| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

গল্প: যে যুদ্ধ জন্মান্ধের। রেজাউল ইসলাম হাসু

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

আস্তে আস্তে দিগন্তের খোসা ভেঙে পূর্বপুরুষের সূর্যটা উদিত হচ্ছে। যেন আঁধারের মাঠে কোনো এক লাল বল বিত্রপ অহমে গড়িয়ে আসছে এইসব দিগন্তের মায়াজালে, আমাদের অভিনয় অভিমুখে কোনো এক অভিনব প্রগতি ও প্রক্রিয়ার পরাধীনতায়, আর কোনো এক অচেনা ডাক অপার মহিমায় আমাকে ডেকে যাচ্ছে করুণভাবে, যেভাবে ডাকত পিতামহের সেই স্প্যানিশ বেহালার প্রতিধ্বনি। যাকে বয়ে নিয়ে গেছে কোনো জন্মান্ধ রক্তগঙ্গা।

খানিক পরে সুদীর্ঘ বেলাভূমির ইশারা-বক্ষে অস্ত যাবে আমার সমূহ কথাসূর্য। বোবাদের ইশকুলের দরজাটা হা মেলে বাজপাখির মতো দাঁড়িয়ে আছে। যেন আমার নাগাল পেলেই মিটিয়ে নেবে তার নিযুত বছরের দানবিক ক্ষুধা। প্রায় বারো বছর বধিরের মতো ছুটাছুটি করছে এদিক-সেদিক। কোনো ছুটির ঘণ্টা নেই, অনুরণন নেই। কেবল প্রবেশ গেটে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে কোনো এক প্রহরী। সেখানেই কোনো এক বার বছর গমনশীল সেই ইশারার ইথারে নিখোঁজ হতে।

জন্মের পরেই আমাকে কোনো এক কাচঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্বচ্ছ কাচঘরের ভেতর তীব্র চিৎকারে হয়তো আমি জানান দিচ্ছিলাম আমার আগমনবার্তাকে। সেই বার্তাকে এই কাচঘরের প্রাচীন প্রাচীর পেরিয়ে অবমুক্ত পৃথিবীর কানে গিয়ে পৌঁছেছিল কি না—জানি না। কেবল আমার মার্বেল পাথরের মতো ক্ষুদ্র দৃষ্টিসমূহের নরম ঢেউ কতক মুখায়বয়বের কুয়াশায় আছড়ে পড়ছিল। তারা আমার মুখকে মিথ ভেবে একরাশ মিথ্যে হাসির রোদে অতলান্ত ইশারায় ডুবেছিল। জন্মের পর কেন আমাকে কাচঘরে আনা হলো? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠে মনের ভেতর। পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে আমাদের নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে শহরটা। কেবল যুদ্ধশকটের হর্ণ, কামানের আওয়াজ আর সৈনিকদের কুচকাওয়াজ ছাড়া তেমন কোনো কোলাহল শহরে চোখে পড়ে না কিংবা শোনা যায় না বললেই চলে। এর চেয়ে বাতাসের প্রবাহ অধিক শব্দশীল মনে হয়। শহরটা সবসময় নৈঃশব্দ্যে আচ্ছন্ন থাকে মনে হয়। মনে হয়, সাধারণ নাগরিকরা বোবার মতো চলাফেরা করি। বাসাবাড়ি, শপিংমল ও অফিসগুলো নিস্তব্ধতায় বুঁদ হয়ে থাকে মনে হয়।

শহরের মানুষকে কখনো হাসতে দেখিনি তেমন। না কাঁদতে শুনেছি কখনো। তবে কোনো এক পহেলা ফাল্গুনে মাকে হাসতে দেখেছিলাম দীর্ঘ নিঃশব্দে। কতদিন ওই পবিত্র আলোর ন্যায় বিভাময় মুখটাকে দেখি না। শেষতক কবে দেখেছিলাম আবছা-স্মৃতির পাতার মতো মনের মধ্যে দুলদুল করে কেবল। আর এরকম এক বসন্তে মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য ভাষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন লিখছি। কারণ কয়েদিদের সঙ্গে কথা বলবার খুব প্রয়োজন পড়লে ভাষা মন্ত্রণালয় থেকে সাময়িক সনদ নিতে হয়। যার কাছে এই সনদ থাকবে, কেবল সে-ই তার কয়েদির সঙ্গে কথা বলতে পারবে। ভাষা মন্ত্রণালয় প্রয়োজনের ধরণ, গুরুত্ব ও সময় বিবেচনা করে কথা বলার সাময়িক সনদ প্রদান করে থাকে। তিনদিন পর ভাষা মন্ত্রণালয় থেকে ফিরতি চিঠি আসে। নীল এনভেলাপের ভেতর ত্রিভাজ এ-ফোর সাইজের সাদা কাগজে কালো কালো অক্ষরে দশ-বারোটা বাক্য লেখা হয়েছে আবেদনকারীর উদ্দেশ্যে।

প্রিয় সাধারণ নাগরিক,
আপনার সদয় অবগতির জন্য অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে যে, এখন বসন্তকাল। আর বসন্তকালে আমাদের কথা বলার সনদ দেয়া নিয়ম-বহির্ভূত। বিধায় আমরা আপনাকে কথা বলার সনদ দিতে অপরাগতা প্রকাশ করে এখানেই বিদায় বলছি। আশা করি, আপনি সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারি বিধানের প্রতি বিনম্র থাকবেন বলে শেষ করছি।

ধন্যবাদান্তে
ভাষা মন্ত্রণালয়

কথা বলার সনদ না পেয়ে আমি হতাশার চাদর মুড়িয়ে শীতার্ত পালকের মতো ঝিমিয়ে থাকলাম না। অবাধ্য মনের তেজি রোদের অশ্ব ছুটিয়ে এলাম সেই বিভাময় মুখের সন্ধানে। যাকে জীবনে একবারই হাসতে দেখেছি দীর্ঘ নিঃশব্দে। প্রথম প্রহরীর চোখ ফসকে এলেও ভেতরে দ্বিতীয় প্রহরীর চোখে ঠিকই ফেঁসে গেলাম। আর মাতামহীর শেষ-স্মৃতিচিহ্ন গলার সোনালি লকেটটা বলি দিয়ে সেই ফাঁস ছিন্ন করে মায়ের নাগাল পেলাম। আমাকে দেখে মা প্রথমে নিঃশব্দে চমকে উঠলেন, আর পানের জন্য কাচের গ্লাসটা তার ডান হাত ফসকে মেঝেতে পড়ে ঠুঙ্ক শব্দ হলো। কারাগারের কাজের মহিলাটি যতটা পারা যায়, সেরকম দ্রুততার সঙ্গে মব নিয়ে মেঝে পরিস্কারের কাজে মনোযোগী হয়ে ওঠল। আমি নিয়ম ভঙ্গ করে ‘শুভ মাতৃত্ব দিবস’ বলে মায়ের চরণধূলি তুলে আপন কপালে আলতো করে ঘষে ঘাড় ফিরেই দেখি আমার পেছনে খাকি ইউনিফরমের অ্যাবসার্ডে নিজের অস্থিত্ব হারানো কোনো এক সেনা অফিসার দাঁড়িয়ে, আর উনি আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলেন যেন আমি কোনো খুন করে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। মা ইশারায় সেনা অফিসারকে বোঝানোর কসরত করছিলেন যে, ‘ও তো বয়সে অনেক ছোট। আর ছোটদের দোষগুলো আমাদের মার্জনার চোখেই দেখা উচিত।’ তবু অন্ধ সেনা অফিসারের কিছুতেই দয়ার দুয়ার খুলল না খাকি ইউনিফরমের পৃথিবীতে। নির্দয়ভাবে লাল ডাইরিটা সাদা সাদা পাতায় আমার পাপগুলো মুনকার নাকিরের ভূমিকায় কালো কালো অক্ষরে ভরিয়ে তুললেন। ‘দ্বিতীয় সুযোগের অপেক্ষায় চলে গেলাম’ বলে সেনা অফিসার চলে গেলেন। তার চাইনিজ জুতোর খটখট আওয়াজে চলে যাবার তাড়াটা পরিমাপ করতে পারলাম যে, তার আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে এবং এরকম লাল ডাইরিতে আমাদের মতো অপরাধীদের অপরাধগুলো নোট করতে হবে। এতে করে তার প্রমোশনের কঠিন পথটা কিছুটা হলেও মসৃণ হবে আর বড়জোর একটা গোল্ড মেডেল ছাড়া কিছুই অপেক্ষা করছে না।

আজকের সূর্যোদয়ের বর্ণাঢ্য বিভায় আমি বিশ বছরকে অতিক্রম করেছি। অথবা বিশ বছর আমাকে অতিক্রম করে বয়ে এনেছে কোনো এক অচেনা উন্মুখতা। এইসব অজানা মুখরতার হাওয়ায় থেকে থেকে কেঁপে উঠছে আমার নবীশ বনসাইয়ের ডালপাতা। আর আমার একুশ বছরি খুরময় ধমনির ভেতর ভীষণভাবে বয়ে যাচ্ছে বিপুল বিদ্যুৎঢেউ। ‘আমি নিময় ভাঙতে চাই, যা চেয়েছিল আমার পিতামহ।’ আর দীর্ঘ বিশ বছর পর পিতামহের মতো আমাদের পরিবারে আবার কেউ এই কথাটা পুনরাবৃত্তি করল এবং এখানেই পিতা ও সহদরের ঘোর আপত্তি ফুঁসে উঠল। যেভাবে আগুন ফুঁসে উঠে হাঁফরের টানে কয়লার ঘুম থেকে। আর তার স্ফূরণ ছড়িয়ে শীতকে উত্তপ্ত করে তোলে। ঠিক সেভাবেই যেন সবকিছু উত্তপ্ত করে তুলতে শুরু করল তারাও। ‘কীভাবে ভাঙব? আমরা তো সৈনিক নই?’ প্রথমে পিতা খুব ক্ষিণকণ্ঠে বললেন। যেহেতু আমি এখনো ইশারার ক্রীতদাস হয়ে উঠিনি। আমি তার ভাজা মাছের মতো ঝলসে যাওয়া চোখের পাতার ভেতর কী যেন এক ঝিলিকের স্ফূরণ দেখে আসছি সেই বিশ বছর তিনশ চৌষট্টি দিন ধরে, যা ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে বড় আপার পোষা পাখিটার আয়ুর মতো। ‘তুমি যেদিন সৈনিক হবে, আমি সেদিন এই ব্যথাকে স্বাধীন করে দেব’। বড় আপা বড় বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই বলল, ‘তোমার বাবা সৈনিক হতে চেয়েছিলেন’। মাতামহী মাছের বড় টুকরোটা আমার থালায় দিতে দিতে বললেন।

এখন আমি একুশ বছরের টগবগে চে গুয়েভার। এখানে একুশ বছর মানে অজস্র অপেক্ষার ডালে ঝুলে থাকবার পর হঠাৎ মট করে ভেঙে যাওয়া কোনো এক অভিশাপকাল। আর ধূসর ধূলিকাল ঝেড়ে বিষন্ন বাতাসের ঘূর্ণিবেগের ঘোরে পুনরায় উঠে দাঁড়ানো। ঠিক যেভাবে অতিরিক্ত সময়ের ভেতর কোণঠাসা দল গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। অথবা অদৃশ্য অসীম ক্ষরণের অরণ্যে অনন্তর অভিযাত্রায় মনস্থির করে অনুধ্যানে বসে পড়া। কিংবা কোনো এক নতুন জগতের ঘূর্ণনপথে জার্নি ও যাপনের নবোদ্যমে অকুতোভয়ের মতো মড়কে ঝাঁপিয়ে পড়া। সরকার থেকে চিঠি এসেছে। জন্ম-নিবন্ধন রেজিস্টারের তথ্যানুসারে একই চিঠি যুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে প্রত্যেক পিতার কাছে।

প্রিয় সাধারণ নাগরিক,
অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে যে, যেহেতু যুদ্ধ থেকেই আমাদের জন্ম, সেহেতু আমরা সকলই জন্মগতভাবে যোদ্ধা। আর আমরা অনেক যুদ্ধের রক্তাভ সেতু পার হয়ে আজকের এই সুখের শহর পেয়েছি। আগামীতে অনেক যুদ্ধ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এজন্য আমাদের সহস্র সৈনিক প্রয়োজন। অনেক সৈনিক। আমরা জেনেশুনেই এই চিঠি আপনার কাছে লিখছি যে, আপনার একুশে পা রাখা সন্তান সৈনিক পদে আবেদন করুক আর আপনার পরিবার একটা সেনা পরিবার হয়ে উঠুক। আশা করি সরকারের এই সুযোগ আপনি সাদরে অভ্যার্থনা জানাবেন এবং আপনার একুশ বছরে পা রাখা সন্তানকে সৈনিক হতে প্রণোদিত করবেন।

ধন্যবাদান্তে
যুদ্ধ মন্ত্রণালয়

 

চিঠিটা পড়ে পিতা আবেগে আপ্লুত হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমাদের কাছে আসেন। চিঠির বার্তা উনি এমনভাবে পরিবারে প্রকাশ করলেন যেন আসমান থেকে ঈশ্বরের কোনো বাণী নাজিল হয়েছে আর উনি যেন থিবসের সেই অন্ধ-পয়গম্বর। সকলেই সেই বার্তায় অবগত হতে পেরে যেন খুব উচ্ছ্বসিত, তা তাদের মুখাবয়বের নির্বিকার প্রফুল্লতা দেখে বোঝা গেল। আমি তখনও জানালা দিয়ে ঝড়ের রাতটাকে দেখছিলাম, যে হুট করেই নৈঃশব্দের শহরটাকে কিছুটা হলেও মুখর করে তুলতে পেরেছে এবং আমাদের হাত থেকে কিছু সময় ছিনিয়ে নিয়ে ভেতরটাকে অধীর ও উন্মুখ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

‘কাল সকালে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সৈনিকের পরীক্ষা আছে তোমার।’ পিতা এরকম এক ঝড়ের রাতে আমার হাতে একটা লাল ফাইল গুঁজে দিয়ে পিতার মতোই কড়া গলায় বাক্যটা বলতে দ্বিধা করলেন না। ‘তোমাকে সৈনিক হতে হবে।’ মাতামহী কাতান শাড়ির আঁচলে করুণ কান্না মুছতে মুছতে ইশারায় বললেন। সহদর বোধের ভেতর সাহসের সিসা ঢালতে ঢালতে তীব্র ইশারা দিল। ‘আমার সৈনিক হতে ভালো লাগে না।’ আর এই ভয়ানক সত্যটা আমি নিময় ভঙ্গ করেই বললাম খুব উত্তেজনা-সমেত। মাতামহী আমার মুখ চেপে আটকাতে চাইলেন তার লাউপাতার মতো নরোম তুলতুলে করজোড়ে অনুরোধ করলেন। আর নিয়ম রক্ষা করবার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন, ‘তোমার স্বপ্নের কথা ভুলে আমাদের স্বপ্নের কথা একবার হলেও ভাবো’। পিতা পূর্বপুরুষের কোনো এক প্রায়শ্চিত্য আমার কাঁধে চাপিয়ে হারিয়ে যাওয়া গানের পাখিটাকে খুঁজতে ঝড়ের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে উধাও হয়ে গেলেন।

‘আমাকে মনে হয় আমার ইচ্ছেরোডেই ছেড়ে দেয়া তোমাদের উচিত। আমিই খুঁজে নেব আমার গতি ও গন্তব্য। সবকিছু প্রাকৃতিক নিয়মেই হতে দেয়া কি ঠিক নয়?’ আমি মাতামহীকে অনেক বুঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকলাম নিরন্তরের পালক মেলে সসীম সাহসের ভেতর। ‘সৈনিকের স্বপ্ন আমাদের জন্মগত স্বপ্ন। বলতে পারো আজন্মের স্বপ্ন। অথবা আমরা আজন্মকাল ধরে এই স্বপ্নের জন্মান্ধ সৈনিক। অথবা অনন্তকাল ধরে এই স্বপ্ন বয়ে যাচ্ছি পুরুষের পর পুরুষ ধরে। এর উপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যত-ভূগোল। আর তুমি বোধহয় সরকারি নিয়মের কথা ভুলে গেছ?’ ইশারা ভাষায় মাতামহী আমাকে আরেকবার ধৈর্যশীলভাবে বোঝানোর কসরত করেন। ‘মনে আছে? তুমি কথা বলার সাময়িক সনদ না নিয়েই তোমার জন্মদিনে নিয়ম ভঙ্গ করে কারাগারে মায়ের সঙ্গে সাক্ষাতে কথা বলেছ। এর জন্য তোমার বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি লেখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার এই কাজ করলে কী হতে পারে তা অবশ্যই তোমার ভালো জানা আছে?’ সহদর একটু রাগত গাম্ভীর্য-সমেত ইশারায় বলে প্রেসার সৃজনের কসরত করে। আমি আমার বেডরুমে নির্বিকার বসে থাকি। তারপর জানালাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ি কোনো এক সেকেলে সকালের জন্য। তখনও জানি না কোন কারণে মায়ের এই সুদীর্ঘ কারাবাস। কেবল পাশের ঘর থেকে পিতার দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি শুনে আসছি জন্মের পর থেকেই।

সেই সেকেলে সকালটা একঘেয়েমিভাবে উঠে দাঁড়াচ্ছে আমাদের যুদ্ধবাজ শহরাকাশে। পুরাতন জানালার রেলিং বেয়ে তারই কিঞ্চিত ঝিলিক এসে পড়ছে আমার চোখের পাতায়। আমিও আস্তে আস্তে চোখের পাতা মেলি। একটা আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসি। যেন সুদীর্ঘ শীতের পর কোনো এক রিক্ত ঋতু জেগে ওঠছে। আমার ভেতরে সেরকমই এক বেগানা বোধ হচ্ছে। আর তা আমি টেরও পাচ্ছি আমার চেতনাপ্রবাহে। আয়েশের বিছানা ছেড়ে সৈনিকের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিই। বাবা তার সেকেলে এইটটি ডিপোজিট মডেলের ভাঙা বাইকটা নিয়ে অপেক্ষার রোডে আমার জন্য অধীর ও উন্মুখ হয়ে আছেন। ‘ওখানে নিয়ম ভঙ্গ করিস না।’ যেতে যেতে মাতামহী আমাকে আরেকবার ইশারায় মনে করিয়ে দেন যাতে আমি ভুলে না যাই। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় বড় আপার অসুস্থ্য পাখিটার কদর্য কাতরতা কানে এলে নিজেকেও অসুস্থ্য পাখিটার মতো বোধ হতে থাকে। বাবার বাইকে আসতে আসতে মনের গর্ভাশয়ে ‘কেন আমি সৈনিক হব?’—এই প্রশ্নটা প্রসব হতে না হতেই আঁতুর ঘরে চিৎকার করতে করতে মরে যায়। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ঢুকে দেখি মানুষের আস্তাবল। হাজার হাজার তরুণ দীর্ঘ লাইনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। ব্লাক স্মিথের সামার যেন ঠিকরে পড়ছে উন্মুক্ত অন্তরিক্ষের নিচে বক্ষ চেতিয়ে ছড়িয়ে থাকা মাঠের অধরে। আমিও এসে লাইনে দাঁড়াই। আমাদের কপাল থেকে ঝরতি ঘামবৃষ্টি। আমরা যেন ভেজার ঝমর। তবু প্রত্যেকেই চাইছি,—আমরা যেন একেকজন সৈনিক হই। যদিও আমার সৈনিক হতে ভালো লাগে না। কামানের আওয়াজ মনে হয় মৃত্যুর অনুরণন। বাবা বারবার নিয়মগুলো ইশারায় বোঝালেন। আমি কেবল অবুঝ বাচ্চার মতো মাথা নেড়ে গেলাম যেন তার ইশারাগুলো বুঝেছি।

সৈনিকের পোশাকে কোনো এক মেজর মঞ্চে এলেন। কালো মাইক্রোফোনটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাত উঁচিয়ে উঁচিয়ে এদিক-ওদিক আঁকাবাঁকা করে বলে যাওয়ার জার্নি শুরু করলেন স্বানন্দে। যুদ্ধ একটা বিজ্ঞান। আমরা সেই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী অথবা অর্থী। এই নৈঃশব্দের শহরটাকে প্রতিবেশী দেশের ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষুরধার ক্ষুধা ও তীব্র তৃষ্ণা থেকে অবমুক্ত করতে আমাদের যুদ্ধ জানা প্রয়োজন। আর সেজন্যই আজ এখানে সমবেত হয়েছি। প্রকৃত সৈনিকরাই কেবল জানে কীভাবে যুদ্ধে জয়ী হতে হয়। আমরা সেই প্রকৃত সৈনিকদের নির্বাচিত করব আপনাদের আস্তাবল থেকে। যেভাবে সহিস তার আস্তাবল থেকে উৎকৃষ্ট অশ্ব নির্বাচন করে থাকে। আর যারা নির্বাচিত হবেন, তারাই পাবেন দেশের সার্বভৌম ও স্বাধীনতা রক্ষার মতো মহতী দায়িত্ব এবং তারা ও তাদের পরিবারবর্গ হবেন সেইসব সৌভাগ্যবান নাগরিক, যারা কথা বলবার অনুমোদন-সমেত সরকারি সমূহ সুযোগ-সুবিধার আওতাভূক্ত হবেন। এইসব কথা আমাদের উদ্দেশ্যে বলতে বলতে মেজর ও তার সঙ্গীরা অতিশয় উল্লাসে উড়াল দৃশ্যের আবহ তৈরি করলে আমাদের প্রাচীন সৈনিকরা থোকা থোকা বারুদের ফুল ফোটায়। অচেনা দিগন্তের দিকে তাক করা কামানগুলো সমহিমায় কেঁপে কেঁপে উঠে। আর বিউগেলগুলো বিপুলভাবে বেজে উঠে করুণ সুরে। বারুদের ফুলের গন্ধ, আমাদের ঘামের গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাদের বুনো উল্লাসে আমরাও যে উচ্ছ¡সিত তা প্রমাণ করবার জন্য আমাদেরও উল্লাসের ইশারায় উপচে পড়তে হয়। যদিও এইসবে মন সায় দিচ্ছে না আমার। তবুও এমনভাবে এসব করতে হচ্ছে যেন জেরুজালেমে যিশু ক্রশবিদ্ধ হচ্ছেন।

প্রথমে আমাদের ভাষা যাচাই করা হলো এজন্যে যে, আমরা অন্যজাতের কি না। আমাদের ধমনিতে আর্যের রক্ত ছাড়া আর কোন কোন জাতির রক্ত প্রবাহমান। এরপর আমাদের লেখাপড়ার সনদসমূহ যাচাই করা হলো। আর যাচাইকারী আমার সনদের অর্জিত ফলগুলো দেখে খুব তুষ্ট হলেন। ‘খুব ভালো’ বলেই পিঠ চাপড়ে পরবর্তী পরীক্ষকের কাছে পাঠালেন। এরপর আমাদের উচ্চতা মেপে শারীরিক সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য একশ মিটার রেসের ব্যবস্থা করা হলো। যদিও আমি একটু স্থূল ছিলাম কিন্তু পরিবারের কথা ভাবতেই যেন উচ্চতা বেড়ে গেল আমার। আর আমি যখন রেসে দৌড়াচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল মায়ের একজোড়া করুণ চোখ সম্মুখে অপেক্ষমান এবং সেই নিস্প্রভ চোখে আমাকে বিপুল বিভার ফুল হয়ে ফুটতে হবে। এভাবেই এখানেও আমি প্রথম স্থানে উত্তীর্ণ হয়ে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য সেনা হাসপাতালের রিসিপশনে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। এখানকার কর্মরত অফিসারগণ পরস্পরের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। কেবল আমরা তাদের ভেতর নৈঃশব্দের ঝর্ণার মতো গড়িয়ে পড়ছি একে-অপরের চোখব্যাপী। আমাদের করুণ ও ক্লেদাক্ত মুখাবয়বগুলো তাকিয়ে আছে কোনো এক স্বর্ণাভ সৈনিক সনদের দিকে।

এক এক করে আমাদের ব্লাড ও ইউরিন নেয়া হলো প্যাথলজিকাল নিয়মে। তারপর আমাদের সম্পূর্ণ শরীর স্ক্যান করে চূড়ান্ত ফলের জন্য সেনা অউিটরিয়ামে অপেক্ষা করতে বলা হলো। আমরা বিগত যুদ্ধসমূহে শহীদদের ভাস্কর্য ডিঙে ‘যুদ্ধ থেকেই আমাদের জন্ম, আমরা জন্মগতভাবেই যোদ্ধা’ পাথরে খোদাই করা ফলকের বড় বড় অক্ষরের মিথ্যে মিথ পড়তে পড়তে অডিটরিয়ামে প্রবেশ করলাম। অজস্র করতালি ও ফুলের সৌরভে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণদের বরণ করে হাতে হাতে গুঁজে দেয়া হলো সেইসব স্বর্ণাভ সৈনিকের সনদ। এইদিন থেকে আমি কেবল কামান ও বন্দুকের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই ভালোবাসতে শিখিনি। এরপর থেকে পরিবারের সকলেই ‘সেনা পরিবার’ লোগো সম্বলিত ইউনিফরমের ভেতর আমাদের অতীত হারিয়ে ফেলি। আর আমরা ভুলে যেতে থাকি আমাদের প্রাচীন দুঃখ-দৈন্যতা। কেবল কারাগারের অন্ধকারে মায়ের নিস্প্রভ মুখাবয়ব ছাড়া। আমরা কোথাও গেলে সকলেই আমাদের দিকে খুব কৌতূহলভরে তাকাচ্ছে। এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন কোনোদিন আমাদের দেখেনি। অথবা আমরা কোনো ভিনগ্রহ থেকে ভুল করে চলে আসা কয়েকটা এলিয়েন। শপিঙমল থেকে মুদির দোকান অব্দি অনেক কেনাকাটা করলেও কেউ আমাদের কাছে সেবা ও দ্রব্যের দাম নিল না। আমরা হাজার জোরাজুরি করলেও নিল না। এমনকি বাসে যাতায়াতের বেলাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে আমরা আরো আশ্চর্যের ফুল হয়ে ফুটতে শুরু করলাম থোকা থোকা।

 

সুদীর্ঘ ট্রেনিঙের পর আমাকে পাঠানো হলো কোনো এক অজানার যুদ্ধে। যুদ্ধে যাবার আগে না ফেরা সৈনিকদের কথা ভেবে মাতামহী কাতান শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন আর আমার কপালে ক্রশচিহ্নের মতো চুমু এঁকে দেন। পিতা পিতামহের স্প্যানিশ বেহালার বদলে আমার হাতে তুলে দেন সরকারি দপ্তর থেকে দেয়া কালো বন্দুকটা। আর পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে ‘যুদ্ধ থেকেই আমাদের জন্ম, আমরা জন্মগতভাবেই যোদ্ধা’ সেই অডিটরিয়ামে প্রবেশ-পথের উপরে পাথরের ফলকে খোদাই করা মিথ্যে মিথ স্মরণ করিয়ে দিতে দিতে ‘বিদায়’ বলতে কুণ্ঠিত হলেন না। কোনো এক অজানার যুদ্ধে শহীদ হবার কিছুদিন আগে জানতে পারি, ধর্ষিত হবার সময় মা রাষ্ট্রের নিয়ম ভঙ্গ করে শিৎকারের বদলে চিৎকার দিয়ে প্রতিবাদ করেছিল বলেই মায়ের সুদীর্ঘ কারাবাস।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত