| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

গ্যাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেজের গল্প : আয়নার সঙ্গে কথোপকথন

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

ভাষান্তর : মাসুদুজ্জামান 

সেই মানুষ, ঘরটা আগে যার ছিল, সকালের দিকে বেশ কয়েক ঘণ্টা ঘুমানোর ফলে আজকাল ভোরের দিকে যেমন হয়, দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতার কথা ভুলতে বসেছিল। বেলা বেশ হয়েছে, এরই মধ্যে শহরের হৈহট্টগোলের আওয়াজ বেড়েই চলেছে আর আধখোলা দরজা গলিয়ে ঢুকে পড়ছে। এবার সে উঠে পড়ল। অন্য কোনো চিন্তা নয়, এ মুহূর্তে মৃত্যুর কথাই তাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছে। মনের ওপর চেপে বসছে সম্পূর্ণ ঘূর্ণায়মান এক ভয়। ভাবনাটা পৃথিবীকে নিয়ে_ নিজেকে মনে হচ্ছে একখ- মাটি_ তার জিভের তলায় নিশ্চয়ই তার ভাই ঘাপটি মেরে বসে আছে।কিন্তু আনন্দোজ্জ্বল সূর্য গোটা বাগানকে নিমিষের মধ্যে ঝলমল করে তুলে তাকে অন্য এক জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দিল, যে জীবন নিতান্তই সাদামাটা, মৃত্তিকালগ্ন এবং সম্ভবত তার অন্তর্নিহিত ভয়ানক অস্তিত্বের তুলনায় কম সত্য। জীবনের কথা ভাবলে সে একজন সাধারণ মানুষ, প্রাত্যহিক পশু, নিজের স্নায়ুম-লীর ওপর নির্ভর না করেই তাকে এ কথাটা মনে রাখতে হয় যে তার যকৃৎ পরিবর্তনসাপেক্ষ, বুর্জোয়াদের মতো পড়ে পড়ে ঘুমাতে সে বাধ্য। সে ভাবছে_ কোনো সন্দেহ নেই বুর্জোয়া হিসাব-নিকাশের মধ্যে জিভ বিকৃত করা নানান ধরনের সংখ্যাটংখ্যা আছে। অফিসের টাকাপয়সার এই হচ্ছে এক গোলকধাঁধা।

আটটা-বারো। আজ নিশ্চিতভাবেই অফিসে পেঁৗছাতে আমার দেরি হয়ে যাবে। আঙুলের ডগা দিয়ে গালের ওপরটা সে বুলিয়ে নিল। কর্কশ চামড়া, কাঁটা গাছের গোড়া বুঝি বুনে দেয়া হয়েছে। হাত বোলাতে বোলাতে সে অনুভব করল ডিজিটাল অ্যান্টেনার ওপর যেন ছড়িয়ে আছে শক্ত দড়ি। এরপর আধখোলা হাতের তালু দিয়ে সন্তর্পণে সে তার এবড়ো-খেবড়ো মুখের অস্তিত্ব অনুভব করল। শল্যচিকিৎসকের মতো মুখে তার সি্নগ্ধ প্রশান্তির ছাপ, টিউমারের বিন্দুটা কোথায় সে ভালোভাবেই জানে।
ওপরের সি্নগ্ধ অংশ থেকে শক্ত একটা বস্তু ভেতর পর্যন্ত সত্যি সত্যি চাড়িয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এখানে, এ আঙুলের তলায়, আরো তলায় শুধু হাড়ের পরে হাড়_ তার ব্যাখ্যাতীত শারীরিক অবস্থা বিন্যাস মেনেই সবকিছু ভেতরে ডুবিয়ে রেখেছে। এই শারীরবিশ্বের বুনন, কিছুটা ঢিলেঢালা, স্বয়ম্ভু, মাংসপি-লগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক উঁচু এবং চূড়ান্তভাবে অস্থিমজ্জার সঙ্গে সম্পর্কিত।
হ্যাঁ। বালিশের বিপরীতে তার মাথা নরম তুলার ভেতরে ডুবে আছে, তার শরীর নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গে মিলে গিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে বিশ্রাম নিচ্ছে। জীবনের একটা সমান্তরাল স্বাদ আছে। নিজের কাছে এ যেন এক ধরনের আপস। চোখ বন্ধ করার সামান্য চেষ্টা, সে জানে দীর্ঘ ক্লান্তিকর যে কাজ তার অপেক্ষায় আছে, তা অসাধারণ এক পথের হদিস দেবে। ক্রমেই সে পথ বুঝি সহজ-সরল হচ্ছে, জটিলতামুক্ত হচ্ছে। সময় বা স্থানের সঙ্গে কখনই কোনো আপস নয়। প্রয়োজন ছাড়াই যখন সে রাসায়নিক রহস্য উদঘাটনের জন্য পেঁৗছাবে তখন কষ্ট পাওয়ার জন্য তার দেহ প্রস্তুত হয়ে যাবে। এভাবে চোখ বন্ধ করা অবস্থায়, মূল রসদের অর্থনীতি, যান্ত্রিক ক্ষয়ক্ষতির সুনিশ্চিত অনুপস্থিতি তার চিন্তায় ভেসে বেড়াবে। স্বপ্নের এক সমুদ্রে তার পুরো শরীর ডুবে যাচ্ছে। শরীর চলতে পারে, পারে বাঁচতে। অস্তিত্বের ভিন্নরকম বিন্যাস ঘটলে তার জীবন বিকশিত হতে পারে। এভাবে তার প্রকৃত জীবন অভিন্ন গতির ঘনত্ব পেতে পারে। এমনকি এর চেয়েও বেশি কিছু ঘটতে পারে, যার মধ্য দিয়ে শারীরিক পরিতৃপ্তির কোনো ক্ষতি না করে বাঁচার প্রয়োজনীয়তা সে সম্পূর্ণভাবে বুঝে নিতে পারবে। জীবন হবে বেশ সহজতর, পার্থিব সম্পদ, অভিনয়_ সবকিছু নিয়েই তো বাঁচা। তবু বাস্তব বিশ্বে যেমনভাবে বাঁচা যায়, ঠিক তেমন করেই বাঁচতে হবে। সকালে দাড়ি কামানো, বাস ধরা, অফিসে হিসাব মেলানো_ তার স্বপ্নে সবকিছুই সহজ এবং জটিলতামুক্ত। অবশেষে তার ভেতরে জন্ম নেবে এক ধরনের তৃপ্তির ভাব।
হ্যাঁ, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করে নেয়াই ভালো। কেননা এভাবেই তো সে তৈরি করে করে নিয়েছিল। আলো ঝলমলে ঘরে আয়নার দিকে তাকিয়ে এভাবেই সে করে যেতে পারত, যদি না সেই মুহূর্তে একটা ভারী যন্ত্র নির্দয়ভাবে ঈষদুষ্ণ পদার্থকে ভেঙে না ফেলত। এবারে গতানুগতিক জগতে ফিরে আসা যাক। সমস্যা নিশ্চয়ই একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশের দিকে ধাবমান। এ এক অদ্ভুত তত্ত্ব, যা তাকে সেই মুহূর্তে নির্ভার হতে সাহায্য করেছিল। এমনকি একটা আপসের জায়গায় সে পেঁৗছে গিয়েছিল। এসব সত্ত্বেও তার অন্তর্নিহিত মানবিক সত্তা থেকে সে অনুভব করেছিল যে তার মুখটা জায়গা বদল করে এক পাশে সরে গেছে। এ হলো এক ধরনের অভিব্যক্তির প্রকাশ। এ অভিব্যক্তিটা হাসি ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে সে হাসি নিশ্চয়ই অনিচ্ছাকৃত। ‘দাড়ি কাটার পর বইয়ের মধ্যে কুড়ি মিনিট ডুবে থাকতে হবে। গোসলের জন্য আট মিনিট, তবে তাড়া থাকলে পাঁচ মিনিট। আর রয়েছে সকালের খাওয়া। এ জন্য বরাদ্দ হচ্ছে সাত মিনিট। পুরনো মাংসের কাবাব খুবই বিরক্তিকর লাগে। মেবেলের দোকান, খাদ্যদ্রব্য, লোহার জিনিস, ওষুধ, মদ_ এ যেন কারো একটা বাক্স। নামটা ভুলে গেছি। (মঙ্গলবার পথে বাস বিকল হওয়ার ফলে সাত মিনিট দেরি)। পেন্দোরা। না, পেলদোরা। না, তাও তো নয়। সব মিলিয়ে আধঘণ্টা হবে। এ কোনো সময়ই নয়। নামটা ভুলে গেছি। একটা শব্দ,-আর তার মধ্যেই সব। পেদোরা। ‘প’ অক্ষর দিয়েই শুরু।’
তার দেহে গোসলের পোশাক। এখন সে হাত ধোয়ার ব্যাসিনের সামনে আধো ঘুমে আচ্ছন্ন। মাথার চুল এলোমেলো। দাড়িও কাটা হয়নি। আয়নায় সে নিজের ক্লান্ত চাউনি দেখতে পেল। আয়নায় নিজের মৃত ভাইয়ের প্রতিবিম্ব আবিষ্কার করে সে শিউরে উঠল। আয়নায় সবে প্রতিবিম্বটা আবির্ভূত হচ্ছে। অত্যন্ত দ্রুত ঘটে যাওয়া এ শিহরণ তাকে একটা ঠা-া দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। সেই একই ক্লান্ত মুখাবয়ব, সেই একই দৃষ্টি, যা এখনো সম্পূর্ণভাবে জাগেনি।
নতুন করে জায়গা পাল্টানোর ফলে আয়নায় প্রচুর আলো এসে পড়ল। একঝলক মনোরম আনন্দের অভিব্যক্তি ঘটল। আলো আবার তার কাছে ফিরে এলো। হাসি পেয়ে যাওয়ার মতো মুখের ভঙ্গি তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিল। জল। গরম জলের ধারা যেন প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসেরই প্রকাশ। সাদা জলের ঢেউ, ঘন গরম জলের ভাপ_ আয়নার কাচের মধ্যে তার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়াল। এভাবেই প্রতিবন্ধকতার সুযোগ নিয়ে দ্রুতগতিতে জায়গা করে নিল বলে সে নিজের সময়ের সঙ্গে এবং আয়নার ভেতরের পারদের সঙ্গে তাল রেখে নতুনভাবে আলো সম্পর্কে একটা সঠিক সূত্র বের করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার উল্টো দিকে আরো একটা মুখ আছে। রয়েছে নাড়ির স্পন্দন। ধুকপুকুনির মধ্যেই তার উপস্থিতি। একই সঙ্গে সে হাসি এবং ভাবগম্ভীর বিদ্রূপের অভিব্যক্তিতে রূপান্তরিত হলো। ভিজে কাচের ওপর দিয়ে তাকে দেখা যাচ্ছে, বাষ্প জমে যাকে আরো দৃশ্যমান করে তুলছে।
হেসেছিল সে। প্রতিবিম্বটিও হেসেছিল। নিজেকে সে নিজের জিভটি দেখিয়েছিল। প্রতিবিম্বটিও প্রকৃত মানুষটিকে তার জিভ দেখিয়েছিল। আয়নার প্রতিবিম্বটিতে আছে আঠাল হলুদ জিভ : ‘আপনার পেট খারাপ’,_ হাসিতে হাসতে সে রোগ নির্ণয় করেছিল। শব্দহীন অভিব্যক্তি। সে আবার হেসেছিল। প্রতিবিম্বটিও আবার হেসেছিল। কিন্তু সে এখন তার দিকে ছুড়ে দেয়া হাসিতে অনেকটা বোকামি, খানিকটা কৃত্রিমতা এবং কিছুটা ছলনার ছাপ দেখতে পায়। সে ডান হাত দিয়ে তার চুল ঠিক করে নেয়। প্রতিবিম্বটিও বাঁ হাত দিয়ে তার চুল ঠিক করে নিল। তক্ষুনি এক লাজুক হাসি ফিরে এসে আবার মিলিয়ে গেল। সে তার নিজের চালচলনে বিস্মিত। তবুও সে ভাবছিল, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সবাই এরকম আচরণ করে। নিশ্চিতভাবেই গোটা ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে বোকামি। তবে তার ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ ছিল অনেক বেশি। কেবল অশ্লীল রীতিনীতিকে সে মান্য করছে। আটটা বেজে সতেরো। সে জানত, অফিসের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে গালাগাল খেতে না হলে তাকে তাড়াতাড়ি করতে হবে। এ দপ্তর থেকেই বেশ কিছু দিন ধরে তার দৈনন্দিন কাজ শুরু হয়েছে। এ অফিস থেকেই শুরু হয় রোজকার শবযাত্রার মিছিলে অংশগ্রহণ করার কাজ।
দাড়ি কামানোর সাবানের ওপর ব্রাশ বোলানোর ফলে একটা নীলাভ সাদা রঙে মুখটা ভরে গেল। ফলে দুশ্চিন্তাটা অনেকটা দূরীভূত হলো। এ মুহূর্তে তার দেহ থেকে যেন ধমনির জালের ভেতর দিয়ে সাবানজলের ফেনা বেরিয়ে এসে দেহের বিশেষ বিশেষ যন্ত্রপাতির কাজ সহজতর করে তুলল। এভাবেই সে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। মুখম-ল সাবান-মাখা। অনেকটা আরাম বোধ করছে সে। এখন সে সেই শব্দটা খুঁজে বেড়াচ্ছে যার সঙ্গে সে মেবেলের দোকানের তুলনা করতে চায়। পেলদোরা। মেবেলের পুরনো জিনিসের দোকান। প্যালদোরা। খাদ্যদ্রব্য অথবা ওষুধ। অথবা একই সঙ্গে সবকিছু পেনদোরা। মগে প্রচুর সাবানের ফেনা। তবুও উত্তেজিত হয়ে সে ব্রাশ ঘষতে লাগল। বুদ্বুদের শিশুসুলভ দৃশ্য তাকে নির্ভেজাল আনন্দ দিচ্ছে। অলক্ষ্যে যেন সস্তা দরের মদের মতো, ভারী ও কঠিন কিছু একটা তার হৃদয়ে প্রবেশ করছে। অক্ষর খোঁজার জন্য তার নতুন প্রচেষ্টা শব্দ বেরোনোর চাইতেও পরিণত আর বর্বর হতে পারত; ঘন অস্পষ্ট জলের ওপর তার স্মৃতি দোলাচলের মধ্য দিয়ে ভেসে চলেছে। অন্যান্য ঘটনার মতো ছড়িয়ে পড়া বিচ্ছিন্ন অংশগুলো পরিপূর্ণভাবে কিছু গড়ে তোলার জন্য সঠিকভাবে নিজেদের মেলাতে পারছে না; আর চিরদিনের মতো ওই শব্দটাকে পরিত্যাগ করতে সে প্রস্তুত : পেন্দোরা!
এখন, অনর্থক অনুসন্ধান থেকে বিরত থাকার সময়। কারণ, তারা দুজনই চোখ মেলে নিজের নিজের যমজ ভাইকে দেখছে। নীলাভ সাদা ঠা-া ফেনাময় ব্রাশ দিয়ে সে তার চিবুক ঢাকতে শুরু করে। বাঁ হাত চলছে আর ডান হাত নম্রতা এবং যথার্থতার সঙ্গে তাকে অনুসরণ করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ছবি অাঁকার এলাকাটা ঢাকা পড়ে যায় ততক্ষণ সে এভাবে তাকিয়ে থাকবে। হাতের ওপরকার ঘড়ির জ্যামিতি দেখানোর জন্যই সে এমনভাবে তাকিয়ে আছে। ক্রোধের নতুন উপপাদ্যের সমাধান করতে সে বদ্ধপরিকর। ঘড়িতে এখন আটটা বেজে আঠারো। এতক্ষণ সে ধীরেই চলছিল। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য সে এখন ক্ষুর ধরল। শিঙের তৈরি ক্ষুরের হাতলটা তার আঙুলের গতি মেনেই চলছে।
হিসাব করে দেখল তিন মিনিটেই সুনির্দিষ্ট কাজটা শেষ হয়ে যাবে। এ হিসাবমতো সে তার ডান হাত (প্রতিবিম্বের বাঁ হাত), ডান কান (প্রতিবিম্বের বাঁ কান) পর্যন্ত তুলেছিল। এভাবেই সে লক্ষ্য করে, দড়ি কাটার চাইতে অন্য কোনো কাজই এতটা কঠিন নয়। আয়নার প্রতিবিম্ব যেমনটা করছিল, তা থেকেই সে এক অত্যন্ত জটিল হিসাবের নিয়ম বের করে ফেলল। আলোর গতির যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য এ সূত্রটার কথাই সে ভাবছিল। কিন্তু তার সৌন্দর্যজ্ঞান গণিতপ্রবণ মনটাকে জয় করে নিয়েছে। শিল্পীসত্তা আর গণিতবেত্তা মনের মধ্যকার দুই অবস্থার মধ্যে কিছুটা সংগ্রামের পর সে দেখে থাকতে পারে যে গতিবেগের বর্গমূল সময়ের সমান। শিল্পীমনের ভাবনা ক্ষুরের চলার গতির সঙ্গে সমানতালে চলছে। বিভিন্ন ধরনের আলোর স্পর্শে তা সবুজ, নীল এবং সাদা হয়ে উঠছে। গণিতজ্ঞ সৌন্দর্যপূজারি, এখন উভয়েই বড় শান্তিতে আছে। খুব তাড়াতাড়ি ডান দিকের (প্রতিবিম্বের বাঁ দিকের) গালের পাশ দিয়ে সরাসরি ঠোঁটের মাঝখান পর্যন্ত ক্ষুরটা সে নামিয়ে আনল। পরিতৃপ্তির সঙ্গে লক্ষ্য করে দেখল যে প্রতিবিম্বের বাঁ দিকের গালের সাবানের ফেনার শেষাংশ ঝকঝকে পরিষ্কার।
রান্নাঘর থেকে ঝলসানো মাংসের গন্ধেভরা ঝাঁঝাল ধোঁয়া ভেসে আসছে। সে তখনো বেস্নড পরিষ্কার করার জন্য পানিতে ডুবিয়ে ঝাঁকুনি দেয়নি। গন্ধ তার জিভের নিচে একটা কাঁপুনি ধরায়। সাদামাটা পাতলা একটা লালার স্রোত বয়ে গিয়ে গরম মাংসের তৃপ্তিদায়ক স্বাদে তার মুখ ভরিয়ে দেয়। যকৃৎ ভাজা হচ্ছে। মেবেলের দোকানের বদনাম সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত একটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেল। পেনদেরা। না, তাও নয়। চাটনির মাঝামাঝি স্বাদগ্রন্থির আওয়াজ তার কানে বেজে উঠলে বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ তাকে সেই স্মৃতিটা স্মরণ করিয়ে দিল। আসলে এ স্মৃতিই তাকে খুব ভোর থেকে আঘাত করে চলেছে। সে জন্যই সে তার বর্ষার জুতা আর বর্ষাতিটার কথা ভুলতে পারে না। মাংসের ঝোলে মাখামাখি যকৃৎ, এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। জ্ঞানত সে গন্ধকে অবিশ্বাস করতে পারছে না, কিন্তু তার পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে সেই ভোজ তার দেহের স্বাদগ্রন্থির মধ্যে আশার সঞ্চার করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। যতশীঘ্র সম্ভব খাওয়া শেষ করাই হলো সে মুহূর্তে পঞ্চেন্দ্রিয়ের জরুরি কাজ। সঠিক এবং দক্ষতার সঙ্গে গণিতবিদ ও শিল্পী নিজেদের দাঁত দেখাচ্ছিল। সে বাঁ হাত (ডান হাত) দিয়ে চামড়া টেনে নরম করে ক্ষুর পেছনের দিকে (সামনের দিকে) এবং সামনের দিকে (পেছনের দিকে), ওপরের দিকে (নিচের দিকে) এবং নিচের দিকে (ওপরের দিকে ) চালাচ্ছিল। ক্ষুরের ধারাল দিকের চলার পথটা সহজ করার জন্যই তার এ চেষ্টা। এভাবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত দুজনই কাজ শেষ করার আকাঙ্ক্ষায় পাশাপাশি কাজ করে চলে।
শেষ করার পর এবার সে যখন তার নিজের কনুই আয়নায় দেখতে পায়, তখনই সে তার ডান হাত দিয়ে বাঁ গালের শেষ কাজটুকু সেরে ফেলে। সে দেখেছিল একটা বড় অদ্ভুত, অপরিচিত চোখ এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছিল যে কনুইয়ের ওপর রাখা অন্য চোখ দুটোও একইরকম বড় এবং অপরিচিত। চোখ দুটো ক্ষুরের গতিপথ দারুণভাবে অনুসরণ করছে। একটা শক্তিশালী হাত তার ভাইকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করছে। রক্ত! তাড়াতাড়ি করলে সবসময় এমনটাই ঘটে।
তার মুখের ওপর একইরকম জায়গা সে খুঁজছিল, কিন্তু তার আঙুল ছিল পরিষ্কার। তবে তার হাতের ছোঁয়া এই ধারাবাহিকতায় কোনো সমাধান আনেনি। সে যখন শুরু করেছিল তার চামড়ায় কোনোরকমের ক্ষতের চিহ্ন ছিল না। আয়নায় অন্যজনের সামান্য রক্ত ঝরছিল। এখনই হয়তো গত রাতের বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি হবে এবং তার মনের ভেতরকার বিরক্তি বা চেতনার প্রকাশ পুনরায় সত্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু থুঁতনি? (গোল অভিন্ন মুখ) অাঁচিলের ওপরকার চুলের জন্য ক্ষুরের মাথাটা প্রয়োজন। সে নিজেকে ভাবছিল যেন কোনো এক মেঘের ক্লান্ত কুজ্ঝটিকা। নিজের প্রতিবিম্বের দ্রুত অভিব্যক্তির ভেতর দিয়ে সে নিজেকেই পর্যবেক্ষণ করল। এ জন্যই কি অত্যন্ত তাড়াতাড়ি সে দাড়ি কাটছিল যাতে সবরকমের স্থান পরিবর্তনকে লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে আলোর ঘনত্ব-দূরত্বকে আবৃত করে রাখার ব্যাপারে সে অক্ষম? গাণিতিক অবস্থার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সে নিয়ে নিয়েছে। সে কি আয়নার প্রতিবিম্বের আগে সবকিছু সেরে ফেলতে পারত? মুহূর্তের মধ্যে কি কাজটা সমাধা করা তার পক্ষে সম্ভব হতো? অথবা এও কি সম্ভব ছিল যে সংক্ষিপ্ত সংগ্রামের পর শিল্পী গণিতজ্ঞকে স্থানচ্যুত করতে সক্ষম হবে এবং সবকিছু ঠিকঠাক করে নির্ভেজাল সময়ে বেঁচে থাকতে পারবে?
অন্যমনস্কভাবে দেখতে দেখতে সে গরম জলের নল খুলে দিল এবং ঘন গরম জলের তোড় অনুভব করল। পরিষ্কার জলের ঝাপটা লেগে তার কানে তালা লাগিয়ে দিল। দোকানে কাচানো পরিষ্কার তোয়ালের আরামদায়ক রুক্ষতা তার ত্বকে এনে দিল গভীর পরিতৃপ্তি, যেন একটা স্বাস্থ্যবান প্রাণীকে সে পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস নিতে সাহায্য করছে। প্যানদোরা। সেই শব্দটা : প্যানদোরা। তোয়ালের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে সে চোখ বন্ধ করে রইল। আয়নার সামনে থাকার সময় তার মুখ অপ্রতিভ, মস্নান হয়ে উঠেছিল। বোকা বোকা চোখে সে নিজেকে অনুধাবন করে মুখটা গাঢ় লাল রঙের দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলল। চোখ খুলে একবার সে হাসল (প্রতিবিম্বটিও হেসেছিল)। তার কাছে এখন আর কোনো কিছুর গুরুত্ব নেই। মেবেলের দোকানে প্যানদোরার বাক্স। মাংসের ঝোলে ডোবানো যকৃতের গরম গন্ধ তার নাসারন্ধ্রের রসনা সমীহের সঙ্গে দারুণভাবে বাড়িয়ে দেয়। সে পরম তৃপ্তি পায়,-ইতিবাচক তৃপ্তি। তৃপ্তিটা এই ভেবে যে একটা বিরাট চেহারার কুকুর তার আত্মার ভেতর লেজ নাড়তে শুরু করে দিয়েছে।
কৃতজ্ঞতা: যায়যায়দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত