| 18 এপ্রিল 2024
Categories
নারী মুক্তিযুদ্ধ

ভাগীরথী সাহা স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও পাননি মুক্তিযোদ্ধার সম্মান

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও বীর মুক্তিযোদ্ধা নামের তালিকায় নেই পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধা ভাগীরথী সাহা’র নাম। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের ক্যাম্প থেকে গোপণ তথ্য সংগ্রহ করে দিতেন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের। যাকে বলে তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর। আর সেটাই কাল হয়েছিল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্মম-বিভৎসতম উপায়ে হত্যা করে তাঁকে। সেই অকুতোভয় যোদ্ধা ইতিহাসের বিভৎসতম হত্যাকান্ডের শিকার ভাগীরথী সাহা কে নিয়ে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে লিখছেন মনিজা রহমান।

লাল সবুজের আরেকটি পতাকা তৈরী হয়েছিল সেদিন। পিরোজপুর শহরের পথ রাঙা হয়েছিল ভাগীরথীর রক্তে। এই শহরের এক অকুতোভয় মানুষ ছিলেন ভাগীরথী সাহা।  ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের ক্যাম্প থেকে গোপণ তথ্য সংগ্রহ করে দিতেন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের। যাকে বলে তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর। আর সেটাই কাল হয়েছিল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্মম-বিভৎসতম উপায়ে হত্যা করে তাঁকে।


freedom-fighters-list-bhagirathi-saha


ভাগীরথির হাত পা বেধে চলন্ত মটরসাইকেলের পিছনে দড়ি দিয়ে বেধে নিয়ে যাওয়া হয়। শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পিরোজপুর শহরের দুই কিলোমিটার রাস্তা রঞ্জিত হয়েছিল ভাগীরথীর রক্তে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তো বটেই সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বিভৎস হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্ত বিরল। অথচ গভীর বেদনা ও পরিতাপের বিষয় পিরোজপুর শহরে একটি স্মৃতি ফলক ছাড়া কিছুই নেই তাঁর নামে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এসেও মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার সম্মান।

আমার দাদাবাড়ি পিরোজপুর শহরে হওয়ায় শৈশব থেকে আব্বার মুখে ভাগীরথির কাহিনী শুনে বড় হয়েছি। প্রতিবার শোনার সঙ্গে সঙ্গে শিহরিত হয়েছি। পিরোজপুর তখন বরিশাল জেলার অন্তর্ভূক্ত একটি মহকুমা।   আব্বা ১৯৭১ সালে পিরোজপুর মহকুমা আওয়ামী লীগে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছর পরেও যখন জানতে পারি- আজও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পাননি ভাগীরথী-তখন বুকটা বেদনায় ভরে যায়।

পিরোজপুরের পাশের জেলা বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার দেবীপুর গ্রামে ভাগীরথীর জন্ম ১৯৪০ সালে। বাবা মুড়ি বিক্রি করতেন। স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি ভাগীরথীর। ১৯৫৬ সালে বিয়ে হয়েছিল পিরোজপুর জেলার বাগমারা গ্রামের প্রিয়নাথ সাহার সঙ্গে। ১৯৬৭ সালে দুই শিশু সন্তান নিয়ে মাত্র ২৭ বছর বয়সে বিধবা হন ভাগীরথী।  

১৯৭১ সালে পাক বাহিনী গ্রামের বাড়ি পুড়িয়ে দিলে এক মুঠো খাবারের আশায় শহরে আসেন তিনি। কখনও বাসাবাড়িতে কাজ, কখনও দুই সন্তানকে নিয়ে ভিক্ষা করতেন। দেখতেন প্রতিদিন রাস্তার পাশে পড়ে আছে নিরীহ মানুষের লাশ। বলেশ্বর নদীর খেয়াঘাট তখন বধ্যভূমি। বিখ্যাত লেখক হুমায়ুন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমানকে হত্যা করা হয় এখানে। সবকিছু দেখে ক্রোধে উন্মক্ত ভাগীরথী সিদ্ধান্ত নেন প্রতিশোধ নেবার।

মে মাস থেকে মহকুমা সদরের আশেপাশের গ্রামগুলিতে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হতে শুরু করে। পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর নজর রাখার জন্য ভাগীরথীকে দায়িত্ব দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। শহরে এসে ভাগীরথী পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পের আশেপাশে ঘুরতে থাকলে তাকে সেলিম নামে এক পাক সেনাবাহিনীর সুবেদার ক্যাম্পের ভিতরে নিয়ে যায়। তাঁকে বলা হয়-‘বোলো মুক্তি কাঁহা, বহোত ইনাম মিলবে।’

ভাগীরথী তাদের কথায় সায় দিয়ে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করতে থাকে, যার সবই ছিল ভুল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুত রেখে তিনি ২৯ আগস্ট পাকিস্তানী সেনাদের বাগমারায় নিয়ে আসেন। ওইদিন মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কিছু সৈন্য মারাত্নকভাবে আহত হয়। শহরে ফেরার পথে খানাকুনিয়ারিতে তারা গেরিলা আক্রমণের শিকার হয়। ভাগীরথী পাকিস্তানী বাহিনীকে বিপদে ফেলেছিল ৮ ও ৯ তারিখেও। পিরোজপুর সদরে ক্যাম্পে ফিরে পাকিস্তানী দলের প্রধান ক্যাপ্টেন এজাজ নিশ্চিত হয়, ভাগীরথী আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের চর। তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়।


freedom-fighters-list-bhagirathi-saha


১৩ সেপ্টেম্বর ভাগীরথী পিরোজপুর শহরে গিয়ে বাজারে ঢুকে পাকিস্তানী বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকেন। রাজাকাররা তাঁকে দেখে ক্যাম্পে খবর দেয়। তারপর তাঁকে ধরে নিয়ে যাবার পরে ক্যাপ্টেন এজাজ সুবেদার সেলিমকে নির্দেশ দেয় ভাগীরথীকে হত্যা করার। দুজন সিপাহী রশি দিয়ে হতভাগ্য এই নারীর দুই হাত বেঁধে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। রশির অপর প্রান্ত বেঁধে দেয় একটি একটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে। তীব্র গতিতে মোটরসাইকেল চলা শুরু করলে ভাগীরথরি দেহ থেকে রক্ত-মাংস খসে খসে রাস্তায় পড়তে থাকে। সুবেদার সেলিম দুই কিলোমিটার মোটরসাইকেল চালিয়ে অবশেষে বলেশ্বর নদীর কাছে এসে থামে। ভাগীরথীর ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ নদীর বুকে নিক্ষেপ করে।

পিরোজপুর শহরে স্থাপিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে ভাগীরথীর নাম আছে চতূর্থ স্থানে। আর শহরের কৃষ্ণচূড়া মোড়ে অবস্থিত চত্বরের একটি নাম ফলক ছাড়া ভাগীরথীর নাম আর কোথাও নেই। দুই ছেলেকে রাস্তার ধারে শুইয়ে রেখে পাকিস্তানী ক্যাম্পে গিয়েছিলেন মা। বড় ছেলে কার্তিক পরবর্তী সময়ে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। ৬০ বছর বয়সী ছোট ছেলে গণেশ সাহা এখনও বেঁচে আছেন। দিনমজুরের কাজ করেন। আর মায়ের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের স্বীকৃতি আদায় করতে দরজায় দরজায় ঘুরে চলেছেন আজও।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত