সৃজনশীল লেখায় তার প্রতিফলন। থিংস ফল এপার্টের মতো না হোক, এই ধারার কাজ হওয়া দরকার ছিলো, তার শুরুটাও হয়নি। আমাদের কথাসাহিত্যে উত্তরউপনিবেশি দৃষ্টিভঙ্গির রচনা প্রায় বিরল বলা চলে। তবে কবিতায় নতুনধারার কাজ শুরু হয়েছে।  বিশ শতকের নব্বই এবং একুশ শতকের প্রথম দশকের বেশ কজন কবির কাজে, ভাবে এবং কাব্যভাষায় উপনিবেশবিরোধী বোধ জায়গা করে নিয়েছে। একে আমি উত্তরউপনিবেশী কাব্যরীতিই বলতে চাই। আমি নিজেও এ ধারারই একজন কবি, জনমানুষের মান কথ্য ভাষার উপরই গড়ে উঠেছে আমার কাব্যভাষা। নব্ব্ই দশকের কবি জহির হাসান ইংরেজি প্রভাবিত তিরিশি কাব্যভাষা প্রত্যাখ্যান করে লিখছেন শুরু থেকে। কবি পাবলো শাহি ও কবি মুজিব ইরম মধ্যযুগের সাহিত্য বিশেষত চর্যাপদ, বৈষ্ণব সাহিত্য ও পুঁথি থেকে গ্রহণ করে উপনিবেশের প্রভাব হতে বেরুনোর চেষ্টা করছেন। কবি ও কথাসাহিত্যিক আসমা সুলতানা শাপলাও মান কথ্যবাংলায় উত্তরউপনিবেশী মনোভঙ্গি নিয়ে এসেছেন কবিতায় । এ ছাড়া কবি ও অনুবাদক রাজিয়া সুলতানা, কবি আশরাফ হোসেন, ওয়াহিদ রুকন, কবি রুদ্র শায়ক, কবি লিটন মোহাম্মদসহ আরো অনেকের কবিতায় সচেতন উত্তরউপনিবেশি বোধ হাজির থাকছে। কিন্তু গল্পউপন্যাস বা নাটকে তেমন বিশেষ কাজ হয়নি। তত্ত্ব যখন আলোচনায় আসে সৃজনশীলতায় তার ছাপ পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আর উপনিবেশবিরোধী বা উত্তরউপনিবেশি সাহিত্য তো সারা পৃথিবীতেই একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিঘাত। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে তার প্রতিফলন ছাড়া জনমনে পৌঁছানো সম্ভব না। এমনকি শুধু সাহিত্য নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলবে না। ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজবিদ্যা সবজায়গায় তো উপনিবেশের প্রভাব রয়ে গেছে, ওসব জায়গাতেও কাজ করতে হবে। তো, অই ব্যাপক পরিসর এবং সৃজনশীলতার জায়গাটার কথা মনে রাখলে বলতে হয় উত্তরউপনিবেশি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুজনশীল ধারার লেখালেখির শুরুটার জন্য আমরা এখনো অপেক্ষায় আছি।

তবে কলিকাতায় এ নিয়ে কি কাজ হয়েছে সেটা অবশ্য আমার জানা নাই। না হয়ে থাকলে খুব বিস্মিত হবো, এ জন্য যে, গায়ত্রী চক্রবর্তী, দীপেশ চক্রবর্তী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান এইসব উত্তরউপনিবেশি তাত্ত্বিকেরা তো কলিকাতার মানুষ। ওখানে এই নিয়ে ব্যাপক কাজ হওয়ার আশা করাটাই স্বাভাবিক না?

প্রশ্ন: উত্তরউপনিবেশবাদ বা উত্তরাধুনিকতার ‘উত্তরকথাটা কি গোলমেলে মনে হয় না?

ফয়েজ আলম: প্রাথমিকভাবে ‘উত্তর’ শব্দটা দিয়ে পরের সময়টাকেই বোঝানো হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আর গোলমেলে মনে হওয়ার সুযোগ থাকে না। উত্তরাধুনিকতার বেলায় এই নিয়ে কোনো সমস্যা নাই। সেখানে উত্তর মানে পরের ব্যাপার নির্দেশ করা হয়। কিন্তু উত্তরউপনিবেশবাদের ‘উত্তর’ কেবল সময়ের দিক থেকে পরের বিষয় না, উপনিবেশবাদের সকল নেতিবাচক প্রভাব পিছনে ফেলে সামনে আগানোর বিষয়ও। এ তো গেল সরল একটা সমস্যার কথা। জটিলতা আছে আরেক জায়গায়। সেটি হচ্ছে উপনিবেশি যুগের সাহিত্য বা সামগ্রিক অর্থে চিন্তার কিছু প্রবণতাকেও আমি উত্তরউপনিবেশি হিসাবে চিহ্নিত করেছি এবং এই ধারণাটাকে আমি সমর্থনও করি। যেমন ঈশ্বরগুপ্তের ব্যঙ্গ কবিতায় উপনিবেশের প্রতি যে ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে সেটাকে আমি কি বলে চিহ্নিত করবো, যদি এ সময়ে চলমান আমাদের উপনিবেশি প্রভাব-বিরোধী তৎপরতাকে তার সিলসিলায় মিলাতে যাই? কিংবা নবীনচন্দ্র সেনের স্বাধীনতার আকঙ্ক্ষাকে বা নজরুলের বিদ্রোহকে? এসবই উপনিবেশ জারি থাকা অবস্থায় ঘটেছে। তাদের উপনিবেশবিরোধী মনোভঙ্গির প্রভাব কি আমাদের উপর পড়েনি? আমি মনে করি এগুলো উত্তরউপনিবেশি মনোভাব ও চিন্তা হিসাবেই চিহ্নিত হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে উত্তরউপনিবেশি শব্দবন্ধের ‘উত্তর’ কথাটার অর্থ দাঁড়ায় ‘প্রভাব-মুক্তি’, ‘প্রভাব ছাড়িয়ে’, ‘প্রভাব কাটিয়ে উঠা’। এই জায়গাটা গোলমেলে মনে হতেই পারে। অনেক বাংলা শব্দ আছে যেগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ মোদ্দা অর্থ ছেড়ে দিনে দিনে বেশ বিস্তারিত অর্থ গ্রহণ করেছে। উত্তরউপনিবেশি শব্দবন্ধের ‘উত্তর’ শব্দটাকেও আমরা পরিভাষা হিসাবে নিয়ে ব্যবহার করতে পারি।

 

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন উপনিবেশবাদের দ্বিত্বতাগুলো, মোটাদাগে এর নানা প্রবণতার ভেতরের অসারতাগুলো তুলে ধরার বিষয়টি উত্তরউপনিবেশবাদের তত্ত্ব কাজের পরিধি তৈরি করে দেয়?

ফয়েজ আলম: দ্বিত্বতা বলতে যদি দুইমুখি নৈতিকতা বা আদর্শের বিষয়টাকে বুঝিয়ে থাকো তাহলে বলবো হ্যাঁ, অবশ্যই তা উপনিবেশবাদের একটা দুর্বল জায়গা যেখানে উত্তরউপনিবেশবাদের কাজের পরিধি তৈরি হয়ে আছে। আমরা যদি সাঈদের বিশ্লেষণের সূত্র ধরে পশ্চিম-পুব দ্বৈতের বিপরীতে ভালো-মন্দ, উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট, যোগ্য-অযোগ্য, সভ্য-অসভ্য ধারণাগুলো বিবেচনায় নিই তাহলে দেখবো এই জাতীয় ধারণার পিছনে কার্যকর দৃষ্টি হলো পশ্চিমের দৃষ্টি, পশ্চিমের বিচার-বিবেচনা, পশ্চিমের যুক্তিবোধ। পশ্চিমের যুক্তিতে মনে হয়েছে, ভারতের ইতিহাস হলো দশ হাত বিশিষ্ট এক রাজার দশ হাজার বছরব্যাপী রাজত্বের ইতিহাস। অর্থাৎ পশ্চিমের বিবেচনায় ভারতের ইতিহাস হলো একরাশ মিথ্যা (কারণ দশ হাতের মানুষ হতে পারে না বা কোনো মানুষ দশ হাজার বছর বাঁচেও না)। এখন আমরা যদি সজাগ উত্তরউপনিবেশি বোধকে কেন্দ্র রেখে ভারতীয় দৃষ্টি দিয়ে দেখি তাহলে দেখবো পশ্চিমের অহঙ্কারী প-িতেরা পুরাণ আর ইতিহাসের পার্থক্যই বুঝতে পারেনি। দশহাতের রাজা আর তার দশ হাজার বছরের রাজত্বের পুরাণকাহিনীকে সে ইতিহাস বলে ভুল করেছে, আবার সেই ভুলের ভিত্তিতে ভারতের মানুষদের ইতিহাসবোধের মূল্যায়নও করেছে। দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পশ্চিমের চিন্তকদের ইতিহাস চিন্তার গোটা প্রক্রিয়াটাই হাস্যকর ভুলে ভরা।  এ রকম বহু ভুল ধারণা বা ছাঁচের উপর দাড়িয়ে আছে পশ্চিমের পুবসম্পর্কিত জ্ঞান ও সিদ্ধান্ত।

আরেকটা বিষয় হলো পশ্চিম নিজের জন্য যে মান নির্ধারণ করে, পুবের জন্য তা প্রযোজ্য মনে করে না। এ কারণেই কার্ল মার্কস ভারতে বৃটিশ উপনিবেশের কোনো সমালোচনা করেননি, বরং তার মনে হয়েছে প্রাচীনপন্থী এ জাতিকে ভেঙ্গেচুরে জাগানোর বিষয়ে বৃটিশের দায়িত্ব রয়েছে। শুধু মার্কস কেন, ইউরোপের অনেক তথাকথিত উদারতাবাদী চিন্তক ইউরোপের মানুষের জন্য এক রকম আর ভারতীয়দের জন্য আরেক রকম ব্যবস্থার কথা বলে গেছেন। এইগুলাও উত্তরউপনিবেশবাদের কাজের জায়গা। 

প্রশ্ন: উপনিবেশবাদ স্থানিকতার বিরুদ্ধে, বৈচিত্রের বিরুদ্ধেএই মহূর্তে গোলকায়নের নামে, নব্য উদারতাবাদের নামে, মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে নতুন উপবিনেবশবাদ চলছেআপনি কিভাবে দেখছেন এই উপনিবেশবাদকে? এখানে উত্তরউপনিবেশবাদ কিভাবে লড়বে?

ফয়েজ আলম: উত্তরউপনিবেশবাদ স্থানিকতা বা বৈচিত্রের বিরুদ্ধে না। বরং স্থানিক ভিত্তির উপর দাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতার সাথে সমন্বয় করতে আগ্রহী, বৈচিত্রের সন্ধানে যেতে উৎসুক। নিজের বাড়িঘর ফেলে আন্তর্জাতিক পরিসরে গিয়ে ভুঁইফোড় হয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ আছে কি? বৈচিত্র্য তো মানুষের চিরায়ত আকা্ঙ্ক্ষা। উত্তরউপনিবেশবাদ বৈচিত্রের বিরোধী হতে যাবে কেন। প্রশ্ন হচ্ছে বৈচিত্র্যের নামে ইউরোপ তার নিজের জিনিষ তোমাকে গছিয়ে দিতে এলে তোমার কি তা যাচাই করে গ্রহণ করা উচিত না? তো, যাচাইয়ের ভিত্তিটা কি হবে? আমি মনে করি উত্তরউপনিবেশি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই ভিত্তিমূল গড়নের কাজটা আগে শেষ হওয়া দরকার, যাতে সেই ভিত্তির উপর দাড়িয়ে আমরাও আন্তর্জাতিকতা, বৈচিত্র্য, উদারতা ইত্যাদি বুলি জোরে জোরে আওড়াতে পারি। দেখ, গোলকায়ন, নব্যউদারতাবাদ, মুক্ত অর্থনীতি— কত নাম, হ্যাঁ! কিন্তু ওগুলো আছেটা কোথায়? বিশ্বায়ন বলতে কিসের বিশ্বায়ন, প্রভাবশালী দেশগুলোর পণ্যের? সেইটাও তো কতভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, চীনা পণ্যের আমেরিকায় প্রবেশের বেলায় কতকিছু ঘটছে, বারবার । বাংলাদেশের পণ্য ইউরোপে ঢুকতে হলে ‘মান’ পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। পরীক্ষাটাও ইউরোপেরই। ট্যারিফের বাধা তো আছেই। কোথাও কোনোভাবে আটকানো না গেলে ‘মান’-এন অস্ত্র আছে। তাহলে গোলকায়ন ব্যাপারটা আসলে কি? আমি কি পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় গিয়ে বসবাস করতে পারবো, ব্যবসা বা চাকুরি করতে পারবো? না, পারবো না। আসলে গোলকায়ন, মুক্ত অর্থনীতি এগুলো নয়াউপনিবেশি হাতিয়ার, প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। গোলকায়ন মানে ‘প্রভাবশালী দেশের পণ্য-সেবা-সংস্কৃতির পুবমুখি গোলকায়ন’। এই রেখায় নয়াউপনিবেশি আগ্রাসন সারা পৃথিবী জুড়ে সক্রিয়। এ জন্য আর সামরিক বাহিনীর দখলাভিযানের প্রয়োজন হয় না। প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর মানুষের ভাবনাচিন্তায় ও চর্চায় টিকে থাকা উপনিবেশি প্রভাবের সওয়ার হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভাবাধিপত্য–সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আর এর মাধ্যম হলো ফানোর চিহ্নিত দেশীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা বড় অংশ। এরা কথায় কথায় দেশের সমস্ত কিছুকে হাসিঠাট্টার ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিয়ে, তাকিয়ে থাকে পশ্চিমের দিকে, খানিকটা উচ্ছিষ্টের জন্য। এদের মাধ্যমেই সংস্কৃতি ও ভাবের আধিপত্য শেষে রূপান্তরিত হচ্ছে অর্থনৈতিক আগ্রাসনে। কেউ প্রতিবাদ করছে না, আন্দোলন হচ্ছে না। এ অবস্থা ভয়াবহ।

উত্তরউপনিবেশবাদ নয়া উপনিবেশি আগ্রাসনের স্বরূপ তুলে ধরে এর বিরুদ্ধে কথা বলে। মনোজাগতিক আধিপত্য কিভাবে আর্থ-রাজনৈতিক আধিপত্যের সদর রাস্তা তৈরি করে দেয় সেইটা প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। এখানেই উত্তরউপনিবেশবাদের আসল কাজ। উত্তরউপনিবেশবাদ দেশীয় সংস্কৃতিকে উচ্চমূল্যে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আর কে না জানে এ কালে মানুষের ভোগের ধরনের উপর সংস্কৃতির প্রভাব অলংঘণীয়। কি কাপড় পড়বে, কোন স্টাইল করবে, কোন জুতা বা চশমা, সেই রুচিতে তো পশ্চিমের সিনেমারও একটা ভূমিকা থাকছে। উত্তরউপনিবেশবাদ যদি দেশজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের মমত্ব জাগিয়ে তুলতে পারে তাহলে তার ভোগের ধরনও তো পরিবর্তন হবে। নিজস্বতার মধ্যেই খুঁজে পাবে সামাজিক মর্যাদার পরিসর। কাজেই গোলকায়নের নামে ‘পণ-সেবা-রুচির পুবমুখি গোলকায়ন’ প্রতিরোধ করার কাজে উত্তরউপনিবেশবাদ হয়ে উঠতে পারে শক্ত একটা হাতিয়ার। 

প্রশ্ন: পুব যে পশ্চিমের রেখে যাওয়া উপনিবেশবাদ আত্মীকৃত করে নিজেই উপনিবেশ সেজে বসে আছে তার কি হবে?

ফয়েজ আলম: এই ভয়াবহ অবস্থার কথাটাই ফানো বলে গেছেন বহু বছর আগে। উপনিবেশ চলে যাবে, কিন্তু দেশীয় সুবিধাভোগীদের মধ্যে উপনিবেশী প্রভুদের অনুকারী তৈরি করে রেখে যাবে। তারা এ দেশকে তাদের নিজস্ব উপনিবেশে পরিণত করবে। আর সাধারণ মানুষ যেহেতু উপনিবেশের জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রভাবে এখনো আচ্ছন্ন। তাই এদের বিরুদ্ধে বাস্তবে তেমন প্রতিরোধও গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। আমার ‘রাইতের আগে একটা গান’ কাব্যগ্রন্থের উপনিবেশের কায়াবদল’ কবিতায় এ অবস্থার একটা কাব্যিক প্রকাশ আছে। ওখানে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি উপনিবেশক শক্তি বিদায় নেয়ার পরও কিভাবে উপনিবেশের অনেক কিছুই কি করে বহাল থেকে যাচ্ছে। তুমি প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর অবস্থা দেখ। মনে হবে ফানো যেন কোনো উপায়ে এ কালে এসে সব দেখেশুনে পিছিয়ে গিয়ে লিখে গেছেন কি ঘটবে এ কালে। উত্তরউপনিবেশবাদ এই গোটা অবস্থাটার বিরুদ্ধে এক বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের নাম। 

প্রশ্ন: ইংরেজি ভাষাকে ভারতীয় নানা ভাষায় আকীর্ণ করে যে খিচুড়ি ইংরেজি তৈরি হয়েছিলো, তা ছিলো এক ভাষিক প্রতিরোধের সূত্রপাতনজরুলের বিদ্রোহীতে ছিলো কবিতার অস্ত্র দিয়ে, হিন্দু-মুসলমানের ইতিহাস-মিথ থেকে শক্তি নিয়ে উপনিবেশের অহংকার বিভেদকামী চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোআজো কি বাংলার উত্তরউপনিবেশবাদ সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, নাকি পরিবর্তন এসেছে?

ফয়েজ আলম: উত্তরউপনিবেশবাদ সে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না। একটু আগে আমি বলেছিও উপনিবেশ যুগে উপনিবেশ-বিরোধিতা বিভিন্ন সমাজেই ঘটেছে, স্থানিক ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে। এগুলো অনেকটাই বিচ্ছিন্ন এবং ব্যক্তিক প্রয়াস হিসাবে মূল্যবান। কিন্তু পরবর্তীতে সংগঠিত তাত্ত্বিক রূপ পাওয়া উত্তরউপনিবেশবাদ একটা জ্ঞানভাষ্য হিসাবে অনেক বিস্তারিত এবং খুবই সক্রিয় আর প্রভাবক। এর সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক পাল্টা আক্রমণ, বিউপনিবেশনমুখি তৎপরতাগুলোই বেশি কার্যকর। উপনিবেশকালের ব্যক্তিক বিদ্রোহ বা ক্ষোভে এই সুক্ষ্ণ দিকটা ছিলো না। উত্তরউপনিবেশবাদ এখন কেবল সাহিত্যের বিষয় নয়, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, সংস্কৃতিসহ বহু বিষয়েরই চিন্তনভঙ্গি হিসাবে ছড়িয়ে পড়ছে।

প্রশ্ন: উত্তরউপনিবেশবাদ একটা আয়না তুলে ধরে আমাদের সামনেসে আয়নাটা দেখতে চাইবে না ক্ষমতা, রাজনীতি উপনিবেশী মডেলে চলা সব প্রতিষ্ঠানসেই আয়নায় দেখবে আমাদের সাহিত্যিক-শিল্পীরা, সংস্কৃতিকর্মীরা, পরিবর্তনকামী তরুণেরাকিন্তু কীভাবে দেখা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

ফয়েজ আলম: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, নিজেকে কীভাবে দেখা উচিত উত্তরউপনিবেশি আয়নায়। একটু আগে খানিকটা বলেছি অবশ্য। উপনিবেশের প্রভাবের জায়গাগুলো এখন আমরা চিহ্নিত করতে পারি। প্রাক-উপনিবেশি ঐতিহ্যের ইতিবাদী প্রবণতাগুলোকে আমরা ভিত্তি হিসাবে ধরতে আগ্রহী। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ছিলো, রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিলো, উৎপাদন ব্যবস্থা ছিলো। আমরা সেই সব ব্যবস্থার ইতিবাচক প্রবণতাগুলোকে গ্রহণযোগ্য মনে করবো। যেখানে দাঁড়িয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করা যায়। উপনিবেশ আমাদের ঐতিহ্যগত মনোভাব, জ্ঞান, প্রজ্ঞার যা কিছু ধ্বংস করেছে তার পুনর্গঠন জরুরি। এইটাই হবে বিউপনিবেশনের (ডিকলোনাইজেশন) ভিত্তি। উপনিবেশি জ্ঞান ও সংস্কৃতির আধিপত্য ছুঁড়ে ফেলতে পারলে অর্জিত মুক্তবুদ্ধির প্ররোচণাতেই আমরা ঠিক করে নিতে পারব কোনদিকে আমাদের যাওয়া উচিত।

প্রশ্ন: মান কথ্য ভাষা আর প্রমিত ভাষার মধ্যে লড়াইটা কোথায়?

ফয়েজ আলম: কথাটা আসলে মান কথ্যবাংলা। এখানে লড়াইয়ের কোনো বিষয় নাই। প্রমিত বাংলার গোড়াটা তো তুমি জানো। নগরায়ন ও ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের সূত্রে নদীয়া শান্তিপুর ও আশপাশের এলাকার মানুষের কলিকাতা শহরে যাতায়াত-স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে সে অঞ্চলের কথ্য বুলি কলিকাতাতেও প্রধান কথ্য ভাষা হয়ে উঠেছিলো। উনিশ শতকের সূচনায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোগে বাংলা ভাষার মূল ধারা বাদ দিয়ে বিপুল সংস্কৃত শব্দবহুল মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলা চালু করা হয়। প্রায় একশ বছর ধরে তা ব্যবহৃত হয়েছে। সে ভাষার প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব কিন্তু অনেকের মধ্যে তলে তলে জমা হচ্ছিলো। গত শতকের গোড়ায় প্রমথ চৌধুরী কলিকাতা শহর এবং আশপাশের কথ্যরীতি অর্থাৎ নদীয়া শান্তিপুরের কথ্যরীতির আদলে লেখ্যরীতি প্রচলিত করার আন্দোলন শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ এসে যুক্ত হন তার সাথে। এর আগেই রবীন্দ্রনাথ তার লেখায় মাঝে মধ্যে কথ্য বাকভঙ্গি ব্যবহার করে আসছিলেন। তো, রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট বটগাছ, সবুজপত্র আর নিজের প্রবল প্রাণশক্তিতে বলীয়ান প্রমথ চৌধুরীর চেষ্টা সফল হলো। নদীয়া-শান্তিপুরের কথ্যরীতি লেখন রীতি হিসাবে মেনে নিল সবাই।

ঐ সময়ই কিন্তু ঢাকার লোকেরা প্রতিবাদ করেছিলো যে, নদীয়ার ভাষা কেন বাংলাদেশের লেখন রীতি হবে। বাংলাদেশের মুখের ভাষা কেন লেখার ভাষা হবে না। প্রমথ চৌধুরীর ঐ সময়ের লেখায় সে বিতর্কের বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যাই হোক, বাংলাদেশের প্রতিবাদ ধোপে টিকে নাই। এর ফলে নদীয়া-শান্তিপুরের  যে-কথ্যভাষা লেখার রীতি হিসাবে গৃহীত হলো তা কিন্তু এখনো বাংলাদেশের মানুষের কাছে রীতিমত কসরত করে শেখার বিষয় হয়ে আছে। এই একশ  বছর পরেও বাংলাদেশের শতকরা এক ভাগ মানুষও এ ভাষায় কথা বলে না। কিন্তু লিখে এ ভাষায়। প্রায় প্রতিটা বাচ্চাকে স্কুলে এসে এ ভাষার উচ্চারণভঙ্গি থেকে শুরু করে অনেক কিছু রপ্ত করতে হয়।

অন্যদিকে, মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলার আগে ৭/৮ শ বছর ধরে যে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা হতো তা ছিলো বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষার আদলে গড়ে উঠা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই ভাষাকেই বলেছেন বিষয়ী লোকের ভাষা। এবং উল্লেখ করেছেন এই ভাষাতেই চিঠিপত্র, পাঁচালি, গান ইত্যাদি লেখা হতো আর সাধারণ মানুষ কথাও বলতো এই ভাষায়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জোরে মৃত্যুঞ্জয়ী সংস্কৃতানুযায়ী বাংলা (পরিভাষাটা বঙ্কিমচন্দ্রের) চালু হওয়ার পর বটতলার রচনা, পুঁথি, পাচালি, গান ইত্যাদি আর বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে সেই ভাষা টিকে থাকে এবং কালক্রমে বিকশিত হয়ে আজকের বাংলাদেশের মান কথ্যবাংলার রূপ পায়। এটি বাংলা ভাষার মূলধারা। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সারাদিন এই ভাষায় কথা বলে, এই ভাষায় চিন্তা করে, কল্পনা করে, স্বপ্ন দেখে—  এই ভাষার মধ্যেই সে বাস করে। কিন্তু লেখার সময় ভিন্ন এক ভাষার দ্বারস্থ হতে হয় তাকে। ফলে তার প্রকাশ হয়ে উঠে অনেকটাই কৃত্রিম, আড়ষ্ট। সে ভাষায় মনের ভাব পুরাপুরি উঠে আসে না। আমরা মনে করি বাংলাদেশের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষায় লিখলে তার প্রকাশ হবে অনেক সহজ, আবেগময়, চিন্তার অনেক কাছাকাছি, তাতে তার প্রতিদিনের জীবনের ছাপ থাকবে পরিষ্কার। এ জন্যই আমরা বলছি বাংলাদেশের মানুষের লেখার ভাষা হওয়া উচিত মান কথ্যবাংলা।

মান কথ্যবাংলা কোনো আঞ্চলিক ভাষা না। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ যখন এক সাথে হয় তখন বাংলা ভাষার সর্বাঞ্চলীয় একটা কথ্যরীতিতে কথা বলে সবাই। একটু আগেই উল্লেখ করেছি বাংলা ভাষার মূল ধারাটিই মুখে মুখে বিকশিত হয়ে এই কথ্য রূপ নিয়েছে। এটিই হওয়া উচিত বাংলাদেশের লেখন রীতি। কলিকাতার মানুষের কথ্য ভাষা যেহেতু বর্তমানে প্রচলিত প্রমিতের কাছাকাছি তাই কলিকাতার লেখন রীতি প্রমিতই থাকা দরকার, যাতে ওখানেও মুখের ভাষা আর লেখার ভাষায় ব্যবধান খুব বেশি না হয়। কাজেই প্রমিত আর মান কথ্যবাংলার লড়াই যদি লেগেই যাই তাহলে বুঝতে হবে এটা একটা অদরকারী লড়াই,  কোনো এক পক্ষ হয়তো ইচ্ছে করেই লাগিয়ে দিয়েছে।     

প্রশ্ন: আজকাল দুই বাংলাতেই দেখছি শব্দকে ধর্মের রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছেন অনেকেএটা হিন্দু শব্দ এটা মুসলিম শব্দ এমন তর্কও দেখা যায়উত্তরউপনিবেশবাদের ভুল ব্যাখ্যা ভুল জ্ঞানের জন্য এগুলো হচ্ছে, নাকি শব্দ আসলেই ধর্মকে প্রতিনিধিত্ব করে?

ফয়েজ আলম: এর সাথে উত্তরউপনিবেশবাদের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে করি না। বাংলাদেশের পটভূমিতে উত্তরউপনিবেশি দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলা ও বাঙালিই চিন্তার ভিত্। ইসলাম, সনাতন হিন্দু ধর্ম কিংবা বৌদ্ধ বাঙালিরই ধর্ম।  উত্তরউপনিবেশবাদে সকল ধর্মেরই জায়গা আছে। এমন কি উপনিবেশের সূত্রে গড়ে উঠা খ্রিস্টীয় জনগোষ্ঠীও বাঙালি। তাহলে শব্দকে ধর্মের রঙে রাঙানোর রোখটা কোত্থেকে এলো?

এ জন্য আমাদেরকে একটু পিছনে যেতে হবে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোগে সংস্কৃতানুযায়ী বাংলা তৈরি করার পর মানুষ রাতারাতি তা মেনে নেয়নি। ১৮২৫-৩০ সালের সংবাপত্রের বিভিন্ন খবরেও মূলধারার বাংলা লেখন রীতি চোখে পড়ে। এই নিয়ে বিতর্ক চলছিলো তখন পুরাদমে। বিতর্কের মূল কথা ছিলো বাংলায় মিশে যাওয়া আরবি-ফারসি শব্দ বাদ দিতে হবে, কারণ এগুলো ‘মুসলমানী’, ‘যবন’, ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দ। শব্দকে ধর্মের রঙে রাঙানোর সূচনা ঐখানে। এই বিতর্কে সংস্কৃতানুযায়ীদের জয় হওয়ার কারণে লেখনরীতি থেকে প্রায় সব আরবি ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে বিকল্প সংস্কৃত শব্দ আমদানি করা হয়। বাংলায় আত্মীকৃত আরবি ফারসি শব্দ বাদ পড়ায়  এ নিয়ে ক্ষোভ-তর্কও শেষ হয়। এক সময় শব্দকে ধর্মের রঙে রাঙানোর বিষয়টা সবাই ভুলে যায়।

পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলাদেশে একদল লেখক নতুন করে এ বিতর্ক সামনে নিয়ে আসেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বসে সংস্কৃত পণ্ডিতরা বাংলা ভাষায় আত্মীকৃত আরবী ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে যেসব সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেন ঐ লেখকগোষ্ঠী। কেউ কেউ এগুলোকে হিন্দু শব্দ হিসাবে চিহ্নিত করে সেগুলো বর্জন করে আবার পুরানা আরবি ফারসি শব্দ ফিরিয়ে আনার তদবিরও করেছিলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সহজে আরবি-ফারসি শব্দ বাদ দেয়া সম্ভব হলেও, বাংলাদেশের মানুষের উদারনৈতিক দৃ্ষ্টিভঙ্গির কারণে সংস্কৃত শব্দ বাদ দিয়ে আবার আরবি-ফারসি শব্দ বহালের দাবী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কাজেই শব্দকে ধর্মের রঙে রাঙানোর সূচনা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে, এবং অবশ্যই ধর্মীয় আবেগের তাড়ণনতেই সেটা ঘটেছিলো। এর সাথে উত্তরউপনিবেশবাদী চিন্তভাবনার কোনো সম্পর্ক নাই।

কিছুদিন থেকে বাংলাদেশের অনেক কবি সাহিত্যিক কথ্যরীতির নানা প্রবণতা লেখায় নিয়ে আসছেন। বাংলাদেশের মানুষের কথ্যরীতিতে তার প্রতিদিনের জীবনযাপনের অনেক চিহ্ন থেকে যায়। গ্রামের অনেক মুসলমান মানুষ ‘অপরাহ্ন’ বা ‘বিকেল’ বলে না, বলে ‘আসরের ওয়াক্ত’। আমার হিন্দু বন্ধুরা বলতো ’মা কালীর দিব্যি কইতাছি, বিশ্বাস কর’।  তখন আমরা হয়তো বলতাম, ‘আল্লাহর কসম, মিছা কথা না’। এই যে ‘মা কালীর দিব্যি’, ‘আল্লার কসম’, ‘আসরের ওয়াক্ত’ মুখের এইসব কথা লেখায় আসার পর আমাদের এখানে অনেকে ‘আল্লার কসম’ বা ‘আসরের ওয়াক্ত’কে ইসলাম ধর্মীয় শব্দ হিসাবে চিহ্নিত করছেন। কলিকাতার লোকেরা তা করছে কি না আমি জানি না, কিন্তু ঢাকার কিছু কিছু লোক সেটা করছে। চিন্তার দিক থেকে এদেরকে আমি চরম মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল হিসাবেই জানি, ব্যক্তিস্বাধীনতার ঘোরতর শত্রু মনে করি। আমি মনে করি না ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ হিন্দু শব্দ, যদিও তার উৎস হিন্দু পুরাণ, তেমনি এও মনে করি না ‘আসরের ওয়াক্ত’ মুসলিম শব্দ যদিও নামাজের সময় বিভাজন থেকে এটি এসেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ব্যক্তিটি ‘আসরের ওয়াক্ত’ কথাটা ব্যবহার করে সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ। ভাষা ব্যবহারে সে স্বাধীন। তাকে জোর করে ‘অপরাহ্ন’ বা ‘বিকেল’ শিখানো প্রায় নাৎসীজিমের পর্যায়ের কাজ। যারা এসব করছে এরা চরম প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ। কারো ওপর যে কোনো ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই নামও তো উত্তরউপনিবেশবাদ। শব্দকে ধর্মের রঙে রাঙানো প্রতিক্রিয়াশীলদের কাজ। এর সাথে উত্তরউপনিবেশবাদের সম্পর্ক নাই।

প্রশ্ন: পৃথিবীতে ভাষা আছে হাজারের বেশিমাত্র ২৩টি ভাষাতেই কথা বলে অর্ধেকের বেশি মানুষবিলুপ্তির পথে আছে পৃথিবীর ২৪ হাজার ভাষামান কথ্য ভাষা তো তাহলে সাত হাজার ভাষাই, নাকি?

ফয়েজ আলম: না, মান কথ্যবাংলা তো ঐ ২৩টা ভাষার (তোমার দেয়া তথ্য অনুযায়ী) একটা। বাংলাদেশের লোকসংখ্যা কুড়ি কোটি হলে অন্তত ১৫ কোটি মানুষ অনিয়মিত কিন্তু স্বতস্ফূর্তভাবে এই ভাষা ব্যবহার করে, যখন বিভিন্ন অঞ্চলের লোক একত্রিত হয়। বাকী পাঁচ কোটির মধ্যে হয়তো সাড়ে চার কোটি মানুষ সার্বক্ষণিক আঞ্চলিক ভাষায় কথা কয়। কেতাবী প্রমিত ভাষায় ৫০ লক্ষ মানুষ কথা বলে কি না সন্দেহ আছে। এই সব বৈচিত্র নিয়ে যে বাংলা ভাষা সেটিই ২৩ ভাষার একটা। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে এইসব বাকবৈচিত্রের মধ্যে মান কথ্যবাংলায় কথা বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এটিই এখনো মূলধারার বাংলা ভাষা।

প্রশ্ন: পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কথা বলা হয় মান্দারিন চীনা ভাষায়যদি ধরি একজন মান্দারিন মান কথ্যভাষায় সাহিত্য রচনা করলো আমি যার কিছুই বুঝি না, কিংবা ‘রেংমিটচ্যমানকথ্য ভাষায় কিছু লিখলোবর্তমান ভাষা মোট ছয়জন লোক বেঁচে আছেনএর মধ্যে একজন নারী, পাঁচজন পুরুষতাদের মৃত্যু হলে রেংমিটচ্য  ভাষাটিরও মৃত্যু ঘটবেপৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে একটি ভাষা একটি সংস্কৃতিতো আমরা সেই ভাষার কিছুই না জানা ফলে  সেই ভাষার কিছুই নিতে পারবো নাকিন্তু প্রমিত বাংলায় লেখা হলো তা সবার জন্য সহজ হতো না কি?

ফয়েজ আলম: বাংলাদেশের যে কোনে গ্রামে বঙ্কিমের বা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ উপন্যাসের একটা পৃষ্ঠা নিয়ে গিয়ে সাধারণ স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষেকে পড়ে শোনাও তাহলে হাতেনাতে প্রমাণ ভাবে সেই পৃষ্ঠার ভাষা অর্থাৎ কেতাবি প্রমিত বাংলাই হলো ঐ লোকটার কাছে ‘রেংমিটচ্য’, যার কিছুই সে বুঝবে না। আর পাশাপাশি মান কথ্যবাংলায় লেখা একটা পৃষ্ঠা পড়ে দেখ, সে তার নিজের মুখের ভাষার মতই বুঝবে। আসলে আমরা অন্ধের মতো আচরণ করছি, আমাদের জনগোষ্ঠীর সিংহভাগকে আমাদের লেখন রীতির বোধগম্যতার ও ব্যবহারের বাইরে রাখছি। এইটা একটা ক্ষমতাধর গোষ্ঠী কর্তৃক আরেকটা দুর্বল গোষ্ঠীর উপর জোর করে নিজেদের মত ও অভ্যাস চাপিয়ে দেয়ার শামিল। স্রেফ গোয়ারতুমি, প্রচণ্ড অন্যায়।

প্রশ্ন: দুই বাংলাতেই অনেক আঞ্চলিক মান কথ্য ভাষা পাওয়া যায় যা অঞ্চলভেদে বোঝা খুব কঠিনসেই ভাষাকে সকলের কাছে সহজলভ্য করতেই সাহিত্য বা বলার  বা কথা বলার জন্য একটা নির্দিষ্ট ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করছিসবাই মান কথ্যভাষা ব্যবহারের বেলায় ময়মনসিংহের মানুষ বরিশালের ভাষা বুঝবে না, পুরুলিয়ার মানুষ কামতাপুরি ভাষা বুঝবে নাতাহলে মান কথ্যভাষাকে কেন প্রাধান্য দেয়া?

ফয়েজ আলম: আবার মনে হয় আমরা একটু ভুল করছি। মান কথ্যবাংলা আর আঞ্চলিক কথ্যরীতি এক না। অঞ্চলভেদে ক্রিয়া ও শব্দের রূপ বদলে যায়। কিন্তু মান কথ্যবাংলা একটা সর্বাঞ্চলীয় কথ্যরূপ। আমি একটু বিস্তারিত বলি যাতে সহজে বোঝা যায়। সেই মধ্যযুগ থেকেই নগরায়নের সুত্রে বিভিন্ন অঞ্চলের লোক বড় বড় কেন্দ্র্রগুলোতে একসাথে হতো। এখনো যেমন বড় বড় শহর ঢাকা, সিলেট, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল প্রভৃতি নগরকেন্দ্রে বিভিন্ন কারণে নানা এলাকার মানুষ এসে বসবাস করে বা কর্ম উপলক্ষে একত্রিত হয়। সেইখানে তারা প্রতিদিন কথা বলে, ভাব বিনিময় করে। এই যে ভাব বিনিময় হচ্ছে সেটা কিন্তু কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় হচ্ছে না, আবার তথাকথিত প্রমিত বাংলা বা কেতাবী বাংলাতেও হচ্ছে না। বরং ভাব বিনিময়ের একটা মান কথ্যরূপ ব্যবহৃত হচ্ছে।

এই ভাষাটা কথ্যরীতি হিসাবে বহু আগে থেকেই চলে আসছে। এইটা হচ্ছে সাধারণ শিক্ষিত বাঙালির ভাষা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। তিনি লিখেছেন আঠারো শতকের শেষে ও উনিশ শতকের শুরুতে তিন ধরনের বাংলা প্রচলিত ছিল। আদালতের ভাষা, দুই সংস্কৃত ব্যবসায়ীদের ভাষা, আর বিষয়ী লোকের ভাষা। বিষয়ী লোকের ভাষাই মুখে মুখে বিকশিত হয়ে এই রূপ ধারণ করেছে। আঞ্চলিক কথ্যরূপগুলোর বিভিন্ন শব্দ ও বাকভঙ্গি এর সাথে এসে মিশেছে। এভাবেই মান কথ্যবাংলার বিকাশ ও প্রবহমান ধারা চলে আসছে। উনিশ শতকের সূচনায় মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলার প্রচলন এবং পরে কুড়ি শতকের শুরুর দিকে নদীয়া-শান্তিপুরের কথ্যভাষাকে প্রমিত চলিত রীতি হিসাবে চালু করায় গোটা পশ্চিবঙ্গের মানুষের ভাষা বদলে যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক নির্দেশিত ‘বিষয়ী লোকের ভাষা’ টিকে থাকে কেবল বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষার রূপে।

এইটাই মান কথ্যবাংলা, বাংলাদেশের অধিকাংশ সাধারণ শিক্ষিত মানুষের ভাষা। অনেকটা লিঙ্গুয়া ফ্রান্কার মত। এই যে তুমি বললে ‘ভাষাকে সকলের কাছে সহজলভ্য অর্থাৎ সহজে বোধযোগ্য করতেই সাহিত্য বা বলার  বা কথা বলার জন্য একটা নির্দিষ্ট ভাষা বা শব্দ ব্যবহার করা দরকার’, সেই সকলের কাছে সহজবোধ ভাষাটার নামই মান কথ্যবাংলা। এইটাকে আঞ্চলিক রীতির সাথে গুলিয়ে ফেললে বিপদ।

আজকাল বড় বড় শহরসহ প্রতিটি ছোট বড় শহর অঞ্চল, এবং সাংস্কৃতিকভাবে সক্রিয় অন্যান্য কেন্দ্রগুলোতেও শিক্ষিত বা সাংস্কৃতিভাবে সচেতন মানুষ এ ভাষাতেই কথা বলে। প্রতিদিনের ব্যবহার্য ভাষা বলে এর প্রকাশ ক্ষমতা অনেক বেশি। এ ভাষায় যারা লিখছেন তারা মুখে মুখে যে শব্দ/শব্দবন্ধে সারাদিন তার মনের ভাব প্রকাশ করছেন লেখার সময় সে শব্দই ব্যবহার করছেন। আবার যিনি শুনছেন তার কাছেও এইসব শব্দ, বাকভঙ্গি অতিপরিচিত। তার বোধ, অনুভুতি, বুদ্ধি এইসব শব্দরাজিকে বহুকাল ধরে চিনে। এইটা এই ভাষার বড় একটা সুবিধা।

প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা ও আকুতি থেকে ভাষার সূচনা ও বিকাশ। তাই কোনো সমাজে যে-ভাষা বিকশিত হয়েছে সেই ভাষাই সেই সমাজের ভাব প্রকাশের সবচেয়ে উপযোগী। প্রকাশের উপযোগিতা নিয়েই তো সেই ভাষাটা বিকশিত হয়েছে। এর বাইরের যেকোন ভাষা সেখানে আড়ষ্ট মনে হবে। মান কথ্যবাংলা বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষা রূপে। এখানে কৃত্রিমতা নাই। প্রকৃতি অর্থাৎ এই মাটি, পানি, বাতাস, আবহাওয়া, পরিবেশ আবার ভূগোল, সমাজ, ভাবচর্চা, ধর্মবোধ, সাংস্কৃতিক বোধ–সবকিছু নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে জীবন তার প্রকাশের জন্যই এই ভাষার বিকাশ। কাজেই এ জীবনকে প্রকাশ করার জন্য আর কোনো ভাষা এর চেয়ে বেশি উপযোগী হতে পারে না।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত