ক্যালিগরী ও জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট সিনেমা

Reading Time: 10 minutes

একটা জাতির মানসিকতা আর দশটি শিল্পের চেয়ে চলচ্চিত্রেই প্রতিফলিত হবার সম্ভাবনা সবচে বেশী থাকে। কারণ চলচ্চিত্র কোনো একক সৃষ্টি নয়, যৌথ সৃষ্টি। ফলে বহু মানুষের চিন্তাচেতনা ও বিশ্বাসের ছাপ পড়ে এতে। আর দ্বিতীয়তঃ, চলচ্চিত্র সৃষ্টি হয় মূলত জাতির কোটি কোটি দর্শকের মনমানসিকতার কথা মনে রেখে। ফলে এই উভয় দিক থেকেই, চলচ্চিত্রে সেই দেশের মানুষের মানসরূপ অনেকখানিই ফুটে ওঠে। এই বিষয়টি মনে রাখলে ব্যাখ্যা করা সহজ হয় কোন্ বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রেক্ষিতে, কেন জার্মানীতেই, এক্সপ্রেশনিস্ট চলচ্চিত্রের জন্ম ও বিকাশ ঘটেছিল।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে নির্মিত “ক্যাবিনেট অব ডঃ ক্যালিগরী” থেকে শুরু করে “নসফেরাটু”, “দি স্টুডেন্ট অব প্রাগ”, “গোলেম”, “ডাঃ মাবুজে দ্য গ্যাম্বলার”, “দি লাস্ট টেস্টামেন্ট অব ডাঃ মাবুজে”, “দি ব্যাকস্টেয়ারস”, “মেট্রোপলিস” ইত্যাদি যে বিশেষ এক ধারার ছবি ১৯২০- য়ের দশকের প্রথম অংশে জার্মানীতে আমরা তৈরি হতে দেখি, যা বিশ্বের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে “জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্ম” নামে পরিচিত বর্তমান নিবন্ধটিতে আমরা সেই ধারার স্বরূপটিকে বুঝতে চেষ্টা করব।

রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা দিয়েই শুরু করা যাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানী পরাস্ত হয়েছে বটে, কিন্তু ধ্বংস হয়নি। বিশেষ করে আমরা যদি ১৯৪৫-তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানীর পরাজয় ও ধ্বংসের চিত্রের সঙ্গে সেই সময়ের তুলনা করি। কাইজার দেশ ছেড়ে পালালেন বটে, কিন্তু বড় ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিরা ঠিকই টিঁকে রইল। বিশেষ করে চলচ্চিত্রে টিঁকে রইল পুরনো আমলের প্রতিক্রিয়াশীল সব ধ্যানধারণাই।

১৯১৮-র নভেম্বরের জার্মানীতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হো’ল। শাসকশ্রেণীর ভাড়াটে বাহিনী কুখ্যাত “ফ্রী কর্পস” তখন স্পার্টাকিয়ার্ড বিপ্লবকে নৃশংসভাবে নির্মূলের কাজে রত। নিহত হয়েছেন রোজা লুক্সেমবার্গ। সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, বড় ভূস্বামী, ধনিক শ্রেণীগুলির শক্তিশালী অবস্থানের কিছুই পরিবর্তন করতে পারল না। এককালীন তেজী মুদ্রা মার্কের দাম কমতে কমতে প্রায় কাগজের দামে এসে ঠেকল। বেকারত্ব পৌঁছল চরমে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণীটা বিপর্যস্ত হল। বিপর্যস্ত হলো গণতন্ত্র ও প্রগতিতে বিশ্বাস। অর্থনীতির এই চরম ধ্বস জার্মান জাতিকে ক্রমশঃই এক ভিখারী ও জুয়াড়ীর জাতিতে পরিণত করা শুরু করল। বেড়ে চলল মূল্যবোধের সংকট, সুস্থ মানবিকতায় অনাস্থা, রাজনৈতিক নৈরাজ্য এবং প্রায় একই সমান্তরালে— নাৎসীবাদের ক্রমপ্রসারমান বাদামী ঢেউ।

এ পর্যায়ে জার্মান চলচ্চিত্রশিল্পের বড় ঘটনা হচ্ছে যুদ্ধের শেষের দিকে জেনারেল লুডেনডর্ফের উদ্যোগে সৃষ্ট “Universal Film AG” বা সংক্ষেপে UFA। অর্থাৎ চলচ্চিত্রব্যবসার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ। তবে তা’ যে খুব একটা সফল হতে পেরেছিল এমনটি বলা যাবে না। বরং আমরা দেখি মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের সেই যুগে, কম মজুরিতে ছবি বানিয়ে বড় মুনাফা করার মতলবে, অনেক ব্যবসায়ীই তখন চলচ্চিত্রশিল্পে টাকা লগ্নী করতে এগিয়ে আসছে। সেই সব ছবি যা ব্যবসা করবে, কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক এস্টাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে যাবে না।

মূলত দু’ধারার ছবি আমরা তখন জার্মানীতে তৈরি হতে দেখি। এক, কিছুটা স্থূল যৌন-আবেদনসর্বস্ব ছবি এবং দ্বিতীয়, হত্যা, জিঘাংসা ও করাল মৃত্যুর উপস্থিতিসহ— জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্মের ধারা, যা ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ ও হিচকক পেরিয়ে, ‘এক্সরসিস্ট’-য়ের এই ‘হরর ফিল্ম’-য়ের যুগে পশ্চিমা চলচ্চিত্রজগতে আজ এক প্রতিষ্ঠিত ধারায় পরিণত হয়েছে। 

প্রথম ধারাটি সম্পর্কে বলা যায় যে, এটা একটা সামাজিক সত্য যে সাধারণভাবে   যুদ্ধোত্তর কালে প্রচন্ড সামাজিক অস্থিরতার ফলে একটা সমাজে যৌনতার ঝোঁক বাড়ে যায়। যথেচ্ছ যৌনাচারের কামনা অনেক সময়ই মানবমনের এক গভীর হতাশাবোধেরই পরিচায়ক। বেশ্যাবৃত্তি ও বিবাহবহির্ভূত যৌনজীবনের বর্ণনা সম্বলিত বিশের দশকের এসব জার্মান ছবির সেটা হয়তো অন্যতম কারণ। এসব ছবির ধরণগুলি অনেক ক্ষেত্রে তাদের নামেই বোঝা যায়- “ভো অব চ্যাস্টিটি”, “হায়েনাস অব লাস্ট”, “লস্ট ডটারস”, “উইমেন এনগাল্ফড বাই দি অ্যাবিস” ইত্যাদি।

সামাজিক পরিবেশ যত আতংকজনক হয়, শিল্প ততই বিমূর্ত হয়ে ওঠে, কথাটা স্যমুয়েল বেকেটের। এই কথার সত্যতাই যেন ফুটে ওঠে জার্মানীর সে সময়কার আতঙ্কময় সামাজিক পরিবেশের কারণে চলচ্চিত্র শিল্পের ক্রমশই বিবরমুখী ও আত্মমুখী হয়ে ওঠার প্রবণতায়। জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্মের জন্ম ও বিকাশটাকে এই বিশেষ প্রেক্ষিতেই দেখতে হবে।

অবশ্য চিত্রকলা ও নাটকে এক্সপ্রেশনিস্ট ধারা জার্মানীতে সিনেমার চেয়ে আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। বুর্জোয়া বাস্তবতাকে ভেঙ্গে মনোজগতের আয়নায় বাস্তবতাকে দেখার প্রবণতা— সুররিয়ালিজম, দাদাইজম ও কিউবিজম, ততদিনে ইউরোপে ব্যাপকভাবে বিকাশমান। তবে জার্মানীতে আমরা এক্সপ্রেশনিস্ট ধারাটাই বেশি লক্ষ্য করি। ১৯০৫ সালে ড্রেসডেনের Die Bruck ও ১৯১১-১৯১২ সালে মিউনিকের Der Blaue Reiter – কে কেন্দ্র করে চিত্রকলায় গড়ে ওঠা এক্সপ্রেশনিস্ট আন্দোলন ততদিনে জমে উঠেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এমিল নল্ড, এডওয়ার্ড মুঙ্ক, ভ্যাসিলি ক্যান্ডিনস্কি, পলা মডার্সন-বেকার ও কিছুটা ভ্যান গগ, এক্সপ্রেশনিস্ট ধারায় সমানে ছবি এঁকে চলেছেন। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এইসব শিল্পী প্রায় সবাই আউটসাইডার। আত্মনির্বাসনের শিল্পী তাঁরা, তাঁদের তাত্ত্বিক গুরু— কিয়ের্কেগার্দ, স্ট্রিন্ডবার্গ ও নীৎসে। নাটকের ক্ষেত্রেও দেখি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বার্লিনে এক্সপ্রেশনিস্ট সেটে তখন মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে টলার বা হাসেনক্লোভারের এক্সপ্রেশনিস্ট আঙ্গিকের সব নাটক।

“দি কেবিনেট অব ড: ক্যালিগরী” (১৯২০) চলচ্চিত্রটি হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্মের একটি যথার্থ উদাহরণ, বর্তমানে যে ক্যালিগরী নামটিই এ ধরণের ছবির একটি আর্কিটাইপে পরিণত হয়েছে। ফলে এ ছবিটা দিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক। দুই ভাগ্যান্বেষী, একজন চেক কবি হানস ইয়ানোকিৎস ও আরেকজন জীবনে অনেক-পোড়খাওয়া কার্ল মেয়ার ছবিটির আদি চিত্রনাট্যটি রচনা করেছিলেন। কাহিনী হচ্ছে ক্যালিগরী নামে একজন ডাক্তার সম্মোহনী শক্তির মাধ্যমে সিজার নামক এক যুবকের দ্বারা অন্যদের হত্যা করায়। চিত্রনাট্যকার বলেন যে, ক্যালিগরী নামটি তাঁরা পেয়েছিলেন ¯ঁÍাদালের অপ্রকাশিত একটি চিঠি থেকে। হয়তো শেক্সপীয়ারের ক্যালিবান নামটিও তাঁদের অবচেতনে ছিল ! ছবিটি প্রথমে পরিচালনা করার কথা ছিল ফ্রিজ ল্যাঙ্গের। কিন্তু ল্যাঙ্গ তখন “দি স্পাইডার” নামে আরেকটি ছবি বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকায় দায়িত্ব পড়ে রবার্ট ওয়াইনের ওপর। প্রতিভাবান পরিচলক ফ্রিজ ল্যাঙ্গ এ ছবি বানালে কেমন ভাবে বানাতেন সে প্রশ্ন আজ নিরর্থক। তবে ওয়াইনের ওপর এ ছবির দায়িত্ব পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে, ওয়াইনের নিজের পিতাও ছিলেন কিছুুটা উন্মাদ। ফলে তাঁর পক্ষে সমস্যাটা উপলব্ধি করা সহজতর ছিল!

আদি চিত্রনাট্যে ছিল যে, এক উন্মাদ আশ্রমের পরিচালক ডঃ ক্যালিগরী তার সম্মোহনী শক্তির দ্বারা সিজার নামে এক যুবককে দিয়ে একটির পর একটি হত্যাকান্ড ঘটিয়ে চলেছে। সিজার একজন নিশিতে-পাওয়া-মানুষ (somnambulist) যে ঘুমের মধ্যে হাঁটত। পাঠক স্মরণ করুন, লেডী ম্যাকবেথও একজন সোমনামবুলিস্ট ছিলেন। যা হোক, ফ্রান্সিস নামের এক যুবকের বন্ধুকে হত্যা করায় ফ্রান্সিস হত্যাকারী সিজারকে তথা নেপথ্যের মূল চালিকাশক্তি ডঃ ক্যালিগরীকে খুঁজে ফেরে। পুলিশ নিয়ে এসে দেখতে পায় যে সিজারের জায়গায় একটা মূর্তি বানানো রয়েছে। সিজার যখন হত্যা-মিশনে যেত তখন পুলিশ ও অন্যান্যদের ফাঁকি দেয়ার জন্যে ডঃ ক্যালিগরী এই মূর্তির কৌশলটা রেখেছিল। এদিকে ম্যাগি নামের একটি মেয়েকে অপহরণ করার সময় সিজার শারীরিক অবসন্নতায় মৃত্যু বরণ করে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে অবশেষে ফ্রান্সিস নেপথ্যের আসল নায়ক ক্যালিগরীর সন্ধান পায়। ক্যালিগরী দৌড়ে উন্মাদ আশ্রমে আশ্রয় নেয়। ফ্রান্সিস তার পিছনে খুঁজতে খুঁজতে যেয়ে অবাক বিস্ময় ও আতঙ্কের সঙ্গে আবিষ্কার করে যে, উন্মাদ আশ্রমের পরিচালকই স্বয়ং ডঃ ক্যালিগরী !

কর্তৃপক্ষের ভেতরেই যে অশুভ রয়ে গেছে মূল চিত্রনাট্যটিতে তা তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু ওয়াইন ও ছবির প্রযোজক কাহিনীটার শেষাংশে পরিবর্তন ঘটালেন। তাঁরা দেখালেন যে গোটা ঘটনাটই ফ্রান্সিস নামের উম্মাদ আশ্রমের একজন রোগীর কল্পনাসৃষ্ট এবং ডঃ ক্যালিগরী একজন খুবই নিষ্ঠাবান ডাক্তার! এভাবেই ওয়াইন প্রধান কর্তৃপক্ষকে দেখালেন সুস্থ ও স্বাভাবিক, বরং কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচারণকারীদেরই দেখালেন উন্মাদ হিসাবে। ফলে ছবিটির গোটা চিত্রনাট্যটাই পাল্টে গেল!

শেষ দৃশ্যে দৃষ্টিভঙ্গিটা এরকম উল্টিয়ে দিলেও এ ছবিতে মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ, হত্যা ও অন্য ব্যক্তির উপর সম্মোহন শক্তির অশুভ প্রভাব এবং এই ইঙ্গিত যে, উন্মাদদের পরিচর্যার দায়িত্বে যে নিয়োজিত সে নিজেও আরেক উম্মাদ, চারপাশে অশুভের এই অনিবার্যতার একটা সামাজিক তাৎপর্য ছিল বৈকি, বিশেষ করে সেই সময়ের জার্মানীতে, যখন আর কিছুদিন পরেই ক্ষমতায় আসছে হিটলার !

কৌতূহলের ব্যাপার যে, ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বার্লিনে “দি কেবিনেট অব ডাঃ ক্যালিগরী” ছবিটি মুক্তি পাবার পর দক্ষিণপন্থী পত্র-পত্রিকায় ছবিটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলা হো’ল যে, এটা সিনেমার পর্দায় সৃষ্ট প্রথম শিল্পকর্ম। এমন কী সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের পত্রিকা “ভরওয়ার্ডস”-য়েও ছবিটার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হোল। এক সার্বিক আত্মিক বিপর্যয়ে ভুগতে-থাকা যুদ্ধোত্তর জার্মানীর মানুষ এ ছবির সামাজিক ও রাজনৈতকি তাৎপর্য হয়তো ততটা বুঝে উঠতে পারেনি, কিন্তু ফরাসীরা ক্যালিগরীকে ঠিকই চিনেছিল। ফরাসীরা একটা শব্দই সৃষ্টি করে ফেলল “Caligarisme” বা “ক্যালিগরীবাদ”। যুদ্ধোত্তর ইউরোপের যা কিছুই উল্টো রকম, তা’ বোঝাতে।

চিত্রনাট্যকার ইয়ানেকিৎস চেয়েছিলেন সুররিয়ালিস্ট চিত্রশিল্পী আলফ্রেড কুবিনকে দিয়ে ছবিটার সেট ডিজাইন করাতে, কিন্তু প্রযোজক পমার ও ওঁর সহযোগীরা চাইলেন বার্লিন স্টর্ম গ্রুপের এক্সপ্রেশনিস্ট আঙ্গিকের ডিজাইনার হারমান ওয়ার্ম, ওয়াল্টার রোহরিগ ও ওয়াল্টার রাইম্যানকে দিয়ে সেটটা করতে। বার্লিন স্টর্ম গ্রুপ তখন হারভার্ট ভাল্লেনের পত্রিকা “স্টর্ম”-য়ের মাধ্যমে শিল্পের সব শাখাতেই এক্সপ্রেশনিজমের প্রচার করছে। এঁরা বিশ্বাস করতেন যে চলচ্চিত্র হচ্ছে আঁকা ছবিকে জীবন্তরূপ দেয়া মাত্র- “films must be drawings brought to life”। ফলে ক্যালিগরী ছবির গোটা সেটটাই হো’ল পুরোদস্তুর এক্সপেশনিস্ট আঙ্গিকের। সেটের ব্যাপারে ছবিটার একটা দুর্বলতা বোধ হয় এই যে, যখন ঘটনা কোনো সম্মোহনী পর্যায়ে নয়, পরিপূর্ণ মানসিক সুস্থতায় ঘটছে, তখনও সেটটা কিন্তু এক্সপ্রেশনিস্টই রয়ে যাচ্ছে !

ছবিটার আরেক দুর্বলতা এর পুরোপুরি মঞ্চনির্ভরতা। দৃশ্যগুলো খুব সামান্যই সিনেমাটিক। আলোর কাজ উল্লেখযোগ্য হলেও ক্যামেরা প্রায় অনড়। আর কোনো উল্লেখযোগ্য কাটিং-ই নেই তেমন।

“ক্যালিগরী”-র পর দস্তয়েভস্কির “ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট”গল্পটি নিয়ে ওয়াইন “রাসোকলনিকভ” (১৯২৩) নামে আরেকটি যে ছবি নির্মাণ করেন, সেটাও পুরোপুরি এক্সপ্রেশনিস্ট ভঙ্গিমায়। অবশ্য এ ছবিটি তেমন সাফল্যের মুখে দেখেনি।

১৯২২ সালে এফ ডব্লিউ মুরনাউ ব্রাম স্টোকারের বহুল পরিচিত “ড্রাকুলা” উপন্যাস অবলম্বনে বানালেন- “নসফেরাটু”। এই মৃত্যুদূত ভ্যাম্পয়ারটি কার্পেথীয় পাহাড়ের নির্জন দুর্গে থাকে, যেখানেই যায় সঙ্গে নিয়ে আসে মহামারী ও মৃত্যু। পরিশেষে এক নারীর পবিত্র ভালোবাসার কাছে এই অশুভ ভ্যাম্পায়ার চরিত্রটি পরাস্ত হয় ও বাতাসে মিলিয়ে যায়। দ্রুতগতিতে ইমেজ প্রক্ষেপণ, নেগেটিভ ফিল্মের ব্যবহার, এসবের মাধ্যমে মুরনাউ খুব সাফল্যের সঙ্গেই এক ভীতিপ্রদ জগত তৈরি করতে পেরেছেন। “নসফেরাটু” গল্পের উৎস লোকজ এক প্রাচীন বিশ্বাস। “ড্রাকুলা” বা “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন”-য়ের গল্পের মতো এই ভুতুড়ে গল্পটিও মূলত একমাত্রিক এবং ঠিক এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার অন্যান্য ছবির মত মনোবিশ্লেষণী নয়। তবে ছবিটির ভীতিপ্রদ দৃশ্যগুলিতে এক্সপ্রেশনিস্ট প্রভাব মোটেই দুর্নিরীক্ষ্য নয়। 

“নসফেরাটু’র পরে মুরনাউ “ফ্যান্টম” (১৯২২) নামে আরেকটি এ জাতীয় ছবি নির্মাণ করেন। এর পরে মুরনাউ এক্সপ্রেশনিজমের ধারা ছেড়ে অন্য ধারায় ছবি তৈরী শুরু করেন। পল ভেগেনারের পরিচালনায় নির্মিত “দি স্টুডেন্ট অব প্রাগ” (১৯২৫) পুননির্মিত ছবি। প্রথমবার নির্মিত হয় ১৯১৩ সালে। আমরা দেখি যে বেশ কিছু এক্সপ্রেশনিস্ট ছবি, যা যুদ্ধের সময় বা আগে নির্মিত হয়েছিল, তা’ বিশের দশকে আবার পুননির্মিত হচ্ছে, যেমন- “দি গোলেম।” “দি স্টুডেন্ট অব প্রাগ” ছবিটার চিত্রনাট্য লেখেন হান্স হাইন্স এভারস যিনি পরে নাৎসী ছবি “জোস্ট ভোসেল”-য়েরও চিত্রনাট্য লেখেন। ছবিটির কাহিনী হচ্ছে, এক গরিব ছাত্র বল্ডউইন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের কাছে নিজের সত্ত্বাকে তুলে দিয়েছিল যেমন ফাউস্ট মেফিস্টোকে বিকিয়ে দিয়েছিল নিজের আত্মা। পরে সে নিজের প্রতিবিম্বিত সত্ত্বাকে, অর্থাৎ নিজেকেই হত্যা করে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। বল্ডউইনের এই split personality, এই দ্বৈত সত্ত্বা, যেন ছিল তৎকালীন জার্মান জাতির চেতনা-মানসেরই আস্তিত্বিক সঙ্কটের এক প্রতিফলন।

১৯২০ সালে পল ভেগেনার ও গালিন “দি গোলেম” ছবিটি পুন:নির্মাণ করলেন। মাটির তৈরি এক দানব এক সময় তার স্রষ্টার কর্তৃত্ব অস্বীকার করে স্বেচ্ছাচারী ধ্বংসে মেতে উঠে এবং পরিশেষে নিজে ধ্বংস হয়। ছবিটিতে জার্মান স্থাপত্যবিদ্ হান্স পোয়েলজিগ, যিনি রাইনহার্ডটের সঙ্গে মঞ্চে কাজ করেছেন, গথিক সেটের আদলে মধ্যযুগীয় এক ‘ঘেটো’ তৈরি করেন। ছবিটিতে সম্রাট কর্র্তৃক ইহুদীদের নির্বাসিত করার ইঙ্গিত রয়েছে। ইহুদীদের উপর নিপীড়ন, ঘেটো তৈরি, এসবই হয়ে উঠল জার্মানীর ভবিতব্যের ক্ষেত্রে প্রতীকী সব অশুভের ইঙ্গিতবাহী।

“গোলেম”-য়ের মতই আরেকটি ছবি “হোমেনকুলাস” (১৯১৬)। এ ছবিতে মানববিদ্বেষী এক রোবট একটার  পর একটা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে এবং হিটলারের মতই এক ডিক্টেটর সে, যে ছবিতে এক বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দেয়। “দি স্টুডেন্ট অব প্রাগ” বা “হোমেনকুলাস” যে রকম অন্ধকারাচ্ছন্ন এক ভবিষ্যৎ ও এক অশুভ নিয়তির ইঙ্গিতবাহী, তা তৎকালীন জার্মানীর সামাজিক জীবনের প্রেক্ষাপটে ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

পাভলভের মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে পুদোভকিন বানিয়েছিলেন “মেকানিক্স অব দি ব্রেন” (১৯২৬)। জি. ডব্লিউ পাবস্ট ওই একই বছর ফ্রয়েডের মনোস্তত্ত্ব নিয়ে বানালেন “সিক্রেট্স অব এ সোল”। কাহিনী হচ্ছে এক ব্যক্তি ছুরি দিয়ে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করার ম্যানিয়ায় ভোগে। নেপথ্য কারণ হচ্ছে স্ত্রীর এক কল্পিত প্রেমিকের প্রতি তার ঈর্ষা ও নিজের যৌন-অক্ষমতা। শেষ দৃশ্যে অবশ্য সে সন্তান লাভ করে এবং তার ম্যানিয়াও দূর হয়। ছবিটিতে ফ্রয়েডের দু’জন সহকারী ডঃ হানস সাকস ও ডাঃ কার্ল আব্রাহাম কাজ করেন, তবে ছবিটি ফ্রয়েডপন্থীদের তেমন প্রীত করতে পারেনি।

আরেকটি এক্সপ্রেশনিস্ট ছবি ‘দি ব্যাকস্টেয়ারস’-য়ের (১৯২১) কাহিনী বেশ সরল। এক গৃহপরিচারিকা মেয়ে তার প্রেমিকের চিঠির প্রতীক্ষায় থাকে। পরে এক প্রেমার্থী পোস্টম্যানের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়। এমন সময় পুরোনো প্রেমিক এসে উপস্থিত। ঈর্ষাকাতর পোস্টম্যান তাকে হত্যা করে। মেয়েটি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। ছবিটির চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন কার্ল মেয়ার। অন্যান্য এক্সপ্রেশনিস্ট ছবির মত এ ছবিটি তেমন জনপ্রিয় হয়নি। বরং এত অর্থহীন ভায়োলেন্স ও দুঃখকষ্ট দেখে দর্শকেরা বিরক্তই হয়েছিলেন।

“ডাঃ মাবুজে” নিয়ে দু’টি ছবি তৈরি হয় “ডঃ মাবুজে দি গ্যাম্বলার”(১৯২২) ও “দি লাস্ট টেস্টামেন্ট অব ডঃ মাবুজে”(১৯৩৩)। প্রথমটার কাহিনী হচ্ছে ধূর্ত ডঃ মাবুজে তার সম্মোহনী শক্তির মাধ্যমে নানা রকম ষড়যন্ত্র, হত্যা ও অন্যান্য কুকীর্তি করার পর উন্মাদ হয়ে পাগলা গারদে আশ্রয় নেয়। দ্বিতীয় ছবিটাতে আমরা দেখি উন্মাদ আশ্রমে বসেই ডঃ মাবুজে ডঃ বাউম নামের এক ডাক্তারের উপর তার সম্মোহনী শক্তি খাটিয়ে নানা অশুভ ঘটনা ঘটিয়ে চলে। এক অজানা জায়গা থেকে বাইরের অগণিত মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে এক উন্মাদ— অনেকেই হিটলারের সঙ্গে মাবুজের সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছেন। ফলে এটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে গোয়েবল্স ছবির পরিচালক ফ্রিজ ল্যাঙ্গের অপর ছবি “মেট্রোপলিস”(১৯২৭)  খুব পছন্দ করলেও “ডঃ মাবুজে”-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফ্রান্সে গোপনে একটা প্রিন্ট পাঠিয়ে অবশেষে ছবিটির সম্পাদনার কাজ শেষ করতে হয়।

প্রায় একই সময়ে ‘ভানিনা’ (১৯২২) নামে স্তাঁদালের গল্পের ভিত্তিতে আরেকটি এক্সপ্রেশনিস্ট চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন আর্থার ভন গার্লাক। এ ছবিটিরও চিত্রনাট্য রচনা করেন কার্ল মেয়ার।

১৯২৪ সালে পল লেনি নির্মাণ করেন “ওয়াক্সওয়ার্কস”। তিনটি মোমের মূর্তির মাধ্যমে তুলে ধরা হোল তিন অশুভ স্বৈরতন্ত্রকে— হারুণ-অর রশীদ, আইভান দ্য টেরিবল ও জ্যাক-দি-রিপার। এর মধ্যে আইভান দ্য টেরিবল তার শিকারদের নিয়ে যে নৃশংসতায় মাতে তা’ মার্কুইস দ্য সাদ কিম্বা নাৎসী কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের রক্ষীদের কাজকেই যেন স্মরণ করায় !

প্রাচীন জার্মানীর এক ইতিহাসভিত্তিক গৌরবগাঁথা নিয়ে ফ্রিজ ল্যাঙ্গ ১৯২৪ সালে বানালেন “নিবেলুঙ্গেন সাগা”। গোয়েবলস এ ছবিটাকে খুবই পছন্দ করেছিলেন এবং ছবিটাকে নাৎসী ছবির আদর্শ বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। এটা স্বাভাবিকই ছিল যে আধাসত্য আধাকল্পিত স্বজাতির ইতিহাসের বীরপূজাভিত্তিক যে কোনো গৌরবগাঁথা নাৎসীরা খুবই পছন্দ করবে।

১৯২৪-২৫ সালের দিক থেকে এক্সপ্রেশনিস্ট ধারায় ছবি নির্মাণ ক্রমশঃ কমে আসতে থাকে। এককালীন এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার অন্যতম প্রধান পরিচালক পাবস্ট ১৯২৫ সালে “জয়লেস স্ট্রীট” নামে যে ছবিটি বানালেন, সে ছবিতে যুদ্ধোত্তর সময়ের হতাশা, দারিদ্র্য ও ভিয়েনার মধ্যবিত্ত জীবনের আর্থিক সঙ্কটটা ফুটে উঠেছিল বেশ চমৎকারভাবে। তবে ছবিটিতে কিছু কিছু এক্সপ্রেশনিস্ট লক্ষণ থাকলেও, মূলত সামাজিক বাস্তববাদের দিকেই ঝোঁকটা ছিল যেন বেশী। এক্সপ্রেশনিস্ট চলচ্চিত্র, জার্মানীতে অন্তত, ১৯২৫- য়ের পর থেকে আমরা ক্রমশঃ পরিত্যক্ত হতে দেখি।          

এই বিভিন্ন এক্সপ্রেশনিস্ট ছবিগুলির মধ্যে আমরা কিছু সাধারণ চারিত্র্যলক্ষণ দেখতে পাই। প্রায় সবগুলি ছবিতেই হত্যা, জিঘাংসা, জুগুপ্সা, উন্মাদ আশ্রম ও এক দানবীয় শক্তির অশুভ উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। বিষয়বস্তুর দিক থেকে ফ্রয়েডের প্রভাব সর্বব্যাপী, এবং আঙ্গিকের ক্ষেত্রে হয়তো নাট্যপরিচালক রাইনহার্ডের। এক্সপ্রেশনিস্ট নাটকের প্রভাবেই, ক্যালিগরীসহ প্রায় সব ছবিতেই ক্যামেরার বাঁকা অ্যাঙ্গেল, সর্পিল সিঁড়ি, অভিনেতাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও প্রসাধন, চেয়ার-টেবিল-জিনিসপত্র, চলচ্চিত্রের ভাষায় যাকে বলা হয়, ‘প্রপস’ (props), মায় দেয়ালচিত্রগুলো পর্যন্ত, এক্সপ্রেশনিস্ট আঙ্গিকে তৈরি।

জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট ছবিগুলি অধিকাংশই, এবং “ক্যালিগরী” প্রায় শতকরা একশত ভাগই, স্টুডিওনির্ভর ছবি। রুশ, ফরাসী ও বৃটিশ চলচ্চিত্রকাররা যখন ক্যামেরাকে বাইরে এনে প্রকৃতির বিশালতা ও বৈচিত্র্যের মাঝে শুটিং করছেন, জার্মান চলচ্চিত্রকাররা তখন ক্রমশই স্টুডিওর ভেতরে আরো অন্তর্মুখী ও বিবরগামী হচ্ছেন। একটা কারণ হয়তো বাইরের জগৎ তখন বড় বিশৃঙ্খলাময়। বড়ই অপ্রিয়। জার্মান চলচ্চিত্রের এই যে আঙ্গিক-সঙ্কট, তা’ জার্মান মধ্যবিত্তেরই আত্মিক-সঙ্কট। এই আত্মবিবরতা হচ্ছে দরিদ্র হয়ে পড়ার ভয়। এই পলায়নীবৃত্তি, বামপন্থীদের প্রভাব এড়িয়ে বাঁচার হতাশ পেটিবুর্জোয়ার এক পলায়নীবৃত্তি, যা মানুষকে কেবল বিবরমুখীই করে।

ইনডোর সেটে ফ্যান্টাসীধর্মী ছবি এক্সপ্রেশনিস্টদের কোনো মৌলিক আবিষ্কার নয়। মেলিয়েঁ ট্রাডিশনের এ বেশ পুরোনো এক ধারাই। কিন্তু ফরাসী মেলিয়েঁর কাছে যা ছিল এক হাল্কা কৌতুকময় ফ্যান্টাসী, ভেগেনারদের হাতে পড়ে সে ফ্যান্টসীই নিয়ে ফেলল এক দানবীয় করাল রূপ।

ফ্রয়েডের প্রভাবের কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। জার্মানীর তৎকালীন সামাজিক বিপর্যয়ের ফলে অবচেতন মনের অনুভূতি ও দুঃস্বপ্নই বড় হয়ে দেখা দিতে থাকল এসব এক্সপ্রেশনিস্ট ছবিগুলিতে। আমরা দেখি মনোজগতের এই অসুস্থ অবস্থায় ভালহাল্লার দেবতা আইকেনভর্ফ, অশরীরী ভুত, লোকজ প্রেত-বিশ্বাস আর ফ্রয়েডের সাইকোঅ্যানালিসিস সব জগাখিচূড়ী একাকার হয়ে এইসব চলচ্চিত্রকারদের অবচেতনায় কাজ করছে। আতঙ্কময় এক বিশেষ যুগের এক বিশেষ দেশের নন্দনতত্ত্ব তা। তবে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে এক্সপ্রেশনিস্ট ছবির আবার কিছু অবদানও রয়েছে। একটা হচ্ছে আলোর বহু-বৈচিত্র্যময় ব্যবহার। জার্মান মঞ্চে অবশ্য ইতোমধ্যেই রাইনহার্ড আলোক-প্রক্ষেপণের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক ও অতি উচ্চ মানের কারিগরি রূপ সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন। এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্ম আলোর এই বৈচিত্র্যময় ও উন্নত প্রযুক্তিকে চলচ্চিত্রেও নিয়ে এল। স্টুডিওর ভেতরে আলোর এই ভাল মানের কাজে দু’জন প্রতিভাবান ক্যামেরাম্যানের নাম বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। একজন হচ্ছেন “নসফেরাটু”, “দি লাভ অব জেন নে”, “দি স্কাই”, এসব ছবির চিত্রগ্রাহক ফ্রিৎজ আর্নো ভাগনার ও অন্য জন হচ্ছেন “দি গোলেম” “মেট্রোপলিস”, “দি লাস্ট লাফ”, “ফাউস্ট” এসব ছবির ক্যামেরাম্যান—কার্ল ফ্রয়েড।

তবে আলোর ব্যবহার ছাড়াও ক্যামেরা মুভমেন্ট, বিশেষ করে ট্রাকিং শট্ ও ডিজল্ভ, ফ্লাশব্যাক, স্লো-মাশন তথা ক্যামেরাকে গতিশীল করার ক্ষেত্রেও জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্ম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

আর বিষয়বস্তুর দিক থেকে পরবর্তীকালের দুই ধরণের চলচ্চিত্র— ভয়-আতঙ্কের হরর ফিল্মস ও পর্নো ফিল্মের ক্ষেত্রে এই জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট সিনেমার কিছু প্রভাব ছিল। ছিল পরবর্তীকালে হলিউডের বিষাদময় নৈরাশ্যের চলচ্চিত্রধারাটি ফিল্ম নোয়া (Film Noir) সৃষ্টির ক্ষেত্রেও।

যদিও ১৯২৬ সালে তৈরি “ফাউস্ট” ছবিতেও এক্সপ্রেশনিজমের কিছু কিছু লক্ষণ দুর্নিরীক্ষ্য নয় তবুও মধ্য-বিশের দশক থেকেই আমরা দেখি এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার ছবির ক্রমশ: অবসান ঘটছে। চলচ্চিত্রে এক্সপ্রেশনিজমের অবসানের এক কারণ এ সময়ে ফ্রান্সে রেনে ক্লেয়ার, লুই বুনুয়েল ও জ্যাঁ রেনোঁয়া যে “আভা গার্দ” আন্দোলন শুরু করলেন, পশ্চিম ইউরোপীয় চলচ্চিত্রকারদের সেই দিকে ঝোঁক ও এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব। আর মূল কারণ হচ্ছে এ সময় জার্মানী ‘Dawes Plan’ গ্রহণ করে। ফলে অর্থনীতিতেও কিছুটা স্থিতি এল। অস্থিত মার্ক স্থিত হো’ল। মানুষের মুল্যবোধেও ঘটল ইতিবাচক সব পরিবর্তন। এই চাঙ্গা অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদ চলতে থাকল ১৯২৯ সাল পর্যন্ত যখন না আবার ওয়াল স্ট্রিটের মহামন্দার প্রেক্ষিতে জার্মান অর্থনীতি ও মূল্যবোধে ধ্বস নামল। জার্মানীতে গেড়ে বসল নাৎসীবাদ ও হিটলার।

এটা ঠিক যে ডাঃ মাবুজের সকল অশুভ জারিজুরী ফাঁস হয়ে যায়, সূর্যের আলো পেয়ে নসফেরাটু মিলিয়ে যায় বাতাসে। কিন্তু যে অশুভের ছাপ তারা রেখে যায়, তা’ জার্মান মানসসত্তায় দীর্ঘদিনই রয়ে যায়। শিল্পের এটা এক দ্বান্দ্বিকতা যে শিল্প যেমন সমাজের সৃষ্টি, তেমনি শিল্প সমাজকেও প্রভাবিত করে। গোয়েবল্স কিছু এক্সপ্রেশনিস্ট ছবিকে নিষিদ্ধ করলেও এক্সপ্রেশনিস্ট ছবিগুলিকেই নাৎসীরা মূলত তাদের ছবির মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে, ব্যক্তিজীবনে এসব অনেক চলচ্চিত্রকারই, যেমন ফ্রিজ ল্যাঙ্গ বা মুরনাউ, ছিলেন ঘোরতর নাৎসীবিদ্বেষী। কিন্তু শিল্পের এও এক দ্বান্দ্বিকতা যে, শিল্পীর সৃষ্ট শিল্প শিল্পীকে অতিক্রম করে যায়। শিল্পীর অনবধানতা বা অনিচ্ছাকৃত ভ্রান্তিই সত্য হয়ে ওঠে, তার ইচ্ছেটা নয়। আর কেউ কেউ তো নাৎসীদের সঙ্গে যোগই দিয়ে বসেন, যেমন— পাবস্ট।  “থ্রি পেনি অপেরা” (১৯৩০) বা “ক্যামেরাডশাফ্ট”(১৯৩০)-য়ের মত প্রগতিশীল ছবির পরিচালক পাবস্ট নাৎসী অভ্যূত্থানের পর জার্মানী ছেড়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নিলেও ১৯৩৯ সালে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে হিটলারের ক্ষমা লাভ করে দেশে ফিরে আসেন এবং নাৎসীদের পক্ষে ছবি বানানো শুরু করেন।

আর বিশের দশকের জার্মানীর প্রেক্ষিতে, যখন হিটলারের ক্ষমতায় আসা আসন্ন, তখন মাবুজের মত এক স্বেচ্ছাচারী ও পীড়নকারী, কিম্বা ক্যালিগরীর মত সম্মোহন শক্তিধারী একজন মনোবিকারগ্রস্ত নেতা, যে মানুষকে অশুভ লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রণ করে, এসব ধ্যান-ধারণা ফ্যাসীবাদকে ইন্ধন জুগিয়েছে বৈকি। আর তাই এটা আশ্চর্যের নয় যখন দেখি যে, এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার চলচ্চিত্রগুলিতে মানুষের উপর মানুষের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের যেসব কৌশল দেখানো হয়েছে, তার অনেক কিছুই, মাত্র এক যুগের ব্যবধানে, নাৎসীরা সত্যি সত্যিই নিরীহ মানুষদের উপর প্রয়োগ করেছে।

তবে আমরা “ফ্রম ক্যালিগরী টু হিটলার” বইটির লেখক সিগফ্রিড ক্রসারের মত এই সরলীকরণ টানা থেকে বিরত রইব যে, এক্সপ্রেশনিস্ট ছবিগুলিই জার্মানীতে নাৎসীবাদের উত্থানের কারণ। বরং আমরা বলব যে, এক্সপ্রেশনিস্ট চলচ্চিত্র ও নাৎসীবাদ একই উৎসের দুইটি প্রতিফলন। আর সে উৎস হচ্ছে যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত জার্মানীর হতাশাগ্রস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তবে যৎসামান্য হলেও নাৎসী-বিকাশে যে এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্ম কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল, এটিই এক্সপ্রেশনিস্ট ফিল্ম সম্পর্কে ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা। শিক্ষা এদিক থেকেও যে, নাৎসীবাদের মতই মার্কিন সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সের টিঁকিতে বাঁধা হলিউড আজকে যে বিশাল আয়োজনে একটার পর একটা ভয়াবহ সব ভায়োলেন্সে ভরপুর আর বীভৎস হরর ছবি নির্মাণে মেতে উঠেছে, তা’ ইতিহাসের কোন্ অশুভ শক্তির মনোজগতকে পুষ্ট করছে, সে সম্পর্কেও সচেতন হওয়া।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>