Categories
গুপ্তচর সংখ্যা: মোহিনী গুপ্তচর না কি যুদ্ধের বলি । সায়ন্তনী সেনগুপ্ত
আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট
শেষ রাতের ঘণ্টা বাজছে দূরের ঘড়িঘরে। ফ্রান্সের কুখ্যাত জেলের নোংরা আর দুর্গন্ধ ১৭ নম্বর সেলে দু’জন সন্ন্যাসিনীকে নিয়ে এসে পৌঁছলেন কর্তব্যরত অফিসার। ভারী বুটের শব্দে চমকে ঘুম ভেঙে উঠে বসলেন সেলের সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী। চোখেমুখে তখনও অবিশ্বাসের ঘোর। ‘‘অসম্ভব, এ অসম্ভব!’’ মুহূর্তে নিজেকে সংযত করে, পোশাক পালটে, একঢাল কালো চুল ঢেকে নিলেন তিনকোনা টুপিতে। সন্ন্যাসিনীদের বললেন, ‘‘আমি প্রস্তুত।’’ প্যারিসের শুনশান রাজপথ দিয়ে ছুটে চলল গাড়ি। কী দেয়নি এই শহর তাঁকে! নাম, যশ, অর্থ, স্তাবক। তাঁর স্বপ্নের শহর প্যারিস। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে পা কেঁপে গেল একটু। বধ্যভূমি প্রস্তুত। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ ঢাকলেন না। মৃত্যুর চোখে চোখ রাখতে চান। তাঁর বুকের দিকে বন্দুক তাক করা অফিসারের দিকে শান্ত ভাবে তাকাতেই ছুটে এল গুলি। নতজানু হয়ে বসে পড়লেন তিনি। মুখের একটা রেখাও কাঁপল না, মাথা হেলে গেল পিছনের দিকে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে কপালের ঠিক মাঝখানে আর একটা গুলি। স্বগতোক্তি করলেন অফিসার, ‘‘এ মেয়ে জানে, কী ভাবে মরতে হয়।’’ ঠিক একশো বছর আগের এই দিনে সেই মৃত্যু।
ফরাসি খবরের কাগজগুলির প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হল মৃত্যুসংবাদ। একটি সংবাদপত্র লিখল, ‘আমাদের দেশের আতিথেয়তাকে দিনের পর দিন ব্যবহার করে, শেষে আমাদের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা! উপযুক্ত শাস্তি পেল মাতা হারি।’ কেউ লিখল, সামরিক আদালতে নিজের ঘৃণ্য অপরাধের কথা স্বীকার করেছিলেন তিনি। সবাই জানল, মোহিনী, লাস্যময়ী মাতা হারি আসলে জার্মানির গুপ্তচর। যাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় হাজার হাজার ফরাসি সৈন্য যুদ্ধে মারা গেছেন। কুখ্যাত ‘ডাব্ল এজেন্ট’ মাতা হারির মৃত্যুর পিছনে যে কী ইতিহাস লুকিয়ে, কেউ জানল না। জানতে চাইলও না।
মাতা হারির আসল নাম মার্গারেটা গের্ট্রুডা জেল। ১৮৭৬ এর ৭ অগস্ট নেদারল্যান্ডসে তাঁর জন্ম। ধনী বাবার আদরে বড় হওয়া মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই বিলাসে অভ্যস্ত ছিল। হঠাৎ বিপর্যয় নেমে এল পরিবারে। মা মারা গেলেন। নিরাপত্তাহীন বিপর্যস্ত জীবনে যখন প্রায় দমবন্ধ অবস্থা, তখনই খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে তাঁর চেয়ে বয়সে প্রায় দ্বিগুণ ক্যাপ্টেন রুডল্ফ ম্যাকলেওডকে বিয়ে করে ফেলল বছর বাইশের মেয়ে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া। পর পর দুই সন্তানের জন্ম। দুর্ভাগ্য অবশ্য পিছু ছাড়ল না। স্বামীরত্নটি শুধু মদ্যপ আর অত্যাচারীই নয়, যৌনরোগগ্রস্ত। একটি বাঁধা রক্ষিতাও আছে। এক জন পুরুষের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা কোনও দিন ধাতে ছিল না তাঁর, তার উপর এ হেন স্বামী। একের পর এক সামরিক অফিসারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে লাগলেন মার্গারেটা। এরই মধ্যে দুই সন্তান ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে পড়ল। মেয়েকে কোনও ক্রমে বাঁচানো গেলেও, ছেলেটি মারা গেল। দুই সন্তানই বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল সিফিলিস। অসুখী দাম্পত্য আর টিকিয়ে রাখা গেল না। মেয়েকে নিজের কাছে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও অর্থাভাবে সফল হলেন না।
কপর্দকশূন্য মার্গারেটা ১৯০৩ সালে এলেন প্যারিসে। কিছু দিন সার্কাসে কাজ, পরে নাচের দুনিয়ায় পা রাখলেন। ইন্দোনেশিয়ায় থাকার সময় সেখানকার নৃত্যশৈলী শিখেছিলেন, এ বার তা কাজে লাগাতে গল্প ফাঁদলেন। বললেন, তিনি আসলে জাভার রাজকুমারী, প্রাচ্যের সভ্যতা-সংস্কৃতি সব তাঁর আয়ত্ত। এর আগেই নিজের নাম নিয়েছিলেন ‘মাতা হারি’। স্টেজে সেই নাম ব্যবহার করতে লাগলেন। তাঁর জলপাই-রং ত্বক, কালো চোখ, একঢাল কালো চুল, শরীরী আবেদনে মাতাল হয়ে গেল প্যারিস। মাতা হারি জানতেন, প্রচারের সব আলো কী ভাবে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতে হয়। পাতলা ওড়না শরীরে জড়িয়ে মঞ্চে আসতেন, নাচতে নাচতে ছুড়ে দিতেন সেটাও। নগ্নতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। ইরোটিক নাচের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন মিথ, আধ্যাত্মিকতাও।
অর্থের অভাব রইল না আর। পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল বিলাসব্যসন, আড়ম্বরের খরচ। ১৯১০ সালের মধ্যে সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। তবে বেশি দিন চলল না এ ভাবে। নর্তকী হিসাবে জনপ্রিয়তায় যত ভাটা পড়তে লাগল, ততই পুরুষ সঙ্গীর ওপর নির্ভরশীল হলেন তিনি। শরীর ও সাহচর্যের বিনিময়ে রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার আর ধনী পুরুষদের কাছ থেকে অর্থ উপার্জন করতে লাগলেন মাতা হারি। সঙ্গী হল কেচ্ছা, দুর্নাম। তাতেও পরোয়া ছিল না। কিন্তু সমস্ত হিসেবনিকেশ উলটপালট করে দিল ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নেদারল্যান্ডস নিরপেক্ষ থাকায় স্বাধীন ডাচ নাগরিক হিসাবে ইউরোপের সব জায়গায় যাতায়াত করতে পারতেন মাতা হারি। এই সময় একটা শো করতে জার্মানি গেলেন তিনি। কিন্তু বার্লিনে তাঁকে আটকে দেওয়া হল। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সিজ করে, টাকাপয়সা-গয়না সব আটকাল জার্মান অফিসাররা। ফিরে যেতে হল মাতা হারিকে। এই সময়েই পরিচয় হল কার্ল ক্রোমার নামে এক জার্মান কনসালের সঙ্গে। তিনি মাতা হারিকে জার্মানির হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাব দিলেন, ২০,০০০ ফ্রাঁ-ও। সঙ্গে দিলেন কোড নেম, H-21। বিলাসে ভাসা মাতা হারির অর্থের ব্যাপারে বাছবিচার ছিল না। তিনি অনায়াসে সেই টাকা নিলেন। ভাবলেন, তাঁর যে জিনিসপত্র আর টাকা জার্মানি আটক করেছে, তার বদলে এই অর্থ তাঁর প্রাপ্য। গুপ্তচর হওয়ার কোনও অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। ব্রিটেন হয়ে ফ্রান্সে ফেরার সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দারা আটকে তল্লাশি করল, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পেল না। ফ্রান্সে ফিরে যথারীতি বিলাসে ডুবে গেলেন। জানলেন না, তিনি পুলিশের নজরবন্দি।
ইতিমধ্যে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো একটা ঘটনা ঘটেছে। প্রেমে পড়েছেন মাতা হারি, জীবনে প্রথম বার। প্রেমিক রাশিয়ান পাইলট ভাদিম মাসলভ-এর সঙ্গে বারবার দেখা করতে লাগলেন রাশিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। মাসলভ যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুতর আহত হলেন, আহত প্রেমিকের পাশে পৌঁছতে মরিয়া মাতা হারি দেখা করলেন ফ্রান্সের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এক অফিসারের সঙ্গে। অফিসার জানালেন, যাওয়ার অনুমতি মিলবে, তবে ফ্রান্সের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির শর্তে। নিরুপায় মাতা হারি রাজি হলেন। বিনিময়ে চাইলেন ১০ লক্ষ ফ্রাঁ। ভাবলেন, প্রেমিক সুস্থ হলে এই টাকা দিয়ে নতুন জীবন শুরু করবেন দু’জনে।
হল্যান্ডে ‘মিশন’-এ যাওয়ার পথে স্পেনে আটকে দেওয়া হল মাতা হারিকে। সেখানেও এক জার্মান গোয়েন্দাকর্তাকে রূপ আর যৌনতার অপ্রতিরোধ্য টোপ দিয়ে উত্তর আফ্রিকায় জার্মান রণকৌশল সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিলেন। বিনিময়ে তাঁকে ফ্রান্সের কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর দেওয়ার ভান করলেন। মিশন-এর সাফল্যের খবর যথাস্থানে দিয়ে ভাবলেন, দাবি মতো তাঁর টাকাটা এ বার পেয়ে যাবেন। অন্য দিকে সেই জার্মান গোয়েন্দাকর্তাটি বার্লিনে এক রেডিয়ো-বার্তা পাঠালেন, জার্মান গুপ্তচর H-21 তাঁকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। ইচ্ছে করে এমন কোডে বার্তাটি পাঠালেন, যে কোডের অর্থ অনেক আগেই ফ্রান্স উদ্ধার করে ফেলেছে। অবধারিত ভাবে বার্তাটি ফ্রান্সের হাতে এসে পড়ল। বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে ফরাসি কর্তারা বুঝলেন, H-21 আসলে আর কেউ নয়, মাতা হারি।
১৯১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্যারিসের এক হোটেল থেকে মাতা হারিকে গ্রেফতার করা হল। তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন কুখ্যাত সঁ লাজার জেলে। দিনের পর দিন জেরা চলল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য নানা জায়গায় অজস্র চিঠি লিখলেন মাতা হারি। কাজ হল না। ফ্রান্স খুব ভালমত জানত, মাতা হারির বিরুদ্ধে সেই জার্মান গোয়েন্দাকর্তার পাঠানো রেডিয়ো-বার্তা ছাড়া আর কোনও তথ্য-প্রমাণ নেই। তাই বিচার চলাকালীন মাতা হারির উকিলকে না করতে দেওয়া হল জেরা, না কোনও সওয়াল। মাতা হারি এত দিন যেখান থেকে যত টাকা পেয়েছেন— হোক তা জার্মান আধিকারিকদের সঙ্গ দেওয়ার বিনিময়ে, বা এক ডাচ ব্যারনের কাছ থেকে মাসোহারা বাবদ— সবটাই গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ‘জার্মানির কাছ থেকে পাওয়া টাকা’ বলে প্রমাণ করা হল। এরই মধ্যে মাতা হারি কার্ল ক্রোমার নামের সেই জার্মান কনসালের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকারও করলেন। মজবুত অজুহাত পেল ফ্রান্স। দোষী সাব্যস্ত হলেন মাতা হারি। ১৯১৭ সালের ১৫ অক্টোবর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল।
সুন্দরী। অপ্রতিরোধ্য যৌন আকর্ষণের অধিকারী। বিশ্বাসঘাতক। পৃথিবীর অন্যতম সেরা গুপ্তচর। এত সব কিছু মিলিয়ে যে ছবিটা আঁকা হল, তার তলায় ঢাকা পড়ে গেল মাতা হারির অন্য মুখ। আদৌ কী গুপ্তচর ছিলেন তিনি? বিতর্ক কম নেই সেই নিয়ে। কিন্তু তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট যেমন বলেছিলেন, ‘দ্য গ্রেটেস্ট ওম্যান স্পাই অফ দ্য সেঞ্চুরি’, তিনি তা ছিলেন না। ‘ডাব্ল এজেন্ট’ তো ছিলেনই না। মাতা হারি তাঁর বিচার চলাকালীন বারবার বলে গিয়েছেন, তাঁর বিশ্বস্ততা শুধুমাত্র ফ্রান্সের প্রতি। হয়তো মিথ্যেও ছিল না সেই দাবি। কিন্তু তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। করার দরকার মনে করেনি, কারণ এটাই তো তারা চেয়েছিল।
যুদ্ধের প্রবল খিদের সামনে সেই সময় একটা বলি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। যখন একসঙ্গে ফ্রান্স আর জার্মানির উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার আর গোয়েন্দা দফতরের অধিকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন তিনি, তখন ঘটনাচক্রে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধে কৌশলগত ভুলের জন্য জার্মানির কাছে প্রবল ধাক্কা খাচ্ছে ফ্রান্স। প্রচুর সৈন্য মারা গিয়েছে যুদ্ধে। ১৯১৭ সালে রণক্লান্ত ফ্রান্সের সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছে। এই অবস্থায় বিদ্রোহী, হতোদ্যম সৈন্যদের মনোবল ফিরিয়ে এনে হারতে-বসা যুদ্ধটা জেতার জন্য এক জন ‘বিশ্বাসযোগ্য বিশ্বাসঘাতক’ তৈরি করার দরকার ছিল। ঠিক এই কারণেই হারের দায়ভার চাপানো হয়েছিল মাতা হারির ওপর। এর চেয়ে আদর্শ বলি আর কে-ই বা হতে পারত! যে মেয়ে নগ্নতায় নির্লজ্জ, যাঁর পুরুষসঙ্গী গুনে শেষ করা যায় না, অর্থের লোভে যে সবার শয্যাসঙ্গী হতে পারে, সেই মেয়ে গুপ্তচর হবে না তো কী হবে? নিপুণ হাতে তাঁর বিরুদ্ধে ফাঁদ পেতেছিল জার্মানি আর ফ্রান্স। আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ মাতা হারি বোকার মতো সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন।
আরও একটা বড় কারণ ছিল— সেই সময় জার্মানির আসল গুপ্তচর, যারা ফ্রান্সে কাজ করছিল, তাদের থেকে নজর ঘুরিয়ে ফ্রান্সকে বিভ্রান্ত করা। রাজনীতি, ক্ষমতালিপ্সা আর যুদ্ধ মেশানো এত জটিল খেলা মাতা হারি বুঝতে পারেননি। সমাজকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সমাজের পক্ষেও মাতা হারিকে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। যে সমাজে তার কিছু দিন আগেও ‘বাড়াবাড়ি’ না করে স্ত্রীকে মারধর করা বৈধ ছিল, যেখানে ‘বিবাহবিচ্ছিন্না নারী’ মানে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দেওয়া মেয়েমানুষ, সেই সমাজ আর সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন তিনি। ব্রিটেনে তাঁকে আটক করা হয়েছিল কিসের ভিত্তিতে? না, ‘যে মেয়ে এমন সুন্দরী, যে এতগুলি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, যে মেয়ে কোনও পুরুষসঙ্গী ছাড়াই একা ইউরোপ ঘুরে বেড়ানোর ক্ষমতা রাখে, তাঁকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যায় না।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অজস্র পুরুষ এবং দশ জনেরও বেশি মহিলাকে গুপ্তচর সন্দেহে ধরা হয়েছিল। এঁদের মধ্যে সব থেকে চর্চিত তিনি, মাতা হারি।
অথচ ‘খারাপ মেয়েমানুষ’ তকমার আড়ালে যে প্রেমিকা, যে মা লুকিয়ে রইল, তাঁকে কেউ দেখল না। জীবনে প্রথম বার ফ্রান্সের হয়ে যে গুপ্তচরবৃত্তি তিনি করার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা শুধুই নিজের প্রেমকে বাঁচানোর জন্য। অজস্র পুরুষকে বিছানায় সঙ্গ দিয়ে খুব সম্ভবত তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই চল্লিশ বছর বয়সে থিতু হতে চেয়েছিলেন জীবনে।
কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রেমিক ভাদিম মাসলভ তাঁর ঘোর দুঃসময়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাতা হারি গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি সাফ বলে দিলেন, তাঁদের দু’জনের ভালবাসার সম্পর্কের কোনও মূল্যই আর নেই তার কাছে। এতটা প্রবঞ্চনা আশা করেননি মাতা হারি। খবর শুনে কোর্ট রুমে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
সন্তানকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণাও নিরন্তর তাড়া করেছে তাঁকে। এক সময় অর্থের অভাবে মেয়েকে কাছে রাখতে পারেননি। পরে যখনই সেই চেষ্টা করেছেন, তাঁর নগ্ন ছবি, চরিত্রের দুর্নাম তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন তাঁর স্বামী। বলেছেন, পতিতা কোনও দিন ভাল মা হতে পারে না। মেয়েকে অজস্র চিঠি লিখেছেন মাতা হারি। সব ফেরত এসেছে। এমনকী মরিয়া মা নিজের মেয়েকে স্কুল থেকে অপহরণও করার চেষ্টা করেছেন। বলা বাহুল্য, সফল হননি। মৃত্যুর আগে মাসলভ আর মেয়েকে চিঠি লিখেছিলেন মাতাহারি। জেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা, এই চিঠি দু’টো যথাস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। হয়নি। ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল সেই চিঠি দু’টো।
মাতা হারি কী ছিলেন আর কী ছিলেন না, তা নিয়ে তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পরও বিতর্ক আর গল্পের শেষ নেই। তাঁর ব্যবহৃত জিনিস এখনও অবিশ্বাস্য দামে নিলামে ওঠে। বহু-আলোচিত এই চরিত্র জন্ম দিয়েছে অজস্র বই আর চলচ্চিত্রের। সৌন্দর্যের খ্যাতি আর চরিত্রের কুখ্যাতি নিয়ে মাতাহারি এক কিংবদন্তি। আর কে না জানে, কিংবদন্তির মৃত্যু নেই!