| 20 এপ্রিল 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

আচিক মান্দির সঙরাম

আনুমানিক পঠনকাল: 14 মিনিট

এক

গোলকায়নের এই সময়ে কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। সময়ের দাপটে ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে পরিচিত দৃশ্যপট;চলমান সময় এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। দাঁড়াবার ফুসরত কই? জীবনগাড়ি গড়গড় করে যাচ্ছে। পেছন পানে তাকালেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঝাপসা হয়ে যাওয়া জীবনের পরিচিত অনুষঙ্গ।

আমরা চাই বা না চাই তের’শ নদীর বাংলাদেশে বোতলজাত পানীয় জলে আস্থা কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত।এই পাল্টে যাওয়া দৃশ্য আমরা মানতে বাধ্য। ধনতন্ত্রের বাজারে সবই পণ্য। পণ্যময় বিশ্ব। সেখানে তৃষ্ণার জল আর বাকি থাকবে কেন?

আমার উত্তর জনপদে পাঁচটি জনজাতির বাস।এই তল্লাটের ভুমিজ সন্তান। এখানকার ভুমির চাষযোগ্য পরিকাঠামো বিনির্মানে তাদের রয়েছে মাথার ঘাম পায়ে ফেলার দীর্ঘদিনের পরিশ্রম।

এই কথা মিথ্যে নয় যে আমার পড়শী গারো হাজং কোচ ডালু বানাইদের যাপন সম্পর্কে আমি কম জানি।হাতের মুঠোয় বিশ্ব নিয়ে বিশ্বায়ন বাজারের হাটুরে। এতো এতো দৃশ্য দৃশ্যান্তরে যাচ্ছে।অথচ পড়শীকে চিনি না। যতটুকু  জানি দূর থেকে দেখা — ভাসা ভাসা দেখা আর জানা।

একজন কোচ বা গারো দ্বি-ভাষিক। সে আচিক ও বাংলা ভাষার দুটোরই বাসিন্দা। আমি সংখ্যার জোরে এক ভাষিকতা নিয়ে জাত্যাভিমানে কাতর থেকে বলি বাংলা সংস্কৃতি হাজার বছরের সংস্কৃতি।।জাতিবাদী পরিচয়ে একুশ বুকে রেখেও অপরাপর ভাষা ও জাতিসত্তার প্রতি মনোভঙ্গি ভালো নয়।আধিপত্যবাদী।আবার ইংরেজির প্রতি ব্যাকুলতা ইংরেজি নিয়ে উঠতি মধ্যবিত্ত সুশীলদের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর আদ্যিখ্যাত থানা শহর পর্যন্ত গড়িয়েছে।।  ইংরেজী শিক্ষাকে মেনেছি আধুনিক শিক্ষার মোড়কে।

সে প্রান্তের প্রান্তিকে বেড়ে ওঠা হলেও দ্বি-ভাষিক জীব। নিজের ভাষা পরিবারেই শিখে নিয়েছি প্রাণের তাগিদে আর বাংলা ভাষা প্রয়োজনের প্রতাপে– লেনদেনের সুবাদে; প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে যাবার আগেই।সে দুটো দাকবেওয়ালেই  (সংস্কৃতি) সহজেই ঢুকে যাচ্ছে।আমি একটিতেই পড়ে আছি। আমি আচিক জানি না। কোচ ভাষা জানি না।

স্থানিকতার পরিসর দৈর্ঘ্যপ্রস্থে না বাড়িয়েই আমি বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা।গভীরতার কথা নাই বা বললাম।           ‘   ‘গোলকধামে কর্পোরেট নির্বাহীর সাথে বিহার করিতে করিতে দেখিতেছি’ পাল্টে যাচ্ছে সব কিছু। তা যাক।

বছর কয়েক আগে জাসেং ঘাগ্রার বাড়িতে চাচ্ছি ( অতিথি)হয়ে  ওর বাড়িতে বেড়াতে গেছিলাম।চমৎকার নিকানো  উঠানে পাতাবাহার গাছের সমাহার। বাসায় ঢুকবার পথেই প্রাইমারি স্কুল—১৯৩২ সালে স্থাপিত। একপাশে পুরান ভবন। রাস্তার দুপাশে গারো পাড়া। অঘ্রানের ধান পেকে গেছে।  ফলন্ত গাছ  নুয়ে পড়েছে। কারো  ধান কাটা প্রায় শেষ। উঠানে সোনালি রঙের ধানপাহাড়। কী ভীষণ পাকা ধানের সোঁদাগন্ধ!

 লোকজন নেই বললেই চলে। এখানে ওখানে গারো শিশুদের সারল্য হাসি মাখা মুখ। কাজের প্রয়োজন সবাই দূরবাসি। দূরে যেতেই হয়। শিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে কাজেরও প্রসার ঘটেছে। তাই দূরগামী। উৎসবে কাছাকাছি আসা। একত্রিত হওয়া।

রাজনৈতিক ভাগাভাগির কারণে রেডক্লিপ সাহেব ভারতবর্ষের মানচিত্র কাটাকুটি করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে এই প্রান্তিক অঞ্চল বাংলাদেশের অন্তভুক্ত–জয়রামকুড়া।এক সময় আসাম রাজ্যের অধীন ছিল।জয়রাম কুড়া একটি বধিষ্ণু গারো পাড়া।যদিও গারোরা নিজেদের গারো নামে অভিহিত হতে পছন্দ করে না। আচিক মান্দির দিকেই মনের ঝোঁক। ‘ প্রবল পরাক্রান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ পড়শীদের দ্বারা চারপাশে পরিবেষ্টিত’,সুভাষ জেংচাম লিখেছেন, “যারা নাকি কথায় কথায় গারোদেরকে অবজ্ঞাসূচক নামোচ্চারণ করে থাকে এবং অনুকম্পা মিশ্রিত তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে থাকে।”

সুভাষের অভিযোগ সংখ্যায় বড়ো বাঙালির দিকে। একজন পড়শী হিসেবে যে অভিযোগ তিনি করেছেন তার দায় আমি এড়াতে পারি না। বাড়ির পাশে পড়শীর বসত যুগ যুগ ধরে— কতটুকু জেনেছি তাদের দাকবেওয়াল। নিজের নিক্তিতে যা কিছু খাটো মনে হয়েছে বা আমার মতো নয় তাকেই ফেলে দিয়েছি তাচ্ছিলের লম্বা লিস্টে।

দুই

খেতে বসেই টের পেলাম টেবিলভর্তি গারো খাবার আর বাঙলা খাবারের মেলবন্ধন।যে কোন জনজাতির মতো আচিক মান্দিরও  রয়েছে নিজস্ব দাকবেওয়াল মানে সংস্কৃতি।আচিক সমাজের আচার-আচরণ,রীতি-নীতি, আহার- পানীয়, শিল্প- সাহিত্য,খেলাধুলা সহ যাপনের নানা অনুষঙ্গ –কী লৌকিক কী অলৌকিক–এই দাকবেওয়ালে অন্তর্ভুক্ত থাকে।

কোন কিছুই স্থীর দাঁড়িয়ে নেই। আচিক মান্দির খাদ্যাভ্যাসও স্থীর দাঁড়িয়ে নেই। গারো সমাজ সদস্য সংখ্যা কম হতে পারে তাই বলে সে স্থাণু নয়।দেশভাগের অস্থিরতায় দলে দলে দেশ ত্যাগ করেছে  আবার ১৯৬৪ সালের ২ ফেব্রুআরিতে দলে দলে বরুয়াজানি গ্রাম সহ আশে পাশের গ্রাম থেকে আসা গারোরা সিমান্তের ওপারে চলে যান।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমান তালুকদার সেদিনের মর্মন্তুদ বিবরণ,” খুবই মর্মান্তিক।স্বচক্ষে না দেখলে ভাষা দিয়ে বুঝানো যাবে না….হতভাগ্য মানুষের সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসার কারণে দলে দলে দেশত্যাগ। বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে শুন্য হাতে।পেছনে বারবার তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠছে।…. যাওয়ার সময় কী যেন উচ্চকণ্ঠে ধ্বনি দিতে দিতে দর্শা নদী পার হয়ে বৈথেল মিশনের দিকে চলে গেল ”  লিখেছেন।

 সে যাই হোক–ইতিহাস পাঠ অন্য সময় করা যাবে—সংখ্যার মাপে লঘু গারো স্থাণু নয়–প্রাণবাণ সত্তা। তাকেও সময়ের স্রোতে পড়শীর সাথে চলতে ফিরতে হয়– পড়শীর সংস্কৃতির প্রভাব ও  প্রতাপ কম বেশি মান্দির জীরনে পড়েছে যাপনে পড়েছে উদযাপনেও পড়েছে। খাদ্য তার ব্যতিক্রম নয়।

সেই প্রভাবের রূপই থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে খাবার টেবিলে  আচিক মান্দির খাবারের পাশে বাঙালি খাবার।ডাইনিং টেবিলে দুই ধনের খাবারের ফিউশন। দুই ভিন্ন সংস্কৃতির ম্যেনু কার্ড পাশাপাশি। আচিক মান্দির সঙরাম( রান্নাঘর) এখন দুই খাদ্য শৃঙ্খলার সংযোগ সড়ক।তার চুদাপে(উনোনে)জ্বাল হচ্ছে দুই খাদ্যাভাসের মিথস্ক্রিয়া।

মান্দির সঙরামে অনেক আগেই বাঙালি খাদ্য ঢুকলেও  নিজস্ব ঐতিহ্যের খাদ্য ও খাদ্য তৈরির প্রণালী  গারো পরিবারে— হোক সে সাংসারেক গারো বা খ্রিষ্ট্রীয় বিশ্বাসে আস্তাশীল গারো—এখনো প্রবল উপস্থিতি।

একবার হাড়িয়াকোনায় প্রাঞ্জল সাংমার উঁচু টিলার বাড়িতে টাউন শেরপুরের কবিদের নিমন্ত্রণ ছিল।প্রাঞ্জল নিজেও কবি। সেবার বরাং মানে উঁচু মাচাং  ঘরে খেতে খেতে উঠে এলো একথা সেকথা।

নিজস্ব উৎসবাদিতে গারো ঐতিহ্যের খাবারের আধিক্যই থাকে।সে সময় সঙরাম তাতারা রাবুগার সন্তানদের একান্ত নিজস্ব লেপে পোছা তিন ঝিকের উনোন (চুদাপ)।

কিন্তু প্রাত্যহিকতায় বাঙালি খাবার থাকে। তবে তৃষ্ণার চোখ গারো খাবারের দিকেই থাকে।পড়শীর নিমন্ত্রনে– হোক বিবাহ বা বাড়িতে–বাঙালী রসালো খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার অভ্যস্ততা তার হয়েছে বটে।

কথা প্রসঙ্গে প্রাঞ্জল বলছিল,” জীবন জীবিকার জন্য গারো যেখানেই থাকুক না কেন হয়ত ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য বাঙলা খাবার খাচ্ছে বা খেতে বাধ্য হচ্ছে কিন্তু খাবারের যে প্রশান্তি যে আনন্দ সে জন্মগত কারনে এখনো নিজস্ব খাদ্য ও পানীয় দিকে তার মনের টান থাকেই।”

যদিও গারোর রান্নাঘরে দৈনন্দিন জীবনে মাছ মাংস  ঢুকছে বাঙালির রন্ধন প্রণালিসহ। আচিক মান্দি আর বাঙালির রন্ধন প্রনালীর উপকরণ ও প্রক্রিয়া আলাদা শুধু নয়– বরং পরস্পরে বিপরীত বিন্দুতে অবস্থান।

ভোজনে রস রসালোর সরুয়া না হলে বাঙালির পাতের ভাত ঢিবি হয়েই থাকে।পাঁচ আঙুল আর গরম ভাতে খেলে না। রন্ধন শিল্প যেমনই হোক উপকরন যাই দিক— গারো খাবারে প্রাকৃতিক গুণাবলী যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে নজর মান্দি গিন্নীর থাকেই।

মান্দি দংরাম( ডাইনিং রুম) বৈচিত্রতার ভরপুর। আষাঢ় শ্রাবণের নয়া জলে বেড়ে ওঠা ছোট ছোট শামুক সংগ্রহ করে গরম জলে সিদ্ধ করে চোখ আর শামুকের পেছনের অংশ কেটে ফেলে চালের গুড়ার সাথে ক্ষার দিয়ে রান্না করা হয় চুচ্চুরু জাবা ( শামুক তরকারি)।চুচ্চুরু  কোথাও কোথাও সুপফ্রু বা সুফ্রু নামেও ব্যবহৃত হয়।

ওয়াক বেন( শুকরের মাংস) প্রাত্যহিক খারাব তালিকায় নিয়মিত না থাকলেও নানা উৎসবাদিতে ওয়াক বেন অনিবার্ষ।বন্য শুকর শিকার একার কম্ম নয়– যৌথতার ফসল। কাজে কাজেই ভুরিভোজনও সমবায় কৃতির কর্মতৎপরতা।

ওয়াক বেন রন্ধন প্রনালী নানা ধরনের। কোথাও চালের গুড়ো দিয়ে থকথক ঝুলে বড় বড়  মাংস পিণ্ড।চিনিগুড়া আতপ চালের হতে পারে কিংবা মিমিদ্দিম ( বিন্নি ভাত) –রান্নার বৈচিত্রের কারনে  স্বাদে গন্ধে আসে বৈচিত্র্য।

বাঁশের কোড়লের তরকারি ( মিআ জাবা) : কচি বাঁশ বা বাঁশের কোড়লের খোসা ছাড়িয়ে এর সাদা নরম অংশ কুচি কুচি করে কেটে গরম কড়াইয়ে খানিকটা লবণ দিয়ে নেড়ে চেড়ে ভাপে কিছুটা সেদ্ধ করা হয়। এর সাথে যুক্ত হতে পারে মুরগির মাংস। হতে পারে কষা বা ঝোলের তরকারি — ক্ষার ও চালেরগুড়া ছাড়া রান্নায় স্বাদ আসে না।

আরেকটি জনপ্রিয় খাবারের নাম হলো নাখাম বা শুটঁকি ঝুল তরকারি। এটি গারো পরিবারের নিত্য খাবার। বানানোর কসরত আলাদা। স্কাদ আলাদা।গন্ধ আলাদা।সংরক্ষণ প্রনালিও বৈচিত্রময়।

নাখাম খারি (শুঁটকি তরকারি)  জাগ দেওয়া শুঁটকি যা চ্যাপা বা জাগ্গুয়া শুঁটকি নামে পরিচিত। পুঁটি মাছের শুঁটকি যখন ঢেঁকিতে গুঁড়া করে বাঁশের ফাঁপা চোঙায় ভরে রাখা হয় তখন একে চুংগা নাখাম বা নাখাম সুওয়া বলা হয়। কড়াইয়ে বা পাতিলে পানি নিয়ে এতে চ্যাপা শুঁটকি বা নাখাম পেয়াঁজ কাঁচা মরিচ পরিমাণ মতো লবণ ও ক্ষার সহযোগে এই জনপ্রিয় খাবারটি রান্না করা হয়।

গারো রন্ধণ প্রনালী বৈচিত্রময়। ঠিক রান্না শেখার রই থেকে শেখা যায় না। এটি হাতে কলমে দেখিয়ে দেবার ও চর্চার ফসল। ঐতিহ্যিক জ্ঞান বংশ পরম্পরা জ্ঞান।আচিক মান্দির রান্না ঘরে টাকি পুঁটি  মোরগ বা গাগাক ফুরা বা চালের গুড়া মিশ্রিত  হাঁসের মাংস  অথবা কলা পাতায় মুড়িয়ে আগুনে সেকা সবজি তরকারি বা কাঁচা বাঁশের চোঙায় ঢুকিয়ে খুব যত্নে উতপ্ত গনগনে কয়লায় সেক দেবার কৌশলের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মান্দি খাবারের স্বাদ ও সাধ।

রান্না প্রক্রিয়ায়  ভাপা সেকা  ও সিদ্ধ মান্দি খাবারে যে গুণগুনা থাকে তা বাঙালির অধিক তেল হলুদ পেয়াঁজ রসুন ও  নানা কিসিমের মশলা দিয়ে রান্না করার ফলে জিবের স্বাদে হাত চেটেপুটে খেলেও পেটের স্বাস্থ্যেরে জন্য সুখকর নয়। আদীবাসীদের তুলনায় বাঙালিদের মধ্যে পেট ফাপা গ্যাস্ট্রিক আলসার ডায়াবেটিকস রোগের প্রার্দুভাব বেশ লক্ষনীয়। গারো সঙরামে খুব কম রান্নায় তেল হলুদ মশলা ব্যবহৃত হয়– আজকাল যতটুকু বেড়েছে পড়শীর রন্ধন প্রনালীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ডোমিনেশনের প্রভাবে।

নাইল্লা শাক আমি কোচ ও গারো পরিবারে একাধিকবার খেয়ে দেখেছি।গারো রান্নায় যতটুকু তিতকুটে ভাব থাকে যা শরীরের জন্য খুবই উপকারি সে তুলনায় বাঙলি পরিবারে নাইল্লা শাক পেঁয়াজ আর রসুনে ডুবে সবুজ নাইল্লার কালচে হয়ে ওঠে ।

সোডা বা ক্ষার গারো রন্ধন প্রনালীর অন্যতম উপদান। সঙরামে স্থায়ী জিনিষ। সোডা ছাড়া গারো নারীর চলে না। যে কোন কিছু ভালোভাবে সিদ্ধ করার জন্য এটি প্রয়োজন। একটা সময় প্রাকৃতিক উপায়েই এই ক্ষার জল তৈরি করে সিদ্ধর কাজে ব্যবহৃত হতো।

‘এখন বাজারে কেনা সোডা ব্যবহৃত হলেও, প্রকৃতপক্ষে রবেতা ম্রং জানালেন, “একটা সময় কলাগাছের গুড়ি টুকরোটুকরো করে কড়ারোদে শুকিয়ে পুড়ানো হতো।তারপর বাঁশের বা নেটের ছাকনিতে সেই পুড়ে ছাই হওয়া চূর্ণ বাঁশের বা নেটের ছাকনিতে ছেঁকে জলে দীর্ঘক্ষণ চুবিয়ে রেখে সেখান থেকে যে জলের ফোঁটা ফোঁটা পড়তো সেটি নানা রান্নায় ক্ষার হিসেবে ব্যবহৃত হতো”

সময় পাল্টে গেছে। মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে। রেডিমেড পণ্যের প্রতি ঝোঁক সকলের।কোচেরাও একই পদ্ধতিতে ক্ষার বের করে সংগ্রহ করে রাখে। কখনো কখনো কোচেরা শেকড়সহ মাসকালাই গাছ  রোদ শুকিয়ে  আর আগুনের পুড়িয়ে ক্ষার বানিয়ে সংরক্ষন করে রাখত।

নেটের ছাকনি কেনার পূর্বে কোচদের ভেতর বাঁশের মিহিদানা চটি দিয়ে এক ধরনের চোঙের মতো ছাকনি বা খারি চক্কেনা বানাত। ক্ষার ও এই খারি চক্কেনা বানাবার সক্ষমতার মাপমাঠি ছিল কন্যা বিবাহযোগ্যা হয়েছে। গেরস্থকর্মের উপায় শিখেছে। মেয়ে এখন স্বামী সংসার সামলাতে পারবে।

মান্দি রান্নাঘরে শুধু সিদ্ধ বা পোড়ানো খাবার নয় রয়েছে টক তিতা মিষ্টির প্রাধান্যও। কাঁচা বা পাকা পেঁপে বাঙালির পছন্দ— ফলে কিংবা সবজিতে। পেপে ফুল বা কচি পাতা সিদ্ধ বা ভাজা মান্দি পরিবারে  জনপ্রিয় খাবার।পেঁপে ফুল বা কচি পাতা এক্কেবারে কুটকুটে তিতা।বাঙালি গিন্নি চৈত্র সংক্রান্তির দিনে পাঁচ বা সাত প্রকারের তেতো সকলের পাতে বেড়ে দেবার একটি নিদির্ষ্ট দিনধার্য থাকলেও গারো হাজং কোচ দের বারো মাসেই কোন না কোন তেতো পাতে পড়ে।

চৈত্র বৈশাখের খররোদে ক্লান্ত মান্দির শরীর-মনে শ্রান্তির ছোঁয়া এনে দেয় মেন্দা পাতা।টক জাতীয় এই পাতা  মলা পুটি বা টাকি মাছের সাথে ঝুল তরকারি রান্নায় আনে অতিরিক্ত স্বাদ।মেন্দা ছাড়াও আছে আগুনজালেং, আদুরাক,  মিক্রেমক্রেম, মিক্রিপদলক ইত্যাদি।

ঝাল টক তিতা থাকবে অথচ মিষ্টি থাকবে না তা তো হতে পারে না। বাঙালি রান্নাঘরে দুধ চিনির মিশ্রণে যেমন পায়েস তৈরি করে রসনা বিলাসে মেতে ওঠে ঠিক তেমনটি আচিক মান্দির পরিবারে নয়। মিষ্টি অাস্বাদন যেটুকু  ফলের মাধ্যমে আহরিত হয় ততটুকুর প্রতি পক্ষপাত লক্ষনীয়।

তবে তারা ওয়াংন্থি ( পিঠা) বানায় না তা কিন্ত নয়। স্বল্প মিষ্টতা গারো যাপনের অংশ।মৌসুমী ফলই অন্যতম সহায়। প্রাণ ও প্রকৃতির কোলে বেড়েওঠার কারণে আলাদা করে তাদের স্বাস্থ্যসচেতনার কথা ভাবতে হয়নি।জিমে যেতে হচ্ছে না। সাংবাৎসরিক ডাক্তারি চেক আপ–কোলস্টেরল, এল ডি এল, এইচ ডি এল, ট্রাইগ্লিসারইড–করতে হিল্লি দিল্লি তাকে যেতে হয় না। ত্বকের সজিবতার জন্য ছুটতে হচ্ছে না বিউটিপার্লারে। গারো যাপন সমগ্রের যাপন। একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত।তাকে আর আলাদা করে ভাবতে হয়নি কোন কিছু।

সম্প্রতি গ্যাস্ট্রিক ও বহুমুত্র রোগে আক্রান্ত হবার পর থেকে ডাক্তার সাহেব যে ম্যেনুচার্টের দিকে বারবার আমার নজর ফেরাবার তাগিদ দিচ্ছেন তখনই আমার আচিক মান্দির রান্নাঘরের কথা মনে পড়ে যায়।যে জ্ঞান আমরা আক্রান্ত হবার পর হন্যে হয়ে খুঁজছি নিজের সুস্থতার জন্য সেই জ্ঞান আমার পড়শি প্রকৃতিকে আত্মস্থ করে দীর্ঘদিন যাপনের সাথে সম্পর্কযুক্ত হইয়েই যাপন করছে উদযাপন করছে।

Food,Ecology and Culture নিয়ে যারা নতুন সহস্রাব্দের পর থেকে কাজ করছেন তারা উচ্চ স্বরে বলছে খাদ্য নিরাপত্তার কথা।প্রান্তিক জেলে কৃষক আদীবাসীদের জীবন জীবিকার কথা। খুঁজছে বংশ পরম্পরায় ক্ষয়ে হারিয়ে যাওয়া নানা বালাই ষাটের গুপ্তমন্ত্র—” Indigenous Knowledge “। আর শোনা যায় এ ব্যাপরারে নাকি অালোর দিশা দেখাতে পারে প্রান্তিকের প্রান্তে থেকে যাওয়া  আদীবাসীরা।

 সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাস দেশে দেশে উদলা করে দিয়েছে স্বাস্থ্যা ব্যবস্থার ভেতর ভঙ্গুর রূপ। কোন তদন্তই পুঁজিতান্ত্রিকদের রোগ ও জীবিণু নিয়ে যে ব্যবসা করে আসছিল তা প্রকাশ করতে পারবে না। গণতন্ত্রের বড় বড় মোড়লেরা ধরাশায়ী।খাদ্য শৃঙ্খল খাদ্য নিরাপত্তা প্রাণ ও প্রকৃতি আশ্রিত জীবন জীবিকার কথা বেশ জোড়েশোড়েই উঠছে।তাই উঠছে Food,Ecology and Culture কথা।বিষমুক্ত খাদ্যের কথা।রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমির যে উর্বরতা তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জীবন জীবিকার প্রতি আমাদের যে নীতি কৌশল তা আত্মবিনাশী।

আবার  পানীয় ( রিংয়া) চু আচিক মান্দির জীবনাচারের অংশ।বিশ্বাস আর শ্রদ্ধার সাথে আনত সম্পর্কের নাম চু জাঙ্গি। বাংলা ভাষান্তরে চু’কে বুঝেছি  মদ অর্থে। মদের সাথে চু’য়ের ব্যবহারিক মিল বাইরের দিকে মিল। মদ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ পড়শী মানুষের ভাব ভাবনা নাবোধকতা দ্বারা তাড়িত।  ধর্মিক বিধি বিধান দ্বারা চালিত।চু আচিক মান্দির দীর্ঘ যাপনের সূত্রে গাঁধা। কৌম ব্যবস্থা ভেতর বয়োজেষ্ঠ্য কিংবা খামালের সাথে যৌথতার গণিত।সামাজিক সম্পর্কের আচার আচরণের বাহন এই পানীয়।

একাকী ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রনা থেকে আপতিক পলায়ন বৃত্তির জন্য যে গোপন পানীয় পানের ভেতর দিয়ে নেশাগ্রস্ত হবার যে-রসায়ন মদে থাকে তা থেকে চু মৌলিকতার দিক থেকে আলাদা। চু’য়ে থাকে কৌমের গোষ্ঠীর যৌথতার ভেতর নিজেকে আরো সেই বেড়ের ভেতর আত্মস্থ হওয়া। মদ ঠিক তার উল্টো বিন্দু। কেবলই একা হয়ে যাওয়। কেবলই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বুদ হয়ে যাওয়া ব্যক্তি মানুষের স্বাতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে  দেবার স্বেচ্ছারিতা।

তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সব কিছু ভেঙে পড়ার মতো আচিক মান্দি সমাজও পুঁজিতান্ত্রিকতার প্রভাব ও প্রভাপে ভূমি থোকে বিচ্ছিন্ন। একটা সময় যে ধানী গেরস্থ মান্দি পরিবার দেখা যেতো আজ আর নেই।ভুমি মালিকানা জটিলতায় হাতছাড়্ হয়ে অর্থনৈতিক ভাবে আরো প্রান্তিক হয়ে গেছে স্বাধীনতার পর থেকেই।

এই ভুমিলগ্ন ভুমিজ সন্তানেরা আজ আর ভুমিতে  নেই। অভাবের সাথে যুক্ত হয়েছে অশিক্ষা কুসংস্কার অন্যদিকে পড়শী সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য ইত্যাদির কারনে বিচ্ছিন্ন তার পরিবার। সে শহর মুখী। প্রথমিক বিদ্যালয় বা মিশন স্কুল পড়াশোনা করলেও মেয়েরা ঢুকে পড়ছে পেটের তাগিদে বিউটি পার্লারে। কেউ বেকার। কেউ এনজিয়ের কর্মী।

নিজেকে বিকশিত করার ফুসরত আর পায় না। আর তখনই ঢুকে পরে অন্ধকার। প্রাঞ্জল সাংমা নানা সামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন ।  ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোশিয়েশনের মাধ্যমে উদ্ধব্ধু করছেন যুবক যুবতীদের।গড়ে তুলছেন কর্মক্ষম করে।

 তিনি জানালেন,” তারপরও তরুনদের মাঝে ঢুকে পড়ছে হতাশা। যে  চু আত্মিক বলবানের জন্য যে চু সকলের সাথে সকলে মিলে জীবন সাজাবার– সেই চু নিয়ে  আচিক মান্দি সমাজের কেউ কেউ নেতিবাচকতার দিকে ঝুঁকে গেছে। চু নিয়ে যে বিভ্রান্তি যে অপব্যবহার তার কিছুটা দায় গারোরা এড়াতে পারে না।”

চু’য়ের নামে চোলাই মদ কেউ কেউ তৈরি করছে। ” স্বপ্ল মূল্যে বেশি নেশার লোভে অনেক হতাশাগ্রস্ত বেকার  পড়শী চোলাই মদের জন্যে আচিক বাড়িতে জড়ো হচ্ছে।” সৃষ্টি হচ্ছে অনাচার ব্যভিচার। একদিকে যেমন নগদ টাকার লোভে আচিক পরিবার চু’য়ের নামে অস্বাস্থ্যকর ক্ষতিকার এ্যালকোহল প্রয়োগ মদ বিক্রি করছে। অন্যদিকে কম পয়সায় নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে  যুবক সম্প্রদায়।ভেঙে পড়ছে সামাজিক শৃঙ্খলা।

চু কে বিনোদনের সাথে যুক্ত হবার কারনে এবং হাল আমলে টাকা পয়সা কামাইয়ের ধান্দা হিসেবে এই জনজাতির কেউ কেউ  এমন একটি পর্যায় নিয়ে গেছে যে,যেন গারো মাত্রই নোশায় বুদ হয়ে থাকা কোন ঊণমানব।

কাজের ভেতর চু’য়ের মর্যদাহানি ঘটে গেছে। যে চু জীবনবোধের সামষ্টিক চেতনাকে উজ্জিবীত করে রাখতো তা আজ কালিমায় ঢেকে গেছে। মদ পানে যে আমোদিত ভাব যে বিনোদনের হল্লা তা ইন্দ্রিয়ের সাময়িক উত্তেজনার প্রশমিত করার কিন্তু চু আত্মিক আনন্দের সাথে সর্ম্পকিত–আনন্দ সমস্ত অস্তিত্বের সাথে জড়িত– সেখানে    শরীর-মন-আত্মা একাকার।

“আজকে চু পানে নেশাগ্রস্থ হবার যে ঝোঁক বা প্রবণতা দেখছি”, কবি প্রাঞ্জল সাংমা শেষ করলেন এই বলে যে, ” “সে প্রবণতা সাংসারেক ধর্মে ছিল না।সাংসারেক ধর্ম প্রকৃতিকে আত্মস্থ করে রচিত এক বিধানের নাম।সেখানে প্রাণ ও প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক কোন উপাদান বা প্রবনতা থাকতে পারে না।”

এই রিংয়া( পানীয়) যেহেতু যাপনে আছে সাহিত্যে যে ওঠে আসবে এ তো স্বাভাবিক কথা।চু জাঙ্গি জীবনের অঙ্গ। বিচ্ছিন্ন করে দেখার ভেতরই বিভ্রান্তি।সম সমায়িক আচিক মান্দি কবিতায় চু উঠে এসেছে।কবি বচ্চন নকরেক  বলেছেন মান্দি জীবনবেদের কথা। জীবনমদের কথা

“ভুমিষ্ঠ হবার সাথে সাথে

আমি চু জাঙ্গির স্বাদ পেলাম

চু জাঙ্গি মানে জীবনমদ

জীবনই মদ মদই জীবন”

         ( চু জাঙ্গিঃ ইচ্ছেবন ইচ্ছেপাহাড়)

তরুন কবি মিথুন রাকসাম আচিক মান্দির জীবনাচারের  বোধ ও বোধি তিনি তার কবিতায় স্পষ্টবাক করে তুলছেন। মান্দির কথা মান্দিকেই বলতে হবে। মান্দির যন্ত্রনা সুখ শান্তি আকাঙ্খা মান্দির নিজের।  তার লড়াই মান্দির নিজস্ব লড়াই। প্রত্যেকের স্ব-ভাব আলাদা। বয়ন ও বয়ানে সেটি মূর্তাায়ন হয়ে উঠে।

কাজে কাজেই মান্দির কথা মান্দিকেই উচ্চস্বরে বলতে হবে। মিথুন রাকসামেরা তাই করছে। আমার এই উত্তর জনপদ ঝিনাইগাতির ভাটপাড়ায় এই কবির জন্ম। নিজের কথা নিজের মতো করে বলবার জন্য মিথুনদের প্লাটফর্মের নাম “থকবিরিম”– মানে বর্নমালা। কয়েক বছর ধরে সেখানে থেকেই একে একে বের হচ্ছে মান্দির কথামালা। চু নিয়ে মিথুন লিখেছেন

“চু আর মান্দি তো জমজ ভাই। চু না খেলে আসর জমে না, সালিশ হয় না,চু না খেলে চোখে রং ধরে না,চু না খেলে ওয়ানগালা হয় না,আমুয়া হয় না। চু তো আপনজনকে কাছে টানার, ছেকে দেখার চু হয় কথায় কথায়, কাম- অকামে,প্রেমে-অপ্রেমে,চু হয় স্নানে- আড্ডায়।”

কিংবা

” স্বপ্নের ভিতর চু খেয়ে হা হা করে হাসি হো হো করে কাঁদি।জমি বেঁচে চু খাই মাটি বেঁচে চু খাই ভিটা বেঁচে চু খাই গাছ বেঁচে চু খাই কাপড় বেঁচে চু খাই গতর খেটে চু খাই তবু চু খাই। চু খেয়ে খেয়ে মরে যাই তবু চু খাই।”

  ( গন্ধচোর)

দুই আচিক মান্দি কবি মিথুন রাকসামের অনুভবে আর বচ্চন নকরেকের জীবনমদ ” মান্দির জন্মই তো চু জাঙ্গি খেয়ে”–একাকার।

তারপরত চু নিয়ে মান্দিদের ভেতর রয়েছে নানা ধরনের বিরোধ ও মত পার্থক্য আর নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। বন্ধনের এই পবিত্র চু নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আচিক মান্দি যারা সাংসারেক ধর্মে আস্থাবান তাদের কাছে চু প্রনালী থেকে শুরু করে যৌথতার ভেতর বন্টন পর্যন্ত রৃযেছে  ঐতিহ্যের ছোঁয়া। শ্রদ্ধা ভালোবাসা আর সন্মানের পরশ।

কিন্ত যারা মূল গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে আলাদা মত ও পথ নিয়ে তাদের ভেতর চু’য়ের তাৎপর্য কিছুটা ম্লান শুধু নয় — কোথায় চু অচ্ছুত। নিষেধ। কী ধর্মিক অনুষ্ঠান কী যাপনে— কোথায় চু’য়ের ঊপস্থিতি নেই; যেমনটি সাংসারেক ধর্মাশ্রাতি তাতারা রাবুগার সন্তানদের কাছে  চু’য়ের ব্যাপ্তি জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি।

উনিশ শতকে শেষের দিকে মূলত আচিক মান্দিরা অন্য মত ও পথের দিকে ঝুঁকে পড়েন।  ১৮৬৩ সালের ৮ ফেব্রুআরি তারিখে শ্বেতাঙ্গ মিশনারী  ডক্টর  মাইলস ব্রনসন সর্ব প্রথম গৌহাটিতে দুজন গারোকে খীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করার মধ্য দিয়ে এঅঞ্চলে মান্দিদের ধর্ম পরিবর্তিত হতে থাকে।

প্রথম যে দুজন গারো তাতারা  রাবুগা আশ্রয় ছেড়ে জিসাস ক্রাইস্টের  শরণ নিয়েছিল  তাদের নাম ছিল–ওমেদ ওয়াট্রে মোমিন ও রামখে ওয়াট্রে মোমিন– সম্পর্কে মামা ভাগ্নে।গেয়ে উঠলেন—

 “জীবনেরও পথ আছে মরণেও পথ আছে

যিশু যিশু’

  অথবা

“যেথায় রয়েছে আধাঁর জ্বালিব সেথায় আলো”   

 ইতিমধ্যে মতান্তরিত মান্দি ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক যিশু থেকে উৎসারিত দুই রীতিনীতি। প্রতিটি গারো পাড়ায় রয়েছে  আলাদা আলাদা উপসানালয়।রয়েছে বিরোধ ও বিভেদ।

ব্যাপ্টিস্টদের ভেতর চু চুড়ান্তভাবে নিষেধ।ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে নানা আয়োজিত অনুষ্ঠানে চু ত্রিসীমানা য় ঢুকে না। অন্যদিকে ক্যাথলিকদের চু বিষয়ক পানীয়তে উদার।তবু গুরুত্ব ও তাৎপর্যের দিক থেকে আচিক মান্দির মতো নয়। আমার উত্তর জনপদ গারো সমাজ তিন ভাবে বিভক্ত।  শ্রীবর্দীর হারিয়া কোনা দীঘলাকোনা  ঝিনাইগাতি মরিয়ম নগর বড় গাজনী নওকুচী, হলদীগ্রাম দাওধরা চকিদার টিলা  নালীতাবাড়ির বারোমাড়ি হাতিবান্দা পানিহাতা রামচন্দ্রকোনা বা হালুয়াঘাটের জয়রামকুড়া জিগাতলা মনিকুড়া ঘোষগাও গোবরাকুড়া বালিপাড়া কমলাকান্দা অঞ্চল সাংসারেক ও ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্টে বিভক্ত।

এই বিভক্তির ছায়া যাপনে যেমন পড়েছে তেমনি কবিতাও। প্রবীণ কবি মতেন্দ্র মানখিন ‘ সাংসারেক গারো ছিলাম” এ লিখেছেন–

আমিও সাংসারেক গারো ছিলাম

নিজস্ব কৃষ্টি –সংস্কতির ধারক

এখন হয়েছি খ্রিস্টান গারো

ঈশ্বরের পান–পাত্র বাহক

অন্যদিকে  মিথুন রাকসাম আরেকটু সাহসী। সাংসারেক ধর্মের পতাকা তোলে মতান্তরদের তুলোধুনো করতে ছাড়েন নি

” মান্দিদের জীবনে আলো আসেনি বরং দখল হয়ে গেছে জমি

দখল হয়ে গেছে খামার।দখল হয়ে গেছে ধর্ম

দখল হয়ে গেছে বিশ্বাস।”

কিংবা

“মান্দি নারীর কোলে খ্রিষ্ট সাংমা

বাপ? ওই মিশনের ফাদার!

ল্যা হালুয়া!

ঢি ঢি পড়ে যায় গ্রামে

মুখে মুখে চ্যাটেরবাল আব্দুল্লাহ”

অথবা

“এই যে পবিত্র বাইবেল — আমার না

এই বাণী — আমার না

এই ঘর — আমার না”

শুধু যে  মান্দিরা খ্রিস্টান হয়েছে তা কিন্তু নয়।শ্রীমন্ত শঙ্করদেব পঞ্চদশ শতাক্দীতে যে ভক্তি আন্দোলন শুরু করেন তার প্রাবাল্যে আসাম অঞ্চলের আচিক মান্দিরা মহাপুরুষিয়া মতে দীক্ষিত হন।এই মত একশরণীয়ানামধর্ম ধারণ করে বৈষ্ণব হতে দেখা যায়।আবার অন্যদিকে মধুপুর অঞ্চলের জলসত্রে কিছু আচিক মান্দি দেখেছি যারা শ্রীচৈতন্য দেবের মতানুসারী গৃহী বৈষ্ণব। উণিশ শতকের শেষের দিকে মান্দি গুরুচরণ সিমসাঙের নেতৃত্বে কিছু গারো পরিবার নিরামিষাশী ভোজী বৈষ্ণবীয় ধারায় যুক্ত হন ষোল নাম বত্রিশ অক্ষরকে মুক্তির ত্রাতা হিসেবে।

গুরুচরণ চৈতন্যপ্রভাবিত। তার মত “গুরুসত্য নামে’ মান্দিদের ভেতর পরিচিত।কন্ঠিধারী  বৈষ্ণব মান্দি ভক্তি আন্দোলনে যুক্ত হবার কারনে তাদের রান্নাঘরে আর চু বা শুকর বা নাখমা ঢুকেনি। নতুন মত ও  পথের বিশ্বাস নিয়ে তাদের যাপন।

 ৭

মান্দির খাদ্য ও পানীয়ের প্রতি বাঙালির নাক সিটকানো তাচ্ছিল বা ঘৃণা সূচক অবজ্ঞা খুব একটা গোপনীয় বিষয় নয়। বাংলাভাষী যে কোন মানুষের সাথে মিনিট পাঁচেক কথা আঁচালেই চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালির নিজস্ব যাপনের যে লক্ষণ বৃত্ত তার বাইরের পৃথিবী অচ্ছুত বা নাপাক।সে হোক বাঙালি হিন্দু বা রাঙালি মুসলমন।

বাঙালির চর্চা ও চর্যায় অপর জাতি সত্তা জন্য কোন পরিসর রাখেনি। বাংলাদেশে সেন্সাস রিপোর্ট অনুসারে২৭ টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির প্রায় ১৫লাখ ৮৭ লোক বসত  বাংলাদেশে। প্রতিটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির রঙ আলাদা। বৈশিষ্ট ভিন্ন। নানা বৈচিত্রে ভরা। বাংলা সংস্কৃতির প্রতাপে অন্যেরা অবিকশিত। মৃতপ্রায়। কেউ জাদুঘরে।গবেষণা পত্রে।

বাঙালির সাংস্কৃতিক রাজনীতি অন্যের জন্য কোন স্পেস রাখেনি।লাল সবুজ পতাকা  অর্জনে স্বাক্ষর আছে সকলের অথচ রাষ্ট্রিক কাঠামো পরিসরে অপর জাতি সত্তা কখনো উপজাতি কখনো আদিবাসী কখনো আদিবাসী বলে কেউ নেই— যা আছে তা ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি;হাল আমলে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি– তাও আবার সংখ্যার মাপ কাঠিতে সংখ্যালঘু— মোটা চিকন দাগ কাটা।

”কী নামে ডাকব তোমায়”–বাংলা গানের মতো অবস্থা তাদের।আইডেন্টিটি ক্রাইসিস খড়গের মতো ঝুলছে মাথার উপর।এমন কী রাষ্ট্রিক রক্ষাকবজ পর্চায় তাদের নিজস্ব সত্তার কোন সিগনেচার নেই।অপর দিকে সামাজিক মেলামেশায় পড়শী মানুষের এ্যালার্জি আছে।

সেই এ্যালার্জির প্রাথমিক রূপ হিসেবে হাজির থাকে রান্নাঘর।  পানীয় ও খাদ্য কে কেন্দ্র করেই সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ অপরের অভ্যাসকে মোটা দাগে বিভক্ত করে ফেলে। একট্টা কোন খাদ্যাভাস নেই।সকল খাদ্যাভাস স্থানিক। স্থানিক পরিসরে কোন খাদ্যাভাস গড়ে উঠবে তা নির্ভর করে একটি নিদির্ষ্ট স্থানের খাদ্য উপকরণ সহজ প্রাপ্তির উপর ভিত্তি করে।

চুই ঝাল আমি চিনতাম না। পিরোজপুরে চাকরির সুবাদে চুই ঝালের সাথে মোলাকাত।পানের লতার মতো দেখতে চুই ঝাল গাছ।বাড়ির এখানে সেখানে বেড়ে উঠতে দেখেছি সেখানে।চুইয়ের কাণ্ড বা লতা ছোট ছোট করে কেটে মাংস বা মাছের তরকারিতে দিলে খাবারে একটি ভিন্ন স্বাদ অনুভুত হয়।তাছাড়া খাদ্য পরিপাক করা ছাড়াও শারীরিক অনেক সমস্যার সমাধান করে এই সপুষ্পক লতা। খুলনা যশোর,বরিশাল পিরোজপুর বাগেরহাটের রান্নাঘরে যেমন উপস্থতি দেখা যায় তেমনটি আমার উত্তরে দেখিনি

পাহাড়ে কাঁচা মাছ অপ্রাপ্যতার দরুণ ড্রাই শুঁটকির প্রতি পক্ষপাত ও তার সংরক্ষণ সুবিধার কারণে আদিবাসির ম্যেনুকার্ডে শুটকির নানা রান্না প্রণালী দেখা যায়— উপকরনের ভিন্নতা স্বাদেও ভিন্নতা নিয়ে আসে। স্থানিক পরিবেশে যা পাওয় যায় তাই খাদ্যাভাসে ছাপ রেখে যায় বা সেই পরিবেশই ঠিক করে  উনোনে কী এবং কীভাবে রান্না হবে।

প্রয়োজনীয় তথ্যাভাবে আমরা মনে করি মান্দিরা এমন কিছু খায় যা ক্লাসিক্যাল না ইটেবল না আমাদের লেভেলের না– এমন পূর্বানুমান ধরে নিয়েই মোটাদাগে তাদের সরিয়ে রাখি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিলের মোড়কে।

এই নাক সিটকানো শুধু কালিক নয়– ঐতিহাসিক। যা আমার মতো নয় তা প্রেজেন্টেবল নয়। তাই তাকে নিজের দীনতা দিয়ে কালিমা লেপন করতে মির্জা নাথানও ছাড়েনি। বাহারিস্তান-ই-গায়বীতে লিখেছেন,”গারোরা পাহাড়ি জাতি। তারা লোহা ছাড়া আর সব কিছুই খায়, কারণ লোহা হচ্ছে সব চেয়ে শক্ত এবং তা দাঁত দিয়ে চিবানো যায় না।”

আমাদের ছোট্ট মফস্বলে মঙ্গলে শুক্কুরে যে হাটগুলো  বসত সেখানে নানা হাটুরেদের সাথে থাকত গারো হাজং হদি রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোক। তারা কোন না হাতে তৈরি পন্য নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসতেন হাটে ।      

খলচন্দা গ্রামের কোচেরা বাঁশের ঢুলি চালুন মাথাল ইত্যাদি পসরা নিযে বসতেন পাতিল হাটি। আবার রাজবংশীরা নিয়ে আসতেন নকুল–কাঁচা চিড়ে হাল্কা ভাপ দিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে দিয়ে বানানো একধরনের খাবার। কোথায় চিড়েগুলো দলা পাকিয়ে থাকে কোথাও ঝরঝরে।

মহিষের দুধে পাতা কাঁচা দই দিয়ে সকালের খাবার সেরে ফেলা যায়— সাথে একদলা মোঠা গুড় হলে আর  সারা দিন  খাবারের কথা চিন্তা করতে হতো না। দই নকুলে মিলে পেট ফুলে ফেপে উঠত। এই খাদ্যাভাস হদি বানাই ডালু গারো রাজবংশীদের ভেতর দেখেছি আশির দশকে। এখন আর দেখি না।

সেই হাটগুলোতে   নাক থ্যাবড়ানো কোন ছেলে দেখলেই — হোক সে গারো বা হদি বা কোচ— তখন জাতি সত্তার ভাগ গুলো জানতাম না; সবাইকে গারো ভেবে আমি আমরা যে ছড়া কাটতাম সেটিও আমাদের পূর্বসুরিদের বরাতে প্রাপ্ত। মির্জা নাথানের অনুমান দ্বারা শাসিত।নিজের পরিচয়কে মান ধরে অপরকে দাগিয়ে দেওয়া।

” গারো গারো নাক বোঁচা গারো

মেইল্লা মারো পাগাড়ো

পাগাড়ের পানি কালা

গারো আমার শালা”

অথবা

সাপ ব্যাঙ কুইচ্ছা গারো খায় পুইচ্ছা

নিজের মতো না হলেই একটি প্রাণবান জাতি সত্তাকে কিভাবে দাগিয়ে দেয়া যায় মির্জা নাথান একটি বড় উদাহরণ। আমি বা আমরাও কম দায়ী না। তখন থেকে আজকে পর্যন্ত অপর জাতি সত্তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি মনোভঙ্গি  আমাদের পাল্টায়নি।

বরং জ্যাতাভিমান বেড়েছে বহুগুণ। জাতীবাদী চেতনার সাথে যুক্ত হচ্ছে ধর্মিক জাতিবাদ ভাবনা — শূধু তাই নয় একই ধর্মের নাম চিহ্নের ভেতরও আলাদা পাকের ঘর। আলাদা ম্যেনু। শাস্ত্রের কূটকচালে অপরের পাক অশুদ্ধ– শাস্ত্রসম্মত নয়; তাই পরিত্যাজ্য শুধু সঙরাম নয় —ব্যক্তিও।

যে কোন স্ট্যান্ডার্টকে মাথায় রেখে অপরকে ডোমিনেশনের বড় হাতিয়ার খাদ্য। এটি বাঙালির নিজের ঘরের ভেতর যেমন আছে তেমনি অপর জাতির প্রতিও আছে। ভিন্নতা ভেবেছে বিভেদের মোকড়ে। ঘৃণা আর তাচ্ছিলের মনোবাঞ্ছায়।তাই বলছিলাম বৈচিত্রের কথাবার্তা চালাচালি হলেও সামাজিক হিসেবে মেলামেশাতে বাঙালির এ্যালার্জি আছে।ভেতর দিকে ফাঁপা— বাইরে লোকদেখানো লোকতন্ত্র। অপর মত ও পথের প্রতি সন্মান নেই অথচ নিজের মত ও পথের শ্রেষ্টতার ধ্বজা উড়িয়ে দেয় প্রবল প্রতাপে।

অথচ গোলকায়নের এই সময়ে একট্ট কোন বাঙালি খাদ্য নেই।ছিল না কোন কালে–এখন যা দেখছি তা কোলকাতা ও পুরান ঢাকার খাবারের ফিউশন। সাথে অাছে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে থাই ও চাইনিজের খাবারের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ।

 কাজে কাজেই—–ভিন্নতাই সুন্দর — কথাটির মৌখিক চর্চা হলেও আজো কাজে কামের ভেতর নেমে আসেনি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত