বাঙালির জীবনের চেতনায় রবীন্দ্রনাথ ভাবনা সেই ছোটো থেকেই আমাদের জারিত করে আসছে। ঠাকুরের লেখনীর সারল্যে, গদ্য, পদ্যের অতি সরল গ্রহণযোগ্যতায়। তাঁর নিজের জীবনযাপনের একান্ত মুহূর্তগুলি বানভাসি করেছে আমাদের শিশুতোষকাল। ।শিশু মন কে তিনি ছুঁতে পেরেছিলেন তা বলাই বাহুল্য। নিজের শিশুসুলভ সারল্য আমাদের মনে সঞ্চার করতে পেরেছিলেন বলেই না সেই মাধ্যমিক কালে পড়া জীবনস্মৃতির কবিতা এখনও আওড়াতে পারি?
নিজে ভোজনরসিক স্বভাবকবি না হলে অত ছোটবেলায় কেউ নয়ত এমন কবিতা লিখে ফেলে?
‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি
তাহাতে কদলি দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুসহুপুস শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে”
শিশুর প্রতি ভালোবাসায় ভরপুর ছিলেন তিনি। শিশুদের প্রতি যেন ছিল অনাবিল আস্থা। খাওয়াদাওয়া, হুটোপাটি সব অনুষঙ্গগুলোই যেন স্থান পেয়েছিল ছড়াতে।
রবিবাবুর বিখ্যাত সহজপাঠেরই কবিতাটা! “কাল ছিল ডাল খালি আজ ফুলে যায় ভরে / বল দেখি তুই মালী হয় সে কেমন করে” নিয়ে একটা মজার গল্প অনেকেই হয়ত জানেন।
নিজের খাওয়ার আয়োজনে আগের দিন রবিবাবু দেখেছিলেন শুধু ডাল আর ডাল! পরদিন দেখেন ফুলে ভরে গেছে! বক ফুল, কুমড়ো ফুল ইত্যাদি। অবাক হয়ে ভৃত্য বনমালীকে ডেকে তিনি বলেন- “বল দেখি তুই মালী, হয় সে কেমন করে!”
এভাবেই নাকি কবিতাটার জন্ম! এখন এ গল্প সত্যি কি মিথ্যে তাঁর বিচার করবেন রবীন্দ্র গবেষকগণ ।
সহজপাঠ প্রথম ভাগেই খাবারের ছড়াছড়ি-
“হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ / বসে খায় ক্ষীর খই”,
“বাটি হাতে এ ঐ / হাঁক দেয় দে দৈ”
“ডাক পাড়ে ও ঔ / ভাত আনো বড় বৌ”,
“ত থ দ ধ বলে, ভাই / আম পাড়ি চল যাই”।
প্রথম পাঠের সেই
“পাতু পাল আনে চাল”, “খুদিরাম পাড়ে জাম”, “দীননাথ রাঁধে ভাত”।
দ্বিতীয় পাঠে আছে-
থালা ভরা কৈ মাছ, বাটা মাছ। সরা ভরা চিনি ছানা। গাড়ি গাড়ি আসে শাক লাউ আলু কলা। ভারী আনে ঘড়া ঘড়া জল। মুটে আনে সরা খুরি কলাপাতা। রাতে হবে আলো। লাল বাতি। নীল বাতি। কত লোক খাবে।
তৃতীয় পাঠে আছে-
মামা আনে চাল ডাল। আর কেনে শাক। আর কেনে আটা। দাদা কেনে পাকা আতা, সাত আনা দিয়ে। আর, আখ আর জাম চার আনা। বাবা খাবে। কাকা খাবে। আর খাবে মামা। তার পরে কাজ আছে। বাবা কাজে যাবে। দাদা হাটে যায় টাকা হাতে। চার টাকা। মা বলে, খাজা চাই, গজা চাই, আর ছানা চাই। আশাদাদা খাবে।
চতুর্থ পাঠে আছে পাখির খাবারের কথা। অসুস্থ রাণীদিদি তাকে দানা খাওয়ায়-
“ও কী খায়? ও খায় দানা। রানীদিদি ওর বাটি ভ’রে আনে দানা।”
তার ঠিক পরের কবিতাতেই যত্ন করে বর্ণনা দেওয়া রয়েছে-
হরিমুদী বসেছে দোকানে।
চাল ডাল বেচে তেল নুন,
খয়ের সুপারি বেচে চুন,
ঢেঁকি পেতে ধান ভানে বুড়ী,
খোলা পেতে ভাজে খই মুড়ি।
বিধু গয়লানী মায়ে পোয়
সকাল বেলায় গোরু দোয়।
আঙিনায় কানাই বলাই
রাশি করে সরিষা কলাই।
পঞ্চম পাঠে আছে-
আজ বুধবার, ছুটি। নুটু তাই খুব খুসি। সেও যাবে কুলবনে। কিছু মুড়ি নেব আর নুন। চড়ি-ভাতি হবে। ঝুড়ি নিতে হবে। তাতে কুল ভ’রে নিয়ে বাড়ি যাব।
সপ্তম পাঠে দেখা যায় শৈলর পৈতের আয়োজনে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থায়
“ওরে কৈলাস দৈ চাই। ভালো ভৈষা দৈ আর কৈ মাছ। শৈল আজ খৈ দিয়ে দৈ মেখে খাবে।” নবম পাঠে আছে আবার মুখশুদ্ধির কথা- “গৌর, হাতে ঐ কৌটো কেন? ঐ কৌটো ভ’রে মৌরি রাখি। মৌরি খেলে ভালো থাকি।” শেষ হয়েছে আবার খাওয়া দিয়েই- “চলো, এবার খেতে চলো। সৌরিদিদি ভাত নিয়ে ব’সে আছে।”
এ যেন পড়তে পড়তে খাওয়া। কিম্বা খেতে খেতে পড়া। অথবা আহার, ওষুধ দুইই। প্রথম ভাগের সব উপাদেয় খাদ্যের বিবরণ কে আবার টেক্কা দেয় সহজ পাঠের দ্বিতীয় ভাগ। একেবারে রাজকীয় খাওয়া থেকে মাটির দাওয়ায় খাওয়া- সব আছে চমৎকারভাবে!
কুমোরপাড়ার গরুর গাড়িতেও বোঝাই করা খাবার সব। “উচ্ছে বেগুন পটল মূলো”, “সর্ষে ছোলা ময়দা আটা” , “কিংবা কলসি-ভরা এখো গুড়ে”।
তৃতীয় পাঠ-এর পঙ্গপালগুলো বেদম ছোঁচা- কপির পাতা খেয়ে একদম সাফ করে দিয়েছে! ঐখানে মা পুকুরপাড়ে কবিতায় দেখি খই খাওয়ার বেলা হরিণ আর ধান খাওয়ার বেলায় কাঠবিড়ালির একেবারেই অরুচি নেই-
আঁচলেতে খই নিয়ে তুই
যেই দাঁড়াবি দ্বারে
অম্নি যত বনের হরিণ
আসবে সারে সারে।
কাঠবেড়ালি ল্যাজটি তুলে
হাত থেকে ধান খাবে।’
‘পাখির ভোজ’ কবিতায় ?
‘ভোরে উঠেই পড়ে মনে,
মুড়ি খাবার নিমন্ত্রণে
আসবে শালিখ পাখি।
কিম্বা
খানিক পরেই একে একে জোটে পায়রাগুলো,
বুক ফুলিয়ে হেলে-দুলে খুঁটে খুঁটে ধুলো
খায় ছড়ানো ধান।
আবার ষষ্ঠ পাঠে আছে-
পথে যদি জল নামে মিশ্রদের বাড়ি আশ্রয় নেব। সঙ্গে খাবার আছে তো? সন্দেশ আছে, পান্তোয়া আছে, বোঁদে আছে। আমাদের কান্ত চাকর শীঘ্র কিছু খেয়ে নিক্। তার খাবার আগ্রহ দেখি নে। সে ভোরের বেলায় পান্তা ভাত খেয়ে বেরিয়েছে। তার বোন ক্ষান্তমণি তাকে খাইয়ে দিলে।
সপ্তম পাঠে রয়েছে বেশ আহ্লাদ করে রাঁধার তোড়জোড়-
” শ্রীশকে বোলো, তার শরীর যদি সুস্থ থাকে সে যেন বসন্তর দোকানে যায়। সেখান থেকে খাস্তা কচুরি আনা চাই। আর কিছু পেস্তা বাদাম কিনে আনতে হবে। দোকানের রাস্তা সে জানে তো? বাজারে একটা আস্ত কাতলা মাছ যদি পায়, নিয়ে আসে যেন। আর বস্তা থেকে গুন্তি ক’রে ত্রিশটা আলু আনা চাই। এবার আলু খুব সস্তা। একান্ত যদি না পাওয়া যায়, কিছু ওল অনিয়ে নিয়ো। রাস্তায় রেঁধে খেতে হবে, তার ব্যবস্থা করা দরকার। মনে রেখো— কড়া চাই, খুন্তি চাই জলের পাত্র একটা নিয়ো।
নোটো রাজমিস্ত্রীর কাঠফাটা রোদে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে করতে মন চলে যায় অন্যদিকে- “সুর ক’রে ঐ হাঁক দিয়ে যায়, আতাওয়ালা নিয়ে ফলের ঝোড়া।”
নবম পাঠের সেই চির পরিচিত ছেলে ভোলানো কৌশল?
“সঞ্জীবকে ব’লে দেব, তোমার জন্যে মিষ্টি লজঞ্চুস এনে দেবে।”
এমন কি দশম পাঠের মতো নিপাট বাঙালিয়ানা? “বাঞ্ছাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দাও। বাঞ্ছা শীঘ্র আমার জন্যে চা আনুক আর কিঞ্চিৎ বিস্কুট।”
আবার একাদশ পাঠে খাওয়ার বর্ণনাও চমৎকার । ঠিক যেন আমাদের রোববারের খাওয়া- “শক্তিবাবু বললেন, এইখানে একটু বিশ্রাম করি। সঙ্গে ছিল লুচি, আলুর দম আর পাঁঠার মাংস। তাই খেলেন। আক্রম খেলো চাট্নি দিয়ে রুটি।”
বনের মধ্যে পথ হারানো এই শক্তিবাবু আর আক্রমের নানা বিপদ পেরোনোর পর সমাপ্তিটাও মন ভালো করা-
“কাঠুরিয়ারা শক্তিবাবুকে আক্রমকে যত্ন ক’রে খেতে দিলে। তালপাতার ঠোঙায় এনে দিলে চিঁড়ে আর বনের মধু। আর দিলে ছাগলের দুধ। নদী থেকে ভাঁড়ে ক’রে এনে দিলে জল।”
ত্রয়োদশ পাঠে নিজের মেয়ের বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উদ্ধব বিশাল এক রুইমাছ ধরে ফেলে! পরে নানান টানাপোড়েনের পর কাত্যায়নী দেবীর কৃপায় পরদিন গোধূলিলগ্নে নিস্তারিণীর বিবাহের এলাহি ফিরিস্তি। পাঁচজন বাহক উদ্ধবের কুটীর প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত। কেউ বা এনেছে ঝুড়িতে মাছ, কেউ বা এনেছে হাঁড়িতে দই, কারও হাতে থালায় ভরা সন্দেশ।
বইয়ের পাতায় সহজপাঠ প্রথমভাগেই তো প্রথম মাছের সঙ্গে আমাদের হাতেখড়ি।
জলে থাকে মাছ। ডালে আছে ফল। মাছ জলে খেলা করে। খালে বক মাছ ধরে … এই করতে করতে সহজপাঠ দ্বিতীয়ভাগে মাছের সঙ্গে আলাপ অনুস্বর অধ্যায়ে। “কাংলা, তোর ঝুড়িতে কী? ঝুড়িতে আছে পালং শাক, পিড়িং শাক, ট্যাংরা মাছ, চিংড়ি মাছ। সংসারবাবুর মা চেয়েছেন”
এরপর ঔকারের অনুপ্রাস, যেখানে সৌরিদিদি ভাত নিয়ে ব’সে আছে। ঐ-যে জলে, যেখানে জেলে মৌরলা মাছ ধরে।
এর ফাঁকে ফাঁকে ঠাম্মাদের মুখে ছেলেভুলানো ছড়া
দুই দিকে দুই কাৎলা মাছ ভেসে উঠেছে
অথবা
মাছ ধরতে ক্ষীরনদীর কূলে। ছিপ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে, মাছ নিয়ে গেল চিলে
অথবা রবিঠাকুরের লোকসাহিত্যের ছেলে ভুলানো ছড়া?
ওরে আমার সোনা
এতখানি রাতে কেন বেহন-ধান ভানা।
বাড়িতে মানুষ এসেছে তিনজনা।
বাম মাছ রেঁধেলি শোলমাছের পোনা॥
পরে আবারো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় সেই মাছ।
“খেঁদুবাবুর এঁধো পুকুর, মাছ উঠেছে ভেসে
পদ্মমণি চচ্চড়িতে লঙ্কা দিল ঠেসে।’
জানেন কি? রবিঠাকুরের প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল পান্তাভাত আর চিংড়িমাছ ভাজা। তাঁর লেখা কবিতাতেও প্রচুর পাই এমন চিংড়ির কথা।
তিমি ওঠে গাঁ গাঁ করে
চিঁ চিঁ করে চিংড়ি
ইলিস বেহাগ ভাঁজে
যেন মধু নিংড়ি।
অথবা
মাছ এল সব কাৎলাপাড়া, খয়রাহাটি ঝেঁটিয়ে ,
মোটা মোটা চিংড়ি ওঠে পাঁকের তলা ঘেঁটিয়ে ।
উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। এক দশকের বেশী তাঁর লেখক জীবন। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায়। প্রথম উপন্যাস সানন্দা পুজোসংখ্যায়। এছাড়াও সব নামীদামী বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখে চলেছেন ভ্রমণকাহিনী, রম্যরচনা, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার। প্রিন্ট এবং ডিজিটাল উভয়েই লেখেন। এ যাবত প্রকাশিত উপন্যাস ৫ টি। প্রকাশিত গদ্যের বই ৭ টি। উল্লেখযোগ্য হল উপন্যাস কলাবতী কথা ( আনন্দ পাবলিশার্স) উপন্যাস ত্রিধারা ( ধানসিড়ি) কিশোর গল্প সংকলন চিন্তামণির থটশপ ( ধানসিড়ি) রম্যরচনা – স্বর্গীয় রমণীয় ( একুশ শতক) ভ্রমণকাহিনী – চরৈবেতি ( সৃষ্টিসুখ) ২০২০ তে প্রকাশিত দুটি নভেলা- কসমিক পুরাণ – (রবিপ্রকাশ) এবং কিংবদন্তীর হেঁশেল- (ধানসিড়ি)।অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।
খুব ভাল লিখেছ