| 13 ডিসেম্বর 2024
Categories
এই দিনে লোকসংস্কৃতি

মহা-লয় থেকে মহা আলয় । গৌরী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

আজ ২৫ আগষ্ট সংস্কৃতের পণ্ডিত, লেখক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রাক্তন প্রধান গৌরী ধর্মপালের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধা।


বিশ্ব যখন নিদ্রামগন গগন অন্ধকার
কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝঙ্কার

রাত্রি-সূক্ত। ভরদ্বাজ-বংশের কনী মেয়ে আদরিণী কন্যা রাত্রি। দেখছে আঁধারের রূপ। অসংখ্য তারার চোখ দিয়ে নিজের রূপ বলতে বলতে আসছেন স্বয়ং রাত্রি। যেদিকে তাকাচ্ছেন অগাধ অসীমে ফুটে উঠছে চোখ -চোখ -চোখ, অজস্র চোখ। তারা ঝিকমিক্ জোনাক্ ঝিকমিক্ ঝলমলে বসন পরে আসছেন কুচকুচে কালো মেয়ে কৃষ্ণা। উঁচুতে নীচুতে গ্রামে গৃহে বনে অরণ্যে কান্তারে প্রান্তরে যেখানে তাকাচ্ছেন ফুটে উঠছে, থিতু হয়ে যাচ্ছে শ্রী। তাঁর শ্রীময়ী কালো আলো দিয়ে যত আঁধার হঠাতে হঠাতে আসছেন অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো। চিলনী মায়ের ডানার মতো তাঁর মধ্যে ঘুমিয়ে আছে গ্রাম, ঘুমিয়ে আছে দু-পেয়েরা, ঘুমিয়ে আছে ডানাতলা পাখিরা, ঘুমিয়ে আছে মতলব-ধান্ধা ছোঁ-মারি; জেগে আছে শুধু সোনালী ডানার চিল, হিরণ্ময় ছন্দ। জেগে আছে শুধু বাক্। সোনার বেতস হয়ে দুলছে আর দুলছে। রাত্রি দেখল, গড়ুরের বিশাল ডানা নিয়ে রাত-মা আত্-মা ক্ষ্যাপা অব্যক্তম্ আসছেন খেলতে খেলতে। দেবনশীলা পাশা খেলতে খেলতে, পাশার দান ফেলতে ফেলতে পাশাবতী রাক্ষসী। কোথায় তাঁর তীক্ষ্ণ তীব্র তৃষাতুর খড়্গের মতো ঠোঁট বসাবেন দেখতে দেখতে। রে মোহিনী, রে নিষ্ঠুরা, ওরে রক্তলোভাতুরা কঠোর স্বামিনী। দিন মোর দিনু তোরে, শেষে নিতে চাস হ’রে আমার যামিনী?

নদের যতি-কবির মতো যাঁরা তাঁর খেলার খেলুড়ে হয়ে বলতে পারে ‘দুর্ভাগ্যের আমি ভগবান্’ তাদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না; তাদের সখী হয়ে যান, অন্তরতমা মহা আপন সে কি! সাকি! লীলাময়ী জ্যোতির্ময়ী ব্যক্তা স্পষ্টা অস্পষ্টা রহস্-মতী রাত্রি। তাঁদের কথা যোগান……. অফুরান অনন্ত কবিতা, ঋক্-যজুম্-সামময়ী ভাষা। তুমি যা বলাও আমি বলি তাই। ত্বম্ অস্য যন্তা সূক্তস্য, ঋ.২.২৩.১৯। তুমিই এ-সূক্তের নি-য়ন্তা। সারথি। অন্তর্যামিনী। যামিনী। গভীর অন্ধকারে পথ পেরিয়ে জলে নামল সাগরপঙ্খী নৌকা। বারুণ সমুদ্র। মহার্ণব।ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে ঊর্মিল স্রোতের মধ্যে স্রোতাপন্ন হতে হতে প্র-তরণ করছে রাত্রি, ভরদ্বাজ – বংশের কনী কন্যা ঋষি হচ্ছে। অনবরত সু-তরা হচ্ছে, দক্ষ সাঁতারু হচ্ছে, লবণাম্বুরাশির কলঙ্করেখা পেরিয়ে পারংগম হচ্ছে, বুলা সঞ্জয় চৌধুরী – চক্রবর্তীর মতো। বৃক-বৃকীরা ছিঁড়ে নিতে আসছে, চুপিচুপি কেড়ে নিতে আসছে হাঙর, তিমি-তিমিঙ্গিল, আকাশ-পাতাল জোড়া সিংহিকা- হাঁ হয়ে, তার রক্তমাংস মেদ-মজ্জা, তার পরমধনগুলি – জানি হে, তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম/ এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম-মা তাদের খেদিয়ে দিচ্ছেন। যাবয়া বৃক্যং বৃকং যবয় স্তনম্ ঊর্ম্যে। অথা নঃ সুতরা ভব (ঋ.১০.১২৭.৬)। তমের মধ্যে তম হয়ে,আঁধারের পেশোয়াজ পরে মা আমাদের নাচ দেখাচ্ছেন যে! নিষ্কূল অকুল অতল সভার নাচ। সব দিয়ে সব পাওয়ার বিন্ টিকিটের নাচ। দর্শক হওয়া চাই। ঋষ্ দর্শনে।ত্রিযামার প্রহরের শেষ-ঘন্টা বাজছে।রাত্রি কূল থেকে আমরা আসছি ঊষার কূলে।উষা-রাত্রি উষাসা-নক্তা—দুই বোন ওঁরা।একই।একবার এ পিঠ দেখান,একবার ও পিঠ।হে বিভাবরি, হে আলোকের মেয়ে রাত্রি—রা দানে, রা মানে দান।তোমার অজস্র দানে বিজয়িনী হয়েছি আমি।আমার শুধু একটি মুঠি ভরি দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী।হল না সারা কত যুগ ধরি কেবলি আমি লব।আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব।…….গান ধরব,বরণ করো আমায়। বৃণীষ্ব দুহিতর্ দিবঃ।রাত্রি স্তোমং ন জিগ্যুষে।(১০.১২৭.৮)।বিভাবরী রাত্রি মাতর্ , উষসে নঃ পরি দোহি। তোমার কাঁথা দিয়ে ঢেকেঢুকে উষার কোলে তুলে দাও আমাদের—বিভাবরী মা আমার।

মাত্র একটি সূক্ত সমগ্র ঋগ্বেদের ১০২৮টি সূক্তের মধ্যে।তাতেই মাত্। মহালয়া থেকে বিজয়া পর্যন্ত।
আর্য মানুষের চলার ইতিহাস। আঁধার আলোর যুদ্ধের ইতিহাস।ভারতের ঐতিহাসিক থেকে আধ্যাত্মিক,বৈদিক থেকে পৌরাণিক,ভূমি থেকে মহাভূমিক স্তর পরম্পরার ইতিহাস।একটার সঙ্গে আর একটা অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা।ব্যক্তিতে সমাজে কুকুর-কুন্ডলী।

আর্য মানে চলন্তক।ঋ চলা, ণ্যৎ প্রত্যয় আর য।জাতি নয়,ধলা নয়,নার্ভিক নয়, race নয়,সম্প্রদায় নয়।চরিত্র।ঋজু সবল চরিত্র।মানুষের মতো মানুষ।সে পৃথিবীর যেখানেই থাকুক।অ-প্রি,দীর্ণ-বিদীর্ণ করা যায় না যাকে কিছুতেই—সেই অচলায়তন ভাঙতে ভাঙতে চলেছে।উড়ন্ত ডানার বলাকা হয়ে,নিখিলের পাখার ঝট্পটিতে বেগ লাগিয়ে,বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালাতে জ্বালাতে আনন্দধারায় ঝরে পড়ছে।

আর্য-শব্দের ভুল ব্যাখ্যা এবং ১০০০ খৃ. পূ. আর্য আক্রমণ থিওরির জাল যাঁরা বিছিয়ে ছিলেন দেড়শ’বছর ধরে, তাঁরা প্রায় নিহত।জাল কেটে বেরোনো ঋষি মুনি বিজ্ঞানীদের প্রাণপাত পরিশ্রমে ভারতের সত্য ইতিহাসের দরজা খুলে গেছে।অতএব ভয় নেই।

ঋগ্বেদ ১০.১২৭ সূক্তটির ঋষি বিকল্প আছে কুশিক সৌরভ।সু-ভর মানে রীতিমতো ভালোরকম আবেশ হয়েছে যাঁর।কুশিক মানে রাতের পাখি,পেঁচা।পেঁচার রাডার(Radar)-এ নিশীথিনীর শব্দ কেমন করে ধরা দেয়,তা যিনি জানেন,হৃদয়বীণার তারে তারে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম অক্ষর মাত্রা শব্দস্পন্দনে,সেই মহাকবিই কুশিক বা রাত্রি। মেয়েই হোক বা ছেলেই হোক—অর্ধনারীশ্বর-সূক্ত। মেয়ের ভাব বা ভার একটু বেশি,তাই স্ত্রীলিঙ্গেই ডাকে লোকে।তাছাড়া ঋষিতে দেবতায় নামও এক।ফলে পাল্লা ভারী হয়ে…. …. ….।বেচারা পেঁচা। উঁহু,বেচারী কেন? বহুযুগের ওপার হতে সৌরভ আর রাত্রি দুই বন্ধু যুগপৎ তরণ করছে।সেই মহাবরষার নীল চিক্চিকে রাঙা জল,কখনো চিৎ-সাঁতারে,কখনো বা ডুব সাঁতারে।তারই শব্দ উঠছে নিত্যকাল,মৃত্যুঞ্জয় অমৃত সূক্তে।নতুন নাম দেব—রাত্রি কৌশিক সূক্ত।

এই রাত্রিকৌশিক সূক্তকে শিরোধার্য করে তৈরী হল দেশের মহাসঙ্কটের দিনে জাতীয় মহাকাব্য শ্রীশ্রীচণ্ডী।ওটি বৈদিক ভাষায়,এটি তারই ধারাবাহিক সংস্কৃত ভাষায়।একই ভাষা,একই ভাব, একই সংস্কৃতি।

অত্যাচারী প্রবল-প্রতাপ চন্ড আর মুন্ডকে ধড় আলাদা মাথা আলাদা করে দিয়েছিলেন এক অসম সাহসিকা তেজী মেয়ে,তাঁর দলবল সহ।কেমন ছিল তাঁর দল?ডাক দিলে তারা ধেয়ে আসত অভয় দিতে,তাই ডাকিনী।শাঁখের আওয়াজে বহু দূর পর্যন্ত জানিয়ে দিত ডাকাত পড়েছে,চলে আয় হাতিয়ার নিয়ে,তাই শাঁকিনী। আবার শক্তিময়ী,তাই শাকিনি।শক্ শক্ত সমর্থ হওয়া,’শিক্ষিত’ হওয়া।শুধু বুদ্ধিজীবী নয়।শাঁখের আওয়াজ হল অ-মাইক ঘোষণা।পুলিশ এসেছে, বিপ্লবীদের সাবধান করতে মেয়েদের এই আওয়াজে মুহুর্মুহু কাঁপত মহল্লা।ভূমিকম্পেও এই শাঁখের আওয়াজ।কুসংস্কার নয় হে রাজনীতিক,বিপদ সঙ্কেত। শিঙার মতো।সাইরেনের মতো।দমকলের মতো।

ভয়ঙ্কর দুই গণশত্রুর নামের অক্ষর দিয়ে তৈরী হলেন ঐ মেয়ে।দেবী চামুণ্ডা।দেবী নয় তো কী? আমরা কি মানুষ?না পোকা? তার তুলনায় সেই চণ্ড-মুণ্ড বিনাশিনী, মাভৈঃ মাভৈঃ ভয় করো না।ভয় করো না—বলতে বলতে ছুটে আসা অ-ভয়া চামুণ্ডা,দেবী নয়? তবে হ্যাঁ,ফুল দিয়ে শুধু পূজা করাটা ঠিক নয়।হবে হয় চামুণ্ডা।অন্তত সে মেয়ের ছিটেফোঁটা।কিছু মেয়ে তাই হচ্ছেনও। পুং নামধারী কিছু না মানুষকে পিটিয়ে বা না পিটিয়ে ঠান্ডা করছেন পূজার বা না-পূজার ভিড়ে, সহরে গাঁয়ে রাস্তায় বাসে লোকে রেলে সভায় সমিতিতে গৃহে সমাজে।সঙ্গে আছেন আর্য পুরুষরা।বেশির ভাগ?না কম ভাগ?

সেই চামুণ্ডাকে স্মরণ করেই তৈরী হল জাতীয় মহাকাব্য চণ্ডী।ঠিক যেমন ‘জয়’ নামক কাব্যকে ছড়িয়ে ছাড়িয়ে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস লিখলেন মহাকাব্য ‘মহাভারত’;ঠিক যেমন সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে ছড়িয়ে ছাড়িয়ে বঙ্কিম লিখলেন ‘আনন্দমঠ’—জাতির চেতনা জাগাতে।দাসরা, গোলামরা তো জাগবে না,তাই আর্য-আর্যাদের চেতনা জাগাতে, তিন যুগের তিন মহাকাব্য।

‘চণ্ডী’র সুরুতে নবার্ণ-মন্ত্রে নয় অক্ষরে ঋণ স্বীকার ও প্রণাম করা হয় তাঁকে।ওঁ-এর পর নয় অক্ষর—ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে।’বিচ্চে’ হল ভিক্ষে-র তামিল রূপ,উত্তমপুরুষ একবচন।একই ভাষা, একই সংস্কৃতি।সিংহলের একজন ক্রিকেট বীরের নাম চামুণ্ডা ব্যাস; একজন পদাধিকারীর নাম মল্লিকার্জুন খড়্গে।ইতিহাসের সুস্পষ্ট পদধ্বনি আছে এইসব নামে।মন্ত্রের মানে হল—মহাসরস্বতী, মহালক্ষী,মহাকালী স্বরূপা হে চামুণ্ডা,শরণ চাই তোমার কাছে।দাও তোমার বীর্য,তোমার সাহস,তোমার শক্তি, শত্রুনিধন করি।আমাদের সড়কি চালানো দাক্ষায়ণী,ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈ,ফ্রান্সের জোন অব্ আর্ক, আমাদের বীণা দাস,প্রীতিলতা ওয়াদ্দেকার,বাংলার আর সব বিপ্লবী মেয়েরা,মাতঙ্গিনী হাজরা ,সুভাষচন্দ্রের ‘ঝাঁসির রাণী’ বাহিনীর মেয়েরা—এঁদের সবারই পূর্বসূরী এই চামুণ্ডা।স্বায়ুধা-—স্ব আয়ুধা,সু আয়ুধা।নিজেই নিজের আয়ুধ হাতিয়ার।একাই একশো।দশ দিকে দশ হাতে শত্রু বিনাশ করছি,দশ বাহু দশ বাই চণ্ডী।ব্রহ্ম বর্ম মম অন্তরম।বিপুল চেতনাই আমার বর্ম।আমার জীবন লভিয়া জীবন জাগো রে সকল দেশ।

ঋষি-মুনি মার্কণ্ডেয়-র মহাগ্রন্থ চণ্ডী।তাঁর বক্তব্যের তারিখ হল—সৃষ্টির আগে থেকে সাবর্ণি মনুর কাল এবং উত্তর কাল পর্যন্ত।প্রায় অনাদি অনন্ত কাল।লেখা হয়েছে অনেক পরে।কিন্তু বক্তব্য হল ঐ।যেমন,রবি-র গীতবিতানের বক্তব্যের তারিখ হল’প্রথম যুগের উদয় দিগঙ্গনে প্রথম দিনের উষা-র তারিখ।জড়ের সমুদ্র,প্রাণের সমুদ্র,মনের সমুদ্র পেরিয়ে মানুষের চৈতন্যের চরায় ওঠা, চূড়ায় ওঠা, পর্বতে চড়া।তাতেও কি নিস্তার আছে?যতক্ষণ না তোমার চর-অচর, অনবরত চলতে থাকা চরাচর এক হচ্ছে, যতক্ষণ না তুমি ‘শম্ভু’ হচ্ছ,ততক্ষণ তোমাকে আকাশে তুলেও ছুঁড়ে ফেলে দেবেন,যিনি সব কিছু মাপছেন,সেই মা-তা,মাতা, নির্মাত্রী মহাদেব মহাসুরী মা।

এই সবই লিখেছেন মহামুনি মহাঋষি মৃকণ্ড-পুত্র মার্কণ্ডেয়,তাঁর নাট্যবেদ ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’তে।গুছিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে,তেরোটি অধ্যায়ে।গীতার মতোই সাতশো শ্লোকে।

নাট্যমঞ্চ হল—মহাশূন্যে ভাসা পৃথিবীর অন্তর্গত এই দেশ—হিমালয় থেকে সমুদ্র।পাত্র হল মানুষ।বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন স্তরের বিচিত্র মাপের বিভিন্ন সাজে সাজা মানুষ।মহাপাত্রী হলেন মা,যিনি সব ছাপিয়ে আছেন,সেই শ্রী বিশালা উৎ-জয়ীনী মা।অবিকল বেদের সহস্র আঁখি সহস্র পা বিশাল পুরুষের মতো।যিনি সমস্ত বিশ্বকে বেড়েও বেড়ে আছেন দশ আঙুল।দু’য়ে এক মা-বাবার সন্তান হতে পারলেই আমরা বাঁচি।মরেও বাঁচি। নইলে তো অজাত-মৃত-মূর্খ — সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় গর্ভস্রাব।

পুরাণ বলেন,মানুষের আদি পুরুষ হলেন স্বায়ম্ভুব মনু অর্থাৎ আপনি হওয়া মননশীল মানুষ।আট হাজার বছর আগে।পর পর চোদ্দ জন মনু অর্থাৎ অদৃশ্য যুগপুরুষ মানব সংস্কৃতির দায় সামলেছেন প্রায় তিন হাজার বছর আগে পর্যন্ত।অষ্টম হলেন সাবর্ণি মনু।তাঁর সময় তখন শেষ হয়ে আসছে,আজ থেকে ৫১০০ বছরের কিছু আগে।

এক রাজা,নাম তাঁর সু-রথ।রাজ্য রথটিকে ভালোই চালনা করেছিলেন।শত্রুরা ঘিরে ধরল তাঁকে।শত্রু কারা?কোল-রা। এবং কোলদেরও যারা ধ্বংস করেছিলেন তারা।এক টুকরো ইতিহাসের জগ্গা আঁচল দুলিয়ে দিলেন শ্রোতার সামনে কবি।তারপর?

তারপর যুদ্ধে তিনি হেরে গেলেন।তখন তাঁর নিজের অমাত্যরাই তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজ্যচ্যূত করে তাড়িয়ে দিল।তিনি তখন একাকী ‘হয়ম্ আরুহ্য জগাম গহনং বনম্।’ ঘোড়ায় চড়ে চলে গেলেন গহীন বনে।

দেখতে পেলেন মেধা-মুনির আশ্রম। যেমন,দুর্বাসস্ থেকে দুর্বাসা,তেমনি মেধস্ থেকে মেধা।মেধা হল মনের গভীরে ঢোকা।রাজা সু-রথ সব হারিয়েছেন,কিন্তু আসলটি থেকে গেছে।নিজে?নিজের দেহটি?এটিই তো আসল রথ।তাকে ঠিকমতো চালানা করলেই সিদ্ধার্থ হবেন তিনি।নিজেকে পাওয়াই তো আসল পাওয়া।এখনো পাননি।শুধু ঘুরছেন।যা বাধ্য হয়ে ছেড়ে এসেছেন,তারই চিন্তা মনকে কুরে খাচ্ছে।ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখা হল এক শ্রেষ্ঠীর সঙ্গে। তাঁর নাম সমাধি। তাঁর দশা প্রায় তাঁরই মতো। ধনলোভে নিষ্ঠুর স্ত্রী -পুত্রেরা তাড়িয়ে দিয়েছে তাঁকে। তবু তাঁদের চিন্তায় অহোরাত্র তাঁর মন যেন পুড়ে যাচ্ছে।

সুরথ আর সমাধি – দুজনে গেলেন মেধামুনির কাছে। বললেন, মুনিবর, এ কিরকম মোহ আমাদের? জ্ঞান আছে, বুদ্ধি আছে, বুঝতে পারছি সবই, তবু ছাড়তে পারছি না। তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা ফেলিয়া দিতে পারি না যে / জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই / ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে।
ঋষি বললেন, স্বয়ং জগৎপতি হরি অনালোকের আবছা আলোয় ঘুমোচ্ছেন যোগনিদ্রায়। অর্থাৎ মটকা মেরে পড়ে আছেন। নিজেরই অশেষ ইচ্ছার কুন্ডলীকৃত বিছানায়। তুমি আমি পারব সে ঘুম ভাঙাতে? কী অদ্ভুত নির্মাণ কৌশল তাঁর। স্বপ্নের মধ্যেই সব। কৌশল বল, প্রজ্ঞা বল, তারি নাম মায়া। মহামায়া। যাদুকরের ভেল্কি। যাদুকরীর ঐ ভেল্কিতেই মুগ্ধ হয়ে আছে সারা জগৎ – মহা মহা জ্ঞানীরাও। মুগ্ধ না হলে কি এ সৃষ্টি হত? সহস্র বন্ধন মাঝে মোহানন্দময়, লভিব মুক্তির স্বাদ। নইলে কীসের জীবন, কীসের মরণ! বেটীর খেলা একবার দেখবে নাকি?

রাজা বললেন, দেখব। শ্রেষ্ঠী বললেন, দেখব।

মেধামুনি তখন বলতে লাগলেন –

জল জল জল জল। চারিদিকে জল। অন্ধকার মঞ্চের মধ্যিখানে সাপের বিছানায় শুয়ে আছেন এক বিরাট পুরুষ। কালো। কালপুরুষ। Time, the all-pervasive entity. সর্বব্যাপী বিষ্ণু। বিষ্ – ব্যাপ্তি। বিষ্ণুর নাভির কাছটা হঠাৎ সুড়সুড় করে উঠল। বেরিয়ে এল মৃণাল সমেত এক পদ্ম। পদ্মপুরুষ ব্রহ্মা। তুলি রং পট সব তোড়জোড় করে ছবির ধেয়ানে বসেছেন – এমন সময় ওটা কী রে? কালো মেঘের মতো দুই মেদাকার দৈত্য! বেরিয়েছে ঐ বিষ্ণুরই কানের ময়লা থেকে। ঘুমের ভান করে শুয়ে শুয়ে কান খুঁটছিলেন বিষ্ণু! তার থেকেই এই কান্ড।

ঋষি – বৈজ্ঞানিক প্রমথনাথ( স্বামী প্রত্যবাত্মনন্দ সরস্বতী) – সন্ন্যাস নামটা বড্ড খটমটে তার বল্লুম না। বললেন, শব্দ হল আকাশ। শব্দ তরতর করে চলে যাবে ঘর্ষণ ছাড়াই, তাহলে আর সৃষ্টি হবে কী করে? তাই ময়লা ছাড়া সৃষ্টি হয় না, যেমন খাদ ছাড়া গয়না হয় না। খাদ দুটির নাম? মধু আর কৈটভ। মধুমাখা কথা, আর কৈটব অর্থাৎ ছল, কপাট। এদের খাদে পড়েছ কি গ্যালে! এরা সৃষ্টির গোড়াতেই ধোঁয়া দিলে সত্যসৃষ্টি আর হয়েছে! কাজেই ব্রহ্মা নিজে তো আর পারবেন না; উনি শুধু সৃষ্টির কারিগর, ধ্বংস করতে জানেন না। ঐ যোগনিদ্রা – মহামায়া বুড়ীবসন্তীর স্তব করতে আরম্ভ করলেন।

বিষ্ণু তো অ-নিমেষ। ওঁর নিমেষ আশ্রয় করে আছেন যোগনিদ্রা। তাঁকে তোয়াজ করতে হবে। তবে যদি ওঁকে জাগানো যায়! তবে যদি দত্যি দানো দুটো ধ্বংস হয়। রূপকথায় পুরাণকথায় রাজকথায় প্রশাসনে ঐ একই শৈলী। এ ওকে বলবে, ও বলবে তাঁকে, তিনি বলবেন হু… …. ই ওনাকে… …. কর্তে কর্তে দেখা যাবে, সেই উনি এই ধারে কাছেই আছেন…… ৷ ধর্ম বলছেন, ধারে কাছে কি ? তুমি আমিই ৷ অপ্রমত্ত হয়ে চলতে হবে এই নিজেরই গভীরে ৷ ভোরবেলাকার একলা পথে চলব সোজা ৷ তোমায় আলোয় ডুবিয়ে নেব সজাগ আঁখি ৷ ……

যোগনিদ্রা জাগলেন ৷ বিষ্ণুর ঘুম ভাঙালেন ৷ বিষ্ণুর সঙ্গে মধু-কৈটভের বাহু-যুদ্ধ হল পঞ্চবর্ষ সহস্রানি অর্থাৎ পাঁচ হাজার বছর ধরে ৷ শেষে সব ভোলানী মহামায়ার ভোলানিতে উন্মত্ত হয়ে দৈত্যরা বলল, বাঃ ! দারুণ যুঝেছ তো ! আমরা তোমায় বর দেব ৷ বিষ্ণু বললেন, তথাস্তু ৷ তোমরা আমার বধ্য হও ৷ দৈত্যরা দেখল, তারা ঠকেছে ৷ তখন ভাবল, এমন একটা শর্ত দিই, যা ও পারবে না ৷ বলল, মারো। তবে এমন জায়গায় মারবে, যেখানে উর্বী মানে পৃথিবী সলিলে আপ্লুত নয় ৷ বিষ্ণু বললেন, আচ্ছা ৷

চারদিক জলে জলময় ৷ মহাসমুদ্র ৷ তার মধ্যে থেকেই অনন্তশয়নম্ বিষ্ণুর হাতে উঠে এল একটি মহাশঙ্খ—পরে পঞ্চ জনের পাঞ্চজন্য শাঁখ হয়ে যা ডাক দেবে মহাজনতাকে ৷ উঠে এল সমুদ্রের মহা ঘূর্ণিপাক, যা সু-দর্শন চক্র হয়ে আলো-কালোর ফাঁকে ফাঁকে সত্য দেখার দৃষ্টি দেবে— ঋষি মুনি সিদ্ধপুরুষ কবি বিজ্ঞানীদের ৷ উঠে এল গদা—যা নিষ্পিষ্ট করে দেবে মদান্ধ একদেশ-দর্শী হাতিদের, জ্ঞান-অঞ্জন শলাকা অন্ধ হস্তী দার্শনিকদের ৷ আর তাঁর বসার আসন কমলটি ব্রহ্মা নিজেই তাঁকে দিলেন হাতে ধরতে ৷ কেননা, লক্ষ্মী যখন আসবে, তখন কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই ? পায়ের তলায় নয়, আধো আঁধারে—নয় কি ?

মহাশূন্যে ভাসছে মহামঞ্চ ৷ তার মধ্যে দেখ, বিষ্ণু উঠছেন—জলে জড়ে আধা শরীর ডুবিয়ে ৷ আধা শরীরে উঠছেন, অনিমেষ দৃষ্টি ঊর্দ্ধে নিবদ্ধ ৷ সেই অবস্থায় জঘনে জঘান ৷ হত্যা করলেন নিজ পশ্চাৎ দেশে ৷ বিশাল শব্দে চড়মড়াৎ বিশাল মেদ-সম্ভার পড়ল মহাসমুদ্রে ৷ অথৈ অতল ইথার । সমুদ্রের তলা—যাকে তন্ত্র বলছেন কারণ-সলিল ৷ বেদ বলছেন অপ্রকেতং সলিলম্ ৷ তৈরী হল এবড়ো-খেবড়ো বন্ধুর ভূমি, তার ওপর বিন্ধ্য হিমাচল আল্পস আন্দিজ পর্বতমালা, ড্যালাডুমলি জমি হল ৷

মহাকালীর অঙ্ক শেষ ৷ পরে যদি বুঝতে না পার, তাই একার্ণবশায়ী বিষ্ণু তাঁর পদচিহ্ন রেখে দিলেন কোটি কোটি বছরের শালগ্রাম শিলায় বজ্রকীটের জীবাশ্মে ৷ তাঁর উত্তরকালের বনমালাও আছে কোনো কোনো দুর্লভ শালগ্রামে অপূর্ব কারুকার্যময়ী সুচারু রেখায় ৷ বিজ্ঞানে পুরাণ ঋষি গিরীন্দ্রশেখর বসু-র শিষ্য না হয়েও স্বাধীন পরবর্তী পথিক অশোক রায়-এর ‘শালগ্রাম শিলার সন্ধানে’ পড়ে দেখ ৷ জীবের জন্ম স্থলে নয়, জলের গভীরেও নয় , জল ও স্থলের মিলনমেলায়— মধু কৈটভের মর্মান্তিক এ আবদারও রেখেছেন বিষ্ণু—অশোক তা প্রমাণ করেছেন এই বইয়ের ৯২ পৃষ্ঠায় ৷

প্রথম অঙ্ক শেষ ৷ দ্বিতীয় অঙ্কে মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন সেই একই মহাসুরী মহাদেবী ৷ তাঁর রূপ-রং-সাজ এবার আলাদা ৷ নাম মহাকালী নয়, মহালক্ষ্মী ৷ ইনিই আমাদের মহিষাসুরমর্দিনী ৷ বিরুদ্ধ শক্তির নাম মহিষ অসুর ৷ মহতী এষণাযুক্ত প্রাণের বেগ, বড় হবার উদগ্র বাসনা ৷ ঐ হল শিঙ ৷ অসু মানে প্রাণ ৷ যুক্ত অর্থে র-প্রত্যয় ৷ মহেশে মহিষে তফাত শুধু তালব্যে অার মূর্ধণ্যে, এ-কারে ই-কারে নয়, আকাশে – জমিনে । মহিষ হতে চায় মহেশ। পারেনা। কেননা, সর্বময় আমিকে, মহাপ্রাণকে সে পায়নি। ফাঁপানো-ফোলানো অল্পপ্রাণ অহং-এর দাস হয়ে আছে। দেবীর বিদ্যুৎ-দীপ্ত ছন্দোবান আমূল বিঁধলে তবে তার শান্তি। যদি না বুঝে থাক, তাহলে অনন্ত মালাকারের শোলায় তৈরী মহিষাসুরমর্দিনী দেখ। মহিষাসুরের কি অদ্ভুত ভাব!বেলুড় হালোবিড খাজুরাহোর দেবশিল্পীরা যেন দল বেঁধে দেখতে এসেছে ভবানীপুর তেইশপল্লীর দুর্গামন্ডপে অনন্তর কাজ।

মধু কৈটভের মেদে মেদিনী হল। পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক বিবর্তন। তার পর চলছে প্রাণের বিবর্তন। তম থেকে রজ। কালো থেকে লাল। তারপর লক্ষ প্রাণের উদ্বর্তন। পশু থেকে মানুষ। গড়পড়তা সংযমী বীরপুরুষ। মহিষকে মর্দন করে সিংহবাহিনী সিংহনী মা আমাদের সিংহ-সিংহী করবেন। প্রতি আশ্বিনে আমরা তাই উৎসবে মাতি।

কিন্তু হচ্ছে কই? ছোট-বড় মহিষাসুরের সংখ্যা বাড়ছেই। ক্ষমতা লোভ দম্ভ উচ্চাশা। টগবগে উৎসাহ। উর্দ্ধশ্বাস দৌড় দৌড় দৌড়। কবে হবে প্রজ্ঞার বিবর্তন? নিজের দিকে ফেরা? কবে হবে মেষেদের উন্মেষ?
ত্রিকালবিদ্ মার্কন্ডেয় তাই তৃতীয় অঙ্ক এনেছেন তাঁর নাট্য-বেদে। মহাকালী মহালক্ষ্মীর পর তৃতীয় চরিত্র মহাসরস্বতী। শুভ্রা, নির্মলা। আঁধারের সাথে যুদ্ধে মহাপারদর্শিনী বজ্রতেজা বাজিনীবতী উষা। এবার যুদ্ধ পর পর সেনানীদের সঙ্গে – ধূম্রলোচন ,চন্ড-মুন্ড, রক্তবীজ। তারপর নিশুম্ভ আর শুম্ভ দুই ভাইয়ের সঙ্গে। চন্ডী পাহাড়ে যুদ্ধ হয়েছিল – বলেন কিংবদন্তীকারেরা। অকুস্থলে চন্ডী মন্দির দেখেও এসেছি হরিদ্বারে – হরদ্বারে। প্রত্যেক মন্দিরে, ভাস্কর্যে, প্রতীকটিতে আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহাসিক পরম্পরা ও মিলনের ছবি জ্বলজ্বল করছে। তাকে অবজ্ঞা করো না, হে ঐতিহাসিক। নিজের দৃষ্টিকে শুদ্ধ করো, শ্রদ্ধা করো। পরের বোঝানোতে বুঝো না। দেশের মানুষ বেনোজলে আনিমানি না ঘুরে দেশে ফিরুক। যেখানেই যাক, নিয়ে যাক সংস্কৃতি রাজরানী মায়ের দূত হয়ে।

অত্যন্ত ভিড়ের মধ্যে চমৎকার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা। উড়ন চৌকিতে উড়ে যাওয়া। চন্ড-মুন্ড বিনাশিনী হয়েই দেবীর নাম হল ‘চামুন্ডা’। চন্ড-র বংশধররা অসাধারন দৈহিক বলের অধিকারী হয়েও অতি সামান্য জীবিকায় জীবনযাপন করছে চন্ডাল হয়ে। নরেন্দ্রনাথ তাই বলেছিলেন, চন্ডাল আমার রক্ত, চন্ডাল আমার ভাই। রক্তবীজ আমার সোদর ভাই। তাই তাদের ওঠাতে হবে সসম্মানে। কোনো নেতা পারবেন, চন্ডালের সঙ্গে এক সঙ্গে বসে আহার করতে? রবি পেরেছিলেন। বৌমার সাহায্যে হাড়ি ডোমদের রান্নাঘরে সসম্মানে প্রবেশ করিয়েছিলেন।

মুন্ড-র বংশধররা হল সাঁওতাল মুন্ডা। আমাদের বিবেচনায় যারা সুসভ্যতম সংস্কৃতির অধিকারী (দ্র. আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)। পূর্ব-পুরুষের ঐতিহ্যধারায় শ্রমে নাচে-গানে তীরধনুকে, সুঠাম দেহে, মাটিতে সোনা ফলানোয়, মেয়ে-পুরুষের সুস্থ যৌথ সমাজে, আল্পনায় সুন্দরতম গৃহের অধিকারী অধিবাসী তারা। আমরা ওদের ধারে কাছেও লাগি না। ওদের অনবরত ঠকানো হয়েছে। তবু… … সিগারেটের ধোঁয়ায় ধূম্রলোচন হয়ে কর্কটে ধরল মহাসরস্বতীকে। কিন্তু পাবে কী করে? পাবার আগেই তো অক্কা।

নিশুম্ভ আর শুম্ভ দুই ভাই ৷ রজ থেকে সত্ত্বগুণে আরোহণ করছে ৷ লাল থেকে সাদায় ৷ তাই রৌহিণ পুরোডাশ দেওয়া হয় বৈদিক সোমযোগের প্রবর্গ্য অনুষ্ঠানে ৷ প্রবৃগণ মানে মেলামেশা ৷ এক সংস্কৃতির সঙ্গে আর এক সংস্কৃতির মিলন ৷

নি মানে তলায়, নিচু এবং গভীর ৷ নিশুম্ভ মানে ঐ জাতীয় মানুষ ৷ ভেতরে গভীর আকাঙ্ক্ষা আকুতি দেবীকে পাবার জন্য ৷ কিন্তু পারল না ৷

শম্ভু একেবারে কৃতসংকল্প ৷ পাবই ৷ কিন্তু সেও পারল না ৷ কেন ? না, সে শম্ভুর একেবারে বিপরীত ৷ শুম্ভ দেখায় যেন স্বয়ং শিবশম্ভু ৷ কিন্তু ভেতরে গজগজ করছে পৃথিবীর সম্রাট হবার আকাঙ্ক্ষা ৷ শম্-কল্যাণ ; ভূ বা ভু- হওয়া ৷ বিশ্বকল্যাণী হলে তবে বিশ্বকল্যাণীকে পাওয়া যায় ৷ সু-রথ হয়ে সমাধিস্থ হলে আত্মনিমগ্ন হয়ে হলেই হবে ৷ বেদ বলছেন ‘ঋভু’দের কথা ৷ ঋভুরা মনুষ্যগন্ধা, গায়ে মানুষের গন্ধ ৷ ঋভ বা রভ— আঁকড়ে ধরা, অক্লান্ত অশ্রান্ত শ্রমিক ৷ Toilers to the Sea of Infinity—বলছেন শ্রীঅরবিন্দ ৷ বেদ বলছেন, অর্ধেক মানুষ—ওপরের দিকটা সবিতার হিরণ্যদুতিতে ঝলমল ৷ বেদের ঋষিরা, রাম, কৃষ্ণ, পাণিনি, যাজ্ঞবল্ক্য, সিদ্ধার্থ-বুদ্ধ, মহাবীর (আত্মজয়ী জিন), তিরুভাল্লুভর, যীশু, মহম্মদ, শঙ্করাচার্য, কৃষ্ণচৈতন্য, বল্লভাচার্য, রামপ্রসাদ, গুরু নানক থেকে গোবিন্দ, ক্ষুদিরাম, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ-সারদা, বঙ্কিম, জগদীশ-অবলা, রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী-মৃণালিনী, বিবেকানন্দ-ক্রিস্টিন নিবেদিতা, শ্রীঅরবিন্দ-মৃণালিনী-মীরা, দীনবন্ধু এন্ড্রুজ, রমণ মহর্ষি….অজস্র, অসংখ্য, অগণন ৷ অর্ধ মানে গোটার সঙ্গে একাকার অংশ—কখনো বেশি, কখনো কম ৷

রাত্রি-কৌশিক সূক্ত দিয়ে চন্ডীপাঠ সুরু ৷ শেষ হয় ঋষি অম্ভূণের কনী-মেয়ে কন্যা বাক-এর দেবী-সূক্ত দিয়ে ৷ ঋগ্বেদের ১০২৮ সূক্তের মধ্যে মহত্তম সূক্ত ৷ তার অষ্টম বা শেষ ঋকটি বলছি—

অহমেব বাত ইব প্র বামি আরভমাণা ভুবনানি বিশ্বা ৷
পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যা এতাবতী মহিনা সং বভূব ৷৷
(ঋ. ১০.১২৫. ৮)
বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে বিশ্বভুবন
স্রষ্টা আমি চলছি বয়ে হাওয়ার মতন ৷
ছাড়িয়ে আকাশ, ছাড়িয়ে বিশাল এ পিত্থিমি,
ছড়িয়ে আছে কী মহিমায় বিপুল আমি ৷

মহা-লয় থেকে মহা-আলয়ে আনন্দ-ভুবনে রাজ-রাজেশ্বরী হয়ে ওঠা মানুষের মেয়ে বাক-এর আত্মঘোষণা দিয়ে শেষ…

অশেষ এই অনন্ত দুর্গমে যাত্রা ৷ গিরীন্দ্রশেখর বলেন, অষ্টম মনুর শেষে ৫১০১ বছর আগে নতুন যুগ সুরু হয়েছিল ৷ তারপর পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা বেয়ে চলেছি আমরা ৷ বারবার নতুন যুগ এসেছে জাতির জীবনে ৷ পন্ডিত জ্যোতিষীদের গণনা গিরীন্দ্র-গণনার সঙ্গে এক করে সংস্কৃতাব্দ ৫১০১-এ সুরু হয়েছে বর্তমান নতুন যুগ ৷ নতুন সূর্য-পক্ষীরাজের পায়ের তলায় নিমেষে হাড়ের পাহাড়, কড়ির পাহাড়, ভুলের পাহাড় চুরচুর্ করতে করতে…..দুগগা দুগগা ৷

(প্রবন্ধটি ধ্যানবিন্দু থেকে প্রকাশিতব্য একটি প্রবন্ধ সংকলন থেকে শ্রীমতি রোহিনী ধর্মপালের অনুমতিক্রমে গৃহীত ও প্রকাশিত)

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত