| 28 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতীর ছোটগল্প: চামড়ার মানিব্যাগ । কণাদ বাগ

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

এটা একটা প্রেমের গল্প।

এ গল্পে বাপ মরা এক গরিব ব্রাহ্মণ ছেলে ছিল। এ গল্পে চা বাগানের ক্রিশ্চান ম্যানেজারের সুন্দরী একমাত্র কন্যা ছিল। এ গল্পে জোৎস্নায় চিকচিক চেলিন নদী ছিল। ফাগুন পাহাড়ে সূর্যাস্ত ছিল। সবুজ কার্পেটের মত চা বাগান ছিল। আর ছিল বহু ব্যবহৃত পালিশ চটা ভাঁজ খাওয়া একটা চামড়ার মানি ব্যাগ।

ডুয়ার্সের এ গ্রামীণ হাসপাতালে আমার কোয়ার্টারের দোতলার বারান্দায় এক পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোয় নদী আর পাহাড় দেখতে দেখতে হারিয়ে যাওয়া বা পালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তাপসদা কুলকুল করে বয়ে গেছিল। তাপস চ্যাটার্জী, ডুয়ার্সের এক শহরের উপকন্ঠে কাছলা নদীর ধারে, ছোট্ট একটা গ্রামে আজ থেকে বছর পঞ্চাশ আগে জন্মে ছিল। তার বাবা নীলমণি যজমানি করে বা কিছু না করেই জীবনটা কাটিয়ে দেবার কথা ভাবতেন এবং এরকম ভাবেই বেশ চলছিল। হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে – সেটা ম্যালেরিয়া না টাইফয়েড, নাকি কালাজ্বর অথবা ডেঙ্গি সেটা তাপসদা এখনো বোঝার চেষ্টা করে, নীলমণি মারা গেলেন।

তারপর সে এক অসাধ্য সাধনের কাহিনী। তাপসদা বহুবার আমায় বলেছে। মা সংসার সামলে পড়াশুনা করতেন। পরীক্ষার গন্ডি পেরিয়ে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়েছিলেন। তার স্বাধীনতা সংগ্রামী দাদু দিদিমা কিভাবে সাহায্য করতেন। প্রত্যেকবার বলার সময়ে তাপসদার গলা বুজে আসত। তবু তাপসদা বলত। আর সত্যি বলছি শুনতে আমার খারাপ লাগত না।

সেদিন কি জানি কি হল, তাপসদা না বলা এক গল্প শুরু করল।

ফার্মাসি কলেজ থেকে পাশ করার সাথে সাথে চাকরি নিয়ে এখানে আসা। চাকরি নিতেই হত। পাঁচ ভাই বোনের সংসার, মায়ের একার রোজগারে আর চলছিল না। সে সময় এ জায়গাটা ছিল আরও দুর্গম, আর তাই আরও সুন্দর। এ পাহাড়ের কোলে বড় বাড়ি ছিল মাত্র দুটো। হাসপাতাল আর ফরেস্ট বাংলো। নীচে সবুজ জঙ্গল দুভাগ করে দিত চেলিন নদীর সফেন স্রোত। তার ওপর ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে ফাগুন পাহাড়। সে পাহাড়ে মখমলের মত চা বাগানের মাঝে আর দুটো বাড়ি। ম্যানেজারের বাংলো আর কারখানা।  যেন ঝুলনে সাজানো খেলনা। সবুজ পাহাড়, মেঘের নীল আর কুয়াশার মায়ায় মিশে পৌঁছে যেত দূর মনেস্ট্রির পদতলে। বাকি পৃথিবীর সাথে এখানের যোগাযোগের রাস্তা একটাই। জঙ্গলের নির্জনতা পেরিয়ে। মানুষের যাতায়াতের সে রাস্তাকে পার হতে হত তিন তিনটে এলিফ্যান্ট করিডোর, হাতিদের রাজপথ। জঙ্গল তখন এত পাতলা হয়ে যায় নি। হাতিদের আনা গোনা ছিল রোজকার ঘটনা। পথের ওপর তাদের অধিকার ছিল সবার আগে। সে রাস্তা পৌঁছাত এক সেনা ছাউনিতে। সেখান থেকে একদিকে এক গঞ্জ, ভুট্টাবাজার; অন্য দিকে বড় নদী পেরিয়ে পাহাড়ি কালিবাড়ী হয়ে সদর শহর। ভোরের আলো ফোটার আগেই “হরি ওম” বাস রওনা দিত।  সদর গিয়ে ফেরত আসত আলো থাকতে থাকতে।

হাসপাতালে ডাক্তারবাবু বলতে তখন মাত্র একজন। তিনি কোলকাতার লোক। মাসে টানা পঁচিশ দিন থাকতেন এখানে। পাঁচ সাত দিন ছুটি নিয়ে বাড়ি যেতেন। তার ছুটির সময় কোন ডাক্তারবাবুকে পাওয়া যেত না এখানে। বড় সুন্দর ব্যবহার ছিল তার। পাহাড়ি মানুষগুলো খুব ভালবাসত তাকে। ছুটিতে যাবার সময় সাথে দিত কমলালেবু, সুপারি, গোলমরিচ। চা বাগানের কামিনরা ছেলে, মেয়ে বা স্বামীর জন্য মানত করে থাকলে বলত কালীঘাটে তাদের নাম করে পূজো দিতে। ফেরার দিন জড়ো হত প্রসাদি ফুল বেলপাতা আর পেঁড়া নিতে।  কেউ কেউ তাকে অল্প অল্প করে জমান টাকা দিত কোলকাতা থেকে পিতল কাঁসার বাসন আনতে। কাঁসা পিতলের বাসনের প্রতি অসম্ভব টান আছে পাহাড়ি মানুষজনের। মেজে ঘসে সোনার মত করে রাখে। অতিথি আপ্যায়নে ব্যবহার করে। সারা মহল্লার সরকারি কাজের চিঠি, চাকরির দরখাস্ত, বড় ডাকঘরে ফেলার জন্য নিয়ে যেতেন কোলকাতায়। এহেন ডাক্তার পশুপতি দে, যেন তাপস চ্যাটার্জীর পথ চেয়েই বসে ছিলেন। একা থাকার দিন কাটল তার। এক গুরু শিষ্যের সর্ম্পক তৈরী হল দুজনের মধ্যে। ডাক্তার পশুপতি দে উঠে পড়ে তাপসদাকে ডাক্তারির পাঠ দেওয়া শুরু করলেন।

সবে মাত্র তাপসদাকে এখানের লোকজন তাপু ডাক্তার বলে চিনছে, দু’ এক বার তার হাতে হাসপাতালের ভার দিয়ে পশুপতি কোলকাতা ঘুরে এসেছেন। তাপসদা সামলে দিয়েছে বেশ। এক সন্ধ্যায় পশুপতি ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে ফাগুন বাগানের ম্যানেজার জিপে করে তার মেয়েকে নিয়ে এলেন হাসপাতালে। মেয়েটার ডান হাতটায় জড়ান একটা দামি শাল, রক্তে সপসপে ভিজে। তাপসদা কি করবে কিছু ভেবে ওঠার আগেই কে যেন খবর নিয়ে এল হাতির দল রাস্তার ওপর জড়ো হয়েছে। সদরে যাওয়া যাবে না। হাতির দল কখন সরবে কে জানে। ততক্ষণে সাহেবের মেয়েকে দেখতে ভিড় জমে গিয়েছে হাসপাতাল চত্তরে। বছর বাইশের এক পরদেশি ছেলে রাজকুমারীর হাতে জড়ানো রক্তে ভেজা শালটা খুলে দেখেছিল ইঞ্চি ছয়েক লম্বা এক ক্ষতের গভীর থেকে গলগল করে রক্ত চেলিন নদীর অবিরাম স্রোতের মত বেরিয়ে আসছে।

সে দিনের সে কথা ভাবলে আজও ভয়ে তাপসদার গলা শুকিয়ে আসে। গায়ে কাঁটা দেয়। সেই শীতের দিনেও ঘামে সপসপে ভিজে গেছিল জামা। যেন পাহাড় চেপে বসে ছিল বুকে। পায়ের আঙুলগুলো চা গাছের শিকড়ের মত মাটি আঁকড়ে নিশ্চল করে দিয়েছিল। একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকের মত কোন এক বিলাপের সুর মস্তিষ্ক থেকে সমস্ত স্নায়ু অবশ করে এক স্থবির অস্তিত্বের গহ্বরে ছুঁড়ে দিচ্ছিল তাকে। ডোমিনিক সাহেবের এক ধমকে তাপসদার সম্বিত ফেরে। তাকে নয়, ডোমিনিক সাহেব ধমক দিচ্ছিলেন মনকলা বুড়িকে। ম্যানেজারের বাংলোর ফুলের বাগানের মালি ছিল বুড়িটা। ফুল গাছ কেয়ারি করার জন্য তার কাছ থেকেই কুকরিটা নিয়ে ছিল অলিভিয়া। সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে মনকলার বিলাপ ডোমিনিক সাহেবের ধমকে থেমে না গিয়ে হড়পা বানের মত দুচোখ ছাপিয়ে বইতে লাগল। ডোমিনিক সাহেব তাপসদার দুহাত ধরে ভিজে গলায় বললেন, Please for heaven shake do something Tapas. She is my only child. Save her. তারপর কি হয়েছিল তাপসদা ঠিক ঠিক মনে করতে পারে না। ছেলে বেলায় দেখা ভুট্টাবাজারে মা কালীর থানে ভূতে পাওয়া পাগলী রাক্ষসী মেয়েটার কথা মনে পড়ে ছিল একবার। কোনও এক অজানা শক্তির ভরে অসাধ্য সাধন করত সে। এর থেকে বেশী কিছু মনে পড়ে না তাপসদার। তবে হ্যাঁ, সেদিন একটা অসাধ্য সাধন করে ফেলেছিল তাপসদা। কাঁপা কাঁপা হাতে আটটা সেলাই দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিল রক্তের স্রোত, ভরিয়ে দিয়েছিল ক্ষত।

পরদিন সন্ধ্যায় ডোমিনিক সাহেব এসে বলে গেলেন ভাল আছে অলিভিয়া। সদর হাসপাতালের নায়েক ডাক্তার দেখে বলেছেন সেলাই খুব ভাল হয়েছে। কয়েকটা ওষুধ লিখে দিয়েছেন। আর বলে দিয়েছেন কি ভাবে ড্রেসিং করতে হবে। সাত দিন বাদে সেলাই কাটতে বলেছেন। তাঁর একটা প্রেসকিপশান প্যাডে ডাক্তার নায়েক লিখেছিলেন Well done Tapas. May God bless you. সই ছিল নীচে।

ডাক্তারি পাশের সে সার্টিফিকেটে লাভ হয়েছিল দুজনের। তাপসদার আর পশুপতিবাবুর। ফাগুন বাগানের ডিসপেনসারিতে ফার্মাসিস্ট  হিসাবে তাপসদার সপ্তাহে দুদিনের পার্টটাইম চাকরি। মাসিক বেতন একশো টাকা। আর এর পর থেকে পশুপতিবাবু নিশ্চিন্তে ছুটি নিয়ে বাড়ী যেতে পারতেন।

অলিভিয়া রাই মাত্র তিন মাস ছিল এখানে। বারো ক্লাসের পরীক্ষার পর তিন মাসের ছুটিতে। সেলাই কাটার পর বিভিন্ন অছিলায় আসত তাপসদার কাছে। মনকলা বুড়ি ওর সঙ্গে সব সময় লেগে থাকত জংলি জোঁকের মত। একদিন এরই ফাঁকে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিয়ে অলিভিয়া বলেছিল আপনার একটা ছবি দেবেন। হয়ত তুমিই বলেছিল। মনকলাকে এড়াতে ইংরিজিতে কথা বলত অলিভিয়া। পরদিন সকালে ভুট্টাবাজারের আলোছায়া স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলেছিল তাপসদা। আর সেদিনই সন্ধ্যায় বাগানের ডিসপেনসারি থেকে ফেরার সময়ে একটু দাঁড়িয়ে যখন ফাগুন পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখছিল তখন কোথা থেকে অলিভিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, কাল বাদ পরশু বাবা আমায় কোলকাতা হয়ে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দিচ্ছে মামির কাছে। তাপস কাল সকালে তুমি সেনা ছাউনির কাছে অপেক্ষা করো। আমরা পালিয়ে যাব। হতচকিত তাপসদা প্রশ্ন করেছিল, কোথায় যাব রাই। দৌড়ে চলে যেতে যেতে অলিভিয়ার উত্তর এল, যে দিকে দু চোখ যায়। তুমি এসো কিন্তু…।

পালিয়ে গেছিল তাপস চ্যাটার্জী। ভোর রাতে হাতি খেদান পার্টীর টহলদারি জিপে চড়ে, সেনা ছাউনি, সেখান থেকে ট্রাকে ভুট্টাবাজার হয়ে বাড়ি। ফরেস্ট গার্ড দুখনা আর ড্রাইভার কায়লা হাসপাতালে এসে বলেছিল, মায়ের জন্য মন কেমন করছিল বলে তাপু ডাক্তার বাড়ি গেছে। সেই একবারই হাসপাতাল খালি রেখে চলে গেছিল ডাক্তার তাপস চ্যাটার্জী।

তিন দিন বাদে তিন কপি সাদা কাল পাসপোর্ট ছবি আর একটা নেগেটিভ নিয়ে ফেরত এল তাপসদা। আর তার দিন সাতেক বাদে বাগানের ডিসপেনসারিতে ডোমিনিক সাহেব এসে বললেন, অলিভিয়াকে লন্ডনের প্লেনে তুলে দিয়ে এলাম তাপস। মনটা ভাল নেই। কোলকাতায় আমার বন্ধু ডাক্তার নিলাদ্রী বোস তো অবাক, বলল এত ভাল সেলাই করেছে তোদের পাহাড়ি গ্রামের ডাক্তার। তিন মাসেই তো দাগ প্রায় মিলিয়ে গেছে।

হাঁপের টানের অসুখ ছিল মনকালার। ভাল থাকুক বা না থাকুক ফাগুন বাগানের ডিসপেনসারিতে সপ্তাহে দুদিন নিয়মিত আসত ওষুধ নিতে। সবার আগে এসে বারান্দার এক কোনে বসে থাকত, চেলিন নদীর দিকে চেয়ে। মাঝে মাঝে নিজের মনে বিড়বিড় করত। সবাই চলে যাবার পর আসত তাপসদার কাছে। কষ্টের কথা কিছু বলত না। তাপসদা পরীক্ষা করে দেখত বুক পিঠ চোখ জিব নাড়ী প্রেসার। দু’ একটা কথা জিজ্ঞেস করত। মনকলা যেন শুনেও শুনত না। ওষুধ লেখা কাগজটা নিয়ে যাবার সময় তাপসদার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করত, কোথায় ছিলে ডাক্তার। গুড়িয়া পাগলের মত খুঁজছিল তোমায়। তাপসদা চোখ সরিয়ে নিত। চেলিন নদীর স্রোতে গড়িয়ে যাওয়া নুড়ির মত আবার চেলিনের বুকেই ফিরে আসত। যাবার সময় মনকলা বলে যেত, তুমি পাহাড়ি হলে এ ভাবে পালাতে না।

আত্মপক্ষ সমর্থনে কোন দিন কৈফিয়ৎ দেয়নি তাপসদা। শুধু বাগানের ডিসপেনসারি থেকে ফেরার সময়ে ফাগুন পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখার জন্য দাঁড়াত একবার।

বছর ঘুরতে না ঘুরতে আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল পাহাড়। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল এখানের বনবাংলো। ভয়ে উৎকন্ঠায় ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ বাবামাকে ফেলে রেখে তাপসদার মা একদিন চলে এলেন হাসপাতালে। ডোমিনিক সাহেব মাকে বলেছিলেন, Tapas is a very good boy, very, very responsible. এরকম সময়েও হাসপাতাল ছেড়ে যায় নি। ওকে বিয়ে দিন। Settle him in family life. মা আমতা আমতা করে বলেছিল, আমাদের রোজকার ত সামান্য। এত বড় পরিবার। আর পাহাড়ের যা অবস্থা। ডোমিনিক সাহেব বলেছিলেন তাপসের কিছু হবে না। সবাই ওকে ভালবাসে। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। তাপসদার মা নিশ্চিন্ত হতে পারেননি তবে বাড়ি ফিরে গেছিলেন।  হ্যাঁ, সেই উত্তাল আন্দোলনের সময়ে তাপসদার কিছু হয়নি, কিন্তু ওলোট পালোট হয়ে গেছিল ফাগুন বাগান। বৃটিশ মালিক বাগান বেচে দিল। ডোমিনিক সাহেব এদেশের পাট চুকিয়ে ইংল্যান্ড রওনা দিলেন। যাবার আগে তাপসদার মাইনে একশো থেকে তিনশো করে দিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন, This is the most I can do. Get married and settle in life. May God bless you. নতুন মালিক, নতুন ম্যানেজারের সঙ্গে তাপসদার পরিচয় করিয়ে অনুরোধ করে ছিলেন তার চাকরিটা যেন ঐ মাইনেতে বজায় থাকে।

আমাদের সামনে দূরে জোৎস্নায় প্লাবিত মোহময় ফাগুন পাহাড়ের কোলে দুটো বাড়ি ম্যানেজারের বাংলো আর কারখানা। চেলিন নদীর অবিরাম কুলকুল শব্দের অখন্ড নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলাম, আর মনকলা বুড়ি। তাপসদা বলল ওষুধ মনকলা নিয়মিত নিয়ে যেত। কিন্তু আমার সন্দেহ হয়, ও ওষুধ খেত না। প্রত্যেকবার আমাকে একই প্রশ্ন করত। একদিন বলেছিল উত্তরটা জানার জন্যই নাকি ও বেঁচে আছে। ওর সাতকুলে কেউ ছিল না। একবার পরপর দুদিন বাগানের ডিসপেনসারিতে এল না। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। দুপুরের দিকে বস্তির লোকজন ওকে হাসপাতালে নিয়ে এল। তখন ওর অবস্থা সত্যিই খারাপ। অসম্ভব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। স্টেরয়েড দিয়েও কোন কাজ হচ্ছিল না। কিন্তু শরীরের কোন কষ্টের কথা বলল না। হাঁপাতে হাঁপাতে প্রলাপের মত আমাকে ঐ একটাই প্রশ্ন করল। পশুপতি স্যারের সেদিন কোলকাতায় যাবার ছিল। বললেন একে রাখা ঠিক হবে না। সদর হাসপাতালে রেফার করে দিয়ে রওনা দিলেন। কিন্তু মনকলাকে নিয়ে যাবে কে। শ্বাস নিতে এত কষ্ট হচ্ছিল যে বিছানায় বসেও দরদর করে ঘামছিল। ততদিনে এখানে ফোন এসেছে। ভয়ে ভয়ে তাপসদা ফোন করেছিল ডাক্তার নায়েককে। খুব মন দিয়ে সব কথা শুনে ছিলেন ডাক্তার নায়েক। তারপর বললেন, মনে হয় না কিছু করা যাবে। আমি তোমায় একটা মেশিন পাঠাচ্ছি। সঙ্গে কিছু ওষুধ। কি ভাবে মেশিনটা ব্যবহার করতে হবে লিখে দেব। শ্বাসকষ্ট হয়ত একটু কমবে। এই আর কি। কাজ হয়ে গেলে ফেরৎ পাঠিয়ে দিও মেশিনটা। সন্ধেবেলা হরি ওম বাসে এসেছিল মেশিন আর ওষুধ। ডাক্তার নায়েকের নির্দেশ অনুসারে তাপসদা চালিয়ে ছিল নেবুলাইজার। মনকলার বিছানার পাশে বসে ছিল সারারাত। শেষ রাতে মনকালার শ্বাসকষ্ট কমে গেল। মুখের মাস্ক খুলে দিতে বলল। সারা রাত বসে থাকার পর বিছানায় শুলো। সিস্টারের কাছ থেকে একটা এক্সট্রা বালিস চেয়েছিল মাথাটা উঁচু করবে বলে। দুপুরবেলা মনকলা মরে গেল। শ্বাসকষ্ট কমে গেলেও মনকলা কেন মরে গেল তা তাপসদা জানে না। মরে যাবার আগে মনকলা জিজ্ঞেস করেছিল, সে দিন যখন পালিয়ে গেলে আজ কেন পালালে না ডাক্তার? আমার হিসেবটা যে মিলল না।

চোখের কোণে জোৎস্নায় চিকচিক চেলিন নদী নিয়ে ফাগুন পাহাড়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তাপসদা। তারপর পকেট থেকে চামড়ার একটা মানিব্যাগ বার করল। বাঁ দিকের ভাঁজে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের নীচে ছেলে কুনালের রঙিন ছবি। তার নীচ থেকে সাদা-কাল পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি বার করে আমার হাতে দিল। চাইনিজ কাটে ছোট করে কাটা চুল। পরিষ্কার মুখ। ঝকঝকে এক অষ্টাদশীর একটু বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছবি। ফেরত নিয়ে তাপসদা বলল, আজ চলি। মিনতি আমার জন্য না খেয়ে বসে আছে। আমি বললাম, আচ্ছা তাপসদা মিনতি বৌদি জানে, অলিভিয়ার কথা? তাপসদা বলল, কে জানে। আমি কোন দিন বলিনি ওকে। সত্যি বলতে কি তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই বলিনি কোন দিন। আর আমাদের বিয়ের অনেক দিন আগেই মনকলা মরে গেছিল।  মনে হয় না মনকলা কাউকে বলেছিল এ সব কথা। আমাকে কিছু বলার আগে সব সময় ভাল করে দেখে নিত আসে পাশে কেউ আছে কি না। চলি। কাল কিন্তু সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিও। দেরি করো না।

পরদিন খুব সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম। আমায় আর তাপসদাকে সদর কোর্টে যেতে হবে। একটা দূর্ঘটনায় মৃত্যু মামলায় সাক্ষী দিতে। এক চিলতে ব্যাডমিন্টন কোর্ট পেরিয়ে তাপসদার কোয়ার্টার। গ্রীল দিয়ে ঘেরা ছোট বারান্দার ওপারে খোলা জানালা। পরিষ্কার দেখা যায় মিনতি বৌদি খাটে বসে তাপসদার ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে। জলের বোতল, একটা ছোট টিফিন বাক্স, ভাজা মসলার কৌটো, তাপসদার মানি ব্যাগে দুটো একশো টাকার নোট রাখল বৌদি। তারপর বাঁ দিকের ভাঁজে কুনালের ছবির নীচ থেকে অলিভিয়ার ছবিটা বার করে এক ঝলক দেখল। কি যেন ভাবল, একটু হারিয়ে গেল বোধ হয়। তারপর অভ্যস্ত হাতে কুনালের ছবির পেছনে সযত্নে রেখে দিয়ে বলল, কতবার বলেছি মানি ব্যাগটা এখানে ওখানে রেখো না, হারিয়ে যায় যদি, কে শোনে কার কথা।

এ গল্পে তাপস চ্যাটার্জী ছিল। এ গল্পে অলিভিয়া রাই ছিল। এ গল্পে সবুজ কার্পেটের মত চা বাগান ছিল। এ গল্পে জোৎস্নায় চিকচিক চেলিন নদী ছিল। ফাগুন পাহাড়ে সূর্যাস্ত ছিল। এ গল্পে মনকলা বুড়ি ছিল, ডোমিনিক সাহেব ছিল, মিনতি বৌদি ছিল। এ গল্পে বহু ব্যবহৃত, পালিশ চটা, ভাঁজ খাওয়া কোন চামড়ার মানি ব্যাগ ছিল না। হ্যাঁ, অলিভিয়ার একটা স্মৃতি চিহ্ন তাপসদার কাছে ছিল। সেটা তাপসদা ঠিক কোথায় রাখত তা মিনতি বৌদি জানত। এত স্বচ্ছ, এত গোপন, এত স্বযত্নে লালিত তথ্য আমি লিখে উঠতে পারি নি।

 

 

 

3 thoughts on “ইরাবতীর ছোটগল্প: চামড়ার মানিব্যাগ । কণাদ বাগ

  1. কণাদদা, এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। খুব ভালো লিখেছেন। চেনিল নদী, পাহাড়, সূর্যাস্ত, জ্যোৎস্না, পাহাড়ি নদীর নির্জন জলস্রোত, এক যুবকের অসহায়তা, এক কিশোরীর প্রথম প্রেমের রোমাঞ্চ— গল্পের গদ্যের ভিতর মায়াবী দ্যুতির জন্ম দিয়েছে। পড়ে খুব ভালো লাগল। আরও লিখুন।

  2. কনাদ দা, অসাধারন লাগলো, অত্যন্ত প্রানবন্ত হয়েছে লেখাটা। প্রকৃতি, প্রেম, অনুভূতি, স্মৃতি রোমন্থন, খুব সাবলীল ভাবে ফুটে উঠেছে। আরও ভালো কিছু লেখার আশায় রইলাম। চালিয়ে যাও।

  3. কনাদবাবু আপনার চামড়ার মানি ব্যাগ পড়তে পড়তে হারিয়ে গিয়েছিলাম কোথায় জানিনা। নিজের একটা বাস্তব চোখের সামনে ভেসে উঠল। ইচ্ছে রইল কোনদিন সেটা বলার…।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত