Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

গীতরঙ্গ চা সংখ্যা: ঠাকুরবাড়ির চায়ের মজলিস

Reading Time: 7 minutes

ঠাকুরবাড়ির রমরমার দিন শুরু হয়েছিল দ্বারকানাথের হাতে। দ্বারকানাথ একদিকে যেমন জ্ঞানী, গুণী, আভিজাত্যময় শিল্পীমনের পুরুষ, তেমনই অন্যদিকে ছিলেন প্রকৃত ব্যবসাদার মানুষ। ব্যবসার জন্যই সাহেব-সুবােকে ডেকে বাড়িতে মজলিশ বসাতেন। বিশাল জমিদারি সামলানাের পাশাপাশি পাট, চিনি, আফিম, নীলের ব্যবসা বা জাহাজের ব্যবসা কি ছিল না তাঁর, তেমনই তাঁর চায়ের ব্যবসাও ছিল।

বিলেতে তখন চায়ের খুব কদর। বিলেতে চা রফতানির প্রয়ােজনেই অসমের বাগানে চা আবিষ্কার হল। এই চা আবিষ্কারের বছর দশেক পরে ১৮৩৪ সালে লর্ড বেন্টিংক ভারতের চায়ের ব্যবসার অনুমােদন দিলেন। দ্বারকানাথ আর দেরি করলেন না। অমনি চা ব্যবসা শুরু করেন। বাগিচা শিল্পের প্রযুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তিনি। তিনিই অসমের চা প্রথম কলকাতায় এনে ইংল্যান্ডে রফতানি করেছিলেন। যে বাড়ি থেকে চায়ের ব্যবসা চলে, সে বাড়ির লােকেরা চা-পানে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে এ আর নতুন কথা কি।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা ছিলেন মজলিশি মানুষ। অবনীন্দ্রনাথের ‘আপনকথা’য় পাই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমলে পাঁচ নম্বর বাড়ির দোতলার দক্ষিণের বারান্দার সামনে লম্বা ঘরে সকালের দিকে চায়ের মজলিশ বসত। গুণেন্দ্রনাথের সঙ্গে অনেক সাহেবসুবাের ভাব-সাব ছিল। একেক দিন সাহেবসুবােরাও আসত সেই চায়ের মজলিশে। সেদিন সেখানে পেয়ারী বাবুর্চি উর্দি পরে তকমা ঝুলিয়ে ফিটফাট হয়ে হাজির থাকত সকাল থেকে। ছােটদের কোট-প্যান্ট পরিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হত দূরে। চায়ের টেবিলে রাখা থাকত চায়ের পেয়ালা, কাচের প্লেট, মাখন, পাউরুটি, বিস্কুট।

গুণেন্দ্রনাথ মারা যাবার পরও চায়ের মজলিশ উঠল না। গুণেন্দ্রনাথের তিন ছেলে গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ। তিন গুণী মানুষ। তাঁদের বাড়িতে তখনও আসতেন বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ। গগনেন্দ্রনাথের মেয়ে পূর্ণিমা ঠাকুর স্মৃতিচারণে বলেছেন, ক্যালকাটা ক্লাবের মাধ্যমে অনেক সাহেবের সঙ্গেই আলাপ হয়েছিল গগনেন্দ্রনাথের। তাঁদের বাড়িতে প্রায় সব লাট সাহেবই এসেছিলেন।

বাংলার প্রথম ছােটলাট লর্ড কারমাইকেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল গগনেন্দ্রনাথের। ছােটলাট তাঁদের বাড়িতে আসতেন বিকেলের দিকে। ঘােটলাটের আসার খবর দুপুরের দিকে তাঁর সেক্রেটারি ফোন করে জানালেই বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে যেত। দারােয়ান, চাকর, বেহারা সব পরিষ্কার হয়ে হাজির থাকত।

লাইব্রেরি ঘরে বসত চায়ের আসর। চারিদিকে দেশি ধরনের কৌচ কেদারা দিয়ে সাজানাে থাকত সে ঘর। গগন্দ্রেনাথ একলা অপেক্ষা করতেন সেখানে। অন্য দুই ভাই চলে যেতেন বাগানে। লাট সাহেবের গাড়ি এলেই গগনেন্দ্রনাথ এগিয়ে গিয়ে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। কারমাইকেল কিন্তু কৌচ কেদারায় না বসে গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে গদিতে বসে গল্প করতেন, গড়গড়ায় তামাক খেতেন। বাড়ির তৈরি চিড়েভাজা, কড়াইশুটি দিয়ে খেতে খুব ভালবাসতেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের হাতে তৈরি চিড়েভাজা টিনের কৌটোয় করে বিলেতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ঠাকুরবাড়িতে এলে নীচে রাস্তায় দুজন বডিগার্ড ঘােড়ায় চড়ে টহল দিয়ে বেড়াত। সময় হয়ে গেলে খবর পাঠাত। কিন্তু সাহেব কিছুতেই উঠতেন না। গল্পই করে যেতেন। ডিনারের টাইম হয়ে গেলেও তাঁদের দুই বন্ধুর গল্প শেষ হত না।

ঠাকুরবাড়ির আর এক মজলিশি মানুষ ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার যতীন্দ্রমােহন ঠাকুর। স্বামীজি যখন দ্বিতীয়বার বিদেশযাত্রার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন যতীন্দ্রমােহন স্বামীজি, নিবেদিতা এবং আরও কয়েকজনকে তাঁর সিঁথির বাগানবাড়ি মরকত কুঞ্জে চায়ের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ১৮৯৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মিস ম্যাকলাউভকে লেখা নিবেদিতার চিঠি থেকে ঘটনাটি জানা যায়। যতীন্দ্রনাথ চিরকুট পাঠিয়ে নিমন্ত্রণ করেছিলেন নিবেদিতাকে। নিবেদিতা জানিয়েছেন, মরকত কুঞ্জের ড্রইংরুমটি ছিল একেবারে প্রথম শ্রেণির ইউরােপীয় রুচি ও বুদ্ধিতে সজ্জিত রাজকীয় কক্ষতুল্য। সেদিন ওই কক্ষের বাইরের বারান্দায় চায়ের টেবিলে চা পান করেছিলেন তাঁরা।

চায়ের সঙ্গে আড্ডার একটা গভীর যােগ আছে। কত কিছুই যে ঘটেছে এই চায়ের আড্ডায়। চা-কে কেন্দ্র করে ঘটেছে নক্ষত্র সমাবেশ। মরকত কুঞ্জের চায়ের আসরের কদিন আগেই একটি ঐতিহাসিক চায়ের আড্ডা বসিয়েছিলেন নিবেদিতা। নরেন্দ্রনাথ দত্ত স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হয়ে ওঠার পর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মাত্র একবারই তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। আর সে সাক্ষাৎ হয়েছিল এই ঐতিহাসিক চায়ের আড্ডাতেই। ১৮৯৯ সালের ২৮ জানুয়ারি এই চায়ের আড্ডাটির আয়ােজন করেছিলেন নিবেদিতা বিবেকানন্দেরই অনুরােধে। বিবেকানন্দ তাঁকে বলেছিলেন, তিনি যদি তাঁর ব্রাহ্ম-বন্ধুদের আমন্ত্রণ করে আনতে পারেন তাহলে তিনিও সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করবেন।

সেই নির্দেশ পেয়েই নিবেদিতা চায়ের আসরের আয়ােজন করেছিলেন। সে আড্ডায় নিমন্ত্রিত ছিলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার, সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র বসু, সস্ত্রীক ড. প্রসন্নকুমার রায়, মােহিনীমােহন চট্টোপাধ্যায়, সরলা ঘােষাল, তাঁর মা স্বর্ণকুমারী দেবী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে আড্ডায় বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথকে মুখােমুখি বসাতে পেরেছিলেন নিবেদিতা। দিনটি ছিল ২৮ জানুয়ারি ১৮৯৯, শনিবার। নিবেদিতার চিঠি থেকে জানা যায়, সন্ধ্যার সেই চায়ের আড্ডার মনােরম পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ তিনটি গানও করেছিলেন। তাঁর একটি গান ছিল ‘বেলা গেল তােমার পথ চেয়ে’। গানটির শেষে ছিল ‘এসাে শান্তি’ কথা দুটি। নিবেদিতা ভেবেছিলেন গানটি বােধ হয় এই চায়ের আসরের জন্যই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এই আসরের তিন বছর আগেই ২৪.৯.১৮৯৫ তারিখে গানটি রচিত হয়েছিল।

ঠাকুর পরিবারের সদস্য স্বর্ণকুমারীর বাড়ির চায়ের আসরেরও সুনাম ছিল সাহিত্য মহলে। অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষের পদধূলি পড়েছিল তাঁদের বাড়িতে। সরলাদেবী চৌধুরাণী তাঁর ‘জীবনের ঝরাপাতায়’য় লিখেছিলেন, তাঁর যখন উনিশ বছর বয়স তখন তিনি ভারতীতে কয়েকটি সংস্কৃত নাটকের সুন্দর জ্ঞানসমৃদ্ধ আলােচনা করেছিলেন। সেই আলােচনা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি লেখিকাকে ধন্যবাদ দিয়ে একটি চিঠিও লিখেছিলেন এবং নিজের লেখা সেই এক সেট বই সরলাকে উপহারও দিয়েছিলেন।

এরপর একদিন স্বর্ণকুমারী তাঁর কাশিয়াবাগানের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রকে। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন চায়ের সমঝদার। জানকীনাথও তাই। স্বর্ণকুমারীর বাড়ির চা বঙ্কিমচন্দ্রের খুব ভালাে লাগে। সেকথা তিনি স্বর্ণকুমারীকে জানালে স্বর্ণকুমারী বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে চায়ের একটি প্যাকেট ও একগুচ্ছ গােলাপ ফুল উপহার পাঠিয়ে দেন। বঙ্কিমচন্দ্র প্রায়ই আসতেন স্বর্ণকুমারীর চায়ের আসরে। সঙ্গে তাঁর দুই নাতিকেও আনতেন।

শুধু বাঙালি বা ভারতীয়েরাও নন, স্বর্ণকুমারীর বাড়ির চায়ের আসরে যােগ দিয়েছিলেন ইউরােপীয়রাও। স্বর্ণকুমারী নিজে যেমন ইউরােপীয়ানদের ডাকা পার্টিতে যেতেন, তেমনই তাঁর বাড়িতেও ইউরােপীয়ানদের নিমন্ত্রণ করতেন। ইউরােপীয়ানদের অভ্যর্থনার জন্য তাঁর বাড়িতে বিশাল ড্রয়িংরুম ছিল। ঘরটি চেয়ার টেবিল দিয়ে সজ্জিত ছিল। সেখানেই অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন তিনি। অতিথিরা এলেই প্রথমে তিনি সুন্দর জাপানি কাপে চা পরিবেশন করতেন। চায়ের পরেই আসত টা। কেক, স্যান্ডউইচ, ফ্রায়েড রাইস, বিস্কিট উইথ হটচিজ, স্যালাড, ফ্রুট, ক্রিম, শরবৎ প্রভৃতি নানারকম খাবার একে একে আসতে থাকত অতিথিদের জন্য। স্বর্ণকুমারী নিজে অতিথিদের খাবার দিয়ে যেতেন যতক্ষণ না তাঁরা বাধা দিতেন। ( Introduction- E.M. Lang, An Unfinished Song, ১৯১৩, London, P.৬)

বাঙালির জীবনে এমন কোনও বিষয় নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া পড়েনি। তাই চা নিয়ে যে তিনি লিখবেন এ আর বেশি কথা কি। চা-পানের বিষয়ে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন তিনি। জোড়াসাঁকোর লালবাড়ি অর্থাৎ বিচিত্রা বাড়িতেও বসত চায়ের আসর। সে বাড়ির দোতলায় রবীন্দ্রনাথের বসার ঘরে এখনও আছে একটি টি-টেবিল ও তিনটি কেদারা। শান্তিনিকেতনে যে চা চক্র বা চায়ে পরিপূর্ণ আড্ডা বসত তার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘চাক্র’। এমনকী এই চা-চক্র বা ‘চাক্রে’র প্রবর্তনের দিনে লিখেছিলেন একটি গানও। যা পরে লিপটন টি কোম্পানির বিজ্ঞাপনেও সাদরে ব্যবহৃত হয়েছিল : হায় হায় হায় / দিন চলি যায় / চা স্পৃহা চঞ্চল / চল, চল হে! / টগবগ-উচ্ছল / কাথলিতল-জল / কল কল হে! / এল চীনগগন হতে / পূর্বপবনস্রোতে / শ্যামলরসধরপুঞ্জ, / শ্রাবণবাসরে / রসঝরঝর ঝরে / ভূঞ্জ হে ভূঞ্জ / দলবল হে!’

গানের এর পরের অংশটি আরও মজাদার। সেখানে রবীন্দ্রনাথ পুঁথি বিশারদ, গণিতবিদ, কাব্যরসিক, চিত্রকর, বাউণ্ডুলে থেকে শুরু করে এমনকী শশব্যস্ত হিসাবরক্ষকদেরকেও কর্মজীবনের গ্লানি চটপট ভুলবার জন্য চা পানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। গানটি মুদ্রিত আছে ‘প্রহাসিনী’ কাব্যগ্রন্থে।

চা ছিল কবিগুরুর একটি প্রিয় পানীয়। রবীন্দ্রনাথ জাপানি চা খুব পছন্দ করতেন। পছন্দ করতেন জাপানিদের চা-পানের রীতিটিকেও। এজন্য তিনি যখন জাপান গিয়েছিলেন তখন প্রতিদিনই তাঁর জন্য ‘টি সেরিমনি’র আয়ােজন করা হয়েছিল। কবির লেখা ‘জাপান যাত্রীর ডায়েরি’ পড়লে বােঝা যায় কেন তিনি জাপানি চা পানের রীতিকে এত পছন্দ করতেন। তিনি মনে করতেন, ধৈর্য, নিষ্ঠা ও মনসংযােগ না থাকলে জাপানি চা তৈরি করা যায় না। তাই তিনি লিখেছিলেন, দেখেছি, শরীর মনকে একান্ত সংযত করে নিরাসক্ত প্রশান্ত মনে সৌন্দর্যকে নিজের প্রকৃতির মধ্যে গ্রহণ করা। ভােগীর উন্মাদনা নয়। কোথাও লেশমাত্র অমিতাচার নেই। সৌন্দর্যের গভীরতার মধ্যে নিজেকে সমাহিত করাই হচ্ছে এই চা-পান অনুষ্ঠানের তাৎপর্য।

জাপানি রীতিতে চায়ের আসর ঘেরা থাকে একটি সাদা পর্দায়। মাঝে মাঝে জাপানি নকশা। মাঝে একটি টেবিলে থাকে জাপানি রীতিতে চা তৈরির সরঞ্জাম ওকামা (জল গরম করার পাত্র), হিসাকু (বাঁশের হাতল দেওয়া লম্বা হাতা), চাওয়ান (চা পানের পাত্র), আর নাৎ সুমে (তৈরি চা ঢালার পাত্র)। চাওয়ানের গায়ে থাকে সুদৃশ্য আলপনা।

চা তৈরির আগে অতিথিরা এসে বসেন। একেবারে ডানদিকের আসনে যিনি বসেন তিনিই জাপানি রীতিতে প্রধান অতিথি। অতিথিরা সবাই আসন গ্রহণ করলে সাদা পর্দা সরিয়ে আসেন চা-মাস্টার। জাপানে বিভিন্ন ঘরানায় চা তৈরি হয়। চা-মাস্টারও বিভিন্ন ঘরানার হন। চা তৈরির আগে মাস্টার প্রত্যেক অতিথির কাছে নিয়ে যান মিষ্টির প্লেট। মিষ্টি বিলির পর শুরু হয় চা তৈরির দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রথমে দীর্ঘক্ষণ ধরে সাদা রুমাল দিয়ে চায়ের সরঞ্জাম মােছা হয়। তারপর ওকামায় জল গরমের পালা। আগে কাঠকয়লায় জল গরম হত। বর্তমানে ব্যবহার করা হয় আগুন জ্বালাবার আধুনিক পদ্ধতি। হিসাকু দিয়ে সেই গরম জল তুলে অন্য সরঞ্জাম ও পাত্রগুলি ধুয়ে নেন মাস্টার। পাশের পাত্রে সেই ধােয়া জল ফেলে ফের মুছে নেন চাওয়ান। তারপর তাতে গরম জল ঢেলে সুদৃশ্য বাঁশের দণ্ড দিয়ে মেশানাে হয় জাপানি চা। সেই চা প্রথম দেওয়া হয় প্রধান অতিথির হাতে। রীতি হল অতিথি যতক্ষণ চা পান করবেন ততক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন চা মাস্টার। পান শেষ হওয়ার পর চাওয়ান ফিরিয়ে নিয়ে অন্য অতিথিকে চা দেন চা-মাস্টার।

আমাদের মতাে সবাই একসাথে চা পানের রীতি নেই জাপানি চা-পানের প্রথায়। জাপানিদের কাছে চা তৈরি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। জাপানিরা চা বানানােকে ধর্মানুষ্ঠানের মতাে সাধনা মনে করেন।

জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা বাড়িতে একবার জাপানি টি সেরিমনির আয়ােজন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন জাপান থেকে কবির কাছে আসতেন অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষ। তাঁদের জাপানি প্রথায় চা-পানে নিমন্ত্রণ করলেন কবি। সেই উপলক্ষে বিশেষ আকৃতির চায়ের সরঞ্জাম তৈরি করা হল। কাঠের চুলার বদলে দোতলায় কয়লার চুলির বিশেষ ব্যবস্থা হল। এখনও সেখানে কৃত্রিম কয়লার আগুন, কেটলি ও কাঠের তৈরি চামচ আর কয়েকটি মগ রাখা আছে। যে বিছানায় বসে অতিথিরা সময় কাটিয়েছিলেন সেই বিছানায় এখনও শােভা পাচ্ছে কবির সঙ্গে তােলা সেই বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি।

শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে কবির কোণার্ক বাড়ির লাল বারান্দাটি ছিল চায়ের আসরের জন্য বিখ্যাত। বহু গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য বহুবার এই বারান্দাতেই পাতা হয়েছিল চায়ের টেবিল। যেবার জওহরলাল সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে এলেন, উঠেছিলেন এই কোণার্ক বাড়িতে। লাল বারান্দাতেই বসল চায়ের আসর। একবার জাপান থেকে এক অতিথি দম্পতি এলেন আশ্রমে। শুরুদেবকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁরা জাপানি প্রথায় ‘টি সেরিমনি’র আয়ােজন করেছিলেন এই লাল বারান্দাতেই।

খুব সকালেই চা পান করতে অভ্যস্ত ছিলেন কবি। শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ যখন থাকতেন তখন খুব ভােরবেলা অন্ধকার থাকতেই উনুন ধরিয়ে কবির জন্য চা করে দিত কবিভৃত্য বনমালী। গুরুদেবের চা ছিল একটু অভিনব। কেটলি ভরা গরম জলে কয়েকটা চা-পাতা ফেলা হত, চায়ে রঙ সামান্য একটু ধরলেই পেয়ালার অর্ধেকটা সেই চা ঢেলে বাকি অর্ধেক দুধে ভর্তি করে নিতেন কবি। দু-চামচ চিনি দিতেন তাতে। চায়ের সঙ্গে আসত মাখন-পাউরুটি, একটু মুড়ি কিংবা আদার কুচি বা গুড় দিয়ে কল বেরােনাে ভিজে মুগ বা ছােলা, কোনওদিন বা একটা আধ সিদ্ধ ডিম।

এ-দেশি উজ্জ্বল সােনালি রঙের চা হলে তিনি তারিফ করতেন। আর পছন্দ করতেন চিন দেশ থেকে আনা শুকনাে বেল, যুঁই-এর চা। গরম জল পড়লেই শুকনাে ফুলের পাপড়িগুলাে খুলে যেত। একবার গুরুদেবের কাছে চিন দেশ থেকে এল গ্রিন টি। সেই চায়ের পাতার ওপর গরম জল ঢাললে চায়ের রঙ হত ফিকে হলুদ। সেই চা খুব পছন্দ হয়েছিল তাঁর।

রবীন্দ্রনাথের রসিকতা ছিল জগৎ বিখ্যাত। বনমালীকে নিয়েও তিনি রসিকতা করতে ছাড়তেন না। একবার অতিথি এসেছেন কবির কাছে। কবি বনমালীকে তাড়াতাড়ি চা করে আনতে বলেছেন। কিন্তু বনমালী আসতে দেরি হচ্ছে। কবি রসিকতা করে কপট বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বললেন, ‘চা-কর বটে, কিন্তু সু-কর নয়’।

কবির লেখা একটি গানের লাইনে আছে সব পথ এসে মিলে গেল শেষে। ঠাকুরবাড়ির নানা মানুষের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল শান্তিনিকেতন। তাই শান্তিনিকেতন হয়ে উঠল বাঙালির পীঠস্থান। দু-চার জন বাঙালি যেখানেই জড়াে হবে, সেখানেই শুরু হবে আড্ডা। শান্তিনিকেতনও তার ব্যতিক্রম নয়।

শান্তিনিকেতনে বিকেলবেলা কবির ঘরে চায়ের টেবিল ঘিরে অধ্যাপকদের আড্ডা বসত। কাঁচের বা সেরামিক কিংবা বােন চায়নার সূক্ষ কাজ করা টি সেট সাজানাে থাকত চায়ের টেবিলে। বেতের ঝুরিতে সাজানাে থাকত নানারকম ফল। থাকত মিষ্টিতে ভরা পাত্র। সে আড্ডায় অতিথিদের জন্য চায়ের সঙ্গে নানারকম বিস্কুট, কেক, মাখন পাউরুটি, নানারকম মিষ্টি, ফল ইত্যাদি পরিবেশিত হত।

একবার চিকিৎসাবিদ্যার গবেষক কলকাতার বসুবিজ্ঞান মন্দিরের সদস্য ডা. জ্যোতিপ্রসাদ সরকার এসেছেন শান্তিনিকেতনের বিকেলের চায়ের আসরে। কবির নির্দেশে বড় থালা ভর্তি শান্তিনিকেতন খ্যাত পান্তুয়া সাজিয়ে রাখা হল তাঁর সামনে। পান্তুয়া শেষ হতে দেরি হল না। জ্যোতিপ্রসাদ খেয়ে ভেবেছিলেন পান্তুয়াগুলি বুঝি ছানার তৈরি। পরে তাঁর ভুল ভাঙিয়ে দেন কবি নিজেই। সেই পান্তুয়াগুলি ছিল ওলের তৈরি।

কবি বিকেলে চায়ের সঙ্গে খেতেন মাখন-পাউরুটি। বিকেলের এই চায়ের আড়ায় মাঝে মাঝেই যেতেন ভােজন রসিক প্রমথনাথ বিশী । চায়ের আড়ায় চা খাওয়ার আগে কবি বেশ আয়েশ করে খেতেন কাঁচের গ্লাসে করে সােনার বর্ণ নিমপাতা সিদ্ধ জল। অধ্যাপকদের অনেকেই সেই নিমপাতার রসকে পেস্তার শরবত ভেবে ভুল করতেন। প্রমথনাথ বিশী এবং আচার্য ক্ষিতিমাহন সেন চায়ের আড্ডায় এসে পেস্তার শরবত ভেবে নিমপাতার রস খেয়ে বেজায় বিপদে পড়েছিলেন।

শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা কিন্তু যেমন তেমন চা মুখে তুলতেন না। বিদেশ থেকে আনানাে দামি কাপে পরিবেশিত হত দামি চা। তবে ব্যতিক্রমও ঘটেছিল। এবার সেই ব্যতিক্রমের কথাটি বলেই শেষ করি। সে গল্প শুনিয়েছেন জসীমউদ্দিন। জসীমউদ্দিন এককালে থাকতেন ঠাকুরবাড়িতেই। একবার পুঁথি কিনতে মেছুয়াবাজারের কোরবান আলী সাহেবের পুঁথির দোকানে গেছেন অবনীন্দ্রনাথ আর জসীমউদ্দিন। দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল অবনীন্দ্রনাথের গাড়ি। জোব্বা-পাজামা পরা সুন্দর দেখতে বাদশাজাদাকে দেখে দোকানি তাে অবাক। পরিচয় জানার পর দোকানি ব্যস্ত হয়ে মেদুয়াবাজারের এক চায়ের ঠেক থেকে মালাই চা আর পান এনে হাজির করল। ময়লা চায়ের কাপ দেখে জসীমউদ্দিন বললেন, ‘উনি এই চা খাবেন না।’ কিন্তু দোকানির আন্তরিকতা দেখে তাঁর সেই চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>