| 25 এপ্রিল 2024
Categories
সাহিত্য

মজার মানুষ হুমায়ূন আহমেদ

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

হুমায়ুন আহমেদ, একাধারে সফল ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার, শিক্ষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর সৃষ্টিতে নজর বুলালেই অসাধারণ হিউমারের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রতিটি কাজেই রসবোধের সাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি নিজেও ছিলেন রসিক প্রকৃতির মানুষ। সাধারণ কোনো ঘটনাকে অসাধারণ করেন তোলার ওস্তাদ বলা যায় তাঁকে। এমন অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ তৈরি করেছেন নিজের জীবনে। সেখান থেকে নির্বাচিত কিছু হাসির ঘটনা সংগ্রহ করে ইরাবতী’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

হিপনোটাইজ
মুহসিন হলে থাকাকালীন ঘটনা। এক রাতে হঠাৎ হইচই শুরু হলো। ঘটনা কী? ঘটনা জটিল এবং অবিশ্বাস্য। হুমায়ূন আহমেদকে হলের একটি ছেলে খুব বিরক্ত করত। শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি ছেলেটিকে জাদুর মাধ্যমে চেয়ারের সঙ্গে আটকে দিয়েছেন। ছেলেটি আর নড়াচড়া করতে পারছে না, কথাও বলতে পারছে না। জড়পদার্থের মতো সে চেয়ারে বসে আছে। খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে হাউস টিউটর এলেন। এ দৃশ্য দেখে তিনিও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অবশেষে ছেলেটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলো। ইনজেকশন দেয়ার পর ছেলেটির চৈতন্য ফিরল। আসল ঘটনা হলো, ছেলেটির পীড়াপীড়িতে হুমায়ূন আহমেদ তাকে হিপনোটাইজ করেছিলেন। এটাই তার প্রথম এক্সপেরিমেন্ট। কিন্তু এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার উপায় না জানা থাকার কারণে এমন কাণ্ড!

অভিনয় বনাম সিনেমা
হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র বানাবেন। আগুনের পরশমণির প্রধান চরিত্র বদিউল আলমকে খুঁজছেন। একদিন শিল্পী ধ্রুব এষকে দেখে তিঁনি সেই চরিত্রের জন্য পছন্দ করে ফেললেন। কারণ, বদিউল আলমের নির্লিপ্ত ভঙ্গি ধ্রুব এষের মধ্যে পুরোপুরিই আছে। প্রস্তাব শুনে ধ্রুব এষ বললেন, ‘অসম্ভব! আমি জীবনে অভিনয় করিনি’। হুমায়ূন আহমেদ মুচকি হেসে বললেন, ‘তাতে কী? আমিও তো জীবনে সিনেমা বানাইনি!’

গভীর ও অগভীর
অনেকেই হুমায়ূন আহমেদের রচনায় গভীরতা কম বলে আক্ষেপ বা অনুযোগ করতেন। তার জীবদ্দশাতে এ ধরনের সমালোচনা তাকে অনেকবার শুনতে হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ একবার বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপককে একটি গল্প পড়তে দিয়ে তার মতামত জানতে চাইলেন। অধ্যাপক গল্পটি পড়ে বললেন, ‘মন্দ নয়। তবে এতে গভীরতা কম।’ হুমায়ূন আহমেদ পাণ্ডুলিপিটি ফেরত নিয়ে পকেটে ভরতে ভরতে বললেন, ‘গল্পটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আমি চরিত্রের নাম পাল্টে কপি করে দিয়েছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় যখন গভীরতার অভাব, তখন আমার লেখা অগভীর হলে কোনো দুঃখ নেই।’

জিপারহীন প্যান্ট
প্রথম স্কুলে যাওয়া উপলক্ষে হুমায়ূন আহমেদকে একটা নতুন খাকি প্যান্ট কিনে দেয়া হল। সেই প্যান্টের কোন জিপার নেই, সারাক্ষণ হাঁ হয়ে থাকে। অবশ্যি তা নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন হননি তিঁনি। নতুন প্যান্ট পরেছে, এই আনন্দেই আত্মহারা। মেজো চাচা তাঁকে কিশোরীমোহন পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন এবং হেডমাস্টার সাহেবকে বললেন, ‘চোখে চোখে রাখতে হবে। বড়ই দুষ্ট।’ তিনি অতি সুবোধ বালকের মত ক্লাসে গিয়ে বসলেন। মেঝেতে পাটি পাতা। সেই পাটির উপর বসে পড়াশোনা। মেয়েরা বসে প্রথম দিকে, পেছনে ছেলেরা।

তিনি খানিকক্ষণ বিচার বিবেচনা করে সবচেয়ে রূপবতী বালিকার পাশে ঠেলেঠুলে জায়গা করে বসে পড়লেন। রূপবতী বালিকা অত্যন্ত হৃদয়হীন ভঙ্গিতে সিলেটি ভাষায় বলল, ‘এই তোর প্যান্টের ভেতরের সবকিছু দেখা যায়।’ ক্লাসের সব ক’টা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হেসে উঠল। সবচেয়ে উচ্চস্বরে যে ছেলেটি হেসেছে, তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। হাতের কনুইয়ের প্রবল আঘাতে রক্তারক্তি ঘটে গেল। দেখা গেল ছেলেটির সামনের একটি দাঁত ভেঙ্গে গেছে। হেডমাস্টার সাহেব হুমায়ূন আহমেদকে কান ধরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দিলেন। ছাত্রছাত্রীদের উপদেশ দিলেন, ‘এ মহাগুণ্ডা, তোমরা সাবধানে থাকবে। খুব সাবধান। পুলিশের ছেলে গুণ্ডা হওয়াই স্বাভাবিক।’ ক্লাস ওয়ান বারোটার মধ্যে ছুটি হয়ে যায়। এ দুই ঘণ্টা তিঁনি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাঁর সময়টা যে খুব খারাপ কাটল তা নয়। স্কুলের পাশেই আনসার ট্রেনিং ক্যাম্প। তাদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। লেফট রাইট। লেফট রাইট। দেখতে বড়ই ভাল লাগছিল তাঁর। মনে মনে ঠিক করে ফেললেন বড় হয়ে আনসার হবেন।

বিয়ের প্রস্তাব
ক্লাস টুতে উঠে তিঁনি আরেকটি অপকর্ম করেন। যে রূপবতী বালিকা তাঁর হৃদয় হরণ করেছিল, তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেললেন। প্রকৃতির কোন এক অদ্ভুত নিয়মে রূপবতীরা শুধু যে হৃদয়হীন হয় তাই না, খানিকটা হিংস্র স্বভাবেরও হয়। সে হুমায়ূনের প্রস্তাবে খুশি হবার বদলে বাঘিনীর মতো তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। খামচি দিয়ে হাতের দুতিন জায়গার চামড়া তুলে ফেলল। সে-ই স্যারের কাছে নালিশ করল। শাস্তি হিসেবে দুই হাতে দুটি ইট নিয়ে তাঁকে দু’ঘণ্টা নিলডাউন হয়ে বসে থাকতে হলো।

ফুটবল না পাওয়া
থ্রি থেকে ফোরে উঠবেন হুমায়ূন। বার্ষিক পরীক্ষা এসে গেছে। বাড়িতে বাড়িতে পড়াশোনার ধুম। তিঁনি নির্বিকার। বই নিয়ে বসতে ভাল লাগে না। যদিও পড়তে বসতে হয়। সেই বসাটা পুরোপুরি ভান। সবাই দেখল তিঁনি বই নিয়ে বসে আছেন এই পর্যন্তই। এমন এক সুখের সময়ে ক্লাসের বন্ধু ‘মাথা মোটা’ শংকর খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে জানাল, তার মা তাকে বলেছেন সে যদি ক্লাস থ্রি থেকে পাশ করে ফোর-এ উঠতে পারে তাহলে তাকে ফুটবল কিনে দেবেন। সে হুমায়ূন আহমেদের কাছে এসেছে সাহায্যের জন্যে। কী করে এক ধাক্কায় পরের ক্লাসে ওঠা যায়। একটা চামড়ার ফুটবলের তাঁদের খুবই শখ।

সেই দিনই পরম উৎসাহে শংকরকে পড়াতে বসালেন। যে করেই হোক তাকে পাশ করাতে হবে। দু’জন একই ক্লাসে পড়েন। এখন সে ছাত্র, হুমায়ূন শিক্ষক। ওকে পড়ানোর জন্যে নিজেকে প্রথম পড়তে হয়, বুঝতে হয়। যা পড়ান কিছুই শংকরের মাথায় ঢোকে না। যাই হোক প্রাণপণ পরিশ্রমে ছাত্র তৈরি হল। দু’জন পরীক্ষা দিলেন। ফল বের হওয়ার পর দেখা গেল তাঁর ছাত্র ফেল করেছে এবং তিঁনি স্কুলের সমস্ত শিক্ষকদের স্তম্ভিত করে প্রথম হয়ে গেছেন। ফুটবল পাওয়া যাবে না এই দুঃখে রিপোর্ট কার্ড হাতে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলেন।

বিচিত্র শাস্তি
পঁচাগড় থেকে হুমায়ূন আহমেদের বাবা বদলি হলেন রাঙামাটিতে। রাঙামাটিতে তাঁরা ছিলেন পাঁচ মাসের মতো। বাবা আবার বদলি হলেন বান্দরবান। বান্দরবানের সবই ভালো, শুধু মন্দ দিকটা হলো এখানে একটা স্কুল আছে। স্কুলে তাঁর একমাত্র আনন্দের ব্যাপার হলো মুরং রাজার এক মেয়ে পড়ে তাঁদের সঙ্গে। গায়ের রং শঙ্খের মতো সাদা। চুল হাঁটু ছাড়িয়েও অনেক দূর নেমে গেছে। তাঁরা ক্লাস সিক্সে পড়েন, কিন্তু তাকে দেখায় তরুণীর মতো। তার চোখ দুটি ছোট ছোট, গালের হনু খানিকটা উঁচু। হুমায়ূনের মনে হলো চোখ দুটি আরেকটু বড় হলে তাকে মানাত না। গালের হনু উঁচু হওয়ায় যেন তার রূপ আরো খুলেছে।

ক্লাসে হুমায়ূন আহমেদ স্যারদের দিকে তাকান-ই না। বোর্ডে কী লেখা হচ্ছে তাও পড়তে চেষ্টা করেন না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন রাজকন্যার দিকে। সত্যিকার রাজকন্যা। তাঁর এই অস্বাভাবিক আচরণ রাজকন্যার চোখে পড়ল কি-না জানেন না, তবে একজন স্যারের চোখে পড়ল। তিনি তাঁকে বিষদৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। প্রতিটি ক্লাসেই তিনি তাঁকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করেন, কিন্তু আটকাতে পারেন না; কারণ ইতিমধ্যে হুমায়ূন একটা জিনিস বুঝে ফেলেছেন, তাঁর স্মৃতিশক্তি অসম্ভব ভালো। যেকোনো পড়া একবার পড়লেই মনে থাকে। সব পড়াই একবার অন্তত পড়ে আসেন।

স্যার ঠিকই একদিন তাঁকে আটকে ফেললেন। সমকোণ কাকে বলে জিজ্ঞেস করলেন, তিঁনি বলতে পারলেন না। শাস্তির ব্যবস্থা হলো। বিচিত্র শাস্তি। বড় একটা কাগজে লেখা ‘আমি পড়া পারি নাই। আমি গাধা’ সেই কাগজ গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। স্যার একজন দপ্তরিকে ডেকে আনলেন এবং কঠিন গলায় বললেন, ‘এই ছেলেকে সব কটা ক্লাসে নিয়ে যাও। ছাত্ররা দেখুক।’ হুমায়ূন অপমানে নীল হয়ে গেলেন। টান দিয়ে গলার কাগজ ছিঁড়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বললেন, ‘আপনি গাধা।’ তারপর এক দৌড় দিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে গেলেন। সন্ধ্যাবেলা লোক পাঠিয়ে শঙ্খ নদীর তীর থেকে বাবা তাঁকে ধরিয়ে আনলেন। হুমায়ূন আতঙ্কে কাঁপছেন। না জানি কী শাস্তি অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। বাবা শান্ত গলায় বললেন, ‘স্যাররা তোমাকে পড়ান। শাস্তি দেওয়ার অধিকার তাঁদের আছে। তুমি আমার সঙ্গে চলো। স্যারের কাছে ক্ষমা চাইবে।’

বাবার সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে রওনা হলেন। স্যারের কাছে ক্ষমা চাইলেন। এর পর বাবা বললেন, ‘মাস্টার সাহেব, আমার এই ছেলেটা খুব অভিমানী। সে বড় ধরনের কষ্ট পেয়েছে। অপমানিত বোধ করেছে। তাকে আমি কোনো দিন এই স্কুলে পাঠাব না। সে বাসায় থাকবে।’

বাবা তাঁকে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। পরদিনই স্কুলের সব শিক্ষক বাসায় উপস্থিত। তাঁরা বাবাকে রাজি করাতে এসেছেন, যাতে হুমায়ূন আবার স্কুলে যায়। বাবা রাজি হলেন না।

গরুদের ক্লাস
হুমায়ূন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। হঠাৎ এক ছাত্র প্রশ্ন করলো, ‘স্যার, আপনি নাকি গরুর কথাও বুঝতে পারেন?’ হুমায়ুন আহমেদের ‘ছেলেবেলা’ বইটি পড়ে হয়তো এমন ধারণা হয়েছিলো ছাত্রটির। ক্লাসের মাঝখানে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় চলে আসায় হুমায়ুন আহমেদ বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, পারি। নইলে তোমাদের ক্লাস নিচ্ছি কীভাবে?’

কেটে সময় কাটানো
এক সাংবাদিক টেলিফোনে হুমায়ূন আহমেদের কাছে তাঁর অবসর সময় কীভাবে কাটে জানতে চাইলেন। উত্তরে হুমায়ুন আহমেদ বললেন, ‘অবসর সময়ে আমি একটা কাঁচি নিয়ে বসি। কাঁচি দিয়ে কেটে সময় কাটাই!’

গ্যাস
গভীর রাতে হুমায়ূন আহমেদকে এক বিখ্যাত অভিনেতা ফোন করল। এত রাতে ফোন পেয়ে তিনি কিছুটা বিরক্ত। অভিনেতা ফোন দিয়ে বললেন, ‘হুমায়ূন ভাই আমার অবস্থা খুব খারাপ।’ হুমায়ুন আহমেদ বললেন, ‘কেন! কী হয়েছে?’ অভিনেতা বললেন, ‘পেটে প্রচুর গ্যাস হয়েছে।’ হুমায়ূন আহমেদ ঠাট্টাস্বরে বললেন, ‘পেটে গ্যাস হয়েছে তো আমাকে কেন? তিতাস গ্যাসকে ফোন দেন।’

প্লেনে সিগারেট খাওয়া
হুমায়ূন আহমেদ প্লেনে করে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। ওনার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস সম্পর্কে তো কম বেশি সবারই জানা আছে। প্লেনের মধ্যে হঠাৎ তাঁর সিগারেট খাওয়ার নেশা চেপে বসলো। হুমায়ূন আহমেদ এয়ার হোস্টেসকে ডেকে বললেন, ‘সিগারেট খাওয়া যাবে?’ এয়ার হোস্টেজ উত্তরে বললেন, ‘না। প্লেনের ভিতর ধুমপান করলে দুইশত ডলার ফাইন।’ হুমায়ূন আহমেদ চারশো ডলার দিয়ে বললেন, ‘আমি এখন দুইটা সিগারেট খাব।’ এয়ার হোস্টেস ছুটে গেল পাইলটের কাছে। পরে পাইলট হুমায়ূন আহমেদকে ডেকে পাঠালেন ককপিটে। তারপর বললেন, ‘ডলার দিতে হবে না। তুমি এখানে বসে সিগারেট খাও।’

জান দেওয়া লোক
হুমায়ূন আহমেদের ৫২তম জন্মদিনের কথা। শাহবাগ থেকে তাজা দেখে ৫২টা গোলাপ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি গেলেন একজন। গিয়ে দেখলেন বগুড়া থেকে এক লোক এসেছেন। উনি হুমায়ূন আহমেদকে বলছেন, ‘স্যার, আপনি চাইলে আমি আমার জান দিয়ে দিবো! আপনি আপনার নাটকে আমাকে একটা চান্স দেন।’ হুমায়ূন আহমেদ তার সহকারীকে ডেকে বললেন, ‘তুমি এর নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার লিখে রাখো তো। এ আমার জন্য জীবন দিতেও রাজি।’ সহকারী সব টুকে নিয়ে চলে গেল। এরপর হুমায়ূন আহমেদ ওই লোককে বললেন, ‘তুমি বাড়ি ফিরে যাও। যদি কখনো কিডনি লাগে তো তোমাকে ফোন দিবো। চলে এসো।’

রবীন্দ্রসঙ্গীত লেখা
ভীষণ গান ভালবাসতেন হুমায়ূন আহমেদ। বিভিন্ন সময় চমৎকার কিছু গান লিখেছেন। এর মধ্যে ‘যদি মন কাঁদে’ গানটি নিয়ে একটি মজার ঘটনা রয়েছে। নিউইয়র্কে একবার এই গানটি গেয়েছিলেন শাওন। সেখানে কয়েকজন দর্শক-শ্রোতা মন্তব্য করলেন ‘এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটা তো আগে শুনিনি। এটা তো চমৎকার।’ এরপর হুমায়ূন আহমেদ মঞ্চে বক্তব্যের সময় বললেন, ‘যাক, এবার তবে রবীন্দ্রসঙ্গীতও লিখলাম।’

ধুয়ে দেওয়া
একবার এক ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে বললেন, ‘অমুক তো আপনাকে একেবারে ধুয়ে দিয়েছে। আপনার লেখায় নাকি শিক্ষামূলক কিছু নাই।’ শুনে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘ঠিকই তো বলেছে, আমি তো পাঠ্যবই লেখি না!’

ট্যাংক কেনার ইচ্ছে
সিনেমা তৈরির প্রয়োজনে হুমায়ূন আহমেদ একবার সেনাবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে তার অফিসে গেছেন। কথা শেষ করে চলে আসার সময় হুমায়ূন আহমেদ হঠাৎ জানতে চাইলেন,

: আপনাদের কোনো পুরোনো ট্যাংক আছে?’

: কেন বলুন তো?

: আমার একটা কেনার ইচ্ছা।

: ট্যাংক দিয়ে কী করবেন?

: ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিতে হয়। ট্যাংকে করে গেলে অনেক সুবিধা, তাই… (তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই গোলাগুলি হত)।

প্রিয় ঋতু
তখন হুমায়ূন আহমেদ ক্লাস এইটে পড়েন। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুল। বাংলা স্যার বললেন, ‘রচনা লিখে আন। প্রিয় ঋতু। চার-পাঁচটা কোটেশন যেন থাকে। প্রতিটা বানান ভুলের জন্য পাঁচবার কানে ধরে উঠবোস। ডিকশনারি সামনে নিয়ে রচনা লিখবি।’ তাঁরা রচনা লিখলেন। স্যার হুমায়ূন আহমেদের রচনা পড়ে রাগি গলায় বললেন, ‘কী লিখেছিস ছাগলের মতো! বর্ষা প্রিয় ঋতু? লিখবি ঋতুরাজ বসন্ত। তাহলে না নাম্বার পাবি। ফুলের সৌরভ, পাখির কূজন। বর্ষায় ফুল ফোটে না। পাখিও ডাকে না।’ হুমায়ূন বললেন, ‘স্যার, বর্ষাই আমার প্রিয়। আপনার প্রিয় আপনার মধ্যে থাক। নাম্বার বেশি পেতে হবে না।’

সিগারেট ছাড়া
হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ হার্ট অ্যাটাক করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি। একদিন হুমায়ূন আহমেদ দেখতে এলেন। সঙ্গে ডাক্তার-নার্সরাও রয়েছে। মাকে দেখে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘আম্মা এবার সিগারেটটা ছাড়েন।’ সবাই হেসে উঠলো। একজন নার্স হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই আহসান হাবীবকে বললেন, ‘আপনার মা সিগারেট খান?’ আহসান হাবীব হেসে উত্তর দেন, ‘না। সিগারেট খেলে হার্ট অ্যাটাক হয় এমন ধারণা আছে আমাদের। তাই রসিকতা করেছে।’

পছন্দের মেয়ে
হুমায়ূন আহমেদের শৈশবের কথা। সিলেট থাকাকালীন যে পাড়ায় থাকতেন, সেখানে এক বিহারি পরিবার বাস করত। সেই পরিবারে পরির মতো ফুটফুটে তিন মেয়ে ছিল। হুমায়ূন আহমেদ সুযোগ বুঝে আলাদাভাবে ছোট দুই মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। ঘটনা মায়ের কানে যেতে দেরি হলো না। তিনি এক ছুটির দিনে বাবার কাছে অভিযোগ দিয়ে ছেলেকে শাসন করতে বললেন। শুনে বাবা মুচকি হেসে বললেন, ‘ছেলে বিয়ে করতে চায়, বিয়ে দাও। তোমার ছেলের পছন্দের কোনো মেয়ে আছে?’ হুমায়ূন আহমেদ পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন। মা উত্তর দেওয়ার আগেই তিনি চিকন গলায় বললেন, ‘আছে।’

নিজের ওপর বিশ্বাস
হুমায়ূন আহমেদ সিনেমা বানাবেন, টাকা প্রয়োজন। হঠাৎ মনে হলো, সরকার যদি সাহায্য করে, তাহলেই তো হয়ে যায়। তিনি তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। মন্ত্রী সব শুনে বললেন, ‘আপনি লেখক মানুষ। ছবি বানানোর আপনি কী জানেন?’

– আমি কিছুই জানি না। তবে আমি শিখব।

– শিখে ছবি বানাবেন?

– জি।

– নিজের ওপর আপনার এত বিশ্বাসের কারণ কী?

হুমায়ূন আহমেদ এবার দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘অন্যের ওপর বিশ্বাস করার চেয়ে নিজের ওপর বিশ্বাস করাটা ভালো না?’

কিডনি উপহার
হঠাৎ এক সকালে বাসায় ভক্ত এসে উপস্থিত। তিনি প্রিয় লেখকের সঙ্গে দেখা না করে কিছুতেই যাবেন না। বাধ্য হয়ে হুমায়ূন আহমেদকে ভক্তের সামনে এসে দাঁড়াতে হলো। ভক্ত এবং হুমায়ূন আহমেদের কথোপকথন নিম্নরূপ,

– স্যার, আমি আপনার জন্য একটা উপহার নিয়ে এসেছি। নিতেই হবে। ‘না’ করতে পারবেন না।

– কী উপহার?

– আমার একটা কিডনি আপনাকে দিতে চাই।

– কিন্তু আমার তো দুটো কিডনিই সচল আছে।

– যদি প্রয়োজন হয়, তাই আগে থেকে জানিয়ে রাখলাম। যখন প্রয়োজন হবে খবর দেবেন। চলে আসব। নো ডিলে।

ইংরেজি কবিতা লেখা
হুমায়ূন তখন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন। স্কুল-ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য ছাত্রদের কাছ থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি আহ্বান করা হয়। তিঁনি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এমনকি ভ্রমণকাহিনী সবই জমা দিলেন। সংকলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রতিটি রচনাই পড়েছেন। বললেন, ‘কী লিখেছিস? সবই তো অখাদ্য। যাই হোক, তোর যখন এত আগ্রহ, তুই বরং ইংরেজিতে যা ইচ্ছে লিখে নিয়ে আয়, ছেপে দেব। ইংরেজি সেকশনে কোনো লেখা জমা পড়েনি।’ হুমায়ূন আহমেদ লিখে ফেললেন একখানা কবিতা। ঈশ্বরবিষয়ক অতি উচ্চশ্রেণীর ভাব বিষয়ক ইংরেজি কবিতা। পরে সেটি ছাপা হয়। ইংরেজির শিক্ষক একদিন ক্লাসে এসে তাঁর কবিতাটি পড়ে শোনালেন। স্যার খুব মুগ্ধ তাঁর কাব্য প্রতিভায়। স্যার বললেন, ‘হুমায়ূন, তুই ইংরেজি কবিতা লেখার চর্চাটা ছাড়বি না।’

বানিয়ে বলা
পরিচালক সমিতির সদস্য হওয়ার জন্য ভাইবা দিতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ সিনেমা বানাবেন। সুতরাং তাঁকেও পরিচালক সমিতির অফিসে ভাইবা বোর্ডের মুখোমুখি হতে হলো। প্রথম প্রশ্ন-

: হুমায়ূন কবীর সাহেব, ছবি পরিচালনা বলতে আপনি কী বুঝেন?

: কিছু মনে করবেন না, আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ।

: সরি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ছবির পরিচালকের আসল কাজটা কী?

: পরিচালকের মূল কাজ হচ্ছে, ক্রিকেট খেলার আম্পায়ারের মতো একটা সাদা টুপি পড়ে হাসি মুখে চেয়ারে বসে নায়িকাদের সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি করা।

উত্তর শুনে প্রশ্নকর্তা গম্ভীর হয়ে গেলেন। হুমায়ূন আহমেদ এবার ততোধিক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আইজেনস্টাইনের মতে, ছবি যদি স্টিম ইঞ্জিন হয়, তাহলে পরিচালক হচ্ছেন সেই স্টিম ইঞ্জিনের স্টিম। উল্লেখ্য আইজেনস্টাইন কখনও এমন কথা বলেননি। ভাইবা বোর্ডে ভারী কিছু না বললে পার পাওয়া যাবে না মনে করে হুমায়ূন আহমেদ সেদিন কথাটি বানিয়ে বলেছিলেন।

পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, উর্ধ্ব-অধ্ব
এক সাংবাদিক হুমায়ূন আহমেদের ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন।

: সুনীলদা’র ‘পূর্বপশ্চিম’ পড়েছেন?

: পড়েছি।

: আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে তিনি এত বড় একটা কাজ করে ফেললেন। আপনি পারলেন না কেন?

: তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেননি বলে লেখাটা তার জন্য সহজ হয়েছে।

: না দেখলে লেখা সহজ!

: অবশ্যই। মীর মশাররফ হোসেন কারবালার যুদ্ধ দেখেননি বলে ‘বিষাদসিন্ধু’ লিখে ফেলতে পেরেছেন।

: আপনার কিন্তু উচিৎ ‘পূর্বপশ্চিম’-এর মতো একটা উপন্যাস লেখা।

: ভাবছি লিখব। নামও ঠিক করে ফেলেছি।

: কী নাম?

: নামটা একটু বড়। ‘পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, উর্ধ্ব-অধ্ব’।

নাম রাখা
এক মা তার ছেলের নামের জন্য হুমায়ূন আহমেদের কাছে এসেছেন।

: স্যার, আমার ছেলের নামের প্রথম অক্ষর হবে ‘আ’। কারণ আমার নামের প্রথম অক্ষর ‘আ’। আতিয়া। শেষ অক্ষর হবে ‘ল’। কারণ ছেলের বাবার নামের প্রথম অক্ষর ‘ল’। লতিফ। নামের অর্থ যদি নদী, আকাশ বা মেঘ হয়, তাহলে খুব ভালো হয়। তারচেয়েও বড় কথা নামটা হতে হবে আনকমন।

: ছেলের নাম রাখো আড়িয়াল খাঁ।

: আড়িয়াল খাঁ!

: হ্যাঁ, তোমার সব দাবি এই নামে পূরণ হয়েছে। এই নাম শুরু হয়েছে ‘আ’ দিয়ে। শেষ হয়েছে ‘ল’ দিয়ে। নদীর নামে নাম। তাছাড়া আনকমন তো বটেই।

: আমার স্বামীর বংশ খাঁ বংশ না।

: তাতে কী? তোমার ছেলে খাঁ বংশের পত্তন করবে।

: স্যার আপনাকে আমার ছেলের নাম রাখতে হবে না। ধন্যবাদ।

: তোমাকেও ধন্যবাদ।

তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা
হুমায়ূন আহমেদ জগতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা বাল্যবন্ধু উনুর কাছ থেকে পেয়েছেন। উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। যেমন: আকাশে উড়োজাহাজ দেখলেই দৌড়ে গাছের নিচে বা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়া উচিত। নইলে উড়োজাহাজের যাত্রীদের প্রস্রাব-পায়খানা মাথার ওপর এসে পড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। কারণ, ট্রেনের বাথরুমের মতো প্লেনের বাথরুমেরও নিচে ফুটো।

এরপর থেকেই উড়োজাহাজের শব্দ পেলেই হ‌ুমায়ূন আহমেদ বন্ধুদের নিয়ে দৌড়ে গাছের নিচে আশ্রয় নিতেন। একদিন তাদের ওভাবে দৌড়াতে দেখে এক পথচারী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’

: আকাশ থেকে গু পড়ছে।

কী সর্বনাশ! আসমানের গু! শুনে পথচারী নিজেও দৌড়াতে শুরু করলেন।

রবীন্দ্রনাথের সার্টিফিকেট
একদিন এক যুবক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে এল। যুবকের হাতের লেখা অবিকল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো। হুমায়ূন আহমেদ যুবককে দিয়ে নিজের জন্য রবীন্দ্রনাথের একটা সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিলেন। সেখানে লেখা-

শ্রীমান হুমায়ূন আহমেদ,

তোমার কিছু রচনা পাঠ করিয়া বিমলানন্দ পাইয়াছি। তোমার কিছু শব্দের বানান বিষয়ে আমার কথা আছে। সাক্ষাতে বলিব।

ইতি

শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের

ভাবপ্রকাশ
সাহিত্য আলোচনার আসরে এক কবি ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনার সব উপন্যাসই দেখি হয় চার ফর্মায়, নয় পাঁচ ফর্মায় কিংবা ছয় ফর্মায় শেষ হয়। এভাবে ফর্মা হিসাব করে কীভাবে আপনার মাথায় উপন্যাস আসে?’ প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে হুমায়ূন আহমেদ বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘ভাই, আপনি যে সনেটগুলো লেখেন, এগুলো তো চৌদ্দ লাইনে লেখেন। আপনার ভাব যদি চৌদ্দ লাইন মেনে আসতে পারে, আমার উপন্যাস ফর্মা হিসাবে এলে অসুবিধা কী?’

সূত্র: হুমায়ূন আহমেদের লেখা আমার ছেলেবেলা, বসন্ত বিলাপ, কিছু শৈশব, রঙ পেন্সিল, বলপয়েন্ট, ফাউনটেনপেন, কাঠপেন্সিল, ‘অন্যদিন: হুমায়ূন আহমেদ স্মরণ সংখ্যা’ ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে নেওয়া।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত