বন্ধু মানে কী?
আমি এখনো বুঝি না, বন্ধু মানে কী? আমার কাছে এর সংজ্ঞা সময়ে সময়ে বদলায়। স্কুলবেলায় বন্ধু মানে ছিল, যার সঙ্গে সব ভাগাভাগি করা যায়- টিফিন, ক্লাসের নোট খাতা, পেন্সিল, বোতলে মুখ লাগিয়ে খাওয়া পানিটাও।
এরপর কলেজে উঠলাম। তখন শুধু টিফিন, কলম আর রিকশার ভাড়া ভাগাভাগি করলেই মন ভরতো না। বন্ধু মানে হয়ে উঠলো যার সঙ্গে ‘বি’ সেকশনের মেয়েটা কেমন ন্যাকামি করে কিংবা পাশের বাসার ছেলেটা আজ কাকে দেখে মুচকি হাসলো এসব নিয়ে গালগপ্প করা যায় সে।
ইউনিভার্সিটিতে আবার আরেক রকম লাগত বন্ধুত্বটা। এই সময়ে এসে আর অত গালগপ্পের সুযোগ কই? সবাই যেন ছুটছে! ছোটাছুটির ফাঁকে যার যার সঙ্গে কোর্স মিলে যায় তাঁর সঙ্গে আড্ডাবাজি, গানবাজনা, ঘোরাঘুরি, বাইরে খাওয়া আর কারো ব্রেকআপ হলে তার কান্নার সময় টিস্যুর বক্সটা এগিয়ে দেওয়া…এই আর কি।
আমি এতক্ষণ সব পরিস্থিতির কারণে গড়ে ওঠা বন্ধুদের কথা বললাম। মনে হবে আমার জীবনে বুঝি সব বন্ধু এমন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণেই পাওয়া! মোটেও তা নয়। আমার বন্ধু ভাগ্য দারুণ ভালো। তবে একটু অন্য রকম। একটা ঘটনা নয়, কয়েকটা স্মৃতির চারণ করে এটা বলতে হবে।
যেমন স্কুলে। আমি ছিলাম কেমন যেন! অদ্ভুত লাগতো নিজেকে! আমার বন্ধু ছিল ক্লাসের সবাই। রোল ১ থেকে ৭০ পর্যন্ত। কিন্তু এত বছর পরে এসে, এখন সর্বসাকুল্যে স্কুলের ৩টা পাগলের সঙ্গেই সুখ-দুঃখের কথা বলি। ওদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কোনো অতীত ইতিহাসের বর্ণনা দিতে হয় না। কারণ ওরা তো আমার জীবনের অর্ধেকের বেশিটাই জানে। আমিও তাদেরটা জানি। আমি যে মরিয়ম আপার ক্লাসে বরাবরই পড়া দিতে গিয়ে ধরা খেতাম, জোরে লাফ দিতে গিয়ে পা পিছলে আছাড় খেতাম, এসব তাদের স্পষ্ট মনে আছে। তাই এখনো জীবনের কঠিন হিসাব নিকাশে ধরা খেলে, কোনো বড় সুযোগ হাত ফসকে গেলে, ওদের গিয়ে বেশি কিছু বলা লাগে না। দু’লাইন শুনেই ৪টা গালি দিবে। আর স্কুলের আছাড় খাওয়া, ধরা খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলবে, “তুই মরস না ক্যান!” তাদের এই কথায় অদ্ভুত জোর আছে। কয়েক সেকেন্ডেই বুঝে যাই- “আমি তো অনেক কিছুর পরও বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকাটা কী আনন্দের!” সত্যিই তো, যেদিন স্কুলে সবার সামনে আছাড়টা খেলাম, জামার পেছন দিকটা ছিঁড়ে গেল, তখন মনে হয়েছিল “ছি ছি, সবাই দেখলো! কি লজ্জা! আমি কাল থেকে স্কুলে আসব কিভাবে? আমার জীবনটা তো শেষ হয়ে গেল!” কিন্তু আমি তো ঠিকই পরদিন স্কুলে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধুরা আমার আছাড় খাওয়া নিয়ে উপহাস করাটাকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। তখন যে আমি রাগে কেমন কিটমিট করেছি! তবে এখন বুঝি, সেটাই আমাকে সবকিছু সামালে নেওয়ার সাহস দিয়েছে। আছাড়-হোঁচট খেয়েও যে বেঁচে থাকাটা সুন্দর, এটা আমাকে বুঝিয়েছে আমার স্কুলের বন্ধুরা।
ধন্যবাদ সাদিয়া, রুবাইয়া, রুহি- তোদের গালিগালাজ আর “তুই মরস না ক্যান!” কথাটা আমাকে এত এত শক্তি দেয়। বুঝতে পারি যে, বন্ধুর ওপর বন্ধুর অধিকার থাকে, কিন্তু অধিকার ফলানোর চেষ্টা থাকে না। তোরা সেই চেষ্টা না করেই আমাকে কত কিছু শিখিয়ে দিস!
আমার বান্ধবি জেরিন। কলেজে ও এক সেকশনে পড়ত, আমি আরেকটায়। কালেভাদ্রে আমাদের কথা হতো, দেখা হতো। জেরিন আর আমার বন্ধুত্বটা হয় কলেজ শেষ হলে। কেমন কেমন করে সেটা হলো, তা আর মনে নেই। মনে নেই আমাদের বন্ধুত্বের কারণ। শুধু মনে আছে জেরিনের সঙ্গে প্রথমবার আমি মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখেছিলাম! এরপর আরো কত যে পাগলামি করেছি। এক সঙ্গে উঠে গেছি অচেনা এক বাসে। এরপর বাসের জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে যে জায়গাটায় চোখে সবুজ ঠেকেছে সেখানে নেমে গেছি টুপ করে। ভাত খেয়েছি নাম না জানা গ্রামের বাজারে। চা খেয়েছি হাইওয়ের পাশের ছাপড়া টং দোকানে। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেছি, “মামা, শহরে নিয়ে যাবেন?” তখন আমাদের বয়স ২২, ২৩ কিংবা ২৪। মেয়েদের যে সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হয় না, আমি আর জেরিন সে সময় নাম না জানা গ্রাম থেকে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ফিরেছি! বাসায় ফিরে মনে হয়েছে, এটাই খাঁটি বন্ধুত্ব!
কিন্তু আমি এক হতচ্ছাড়া। খাঁটি বন্ধুত্বের কদর করতে জানি না। সবাই বলে খাঁটি জিনিস যত্নে রাখতে হয়, সামলে রাখতে হয়। আর আমি? জেরিন ফোন দেয় আমি ধরি না, ফোন কেটে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকি, আজ দেখা করব, কাল করব, সময় আর বের করা হয় না। এভাবে মাসের পর মাস কেটে যায়, খাঁটি বন্ধুর অভিমান বাড়ে আর আমি ভুলোমনা সেজে থাকি। এরপর হঠাৎ তার বাসায় হাজির হই অনাহুত অতিথি হয়ে। মনে মনে ভয়ে থাকি, জেরিন বুঝি দরজাটা খুলবে না। কিন্তু বন্ধু তো, তা-ও খাঁটিটা, তাই সময়ের বদলে যাওয়া বদলাতে পারে না আমাদের। আমরা আবার হাসি, গালিগালাজ করি, মারামারি করি, এরপর আবার বসে পড়ি নতুন কোনো পাগলামির ফন্দি আঁটতে।
একই অবস্থা আমার আর আমার বন্ধু স্নিগ্ধার। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এর কোনোটাই আমাদের পরিচয়ের মাধ্যম নয়। স্নিগ্ধা আর আমার যোগাযোগ ফেসবুকে। একদিন অনেক আয়োজন করে দেখা করি আমরা। এরপর দেখা করতেই থাকি, কথা বলতেই থাকি। কোনো প্রয়োজনে না, স্নিগ্ধা আর আমার বন্ধুত্ব কোনো “কি? কেন? কোথায়? কবে? কখন? কিভাবে?” এর উত্তরের ঊর্ধ্বে, কোনো যুক্তি ছাড়া, বিনিময় ছাড়া বন্ধুত্ব। ওকে আমি বলি আমার সিন্দুক। আমার যা মন চায়, আমি ওকে তাই বলি। আর আমার সিন্দুক সে সব গোপন কথা তার মধ্যে জমা করে রাখে। আমি আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই। কোনো যোগাযোগ হয় না, কথা হয় না, দেখা হয় না। অনেক অনেক দিন পর, আবারও যখন কথা জমে যায়, তখন সিন্দুকটায় কথা রাখতে আবার যাই স্নিগ্ধার কাছে। সিন্দুক-বন্ধু স্নিগ্ধাও কোনো “কারণ দর্শাও” নোটিশ চায় না। আমার কথার ঝাঁপি ও বাধ্যগত সিন্দুক-বন্ধু হয়ে নিজের করে নেয়।
আরেকটা বন্ধুর কথা বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই নিজের ভবিষ্যত, ক্যারিয়ার এসব নিয়ে ভাবে বেশি। তাই আমার কাছে মনে হতো এই ধাপের বন্ধুত্ব খুব একটা গাঢ় হবার নয়। ভার্সিটির চৌকাঠ পেরোলেই বন্ধুত্ব বুঝি উবে যাবে। কিন্তু আজব! মৌ এমন ভাবে না। কাছের বন্ধুর সবচেয়ে ছোট ছোট দিকও যে এত শত পার্থিব যন্ত্রণার মাঝেও মনে রাখা যায়, সেটা মৌকে না দেখলে বুঝতাম না। আমার মতো “এই আছি, এই নাই” টাইপ বন্ধুর জন্যও ওর অদ্ভুত আবেগ আমাকে বন্ধুত্বের আরেকটা সংজ্ঞার সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। যে সংজ্ঞাটা আপাতত আমার কাছে চাঁদ-সূর্যের মতো চিরন্তন লাগছে। সেটা হলো- অনেক অনেক দুরত্বেও যে সম্পর্ক মরে না, যে সম্পর্কে “ভুলে যাওয়া” নিয়ে কেউ কোনো দোষারোপ করে না, যে সম্পর্কে জবাবদিহিতা বা বিনিময় নেই কোনো, যে সম্পর্কে ফিরে আসাটাই যথেস্ট, সেটাই বন্ধুত্ব। এটা হলো অনেকটা খুব অল্প হিসাব নিকাশে অদ্ভুত এক দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়পত্রের মতো, যেখানে পুঁজি দিয়েই জীবন কাভার, সুদ-মাসিক ডিপোজিট-লভ্যাংশের কোনো বালাই নেই!
এত বছর ধরে আমার বন্ধুরা আমাকে শিখিয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বদলালেও, বন্ধুরা কখনো বদলায় না। হাজার আলোকবর্ষ পরেও তাদের দরোজা সবচেয়ে স্বার্থপর আর হতচ্ছাড়া বন্ধুটার জন্য খোলাই থাকে।
তোদের খুব ভালোবাসিরে। গালি দিবি জানি, তবু সাহস করে বলেই দিলাম আজ। বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা।
.
.