বাবা
কাল ফাদার্স ডে। পিতাদের জন্য একটি বিশেষ দিন।যদিও আমি এই বিশেষত্বে বিশ্বাস করি না।আমি মনে করি শুধু এক আধটা দিন নয় আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত জুড়ে থাকে বাবা মার স্নেহচ্ছায়া। পৃথিবী পরিক্রমার এই সফরে যতটুকু পাওয়া সবই তো তাদের হাত ধরে।তাদের শাসন, দিকনির্দেশ শিক্ষকদের আশীর্বাদ,বন্ধু ও পরিজনদের ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে প্রতিটি পলে, অনুপলে । তবু কখনও কখনও কিছু কথা বলার উপলক্ষ্য দরকার হয়। নির্জনে যে কথাগুলো ভাবি, সেই কথাগুলো নিবিড় ভাবে লিখতে ইচ্ছে করে। শৌনক সেই জায়গাটা দিয়েছে বাবাকে নিয়ে কিছু বলার। এটাও ভালোবাসা। এই ভালোবাসা নিয়েই আমাদের তুচ্ছ লেখালেখি।
আমি কী নিয়ে লিখব ভাবছিলাম? কবি মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়? সে কথা অনেকেই লিখবে। আমি লিখব কবিতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পিতাকে। তাঁর পিতৃসত্তার বিভিন্ন দিক, ব্যক্তিগত বিভিন্ন টুকরো ঘটনা।
বাবাকে আমরা চার ভাইবোনই ছোটবেলায় খুব ভয় পেতাম। শুধু ছোটবেলা কেন অনেক বড় অবধিই।গম্ভীর, রাগী, মেজাজী মানুষ বলেই মনে হত তখন।এর কারণ হচ্ছে বাবার কণ্ঠস্বর ছিল এতটাই তেজি এবং বজ্রগম্ভীর যে একবার ডাকলে বুক শুকিয়ে যেত আমাদের। ফলে বাবার সাথে একটু দূরত্বই ছিল।সে তুলনায় মা বা ঠাকুমা ছিল আমাদের খুব কাছের। তবু বাবার বৈঠকখানার উপর প্রবল আকর্ষণ ছিল।কত অজস্র পত্রিকা, বই আলপিন, আঁটা, কাগজ কাঠের ব্লক, বিভিন্ন শিল্পীদের প্রচ্ছদের সম্ভার নিয়ে এক রহস্যের জগত।সেই জগত নিয়ে তীব্র কৌতুহল তৈরি হয়েছিল অল্প বয়স থেকেই।কিন্তু বাবাকে এতটাই ভয় পেতাম যে সেখানে ঢুকবার হিম্মত ছিল না একদম। বাবা স্কুল বেরিয়ে গেলে কিংবা দূরে কোথাও কবিতার অনুষ্ঠানে গেলে সেই বৈঠকখানার দখল নিয়ে তুমুল তুলকালাম কান্ড করতাম আমরা। বাবার গুছিয়ে রাখা ছোটদের পত্রিকাগুলো নিয়ে শুরু হত আমাদের নিবিড় পড়াশোনা।বৈঠকখানা অগোছালো করে রাখতাম আমরা। তারপর বকুনিও খেতাম। তখন খুব অবাক হতাম এত এত পত্রিকা তবু বাবা কী করে বুঝে ফেলে কোন পত্রিকা কোথায় ছিল এবং তার অবস্থান বদল হয়েছে। বাবার স্মৃতির এক অদ্ভুত গ্রন্থাগার ছিল। কোন বইয়ের কত পাতায় কোন গুরুত্বপূর্ণ লেখা আছে বলে দিতে পারতেন। আজ সেরিব্রাল স্ট্রোকের কারণে অধিকাংশ সময় বিছানায় শুয়েই থাকেন বাবা, হাঁটাচলা ঘরের মধ্যে সামান্যই।লেখালেখিও বন্ধ।তবু পত্রিকা পড়েন, বই পড়েন। যখন লিখতে লিখতে থমকে যাই, কোন তথ্যের দরকার পড়ে বাবার কাছে দাঁড়াই, অসুস্থতার ভেতরেও বাবা ঠিক বলে দেন এই বই এত পাতা। খুলে মিলিয়ে নিতে গিয়ে অবাক হয়ে যাই।
বড় হওয়ার পর সাহিত্যের জন্যই নিবিড় এক বন্ধুত্বই তৈরি হয়েছিল বাবার সাথে। গল্প করতে করতে কথা বলতে বলতে মনের ভেতরের জগতটাকে আবিষ্কার করেছিলাম একটু একটু করে।বাইরের যে আবরণ যা দেখে ছোটবেলায় ভুল হত , মনে হত গম্ভীর রাগী এবং কঠিন মানুষ ,বাবা মানুষটা আসলে তা নয়। তাঁর ভেতরে একটা দুঃখের আছে, বেদনার জগত আছে, লড়াই আছে,কিছু সাফল্য,কিছু ব্যর্থতা নিয়ে একটা অন্যরকমের মানুষ।যেখানে নরম পলিমাটির স্তর।সরল শিশুর মতন একটা সবুজ আভা।
ছোটবেলায় বাবাকে যেমন ভয় পেতাম, সেরকম অভিমানও ছিল বাবাকে ঘিরে।আজ কোচবিহার তো কাল কাকদ্বীপ। পরশু বরাকর তো তার পরদিন বান্দোয়ান।এরকম অনেক অনেক কর্মসূচি। সাহিত্যের পার্টির , মানুষের পাশে দাঁড়ানোর । ছোটবেলায় সেভাবে আমরা কাছে পাইনি বলেই একটা অভিমান হত মনে।মাকে জিজ্ঞেস করতাম- সবার বাবা তাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে বসায়। মামাবাড়ি বা পিসিবাড়ি বা এদিক ওদিক বেড়াতে নিয়ে যায়। কই আমাদের তো তেমন সৌভাগ্য হয় না।
মা বেশ গুছিয়ে বল – সবাই কি নক্ষত্র পুরুষ হতে পারে। তোদের মতো অজস্র শিশু আছে পৃথিবীতে। তাদের সবার জন্য একটা সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে হবে মানুষকে। আর এই কাজের জন্য এগিয়ে আসতে হবে কিছু মানুষকেই। সবাই ভালো থাকলে আমরাও তো ভালো থাকব ।
যেকোন বয়সের মানুষের সাথে মিশে যাবার বন্ধুত্ব করবার তুমুল দক্ষতা বাবার। আমার চেয়েও কম বয়সী ছেলেরা কত অনায়াসেই বলে একমাত্র মোহিনীদার সাথেই প্রাণ খুলে কথা বলা যায়। গল্প করা যায়। বিড়ি খাওয়া যায়। অথচ এমনই ব্যক্তিত্ব দেখলেই শ্রদ্ধা এসে যায়। বয়স টয়সের ধারই ধারেন না।
এরকমই বাবা। যেকোন বয়সের লোকের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটিয়ে দেওয়া মানুষ।গ্রামের কোন কুটুম আত্মীয় এলে বাবার সাথে দেখা করে যাবেই। একবার হয়েছে কি জগদ্ধারী পুজার শেষ একজন জামাই এসেছে বাবার সাথে দেখা করতে। আসলে এটাই তখন ছিল রীতি। পুজা শেষে গুরুজনদের প্রণাম করে ট্রেন ধরে বাড়ি যাওয়া।দশটার ট্রেন ধরবে। সে বেশ সময় নিয়েই এসেছে। আটটার সময়। সিরজাম স্টেশন হেঁটে চল্লিশ মিনিটের পথ । প্রণাম করতে এসে সে এমন গল্পে মজে গেল তিন কাপ চা খাওয়ার পরও গল্প শেষ হয় না। যখন ঘড়ি দেখল তখন বারোটা বাজে। ট্রেন কবেই চলে গেছে। বাবা বলল- তোমার বাড়ি যাওয়ার ছিল না ?
সে বলল- সে তো ছিল, সেটা কাল গেলেও হবে। কিন্তু আপনার সাথে এই মজলিশের স্বাদ আমি তো রোজ রোজ পাব না ।
বাবা এরকমই প্রাণবন্ত আড্ডাবাজ মানুষ । যেমন গল্পপ্রিয়।গলাও তেমনি।এক মাইল দূরের লোক অনায়াসে শুনতে পাবে। কোন সভায় মাইক লাগত না এমন কণ্ঠস্বর । চলাফেরাতেও তেমনই গতিশীল। সিরজাম স্তেশন চল্লিশ মিনিটের মিনিট বাবার পায়ে হেঁটে লাগত পনের মিনিট। আর হাতদুটো অনিবাম লেখায় মগ্ন থেকেও অক্লান্ত। দুপার বাংলায় এমন কোন কাগজ নেই বাবা লেখে নি। বাবা গর্ব করে বলত- আমি সাতদিন না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু একদিন না লিখে থাকতে পারব না।
আজ এগারো বছর হয়ে গেল।বাবা না লিখে আছে।আমি বাবাকে প্রশ্ন করিনি- বাবা এতদিন না লিখে আছো কী করে ?
ছোটবেলায় আমাদের শরীর খারাপ হলে বাবাকে দেখতাম অস্থিরভাবে পায়চারি করতে। সারা রাত বিড়ি খেয়ে নির্ঘুম কাটিয়ে সকালেই বাঁকুড়া ডাঃ জয়ন্ত দত্তর চেম্বার।এই অসুস্থতার সময় বাবাকে মনে হত কত নরম। বজ্রকঠিন মানুষটা তখন কোথায় হারিয়ে যেত। বিপন্ন অসহায় ছায়া পড়ত বাবার চোখেমুখে। আমরাই সাহস দিতাম – দেখো ঠিক সেরে উঠব ।
অথচ নিজের ব্যাপারে তীব্র উদাসীনতা ছিল। কতবার হাত ভেঙেছে, পা ভেঙেছে । কিন্তু দমাতে পারেনি মনোবল । একবার বাবা ও সমীরণবাবু( আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক) আদ্রা থেকে ফেরার পথে সমাজবিরোধীদের দ্বারা আক্রান্ত হল। বাবার পা ভাঙল। পায়ের চিকিৎসা করছিলেন যে চিকিৎসক প্লাস্টার করে বাবাকে ছমাস বিশ্রামের নির্দেশ দিলেন। কুড়ি দিনের মাথায় বাবা প্লাস্টার টাসটার সবকিছু ছিঁড়ে বলল- নিকুচি করেছে এসবের। আমার কত কাজ। পা ভেঙে ঘরে বসে থাকলে চলবে ?
বাবা এগারো বছরের ঘরের চৌকাঠেই প্রায় বন্দী। ডানদিক অবশ। প্যারালাইসড।
আমি জানি বাবার এসব ভালো লাগছে না।মনের ভেতর চঞ্চল হয়ে উঠছে কবিতার লাইন। কবিতার আডডা আজও বাবাকে ডাকে।
বাবা ঠিক বলে উঠবে – নিয়ে আয় নতুন খাতা । আমার কি এইভাবে চুপচাপ শুয়ে থাকা মানায়?
.
কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
জন্ম ১৯৭২, পুরুলিয়ায়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ এক ডজন। পেয়েছেন ত্রিবৃত্ত পুরস্কার মালীবুড়ো সন্মান সহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সন্মাননা। কেতকী পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত।