Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

মর্ত্যের রোশনাই

Reading Time: 4 minutes

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ঘটনাটা সন্ধ্যা নামার আগ মুহূর্তের। বাড়ির উঠানলাগোয়া উত্তরদিকের নারিকেল গাছগুলোর উপর দিয়ে আচমকা শত শত বাদুড় পাড়া অতিক্রম করে।

দৃশ্যটা দেখে কিশোর বয়সী একটা ছেলে অনেকক্ষণ ধরে উল্লাস প্রকাশ করে। এই ফাঁকে নারিকেল গাছের পাতাগুলো সহসা দুলে ওঠে। কচি ডাবে বেখেয়ালে গুঁতাগুতি করতে থাকা বাচ্চা বয়সী একটা কাঠবিড়ালি এক লাফে আড়াল হয়ে যায়। 

জিন্নাত আলী দীর্ঘ সময় ধরে ঊর্ধ্বমুখী করে রাখা ঘাড়টা সোজা করার পরও অস্বস্তি কাটাতে পারে না। বিদঘুটে শব্দ করে নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে শক্তভাবে চেপে ধরে। নাকের ফুটোগুলো বড় করে এক ঝটকায় কিছু বাতাস চালান করে দেয়। পুনরায় মরা বাতাস বের করে আনে। হৃৎপিণ্ডের এই গড়মিল বশে আনতে আরও কয়টা লম্বা নিঃশ্বাস ভেতরবাইরে আনা নেওয়া করলে তার আরাম লাগে। তারপর তার দৃষ্টি মেরাজের মা বার্ধক্যে কুঁচকানো শরীরটা অনুসরণ করে। অনতিদূরে বাড়িঘাটার পাশঘেঁষা খোলা জায়গায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে টাঙানো হয়েছে লম্বা রশি। সহরাবানু ডান হাত দিয়ে রশিতে ঝুলানো শুকনা কাপড়গুলো নামিয়ে নিয়ে একে একে বাম হাতে আঁজা করে রাখে। খেয়াল করলে দেখা যায় মুখটা ক্রমাগত কাউকে উদ্দেশ্য করে ঝাপটা মারছে। পঙ্গু পুত্রের রূপবতী বউয়ের শুকাতে দেওয়া একটি কাপড় মাটিতে পড়ে যায়। তখন ঘ্যানঘ্যান করতে থাকা মুখটি আরও বেশি কঠিন হয়ে ওঠে। সরাসরি স্বামীর দিকেই তাক করে। জিন্নাত আলী বউয়ের ঝাপটা আঁচ করতে পেরে সরে যায়। লুঙ্গির নিচের ভাগটা দুহাতে উঁচু করে ধরে খানিকটা আড়ালে দাঁড়ায়। তারপর সন্ধ্যার আঁধারকে কাজে লাগিয়ে দুহাঁটু ভেঙে কায়দা করে বসে। অনেকক্ষণ ধরে ভারি হয়ে থাকা তলপেটটা খালি করতে শুরু করে। বউয়ের শাপমন্যি প্রসবে বিঘ্ন ঘটিয়ে যেজলস্রোত সরসর করে ভিজিয়ে দেয় কাঁচাশুকনা ঘাসগুলো, জিন্নাত আলীর ষাট পার করা শরীরও তাতে চাঙ্গা হয়। বউকে এড়াতে পেরে স্বস্তি পায়। সাঁইত্রিশ বছর ধরে এই অভিশাপ তাকে সহরাবানু থেকে মুক্তি দেয়নি। কিশোরী বউকে ঘরে তুলে দুর্ভাগ্যের সূচনা করেছিল। আপন ঔরসজাত সন্তানের পিতা হবার স্বপ্ন তার পূরণ হয়নি। আযৌবন অতৃপ্ত জিন্নাত আলী ক্ষোভ হতাশায় ভিজে ওঠে। ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসা পেশাবের বেগ টিপটিপ শব্দে ওঠানামা করে। বামহাতে শিশ্নটা কয়েকবার মৃদু নাড়িয়ে আগায় লেপ্টে থাকা জলগুলো সরায়। ঘাড়টা ঈষৎ ঘুরিয়ে আশপাশে মাটির ঢেলার খোঁজ করে। তারপর বামহাতে কুড়িয়ে শিশ্নে কয়েকবার ঘষে নেয়। ভরসন্ধ্যায় এতগুলো বাদুরের এমন অলক্ষুণে চিৎকারে তার হৃৎপিণ্ডের নাড়ি-নক্ষত্রে খবর হয়ে যায়। ঘামে ভিজে ওঠা দেহ ঝিমঝিম করতে থাকা মাথার ওজন আচমকা কয়েক মণ বেড়ে যায়। তার মনে হতে থাকে শিশ্নপথের যে জলধারা টিপটিপ শব্দে ক্রমশ থেমে আসার কথা, তা উলটা এক ভয়ঙ্কর বেগ নিয়ে পুনরায় ছুটতে শুরু করে। জলধারা ক্রমশ লাল হতে থাকে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে লম্বা দুই কোনা টুপিটা বের করে ডান হাতে তড়িঘড়ি করে মাথায় বসিয়ে জিন্নাত আলী বিড়বিড় করে আল্লাহপাকের নাম জপতে শুরু করে। 

স্বামীর অলক্ষুণে চেহারাটা আড়াল হয়ে গেলে জিন্নাত আলীর বউ সহরাবানু পুত্রবধূর শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো নিয়ে ঘরে ফেরে। পুত্র মেরাজ আলী দূর থেকে মায়ের ঘরে ফেরা প্রত্যক্ষ করে। তারপর শরীরের ভারটা হাতের উপর নিয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে মূত্রত্যাগের চিলমচিটার কাছে পৌঁছায়। পাদুটো তার অসাড়। বউয়ের অনুপস্থিতিতে একটা ক্রোধ জমাট বেঁধে আছে বুকে। অতি কষ্টে বশে আনে। হীনমন্যতা যন্ত্রণা তবু কমে না। মূত্রথলির নিঃসরণক্রিয়া স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। প্রায় সারাটা বিকেল দরজার চৌকাঠ পাহারা দিয়ে উঠানে বউ রিজিয়ার চাল ঝাড়া দেখেছে। মেরাজ আলী বউয়ের বুক উপচানো ক্ষোভ টের পায়। শরীরের তেজ পুরোপুরি তলিয়ে যেতে থাকে। বয়ঃসন্ধিকালে মহাজনের বাড়ির আমবাগানে আম পাড়তে গিয়ে নিজের শরীরের সর্বনাশ করেছিল। দুর্ঘটনা তার চিন্তা তেজই কেবল অসাড় করেনি, ডানপিটে শরীরের মর্দামিও কেড়ে নিয়েছে।

ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছে লোবান শাহ-এর মাজার থেকে বাপ-মা তাকে কুড়িয়ে এনেছে। তার আশ্রয় হয়েছিল মা সহরাবানুর কোলে। একটা এতিম শিশুর ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিল পিতামাতা। নয় বছর বয়সে পঙ্গু হবার জ্বালা এখনও সয়ে উঠতে পারেনি। তার এই ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনে আচমকা রিজিয়া জড়িয়ে যায়। বাপ-মায়ের মুখ রাখতে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। তবুও মনে হয় একটা পোড়া ঘা হৃৎপিণ্ডে দগদগ করে প্রতিনিয়ত। রিজিয়ার নিশ্চল ও অনুভূতিশূন্য দাম্পত্য জীবন তাকে বারবার কেঁচো বানায়। 

বউ রিজিয়া ততক্ষণে চাল ঝাড়ার কাজ শেষ করে পুকুর ঘাটের দিকে রওনা দেয়। সারাদিনের বাসি হাঁড়ি, পাতিলগুলোও সাথে করে নিয়ে যায়। ঘাটের উপর তার নড়চড়ে জলের ভেতরে অর্ধেক ডুবে থাকা তালগাছের ঘাটটি নড়েচড়ে ওঠে। শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। রিজিয়ার বুকটা কোনও এক অজানা কারণে নিঃশব্দে কেঁপে ওঠে। জলের নিচে তেলাপিয়া মাছের দাপাদাপি চোখে পড়ে। রিজিয়ার অসতর্ক শাড়ির আঁচল খসে গিয়ে পানিতে ভেজে। বাম হাত বাড়িয়ে দিয়ে আঁচলটা পানি থেকে তুলে নিয়ে কোমরে গুঁজে দেয়। 

সোয়াপাঁচ বছরের সংসারের আঁচলটা প্রতিনিয়ত গোঁজে। ভোরের আলো না ফুটতেই মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। সারাদিন সংসারধর্ম পালন করে। মনের উপর একটা ভারী পাথর চেপে থাকে। চোখের কালশিটে দাগের উপর কখনও কখনও পানি জমা হয়। মনটা বশ মানতে চায় না। দরিদ্র বাপের কাঁধ খালি করে স্বামীর ঘরে এসেছে। মাথার উপর একটা ছাদ তো জুটল। কপাল তার পোড়েও না, গলেও না। রিজিয়া পউষের শীতে কাঁপে না, মাঘের শীতে জমে না। 

তবু আড়ষ্ট কণ্ঠে শ্বশুরের গলাখাঁকারি তাকে জাগিয়ে তোলে। মুয়াজ্জিনের আযান আবছা আঁধারে আলো ছিটায়। জিন্নাত আলীর গলার আওয়াজ তার কানে প্রতিরাতে পৌঁছায়। লাকড়িঘরের অতিথি কুকুরগুলোকেও জাগিয়ে তোলে। শিথিলবসনা রিজিয়া সতর্ক মনোযোগে কুকুরগুলোর নড়াচড়ার শব্দে কান পাতে। শরীরের কাপড়গুলো ঠিকঠাক করে। তারপর শ্বশুরের ওজুর বদনার হদিস করে। সে অনুভব করে ইছাখালি বিলের শীতল তেলতেলে একটা জোঁক তার শিরদাঁড়া অতিক্রম করে। 

প্রতি ভোররাতে অজুর বদনা নিয়ে সে শ্বশুরের সামনে হাজির হয়। অজুর পানির সরসর পতন জিন্নাত আলীর হাত, পা শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ ভিজিয়ে দেয়। পুতবউয়ের ঘোমটা টানা মুখের বিষণ্নতা তাকে গ্রাস করে। একটা সুক্ষ্ম ব্যথা বাতাসে পাক খেয়ে বুকের ভেতর ঘাই মারে। ডুগডুগির শব্দের মতন একটা আওয়াজ কানে বাজতে থাকে। ছেলের অদৃষ্ট তাকে ব্যথিত করে। ভোররাতের মাতাল করা নির্জনতায় ছেলের জন্য শোক উথলে ওঠে। যুবতি রিজিয়ার দীর্ঘশ্বাস তাতে উসকানি দেয়। রাতের ভারী বাতাসে মনের দ্বন্দ্ব হার মানে। অজানা এক কারণে নিজের বিশাল বুকের ভেতর রিজিয়াকে লুকিয়ে ফেলে। তারপর কী করবে ভেবে না পেয়ে আচমকা গুঙিয়ে ওঠে। গোঙানির শব্দ ভেঙে ভেঙে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে দুয়েকটা নেড়িকুকুর কুঁইকুঁই শব্দ করে লাকড়িঘর থেকে বেরিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে আড়াল হয়ে যায়। 

শ্বশুরের সবল বাহুর চাপে প্রায় পিষে যাওয়া রিজিয়া অতি কষ্টে নিঃশ্বা নেয়। তারপর শ্বশুরের চোখ বেয়ে নেমে আসা পানির ধারা হাত দিয়ে আলগোছে মুছে দেয়। দীর্ঘ শ্মশ্রুর স্পর্শ তার কপাল গালে সুড়সুড়ি জাগায়। আশ্চর্য এক পুলকে সে চোখ বোজে।

ইছাখালি বিলের আঙ্গুলসমান জোঁকটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠে।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>