নার্সিংহোমের বেবিকটে চোখ বুঁজে ঘুমিয়ে আমি, করলে আমায় আদর তুমি।
দশপুত্র সম এক কন্যা বলে কোলে নিলে তুলে, হাত বুলিয়ে চুলে।
ঘুমিয়েছিলাম, মেয়ে হয়ে এসেছিলাম, তোমার দুঃখ তোমার সুখ ভাগ করে নেব বলে।
আমি নাকি তোমার আয়পয় বাড়ি ঘর সবকিছুরই মূলে।
আমি কিন্তু এসে তোমার কাজ বাড়িয়েছি কি? তোমাকে দুদন্ড দাঁড়াতে দিই নি ।
রংবেরংয়ের জামা, উলের মোজা, ছোট্ট মশারি, তুলোর তোষক, সর্ষের বালিশ, অয়েল ক্লথ, বেবি পাউডার, ফিডিং বটল্, থার্মোস …
সব কিছু একে একে কিনে কেটে মায়ের পাশে রেখে গেছ।
আমি ঘুমিয়ে, মা ও আধো ঘুমে! হাত রাখলে মাথায় তুমি এসে থেমে।
বাড়ি এলাম আমাদের পুরোণো ভিটেয়, গঙ্গাতীরে,শীতের দুপুরে।
আমি শুধু ঘুম, ঘুম, আর ঘুম। আর তুমি কোন অছিলায় আমার পাশে, ঘুমপাড়ানি গানের সুরে।
খবরের কাগজ হাতে, চায়ের চুমুক সাথে।
বেশ কয়েক বছর পরে…
আমার স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরে, লেখাপড়ার সাথে শেখালে গান তোমার ছন্দে তোমার সুরে।
তোমার পাশে থেকে থেকে তৈরি হলাম আমি। আজ তোমার কথা গুলো তোমার চেয়েও দামী।
একে একে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির গন্ডি পেরোলাম ঠিক!
শুধু ছিলে পাশে তুমি, দিলে শিক্ষা, সাহচর্য্য তুমি পরিশ্রমী !
তুমি আমার সেই তেজোদৃপ্ত প্রথমপুরুষ, যাকে আমি দেখছি এতকাল!
গীতা–গায়ত্রী–গঙ্গা স্নানে আপ্লুত, ধ্যানমগ্ন, সৌম্য–প্রশান্ত কোমল মানুষ।
আমার জীবনের দ্বিতীয় পুরুষ খুঁজে এনে দিলে, সেই তুমি আবার আমার মন ছুঁয়ে গেলে !
পাঠিয়ে দিলে স্বামীর ঘরে, বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে,তুমি চলে গেলে আমার থেকে দূরে।
বড় অভিমান হোল সেদিন, যখন তোমাকে দেখিনি সবে মাত্র দুটো দিন।
ক্রমে ভুলে গেলাম আমি, ডুবে রইলাম সংসারে, সঙ্গে আমার নতুন বন্ধু, প্রথম প্রেমিক, আমার প্রিয় স্বামী।
পেলাম আমার ছেলে, আরো গেলাম ভুলে, স্বামী–পুত্র সংসারসুখে, সব পেয়েছির দেশে।
কি নিষ্ঠুর না আমি? কি স্বার্থপর মেয়ে তোমার! আজ তোমাকে পেয়েছিলাম তাই আমার জীবন ধন্য |
কিন্তু আজ সে কেমন বদলে গেল হয়ত তোমারই জন্য।
জানো ঠিক এমনি হয়, গ্রীষ্ম যায়, বর্ষা যায় মেয়েরা কেমন বদলে যায় ।
ঠিক এমনি হয়, তোমার কালোচুল সাদা হয়, মেয়েরা যেন বদলে যায় |
ঠিক এমনি হয় তোমার দাঁত নড়ে, পড়ে যায়, মেয়েরা কেমন বদলে যায়।
ঠিক এমনি হয়, বাবার চোখে ছানি পড়ে মেয়েরা শুধু বদলে যায়।
তুমি শাসন করেছ এতটাই, যতটা করেছ সোহাগ, তোমার কাছেই হাতেখড়ি ভৈরবী–ইমন–বেহাগ।
তোমার আবৃত্তি, পুরস্কারে তুমি মহান আজ! স্বামিজীর শিকাগো লেকচারে, গীতবিতানের পাতায় পাতায়,
বাচনভঙ্গিমায়, পুরুষ কণ্ঠে, আমি প্রণাম করি তোমায়।
কখনো তোমাকে দেখেছি তারাশঙ্করের কালিন্দীর জমিদারের বেশে, কখনো টিপুসুলতানে মারাঠা ব্রাহ্মণের বেশে,
শরদিন্দুর ঝিন্দেরবন্দী কিম্বা উল্কায় !
তোমার হাত ধরে পয়লা বোশেখের হালখাতার মেহফিলে, দোকানে সূর্যাস্তের বিকেলে ।
শীতের দুপুরে, বইমেলার কোলাহলে, বাছাই করা বইয়ের গোছায়, ট্যাক্সি নিয়ে ব্যাস্ত রাস্তায়।
শরতের মিঠে রোদে, নিউমার্কেটে, কিম্বদন্তী সব ফ্রকের দোকানে, চীনেপাড়ার নতুন জুতোর গন্ধ নিয়ে,
হাতে কারকোর চাইনিজের পার্সেল প্যাকের ভিনিগারের গন্ধ ছুঁয়ে |
মনে পড়ে যায়….
রোববারের সকালে, কলের গানের চোঙ থেকে একে একে এলপি রেকর্ডের সুরে ..
সিন্ধু ভৈরবী থেকে শিবরঞ্জনীর মূর্ছনা ..সে ও তোমার সংগ্রহ থেকে, আজ অনেক দূরে।
ডোভার লেন কনফারেন্সের নস্টালজিয়ার গন্ধ নিতে নিতে, তোমার সঙ্গে ফ্লুরিজের কেকে,
বা জিমিস কিচেনে, মেট্রোসিনেমার যুদ্ধের ভয়াবহ সিনে, হাটারি কিম্বা ব্রুস লি দেখে।
কত কি পেয়েছি !
জন্মদিনের ভোরে মাথার বালিশের পাশে বুক–অফ–নলেজ থেকে শরদিন্দু অমনিবাস,
কিম্বা সঞ্চয়িতা থেকে বিশ্বপরিচয়, পুশকিন অথবা আর্থার কোনান ডয়েল |
অকশান থেকে কেনা বিশাল জার্মান পুতুল, হায়দ্রাবাদি মুক্তোর দুল।
হিসেব মেলাতে পারবো না..
আমি তখন অষ্টাদশী, ফ্রক থেকে শাড়ি, প্রথম শাড়ি তোমার দেওয়া মেরুণ বালুচরি!
স্মৃতির ক্যানভাস থেকে হারিয়ে যাবে না সেই সুর।
তুমিও থাকবে আমার জীবনে সপ্ত ঋষির মত, স্মৃতি সুমধুর।
সকলের সব দ্বেষ হিংসা, কর্কশ কটুক্তি হজম করে আজ তুমি নিজের মহিমায় অমলিন, নীলকন্ঠ!
পবিত্র–যজ্ঞ–উপবীত তোমার গঙ্গোদকে পূর্ত, পবিত্র!
হে ব্রাহ্মণ প্রণমি তোমারে !
তোমার গন্ডুষ পাত্রে তোমার উচ্ছিষ্ট পান করি
আশীর্বাদ করো পরমং তপঃ পিতা স্বর্গ পিতরি ।