ফিদেল কাস্ত্রো : বিপ্লবের এক সফল নায়ক
রাহাতুল ইসলাম রাফি
১৩ আগস্ট ১৯২৬। সেদিন পূর্বদিকে উঠা সূর্যটা কিউবা নামক দেশটাকে বোধ হয় একটু বেশিই আলোকিত করেছিলো বলে। আখচাষী পিতার উদ্বাস্তু পরিবারে জন্ম নেন ‘সমাজতন্ত্রের প্রবাদপুরুষ’ খ্যাত বিপ্লবী আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো রুৎজের। যাকে পৃথিবীর মানুষ ফিদেল কাস্ত্রো নামে চেনে।
বিপ্লবের অগ্নিশিখা মাথায় নিয়ে জন্মানো কাস্ত্রোর শিক্ষা জীবন শুরু হয় স্যান্টিয়াগোর এক ক্যাথলিক স্কুলে। কলেজ জীবন পার করেন হাভানা শহরের এল-কলেজিও ডে বেলেন নামক এক প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু, লেখাপড়ার চাইতে খেলাধুলোতেই বেশি ঝোঁক ছিলো কাস্ত্রোর। ঝোঁক থাকলেই কি হয় সব? তবে তো এই কাস্ত্রো ‘পুঁজিবাদের আখড়া’ খ্যাত মার্কিনিদের নাকের ডগায় বসে বিপ্লবের ঝাণ্ডা উড়োনোর কথা না!
এই কাস্ত্রোর সুযোগ ছিলো ঘোর পুঁজিবাদী হয়ে যাবার। সুযোগ ছিলো কিউবার লাগামহীন পুঁজিবাদের অংশ হয়ে জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপনের। এই সুযোগ-সুযোগ করছি যেই গপ্পকে পুঁজি করে, সেটাই শোনাই অল্প কথায়- ১৯৪৮ সালে কাস্ত্রো বিয়ে করেছিলেন কিউবার অভিজাত শ্রেণীর এক রাজনীতিবিদের কন্যাকে। সুযোগ ছিলো স্ত্রী-পক্ষীয় সংস্কৃতিতে অনায়েসেই গা-ভাসানোর, সুখ নিংড়ে জীবনটা কাটানোর; কিন্তু তার বদলে তার রক্তে মিশে যায় মার্ক্সবাদের নেশা। বিপ্লবীরা হয়তো এমনই হয়- খানিকটা অন্যরকম। সব জায়গায় গা-ভাসে না তাদের!
কিউবা তখন উন্মার্গ-উচ্ছৃঙ্খল পুঁজিবাদী ধনীদের হাতের মুঠোয় বন্দি। মদ, নেশা, অবাধ যৌন ব্যবসা থেকে শুরু করে সব অনাচারই যেন কিউবাকে আকড়ে ধরেছিলো কালো আলখাল্লা গায়ে অশুভ কোনও এক শরীরী আত্মা হয়ে যায়।
১৯৫২ সাল। কিউবা তখন কার্লোস প্রিয়রের শাসনাধীন। এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রিয়রকে ক্ষমতাচ্যুত করে কিউবার লাগাম হাতে নেন পুঁজিবাদে বিশ্বাসী মার্কিন-ভ্রার্তৃপ্রতিম প্রেসিডেন্ট ফুলেগেন্সিও বাতিস্তা।
এদিকে, ১৯৫২ সালে দলীয় কংগ্রেসের সদস্য প্রার্থী হয়েছিলেন কাস্ত্রো। কিন্তু, ঘটলো তো উলটো কিছু!
পিপলস পার্টির বিজয়ের সম্ভাবনা থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে জেনারেল বাতিস্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করে নেয় । লাউয়ের বদলে অন্যকিছু আসলো কিউবার গদিতে, যার নাম আবার ‘কদু’। ঘুরেফিরে আবার সেই অমানবিক পুঁজিবাদ!
কাস্ত্রোর বুঝতে দেরি হলো না যে, কিউবার লাগামহীন পুঁজিবাদের কালো স্রোত দেশটির যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যার মূল কারণ। তার বিশ্বাসই ছিলো -একমাত্র জনগণের বিপ্লবেই কিউবাকে এসব থেকে বের করে আনতে পারে। বাতিস্তা সরকারের পতনের অভিপ্রায়ে ‘দ্য মুভমেন্ট’ নামক একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন ক্যাস্ট্রো। বিপ্লব তো আর এমনিতে হয় না; বিপ্লবের আগুনে ঘি ঢালবার জন্য প্রয়োজন অস্ত্রের। তাই সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩-র জুলাই মাসে সান্টিয়াগোর কাছে মোনাকাডা সেনা ছাউনিতে একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন কাস্ত্রো।
এই ব্যর্থ পরিকল্পনায় নিহত হয় বহু বিপ্লবী, আটক হয় আরও অনেকে। কাস্ত্রোও বাদ যাননি; তাকেও পরতে হয়েছিলো হাতকড়া, যেতে হয়েছিলো আইন-আদালত-বিচারের মধ্য দিয়ে। তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলো আদালত।
বাতিস্তা সরকার ১৯৫৫ সালে এক সাধারণ ক্ষমার মধ্য দিয়ে কাস্ত্রোর মুক্তি দেয়। মুক্তি পেয়েই কাস্ত্রো চলে যান মেক্সিকোতে। সেখানে তার পরিচয় হয় তরুণ বিপ্লবী আরনেস্তো চে গুয়েভারার সঙ্গে।
১৯৫৬ সালের নভেম্বরে ৮১ জন সশস্ত্র সঙ্গীকে নিয়ে নৌকায় করে কিউবায় ফিরে আসেন ফিদেল কাস্ত্রো। যেদিন কাস্ত্রো মেক্সিকো থেকে কিউবায় এসে পদার্পণ করেন, সেই দিনটি ছিল জুলাই মাসের ২৬ তারিখ। সেই অনুযায়ী তার আন্দোলনের নাম হয় ‘জুলাই টুয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট’। তারা সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে হাভানার সরকারের বিরুদ্ধে দু’বছর ধরে গেরিলা আক্রমণ চালান।
১৯৫৯ সালের দোসরা জানুয়ারি বিদ্রোহীরা হাভানায় প্রবেশ করে। বাতিস্তা পালিয়ে গেলে এসময় বাতিস্তার বহু সমর্থককে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যদিও এই বিচার কার্যক্রমকে অনেক বিদেশী পর্যবেক্ষকই ‘অনিরেপক্ষ’ বলে মনে করেন।
এরপরই কিউবার প্রথম সমাজতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী হন ফিদেন কাস্ত্রো। ১৯৭৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব সামলান তিনি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করে ভাই রাউল কাস্ত্রোকে দায়িত্ব দেন।
কাস্ত্রো একবার বলেছিলেন, “হত্যার চেষ্টা এড়িয়ে যাওয়ার যদি কোনও অলিম্পিক ইভেন্ট থাকত, তাহলে নির্ঘাত তাতে সোনা জিততাম আমি।” শুধু শুধু তো আর এমন বলেননি তিনি; এই বলার পেছনে আছে রোমাঞ্চকর গল্প। কাস্ত্রোকে হত্যা করবার জন্য মোট ৬৩৮ বার চেষ্টা করা হয়েছিলো। হ্যাঁ, ব্যাপারটা সত্যি। কখনও স্লো পয়েজনিং করতে তার জুতো ও চুরুটের মধ্যে বিষ রাখা হয়েছে। খাবারে বিষ মেশানোর চেষ্টা থেকে শুরু করে তার ব্যবহৃত কলমে বিষযুক্ত সূচ রেখে কিংবা পোশাকে জীবাণু ছড়িয়েও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিলো। আর এইসব ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তার নিরাপত্তারক্ষী ফ্যাবিয়ান অ্যাসকালান্টে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ-কে দিয়েই এই হত্যাচেষ্টা চালাতো। এই চেষ্টাগুলোর বেশির ভাগই করা হয়েছিল ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে। পাশাপাশি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ‘অপারেশন মঙ্গুজ’ নামে একটি ছক কষেছিল আমেরিকা। মার্কিনিরা কী না করেছিলো কাস্ত্রোকে দমানোর জন্য, কিন্তু পারেনি কখনো। ৪৯ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে আইসেন হাওয়ার থেকে বারাক ওবামা মোট ১১ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের শাসনকাল দেখেছেন ফিদেল। কিন্তু তাকে সরাতে পারেননি কেউই। ফিদেলের অবসরের পরও কিউবা শাসন করছে তারই প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টি।
বিপ্লবী ক্যাস্ট্রো ১৯৬০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ৪ ঘণ্টা ২৯ মিনিট ভাষণ দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের অধিবেশনে সবচেয়ে দীর্ঘ ভাষণ দেওয়ার রেকর্ড তার দখলে।
কিউবার মানুষককে তাদের নিজের দেশ ফিরিয়ে দিয়ে ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুকে বুকে টেনে নিয়ে দ্যা ফিদেল কাস্ত্রো পৃথিবী ছেড়েছিলেন ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর তারিখে। যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সমাজতান্ত্রিক কিউবা প্রতিষ্ঠাকারী এই কিংবদন্তি চলে গেছেন ঠিকই; কিন্তু রেখে গেছেন তার আদর্শে উজ্জীবিত হাজার হাজার কিউবানদের। গালে একরাশ দাড়ি এবং মুখে কিউবান চুরুট নিয়ে মার্কিন-মদদপুষ্ট বাতিস্তা সরকারের শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে কিউবাকে ফিদেল কাস্ত্রো দিয়েছেন নতুন এক অপার সম্ভাবনাময় জীবন। কিউবায় তার নামে কোনও রাস্তা নেই, কোনও মূর্তি নেই। থাকার কোনো প্রয়োজনও নেই। কারণ তার স্থান সবার হৃদয়ে।
ইতিহাস বিশ্লেষণে কাস্ত্রোকে সমাজবদলের লক্ষ্যে একজন নিবেদিত বিপ্লবী না স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? কিংবা মার্কিন মদদপুস্ট স্বৈরাচারী ফুলজেনসিও বাতিস্তা সরকারকে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে উৎখাত করে যে মানবিক-গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি তিনি কিউবার জনগণকে দিয়েছিলেন, তা গড়ে তুলতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন নাকি নিজেই পরিণত হয়েছিলেন বাতিস্তার মতো স্বৈরাচারী একনায়কে?- এমন প্রশ্ন রয়েই যায়। এইসব মতভেদপূর্ণ প্রশ্নের দিকে না যাওয়াটাই আমার পক্ষে সঠিক হবে বোধ করছি!
এত কিছুর পরও ফিদেল কাস্ত্রো শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্নে বিভোর মানুষের জন্য এক কিংবদন্তি, অনুসরণীয় নেতা।