Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,First meeting with Binoy Majumdar

বিনয় মজুমদারের সঙ্গে প্রথম দেখা । অমিতাভ পাল

Reading Time: 4 minutes
বিনয় মজুমদার

বিনয় মজুমদার ছবি: সংগৃহীত

এনজিওর কোনো চাকরিজীবী আমার মতো জীবন যাপন করলে যা হয়, আমারও তাই হলো। চাকরিচ্যুত হয়ে আবার ফিরে এলাম ঢাকায়। তবে একটা লাভ হয়েছিল এতে, বড় লাভ, সারা জীবনের জন্য বিদায় নিয়েছিল চাকরি করে উন্নতি করার মোহ।
তবে বেশি দিন চাকরির বাইরে থাকতে পারিনি সেবার। প্রশিকার মুখ্য ব্যক্তি আমার ক্রিকেট দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে আবার আমাকে ফিরিয়ে নেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে। শুধু তা-ই না, আমার একটা বিদেশ সফরেরও ব্যবস্থা হয়। সেই বিদেশ সফর থেকে ফিরেই রিফাত চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় বিনয় মজুমদারের সঙ্গে সশরীরে দেখা হয় আমার।
সেটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে ছেউড়িয়ার লালন উৎসবের সময়। পাতাভরা সেই অভিযানের গল্প লিখেছিলামও ‘সমকাল’-এর কালের খেয়ায়। সেই দেখাটা ছিল বিনয় মজুমদারের সঙ্গে আমার সখ্যের চরমতম বিন্দু। আমি টের পেয়েছিলাম, এর চেয়ে বেশি আর কিছুই হতে পারে না।
দুই.
বিনয় মজুমদারের প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে—দুর্লভ কবির এটা থাকে। ভাবনার মধ্যে ঢুকে পড়ার শক্তিসহ এই কবি সহজ ভাড়াটিয়া না। বিভিন্ন মতামত ও ভাবনার বিভিন্নতা থাকতেই পারে, কবি সার্বভৌম সহজ ব্যাপার না—এমনকি অসম্ভবই। তারপরও যাঁদের দেখা যায় লাইটপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে, বিনয় তাঁদের মতো।

লোকটা প্রেম করতে জানতেন।
বিনয় মজুমদারের প্রেম ছিল নারী, অঙ্ক আর কবিতার সঙ্গে। তিনজনকে নিয়ে ঘর করা এই কবি সম্পর্ক সামলেছেন সুবিপুল দক্ষতায়। প্রেমের স্বপ্ন কীভাবে দেখতে হয়, দেখিয়েছেন বিনয় মজুমদার। তবে তাঁর সঙ্গে সখ্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মতো করে প্রেমটাকে শিখতে পারিনি আমি। এটা অবশ্য তাঁরই দান—প্রত্যেকের নিজের কবিতার মতো আমার প্রেমবোধও আমারই।

বিনয় মজুমদারের প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে—দুর্লভ কবির এটা থাকে। ভাবনার মধ্যে ঢুকে পড়ার শক্তিসহ এই কবি সহজ ভাড়াটিয়া না। বিভিন্ন মতামত ও ভাবনার বিভিন্নতা থাকতেই পারে, কবি সার্বভৌম সহজ ব্যাপার না—এমনকি অসম্ভবই। তারপরও যাঁদের দেখা যায় লাইটপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে, বিনয় তাঁদের মতো।

বিনয় মজুমদার আমাকে চমকে দিয়েছিলেন তাঁর উপমার শক্তি দিয়ে। এমন অভাবিত, আকস্মিক আর কাছাকাছি উপমা জীবনানন্দ দাশের পরে আর খুব একটা পাইনি। আর কী অসম্ভব সেই উপমার স্ফুরণ—আ্যানেস্থেসিয়ার মতো আচ্ছন্ন করে ফেলে। বিনয় মজুমদারের কবিতা পড়ার পরে আমি বহুদিন অন্যদের কবিতায় মন দিতে পারতাম না। তাঁর কবিতার স্বাচ্ছন্দ্যও ‘ডিস্টিলড’—যেকোনো কাজে লাগানো যায় এই পরিশুদ্ধ জল।
যেকোনো কিছুই যে কবিতার বিষয় হতে পারে, সেটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন এই গণিতজ্ঞ কবি। মিরোস্লাভ হোলুব বা নিকানর পাররার মতো এই কবিও বাংলা কবিতার প্রথম অ্যান্টি পোয়েট বলে আমার মনে হয়। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়, বাংলা ভাষায় বিনয় মজুমদার জীবনানন্দের মতোই দুর্লভ।

‘ফিরে এসো, চাকা’র প্রচ্ছদ

‘ফিরে এসো, চাকা’র প্রচ্ছদ

বিনয়ের যেকোনো কবিতাই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি রেখে যায় পরের কবিতাটারও ইঙ্গিত। অর্থাৎ তাঁর সব কবিতাই একটা সিরিজের খণ্ডও যেন। প্রাণ যেমন নিজে সম্পূর্ণ ও জীবনের বিভিন্ন ফর্মের যোগসূত্র, বিনয় মজুমদারের কবিতাও সে রকম। প্রাণ এবং তার আকারগত উদাহরণের মধ্যে সামঞ্জস্যগুলো যেমন বুঝিয়ে দেয় এরা সব একেরই বিভিন্ন প্রকাশ, তেমনি বিনয় মজুমদারের কবিতাও বলে দেয় এরা বিনয়েরই কবিতা। অন্য কেউ বা অন্য কিছুই নেই এর মধ্যে। কবি হিসেবে বিনয় মজুমদারের অন্যতম মহত্ত্ব এটি। ঈশ্বরের মহত্ত্বের মতো যাতে থাকে সৃষ্টিতে নিজের ছাপ রেখে দেওয়ার ক্ষমতা। কবিতার ঈশ্বর বিনয় মজুমদার তাই বোধ হয় লিখতে পারেন তাঁর ঈশ্বরীকে নিয়ে কবিতার বই।
বাংলা কবিতায় দিনপঞ্জি ধরনেরও উদগাতা মনে হয় বিনয় মজুমদার। প্রতিদিনের ঘটনাকে সাধারণীকরণ করার কৌশল তিনি প্রয়োগ করেছেন এই ধরনের কবিতায়। ফলে যেকোনো ঘটনাই হয়ে পড়ে বিশ্বের ঘটনা, সমগ্রতার চিহ্ন। এটা বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য, অঙ্কের বিজ্ঞান ঘাঁটা বিনয় মজুমদার এই দানও করেছেন বাংলা কবিতায়।

তিন.
কবি নিজে মহাসময়ের কথা ভাবেন। আর মহাসময়ের গ্রাফে মানববোধ সারাক্ষণ লাফালাফি করে—কখনো মাটি ছোঁয় তো কখনো আকাশ। এর মাঝখান দিয়েই কবির পথচলা। সব কবির, সব কবিতার। এর ফলে স্থানীয় বর্তমান যেমন এঁদের স্পর্শ করে, অতীত ও ভবিষ্যতেও এঁদের নাগালজুড়েই থাকে। তাই খণ্ডের মুক্তি মিললেও পূর্ণের মতো কবির মুক্তি নেই। কবিতাই তাঁকে বারবার দাঁড় করায় বিভিন্ন উচ্চতায়।
বিনয় মজুমদারের কবিতাকেও এভাবে বারবার দাঁড়াতে হবে বিভিন্ন উচ্চতায়। পরীক্ষিত হবেন, উজ্জ্বল হবেন, মলিন হবেন। কিন্তু উঠতে থাকবেন একঘেয়ে ও বেহায়া সূর্যের মতো। আলো দিতেই থাকবেন, দেখাতেই থাকবে তাঁর যা দেখানোর।
জন্মদিনে এই মহাকবিকে শ্রদ্ধা ছাড়া আর কিই-বা জানাতে পারি।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>