| 24 এপ্রিল 2024
Categories
প্রযুক্তি ও বিস্ময়

ভুলো মনের বিজ্ঞানী ও তাঁদের গল্প । দীপঙ্কর বসু

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

অনেক বিজ্ঞানীর ভুলো মনের কথা সকলেই শুনেছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কৌতূহলও কম নেই। এমনই কয়েকজন বিজ্ঞানীর কথা বলব আজ।

রয়েন্টজেন

মধ্যাহ্নভোজনের খাবার নিয়ে বসে আছেন স্ত্রী বার্টা। বিখ্যাত বিজ্ঞানী এক্সরের আবিষ্কর্তা রয়েন্টজেনের দেখা নেই। পরিচারিকাকে পাঠালেন স্বামীকে ডেকে আনতে। অধ্যাপক খাবার গবেষণাগারে পাঠিয়ে দিতে বললেন। তাই করা হল। সন্ধ্যা নাগাদ পরিচারিকা আবার যখন ডাকতে এলো রয়েন্টজেন তখনও মধ্যাহ্নভোজন সারেননি। খাবার তেমনই ঢাকা পড়ে আছে। রয়েন্টজেন তখন অন্য জগতে। ভুলে গেছেন খাবার কথা।

আইজ্যাক নিউটন

খাবার খাওয়ার ব্যাপারে ভুল হয়েছিল সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনেরও। ঘটনাটি জানা গেছে ওনার বন্ধু থমাস মুরের লেখা থেকে। একদিন বন্ধুকে রাতে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু ভুলে গেলেন সে কথা। বন্ধু যথা সময়ে এসে দেখলেন নিউটন ব্যস্ত তাঁর কাজে। বসে রইলেন কখন বন্ধুর কাজ শেষ হয় তার প্রতিক্ষায়। ইতিমধ্যে একজন পরিচারক এসে খাবার টেবিলে রেখে গেলেন । একজনের খাবার। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পরে খিদে পাওয়ায় বন্ধুটি রেখে দেওয়া খাবারটি খেয়ে ফেললেন। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে নিউটন পরিচারককে বললেন খাবার আনতে। তারপর খালি প্লেট দেখে বন্ধুকে বললেন, “ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার খাওয়া হয়ে গেছে। এই খালি প্লেট চোখের সামনে না থাকলে আমি ভাবতাম আমার এখনো খাওয়াই হয়নি”। নিউটনের ভুলো মন নিয়ে আরো অনেক গল্প চালু আছে। ওনার ভুলো মনের কথা বলতে গিয়ে ওনার পরিচারিকা বলেছিলেন যে তিনি একদিন রান্নাঘরে নিউটনকে ডিম হাতে ধরে হাতের ঘড়ি জলে ফোটাতে দেখেছেন। জিজ্ঞাসা করায় নিউটন বলেছিলেন যে তিনি ডিম সেদ্ধ করছেন।

আর্কিমিডিস

ভুলো মনের বিজ্ঞানীদের তালিকায় আরেকটি অত্যন্ত পরিচিত নাম হল আর্কিমিডিস। কোনো বস্তুর ভাসবার  ক্ষমতা ও অপসারিত জলের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক বের করার আনন্দে ‘ইউরেকা, ইউরেকা’ বলতে বলতে নগ্ন অবস্থায় রাজপথে তাঁর দৌড়ে যাবার কথা প্রায় সকলেরই জানা আছে। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই যে নিবিষ্ট মনে অঙ্ক কষায় ব্যস্ত থাকায় এক রোমান সৈনিকের উপস্থিতিকে উপেক্ষা করেছিলেন তিনি। আর এর জন্যই মরতে হয়েছিল সেই সৈনিকের হাতে পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই বিজ্ঞানীকে।

থালেস

ভুলো মনের বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রাচীনতম নামটি হল স্বাধীন ও মুক্ত বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রবর্তক থালেস যিনি থাকতেন এশিয়া মাইনরের তখনকার ( খ্রিস্টপূর্ব ৬২৪ – ৫৪৭) বিখ্যাত নগর মাইলেটাসে। তখনকার যুগের সাতজন জ্ঞানী ব্যক্তির অন্যতম বলে গণ্য করা হত তাঁকে। থালেসের ভুলো মন নিয়ে যে গল্পটি আছে তা বেশ মজার। তারাদের পর্যবেক্ষণের জন্য একদিন এক পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন তিনি। বিস্তীর্ণ এক মাঠের উপর দিয়ে যেতে যেতে তারাদের দেখতে এমন বিভোর ছিলেন তিনি, ভুলে গিয়েছিলেন সামনে আছে এক গর্ত। পড়ে গেলেন গর্তে। পরিচারিকা গর্ত থেকে তাঁকে টেনে তুলতে তুলতে মন্তব্য করলেন, “কি করে আপনি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কথা জানবেন, যেখানে আপনি আপনার পায়ের সামনে কি আছে তাই জানেন না”।

আলবার্ট আইনস্টাইন

আরেকটি ঘটনার কথা বলি। একদিন বার্লিনের একটি ট্রামে চলেছেন এক ভদ্রলোক। কন্ডাক্টর এসে চাইলেন টিকিট। ভদ্রলোক পয়সা দিলে কন্ডাক্টর টিকিট ও বাকি পয়সা ফেরৎ দিলেন। ভদ্রলোক বললেন যে কন্ডাক্টর তাঁকে ঠিক পয়সা ফেরৎ দেননি। কন্ডাক্টর আবার গুনলেন পয়সা এবং বিরক্ত মুখ করে বললেন, ” আমি ঠিক পয়সাই দিয়েছি, তবে অসুবিধা হল গিয়ে মশাই, আপনি অঙ্কটা এখনও ঠিক মত শিখে উঠতে পারেন নি”।

যাঁকে বলা হল কথাগুলো, তিনি হলেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের ভুলো মনের ব্যাপারে আরেকটি ঘটনার কথা বলছি। একদিন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনের অফিসে হাজির হলেন এক ভদ্রলোক।  উপস্থিত অফিস কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করলেন আলবার্ট আইনস্টাইনের বাড়িতে যাওয়ার পথ নির্দেশ। উটকো লোকের জন্য আইনস্টাইনের মতো নামী লোকের যেন অসুবিধা না হয়, এ কথা ভেবে কর্মচারী ভদ্রলোক বললেন যে তিনি বিজ্ঞানীর বাড়ি কোথায় তা জানেন না। আগন্তুক ভদ্রলোক মাথা চুলকে লজ্জিত ভাবে বললেন, “আমারই নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। ক্যাম্পাস থেকে বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না”।

থমাস আলভা এডিসন

থমাস আলভা এডিসনের নাম কে না জানে। এই মানুষটি পৃথিবীকে এক  হাজারেরও বেশি আবিষ্কার উপহার দিয়েছেন। অথচ এই মানুষটিই এমন কাণ্ড  ঘটিয়েছেন যা শুনলে অবাক হয়ে যেতে হবে। একদিন এডিসন গিয়েছেন কর দিতে। দাঁড়ালেন লাইনে। কাউন্টারের সামনে যাওয়ার পর উল্টোদিকের কেরানি ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর নাম। এডিসন নাম বলার বদলে উদাস ভাবে লাইনের অন্যদের দিকে তাকাতে লাগলেন। কেরানি ভদ্রলোক নিজের নাম ভুলে যাওয়া এমন অদ্ভুত মানুষ দেখে অবাক হয়ে গেলেন।

লুই পাস্তুর

নাম ভুলে যাওয়া যদি অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা হয়, তবে বিয়ের দিন ভুলে  যাওয়া নিশ্চয় আরও বেশি অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। আর এমন ঘটনাই ঘটিয়েছিলেন বিখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর। ১৮৪৯ সালের ২৯শে মে ঠিক  হয়েছিল তাঁর বিয়ের দিন। সকলে ঠিকমতো সময়ে অনুষ্ঠানে এসে দেখলেন পাস্তুর  আসেননি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরে পাস্তুরের কয়েকজন বন্ধু গেলেন পাস্তুরের রসায়নাগারে। গিয়ে দেখলেন যা ভেবেছেন তাই। পাস্তুর কাজে ব্যস্ত। ‘কি ব্যাপার, তুমি কি ভুলে গিয়েছো যে তোমার আজ বিয়ে? ‘ পাস্তুর স্বীকার করলেন যে কাজের আগে তাঁর কথাটা মনে থাকলেও কাজ করতে করতে ভুলে গিয়েছিলেন বিয়ের কথা। তারপর ধন্যবাদ দিলেন বন্ধুদের ঠিকমতো সময়ে আসার জন্য। লুই পাস্তুরের ভুলো  মনের আরো উদাহরণ আছে। একদিন পাস্তুর বন্ধুদের সঙ্গে রাতের খাবার খাচ্ছেন। খাবার টেবিলে আঙুর দেওয়া হল খাবার জন্য। সবাই খাবার জন্য আঙ্গুর তুলতে যাবেন, এমন সময় পাস্তুর সকলকে হাতের ইশারায় থামতে বললেন। তারপর নিজের আঙুলগুলো জলের গ্লাসে ধুতে ধুতে বলে চললেন আঙুর না ধুয়ে খাওয়ার বিপদের কথা। বললেন, আঙুরে থাকা মারাত্মক সব জীবাণুদের কথা। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন বিশ্ববরেণ্য এই বিজ্ঞানীর কথা। হঠাৎই হেসে উঠলেন সকলে। পাস্তুর অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন হঠাৎ হাসির এই কারণ জানার জন্য। আসলে কথা বলতে বলতে পাস্তুর ভুল করে খেয়ে ফেলেছিলেন গ্লাসে রাখা আঙুর ধোয়া জল যা ছিল সাংঘাতিক সব জীবাণুতে ভরা।

ওয়াইনার

সেদিন ছিল বিখ্যাত বিজ্ঞানী ওয়াইনার ও তাঁর পরিবারের বাসস্থান পরিবর্তনের দিন। ওয়াইনারকে আবার গবেষণার কাজে MIT তে যেতেই হবে সেদিন। স্বামীর ভুলো মনের কথা জানা থাকায় ওয়াইনারের স্ত্রী তাঁকে একটি কাগজে লিখে দিলেন নতুন বাড়ির ঠিকানা। সারা দিনের কাজের মধ্যে কোনও এক সময়ে ঐ কাগজে কিছু লিখতে লিখতে ভুল করে কাগজটি ফেলে দিলেন ডাস্টবিনে। সন্ধ্যা বেলায় ফিরে গেলেন পুরানো বাড়িতে। গিয়ে দেখলেন তালা। কি করবেন বুঝতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, তখনই দেখতে পেলেন মেয়েকে। মেয়ে জানালো মা মিসেস ওয়াইনার এমন ঘটনা ঘটতে পারে আন্দাজ করে পাঠিয়েছেন ওকে।

এই হল কয়েকজন ভুলো মনের বিজ্ঞানীদের কথা। ঘটনাগুলো বেশ মজার হলেও , ভুলো মনের সব মানুষই কিন্তু জিনিয়াসও নন এবং বিজ্ঞানীও নন।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত