এহেন রবিঠাকুরের খাইতুড়কেপনা ছিল সর্বজনবিদিত। যা বারেবারে উঠে এসেছে বিভিন্ন সাহিত্যিকের লেখায়। আসলে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে রান্নাবান্না নিয়ে নিত্যনতুন অভিনব সব গবেষণা, নব উদ্ভাবিত খাদ্য পরিবেশনা সব মিলিয়ে এক অভিজাত পরিপাটি…আমাদের রবিকবি সে নেশা থেকে কি আর বঞ্চিত হবেন? মেয়েদের নিত্য নৈমিত্তিক গবেষণার সাক্ষী থেকে নিজের রসনা তৃপ্তিতেও প্রবল উৎসাহী ছিলেন কবি। গ্যাস্ট্রোনমিক ফুর্তিতে তিনিও আমাদেরই মত সুখ ঢেঁকুর তুলতেন বৈকি।
তাঁর আহার সম্পর্কে বনফুলের লেখায় পাই…
‘ভৃত্য নীলমণি বেশ বড়ো একটা কাঁসার থালা এনে রবীন্দ্রনাথের সামনে রাখল। থালার ঠিক মাঝখানে একটা রুপোর বাটি উপুড় করা। আর তার চার পাশে নানা রকমের কাটা ফল গোল করে সাজানো। কাটা ফলের ফাঁকে ফাঁকে গুঁড়ো গুঁড়ো কী সব ছড়ানো। প্রাতরাশের এই অদ্ভুত সজ্জা দেখে আমি তো অবাক। বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে গেল যখন রবীন্দ্রনাথ আস্তে করে রুপোর বাটিটা তুলে ফেললেন আর তার ভেতর থেকে ওই বাটির মাপের সাদা জমানো একটা জিনিস বেরিয়ে পড়ল। জিনিসটা কী জানতে চাইতেই রবীন্দ্রনাথ বললেন, ক্রিম। আর এগুলো নানা রকমের ফল, বাদাম, ডাল ভেজানো, খাবে তুমি? আমি খাইনি। তবে লক্ষ করেছিলাম তাঁর দীর্ঘ প্রাতরাশ।‘
কবির বৈকালিক আহারের একটা নমুনা মেলে প্রমথনাথ বিশীর স্মৃতিকথায়-
‘তখন তিনি বৈকালিক জলযোগে বসিয়াছেন -সময় নির্বাচনটা হয়তো একেবারে আকস্মিক ছিল না। কবিতাটি লইয়া গিয়া তাঁহার হাতে দিলাম। তিনি এক পলকে পড়িয়া লইয়া হাসিলেন। তারপর এক প্লেট ‘পুডিং’ আমার হাতে তুলিয়া দিলেন। ‘পুডিং’ অতি উপাদেয় খাদ্য সন্দেহ নাই; কিন্তু হায়, আমি কি ইহার জন্য আসিয়াছি? আমি কি ইহার জন্যই সর্পসংকুল বল্মীকস্তূপের পাশে বসিয়া দুপুর রোদে ঘামিতে ঘামিতে কবিতা লিখিয়াছি। পুডিং শেষ করিলাম। কিন্তু কই, প্রশংসা তো করিলেন না। আমি উসখুস করিতেছি দেখিয়া আরো রসপিপাসু মনে করিয়া এক প্লেট আনারস দিলেন।‘
সত্তর বছর বয়সে পারস্য ভ্রমণে বেরিয়ে একজন বেদুইন দলপতির তাঁবুতে কবির নিমন্ত্রণ ছিল। প্রথমে ভেবেছিলেন, ‘শরীরের প্রতি করুণা করে না যাওয়াই ভালো।‘ পরে ভাবলেন, তিরিশ বছর বয়সে আস্ফালন করে লিখেছিলেন, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন। কবিতাটিকে কিছু পরিমাণে পরখ না করলে পরিতাপ থাকবে।‘ গাড়ি চলল মরুভুমির উপর দিয়ে, তবে বালুময় নয়, শক্ত মাটি। অনেক দূর পেরিয়ে এদের ক্যাম্পে পৌঁছোলেন। মস্ত মাটির ঘরে বসার ব্যবস্থা। বেশ ঠাণ্ডা। মেঝেতে কার্পেট, এক প্রান্তে তক্তপোশের উপর গদি পাতা। শুরু হল আপ্যায়ন– ‘ছোটো আয়তনের পেয়ালা আমাদের হাতে দিয়ে অল্প একটু করে কফি ঢাললে, ঘন কফি, কালো তেতো। দলপতি জিজ্ঞাসা করলেন, আহার ইচ্ছা করি কি না। ‘না’ বললে আনবার রীতি নয়। ইচ্ছে করলেম, অন্তরে তাগিদও ছিল।… অবশেষে চিলিম্চি ও জলপাত্র এল। সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে প্রস্তুত হয়ে বসলুম। মেঝের উপর জাজিম পেতে দিল। পূর্ণচন্দ্রের ডবল আকারের মোটা মোটা রুটি, হাতওয়ালা অতি প্রচণ্ড পিতলের থালায় ভাতের পর্বত আর তার উপর মস্ত ও আস্ত একটা সিদ্ধ ভেড়া।… আহারার্থীরা সব বসল থালা ঘিরে। সেই এক থালা থেকে হাতে করে মুঠো মুঠো ভাত প্লেটে তুলে নিয়ে আর মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল। ঘোল দিয়ে গেল পানীয় রূপে।‘
সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের কথায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভোজনবিলাসী, ভোজনরসিক। নানা রকমের খাবার খেতে, খাবার খাওয়াতে এবং খাবার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন। নানা জনের স্মৃতিকথা থেকে এ সংক্রান্ত নানা তথ্য পাওয়া যায়। যেমন মার্মালেড দিয়ে ছাতু। মার্মালেড, গোল্ডেন সিরাপ, আদার রস, দুধ, কলা, মাখন ইত্যাদি দিয়ে আধ ঘণ্টা ধরে ছাতু মাখতেন, নিজে খেতেন, অন্যকে খাওয়াতেন। বেশ গর্ব করেই মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছিলেন, ‘এক সময় ভালো ছাতু মাখিয়ে বলে আমার নাম ছিল। মেজদার টেবিলে ছাতু মাখতুম মার্মালেড দিয়ে।’
হিমানীশ গোস্বামী তাঁর অভিনব মজার অভিধান ‘অভিধানাইপানাই’-তে ‘Solar cooker’ এর বাংলা করেছিলেন রবি ঠাকুর! এখন মনে হচ্ছে তা যথার্থই সত্য।
রবীন্দ্রনাথ একবার তার ভক্ত আর ছাত্রছাত্রীদের সামনে গাইছেন, “হে মাধবী, দ্বিধা কেন?” তখন ভৃত্য বনমালী আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বনমালী ভাবছে ঘরে ঢুকবে কি ঢুকবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ গান গাইছেন, এ সময় বিরক্ত হবেন কি না কে জানে। গুরুদেব বনমালীর দিকে তাকিয়ে গাইলেন, “হে মাধবী, দ্বিধা কেন?আসিবে কি ফিরিবে কি–”
বনমালী আইসক্রিমের প্লেট গুরুদেবের সামনে রেখে লজ্জায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ পরক্ষণেই বললেন, “বনমালীকে যদিও মাধবী বলা চলে না। তবে তার দ্বিধা মাধবীর মতোই ছিল। আর আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে দ্বিধা করা মোটেই ভালো নয়।” এমন ছিল তাঁর ভোজন রসিকতা।
ঠাকুরবাড়িতে হরেক কিসিমের সব রান্নাবান্না হত সেযুগে। মেয়েদের এ বিষয়ে ছিল বিশেষ আগ্রহ এবং নিত্যনতুন গবেষণা। কাসুন্দি দিয়ে পাটপাতার ঝোল, ছোলা ও ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক, পুঁইমিটুলির চচ্চড়ি, রসুন দিয়ে সজনে শাকভাজা, কচি লাউয়ের ডগা দিয়ে মটর ডাল, মুসুর ডালের বড়া দিয়ে মোচাঘণ্ট, ডুমুর আলুর রসা, বকফুল আর পাটপাতার বড়া, কাঁচা ইলিশের ঝোল জাতীয় মহার্ঘ সব পদ রান্না হত বিশেষ উৎসবের দিনে ।
সেযুগে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা বিদ্যাচর্চা, হাতের কাজের নজির যেমন দেখিয়েছিলেন, তেমনি ঝুনি রাইয়ের ঝাল কাসুন্দি, আমসত্ত্ব, ফাইন করে কাটা নারকেল চিঁড়ে তৈরি করতেন অধ্যাবসায়ের সঙ্গে । রবির বৌঠান কাদম্বরীদেবীরও রান্না বিষয়ে যথেষ্ট মুনশিয়ানা ছিল।
রুপোর রেকাবিতে খোসা ছাড়ানো ফল, নিজের হাতে তৈরি মিষ্টি সাজানো হত গোলাপের পাপড়ি দিয়ে। গেলাসে থাকত ডাবের জল বা ফলের রস কিম্বা বরফে ঠান্ডা করা কচি তালশাঁস, সমস্তটার উপর একটা ফুলকাটা রেশমের রুমাল ঢেকে মোরাদাবাদি খুঞ্চেতে করে পাঠিয়ে দিতেন কাছারিতে।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরা দেবী নিজে কোনোদিন রান্নাঘরে ঢোকেননি, কিন্তু যে রান্নাই ভালো লাগতো, তখনই খাতায় টুকে রাখতেন। পূর্ণিমাদেবীর মা ছিলেন ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। তাঁর রান্নার প্রণালীও রয়েছে এই বইতে।
ঠাকুরবাড়ির আনাচে কানাচে লুকানো ছিল এমনি সব পরশপাথর। হয়তো তাই এই বাড়ির সদস্যরা যে শিল্প স্পর্শ করেছে, তা-ই সোনা হয়ে মুগ্ধ করেছে সকলকে। সেগুলিই আমাদের রান্নাঘরের তাকবাক হয়ে রয়ে গেছে।
ঠাকুরবাড়ির রান্নাবান্না ছিল সেযুগের এক ব্যতিক্রমী ঐতিহ্য। বিভিন্ন সময়ে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে থাকা শিক্ষকদের স্ত্রীরা অনেকটা প্রতিযোগিতা করে তার জন্য রান্না করতেন। প্রতিদিন সকালে উঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক গ্লাস নিমপাতার রস খেতেন। আশ্রমের শিক্ষক অনিল চন্দের স্ত্রী রানী চন্দ প্রায়ই রান্না করে আনতেন। পায়েস বা বাদামজাতীয় মিষ্টি রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন।
বিদুষী ইন্দিরাদেবীর বিদ্যাচর্চার কথা আমরা জানি। কিন্তু তাঁর একটি রান্নার খাতা ছিল। প্রমথ চৌধুরীর ভাই সুহৃৎনাথ চৌধুরী এবং দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে নলিনীদেবীর সন্তান পূর্ণিমা দেবী, পরবর্তীকালে যাঁর বিয়ে হয় সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। তিনি ইন্দিরাদেবীর সেই খাতাটি পেয়েছিলেন। পূর্ণিমা ঠাকুরের লেখা ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন
ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে।
উনিশ শতকের সব রহস্যময় পদ ছিল ‘দ্বারকানাথ ফির্নিপোলাও’, ‘কবিসম্বর্ধনা বরফি’ । এইসব অদ্ভুত নামের পদ উদ্ভাবন করেছিলেন কবি ভাইঝি প্রজ্ঞাসুন্দরী।
প্রজ্ঞাসন্দরীর মতে ” অনুপানের গুণে যেমন ঔষধির গুণ হয় , সৈন্যের গুণে সেনাপতির খ্যাতি বর্ধিত হয়, সেইরূপ আনুষাঙ্গিক খাদ্যের গুণে প্রধান খাদ্য সমধিক রুচিকর হইয়া ওঠে। “
ভোজনবিলাসী আর প্রতিভাবান বাঙালির রান্না নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার শেষ ছিলনা। এক পরিবার ছিল বটে এই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি! শিল্প সাহিত্য চিত্রকলা… এসবের সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির চৌষট্টি কলার অন্যতম রন্ধনশিল্পেও এই পরিবারের সদস্যদের জাদু স্পর্শ ছিল। ঠাকুরবাড়ির হেঁশেলে ‘রামমোহন দোলমা পোলাও’, ‘দ্বারকানাথ ফির্নিপোলাও’, ‘কবিসম্বর্ধনা বরফি’ এইসব অদ্ভুত নামের পদ উদ্ভাবন করেছিলেন কবি ভাইঝি প্রজ্ঞাসুন্দরী।
প্রজ্ঞাসন্দরীর মতে ” অনুপানের গুণে যেমন ঔষধির গুণ হয় , সৈন্যের গুণে সেনাপতির খ্যাতি বর্ধিত হয়, সেইরূপ আনুষাঙ্গিক খাদ্যের গুণে প্রধান খাদ্য সমধিক রুচিকর হইয়া ওঠে। “
ভোজনবিলাসী আর প্রতিভাবান বাঙালির রান্না নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার শেষ ছিলনা।
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।