ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৪) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
কুলপীওলারা আসত গরমের দুপুরে।লাল শালুতে মোড়া তাদের হাঁড়িতে থাকত নানা আকারের টিনের তেকোনা কৌটোয় ভরা কুলপী।মাটিতে হাঁড়ি নামিয়ে হাতের কসরতে মোচড় দিয়ে কুলপী বার করত তারা।তারপর ছুরি দিয়ে কেটে শালপাতায় ছড়িয়ে দিয়ে,টুকরো আর একটি শালপাতা ওই কুলপী তোলার জন্য দিত। ঠান্ডা সেই জমাট ক্ষীরের স্বাদ দৈবাৎ জিভ স্পর্শ করত।কেননা সাধ্যের তুলনায় দাম বড় বেশি ছিল।সেটা আমরা ছোটরাও বুঝতুম। দুপুরে ঘুমন্ত মায়েদের ডেকে কুলপীওলার কথা বললে প্রায় সবসময়েই তারা পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়তেন।মাঝেমাঝে নিজেদের বা প্রতিবেশীদের কারোর বাড়িতে সদ্য বিবাহিত দিদিটি দু’একদিন কাটাতে এলে, তার কাছে কুলপী খাবার আবদার রাখা হত। বলাবাহুল্য পাড়ার সব বাচ্চারা সেখানে জড় হয়ে যেত।আর সে নতুন শাড়ির আঁচলে খস্খস্ আওয়াজ তুলে, নবলব্ধ স্বামীটির দেওয়া হাতখরচার টাকায়, সেই বায়না মেটাত।আজ এই বয়সে এসে তার সেই বিড়ম্বিত অথচ অহঙ্কারী মুখটি মনে পড়ে বড় লজ্জা হয়।আর আনন্দ হয় পাড়ার সবকটি বাড়ির অনাবিল আত্মীয়তার কথা মনে করে।
এরপরে বলি একটু বড় হয়ে দেখা মাছওয়ালিদের কথা।ময়না নামের একটি বউ মাথায় বয়ে আনা, টিনের গোল পাত্রে রাখা জ্যান্ত মৌরলা মাছের ঝাঁক নামাত উঠোনে।তার টিনের ওই মুখখোলা গোল পাত্রে কলবল করত চারা পোনার ঝাঁক। সেই মাছ দেখে আমরা উদাস হয়ে ভাবতাম আমরাও তো বর্ষাকালে,মাছওয়ালি হতে পারি। যখন নদী নালা ভেসে অনেক মাছ এধার ওধার করে, সেইসব মাছেদের ধরে ,এমন মাছওয়ালি হওয়া, খুব একটা শক্ত কাজও নয় তো।বিক্রিবাট্টার শেষে একটা দুটো মাছ মাটিতে গড়াগড়ি খেলে আমরা ধরে বাড়ির চৌবাচ্চায় ফেলতাম।বড়দের বকুনি বা কানমলার ভয় অনায়াসেই তুচ্ছ করতাম, ওতো ‘নিত্য বর্তমান’ ভেবে।
তখন বাড়িতেই মায়েরা কিনতেন কাতলা ,ছোট ভেটকি,অথবা চুনো মাছ।মাছ বিক্রি করত ময়নাবউ ।তার নাকে সোনার পাথর বসানো নাকছাবি, হাতে শাঁখা পলা। ওপরের হাতে সোনার মাদুলি কালো কারে বাঁধা। সে পান চিবোতে চিবোতে দরদাম করত। বেশি দামের জন্য মায়েরা “কিনব না” বললেও জোর করে সে ধারেই মাছ গছিয়ে যেত।
বাড়িতে প্রায় দুপুরেই আসা যাওয়া করত কাপড়উলিরা।তাদের গাঁটরিতে রাখা বাড়িতে পরার তাঁতের সস্তা ডুরে শাড়ি একটি দুটি নিতেন মায়েরা। সেটার নাম ছিল বারোমাসের শাড়ি।তখন ঘরে ঘরে ওই ‘বাড়িতে পরার শাড়ির’ খুব কদর ছিল। তাছাড়াও শাড়ি, উপহার দেবার জন্য,পুজো পার্বণে পরার জন্য কেনা হত। সবমিলিয়ে ওই দুপুরের বাজার বেশ জমে উঠত।কোন কোন মহিলারা সামর্থ্য না থাকায় কিছুই না কিনে,শুধু নেড়েচেড়ে সাধ মেটাতেন।তারা না কিনে চলে গেলে কোন কোন অহঙ্কারী মহিলার তাদের সম্বন্ধে করা ছোটখাটো ব্যাঙ্গোক্তি বলাবাহুল্য, আমাদের মত ছোটদের কান এড়াত না।মুখ বেঁকিয়ে যারা তাদের উদ্দেশ্যে বলতেন, “ঢং, নিবি না তো দেখছিস কেন?” তাদের চেয়ে অসময়ে খালি হাতে উঠে যাওয়া মা কাকিমাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি ছিল বেশি। বোধহয় নিজেদের নিরুপায়তার আয়নায়, তাদের অসহায় অবস্থাকে সহজেই চিনে নেওয়া যেত। বড়দের ওই অকারণ নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করা যেত না।তবে অপছন্দের তালিকায় আমরা মনেমনে সেই মুখবেঁকানো মহিলাদের নাম তুলে নিতাম।
আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৩) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
পুরো কেনাকাটিই হত মহিলামহলে।অফিস করা পুরুষমানুষেরা সেখানে থাকতেন না।আর ছুটির দিনে তারা কখনওই আসত না।আমাদের মত ছোটদের ব্যবহার করা হত শুধুমাত্র ডাকাডাকি করে বিক্রেতাকে ধরে আনার জন্য।তারপরেই বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে, ছোটদের, ওই বড়দের আসর থেকে চলে যেতে বলা হত।
তবু তারই মাঝে আমরা মা ,কাকিমা বা পিসিদের গা ঘেঁসে ওই মহিলামহলে যোগ দিতাম, থাকতাম । বারবার বিতাড়িত হতে হতে আমাদের চক্ষুলজ্জা ফিকে হয়ে গিয়েছিল।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।