| 24 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ

গণহত্যা: হাড়ের এ ঘরখানি

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট
একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে এই লেখা। নয়মাস জুড়ে যে হত্যাযজ্ঞ চলেছিল এই বাংলায়, তারই স্বরূপ সন্ধান করা হয়েছে এই লেখায়। লেখাটি বাংলা একাডেমিতে পাঠ করা হয়েছিল।

 

আয়নায় দাউ দাউ আগুন

একটি পাঁচ বছরের শিশুর ঘুম ভাঙল গভীররাতে, যখন পাশের বাড়ির লুলু মামা তাকে পাঁজাকোলা করে খাট থেকে নামিয়ে আনছিল। চোখ মেলতেই তার চোখ গেল ঘরের আয়নার দিকে। সেই আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছিল দাউ দাউ আগুন। ছেলেটা ভাবছিল, আয়নায় বুঝি আগুন লেগেছে। সে আগুন বুঝি ছড়িয়ে যাবে পুরো ঘর। এরপর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেল, যা সারাজীবনের জন্য স্থির হয়ে গেল শিশুটির মনে।
শিশুটি দেখতে পেল তাদের ঘরটিতে একের পর এক মানুষ এসে ঢুকছে। পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা পুলিশ। সঙ্গে তাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে। পুলিশের লোকেরা ঘরের আলমারি খুলে শিশুটির বাবা কিংবা বড় ভাইদের লুঙ্গী, প্যান্ট পরে নিচ্ছে। খুলে ফেলছে পুলিশের পোশাক। লুলু মামার কোলে করে বাড়িওলার বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় বাড়ির সিঁড়িতে পুলিশ বাহিনীর আরো অনেক সদস্যকে দেখা গেল। এরই মধ্যে একতলা বাড়ির ছাদ থেকে কোনো কোনো সাহসী পুলিশ সদস্য থ্রি নট থ্রি বন্দুক থেকে গুলি করা শুরু করেছেন। আর তারই প্রত্যুত্তরে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করছিল পাকিস্তানি বাহিনী। এবার শিশুটি দেয়াল পার করে দেওয়া দৃষ্টিতে দেখতে পেল, দাউ দাউ করে জ্বলছে পুলিশ লাইনের ব্যারাক। আকাশে মাঝে মাঝে আলো ফুটে উঠছে, সেই সঙ্গে গুলির শব্দ। এত গুলির আওয়াজ শিশুটি শুনল এই প্রথম।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


বাড়িটি চামেলীবাগে। ৫ নম্বর বাড়ি। এর ঠিক পিছনেই ছয় আর সাত নম্বর বাড়ি। সে দুই বাড়ির দেওয়াল পার হলেই পুলিশ লাইন। সেখানেই জ্বলছে আগুন। আমি বলছি ২৫ মার্চ দিবাগত রাতের কথা। গুলির আওয়াজে সবাই জানতে পারে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেদিন থেকে সেই শিশুটির নতুন জীবন শুরু হয়। ১৯৭১ সালের সকল শিশুর মানসিক বয়স তখন বেড়ে যায়। তারা অনেক কম বয়সেই অনেক বড় হয়ে যায়। সেদিনের যেকোনো শিশুর উদ্দেশে বলি, তোমাদের কি মনে পড়ছে, রাতের ব্ল্যাক আউটের কথা? কারফিউ–এর কথা? বাতি নিবিয়ে নিবিষ্টমনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার কথা? ট্রেঞ্চে লুকিয়ে থাকার কথা? বিমান আক্রমনের কথা। বিমান আক্রমনের আগে সাইরেনের শব্দ? রাস্তায় পাকিস্তানি মিলিটারি সদস্যদের সামনে দিয়ে দুরু দুরু বুকে এগিয়ে যাওয়ার কথা?


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সেদিনের শিশুরা বুঝে গিয়েছিল, ‘জীবন–মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।’ সেই শিশুটির মনের ওপর দিয়ে ২৫ মার্চ রাতে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। রাতে আর ঘুম আসেনি। মাঝে মাঝে কোনো নারীর ফুঁপিয়ে কান্নার কথা মনে আছে তার। সে তখনও বোঝেনি, আর কিছুদিন পরই বাড়ির দুদিকে দুটো ট্রেঞ্চ খোড়া হবে। একটা হবে এল প্যাটার্নের, অন্যটা আই প্যাটার্নের। গর্তের ওপরে টিনের ছাদ তৈরি করে তা ঢেকে দেওয়া হবে মাটি দিয়ে, সেই মাটিতে পুতে ফেলা হবে ঘাস, সেই ঘাসের ওপর লাগিয়ে দেওয়া হবে পেয়াজের গাছ। শিশুটি তখনও জানে না, কিছুদিনের মধ্যেই বিমানের সতর্কতা সাইরেন বেজে উঠলেই নেমে পড়তে হবে এই ট্রেঞ্চে এবং বিমান চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থাকতে হবে সেখানেই বসে। শিশুটি তখনও জানবে না, চামেলীবাগের পাশে রাজারবাগে পাকিস্তানি বাহিনী যে আক্রমণ চালিয়েছিল সেদিন, সেটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। সে তখনও জানবে না, একই রাতে রক্তলোলুপ পাকিস্তানি সৈন্যের দল এগিয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, সেখানে চালিয়েছে নারকীয় হত্যাকান্ড। হত্যা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক–কর্মচারীদের। একইসঙ্গে আক্রমণ করেছে পিলখানায়। বাদ পড়েনি সংবাদপত্র অফিস। পুরান ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় চালিয়েছে গুলি।
এই হত্যাযজ্ঞের নাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

 

অপারেশন সার্চলাইট: আগে পরে…

আমরা যখন একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে কথা বলতে যাই, তখন অবধারিতভাবেই আমাদের বলতে হয় অপারেশন সার্চলাইটের কথা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে যে বাংলার মানুষ নয়, বাংলার মাটিই ছিল মূখ্য, সে কথা আজ কারো জানতে বাকি নেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হলো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, পাকিস্তানের শাসনভার আওয়ামী লীগের হাতেই আসার কথা, ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী’ও বলছেন, ঠিক এ রকম এক পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের এক তারিখে ইয়াহিয়া ঘোষণা করলেন, ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসছে না। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো অধিবেশনে যোগ দিতে চাইছেন না। এ যেন বারুদে আগুন ধরালো। ‘মানি না, মানি না’ বলতে বলতে রাজপথে নেমে এল বাংলার মানুষ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। ২ মার্চ গঠিত হয় ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’, ছাত্ররাই বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে ‘স্বাধীনতার ইশতাহার’ ঘোষণা করল। সেদিনই স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি নির্বাচন করা হলো। জাতীয় পরিষদ না বসায় এ দিনটিকে জাতীয় শোকদিবস হিসেবে পালন করা হলো।
প্রতিদিনই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর অসাধারণ ভাষণটি দিলেন, যা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা হওয়ার যোগ্য। সরাসরি কিছু না বলে সব কথাই বলে দিলেন তিনি ‘যদি’ শব্দের ব্যবহার করে।
১৫ মার্চ সদলবলে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া–মুজিব বৈঠক হয়। ১৭ মার্চেও হয়। বাইরে আন্দোলনও চলতে থাকে। ১৯ মার্চ আবার ইয়াহিয়া–মুজিব বৈঠক হয়। ২০ মার্চ উপদেষ্টাদের সহ বৈঠক হয়। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। এ দিনটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পালন করে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে। ভাসানী ন্যাপ পালন করে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা দিবস’ হিসেবে। ‘জয়বাংলা বাহিনী’র সদস্যরা ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে নতুন পতাকাকে অভিবাদন জানায়। ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ, হ্যাঁ, ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সেদিনই ‘অপারেশন সার্চলাইট’–এর নামে নীরিহ পূর্ব বাংলাবাসীদের হত্যাকাণ্ড শুরু করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


পাকিস্তানিরা প্রমাণ করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আওয়ামী লীগ মূলত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করেছে। এই রাষ্ট্রদ্রোহ নস্যাৎ করার জন্যই তারা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে। অপারেশন সার্চলাইটে অংশগ্রহণকারীদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে আওয়ামী লীগের সকল ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়াকে বিদ্রোহ হিসাবে গণ্য করা হবে। যারা আওয়ামী লীগের সমর্থন করবে, তারাও শত্রুপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবে।
তারা ধূর্ততা ধোঁকাবাজির মাধ্যমে ঝটিকা আঘাত চালিয়েছিল। এতে কোনো নৈতিকতা ছিল না। ধূর্ততার মাত্রা বোঝাতে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা যায়। অপারেশন সার্চলাইটের ব্যাখ্যা অংশে বলা হয়েছে ‘অনুরোধ করা হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট যেন সংলাপ অব্যাহত রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নেন—এমনকি মিস্টার ভুট্টো হয়তো সম্মত হবেন না, তবুও মুজিবকে ধোঁকা দিতে তিনি ( প্রেসিডেন্ট) যেন ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন।’ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকেও এই ধোঁকাবাজির অংশ করে নিয়েছিল সামরিক নৃশংসতার পরিকল্পকেরা।
ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার জন্য তারা রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের যত বেশি সম্ভব গ্রেপ্তারের কথাই ভেবেছিল। হিন্দু বাড়িমাত্রই ছিল সেনাবাহিনীর টার্গেট, বিশেষ করে পুরনো ঢাকায়। বলা হচ্ছিল তল্লাশি চালানোর কথা, কিন্তু আসলে তা ছিল মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া অর্থাৎ হত্যা করার পরিকল্পনা।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বহরটি আক্রমণ চালিয়েছিল, তাদের সঙ্গে কম্যান্ড হেড কোয়ার্টারের ওয়ারলেস যোগাযোগের অডিও টেপটি থেকেও অপারেশন সার্চলাইটের স্বরূপ বোঝা সহজ হবে। ৮৮ শীর্ষক সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত ইউনিটকে কনট্রোল রুম থেকে বলা হচ্ছিল,
‘বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিকার কত হলো? চোখে যা দেখছ, তাতে কত আন্দাজ হয়? কত খতম, জখম বা বন্দি? ওভার।’
‘মনে হয় শ তিনেক। ওভার।’
‘বাঃ বেশ! তা তিনশ, খতম না বন্দি? জখম? ওভার।’
এবার শীতল কণ্ঠে উত্তর আসে, ‘না না, একেবারে সাফ! খতম, ওভার।’
এবার রক্ত হিমকরা এমনি বার্তা শোনার পর প্রধান সমর কর্মকর্তা বলে ওঠেন, ‘খাসা খাসা। খুব ভালো কাজ। চালিয়ে যাও, কোনো পরোয়া কোর না। তোমার কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার কেউ নেই। আবারও বলছি, যা করছ, তার জবাব নেই। সাবাশ, বড় খোশ খবর। ওভার।’
এই ছোট্ট কথোপকথন থেকেই বোঝা যায়, মানুষের মৃত্যু এদের জন্য কোনো ঘটনা ছিল না। বরং যত মৃত মানুষের লাশ জমা হবে, ততোই তারা বাঙালিদের শায়েস্তা করতে পারবে বলে মনে করছিল।
অপারেশন সার্চলাইটের ছিল দুই কম্যান্ড। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন ঢাকা শহরের অপারেশনের দায়িত্বে। তাঁর অধীনে ব্রিগেডিয়ার জেহানজেব আরবাবের ৫৭ পদাতিক ব্রিগেড। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ছিলেন দেশের অন্য সব অঞ্চলে পরিচালিত অপারেশনের দায়িত্বে। এই রাও ফরমান আলীই পরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শান্তি কমিটি গঠন ও আল বদর বাহিনী গঠনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তার ডেস্ক ক্যালেন্ডারে কিছূসংখ্যক বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা ছিল, যাদের মৃতদেহ পরে রায়েরবাজারের ইটখোলায় পাওয়া গিয়েছিল। রাও ফরমান আলী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পক।
আমরা যে পাঁচ বছর বয়সী শিশুটির কথা বলছিলাম লেখার শুরুতে, সে কিন্তু এ সবের কিছুই জানত না সে সময়। কিন্তু এই ঘটনা তাঁকে কিছুদিন পরই ছুঁয়ে যাবে একটি বিশেষ কারণে—রাও ফরমান আলী—বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল এই পরিকল্পকের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই শিশুটির বাবাকে ধরে নিয়ে যাবে আল বদর বাহিনী, ডিসেম্বরের ১০ তারিখে। ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের প্রথম শিকার হবে শিশুটির বাবা। আমরা ২৫ মার্চের কথা বলতে গিয়ে বলছি ১০ ডিসেম্বরের কথা। এই দুটি মাসের মধ্যবর্তী সময়েই এ দেশে ঘটে গেছে বিংশ শতাব্দির নৃশংসতম গণহত্যার একটি। স্বল্প সময়ে এত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল—এ রকমটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৬ ডিসেম্বরে আমরা যেদিন শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করলাম, সেদিনটি আমাদের জন্য গর্বের। কিন্তু সে দিনটির কাছাকাছি আসতে আমাদের যতোটা আনন্দ–বেদনার মধ্য দিয়ে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, তা যে কোনো মহাকাব্যকেও হার মানাবে। বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য—১৯৭১। একদিকে আনন্দের ফল্গুধারা, অন্যদিকে স্বজন হারানোর হাহাকার। তার মাঝ দিয়েই এল নতুন দেশ—বাংলাদেশ।

 

তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা বাংলাদেশ?

শিশুটি বড় হতে থাকে। ১৯৮২ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেয়। এ সময় হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সরকার তাদের বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ইস্কাটনের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে। অল্প সময়ের নোটিশে তারা এসে ওঠে জিগাতলার ভাড়া বাড়িতে। এ বাড়ির কাছেই ছিল সাত মসজিদ। শিশুটা, মানে সে সময়ের সেই কিশোর মাঝে মাঝেই গিয়ে বসত সাত মসজিদের পিছনের ঘাসের লনে। সেখানে তুরাগ নদীর ঢেউ কিশোরকে আকৃষ্ট করত। এবং একদিন, একদিন হঠাৎ করেই সেখানে বসে কিশোরটি চিৎকার করে বলে উঠেছিল, ‘তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?’
এই কবিতাটি আসাদ চৌধুরীর। খুবই পছন্দের কবিতা ছিল এটি। এখানে বসেই দেখা যেত রায়েরবাজার ইটের ভাটা। ছেলেটি কখনো সেখানে যায়নি। ভয় পেয়েছে। যদি কখনো সত্যিই কোনো কঙ্কালের দেখা পায় আর যদি সে কঙ্কালের সাদা হাড়গুলোকে তার বাবার হাড় বলে মনে হয়—তখন কী হবে? ছেলেটা দূর থেকেই রায়েরবাজার ইটের ভাটা দেখতে থাকে। এই ইটের ভাটার ছবি সে দেখেছে পত্রিকার। একটা বড় গর্ত, তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশ। বাবার লাশ খুঁজতে ১৬ ডিসেম্বরের পর ছেলেটার মেজ আর সেজ ভাই গিয়েছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। লাশের পর লাশ দেখে আর লাশের দুর্গন্ধে সেজ ভাই বমি করতে থাকে। তার শরীর ও মন বিচলিত হতে হতে স্থবির হয়ে যায়। সে ভয়ে–আতঙ্কে কয়েকদিন অন্য মানুষ হয়ে থাকে। সে অন্য এক গল্প। সারা বাংলাদেশের মানুষ এই গল্পগুলোর সাক্ষী। প্রতিটি গল্প যদি সূঁচ দিয়ে সেলাই করা যায়, তাহলে তা হবে ৫৫ হাজার বর্গমাইলব্যাপী এক কাল্পনিক কাথা। এই কাথা দিয়েই তৈরি হয়েছে মহাকাব্যটি।
কিশোরটা জানে, এরআগে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সবকিছু বদলে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধু সবসময় ছেলেটির পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে যাওয়ার পর সেখান থেকে বঙ্গভবনে ফোন করে সৈয়দ শাজাহানকে প্রথমেই তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘সিরাজকে নাকি ওরা মেরে ফেলেছে?’
সৈয়দ শাজাহান বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ।’
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আহ!’


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


হ্যাঁ, কিশোরটির বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেন আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন একসঙ্গে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর বন্ধু সিরাজের কথা লিখেছেন। দৈনিক ইত্তেফাক যেন হয়ে উঠেছিল ছয় দফার মুখপত্র। সিরাজুদ্দীন হোসেন ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর যাবতীয় প্রচারের দায় বহন করতেন।
জিয়াউর রহমান জেনে বুঝেই বাংলাদেশটাকে একটা মিনি পাকিস্তান বানাচ্ছিলেন। বহুদলীয় গনতন্ত্রের নামে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। যারা একাত্তরে দালালি করেছে, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পা–চাটা কুকুর হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে তৃপ্তি পেয়েছে, তারা চলে এসেছে প্রকাশ্যে। বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু নির্দিষ্ট অপরাধে অভিযুক্ত ১১ হাজার অপরাধীকে ছাড়েননি। জিয়াউর রহমান সিএমএলএ থাকা অবস্থায় দালাল আইন রদ করে দেন। ফলে পাকিস্তানপন্থিদের মধ্যে একরকম জোশ এল। তারা জিয়াউর রহমানের স্যাঙাত হয়ে দেশের চাকা পিছনের দিকে ঘোরাতে শুরু করল। এবং তখন থেকেই ‘মুক্তিযুদ্ধ বৃথা’ যেতে শুরু করল। সে অবস্থা চলল অনেকগুলো বছর। স্কুলের শিক্ষার্থীরা যে বইগুলো পেল, তাতে লেখা থাকল মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ, তার স্পিরিটটাকেই এরা দলে বলে অগ্রাহ্য করতে থাকল। ঘাতকেরাই ফুলে ফেঁপে উঠল। তারাই তখন দেশের ঝাণ্ডা বরদার! এ যেন শকুনে শকুনে ছেয়ে যাওয়া দেশ!


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


এরই মধ্যে দেখি জাহানারা ইমামকে। ঘাতকদের বিচারের দাবিতে তিনি আবার এক করলেন দেশের মানুষদের। মানুষ যেন বহুদিন পর নিজেকে নিজের মধ্যে খুঁজে পেল। ফিরে আসতে লাগল একাত্তর। বার বার। সেই একাত্তরের কথাই ফিরে এল, যে একাত্তরে শহীদ হয়েছিলেন তিরিশ লাখ মানুষ। অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে প্রকাশ্যে দালালি করা অধ্যাপক গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের পর পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামী অধ্যাপক গোলাম আযমকে তাদের দলের আমির বলে ঘোষণা করে। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত থাকা এই দেশদ্রোহী ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এ দেশে প্রবেশ করেছিলেন। আবেদনটি ছিল অসুস্থ মাকে দেখার। তার নাগরিকত্ব ছিল না। কিন্তু সেই থেকে তিনি এ দেশেই অবস্থান করছিলেন। সংসদে বেশ কয়েকবার তার নগরিকত্বের প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তার নাগরিকত্ব প্রত্যার্পন করার ইচ্ছে সরকারের নেই। ভিনদেশি পাসপোর্টের অধিকারী একজনকে আমির নির্বাচিত করার পরেই গড়ে উঠল ঘাতকদালাল নির্মুল কমিটি। বলা যায়, একাত্তরের চেতনার পক্ষে এটাই ছিল বহুদিন পর এক ঝলক সুবাতাস। মিনি পাকিস্তান হয়ে ওঠা বাংলাদেশ আবার আড়মোড়া ভেঙে তার অতীত বীরত্বের কথা সম্মিলিতভাবে মনে করল এ সময়। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি গড়ে ওঠে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতকদালাল নির্মূল কমিটি। সে বছরের ২৬ মার্চ গণ আদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। সচকিত মানুষ বহুদিন পর একাত্তরের ঘাতকদের নির্মমতার কথা প্রকাশ্যে বলতে পারল। তাই এই দিনটিকে বাঙালির ইতিহাস–সংলগ্ন শিকড়ে ফেরার দিন হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


গণহত্যা: হাড়ের এ ঘরখানি

আমরা এবার ৩০ লাখ মানুষ মানে কী, তা বোঝার চেষ্টা করব। আচ্ছা, ১ থেকে ৩০ লাখ পর্যন্ত গুনতে চেষ্টা করুন তো? দেখুন তো কতটা সময় লাগে?
কয়েকটি বধ্যভূমির নাম বলি। বলতে পারবেন, কী ঘটেছিল সে জায়গাগুলোয়? যেমন, ঢাকার শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি, জগন্নাথ কলেজ গণকবর, চট্টগ্রামের লালখান বাজার বধ্যভূমি, সার্কিট হাউজ বধ্যভূমি, টাইগারপাসের নেভাল অফিস বধ্যভূমি, হালিশহরের ডকইয়ার্ড ক্যাম্প বধ্যভূমি, রংপুরের টাউনহলের বধ্যভূমি, খুনিয়া দীঘি বধ্যভূমি, খুলনার গল্লামারি বধ্যভূমি, চুকনগর বধ্যভূমি?
এ বিষয়ে কিছু বলার আগে জেনোসাইড বলতে কী বুঝব, তা নিয়ে একটু বলা দরকার। শুধু গণহত্যা শব্দটি দিয়ে জেনোসাইডের ব্যাখ্যা করা যায় না। জেনোসাইড বলতে
‘একটি জাতি, নৃতাত্ত্বিক, বর্ণগত কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠিকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে নিম্নবর্ণিত যেকোনো কর্মসাধনকে বোঝাবে:
১. গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা
২. গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন
৩. উদ্দেশ্যমূলকভাবে গোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় এমন কিছু আরোপ যা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে এর কাঠামোগত ধ্বংস বয়ে আনবে
৪. গোষ্ঠীর মধ্যে জন্মধারা রোধ করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা আরোপ
৫. গোষ্ঠীর শিশুদের বলপূর্বক অন্য গোষ্ঠীতে চালান দেয়া।
এগুলো রয়েছে জেনোসাইড কনভেনশনের দ্বিতীয় বিধানে।
(মফিদুল হক: জেনোসাইড কনভেনশনের ষাট বছর ও বাংলাদেশ,/জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয়, পৃষ্ঠা ২৫/বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯)
গ্রিক শব্দ জেনস (গোষ্ঠী বা জাতি অর্থে) লাতিন শব্দ সাইড (হত্যা অর্থে) মিলে তৈরি হয়েছে শব্দবন্ধ জেনোসাইড। শব্দটি প্রথম বলেছিলেন পোলিশ আইনবিশারদ রাফায়েল লেমকিন।
১৯৭১ সালের হত্যাযজ্ঞকে জেনোসাইড হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়। ২৫ মার্চের বর্বরোচিত ঘটনা ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’ বলেছিলেন। সানডে টাইমসে অ্যান্থনী মাসকারহানসের যে রিপোর্টটি ছাপা হয়েছিল, তার নামও দেওয়া হয়েছিল ‘জেনোসাইড’। জহির রায়হান যে তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন ১৯৭১ সালেই, তার নাম ছিল ‘স্টপ জেনোসাইড’। এই ভূখণ্ডে শুধু থাকবে পোড়া মাটি—মানুষ নয়; এই ছিল বিকৃতমনা পাকিস্তানি জেনারেলদের মনোজগত গ্রাস করা ভাবনা। এই জেনোসাইড তারা ঘটিয়েছিল ৩টি ধাপে। এবং পুরো নয়মাসজুড়েই তারা ভেবেছে, তাদের পরম শত্রু হলো আওয়ামী লীগের যে কোনো স্তরের নেতা–কর্মী, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষ এবং আওয়ামী লীগের প্রতি দুর্বল—এমন প্রতিটি মানুষ। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ, পূর্ব পাকিস্তান নামের যে ভূ–খণ্ডটি তখন বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছে, তার প্রত্যেকটি মানুষই তাদের লক্ষ্যবস্তু। এই ভীষণ দানবীয় এক ভাবনাজগতের সঙ্গে লড়াই করেই বাংলার মানুষ টিকে ছিল। এক কোটি মানুষ হয়েছিল উদ্বাস্তু, সাড়ে ছয় কোটি মানুষ এই ভূমিতে থেকেই টিকে থাকার যুদ্ধ করেছে—সে–ও এক গভীর সংগ্রাম। আমরা ভুলিনি সেই বৃদ্ধার কথা, যে তার ভালোবাসার মোরগটি রান্না করে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের, ভুলিনি তাদের কথা, যারা সঙ্গোপনে নিজের বিপদ জেনেও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, চিনিয়ে দিয়েছে ঘাতকদের অবস্থান। সেই সাড়ে ছয় কোটি মানুষের মধ্যে ছোট্ট একটি অংশ যোগ দিয়েছিল পাকিস্তানি জেনারেলদের সঙ্গে। সে কথাও আমরা ভুলিনি।
কী ছিল পাকিস্তানিদের মনজগতে? বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানকে তারা কী চোখে দেখত? পাকিস্তানি সেনাপ্রধানরা ধরেই নিয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ আসলে হিন্দু সম্প্রদায়ের কারসাজি। পূর্ব বাংলায় শিক্ষকদের মধ্যে হিন্দুরাই বেশি, তারাই এখানকার আতরাফ মুসলমানদের মগজ ধোলাই করছে। এ কারণেই ইসলামের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চাইছে একদল বিচ্ছিন্নতাবাদী। শিক্ষককুলের প্রতি ঘৃণা এবং সেই শিক্ষকদের কাছে শিক্ষা পাওয়া শিক্ষার্থীদের প্রতিও সমহারে ঘৃণা জমিয়েছে তারা মনে। ফলে এদের প্রত্যেককেই হননযোগ্য বলে মনে করত পাকিস্তানি জেনারেলরা। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই, ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলইটের গণহত্যার লক্ষবস্তু হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত শিক্ষক ও জগন্নাথ হল আর ইকবাল হলের শিক্ষার্থীদের হত্যা করেছিল নির্বিচারে। কার্পণ্য করেনি দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও দ্য পিপলস পত্রিকা গুড়িয়ে দিতে। দাউ দাউ আগুন জ্বলেছে নয়াবাজারে, লক্ষ্মীবাজারে। শামসুর রাহমানের কবিতায় সে কথা মূর্ত হয়ে আছে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে চমকে দেবে এবং সবধরনের বিদ্রোহ, বিপ্লব থেকে মুক্ত করবে পাকিস্তানকে—এ রকম একটি অলীক ভাবনা নিয়েই ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ এই বাংলা ছেড়ে চলে গিয়েছিল পশ্চিমের ডেরায়। সেনা শক্তি দিয়ে তিনি একটি অঞ্চলের সকল মানুষকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বতস্ফূর্তভাবে যে আন্দোলন হয়ে উঠেছিল সর্বব্যপী, তাকে গলা টিপে যে মারা যায় না—তার প্রমাণ আজকের বাংলাদেশ। কিন্তু এই বাংলাদেশ এসেছে রক্তের বন্যায় স্নাত হয়ে। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী কোনো সশস্ত্র সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকটি জায়গায় সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল কেবল। তা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে পাকিস্তানিরা এবং জুনের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। ফলে সে সময় তাদের যুদ্ধটা ছিল বেসামরিক মানুষের সঙ্গে, আরো ষ্পষ্ট করে বললে, তারা তখন নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে।
এরপর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তারা যে প্যাটার্নে মানুষ হত্যা করেছে, তার নাম সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয়। সারা দেশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তা বজায় রাখার সামরিক তৎপরতা ছিল সেটি। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে আঘাত হানতে শুরু করে। মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি করতে থাকে তারা। ফলে আরো বেশি নৃশংস হয়ে ওঠে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দালালেরা। খোঁজ ও খতম তখন তাদের মূল প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় রাজাকার, মুজাহিদ আর আল বদর বাহিনী গড়ে তোলা হয়। রাজাকার আর মুজাহিদের দলে সমাজের গরিব ও অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি, আলবদর বাহিনী তৈরি হয়েছিল শিক্ষিত পাকিস্তানপন্থি তরুণদের নিয়ে। ফলে এদের সহযোগিতায় পাকিস্তানিরা এ সময় সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা খোঁজার নামে খতম করতে থাকে বাঙালিদের।
এর পরের ঘটনা নভেম্বর–ডিসেম্বরের। নভেম্বরের শেষ দিক থেকেই বোঝা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীও যুক্ত হয়ে পড়েছে এই যুদ্ধে। ফলে পাকিস্তানীরা বহু জায়গায় তাদের অবস্থান হারাতে থাকে। যৌথ বাহিনীর হামলায় পাকিস্তানী প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। বোঝা যায়, এই দেশে তারা আর নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে না। পাকিস্তান বাহিনীর এই দুর্দশার মধ্যেই এক নতুন ষড়যন্ত্র করল তারা। এই নতুন ষড়যন্ত্রকে কাজে পরিণত করার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল আল বদর বাহিনী। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা করেছিল তারা। ৯ ও ১০ ডিসেম্বর পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টারে ইস্টার্ন কমান্ডের বৈঠকে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল। রাও ফরমান আলী, নিয়াজীর লেখায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রমাণ পাওয়া যায় হামিদুর রহমান কমিশন রিপোর্টেও। আল বদর বাহিনীর সহায়তায় ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের মেধাবী মানুষদের অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থাকে তারা। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়, কিন্তু এর আগেই ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ হরণ করে নেয় এরা।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


 

কয়েকটি উদাহরণ

বাঙালি বীরত্ব নিয়ে খুবই রোমাঞ্চিত থাকে। বিজয় নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু এই বীরত্ব ও বিজয়ের পেছনে যে আত্মত্যাগ আছে, সে কথা সবসময় মনে রাখে না। আমরা চুকনগরের গণহত্যার কথা উল্লেখ করতে পারি। হাজার হাজার মানুষ খুলনার সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে সমবেত হয়েছিল সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্য, বাঁচবার আশায়। ২০ মে সকাল আটটায় পাকিস্তান বাহিনী এখানে এসে যে তাণ্ডব চালায়, তা এক কথায় অবর্ণনীয়। প্রায় ১০ হাজার মানুষকে তারা এখানে হত্যা করে। মুনতাসীর মামুনের সম্পাদনায় ১৯৭১: চুকনগরে গণহত্যা নামক বইয়ে যাদের স্মৃতিকথা আছে, তারা সেই সময়টার প্রত্যক্ষদর্শী। কেউ বেঁচেছেন ভাগ্যের জোরে, কেউ বেঁচেও এখনও ভাগ্যহত। এখানকার এরশাদ আলী মণ্ডল আর সুন্দরীর কথা বলতে চাই। এরশাদের বাবাকেও হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বর্বরেরা। সেই কারবালা অথবা কুরুক্ষেত্রের মাঠের মতো লাশের সাগরে এরশাদ বাক্যহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, দেখছিলেন লাশের সারি। এরই মধ্যে এরশাদ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন এক মৃত মায়ের বুকে এক জীবিত শিশু। স্তন্যপানের চেষ্টা করছে। মায়ের হাতে শাখা, মাথায় সিঁদুর। এরশাদ শিশু মেয়েটাকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। এরপর একজন হিন্দু প্রতিবেশীর কাছে রাখতে দিলেন। বললেন, এই শিশুর সকল ভার তিনি নিজেই গ্রহণ করবেন। এরশাদ তাঁর কথা রেখেছেন।
আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক ডোমের কথা শুনেছিলাম ১৯৯৭ সালে। নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া লাশ আকশি দিয়ে টেনে টেনে গর্তে ফেলার দায়িত্ব ছিল তাঁর।ডোম লাশকে ভয় পায় না। কিন্তু কী যেন কী হয়ে গেল একদিন। বহুদূর থেকে ভেসে আসা একটি লাশ যখন আকশি দিয়ে টেনে আনছিলেন তিনি, তখন দেখেছিলেন এ এক নারীর লাশ। লাশে পচন ধরা শুরু হয়েছে। লাশটি যখন টেনে নিজের দিকে আনছিলেন, তখন হঠাৎ সেই নারীর পেটটা ফেঁড়ে গেল এবং পেটে দেকা গেল একটি মৃত শিশুকে।
এই লাশ গর্তে পুরে বাড়ি ফিরে এল ডোম। এবং সেদিনই সে মানসিক ভারসাম্য হারাল। আর কোনোদিন সে তাঁর মানসিক ভারসাম্য ফিরে পায়নি।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


এ রকম লাখ লাখ কাহিনী দিয়ে আমাদের গণহত্যার গল্পটি তৈরি হয়েছে। এই গল্পের প্রতিটি শব্দ সত্য। প্রতিটি আবেগ মৃত্যুঞ্জয়ী।
একাত্তরে যে শিশুটির বয়স ছিল পাঁচ বছর, সে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়, দেশকে অতীত বিস্মৃত হতে দেখে, পাকিস্তানি দালালদের আস্ফালন দেখে এ দেশে, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী হতে দেখে, পাশাপাশি জাহানারা ইমামের গণআদালত দেখে, গণজাগরণ মঞ্চ দেখে, ঘাতকদের বিচার হতে দেখে। এবং এক সময় সে শিশুটি উপলব্ধি করে, নশ্বর জীবনে তাঁর আয়ু একদিন শেষ হবে, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের সবাই একদির মারা যাবে, কিন্তু টিকে থাকবে এই দেশটা, যার নাম বাংলাদেশ।
আর এই বাংলাদেশ টিকে থাকবে, যদি এ দেশের মানুষেরা যুগের পর যুগ ধরে তাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধকে লালন করে। যদি এ দেশমাতৃকার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে, তাঁদের সম্মান করে। এবং আক্ষরিক অর্থেই বুঝে বলে, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়।’

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত