| 18 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

কাফকার মেটাফরসিস : ফ্যান্টাসি ও যাদুবাস্তবতার দ্বৈরত

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

চারুলতা হক

বন্যপ্রাণীরা আমাদের সবচেয়ে কাছের জন। কেননা আমরা মানুষের চেয়ে প্রাণীদের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক গড়তে পারি। 
–ফ্রাঞ্জ কাফকা

 

ফ্রাঞ্জ কাফকার ‘দি মেটামরফোসিস’ বা রূপান্তর একটি অস্তিত্ববাদী উপন্যাস হিসেবে সারা পৃথিবীতে খ্যাত। এই উপন্যাসে যে দর্শন ও নির্মাণশৈলী ব্যবহার করা হয়েছে তাতে উপন্যাসটির মধ্য থেকে ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতার যথেষ্ট উপাদান পাওয়া যায়। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বা সালমান রুশদী যেভাবে সচেতনভাবে জাদুবাস্তবতাবাদকে তাদের রচনায় ব্যবহার করেছেন কাফকা ঠিক সেভাবে ব্যবহার করেননি। ফ্যান্টাসি ও জাদুবাস্তববাদী রচনাশৈলীর যুগল মিশ্রণ রূপান্তর উপান্যাসে প্রয়োগ করেছেন কাফকা।

 

ফ্যান্টাসি আর জাদুবাস্তবতার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে।  ফ্যান্টাসি আসলে কল্পনার জগত। প্রকৃত বিশ্বের সমস্যাকে অতিক্রম করে ফ্যান্টাসি অপ্রাকৃত জগতের দিকে নিয়ে যায়। সেই জগতটা যতই কাল্পনিক বা অপ্রাকৃত হোক না কেন লেখকের মুন্সিয়ানায় তা বিশ্বাস্য হয়ে ওঠে। তবে পড়তে পড়তে পাঠক জানেন যে গল্পে বর্ণিত আখ্যান সম্ভব হতে পারে না। আবার অসম্ভবও হতে পারে না। সম্ভব-অসম্ভবের বিভ্রম সৃষ্টি করে।  

কোনো গল্পে হয়তো বেশ কয়েকটি উপাখ্যান আছে। এদের মধ্যে সবগুলোই বাস্তব। কল্পনার কোনো স্থান নেই। কিন্তু একটি একটি বা দুটি উপাখ্যান এমন কাল্পনিক আজগুবি বিষয়ের অবতারণা করছে যা অসম্ভব বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটা বাস্তব বা সম্ভব আখ্যানের মধ্যে অতি চতুরভাবে বলা হয় যে তাকে অসম্ভব বলে মানতে ইচ্ছে করে না।  বাংলা সাহিত্যে অমর মিত্র এ ধারায় লেখেন ‘অশ্বচরিত’ নামে উপন্যাস। উপন্যাসে ‘কত্থক’ ও ‘কন্থক’ নামে দুটো ঘোড়া মহামতি বুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করে। বুদ্ধ জগতের দুঃখের কারণ দূর করতে সাধনায় বসেছেন। জীবনে অশান্তির নিরাময়ের উপায় বের করতে চান। এই দুটো ঘোড়াকে দেখা যায় হিরোশিমা নগরের মধ্যে থেকে বের হয়ে আসছে পারমাণবিক কালো বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।

ফ্যান্টাসিতে যে সব চরিত্র নির্মাণ করেন লেখক তাদেরকেও সত্যি মিথ্যে আকার দান করেন। আনন্দ ও বিনোদনের খাতিরে পাঠক এইই ফ্যান্টাসি থেকে নানা মজা পেতে পারেন। যেমন,  Tolkein এর lord of the Rings, Harry potter এর উপন্যাস এবং এমন কি  Issac Asimov এর সায়েন্স ফিকশন এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। motion pictures  বা চলচ্চিত্র Matrix trilogy,  Superman এবং  Batman এ ধারার সিনেমা। Over Imagination বা অতি কল্পনা অথবা কল্পনাতীত বলতে যা বোঝায় এই সব ফ্যান্টাসিতে খুঁজে পাওয়া যায়।

সাহিত্যে বাস্তবতা বলতে পৃথিবীতে অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত সত্য বস্তু বিষয় বা ঘটনাকে বোঝায়। নাক কান চোখ ত্বক বা ইন্দ্রিয় দিয়ে এর অস্তিত্ব বোঝা যায়। এখানে কল্পনার কোনো স্থান নেই।  কোনো রহস্যময়তা নেই। নেই কোনো ফাঁকিঝুকি।

জাদু বলতে এমন কিছু বস্তু বিষয় বা ঘটনাকে বোঝায় যার কোনো প্রত্যক্ষ বা পরীক্ষণলব্ধ প্রমাণ নেই।  ইন্দ্রিয় দিয়ে তাকে বোঝা যায় না। একে অতিন্দ্রিয় বা অতিপ্রাকৃতিক বলা হয়। একে অপ্রাকৃতিক বলা হলেও আসলে এসব ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে কোনো স্থান বা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, চর্চা বা জীবন আচরণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। তা আসলে সংস্কৃতির অংশ। ধরা যাক বনবিবি বা সত্যপীর নামে এক অলৌকিক দেবি বা শক্তিকে মান্য করে সুন্দরবনের বাওয়ালী-মৌয়ালীরা। বনবিবির অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই। এটা এক ধরনের জাদুকরী শক্তি। বাওয়ালীরা যখন সুন্দরবনে কাঠ কাটতে যায় তখন এই জাদুকরী শক্তির অস্তিত্বকে মান্য করেই নির্ভরতা পায়।  আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা উপন্যাসে কাৎলাহার বিলের পাকুড় গাছে এক অলৌকিক মুন্সির উপস্থিতি এলাকার চাষিরা ধরে নেয়। মনে করে ১৭৯৪ সালের বাংলায় যে ফকির সন্নাসী বিদ্রোহ হয়েছিল মুন্সি সেই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা। প্রায় তিনশো বছর ধরে এই মুন্সি কাৎলাহার বিলে আশ্রয় নিয়ে আছে। চাষিদের আন্দোলন সংগ্রামে প্রেরণা যোগায়। এই জাদুর মুন্সি এলাকার চাষিদের কাছে বাস্তবতার প্রতীক তার অস্তিস্বকে তাদের জীবনে অস্বীকার করা যায় না। । ইলিয়াস যখন মুন্সিকে খোয়াবনামায় চরিত্র বা আখ্যানের অংশ করেন তা হয়ে ওঠে জাদুবাস্তব।

জাদুবাস্তববাদী গল্পে ভৌতিক উপাদানগুলো ভৌতিক হিসেবে নয় স্বাভাবিক চরিত্র হিসেবে অংশ গ্রহণ করে। এরা গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে নয়, সমাজের সমালোচনাকারী বা ক্রিটিক হিসেবে কাজ করে।  এদের মধ্যে এক ধরনের সিরিয়াসনেস থাকে।  সত্যি মানুষের মতো আচরণ করে।  জাদুবাস্তববাদী ধারার গল্পে  কিছু পরিমাণে ফ্যান্টাসি থাকতে পারে। কিন্তু  ভৌতিক গল্পে ভুতেরাই প্রধান বা কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাদেরকে  ঘিরেই কাহিনী আবর্তিত  হয়। এদের মধ্যে কোনো সমসাময়িক বিষয় থাকে না। তাদের উদ্দেশ্য থাকে নিছক বিনোদিন দেওয়া।

জাদুবাস্তব— ফ্যান্টাসি

১. সিরিয়াস এবং তাৎপর্যপূর্ণ—- সিরিয়াসনেস নেই।

২. ইতিহাস ও পুরানের ব্যবহার করা হয়– পুরান আসলেও তা খুব বেশি গুরুত্ববহন করে না।

৩. সমসাময়িক বিষয়ের জন্য এটা বাস্তব হয়ে ওঠে।–ফ্যান্টায়াটিস জগতের জন্য এটা অবাস্তব।

৪. বাস্তবতা ও ফ্যান্টাসির সংমিশ্রণ থাকে। — কোনো বাস্তবতা থাকে না।

কাফকার মেটামরফোসিস উপন্যাসটি জাদুবাস্তবতাবাদ ও ফ্যান্টাসির মিশ্রণ। উপন্যাসটিকে রূপক, দর্শনাত্মক অথবা প্রতীকাশ্রয়ী আখ্যান হিসেবে পড়া যায়।

উপন্যাসে গ্রেগর সামসা নাম একজন ভ্রাম্যমান সেলসম্যান বাবামায়ের সঙ্গে থাকে। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায় সে একটি বড় আকারের পোকায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই রূপান্তর ঘটনায় তার পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করে যার জন্য শেষ পর্যন্ত সে মারা যায়। এটাই এই উপন্যাসের মূল ঘটনা।

গল্পটিকে ফ্যান্টাসি হিসেবে ধরে নিতে চাইলে পাঠককে বুঝে নিতে হবে, কী কারণে গ্রেগরের রূপান্তর ঘটল এবং সে কীভাবে পরিবির্তিত পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক হতে গিয়েছিল। এই উপন্যাসে গ্রেগরের রূপান্তরটাই হল সত্যিকারে একটিমাত্রি ফ্যান্টাস্টিস উপাদান ।  

পরে যখন তার পরিবারের সদস্যরা জানতে পারল তার পোকায় রূপান্তরের ঘটনাটি, তখন তাদের আচরণের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে।  তাদের আচরণের এই পরিবর্তনটাই এই গল্পের আসল রূপান্তর। তা কিন্তু ফ্যান্টাসি নয়।

আভিধানিক অর্থে মেটামরফোসিস শব্দটি কোনো প্রাণীর আকারগত বা আচরণগত পরিবর্তনকে বোঝায়। যেমন প্রজাপতির ডিম থেকে যখন বাচ্চা ফোটে তখন তার আকার হয় লম্বা। তাকে বলে লেদাপোকা। লেদাপোকা প্রচুর পাতা খায়। এই লেদাপোকা কিছুদিন পরে একটি গুটি তৈরি করে তার মধ্যে অনড় অবস্থাপূর্ণ মুককীটে পরিবর্তন ঘটায়। তারা কিছুই খায় না। আবার কিছুদিন পরে মুককীট নিজের শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। তাকে বলে প্রজাপতি। প্রজাপতির ডানা থাকে। উড়তে পারে। সে তেমন কিছুই খায় না। এ পর্যায়ে  তারা ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়। মধু খায়। ফুলের মধ্যে পরাগায়ণ ঘটায়। আর স্ত্রী ও পুরুষ প্রজাপতি যৌন সংগম করে। এই যে প্রজাপতির জীবনকালে লেদাপোকা, মুককীট এবং পূর্ণ প্রজাপতির আকার নানা বয়সে পালটে যাচ্ছে, একটা স্তর থেকে আরেকটা স্তরে গিয়ে আগের চেহারায় আর চেনা যাচ্ছে না, সম্পূর্ণ নতুন চেহারা পাচ্ছে। নতুন চেহারার কারণে তাদের স্বভাবও পালটে যাচ্ছে। এটাই মেটাফরফোসিস। মানুষের জীবনেও নানা বয়সে নানা পরিবর্তন ঘটে। যেমন শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক ও বুড়ো। কিন্তু এইপরিবর্তনে চেহারার কোনো মোলিক পরিবর্তন ঘটে না।  একে বিজ্ঞানের ভাষায় মেটামরফোসিস বলা হয় না। কিন্তু মানুষ গ্রেগর সামসা যখন পালটে গিয়ে একটা বড় পোকায় পরিণত হল তখন তাকে মেটামরফোসিস বলা যায়।

মানুষ গ্রেগরের পোকায় রূপান্তরিত হওয়াটা বাস্তবে ঘটে না। এটা অতি মাত্রায় কাল্পনিক বা গাজাখুরি গল্পমাত্র। এই কারণে এটা সাহিত্যের টার্মে ফ্যান্টাসী। আবার গ্রেগরের পোকায় রূপান্তরের কারণে তার বাবা, মা, বোনদের স্বভাবে যে আমূল পরিবর্তন পরিবর্তন ঘটল, তা কিন্তু অতি কল্পনা নয়। এটা বাস্তবসম্মত। যতই গ্রেগর এই পরিবারের কারো ছেলে বা কারো ভাই হোক না কেন, সে তো আর মানুষ নয়। পোকা মাত্র।  পোকাকে কে আর সহ্য করতে পারে?

 

গ্রেগর সামসা একজন কর্তব্য পরায়ণ ছেলে এবং ভাই। সে তার বুড়ো বাবা-মা ও বোনকে দেখাশুনা করে। তার মা গৃহকর্তী। আর তার বাবা ঘরে পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। ছোট বোন গ্রেটা ভাই গ্রেগরকে  খুব যত্ন করে। আর মা তাকে খুবই ভালোবাসে।কিন্তু তারা যখন বুঝতে পারে গ্রেগরের রূপান্তর ঘটেছে, সে আর মানুষ নেই–একটা কদাকার পোকায় পরিণত হয়েছে, তখন প্রথমে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে। কিন্তু পরে বুঝতে পারে যে সে সত্যিই পোকা, মানুষ নয়– মানুষের চেহারায় তার আর ফেরার উপায় নেই, তখন তারা বিরক্ত হয়। তাকে অবহেলা করতে শুরু করে। শেষ তার প্রতি নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণ করে।

এ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাবা চরিত্রের পরিবর্তনটি বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। বাবার এই পরিবর্তনটু গ্রেগরের চোখে পড়ে প্রকটভাবে। তাকে ঠিক আগের মতো স্নেহময় বাবা মনে হয় না। আগে যখন গ্রেগর ভ্রাম্যমান সেলসম্যানের কাজে বাড়ির বাইরে যেত, তখন তার বাবা মানুষটি ক্লান্তভাবে বিছানায় এলিয়ে  পড়ে থাকতেন। যখন সে কাজ থেকে ঘরে ফিরত তখন বাবা নড়েচড়ে উঠতেন। তাকে খুব খুশি মনে শুভেছা জানাতেন। লম্বা একটি আরাম কেদারায় বসতেন, পায়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারতেন না। কিন্তু তিনি হাত দুটি ছেলের দিকে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তুলে ধরতেন। এখন এগুলো কিছুই করেন না। তাকে দেখে বিরক্ত হন। তার মনে হয়, এ লোকটি কোনোদিনই যেন তার বাবা ছিলেন না।

আগে বছরের দু-এক রবিবারে কিংবা বিশেষ ছুটির দিনে, যখন পরিবারের অন্যদের সঙ্গে বেড়াতে বের হতেন তখন তিনি গ্রেগর আর তার স্ত্রীর মাঝখানে অবস্থান নিয়ে হাঁটতেন। পরিবারের সবাই এমনিতে আস্তে আস্তে হাঁটত। আর তার বাবা তাদের চাইতেও ধীর গতিতে হাঁটতেন। তার পুরনো ওভারকোটটায় নিজেকে ভালোভাবে ঢেকে-ঢুকে বেশ কষ্ট করে হাঁটতেন। প্রতিটি পদপক্ষেপের সময় তাঁর হাতের মাথা-বাঁকানো লাঠিটা সতর্কতার সঙ্গে ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে যেতেন। গ্রেগর এ সময় তাকে সাহায্য করত। এ সময় কিছু একটা বলতে চাইলে প্রায় একদম দাঁড়িয়ে পড়ে তার সংগীদের কাছে ডেকে আনতেন।

‘ওই-তো এখন তিনি ওখানে চমৎকারভাবে দাঁড়িয়ে আছেন; তার পরনে একটা কেতাদুরস্ত নীল ইউনিফর্ম, সোনালী বোতাম আঁটা তাতে, ব্যাঙ্কের বার্তাবাহকরা যে রকম পোশাক পরে সেই রকম; তাঁর কোটের উঁচু শক্ত কলারের উপর দিয়ে তাঁর বলিষ্ঠ দ্বিত্ব চিবুক ফুলে ঝুলে পড়েছে। ঘন ভ্রূযুগলের নিচ থেকে তাঁর কালো দুচোখ তীক্ষ্ণ সতেজ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে; তার একদা এলোমেলো সাদা চুল এখন চকচকে, সযত্নে ভাগ করে, সিঁথির দুপাশে পাট করে আঁচড়ানো।’

এ উপন্যাসের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত অংশ হচ্ছে গ্রেগরের বাবার পরিবর্তনটা যে ভাবে হয়েছে সেটা। গ্রেগর আর তার বাবার ভেতরকার লড়াইওটা আসলে কল্পনাপ্রসুত।

দ্বিতীয় অংশের শেষের দিকে ক্ষিপ্ত বাবা গ্রেগরের দিকে আপেল ছুড়ে মারেন। একটি আপেল  তার পিঠে আটকে যায়। গ্রেগর ভীষণ ব্যাথা পায়। অবশেষে এটাই তার মৃত্যুর কারণ ঘটে।

গ্রেগর এর চরিত্র চিত্রণ সত্যিই জাদুবাস্তবতার একটি আদর্শ উদাহরণ। মানুষের চেহারার দিক থেকে একটি পোকায় রূপান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনেরও রূপান্তর ঘটে। সে পোকার মতো আচরণ করতে থাকে। কিন্তু চিন্তা করে মানুষের মতো আবেগ ও অনুভূতি দিয়ে।

বেশিরভাগ পোকাই গর্তে, আড়ালে ও অন্ধকার জায়গায় লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। গ্রেগরও সে রকম করতে পছন্দ করতে শুরু করে। এটা খুবই উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, মানুষের স্বাভাবিক খাবারে গ্রেগরের প্রবল অরুচি দেখা দেয়। যখন সে স্বাভাবিক মানুষ ছিল তখন গ্রেগরের পছন্দের খাবার ছিল দুধ। পোকায় রূপান্তরিত হওয়ার পরে তার বোন এক বাটি সেই দুধ নিয়ে এলে তা তার কাছে স্বাদহীন লাগে।
তার বোন এই ব্যাপারটি বুঝতে পারে না। তখন সে তার জন্য অন্য কিছু খাবার নিয়ে আসে। এর মধ্যে  দুদিন আগের দিনের বাসি পচা পনির গ্রেগর পছন্দ করে। সে আরো পছন্দ করে আধা পচা সবজি এবং গত রাতের উচ্ছিষ্ট হাড়-গোড় যার উপর পুরু হয়ে সস জমে আছে । আর আছে কিছু কিসমিস ও বাদাম; এক টুকরো পনির যা দুদিন আগেও গ্রেগর অখাদ্য হিসেবে বিবেচনা করত। একটা শুকনো রুটি, একটা মাখন-মাখানো রুটি এবং রুটি যাতে মাখন ও লবণ দুই-ই মাখানো আছে। এগুলো তার অতি সস্বাদু মনে হয়। অন্যদিকে তাজা খাবার ও সবজির দিকে তার মন নেই। এ তাজা খাবারের ঘ্রাণও সে নিতে পারছিল না।’

গল্পের শেষে গ্রেগর বুঝতে পারে তার পরিবার তাকে আর ভালোবাসে না– ঘৃণা করে। তার বাবা আর তাকে আর স্নেহ করে না– তাকে সহ্য করতে পারে না। গ্রেগরের ইচ্ছে করে অন্তর্ধান হয়ে যেতে। অবিলম্বে মরে যেতে চায়। তার বোন যখন তাকে দেখে বলে ওঠে– ওকে এবার যেতে হবে, তখন আর আর বেঁচে থাকার উচ্ছেটা লুপ্ত হয়ে যায়। তার বোনের উচ্চারিত শব্দ তিনটি তার পিঠে গেঁথে যাওয়া আপেলের ব্যাথার চেয়েও বেশি বেদনাদায়ক হয়ে দাঁড়ায়।

গ্রেগর গভীর আবেগ ও ভালোবাসার সঙ্গে তার পরিবারের কথা ভাবে। তার প্রত্যয় হয় যিদি সম্ভব হতো তবে সে এ জগত থেকে অদৃশ্য হয়ে যেত। এমন কি তার বোনের চেয়েও অধিক নমনীয় হতো।

অবশেষে যখন সে মারা যায় তখন তার বাবা বলে ওঠে, আমি এখন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে পারি।

 

এই গল্পে আছে কিছু কাল্পনিক উপাদান এবং প্রচুর বাস্তব উপাদান। এই দুয়ের মিশ্রণে পাঠক ভাবতে পারেন, কাফকা হচ্ছেন জাদুবাস্তববাদি কৌশলের অগ্রদূত। কিন্তু সত্যি হচ্ছে, এ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার উপাদান আছে অতি সামান্য। জাদুবাস্তবকে প্রকৃতভাবে জানতে হলে পাঠ করতে হলে পড়তে হবে হোর্হে লুইস বোরহেস, ইতালো কালভিনো। বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়তে হবে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত